অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


বিবিধ প্রসঙ্গ

জুন ৩০, ২০১৭

 

“শব্দ” মূলক বস্তুবাদ

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সান্যাল

না, ময়াই ! এই লেখাটার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই । তবে কিনা, আবার রাজনীতিও আছে একটুস্ ।

তার নাম শব্দ-রাজনীতি । এই ধরুন শ খানেক বছর আগেও লেখকরা তৎসম শব্দবহুল লেখা লিখতেন ।

উদাহরণ চাই ? বেশ দিচ্ছি । তবে পড়বার পর একবার নিজেকে ডেন্টিস্ট দিয়ে দেখিয়ে নেবেন কিন্তু !

“এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশ আকাশপথে সতত সঞ্চরমাণ জলধরপটল সংযোগে নিরন্তর নিবিড়, নীলিমায় অলঙ্কৃত; অধিত্যকা প্রদেশ ঘনসন্নিবিষ্ট বিবিধ বনপাদপসমূহে আচ্ছন্ন থাকাতে, সতত স্নিগ্ধ, শীতল ও রমণীয়; পাদদেশে প্রসন্নসলিলা গোদাবরী তরঙ্গ বিস্তার করিয়া প্রবলবেগে গমন করিতেছে।” [সীতার বনবাস/ বিদ্যাসাগর (“সাধু ভাষার” গুরুগম্ভীর রূপ)]

“একটিবার মাত্র মহেশ মুখ তুলিবার চেষ্টা করিল, তাহার পরেই তাহার অনাহারক্লিষ্ট শীর্ণদেহ ভূমিতলে লুটাইয়া পড়িল। চোখের কোণ বাহিয়া কয়েক বিন্দু অশ্রু ও কান বাহিয়া ফোঁটা –কয়েক রক্ত গড়াইয়া পড়িল।” [মহেশ/শরৎচন্দ্র ("সাধু ভাষার" লঘু রূপ)]

তা, এই যে সাধু ভাষা- এই নামটা কে দিয়েছিলেন, সেটা জানা যাক।

“সাধু ভাষা” শব্দটি রামমোহনই প্রথম ব্যবহার করেন।

"সাধু ভাষা” নামটি, রামমোহন কেন দিলেন? সংস্কৃত জানা বা কিছুটা সংস্কৃত জানা লোকেদের সঙ্গে ভাব আদান প্রদানের জন্য, ব্যবহৃত এই ভাষাকে তিনি “সাধু ভাষা” বলেছিলেন। একটা কারণ ছিল। সেই সময় থেকেই আস্তে আস্তে জাতীয় চেতনার একটা আবছা চেহারা ফুটে উঠছে।সমগ্র বাংলার জন্য, এই “সাধু ভাষা” র প্রয়োজন তখন খুব জরুরী। যাই হোক, আজও সমগ্র বাংলার আনুষ্ঠানিক চিঠিপত্রে এই সাধু ভাষার চলন আছে। তবে, ওই যে বলেছি, বর্তমানে কিন্তু মান্য চলিত ভাষাও চিঠিপত্রে ব্যবহার হচ্ছে।

বাংলা সাহিত্যের ভাষা,সর্বজনবোধ্য হওয়া উচিত, এটা সবাই মানবেন! চট্টগ্রামের কথ্য ভাষা, বাঁকুড়ার লোক বুঝবে না,বর্দ্ধমানের লোক, মৈমনসিংহের লোকেরা বুঝবে না। এই যে বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন রকম ভাষা, সেগুলোকে উপভাষা বলে। এবার সাধারণ ভাবে; এই উপভাষাগুলো কোথায় ব্যবহৃত হয়, একবার দেখে নেওয়া যাক।

