প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

শারদ অর্ঘ্য

সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬

 

শারদপ্রাতের আলোর বেণু

কেয়া মুখোপাধ্যায়

 

শিউলির গন্ধ-মাখা হিমে-ভেজা শরতকালের এক ভোরে পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের সূচনা। রেডিয়ো থেকে ভেসে আসে ঘোষণা:

“আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।”

তিনবার শঙ্খধ্বনি। তারপর সুরে সুরে...

‘যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী
যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটিমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী।।’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উচ্চারণে, সংস্কৃত স্তোত্রপাঠে দেবীর আগমন-বার্তা...

“আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর। ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম-ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন। তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।
আজ চিচ্ছক্তিরূপিণী বিশ্বজননীর শারদশ্রীবিমণ্ডিতাপ্রতিমা মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা।”
‘সিংহস্থা শশিশেখরা মরকতপ্রেক্ষা চতুর্ভির্ভুজৈঃ।
শঙ্খং চক্রধনুঃশরাংশ্চ দধতী নেত্রৈস্ত্রিভিঃ শোভিতা।।
আমুক্তাঙ্গদহার কঙ্কণরণৎ কাঞ্চীক্কণন্নূপুরা।
দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নো রত্নোল্লসৎকুণ্ডলা।।’

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

স্তোত্রপাঠের পরে সুরের মূর্চ্ছনায়, সুপ্রীতি ঘোষের মায়াময় গায়কীতে- ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। এভাবেই প্রতি মহালয়ার ভোরে রেডিয়োতে নতুন করে আসে  ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। আকাশবাণী কলকাতার মহালয়ার বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান। আজও টেলিভিশনের অনুষ্ঠান, দৃশ্য মাধ্যমের আকর্ষণ ফিকে হয়ে যায় কথা ও সুরের এই আশ্চর্য মহাকাব্যিক সৃজনের কাছে।  

কী সেই আশ্চর্য রসায়ন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র?

‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র প্রাণ তিনজন মানুষ। এই আশ্চর্য সৃজনের তিনটি স্তম্ভ। রচনা ও প্রবর্তনা- বাণীকুমার। সঙ্গীত-সর্জন- পঙ্কজ কুমার মল্লিক। গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠ- বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। কেমন করে এর সৃষ্টি, খুঁজতে খুঁজতে একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক।

১৯২৭ সাল। ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে বোম্বের (এখন মুম্বই) এক বেসরকারি সংস্থা ডালহৌসির ১নং গার্স্টিন প্লেসের একটি ভাড়া বাড়িতে চালু করল রেডিয়ো স্টেশন। অধিকর্তা স্টেপলটন সাহেব। ভারতীয় অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন ক্ল্যারিনেট বাদক নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার আর প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল। সে সময়ে হাতে-গোণা কিছু অভিজাত পরিবারেরই শুধু শোভা পেত রেডিয়ো। 

১৯৩০-এর ১লা এপ্রিল সরকারী পরিচালনাধীনে এর নতুন নামকরণ হয়েছিল ‘ইন্ডিয়ান স্টেট ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। পরে ১৯৩৬-এ এই রেডিয়ো স্টেশনের নাম হয় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো’, আরও পরে, ১৯৫৭ সালে ‘আকাশবাণী।’

যাই হোক, আবারও ফিরে যাই শুরুর কথায়। ১৯২৮ সালে রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট হয়ে রেডিয়ো স্টেশনে চাকরি নিলেন বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরাজি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস আর সংস্কৃতে ‘কাব্যসরস্বতী’ উপাধি পাওয়া বৈদ্যনাথ রেডিয়োতে যোগ দিয়ে নতুন নাম নিলেন ‘বাণীকুমার’। বহুমুখী সৃজনশীল প্রতিভা তাঁর। 

ওই সময়েই রেডিয়ো থেকে একটা নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ওরফে ‘বুড়োদা’ এলেন সে মুখপত্র সম্পাদনার জন্যে। ১৯২৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে আত্মপ্রকাশ করল রেডিয়োর নিজস্ব পত্রিকা ‘বেতার জগৎ’।

