কান পেতে রই...
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
একটি কিশোরের আকাশবাণী
সুমিত রায়
আমি এখন যে দেশে থাকি সে দেশ সত্বর ব্যাপকভাবে পিশাচ-অধ্যুষিত হয়ে যেতে পারে, সম্প্রতি এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে প্রাবল্যে তা হবে কল্পনাতীত, মানে মানুষজাতি লোপ পেয়ে যেতে পারে, এরকম সন্দেহ করা হচ্ছে। সায়েবরা এর নাম দিচ্ছেন zombie apocalypse। বিশ্বাস হচ্ছে না? বারোই অক্টোবর টিভি খুলে দেখুন, লোকে কীভাবে এই মহামারীর মোকাবেলা করতে পারে, প্রচুর পয়সা খরচ করে টিভিওয়ালারা তার জনশিক্ষা প্রচার করছেন। কয়েকটা বইও ছাপা হয়েছে, কাটতি প্রচুর। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে টিভি সিরিয়াল মারফৎ জনগণকে তথ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।
আমি জীবনের প্রত্যন্তপ্রদেশে এসে পৌঁছেছি, আমার আজকের গেঁটে বাতের কামড়ের থেকে ওই পিশাচের কামড় আর কতোটাই বা বেশী যন্ত্রণা দেবে? তাই এ নিয়ে আমার উদ্বেগ খুব একটা বেশী নয়। তবে কিনা সারা জীবন অনাগত বিপদের জন্য প্রস্তুত হয়ে থেকেছি, এই তো "নৌকা ফিসন ডুবিছে ভীষণ, রেলে কলিশন হয়", সে কারণে মোটরগাড়ী আর এরোপ্লেন ছাড়া আর কিছুতে চাপি না, তাই ভাবলাম বইয়ের পাতা একটু উল্টে পাল্টে দেখে রাখি, কখন কাজে লেগে যায় কে বলতে পারে। জলের বোতল, ঠিক হ্যায়, মোমবাতি, নাতির জন্মদিনে কেকের ওপর দেবার জন্য এক বাক্স কেনা হয়েছিলো, তার কটাই বা খরচ হয়েছে, বুকে বল আনার কারণে কয়েকটি বোতলসুন্দরী তো চাইই, আর আমার বিপত্তারিণী গিন্নি তো থাকবেন। লিস্টিতে এমনি সব টিকের পর টিক মেরে চলেছি।
বিরাট হোঁচট খেয়ে থামতে হোলো রেডিওতে এসে, ব্যাটারীর রেডিও। কী সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, সারা বাড়ী খুঁজে কোনো রেডিও পাওয়া গেলো না, না ইলেক্ট্রিকের, না ব্যাটারীর। মনে পড়লো রিটায়ার করার পরেই অ্যালার্ম রেডিওটা সিঁড়ির ঘরে নির্বাসন দিয়েছিলাম, এই বছরই তার ব্যাটারী-অ্যাসিড জর্জরিত দেহ জঞ্জালের সঙ্গে বিসর্জন দিয়েছি। গাড়ীতে অবশ্য একটা রেডিও আছে, আজকাল বোধহয় আর চাইতেও হয়না, গাড়ী কিনলে এমনিতেই রেডিও পাওয়া যায়। কিন্তু বাইরে যখন পিশাচের তাণ্ডব চলেছে তখন কে গ্যারাজের ঝাঁপ খুলে রেডিও শুনতে যাবে। আমার এই একটা জীবনেই কতো প্রযুক্তি মরে ভূত হয়ে হারিয়ে গেলো-- গ্রামোফোন-রেকর্ড, রেকর্ড প্লেয়ার, টেপ রীল, এইট ট্র্যাক, ক্যাসেট টেপ, ভিএইচএস... ভাবলেও মাথা ঝিম ঝিম করে। তারই মধ্যে অভিমান করে কখন রেডিও আমার জীবন থেকে সরে গেছে। লিস্টি হাতে আস্তে আস্তে সিঁড়ির ওপর বসে পড়লাম। আরে না, পিশাচের ভয়ে নয়, স্মৃতিবিধুর হয়ে। এই রেডিওকেই তো আমার ছেলেবেলায় বলেছি আমার চিরসাথী, একসময় ছিলো যখন জেগে থাকার প্রতি মুহূর্তে কোথাও না কোথাও থেকে রেডিওর আওয়াজ আসতো কানে, না এলে চিমটি কেটে দেখতে হোতো বেঁচে আছি কিনা। বসে পড়লাম আর স্মৃতির পাপড়ি খুলে যেতে থাকলো। আস্তে আস্তে নয়, হুড়মুড় করে। ঝড়ে ওড়া পাতার মতো ছোটো ছোটো ছবির টুকরো আছড়ে পড়ে আর মন হয়ে যায় দিশাহারা।
একেবারে ছোটোবেলায় বাড়ীতে রেডিও ছিলো নিশ্চয় কিন্তু তার চেহারা মনে করতে পারিনা। তখন আমার দৌরাত্ম্য আর অপকীর্তির বয়েস, তবে মনে আছে মা প্রায় সবসময় রেডিওর সঙ্গে গুনগুন করতো, বিয়ের আগে ছোটো পিসি মাঝে মাঝে হার্মোনিয়াম নিয়ে রেডিও থেকে সা-রে-গা-মা শিখতো, ঠাকুরদা খবর শুনতে শুনতে "বুঝলে বৌমা এই বাঙালী জাতটাকে দিয়ে কিস্সু হবে না" বলে হাতপা ছুঁড়তেন। একটা চোঙা-লাগানো কলের গান ছিলো, তারই আকর্ষণ ছিলো বেশী, কেন তা মনে পড়ছে না। তারপর একদিন জ্যাঠামণি বিলেত থেকে ব্যারিস্টারী ডিগ্রী আর যক্ষ্মা রোগ নিয়ে ফিরলেন, ঠাকুরদাকে সর্বস্বান্ত করে যখন গেলেন