• রাঢ়ী:- মূলত, পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া,হুগলি,বর্ধমান, মেদিনীপুর( যদিও, এ জেলায় বেশ কিছুটা ওড়িয়া ভাষার প্রভাব আছে।),মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, চব্বিশ পরগণা।
• বরেন্দ্রী : - উভয় বাংলার উত্তর দিকের জেলা গুলোতে। মালদহ ( কিছুটা ঝাড়খণ্ডি), দিনাজপুর, রাজশাহি, বগুড়া, পাবনা। কোচবিহার, রংপুর জেলায় কোচ বা কামরূপী ভাষার প্রভাব আছে।( ডঃ সুকুমার সেনের মতে, রাঢ়ী আর বরেন্দ্রী একই উপভাষা ছিল। পরে, একদিকে বঙ্গালী এবং বিহারীদের প্রভাবে পড়ে; রাঢ়ী আর বরেন্দ্রী বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বলে, তিনি বলেছেন।)
• বঙ্গালী : -এই ভাষাটির প্রভাব, বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, অহমের কাছাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। এই উপভাষাটি ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে থাকায়, এখানে প্রচুর বৈচিত্র্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ফলে, কেউ কেউ এই উপভাষাটিকে দুটি ভাগে ভাগ করে; নোয়াখালি, চট্টগ্রাম,ত্রিপুরা, কাছাড় আর পূর্ব শ্রীহট্টকে নিয়ে আর একটি উপভাষা গঠনের পক্ষপাতী। এটাকে তাঁরা, চট্টগ্রামী উপভাষা বলতে চান।
• ঝাড়খণ্ডী: -দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গ, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া।
• কামরূপী উপভাষাটি, বরেন্দ্রী আর বঙ্গালির মাঝামাঝি। এটাকে কোচ ভাষাও বলে ।

এবার নমুনা (প্রচুর আছে, রকমফেরও আছে, শুধু সাধারণ কয়েকটি দিলাম) : - ( এখানে যে বানান গুলো ব্যবহৃত হবে, তা উচ্চারণের সুবিধের জন্য)

• রাঢ়ী--- এই তো এক্কুনি দেকে এলুম।
• বরেন্দ্রী-----আ্যকদিন, বাগ( বাঘ) ঘরৎ ( ঘরে) আইল( এলো)
• বঙ্গাল- তোমরাগো, বাড়ী যাইতাম পারি। ( চট্টগ্রামি- আঁই না পাইরগম- আমি পারব না)
• ঝাড়খণ্ডী- কুণ্ঠে, যাছিস রে? (কোথায় যাচ্ছিস?)
• কামরূপী -এ পাখে আয়, মুই না পারিম। (এদিকে আয়, আমি পারব না)

সুতরাং, এই অল্প পরিসরে কি দেখা গেল? প্রত্যেকটা জেলার কথ্য ভাষার মধ্যে ফারাক। তাহলে, আদর্শ কথ্যভাষা কি হবে? দেখা গেছে, কলকাতা আর ভাগীরথী নদীতীরের বসবাসকারীদের ভাষা, সাধারণত শিক্ষিত সমাজে মান্য হয়েছে।

‘রাঢ়’ শব্দটি এসেছে সাঁওতালি ভাষার ‘রাঢ়ো’ শব্দটি থেকে, যার অর্থ ‘পাথুরে জমি’। অন্যমতে, গঙ্গারিডাই রাজ্যের নাম থেকে এই শব্দটি উৎপন্ন। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চল বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম প্রধান অবদানকারী।

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও রাঢ়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।মহাভারতে সুহ্ম ও তাম্রলিপ্তকে পৃথক করে দেখা হলেও গুপ্ত শাসনে রচিত দণ্ডীর ‘দশকুমারচরিত’-এ বলা হয়েছে ‘সুহ্মেষু দামলিপ্তাহ্বয়স্য নগরস্য’। অর্থাৎ দামলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) সুহ্মেরই একটি নগর ছিল। ধোয়ীর পবনদূত কাব্যে রাঢ় প্রসঙ্গে বলা হয়েছে –

গঙ্গাবীচিপ্লুত পরিসরঃ সৌধমালাবতংসো
বাস্যতুচ্চৈ স্তুয়ি রসময়ো বিস্ময়ং সুহ্ম দেশঃ।