রেডিয়োর অনুষ্ঠানকে আরোও সৃজনশীল, আরোও জনগ্রাহী করার জন্য প্রায়ই আলাপ-আলোচনা হত তখন। সেরকমই এক আলোচনায় একবার বুড়োদা মত প্রকাশ করলেন, যা যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনাও দরকার। বললেন,

“এই তো বাণী রয়েছে- সংস্কৃতের তো আদ্যশ্রাদ্ধ করেছে। ও-ই কতকগুলো বৈদিক শ্লোক জোগাড় করে ফেলুক, আর গান লিখুক, রাই (রাইচাঁদ বড়াল) সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক। ভোরবেলায় লাগিয়ে দাও, লোকের লাগবে ভালো৷”

কথাটা বেশ মনে ধরল নৃপেন মজুমদারের৷ বাণীকুমারও ভাবতে লাগলেন৷ এসব যখন কথা হচ্ছে, তখন দুর্গাপুজোর আর একমাস দেরি৷ বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র প্রস্তাব দিলেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে৷ সকলেই সমর্থন জানালেন৷ কিন্তু একটু দ্বিধার ছোঁয়াও ছিল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তো কায়স্থ৷ তিনি চণ্ডীপাঠ করলে, শ্রোতারা সকলে মেনে নেবেন তো? নৃপেনবাবু বললেন,

“প্রোগ্রাম করবে, তার আবার বামুন কায়েত কী হে? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান- খুশী মহম্মদ, আলী, মুন্সী সবাই তো বাজাবে। তাহলে তো তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়৷ তা ছাড়া আমরা একটা বিরাট উত্সবের আগে ভূমিকা হিসেবে এই প্রোগ্রাম করব। এতে কার কী বলার আছে?...”

বাণীকুমার তখন হেসে উঠে বলেছিলেন, যাই হোক না কেন, বীরেনবাবু ছাড়া আর কাউকে তিনি এ কাজের জন্যে ভাবতেই পারেন না৷

এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনার আগে, ১৯৩২ সালের মার্চ মাসে অর্থাৎ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের চৈত্রমাসে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি গীতিআলেখ্য সম্প্রচার করে কলকাতা বেতার৷ সে ইতিহাস শোনা যাক বাণীকুমারের লেখা থেকেই:

‘কলকাতা বেতার প্রতিষ্ঠানে স্বভাবতই জেগে উঠলো জনচিত্তের পরে আকর্ষণী-শক্তি সবিশেষ বিস্তার করবার অদম্য উত্‌সাহ। চললো নব নব অনুষ্ঠান-সম্ভার সাজাবার অক্লান্ত আয়োজন। এরই ফলে জন্ম নিলো ‘বেতার বিচিত্রা’। সাধারণত সংগীত-বহুল অনুষ্ঠানই বৈচিত্র্যে অধিক আদরণীয় ছিলো। সেই সূত্রে শ্রীশ্রী মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর বিষয়বস্তুর উপর ভিত্তি করে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি চম্পূ রচনা করি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ অর্থাত্‌ ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। ওই বছর চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর প্রভাতে বাসন্তী ও অন্নপূর্ণা পূজার সন্ধিক্ষণে সম্প্রচারিত হয় ‘বসন্তেশ্বরী’।

বসন্তেশ্বরী আলেখ্য দিয়ে সূচনার পর, সে বছরই ষষ্ঠীর দিন ভোরে বাণীকুমারের লেখা আর একটি গীতি-আলেখ্য সম্প্রচারিত হল। বিষয়- মহিষাসুর বধ। তখন নাম দেওয়া হয়েছিল ‘শারদীয় বন্দনা’। ‘শারদীয় বন্দনা’-র ভাষ্যকে পরিমার্জনা করেই সৃষ্টি হল কালজয়ী সঙ্গীতালেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমার লিখছেন,