তখন তাঁর সঙ্গে বসতবাড়ীটি গেলো আর আসবাবপত্রের মধ্যে লুকিয়ে কখন রেডিও আর কলের গানও চলে গেলো বুঝতেই পারলাম না। দাদা ফিরে এসে ছোটো ভাই, অর্থাৎ আমার বাবাকে ( বেঁচে থাকতে বাবা-ডাক অত্যন্ত অপছন্দ করতেন, বাবুজী, নাহলে অন্তত বাবু। অনেকদিন খুসী-অখুসীর ওপারে, তবু খুসী করার লোভ সামলাতে না পেরে এ রচনায় "বাবু"ই লিখবো) বিলেত পাঠাবেন এমন কথা ছিলো, তার দফা তো সেখানেই রফা। বাবু নামলেন যুদ্ধশেষের মন্দা চাকরীর বাজারে, মানে নামতে হোলো। ঠাকুরদা তখন রিটায়ার করেছেন। আমি অবশ্য এতোসব বুঝি না, রেডিওর চেয়ে বেশী মিস করি কলের গান, তার চেয়েও বেশী পুরোনা পাড়ার বন্ধুদের। মায়ের গুনগুন একেবারেই নেই, নিশ্চয় রেডিও না থাকার দুঃখে। আমি এর বেশী বুঝি না, বোঝার বুদ্ধি আমার নেই।
একদিন ঠাকুরদা সাত সকালে উঠে আমাকে না নিয়েই মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে গেছেন। স্কুলে যাওযার সময় অবধি ফেরেন নি, মাকে নিশ্চয় বলে গেছেন, মাকে খুব উদ্বিগ্ন দেখলাম না। মা বাবু দুজনেরই খুসীখুসী ভাব। রহস্যাতুর হয়ে স্কুলে গেলাম, ফিরে দেখি শোবার ঘরে এক প্রমাণ সাইজের রেডিও শোভা পাচ্ছে। পুরোনো রেডিওটার যেমন ঘরের কুলুঙ্গীর মতো চেহারা ছিলো তেমন নয়, চৌকো, নানা রকম প্লাস্টিকের শোভা, বোতাম, নব্, লালনীল আলো -- খুব কায়দার ব্যাপার। ব্র্যাণ্ড বা মডেল ইন্ভিক্টা, মনে থাকার কোনো কথাই নয়, তবু এখনো মনে আছে। ব্যাপার হোলো এই, কয়েক ঘাটে জল খাবার পর বাবুর অল ইণ্ডিয়া রেডিওর কোলকাতা স্টেশনে প্রোগ্রাম ডিরেক্টরের চাকরী হয়েছে, জানা গেছে এই গতকাল রাত্রেই। পুত্রগর্বে গর্বিত বুড়ো কর্তার আর ত্বর সয়নি, সাত সকালে বেরিয়ে বাজার ঘুরে সবচেয়ে দামী যে রেডিও পেয়েছেন তাই কিনে এনেছেন, ছেলের পার্ফর্মেন্স শুনবেন আর শোনাবেন, সেকি সস্তার জাপানী মালে হয়! আংটিটি বোধহয় বাঁধা পড়লো। পাড়ার নিকট প্রতিবেশীদের মিষ্টি বিলোনো হোলো, ইভনিং ওয়াকের সাথীরা বাদ গেলেন না। তখনকার দিনে মানে আমার ঠাকুরদার বয়সী লোকেরা জীবিত থাকার কালে এসব হোতো।
আকাশবাণী এবার আমাদের জীবনে শুধু বিনোদিনী নয়, অন্নদাত্রীর ভূমিকায় ঢুকে গেলো। অনেক দিনের জন্য নয় তবে বেশ কিছু দিন বলা যেতে পারে। বাড়ীর ভেতর এরিয়েল খাটিয়ে রেডিওর আওয়াজ তেমন জোরদার হয় না, তাই বাড়ী বদল করা হোলো। পাড়ার নেপেন মিস্তিরি এসে ছাতে দুই বিশাল বাঁশ বসিয়ে ভিজে কাপড় শুকোবার নাগালের বাইরে উঁচুতে তার খাটালেন। লেসের ঝালর দেওয়া চাদর গায়ে জড়িয়ে, এরিয়েলে টিকি বেঁধে ইন্ভিক্টা রেডিও বড়ো ঘরের টেবিলে তুলসীমোড়া শালগ্রামের মতো স্থাপন হলেন। বোতাম টিপে, নব্ ঘুরিয়ে নেপেনদা ঠিকঠাক করে কাঁটা লাগিয়ে গেলেন, ইন্ভিক্টার জীবদ্দশায় সে কাঁটা সরেছে বলে মনে পড়েনা। ময়রা নিজের মিষ্টি খায় না, বাবুকে রেডিওর ধারে কাছে যেতে দেখিনি। মা রেডিও শুনতেন ঠিকই, ভালো লাগা গান গুনগুনও করতেন, রেডিওর চালু-বন্ধ তো তাঁরই হাতে, তবে সংসার সামলে রেডিওর সামনে বসে শোনা তাঁর আর হয়ে উঠতো না বললেই চলে। ঠাকুরদা আড্ডাবাজ লোক, সকাল সন্ধ্যে বেড়াবার আড্ডাধারী, গুরুদেবের মঠে এক জমাট আড্ডা ছিলো, এদিক ওদিক কীর্তনের আসরে যেতেন, দিবানিদ্রার আগে আর পরে দুটি খবরের কাগজ আদ্যোপান্ত পড়ার অভ্যেস ছিলো, কাজেই তিনি রেডিওগতপ্রাণ ছিলেন বলা যায় না। শোবার আগে একটা খবর নিশ্চিত করে শুনতেন -- সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় বাংলা খবর পড়তেন বেচু বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতি দাস, জয়ন্ত চৌধুরী বা নীলিমা সান্যাল, আর একটু পরে (রাত নটা কি?) ইংরেজীতে মেলভিল ডিমেলো। পরে হিন্দি খবরও হোতো, পড়তেন দেওকিনন্দন পাণ্ডে, তবে তা দেখে যাবার কষ্ট আমার ঠাকুর্দাকে সইতে হয়নি। ঠাকুর্দা আবার এসব