অর্থাৎ, ‘যে-দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল গঙ্গাপ্রবাহের দ্বারা প্লাবিত হয়, যে দেশ সৌধশ্রেণীর দ্বারা অলংকৃত, সেই রহস্যময় সুহ্মদেশ তোমার মনে বিশেষ বিস্ময় এনে দেবে।’ পরবর্তীকালে রচিত ‘দিগ্বিজয়-প্রকাশ’-এ বলা হয়েছে –

গৌড়স্য পশ্চিমে ভাবে বীরদেশস্য পূর্বতঃ।
দামোদরোত্তরে ভাগে সুহ্মদেশঃ প্রকীর্তিতঃ।

অর্থাৎ, গৌড়ের পশ্চিমে, বীরদেশের (বীরভূম) পূর্বে, দামোদরের উত্তরে অবস্থিত প্রদেশই সুহ্ম নামে খ্যাত।

এই সব বর্ণনার প্রেক্ষিতে বর্তমান হুগলি জেলাকেই প্রাচীন রাঢ়ের কেন্দ্রস্থল বলে অনুমান করা হয় এবং এর সীমানা বীরভূম থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে ধারণা।

চৈতন্যচরিতামৃতের বর্ণনা অনুসারে, রাঢ়ের জঙ্গলাকীর্ণ পথে চৈতন্যদেব কাশীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কবির বর্ণনায় রাঢ়ের অরণ্যভূমির একটি কাল্পনিক বর্ণনা পাওয়া যায়, যা বাংলা সাহিত্যে একটি অন্যতম উজ্জ্বল কবিকল্পনা –

প্রসিদ্ধ পথ ছাড়ি প্রভু উপপথে চলিলা।
কটক ডাহিনে করি বনে প্রবাশিলা।।
নির্জন বনে চলেন প্রভু কৃষ্ণ নাম লৈয়া।
হস্তী ব্যাঘ্র পথ ছাড়ে প্রভুকে দেখিয়া।
পালে পালে ব্যাঘ্র হস্তী গণ্ডার শূকরগণ।
তার মধ্যে আবেশে প্রভু করেন গমন।।
ময়ূরাদি পক্ষিগণ প্রভুকে দেখিয়া।
সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ বলে নাচে মত্ত হৈয়া।।
হরিবোল বলি প্রভু করে উচ্চধ্বনি।
বৃক্ষলতা প্রফুলিত সেই ধ্বনি শুনি।।
ঝারিখণ্ডে স্থাবর জঙ্গম আছে যত।
কৃষ্ণনাম দিয়া কৈল প্রেমেতে উন্মত্ত।।

যাই হোক, প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছিল কাব্যপ্রধান। হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও বাংলার লৌকিক ধর্মবিশ্বাসগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল এই সময়কার বাংলা সাহিত্য।মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্তপদাবলী,বৈষ্ণব সন্তজীবনী, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের বঙ্গানুবাদ, পীরসাহিত্য, নাথসাহিত্য, বাউল পদাবলী এবং ইসলামি ধর্মসাহিত্য ছিল এই সাহিত্যের মূল বিষয়।

আবার ধরুন:- এই লেখাটি এক শিলালিপিতে পাওয়া:-

শুতনুকা নম দেবদশিক্যী
তং কময়িথ বলনশেয়ে
দেবদিনে নম লূপদখে

এর অর্থ:- সুতনুকা নামে( নম) এক দেবদাসী(দেবদশিক্যী), তাকে(তং)কামনা করেছিল(কময়িথ) বারাণসীর(বলনশেয়ে)দেবদিন নামের এক রূপদক্ষ(লূপদখে), মানে ভাস্কর।

এটা কবে লেখা হয়েছিল, এখনও গবেষণার বিষয়বস্তু। তবে এটা যে আদিযুগ বা প্রাচীন যুগে লেখা হয়েছিল, মনে হয় এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

এই ভাবেই, “শব্দ”মূলক বস্তুবাদ পাল্টে গেছে যুগের প্রয়োজনে ।

স্বয়ং বিদ্যাসাগর যাঁকে আমরা বাংলা ভাষার পথিকৃৎ বলেই জানি, তিনি কি করেছিলেন ?