“...বন্ধুবর সঙ্গীতপণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালীর সুর-সর্জনে রাগ বসন্ত এবং দেশী, দেবগিরি, বরাটী, তোড়ী, ললিতা ও হিন্দোলী- এই ছয় রাগিনী বাণী সংযোগে এক অপূর্ব রসের সঞ্চার হয়৷ অন্যান্য গানের সুর দেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, কয়েকটি নাট্য- কথাসূত্র ও গীতাংশ গ্রহণ করেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং আমি শ্রীশ্রীচণ্ডীর কতিপয় শ্লোক আবৃত্তি করি৷ বন্ধুবর রাইচাঁদ বড়ালের সঙ্গীত-পরিচালনায় ও আমার প্রবর্তনায় অনুষ্ঠানটি রসোত্তীর্ণ হয়৷ এই অনুষ্ঠানটিই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পরিকল্পনার উত্স৷ ... আমি সংস্কৃত রূপকের অন্তর্গত 'বীথী' (ORATORIO) নাট্য রচনাশৈলী অনুসরণে নবভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রণয়ন করি ১৩৩৯ বঙ্গাব্দে৷ ...”

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কলমেও ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সেই প্রথম  প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা বড় আকর্ষক:

‘‘পঙ্কজ সুর তুলে ও সুরারোপ করে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের কণ্ঠে গান তোলাতে লাগলেন। রাইচাঁদও এক বিরাট অর্কেস্ট্রা পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলেন। সেকালের সবচেয়ে বড় বাজিয়েরা গানের সঙ্গে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এলেন।’’

১৯৩৪-এর ৮ই অক্টোবর প্রথমবার মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারিত হল অনুষ্ঠানটি।

যেটুকু জানা যায়, প্রথম প্রচারের পর ‘শারদীয় বন্দনা’ খুবই ভালো লেগেছিল শ্রোতাদের। সমস্যা হল ১৯৩৪-এ, প্রথমবার মহালয়ার ভোরে সম্প্রচারের পর। কিছু রক্ষণশীল মানুষ, ধর্মকে যাঁরা চিরদিন বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চান, তীব্র আপত্তি জানালেন।   বললেন, এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শুনতে হবে? প্রতিবাদ করলেন বাণীকুমার। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ করলে তবেই   অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারিত হবে, নচেৎ নয়। আরও একটি আপত্তি ছিল। মহালয়ার সকালে পিতৃপুরুষের তর্পণের আগেই কেন চণ্ডীপাঠ? এটা মাথায় রেখেই ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল ষষ্ঠীর ভোরে।  ১৯৩৬ - এর ২১ অক্টোবর , ষষ্ঠীর দিনে প্রথমবার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামটি ব্যবহার করা হয়।  বাণীকুমারের সিদ্ধান্ত মেনে, পরের বছর, ১৯৩৭ সাল থেকে আবারও মহালয়ার ভোরেই  ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র সম্প্রচার শুরু হল। এখনও সেই ধারাই অক্ষুণ্ণ।

প্রথমদিকে কয়েক বছর পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির সঙ্গীত পরিচালনা করেন রাইচাঁদ বড়াল৷ অধিকাংশ গানের সুরই পঙ্কজ কুমার মল্লিকের। পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী সুর দিয়েছিলেন ‘অখিল বিমানে তব জয়গানে’ আর ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে’ গান দু’টিতে। ‘শান্তি দিলে ভরি দুখরজনী গেল তিমির হরি’-র সুর উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ-র।  ‘নিখিল আজি সকল ভোলে’ গানে সুর দিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়ালের। তবে এই গানটি পরে বাদ যায়৷