ব্যাপারে খুব কট্টরপন্থী ছিলেন। কীর্তন বা শ্যামাসঙ্গীত হলে শুনতেন, চেনা গান হলে ভাঙা গলা মেলানোও শুনেছি। সেসময় পালাকীর্তনের খুব চলন ছিলো, নবদ্বীপচন্দ্র, রাধারানী, রথীন ঘোষ, ময়নাডল, আরো অনেক জাঁদরেল দল, তারপর কীর্তন গানই তো কোথায় হারিয়ে গেলো। আর ছেলের কিছু প্রোগ্রাম থাকলে তা শুনতেন, অবশ্য রাত নটার পরে হলে নয়। একবারই ব্যতিক্রম, সেটা উনিশশো সাতচল্লিশ সালের পনেরোই অগাস্ট রাত্রে। সেসময়ে রেডিওর নৈশ অধিবেশন শেষ হোতো এক চমৎকার শুভেচ্ছাবাণী দিয়ে-- স্থলচর, জলচর, খেচর, সব মানুষই ভালো থাকুন, নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরুন, এইরকম একটা কিছু। পনেরোই অগাস্ট আমরা স্বাধীন হলাম, রাত বারোটার সময় পণ্ডিত নেহরু তাঁর চিরখ্যাত Tryst with Destiny কথিকা বললেন। আমার ঠাকুরদা জোর করে জেগে থেকে তা শুনলেন। সেই রাত্রে বাবুর ভার ছিলো স্টেশনের ওই শুভরাত্রি বলবার, সেটাও শুনলেন, তারপর শুতে গেলেন। তারপর তাঁর সারা জীবনের ধ্যান আর সাধনার সিদ্ধি লাভ করে ভারতবর্ষের স্বাধীন নাগরিক হয়ে ভোরের দিকে মারা গেলেন।
রেডিও চলতো বটে ভবানীপুর চক্রেবেড়ে রোডে, আমার মামারবাড়ীতে। দাদামশায় বাতে ভুগতেন, বাড়ী থেকে বেরোতে পারতেন না। বয়েসকালে কালোয়াৎ ছিলেন, গান শুনতেন, বুঝতেন। এদিকে আমরা যখন দেখছি তখন চোখে ছানি পড়ে তাঁর দৃষ্টি ক্ষীণ -- একেবারে তেরোস্পর্শ, রেডিও ছাড়া গতি নেই। বড়ো ঘরে একটা পুরোনো আমলের রেডিও থাকতো, বৃদ্ধ তারই কাছাকাছি বাতে সেঁক দেবার গরম জলের বোতল বাগিয়ে বসে থাকতেন। আমি আর ছোটোমামা প্রায় একবয়সী, মামারবাড়ীতে আমার প্রচুর যাতায়াত। দাদামশায় আবার চমৎকার গল্প বলতেন, তাঁর জীবনে গল্পের উপাদান ছিলো অনেক। আমরা তাই অনেক সময় কাটিয়েছি তাঁর কাছে বসে, গল্প শোনার ফাঁকে ফাঁকে রেডিও শোনা হয়েছে অনেক, দাদামশায়ের সমন্তব্য। সেদিন বুঝিনি কিন্ত আজ বুঝি যে রেডিওকে পটভূমিকায় রেখে দাদামশায় অনেক কিছু আমাদের শিখিয়েছিলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে চালাকি যেটায় সেটা হোলো ছেলেবয়সের অগভীর কৌতূহলকে ফালতু নষ্ট হতে না দিয়ে দক্ষভাবে চালিয়ে বিষয়ের গভীরে নিয়ে গিয়ে সে কৌতূহল নিবৃত্ত করা। বড়োমামাও ছিলেন গানের সমঝদার, ওস্তাদী গানের চর্চা করতেন। তখন একটা সাপ্তাহিক (না কি পাক্ষিক?) বার হোতো, বেতার জগৎ, তাতে থাকতো কোলকাতা রেডিওর দৈনিক প্রোগ্রামের বিশদ তালিকা, হাতে পাবার সঙ্গে সঙ্গে মামা লাল কালি দিয়ে অবশ্যশ্রোতব্য প্রোগ্রাম বেছে দাগ দিয়ে রাখতেন। আমরা সেসবও শুনতাম, মেজাজ ভালো থাকলে বড়োমামা টিকা কাটতেন। ওস্তাদী গান শেখা আর গাওয়া আমার আর হোলো না বটে কিন্তু একসময় অন্তত চলনসই সমঝদার বলে গর্ব ছিলো, সেখানেও বড়োমামা মারফৎ পাওয়া রেডিওর একটি দান আছে এ মানতেই হবে।
সারাদিনের রেডিও প্রোগ্রাম শুরু হবার আগে একটা খুব ছোটো বাঁশির সুর ঘুরে ফিরে বাজতো (এইখানে ক্লিক করে শুনতে পারেন, যদিও শব্দের কোয়ালিটি খুব একটা ভালো নয়, অনেকদিনের পুরোনো তো), লোকে বলতো AIR Signature Tune। কতোদিন আধোঘুমে আধোজাগরণে শুনে শুনে মনে একেবারে গেঁথে বসে গেছে, এখনো চোখ বন্ধ করে ছয় দশক আগের সুর সঠিক শুনতে পাই। সেই বয়সে প্রতিটি দিনই কিশোর মনে আসতো অনেক নতুন আনন্দের প্রতিশ্রুতি নিয়ে, কিন্তু যেদিন এই বাজনা শুনে উঠতাম সেদিন যেন আরো ভালো কাটবে বলে মনে হোতো। বোধহয় সকাল সকাল উঠে বেশী মজা কাড়ার সময় পাওয়া যাবে বলে। পরে মৃণাল সেন তাঁর কোনো ছবিতে এই সুরটি ব্যবহার করেছিলেন। তখন যা জানতাম না এখন ইন্টারনেট থেকে জানছি এর সুরকার ছিলেন জন ফাউল্ড্স্, এতে বেজেছে বেহালা, ভায়োলা, চেল্লো আর তানপুরা। আট সেকেণ্ড বাজনা, দশ সেকেণ্ড তানপুরা দিয়ে বিরতি, আবার আট সেকেণ্ড, এই রকম। জয় ফাউল্ড্স্ সায়েব!
