কান পেতে রই...
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
জিয়াউদ্দীন তারেক আলী
যে রাজনৈতিক প্রয়োজন এবং পটভূমিতে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা
বেতার কেন্দ্র তার কার্যক্রম শুরু করেছিল, শুরুতেই তার কিছুটা
ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন। পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ
তার একমাত্র পূর্ব পাকিস্তান সফরকালে যখন উচ্চারণ করেছিলেন যে
শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, সেই সভার মাঠ জুড়ে
যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, তাতে সেদিনই বোধ হয় পাকিস্তানের
ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী ১৯৫২-র
২১শে ফেব্রয়ারি ছাত্র হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গতি পায় এবং কয়েক
বছরের মধ্যেই এই দাবী অর্জিত হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ১৯৬৬ সালে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা দাবীও ছিল পাকিস্তানি আমলের
অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির সুসংগঠিত
পদক্ষেপ, যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানের ৩১৯ টি
আসনের মধ্যে ১৬৭টি পেয়েছিল আওয়ামী লীগ সংখ্যার বিচারে আওয়ামী লিগের পাকিস্তান সরকার গঠন করার কথা ,
কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী (ইয়াহিয়া খান- প্রেসিডেণ্ট)
এই দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। যে কোনভাবে
শাসন ক্ষমতা যাতে পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিবিদদের (ভুট্টো-র ও
অন্যান্য) হাতে থাকে - সেটাই ছিল উদ্দেশ্য। ১৯৭১ সালে ৩রা মার্চ
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বান করার কথা
ছিল, কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা মার্চ এই অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের
জন্য মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এই খবরে শোনা মাত্র পূর্ব পাকিস্তানে
বিক্ষোভ শুরু হয়। আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে
২রা মার্চ ঢাকায় এবং ৩রা মার্চ সারাদেশে একযোগে হরতাল পালিত হয়
- সমগ্র পূর্ব বাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিও ঘোষণা
করা হয়।
৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের এক বিপুল জনসভায় পাকিস্তানের
মিলিটারি প্রশাসকদের কাছে সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নির্বাচনের
ফলাফল মেনে নিয়ে জনতার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাজ্যভার
তুলে দেবার দাবী জানান। যদিও এই বক্তৃতা মূলত ছিল গণতন্ত্র অধিকারের
দাবী - তবে স্বাধীন হবার বীজ এর মধ্যেই প্রচ্ছন্ন ভাবে লুকিয়ে
ছিল এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান সোজাসুজি না বললেও সেই বার্তাই
দিতে চেয়েছিলেন। ...।
"তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে
ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা
করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু - আমি যদি
হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।
...মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি
রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালী রেডিও স্টেশনে যাবে
না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন
না।...
...তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
রক্ত যখন দিয়েছি, আরো রক্ত দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো
ইনশাল্লাহ।
...মনে রাখবা, এবারের সংগ্রাম...আমাদের মুক্তির সংগ্রাম... স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।"১
রেসকোর্স ময়দানের এই ভাষণ রেডিও থেকে যুগপৎ সম্প্রচারের কথা
থাকলেও সম্প্রচারিত হয় নি। প্রতিবাদে ঢাকা রেডিও কেন্দ্রের কর্মচারীরা
কর্ম থেকে বিরত হন। সেই ভাষণ পুনঃপ্রচার করার শর্ত সাপেক্ষে ৮ই