শুরুতে বেশ কিছু গান ছিল, যা পরে আর গাওয়া হয়নি৷ এমনকী, একটি গানের বিকল্প গান হিসেবেও কয়েকটি গানকে তাঁর স্ক্রিপ্ট-এ উল্লেখ করেছিলেন বাণীকুমার৷ কিন্তু সেগুলো পরে গাওয়া হয়নি৷ সংস্কৃত স্তোত্রও কিছু কিছু জায়গায় সংক্ষিপ্ত করে নেওয়া হয়েছে।  সময় ঠিক রাখার জন্যই সম্ভবত এই পরিবর্তনগুলো করা হয়৷ কোনও কোনও বার দু’ঘণ্টা ধরে সম্প্রচার হলেও পরে মোটামুটি দেড় ঘণ্টায় স্থায়ী হয় অনুষ্ঠানটি৷

১৯৩২ সাল থেকে ১৯৬২ অবধি লাইভ সম্প্রচার চলছিল মহিষাসুরমর্দিনীর, শুধু একটি বছর বাদে। ১৯৪৬-এর ১৬ অগস্ট থেকে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। সে বছর অত রাতে বেতার-কেন্দ্রে শিল্পীদের আনার ঝুঁকি কর্তৃপক্ষ নেননি৷ তাই আগে রেকর্ডিং করে রাখা হয়। ১৯৬২-র পরে রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা হোল। তবে রেকর্ডিং এর মান খুব উন্নত ছিল না বলে ২-৩ বছর অন্তর নতুন করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং করতে হত৷ ১৯৭২ সালে স্থায়ীভাবে রেকর্ড হল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র।

অনুষ্ঠানের আদিযুগে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সঙ্গে গাইতেন বিমলভূষণ, কৃষ্ণা ঘোষ, আভাবতী, প্রফুল্লবালা, বীণাপানি, প্রভাবতী প্রমুখ৷ আর পঙ্কজ মল্লিক তো ছিলেনই৷ পঙ্কজবাবু বাদে এঁদের কারোরই কণ্ঠ পরবর্তীকালে শোনা যায়নি৷ ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৪০-এ গাইছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, অনিল দাস, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শৈলদেবী, ইলা ঘোষ, সুপ্রভা ঘোষ (পরে সরকার), কল্পনা হাজরা৷ শৈল দেবী গাইতেন, ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে’ ও ‘বাজল তোমার আলোর বেণু’। মুখোপাধ্যায় ১৯৪০ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। 

১৯৭২ সালে স্থায়ীভাবে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রেকর্ড করে রাখার আগে পর্যন্ত শুরুর সময় থেকে বহুবার শিল্পী পরিবর্তন ঘটেছে শিল্পী তালিকায়৷ জগন্ময় মিত্র, রাধারাণী দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, শচীন গুপ্ত, বাঁশরী লাহিড়ি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মজুমদার, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ অনেক শিল্পী বিভিন্ন সময়ে এই অনুষ্ঠানে গেয়েছেন অথচ পরবর্তীকালে আর শোনা যায়নি তাঁদের গান। সমবেত গানে সব শিল্পীই গলা মেলাতেন।

শুরুতে যে শিল্পীরা অংশ নিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে রেকর্ডিং এর সময় তাঁদের কেউ কেউ উপস্থিত থাকতে না পারায় অন্য কোনও শিল্পী গেয়েছেন।  ‘অখিল বিমানে’ গানটি কৃষ্ণা দাশগুপ্ত গেয়েছিলেন। এই গানটি পরে গাইলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সেই রেকর্ডিংটা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে বাজে। বাণীকুমার রচিত ও পঙ্কজকুমার মল্লিক সুরারোপিত জাগো দুর্গা জাগো দশপ্রহরণধারিণি/ অভয়া শক্তি বলপ্রদায়িনি, তুমি জাগোগানটি প্রথমে গাইতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি বোম্বে (তখনও মুম্বই নাম হয়নি) চলে যাওয়ার পর পঙ্কজকুমার গানটি গাইতে দিলেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। আরতি মুখোপাধ্যায়ও পরে যোগ দিয়েছেন পঙ্কজ কুমার মল্লিকের ডাকে। তখন আর গান বেশি পড়ে নেই। তাই শ্যমল মিত্রের সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে তিনি গাইলেন ‘শুভ্রশঙ্খ রবে’ গানটি।  