কী শুনতাম? সুশৃঙ্খলভাবে মনে আসছে না, আসছে এলোমেলো। তাই বলি। কোলকাতা স্টেশনের দুটো চ্যানেল ছিলো, 'ক' আর 'খ'। আমার যতোদূর স্মরণে আসছে, আমরা বরাবর কোলকাতা 'ক'-ই শুনতাম, এবাড়ী-ওবাড়ী কোথাও কখনো 'খ'-চ্যানেল খোলা হোতো না, যদিও 'খ'-চ্যানেলে বেশ ভালো গানের অনুষ্ঠান থাকতো বলে শুনেছি। কেন এই অবহেলা তা নিয়ে তখন কিছু মনে হয় নি, এখন জানতে ইচ্ছে হয়। এক হতে পারে রিসেপশন ভালো আসতো না, দুই 'ক'-চ্যানেলের প্রোগ্রাম সবসময়েই বেশী মনোরঞ্জক, তিন, 'খ'-চ্যানেলে ইংরেজী প্রোগ্রাম বেশী হোতো আর তখন আমাদের ইংরেজী শুনলেই গায়ে জ্বর আসতো আর চার, আর কিছু না হয় রেডিওর কাঁটা ঘোরাতে হবে, আঃ আবার সুস্থ প্রাণ কেন ব্যস্ত করা। শ্রমবিমুখ বলে বাঙালীর তো বরাবরই একটু সুনাম আছে।
দিনে তিনটে অধিবেশন, সকালে ঘণ্টা দুই, তারপর লম্বা ফাঁক, দুপুরে ঘণ্টা দুই, ফাঁক, বিকেল-সন্ধ্যে-রাত্রিতে অনেকক্ষণ, প্রায় পাঁচ-ছ ঘণ্টা। রবিবারেও সেই তিনটে অধিবেশন, কিন্তু বিশেষ ব্যতিক্রম, ফাঁক ছোটো, অধিবেশন বড়ো। অনেক গান, প্রায় সবরকমের গান-- সে ভজন, কীর্তন থেকে পল্লীগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, রাগপ্রধান, অবশ্যই আধুনিক। মাঝে মধ্যে কবির গান-টানের বিশেষ পরিবেশনা হোতো, সরকারী সংস্থা তো, তাই তা তরজা বা খেউড় পর্যন্ত গড়াতে পারতো না। হলে ভালো হোতো, উঠতি বয়সে মাতৃভাষা শিক্ষায় কাজে লাগতো। ওস্তাদী বা মার্গসঙ্গীত পর্যায়ের গানে খেয়াল-ঠুংরী তো বটেই, ধ্রুপদও চলতো মাঝেমধ্যে, আর বাজনায় সরোদ-সেতার-বাঁশী-বেহালা এমনকি মহম্মদ দবীর খানের রুদ্রবীণা। এর ওপর সোনায় সোহাগা, রেডিওর দিকপাল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, জ্ঞানবাবু এআইআর লাইট মিউজিক, রম্যগীতি নাম দিয়ে এক দুর্ধর্ষ প্রোগ্রাম চালু করেছিলেন, তার অনেক গানই জ্ঞানবাবুর নিজের সৃষ্টি, অনবদ্য। মনে পড়ছে বেশীর ভাগ আর্টিস্টই একদিনে একাধিকবার প্রোগ্রাম করতেন, যেমন সকালে ছোটে খেয়াল, সন্ধ্যেয় ঠূংরী, রাত্রে খেয়াল -- প্রথমবার ধরা না গেলে পরে শোনা যাবে। প্রকাশ্যে বা লুকিয়ে টেপ করে রেখে দেবার ব্যবস্থা ছিলো না তো, কাজেই পাইরেসির কথা তুললে আমরা ধোয়া তুলসীপাতা। বেশীর ভাগ সময়ে কোন প্রোগ্রামে কী রাগ পরিবেশন করা হবে তা বেতার জগতে লেখা থাকতো, তাতে আমার বড়োমামার ভারী উল্লাস। খ্যাতনামা অনেক শিল্পী গাইতেন বা বাজাতেন, কেউ কম কেউ বেশী। যেমন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে খুব একটা দেখা যেতো বলে মনে পড়ছে না। এক এক দফার প্রোগ্রাম পনেরো মিনিট, কখনো কুড়ি, ওস্তাদী হলে পরে আধঘণ্টা থেকে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর্যন্ত হতে পারতো। লাইভ অনুষ্ঠানের মধ্যে মধ্যে পাঁচমিনিটের ফাঁক ভরা থাকতো গ্রামোফোন রেকর্ডের গান দিয়ে। আরো কম সময় ভরাতে হলে বাজনা-- তিমিরবরণের পরিচালিত অর্কেস্ট্রা বা সুজিত নাথের বেহালা-- বৃদ্ধ বয়সের মন, নীরং ত্যক্ত্বা ক্ষীরং, পুরোটা না হলেও ঝলকে ঝলকে মনে আসে।
দুপুরের অধিবেশনটা মাঠেই মারা যেতো, ইস্কুল ছিলো, সকালে পড়া শেষ করা, ইস্কুলে যাবার জন্য তৈরী হওয়া, সময় কোথায়। তৃতীয় অধিবেশনটা কাজে লাগতো। দাদামশায় 'পল্লীমঙ্গল আসর' শুনতেন, তার মাতব্বর অবশ্যই মোড়ল, চ্যালা কাশীনাথ আর কৌতুকের খোরাক জোগাতেন ছিরিগোবিন্দদা, তাঁর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু চাষাড়ে, না থাকলে পল্লীই বা হবে কেন আর তার মঙ্গলই বা হবে কী করে? আসরের কল্যাণে হুঁকোর জল দিয়ে কপিপাতার পোকা ছাড়ানোর কথা জেনেছি, আখেরে কী লাভ হোলো তার হিসেব রাখিনি। এমনটা যে হতে পারে, সে বয়সে এটা জানাটাও কম নয়। শুনতেন 'মজদুর মণ্ডলী'ও, তার কথা মনে নেই কিছু। শনি-রবি দুদিন দুপুরের 'অনুরোধের আসর'-এর নাম ছিলো খুব, 'অনুরোধের আসর' কথাটাই তো আজ প্রায় প্রবাদে দাঁড়িয়ে গেছে। শ্রোতারা ডাকযোগে অনুরোধ জানাতেন আর সেই মাফিক রেকর্ড বাজানো হোতো, তবে মাঝে মাঝেই কিছু এমন উটকো গান বাজানো হোতো যে তার অনুরোধের উৎস নিয়ে আমাদের জল্পনার অন্ত ছিলো না। বাবুকে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি, মুচকি হেসে এড়িয়ে যেতেন। গোড়ায় অনুরোধকারীদের নাম বলা হোতো না, তজ্জনিত মাৎস্যন্যায় আর প্রজাবিদ্রোহের আশঙ্কায় পরে কোথা থেকে কারা শুনতে চেয়েছেন জানিয়ে এটিকে কব্জায় আনার চেষ্টা করা হয়। তাতে উটকো গান কমেছিলো নিশ্চয়, কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়েছিলো বলা যায় না। যাই হোক, ভিক্ষার চাল, কাঁড়া বা আকাঁড়া।