মার্চ সকাল থেকে ঢাকা বেতারকেন্দ্র আবার সচল হয়েছিল। সমগ্র বাংলাদেশের
মতো সেই বিপ্লবের ঢেউ সূর্য সেন, প্রীতিলতার চট্টগ্রামেও পৌঁছে
গিয়েছিল। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের সামরিক সরকার পশ্চিম পাকিস্তান
থেকে সৈন্য এনে ২৫শে মার্চ শুরু করে তাদের ‘অপারেশন সার্চ-লাইট’
। ২৫ মার্চের সেই কালরাত্রিতেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক
বাঙালি নিধনপর্বের সংবাদ ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ওয়ারলেস
অপারেটর দেশের সকল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
চট্টগ্রামে তাই ভোরবেলায় মাইকযোগে প্রচার করা হতে থাকে যে বঙ্গবন্ধু
স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।
২৬ তারিখ দুপুরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার ভবন থেকে আওয়ামী
লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পড়ে শোনান।
২৬ তারিখ সন্ধ্যার সময় বেতারকর্মী বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম
সন্দীপ এই বেতারকেন্দ্রকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র
হিসেবে আখ্যায়িত করে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করেন। ২৭ মার্চ পটিয়া
থেকে মেজর জিয়াউর রহমানকে ডেকে এনে ঘোষণাপাঠ করানো হয়। অস্বীকার
করার উপায় নাই যে এতে সাধারণ মানুষ এই ভেবে স্বস্তি পেয়েছিল
যে বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও তাদের সঙ্গে আছে। ৩০ মার্চের
পরে কৌশলগত কারণে এই কয়েকজন বেতারকর্মী কালুরঘাট থেকে ১ কিলোওয়াটের
একটি শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার সঙ্গে নিয়ে রামগড় হয়ে আগরতলায়
চলে যান এবং খণ্ডিতভাবে হলেও সম্প্রচার চালু রাখেন। ইতিমধ্যে প্রবাসী বাংলাদেশ
সরকার গঠিত হয়ে গেছে এবং সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়াও পাকিস্তানি মনোবল
দুর্বল করে দেবার এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের মনোবল অটুট রাখার
জন্য psychological warfare চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে
সেই সরকার। ঢাকা থেকে ততদিনে বেতারকর্মী ও শিল্পীরাও প্রচুর সংখ্যায়
কলকাতায় পৌঁছে গেছেন। এই কলাকুশলী সমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার
কেন্দ্র ভারত সরকারের দেয়া একটি ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ
ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে ২৫শে মে বালীগঞ্জ সারকুলার রোডের একটি
বাড়িতে তার যাত্রা শুরু করে। প্রতিদিন দু’বেলার প্রোগ্রাম ক্যাসেটবন্দী
করে ‘বিএসএফ’ এর কাছে দেয়া হতো এবং সেই ক্যাসেটের অনুষ্ঠান বর্ডারের
কাছাকাছি এক অজানা স্থান থেকে সম্প্রচারিত হতো।
প্রতিদিন সকাল এবং সন্ধ্যাবেলায় দুই অধিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান
প্রচার করা হতো। বাংলা এবং ইংরেজিতে সংবাদ পরিবেশন করা হতো। উর্দু
সংবাদও সংযোজিত হয়েছিল কয়েকদিনের মধ্যেই। প্রয়াত চিত্রপরিচালক
আলমগীর কবীর এবং আলী যাকের ইংরেজি অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন। বাংলা
অনুষ্ঠানের মধ্যে সঙ্গীত, কথিকা, নাটক ইত্যাদি ছাড়াও প্রধানত
রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান, মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানের
পাঞ্জাবী সেনাদের নাস্তানাবুদ হওয়ার খবর এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে
বাংলাদেশের সপক্ষে যে জনমত ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে শুরু করেছিল তার
খবর থকত বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংবাদে। এছাড়া দেশাত্মবোধক
এবং উদ্দীপক সঙ্গীত তো প্রচার করা হতোই।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় যে দুটি অনুষ্ঠান
ছিল, সে সম্পর্কে না বললেই নয়। প্রথমটি হচ্ছে নাট্যকার কল্যাণ
মিত্রের লেখা “জহ্লাদের দরবার” নামক একটি ধারাবাহিক নাটক, যার
প্রধান চরিত্র হচ্ছে রূপক বেশে ইয়াহিয়া খান। পাকিস্তানি শাসকমহল
