প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

রম্যরচনা

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭

 

মাথাব্যথা

মধুমিতা ভট্টাচার্য


“তোর তো অতগুলো আছে, আমায় দে না একটা, হতভাগা!” আঙুল নেড়ে সাংকেতিক ভাষায় কথাগুলো জানাল জরির জামা গায় দেওয়া লোকটা। “দেখছিস না আমার একটাও নেই। যা-ও বা একটা ছিল, সেটাও যে কোথায় পড়ল কে জানে! কোন আদ্যিকাল থেকে এখানে ওখানে ঠোক্কর খেতে খেতে ঘুরে বেড়াচ্ছি! না পাই দেখতে, না পারি শুনতে। খেতে ঘুমোতেও পারিনা! ফুল-ফল আর রকমারী রাজকীয় খাবার-দাবারের গন্ধ পাওয়াও আমার কপালে লেখা নেই! ধূসসস্‌, কপালটা-ই বা কই, লিখবে কিসে! ছ্যা...ছ্যা...ছ্যা..., এভাবে বেঁচে থাকা যায়? একেক সময় ভাবি বিষ খেয়ে কিংবা গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মঘাতী হই। কিন্তু তার-ই বা কী উপায়? গলা-ই নেই, ফাঁস লাগাব কিসে? আর মুখ থাকলে তো বিষ খাব? অথচ তুই নিজের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ, আড়াই-গন্ডা মাথায় দশখানা হীরে-জহরতের মুকুট চাপিয়ে মটমটিয়ে ঘুরছিস! এভাবে অন্যের হাড় জ্বালানোটা কি ভদ্রলোকের কাজ? অতগুলো মাথা থাকলে কী হয়, খুপড়িটা তোর বিলকুল মজা পুকুর! নইলে অত পড়াশুনো আর জপতপ করেও রামস্যরের বৌ সীতাজী কে কিডন্যাপ করে আনিস? হতচ্ছাড়া...পাজি, দে না একটা আমায়!”

“তোর নেই তার আমি কী করব? আমারগুলো তো আমারই। তার থেকে একটা খুলে তোর ঘাড়ে সেঁটে দিলে গিন্নি রাগ করবে না? সে বাপু বড্ড ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমার অত সাহস নেই। গিন্নিকে আমি খুবই মান্যি করি জানিস। তাছাড়া মাথাহীন শূণ্য ঘাড়টাকেই বা কি জবাব দেব? ফের নতুন একটা গজাবে সেখানে? তখন চোখ, নাক, কান, মুখ আর ঘিলুর জন্যে কোথায় হত্যে দেবো রে হতভাগা! অন্য কোথাও খোঁজ গে, আমি দেবনা যাঃ..., ব্যাটা কবন্ধ”! গমগমে আওয়াজ তুলে বলল সামনের জবরজং লোকটা।

“তা তো বলবিই। তোর আর কি! হাড়-বজ্জাত, স্বার্থপরের শিরোমণি। দিব্যি আছিস কিনা! একটা নয় দুটো নয়..., একেবারে দশ দশটা মুণ্ডু। দশ দিকের কোথায় কোন চুলোয় কি কেচ্ছা-কেলেঙ্কারী চলছে সব এক ঠাঁইয়ে বসে টের পাচ্ছিস! দশ দু’গুণে কুড়ি চোখে স্বর্গের অপ্সরাগুলোর নাচা-গানা আর ডিস্কো দিওয়ানের হুল্লোড়বাজি দেখছিস। দশ দশটা নামে বদন-পুস্তকে এ্যাকাউন্ট খুলে এন্তার দোস্তানার রিকু পাঠাচ্ছিস। এই মাগ্‌গী-গণ্ডার বাজারে এভাবে একদিকের পাল্লা ভারী হয়ে থাকাটা কি ঠিক? আমার প্রতিবাদী মন স্লোগানে স্লোগানে ছয়লাপ। বলছে, কারও থাকবে আর কারও থাকবেনি, তা হবেনি...তা হবেনি...কিছুতেই হবেনি”! রাগের চোটে হাত নেড়ে দেহাতি ভাষায় সঙ্কেত পাঠায় মুণ্ডহীন রাজা। “কিন্তু বলবই বা কী করে? মুখ থাকলে তবে তো! আমি তো বোবা-কালা-কানা-খোনা। নালিশ করব বুঝলি, নালিশ করব আমি পরলোক রাইট্‌স কমিশনে, তখন বুঝবি ঠ্যালা। ছাড়বনি...কিছুতেই ছাড়বনি তোকে”! ফস্‌ করে দীর্ঘশ্বাস বেরয় গলার নলি ফুঁড়ে।

“হুঁউঁউঁউঁউঁউঃ...”! যার উদ্দেশ্যে এসব বলা, তার বিস্তৃত নাকের আগাছাময় গুহা থেকে, শুধু এই শব্দটিই ঝরে পড়ে। উদ্‌বৃত্ত মস্তক-সম্পদের ভাগ-বাঁটোয়ারা করার ন্যূনতম ইচ্ছেও তার নেই বোঝা গেল। তারপর সে অপরপক্ষের বক্তার দিকে তাকিয়ে ঝম্পস্‌ গোঁফে আলতো মোচড় দিয়ে হুঃ...হুঃ...হাঃ...হাঃ...হাঃ শব্দের প্রবল অট্টহাসিতে দশদিক কাঁপিয়ে বলে উঠল,
“কেনরে ব্যাটা কন্ধকাটা! তোর বুঝি হিংসে হচ্ছে? আমি দশে দশ আর তুই গোল্লা! ” তারপর ভেংচি কেটে বললো, “যাঃ...করগে নালিশ! দেখি কে শোনে তোর কথা! আমার মাথা আমারই, তোর তাতে কি? ভাবতো, এই দশ মুখে কতগুলো রসগোল্লা খাই একসাথে? তবে সমস্যাটা হোল পেট একটাই। বেশি খেয়েও লাভ নেই। পাকস্থলির ওপর অনাবশ্যক চাপ পড়ে বেমক্কা বেগড়বাঁই করে বসে। হাঁসফাঁস চলতে থাকে বেদম!”