রবিবার সকালে পঙ্কজ মল্লিক চালাতেন 'সঙ্গীতশিক্ষার আসর'। আমি শুনে শুনে শেখার চেষ্টা করতাম, অনেক গান তুলেও ছিলাম। তবে বন্ধুদের বলা যেতো না, আমাদের দলে সঙ্গীতশিক্ষার আসরকে তামাসার ব্যাপার বলে ধরা হোতো, বোধহয় মল্লিক মশায়ের শেখাবার ভঙ্গীর কারণে। নিছক গান শেখানোর ব্যাপারটা মোটেই চিত্তাকর্ষক হবে না তাই সে আসরে একটু আধটু নাটক জুড়ে জীবন্ত করার চেষ্টা করা হোতো। পঙ্কজ শেখাতেন, সামনে তাঁর ছাত্রগোষ্ঠী, আমরা দেখতে পাচ্ছি না, নাটকের খাতিরে তাদের অ-সুরত্বের মাত্রা বেশ ওজন করে সাজানো, তারা তাদের মূর্খতার অনুসারে অনর্গল ভুল করে যাচ্ছে, মল্লিকমশায় ঠিক করে দিচ্ছেন, কখনো প্রসন্ন কখনো অপ্রসন্ন, কিন্তু প্রায় সবসময় সুরে আর তালে। মনে পড়ছে একজন খুব বকুনি খেতেন, পরে জেনেছি তিনি ছিলেন পঙ্কজের ছোটো ভাই অম্বুজ, ভালো গাইয়ে। "আঃ, 'আমারে তুমি অশেষ করেছো', অহশেহেএস, পাওমাপাধানিসা, বলো পাওমাপাধানিসা"। অনেক রবীন্দ্রসঙ্গীত -- তখনও পঙ্কজ মল্লিকের রবীন্দ্রসঙ্গীত জনপ্রিয়তার ওপরের দিকে-- 'ইয়ে রাতে, ইয়ে মৌসম, ইয়ে হসনা-হসানা', 'গানখানি মোরা রেখে যাবো', 'তেরা মন্দিরকা হুঁ দীপক', ...। স্মৃতি সততই সুখের।
আসল মজা হোতো শুক্রবার সন্ধ্যেয়, পৌনে আটটা থেকে সাড়ে আটটা বা ওর কাছাকাছি সময়ে। সে ছিলো বেতারে সাপ্তাহিক নাটকের সময়। অসাধারণ জনপ্রিয় ছিলো এই প্রোগ্রাম, বহুদিন ধরে প্রযোজকগোষ্ঠীতে প্রথম যে নামটি মনে আসতো সেটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অবশ্যই তাঁর সুযোগ্য সহকর্মী ছিলেন অনেক-- বাণীকুমার, শ্রীধর ভট্টাচর্য, অতুল মুখার্জি, জয়ন্ত চৌধুরী আদি। যোগদান করতেন সেকালের সব তাবড় তাবড় শিল্পী, মঞ্চ আর চিত্র, দুই জগৎ থেকেই। মামার বাড়ীতে এই নাটকের জমায়েতটা ছিলো দেখার মতো। চা-জলখাবারের পাট সারা, গিন্নিরা রান্নাবান্না সেরে, গা ধুয়ে চুল বেঁধে তৈরী, ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরেই হোমওয়ার্ক সেরেছে। সাড়ে সাতটা নাগাদ দাদামশায় বসতেন এক বাহারী চেয়ারে, একেবারে রেডিওর সামনে। মামারবাড়ীতে বহুদিনের ভাড়াটে ছিলেন তিন ঘর, এক পরিবারের মতোই থাকতেন সবাই, তাঁদের প্রায় সবাই এক এক করে এসে জুটতেন, সে বুড়ো কর্তা থেকে নতুন বৌ অবধি। তখন বয়সের মাপে লোককে সম্মান দেওয়া হোতো, ভাড়াটে দাদুরা চেয়ারে বসতেন সামনেই, দাদামশায়ের আশেপাশে, তার পেছনে মোড়ায় বড়োমামা আর তাঁর বন্ধুরা, তারপর মাদুরে দিদিমা ক্লাসের বুড়ীর দল, বাড়ীর মেয়েরা, সব শেষে বউদের দল। আমরা এণ্ডিগেণ্ডিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তখন সুইসাইড বম্বারের চল হয়নি এই রক্ষে, নাহলে সেসময় এখানে একটি বোমাতেই অর্ধেক ভবানীপুর খতম হয়ে যেতো। অবশ্য বলা যায় না, সেও যে সবার মতো হাঁ করে নাটক শুনতে বসে যেতো না তা কে বলতে পারে। নাটক শুরু হবার আগে পর্যন্ত আলোচনা চলতো, তাকে নাটকের প্রস্তুতি বলা যায়, জুড়ীর বা বিবেকের গানের মতো। দাদামশায় শান্তিরক্ষা করতেন। একবার নাটক শুরু হলে চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট কবরের নীরবতা, তারপর নাটক শেষ হলে কলধ্বনি উঠতো, ফ্রী-ফর-অল, ডেসিবেল মাপলে তা মোহনবাগান গোল দেবার কাছাকাছি যেতে পারে। সবাই নাটক শুনেছে, প্রত্যেকেরই মতামত আছে, আছে তা প্রকাশ করবার অধিকার। প্রথম উচ্ছ্বাসটা কমলে শুরু হোতো নাটকের ব্যবচ্ছেদ, অক্ষরে অক্ষরে, শ্বাসে শ্বাসে। তা সে তুমি যতো বড়ো অভিনেতা হও, যতো বড়ো পরিচালক, যতো বড়ো নাট্যকার-- চক্রবেড়ের এই রসগ্রাহী দর্শকদের নির্মম সমালোচনা থেকে মুক্তি নেই। সমালোচনার মর্ম বুঝতে আমার দেরী হয়েছে অনেক কিন্তু উষ্ণতাটা মর্মে লেগেছে গোড়া থেকেই। এদেশে পুরোনো পাড়ায় একসময় আমেরিকান ফুটবলের সেরা খেলা সুপার বোল দেখতাম প্রতিবেশীদের সঙ্গে, অনেকটা তার মতো, যদিও সায়েবরা গলাবাজিতে চক্রবেড়ের কাছাকাছিও আসতে পারে না। গন উইথ দি উইণ্ড, কোথায় যে চলে গেলো সে সব লোকেরা!