মহিষাসুরমর্দিনী-র গান এখন আমরা শুনি সুপ্রীতি ঘোষ, প্রতিমা বন্দ্যোপাধায়,  সুমিত্রা সেন, শিপ্রা বসু, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ইলা বসু, অসীমা ভট্টাচার্য, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অরুণকৃষ্ণ বসু‚ ধীরেন বসু‚ রবীন মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, শ্যামল মিত্র, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বরেণ্য শিল্পীদের গলায়৷ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া, ‘তব অচিন্ত্য রূপচরিতমহিমা’ গানটি প্রথম দিকে ছিল না৷ পাঁচের দশকে গানটি ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে অন্তর্ভুক্ত হয় গানটি৷

প্রতিভাবান যন্ত্রশিল্পীদের এক চমৎকার সমাবেশ ঘটেছিল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে৷ আদিযুগে বাজাতেন মুন্সী (সারেঙ্গি), আলী (চেলো), খুশী মহম্মদ (হারমোনিয়াম), অবনী মুখোপাধ্যায় ও তারকনাথ দে (বেহালা), সুরেন পাল (ম্যান্ডোলিন), সুজিত নাথ (গিটার), দক্ষিণামোহন ঠাকুর (এসরাজ), শান্তি ঘোষ (ডবল বাস্), রাইচাঁদ বড়াল (পিয়ানো ও অর্গ্যান) ইত্যাদি আরও কয়েকজন৷ পরে বংশীবাদক গৌর গোস্বামী, হিমাংশু বিশ্বাস, শৈলেন দাস, অনিল দাস ও আরো অনেক যন্ত্রশিল্পীদের সমন্বয় ঘটল সেই অনুষ্ঠানে। এক সময় সঙ্গীত-আয়োজনের মূল কাজ শুরু হয় সুরেন্দ্রলাল দাসের পরিচালিত ‘যন্ত্রীসঙ্ঘ’-র মাধ্যমে৷ পরবর্তীকালে, এই কাজের মূল দায়িত্ব দীর্ঘদিন সামলেছেন ভি. বালসারা৷

গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশের সময় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রসঙ্গে বাণীকুমার লিখেছেন:

“‘মহিষাসুরমর্দিনী’ আমার প্রথম যৌবনের রচনা। কিন্তু মূল রূপটির বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও এই গ্রন্থের বর্তমান রূপ বহুতর তথ্য ভাবগর্ভ বিষয় এবং বেদ-পুরাণাদি-বিধৃত শ্লোকাবলী সংযোজনায় সমলঙ্কৃত। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্থ মার্কন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার বললেও অত্যুক্তি হয় না, তদুপরি এর মধ্যে আছে মহাশক্তি-সম্বন্ধে বৈদিক ও তান্ত্রিক তত্ত্বের ব্যঞ্জনা, এবং এর অন্তরে নিহিত রয়েছে শাশ্বত ভারতের মর্মকথা। ......”  

সেসময় মহালয়ার আগের দিনই শিল্পীরা এসে পড়তেন রেডিয়ো স্টেশনে। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে যাঁরা অংশ নিতেন তাঁরা সকলেই মহড়া দিতে আসতেন ক’দিন ধরে। মহড়ার অবসরে চলত চা-পানের বিরতি, নানা রঙ্গরসিকতা, গল্প।

প্রথমবারের অনুষ্ঠানের আগে ঠিক হয়েছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেই সংস্কৃত শ্লোক পাঠ শুরু করবেন, অমনি বাদ্যযন্ত্রীরা তার সঙ্গে স্বরের ওঠানামা অনুযায়ী উপযুক্ত বাজনা বাজাবেন। তিনি যখন বাংলায় ভাষ্যপাঠ করবেন, তাঁরা সঙ্গত করবেন এক একটা শাস্ত্রীয় রাগের গৎ বাজিয়ে। রাইচাঁদ বড়াল সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পীদের। কিন্তু সমস্যা হল শুরু হতে।