হ্যাঁ এতক্ষণে ঠিক ধরা গেছে। স্বর্গোদ্যানে বাক্‌যুদ্ধ চলছিল দশানন রাবন আর মুণ্ডহীন রাজা কনিষ্কর মধ্যে। একজনের ঘাড় দশ-দশটা মাথায় সুশোভিত, আরেকজনের কিছুই নেই। এপক্ষে রাগ-দুঃখের ধারাবর্ষণ হওয়াই স্বাভাবিক।

কিন্তু দশানন হঠাৎ যেন কিছুটা কাতর হয়ে পড়ল! ছলছল চোখে বলে ওঠে, “ভাইরে, দশমুণ্ডুর সুবিধেগুলোই দেখিস কেবল, অসুবিধেগুলো চোখে পড়ে না? সবেধন নীলমনি ঘাড়টা যে দশমাথার চাপে চুঁচড়োর চড়ুইপাখি হয়ে থাকে! তার বেলা? এতগুলো অর্বাচীনকে সামলানোর সমস্যা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতিস তো বুঝতাম! তোর বরং একদিকে ভাল, মাথা মেইনটেন্যান্সের কোনও হ্যাপা নেই। খরচাপাতিও যাকে বলে মিনিমাম। তাছাড়া সবাই জানে কান টানলে মাথা আসে। অঙ্কের হিসেবে তাহলে মাথা টানলে কানকেও আসতে হয়। তা মাথা আর কান দুটোই যখন নেই তখন সোনা আর হীরে জহরতে গড়া অত দামী মুকুটই বা কোথায় পরবি আর কুন্ডলই বা কোথায় দোলাবি? তেল, চিরুণী, দাড়ি কামাবার সাজ-সরঞ্জাম, শ্যাম্পু, আয়না এমনকি কোর্মা-পোলাও পর্যন্ত লাগেনা তোর। আমার তো এতগুলো মাথার খোরাকের জোগান দিতে নাভিশ্বাস ওঠে। কম হুজ্জুত? খাবার জন্যে হাঁ করে থাকে সবক’টা। দশ মুখে দশ গুণিত বত্রিশ মানে তিনশ কুড়ি খান দাঁত শানিয়ে থাকে হাড্ডি মাংস চিবোবার জন্যে। একমুখে বেশি দিলে আরেকজনের দাঁত কিড়মিড় শুরু হয়ে যায়। সেসব প্রতিবাদী আন্দোলন যে কি করে সামাল দিই, সে আমিই জানি! একটা বিরিয়ানী চায় তো আরেকটা শুক্তোনীর জন্যে ধন্না দেয়! এ যদি রাক্ষস-ভজন গায় তো ও শুরু করে দানবীয় কালোয়াতি গানা। কেউ অম্রুতাঞ্জন মাখে তো কেউ হেডফোন খোঁজে! তার ওপর মাঝরাতে গিন্নির মুখঝামটার বোনাস! আমার নাসিকা গর্জন নাকি দশ ক্রোশ দূর থেকে শুনলেও কানে তালা লাগে। দশ নাকের সেই দশাসই ডাকে তেনার ঘুম ব্যোম্‌কে বেগুন পোড়া হয়ে যায় কিনা! অথচ তুই ভাবিস না-জানি কী দিব্য আরামে দিন কাটাই আমি! আমার হ্যাপায় লবেজান হয়ে কেবল আমিই দশ মাথার মুঠো মুঠো চুল ছিঁড়ি। তাছাড়া এই আধকুড়ি মাথা থেকে রোজ কত বালতি ঘাম ঝরাতে হয় ভেবে দেখেছিস কোনওদিন? ”

“সে বল্লে হবে? তোমার বেলায় অতিরিক্ত সুবিধে আর আমার বেলায় ঢুঁ-ঢুঁ! কম্প্‌লেন করবই করব। কারও থাকবে কারও থাকবেনি...তা হবেনি তা হবেনি!” বলতে বলতে রওনা হলেন মুণ্ডহীন রাজা। হাতড়ে হাতড়ে এদিক সেদিক গুঁতো খেতে খেতে চলতে থাকলেন কম্প্‌লেন করতে। কার কাছে কে জানে! তবে যে শুনবে তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বহাল তবিয়তে থাকলেই হল। আজকাল সেটারই বড় অভাব কিনা!

দশাননের দশজোড়া চোখ তখন কুড়ি ফোঁটা জলে স্যাঁতস্যাঁতে। মাথা থাকার মাথাব্যথাতেই বোধহয়!


লেখক পরিচিতি - লেখালিখিকে ভালবাসার সূচনা আসানসোলে, স্কুলবেলা থেকে। কলেজবেলার শুরু থেকে বারো বছর শান্তিনিকেতনে ওতপ্রোত হয়ে থাকা। সংসারসূত্রে প্রথমে আসাম ও এখন ডুয়ার্সের হরিয়ালি চা বাগানের বাসিন্দা। প্রকাশিত কবিতার বই "নক্ষত্র নাবিক"। লেখা (কবিতা, গল্প ইত্যাদি) প্রকাশিত হয়েছে 'দেশ', 'কৃত্তিবাস', 'সানন্দা, 'এবেলা', 'ফেমিনা(বাংলা)', ও আরও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায়।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।