এই পর্যন্ত লিখে যখন বিশেষ বিষণ্ণ বোধ করছি তখন হঠাৎই গুগ্ল সার্চে 'বেতার জগৎ' লাগিয়ে ফেললাম। যা উঠলো তার একেবারে ওপরের দিকেই একটু নেড়েচেড়ে যা পেলাম তা অমূল্য। কোথায় না কোথায়, জার্মানীর হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির মহাফেজখানায় রয়েছে ১৯৫৭ জুন মাসের বেতার জগতের পিডিএফ কপি, ভল্যুম ২৮, সংখ্যা ১২! এ হচ্ছে এক্কেবারে যখনকার কথা আমি বলছি তখনকার, এ তালিকার সব শিল্পীরা আমার চেনা, এঁদেরই গান, নাটক, আলোচনা শুনে আমি বড়ো হয়েছি। বড়োমামার দাগানো লাল পেন্সিলের লেখাও যেন ফিকে হয়ে দেখা যাচ্ছে। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে চার কপি বেতার জগৎ আছে বলে জানা যাচ্ছে তবে তার প্রতিলিপি পাবার কোনো উপায় দেখি না। আমাদের 'অবসরের' দীপক সেনগুপ্ত মশায়কে তাঁর মধুসূদনদাদার দইয়ের ভাঁড়ে একটু খুঁজতে অনুরোধ করি। তা বেতার জগতে তো কোলকাতা বটেই, তা ছাড়া দিল্লী, পাটনা, কটক, গৌহাটি রেডিওর নির্ঘণ্টও থাকতো। আগেই বলেছি আমার রেডিওপ্রীতির কালে কখনো কাঁটা সেই কোলকাতা ক থেকে ঘোরাইনি, ঘুরতেও দেখিনি। তবে এ ব্যাপারে চোস্ত ছিলো আমার ছোটো বোন, সে ছিলো হিন্দি আর ইংরেজী গানের শ্রোতা, সে রেডিওর দখল নেবার পর থেকে কাঁটার ঘূর্ণী আর থামতো না, রেডিও সিলোন তো বটেই আরো কোথায় কোথায় ঘুরতো তার ঠিকানা জানিনে। যাইহোক, রেডিওর প্রোগ্রাম ছাড়াও বেতার জগতের গোড়ার কিছু পাতায় গল্প-প্রবন্ধ-কবিতা ছাপা হোতো। আমার বাড়ীতে ঠোঙাও পাঠ্য বিবেচিত হোতো, কাজেই আমরা সেসব লেখা পড়েছি, ভালোই। কোনো একসময় থেকে বেতার জগতের শারদীয়া সংখ্যা বার হওয়া শুরু হোলো বলে মনে পড়ছে। এখন দেখছি সম্প্রতি বেতার জগতে প্রকাশিত গল্প আর প্রবন্ধসংগ্রহ ছাপা হয়েছে। ইন্টারনেটে পাওয়া উৎস বেতার জগৎ থেকে এক রবিবারের প্রোগ্রাম দিলাম, কৌতূহলী পাঠক প্রোগ্রাম কেমন হোতো তার আঁচ পাবেন। পুরো পিডিএফ ফাইলটা দেখতে চাইলে এইখানে ক্লিক করে পেতে পারেন।
+ = গ্রামোফোন রেকর্ড
এর মধ্যে একদিন অকস্মাৎ বেতারশিল্পী বনে গেলাম। না ঠিক অকস্মাৎ নয়, স্বজনপোষণের ব্যাপার আছে। মাঝে মাঝে স্কুল ছুটির দিনে ফরসা শার্ট প্যাণ্টের মধ্যে গুঁজে, চুল আঁচড়ে, জুতোয় ফিতে বেঁধে বাবুর সঙ্গে বেতার ভবন যেতাম, ঘণ্টা দুতিন থাকার পর ঠাকুরদা সে পাড়ায় পেনসন তুলতে এসে তাঁর রিটায়ার্ড সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা মেরে ফেরৎ যাবার সময় আমায় তুলে নিয়ে যেতেন। আমার তখন কিছুই বোঝার বয়েস হয়নি, তবে যেতে ভালো লাগতো, কতো লোক, আসছেন যাচ্ছেন, হৈ হৈ হাসির হররা, বাজনার ঝঙ্কার। কাকুরা ছোটো ছোটো টুর দিতেন, চলো কী করে স্টুডিয়ো রেকর্ড হয় দেখিয়ে আনি। ছাতে যাবার দরজার ঠিক ওপরে ঝুলছে একটা হাতল দেওয়া টিনের পাত, সেটা ঝাঁকালে হয় মেঘের ডাক, ডাম্বেল গড়ালে কি হয় ভুলে গেছি। একজন কাকু (অজিত চট্টোপাধ্যায় কি?) হরবোলা, মুখে কুকুরের ডাক থেকে হাঁস উড়ে যাওয়া, সেতার বাজনা, কতোরকমের মজার আওয়াজ করে দেখাতেন। রেডিয়ো আর বাংলাদেশের বিনোদন জগতের তাবড় তাবড় কতো লোককে দেখেছি, সব এখন ধোঁয়াটে, কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ কুয়াশা ভেদ করে দুয়েকজন মানুষ আর দুয়েকটা কথার টুকরো ঝিলিক দিয়ে যায়। আর মনে পড়ে যে সেখানকার পরিবেশ মোটেই আপিসে যেমনটি শুনেছি, সবাই একেবারে চুপচাপ, ভীষণ গম্ভীর মুখে পৃথিবী উদ্ধার করে যাচ্ছেন, তেমনটি নয়, এখানে খালি হাসিগল্প, গানবাজনা, চেঁচামেচি। দেখলে মনে হয় সকলেই এইসময় এইখানে থাকতে পেরে ভারী খুসি, তাঁরা অন্য কোথাও যেতে চান না। এর কারণ বোঝা সহজ, সেখানে যাঁরা আসতেন বা থাকতেন তাঁদের বেশীর ভাগই শিল্পী বা রেডিওর প্রোগ্রামের সঙ্গে জড়িত, মানুষকে আনন্দ দেওয়া তাঁদের পেশা, তাঁদের আনন্দময় হয়ে থাকাটাই স্বাভাবিক। প্রদীপের নীচে অন্ধকারও নিশ্চয় থাকতো কিন্তু আমার মতো ফালতু দর্শকের তা নজরে পড়ার কথা নয়।
এমনই এক ঝিলিক একদিন। এক সুন্দরী মহিলা, আমার মতে তিনি স্বচ্ছন্দে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হতে পারেন, রোগাসোগা, ভীষণ ফরসা, বব করা চুল, গায়ে চিকন সাদা শাল, বাঁশির মতো গলায় বাবুকে বললেন, "ওমা, বিকাশবাবু, আপনার এই রত্নটিকে এতোদিন কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, আমার কিন্তু ওকে চাই।" আমি উদ্ধারের কোনো আশা নেই জেনেও ঝপাস করে প্রেমে পড়ে গেলাম। বাবুর উত্তর, "আপনার কাছ থেকে কি লুকোবার উপায় আছে। আচ্ছা, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।" আমাকে বললেন, "ইনি কে জানো, ইনি শিশুমহলের ইন্দিরাদি, তোমাকে শিশুমহলে নিতে চাইছেন।" হায় কপাল, প্রতি রবিবার সকাল নটায় সব বদমায়েসি ছেড়ে