“শব্দসংগ্রহ” (সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ৮ ই শ্রাবণ ১৩০৮ য়ে মুদ্রিত) দেখলে অবাক হয়ে যেতে হবে ।

অল্প–বেশী সাত হাজার শব্দের সংগ্রহে- মৌলিক এবং সেখান থেকে উদ্ভব হওয়া শব্দের বাইরে খাঁটি বাংলা শব্দ বা দেশী শব্দের পাশাপাশি ফারসী, আরবী, ইংরেজী, পোর্তুগীজ শব্দও নিয়েছেন অকাতরে ।

কেন নিয়েছিলেন ?

সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই বলেই ।

আর চলন্তিকার রূপকার রাজশেখর বসু বলেছিলেন :-

“যদি প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য সাবধানে নির্বাচন করে আরও বিদেশী শব্দ আমরা গ্রহণ করি, তবে মাতৃ ভাষার পরিপুষ্টি হবে, বিকার হবে না । অপ্রয়োজনে আহার করলে অজীর্ণ হয়, প্রয়োজনে হয় না । যদি বলি- ওয়াইফের টেম্পারটা বড়ই ফ্রেটফুল হয়েছে, তবে ভাষা জননী ব্যাকুল হবেন ।
যদি বলি, মোটোরের ম্যাগনেটটা বেশ ফিনকী দিচ্ছে , তবে আমাদের আহরণের শক্তি দেখে ভাষা জননী নিশ্চিন্ত হবেন ।”

চলন্তিকার পাতায় পাতায় তাই অজস্র ইংরেজী শব্দ স্থান পেয়েছে ।

একটা গোলমাল আছে , সেটা হলো ব্যাকরণ । এই ব্যাপারটাই বড্ড ঝঞ্ঝাট পাকায় । মানুষ যখন কথা বলে, তখন তো ব্যাকরণ মাথায় রাখে না । কি প্রকাশ করছে সেটাই প্রধান ।

আমার এক সাঁওতাল বন্ধু ছিলেন । কথায় কথায় বলতেন – অসম্ভব্ । খুব বেশী উত্তেজিত হলে বলতেন – সাট্টাম্ ।

অনেক পরে বুঝতে পারি তিনি কি বলতে চাইছেন , তবে তাঁর সমজাতীয়রা কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতেন ।

উদাহরণ :- হ্যাঁরে ! কোলকাতায় যে গেলি, কি বুঝলি শহরটার ?

উত্তর এলো – অসম্ভব । মানে সে এই শহরের বিরাটত্বকে এক কথায় ধরতে চাইলো।

এবারে ওর উচ্চারণ অনুযায়ী যদি লিখি, সেটা হবে – অশমবব । শেষ “ব” টা অনেক দীর্ঘ । এটাই যদি লিখি, তবে পণ্ডিতরা তেড়ে মারতে আসবেন এবং এটাই বলতে পারেন- আপনি মশাই ব্যাকরণেও “ নাস্তিক” ।

যাক, সে কথা । এবারে তাকে বললাম- এই যে তুই পাতাল রেল দেখলি, সেটা কেমন লাগল ?

উত্তর – সাট্টাম্ ।

মানেটা হলো ভয়ংকর ভাবে সুন্দর ।

আরও একটা সমস্যা- ব্যাকরণ জানতে গেলে ভালো করে , ভাষাতত্ত্ব, উচ্চারণ পদ্ধতিও জানতে হবে !

আমার এক বন্ধু আছেন, তাঁর ইংরেজী জ্ঞান সন্দেহাতীত । মুশকিল তিনি আবার ফোনেটিক্স (উচ্চারণ পদ্ধতি ) পড়ান !

আমার মত রজক বাহন তাঁর উচ্চারণ শুনে বুঝতেই পারেনা, যে কি বলছে ?

আমরা তো জানি মানডে অথচ তিনি বলছেন – মানডি ।

ল্যাও ঠালা ! এবারে এটা “ বার” ( না, ভাটিখানা নয় – রোজ ) না হাট কি করে বুঝি ? তিনি তো বলেই খালাস , আমি / আমরা বুঝি কি করে ?