যেভাবে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে নাজেহাল হচ্ছিল তাদের আক্ষেপমিশ্রিত
কথোপকথনে সমৃদ্ধ এই নাটকের অন্যতম প্রধান ভূমিকায় ছিলেন রাজু
আহমেদ ও নারায়ণ ঘোষ। ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় লেখা স্বাধীন বাংলার
সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল এম. আর. আখতার মুকুলের লেখা এবং
পাঠ করা “চরমপত্র”। বিপদকবলিত বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য
এই চরমপত্র ছিল মৃতসঞ্জীবনী সুধার মতন। কয়েক মিনিটের জন্য দেশের
বাইরে যে এক কোটি মানুষ রিফিউজি ক্যাম্পে দুঃসহ জীবন যাপন করছিল
এবং দেশের অভ্যন্তরে যে সাড়ে চার কোটি মানুষ খড়কুটোর মত আজ এখানে
কাল ওখানে ভেসে বেড়িয়েছে তারা তাদের শিকড়হীন জীবনের দুঃখ দুর্দশার
কথা ভুলে গিয়ে দিনের একমাত্র বিনোদন এই চরমপত্র প্রচণ্ডভাবে উপভোগ
করত এবং মুক্তিবাহিনীর এই ‘বিচ্ছুগুলো কেমন করে শক্তিধর পাকিস্তান
বাহিনীকে “ক্যাঁচা মাইর” দিচ্ছে, সেই বিবরণ শুনত।
দেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, গীতিকার প্রায় সকলেই গিয়ে
একে একে হাজির হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। সাংগঠনিক
পর্যায়ে ছিলেন আশফাকুর রহমান, সামসুদ্দিন আহমদ, কামাল লোহানী,
হাসান ইমাম, কামরুল হাসান। সুরকারদের মধ্যে ছিলেন
সমর দাস, অজিত রায়, সুজেয় শ্যাম, প্রমুখ এবং শিল্পীদের মধ্যে
ছিলেন আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, বিপুল ভট্টাচার্য,
মোশাদ আলী, কল্যাণী ঘোষ, শেফালী ঘোষ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, স্বপ্না
রায়, শাহ আলী সরদার, নমিতা ঘোষ, শাহীন সামাদ, ডালিয়া নওশীন,
মাধুরী আচার্য প্রমুখ। গীতিকারদের মধ্যে যেমন ছিলেন ওপার থেকে
আসা মোশাদ আলী, মোকসেদ আলী সাঁই, আবদুল গণি বোখারী, তেমনি পশ্চিম
বঙ্গের গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, গোবিন্দ হালদার, শ্যামল গুপ্ত প্রমুখেরাও
স্বাধীন বাংলা বেতারের জন্য অনেক জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন। এর
মধ্যে সবচেয়ে উলেখযোগ্য হচ্ছে, “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে
যুদ্ধ করি”, “বাংলার হিন্দু বাংলার খৃষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার
মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি” এবং “শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ
মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি”। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের মধ্যে শ্যামল
মিত্র, অংশুমান রায় বিশেষভাবে জনপ্রিয় কয়েকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন।
এছাড়া আকাশবাণী কলকাতা প্রতিদিন “সংবাদ পরিক্রমা” প্রচার করত,
যার পাঠক দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়, গ্রন্থক প্রণবেশ সেন এবং উপেন
তরফদার বাংলাদেশের psychological warfare এর সাথে সমার্থক হয়ে
গেছেন। আকাশবাণী কলকাতা আর একটি ভূমিকা পালন করছিল। ১৫ই আগস্ট
রাত্রে দেশের বিভিন্ন সমুদ্র এবং নদীবন্দরে ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে
দিয়ে দেশের আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা যে সম্পূর্ণ অকার্যকর
করে দিয়েছিল বাংলার নৌ-কম্যাণ্ডোরা, তার cue তারা পেয়েছিল আকাশবাণী
থেকে প্রচারিত দুটো পূর্বনির্ধারিত গান প্রচারের সংকেতের মাধ্যমে।
এইভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয়ের পরেও
৩রা জানুয়ারিতে তার শেষ অধিবেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে
একটি অনন্যসাধারণ ভূমিকা রাখে।
১পুরো বক্তৃতাটি ইউটিউব-এ এখানে
ক্লিক করলে পাবেন।
লেখক পরিচিতি - লেখক পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও বহুদিন থেকেই তিনি একজন সর্বক্ষণিক সাংস্কৃতিক কর্মী।। বর্তমানে ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ
মিউজিয়ামের একজন ট্রাস্টি এবং সেক্রেটারি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।