যা শোনার জন্য হাঁ করে বসে থাকতাম, "ছোট্টো সোনা বন্ধুরা ভাই, আমার আদর আর ভালোবাসা নিও। তোমরা সব ভালো আছো তো?" আর একঝাঁক পাখীর কাকলি, "হ্যাঁ-আ-আ-আ।" সেই গলার স্বর চিনতে পারলাম না? যাই হোক, আমি শিশুমহলের নিয়মিত আর্টিস্ট হয়ে গেলাম। প্রথমে জনতার রোল থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে "বাবুরাম সাপুড়ে" বা "বীরপুরুষ" আবৃত্তিতে প্রোমোশন পেয়েছিলাম মনে পড়ে। শিশুমহলে অনেকবার গেছি, রবিবার বাবুর ছুটির ব্যাঘাত যাতে না হয় তাই ঠাকুরদা নিয়ে যেতেন, ফেরার পথে গ্রেট ইস্টার্ণের পেস্ট্রি আর প্যাটিস বকশিস। এরমধ্যে একদিন বাবু এসে একটা পাঁচটাকার নোট ধরিয়ে বললেন, "যাও দাদাভাইকে প্রণাম করে টাকাটা মার হাতে দিয়ে দাও, এটা শিশুমহলে কাজ করেছো বলে তোমার মাইনে।" আমার টাকা না পেলেও চলতো, ইন্দিরাদিকে দেখতে পাচ্ছি, তাতেই আমার স্বর্গলাভ তবু চল্লিশের দশকে পাঁচ টাকা অনেক টাকা, আমার বুদ্ধির বাইরে, তবে বিকেলে পার্কে খেলতে গিয়ে গলাবাজি করার লোভ সামলাতে পারলাম না, কেউ পাত্তা দিলো বলে মনে হয় না।
আমি শিশুমহল্লাদার থাকতে থাকতে বাবু রেডিওর কাজ ছেড়ে অন্য কর্মক্ষেত্রে চলে গেলেন। যেমন হয়, প্রথমদিকে প্রায়ই রেডিওতে যেতেন নিছক আড্ডা দিতে, পরে তা কমে এলেও মাঝে মাঝে রেডিওতে তাঁর নাটক করার ডাক পড়তো, যেতেনও। এদিকে আমার বুকে শেল হেনে ইন্দিরাদি একদিন আমাকে বদলি করে দিলেন "গল্পদাদুর আসরে", এদেশে যাকে বলে প্লেয়ার ট্রেড। ভালোই করলেন, তখন ইস্কুলে যাচ্ছি, ওই কিচিরমিচিরদের দলে থাকার কথা সহপাঠীরা জানতে পারলে অতি বেইজ্জৎ। আসর বসতো সপ্তাহের কোনো একদিন, বৃহস্পতিবার হবে বোধহয়, বিকেল পাঁচটায়। যতোদূর মনে পড়ে, প্রথমদিকে গল্পদাদু ছিলেন অখিলজ্যেঠু বলে একজন, তখনকার দিনে স্বপনবুড়ো ছদ্মনামে খ্যাত অখিল নিয়োগী হতে পারেন। পরে গল্পদাদু হলেন জয়ন্ত চৌধুরী। ইনি ছিলেন অল ইণ্ডিয়া রেডিওর স্টাফ, প্রোগ্রাম ডিরেক্টর আর নিজে বেশ কিছু সংখ্যক জনপ্রিয় প্রোগ্রামে অংশ নিতেন -- বাংলা খবর পড়া ছিলো তার একটি। ফর্সা ছোটো খাটো মানুষ, আমার মনে আছে গরদ গোছের পাঞ্জাবী, পকেটে কোঁচা, পান-খাওয়া হাসি-হাসি মুখ, অতি অমায়িক লোক। যাই হোক, গল্পদাদুর আসরে সাধারণত কী ঘটতো তা আর মনে পড়ে না, তবে বয়ঃসন্ধির কালে আমি একবার হোঁচট খেয়েছিলাম তা মনে পড়ে। আমরা যখন ছোটো তখন থেকেই আমাদের বয়সী একটি ফুটফুটে মেয়ে ফ্রক পরে মাথায় ফিতে বেঁধে বাংলা সিনেমায় খুকীর পার্ট করতেন, প্রায় একেশ্বরী বলা যেতে পারে। তাঁর নাম শিখারানী বাগ। একদিন গল্পদাদুর আসরে রিহার্সাল দিতে গিয়ে দেখি আমার সহঅভিনেত্রী হচ্ছেন শিখারানী বাগ। তখন বয়েসটা খারাপ হতে শুরু হয়েছে, একজন শাড়ীপরা বেণীবাঁধা অচেনা মেয়ের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রিহার্সাল দিচ্ছি, তার ওপর শিখারানী বাগ, শীতের দিনেও ঘাম ছুটে গেলো। জয়ন্তকাকুর কৃপায় অবশ্য আমরা আমাদের "হ্যাঁ ভাই", "না ভাই" মার্কা ডায়ালগ ঠিক মতো বলে আসর মাৎ করে দিলাম কিন্তু শিখারানী বাগ আমার স্বপ্নসহচরী হয়ে রইলেন অনেকদিন। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ওই একবারই ছিঁড়েছিলো। তারপর শিখারানী ছবির পর্দায় এসেছেন অনেকবার, "অগ্নি পরীক্ষা" ছবিতে ছোটো সুচিত্রা সেন। বড়ো হয়ে ছবির জগৎ থেকে হারিয়ে গেলেন মনে হয়, তবে পরে কোথায় নাচের ইস্কুল খুলেছিলেন শুনেছি। আশা করি এখন কোনো ফ্রকপরা ফিতেবাঁধা ফুটফুটে মেয়েদের ঠাম্মা দিম্মা হয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। ও, বলতে ভুলে গেছি, দক্ষিণা সেই পাঁচ টাকা, যুদ্ধের পর মুদ্রাস্ফীতি হওয়া সত্ত্বেও।
এই গল্পদাদুর আসরে যাতায়াত করতে করতে একদিন দেখি বেতার নাটকের তালিকাতেও নাম উঠিয়ে ফেলেছি। একবার এক গল্পদাদুর আসর শেষ করে বেরোবার সময় শ্রীধরকাকু, বেঁটেখাটো পরিচালক শ্রীধর ভট্টাচার্য মশায়, হাতে একগোছা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, বেনুবাবু (আমার ডাক নাম, সে নামে ডাকার লোক আজ প্রায় সবাই চলে গেছেন) কয়েক হপ্তা পরে এক বিষ্যুৎবারের নাটকে তোমার পার্ট আছে, বাবুকে জিগ্যেস করে নিয়েছি, তিনি হ্যাঁ বলেছেন। এই নাও তোমার পার্ট, হারিয়ে ফেলো না বাবা। কী নাটক মনে নেই, আমার পার্টও বোধহয় দশ লাইনের বেশী নয়, কিন্তু উত্তেজনায় কয়েক রাত ঘুম হোলো না। ঠিকঠাক পার্ট বলতে পারবো কিনা তার ভয়ে নয়, পার্ট মুখস্থ করার দায় নেই, আর এতোদিন এলেবেলে হলেও ছোটোদের আসরে পার্ট করে করে চোথা ধরে পার্ট বলায় আমার মোটামুটি অভ্যাস হয়ে গেছে। ঘুম না আসার কারণ হোলো, ওরে বাবা, মামারবাড়ীর জমায়েতে সবাই শুনবে, আমার পার্ট শুনবে, আমার কিশোর জীবনে সে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। আর নাটকের পরে যে সমালোচনা, পাড়ার ছেলে বলে চক্রবেড়ে কি আমাকে কচুকাটা থেকে বাদ দেবে? তবে এই রক্ষে যে নাটক লাইভ, অতএব সমালোচনাটা লাইভ হবে না অন্তত আমার কাছে। জানাশোনা সব ঠাকুরদের ডাকলাম, কিছু কিছু আবার সংস্কৃতে, তারপর জয়মা বলে নেমে গেলাম। তা সে বৈতরণী পার হওয়া গেলো, স্বজনতোষণটা যে লুকিয়েচুরিয়ে হলেও সর্বত্রই চলে, সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি তখনো হয়নি, আমি ভাবলাম ঠাকুরের কৃপা। ও, দক্ষিণা সেই পাঁচটাকা।