গোড়ায় গলদ আরও আছে । আমরা দেখেছি রাঢ় অঞ্চলের ভাষা এবং বানান রীতি সব জায়গায় মান্যতা পায় । কারণ, মূলে ছেল ( ছিল নয় ) সব লেখকরাই ওই রাঢ় অঞ্চলেরই !

অতি কষ্টে আমার রাজশাহী জুবানে, আমি যখন বলি এই ভাষা তখন লোকে সেটা কিচকিচ বলে ভেবে শাখামৃগ (বান্দর) বলবে ।

আরও বিপদ !!

যদি লিখি – কাল রেইতে মাল্ খেয়ে, জানটা তররররররররররররর্ হয়ে গেল – প্রথমেই তেড়ে আসবে সংস্কৃত ভাষার লোকেরা ! নাসিকা কুঞ্চিত করে বইলবে ( বলে – নয় ) এটা মড়া দাহ- শবপোড়া ভাষা !

আরবীর লোকেরা বলবে জান মাল হবে, মাল জান নয় ।

কী বিপদ !

ইদানিং সোসাল মিডিয়াতেও ভাষা/ শব্দ পাল্টে যাচ্ছে ।

অনেক শব্দ তৈরী হয়েছে বা হচ্ছে , এবং অনেক সময়ই এগুলোর উৎস কলেজ ক্যাম্পাস বা সমগোত্রীয় এলাকা যেখানে অল্পবয়সীরা এই ধরণের শব্দের প্রয়োগ বহুল করে থাকে।

ক্ষেত্রবিশেষে এই শব্দগুলোর উৎস খুঁজে পেতে খুব অসুবিধা হয় না ।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ সূত্র পাওয়া যায় না

চরম (ultimate ), নোংরা ( as in filthy rich ) এগুলো বোঝা যায় । কিন্তু "উদ্রুম" , বা "গোলা" র উদ্ভব সূত্র বেশ জটিল ব্যাপার ।

ঝক্কাস মানে হেব্বি, মানে, দারুণ :- কাকাটা কিন্তু ঠিক ব্যঙ্গাত্মক অর্থে ব্যবহৃত হয় বলে মনে হয়না। একটা ইয়ারদোস্ত টাইপের ভাব বোঝাতে ব্যবহার করা হয় এবং মেয়ে-পুরুষ উভয় ক্ষেত্রেই।

অসাধারণ পুরোটা বলে না, বদলে 'অসা' বলেই কাজ সারে । এছাড়া 'চরম'(দুর্দান্ত) আমরা যে অর্থে ব্যবহার করতাম, তা নয়।

আরেকটা এখন চলছে, সেটা হল "কালীদা" - "এই তো জীবন, কালীদা" থেকে অনুপ্রাণিত।


ফ্যাদ্‌রা প্যাচাল বা ভজর ভজর= ফালতু বকবকানি (blabbering)
হা হা প গে = হাসতে হাসতে পড়ে গেলাম। মতান্তরে, হা হা ম গে = হাসতে হাসতে মরে গেলাম।
সিরাম – চমৎকার ( বাংলাদেশী)
লুল –লোলের বাংলাদেশী প্রয়োগ।
সমস্যা নাই – বেপরোয়া ।( বাংলাদেশী)
গ্যালারিতে বসলাম = বিতর্ক উপভোগ করছি ।
একঘর -শব্দটির প্রয়োগও ব্যাপক, খুব ভাল অর্থে।
একদম! ---- বারংবার ব্যবহারে সম্মতি প্রকাশ।
ঘ্যামা- ঘ্যাম অর্থ অহংকার, কিন্তু ঘ্যামা মানে খুব ভাল।
বিটু- বিটুমিনাস মানে পিচ, বিটু মানে খারাপ ।
নোংরা- দারুণ। প্রয়োগ: --পরীক্ষা কেমন হল? --নোংরা।
এই পোস্টটা পুরো “চুমু” – ভালো লাগা
কি “ভয়ঙ্কর” দেখতে মাইরি.... সুন্দর অর্থে ।
চাপ – কষ্টের কাজ।
বিন্দাস = ঝঞ্ঝাট মুক্ত
বুড়ো আঙুল দেখানো মানে ছিল ভেঙানো আর এখন প্রশংসা বা লাইক।
যাতা :- আগে জানতাম, এই শব্দের অর্থ যাচ্ছেতাই । কিন্তু এখন “চমৎকার” অর্থে ব্যবহৃত হয় ।
“ল্যাদ” খাওয়া.. আলস্য করা ।
ব্যাপক :- ব্যাপ্তিশীল অর্থে ব্যবহৃত, কিন্তু এখন প্রচণ্ড ভালো হিসেবে চালু আছে ।

আবার – আড্ডানো, আপলোডানো, পোস্টানো, এগুলো তো আকচার ব্যবহার হয় ।

ইংরেজ শাসন অবিভক্ত ভারতে আসার আগে, ফার্সী ছিল ভারতের শাসনের ভাষা । তারও আগে ছিল সংস্কৃত ।

দেশজ ভাষায় যারা কথা বলতেন বা এখনও বলেন তাঁদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল এই সব ভাষার সংমিশ্রণ ।

হট্ট- আপণ- বিপণি সরে গিয়ে এলো – বাজার, দোকান । এখন চলছে শপিং মল । এই সব “ শব্দ” র সঙ্গে আমজনতা অতি পরিচিত ছিল তখন এবং এখনও ।

ওজন করেছিলাম, তৌলন না করে এখন ওয়ে করিয়ে নিই, ক্ষতি কী ?

আগে আপসোস করতাম জালবাজির ফেরেবীতে পড়ে । এখন ? রিগ্রেট করি ফর্জারির সাইকেলে পড়ে । অনুতাপ করছি প্রতারকের পাল্লায় পড়ে এটাও বলি ।

বেকুব বনে যাই মাঝে মাঝে । মোটেই বোকা হই না । বিফুল্ড হই অবশ্য ।

কেতাবী থেকে জীবনের স্রোতে যদি ফিরে আসা যায় মন্দ কি ?

ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি, সিনেমা, অটো ডেইলি ব্যবহার তো হয়ই । লিখিত এবং কথ্য ভাষায়, সে “ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত” দের মধ্যেই ।

একটা সময় যে ছিল বিদেশী, সে এখন এতই আপন ( আপণ নয় ) যে আঙুল দেখালেও চিনতে কষ্ট হয় ।

লোন ওয়ার্ডস তাকে কৃতঋণ বা অতিথি শব্দ- যাই বলুন না কেন, আমাদের ভাষার শ্রীবৃদ্ধি তো ঘটাচ্ছে !!!

এখন রেশন কার্ড বললে ১০০ শতাংশ লোক বুঝবেন, কিন্তু সংবিভাগ পত্র বললে কি হবে ?

সুতরাং আগে বঢ়ো ভাইয়া !!!! গর্দিশে যা আছে, তাই হবে !!!


এই লেখার অনেক অংশ খণ্ড খণ্ড ভাবে আমার চাপড়ঘণ্ট বইয়ে ও নেট-এ নানান জায়গায় পূর্ব-প্রকাশিত। সেগুলি একত্র করে ও কিছু নতুন তথ্য যোগ করে এই রচনাটি লেখা হয়েছে।

তথ্যঋণ:
ইন্টারনেট, সুকুমার সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ও ফেসবুকে আমার বন্ধুদের পোস্ট ।‍


পরিচিতি - প্রাক্তন ঔষধ বিপনন প্রতিনিধি। শখের লেখালেখি করেন। বর্তমানে দমদমে বসবাস রত। প্রকাশিত বই: চাপড়ঘন্ট, দোতালা বাস, নাট্যে উপেক্ষিত,  বেচুবাবু, অল্পতে গল্প  এবংসম্পাদিত বই- নুনেতে ভাততে খণ্ড ১ এবং ২।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.