তারপর আরো পনেরো-ষোলোটা নাটকে পার্ট করেছি, বেশীর ভাগেই পার্ট ছোটো ছোটো, কয়েকটা মাঝারি, কিন্তু একটা বড়ো নাটকের কথা মনে আছে, রবীন্দ্রনাথের "ছুটি" গল্পের নাট্যরূপ। তাতে আমি করলাম ফটিক, ফটিকই নায়ক। তখন আইএসসি পড়তে কলেজে ঢুকে গেছি, ভাগ্যিস, স্কুলে থাকলে 'ফট্কে', 'ফট্কে' করে উদ্ব্যস্ত করে দিতো। বাবু খুব যত্ন করে আমাকে গল্পটা বোঝালেন, বুঝিয়ে পার্ট শেখালেন, নামিয়ে দিলাম। চক্রবেড়ের সুখ্যাতিতে এবারে কোনো প্রশ্রয়ের ভেজাল নেই। দস্তুরমতো দরখাস্ত করে ততোদিনে বেতন বাড়িয়ে নিয়েছি, প্রোগ্রাম পিছু বারো টাকা। এই বাড়তি আয়টা বেশ কাজে লাগছে তখন, সিগারেট ধরে ফেলেছি যে।
নাটক হোতো স্টুডিও ঘরে, অন্ধকূপের চেয়ে একটু বড়ো। একটা ডাইমন-মার্কা মাইক, প্রায় সবসময়েই দেখেছি ঝোলানো থাকতে, মাত্র দুয়েকবার দাঁড়ানো দেখেছি। তারই চারধারে গোল হয়ে সবাই পার্ট পড়তেন, আমার দাঁড়াবার জন্য কখনো কখনো ছোটো টুলের ব্যবস্থা হয়েছে। সোনালী নিয়ম ছিলো পাতা উলটোতে গিয়ে কাগজের খসখস চলবে না। লম্বা সংলাপ বলার সময় পরিচালক (বা প্রযোজক, আমার মনে হয় বেতার নাটকে এঁরা হতেন একই লোক, অন্তত আমি যা দেখেছি) দূরে গিয়ে পাতা উলটে এনে অভিনেতাকে আস্তে আস্তে ধরিয়ে দিতেন। এই নাটক করার সময় অনেক তাবড় তাবড় শিল্পীকে দেখেছি। সে যে এক বিরাট সৌভাগ্য তা বোঝার বয়স ছিলো না আমার, তাঁরা হয় জ্যেঠু, নয় কাকু, নয় মাসী বা দিদি, "ও এই বুঝি বিকাশ/বিকাশদা/বিকাশবাবুর ছেলে, বাঃ, বাঃ, এবার কোন ক্লাসে উঠলে, ...।" তবে চোখ বুজলে আজও তাঁদের কারুর কারুর ছবি দেখতে পাই। ইন্দিরাদি তো আছেনই, বীরেনজ্যেঠু, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, নস্য নিতেন, সেই রঙেরই একটা চাদর গায়ে, শ্রীধরকাকা, অতুলকাকু, মহিলামহল চালাতেন বেলাদি, ভীষণ ফ্যাশনেবল নীলিমাদি, নীলিমা সান্যাল, এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসের মক্ষীরানী ছিলেন বলে জেনেছি বড়ো হয়ে। লীলা মজুমদারের জীবনী পড়ে জানলাম তিনিও নাকি একসময়ে কোলকাতা বেতারের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন, তবে আমি তাঁকে দেখিনি, দেখলে নিশ্চয় মনে থাকতো, তখন 'দিনদুপুরে' লিখে তিনি আমাদের কিশোরদের নমস্যা। আর অবশ্যই শিখারানী বাগ।
তারপর একদিন এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শিবপুরে চলে এলাম। কোলকাতা আকাশবাণীর সঙ্গে আমার এতোদিনের অন্তরঙ্গতার সেখানেই ইতি। সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ, আবশ্যিক ছাত্রাবাস বিইকলেজে রেডিওর একেবারেই চল নেই। ঘরে ঘরে তো নয়ই, হোস্টেলের কমন রুমে নেই, কলেজের সাধারণ কমন রুমেও নয়। নবলব্ধ স্বাধীনতায় মাতোয়ারা হয়ে এই ঘাটতিটা নজরেই পড়লো না। পুরিয়ে নেবার জন্য অবশ্য অনেক কিছু পাওয়া গেলো-- অনর্গল ধূমপান, বঙ্গবাসী-অলকা-মায়াপুরী-ঝর্ণা সিনেমায় খুসীমতো ছবি দেখা, সঙ্গী জোগাড় করতে পারলে ধর্মতলায় বিলিতি সিনেমা আর চপ-কাটলেট-কাবাবের শ্রাদ্ধ, আর ছুটির দিনে বট্যানিকাল গার্ডেনে প্রজাপতির ভীড় তো আছেই। গরমের ছুটিতে বাড়ী এসে দেখি ছোটো বোন বেওয়ারিশ রেডিওর দখল নিয়ে বসেছে, সেদিকে কোনো সুবিধে করা গেলো না। তারপর চাকরী, বিদেশ-- আকাশবাণী কোলকাতা আস্তে আস্তে আমার জীবন থেকে মুছে গেলো।
আজ অর্ধশতাব্দীরও বেশী দূর থেকে দেখতে গিয়ে আমার এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে এক আনন্দবাজারের কথা মনে আসে। হাঁক, ডাক, হৈচৈ, হাসিতামাশা, খোশগল্প-- মানুষগুলো সবাই খুসী, সবাই সেখানে এসে খুসী, সবাই সবাইকে দেখে খুসী, সে যেন এক 'সব পেয়েছির দেশ'। ভালোর আড়ালে মন্দ, হাসির আড়ালে কান্না কি ছিলো না? নিশ্চয় ছিলো তবে তখন বয়স হয়নি, তাই তা বুঝিনি। আর আজ? আজ "হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী।" তা সে পিশাচ আসুক বা না আসুক।
ভুশুণ্ডী বন্ধু পুষ্পেন্দুসুন্দর মুখোপাধ্যায়ের রচনা ও আলোচনা থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি, ঠুকরে দিতে পারে জেনেও ধন্যবাদ লিখলাম।
লেখক পরিচিতি: পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।