অবাঙালি মুসলমান যন্ত্রশিল্পীরা বাংলা আর সংস্কৃতর পার্থক্য বুঝতে না পেরে ভাষ্যের সময়েও শ্লোকপাঠ করার সময় যেমন বাজাচ্ছিলেন তেমন করেই বাজিয়ে যেতে লাগলেনই। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ পাঠের মধ্যেই বুঝলেন, সে ব্যাপারটিও দিব্য জমছে। তিনি ভাষ্যপাঠ করে যেতে লাগলেন গলার স্বর উঁচুনীচু করে। ভাষ্যের সঙ্গে চমৎকার খাপ খেয়ে গেল বাদ্যযন্ত্রীদের সঙ্গত। রাইচাঁদ, নৃপেন মজুমদার আর পঙ্কজকুমার প্রথমদিকে সন্তুষ্ট নয়া হলেও ক্রমেই তাঁরাও বেশ বুঝতে পারলেন জিনিসটা সুন্দর জমছে। তাঁদের ইঙ্গিতে এরপর বাঙালি যন্ত্রশিল্পীরাও সেই তালে তাল দিতে লাগলেন। সর্বাঙ্গসুন্দর রূপ পেল সমবেত প্রয়াস।

প্রথম বছরের দু’ঘন্টার সেই অনুষ্ঠান শুনে মুগ্ধ শ্রোতাদের অকুন্ঠ প্রশংসা আর অভিনন্দনে ভেসে গেলেন প্রয়োজক, শিল্পীরা।

প্রথম কয়েকবার ভাষ্য অংশ পাঠ করা হত স্বাভাবিক কথ্যভঙ্গিতে। সুরে নয়। একবার মহড়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তাঁর নিজস্ব বাচনভঙ্গিতে চণ্ডীপাঠ করছিলেন সুরেলা কণ্ঠে। করতে করতে হঠাৎই কী মনে হল, রসিকতার ছলে বাংলা ভাষ্যটিও স্তোত্রের সুরের মত করে বলতে শুরু করলেন। বাকিরা নড়ে-চড়ে বসলেন। মুখে মৃদু হাসি। বাণীকুমার বসেছিলেন রেকর্ডিং কনসোলে। দ্রুত বেরিয়ে এসে বললেন,

“আরে আরে থামলে কেন? বেশ তো হচ্ছিল! ওই ভাবেই হোক না।”

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ হেসে বললেন,

“আরে না না একটু মজা করছিলাম!”

কিন্তু বাণীকুমার গভীর আগ্রহ নিয়ে বললেন,

“মোটেই না! দারুণ হচ্ছিল! ওইভাবেই আবার করো তো!”

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ আবার শুরু করলেন। এবার সুরে ভাষ্যপাঠ- “দেবী প্রসন্ন হলেন...”। সকলেরই ভাল লেগে গেল।

সুরে, ছন্দ, উচ্চারণে, সাংগীতিক উপাদানের বৈচিত্রের দিক থেকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ যেন সঙ্গীতের এক মহাকাব্য। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সুর-সংযোজনা পঙ্কজকুমার মল্লিকের এক অসামান্য কাজ। প্রথম স্তোত্রটির আধার মালকোষ রাগ, দশ মাত্রায়। রাত্রি তৃতীয় প্রহরের রাগ মালকোষ। রাত থাকতেই সূচনা ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র। তাই অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত এই রাগ। শান্ত, প্রচ্ছন্ন আনন্দের মেজাজ এই স্তোত্রের সুরে।

প্রথম স্তোত্রটির সুরের রেশেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ভাষ্যপাঠের সূচনা। মধ্যসপ্তক থেকে ক্রমশ তারসপ্তকে কন্ঠ বিস্তৃত তাঁর।

‘মহিষাসুরমর্দিনী’র দ্বিতীয় গান বাজল তোমার আলোর বেণু’ ভৈরবী রাগে আধারিত। সূচনা স্তোত্রের মালকোষ রাগে দুটি মাত্র স্বর, কোমল রে ও পা যোগ করলেই পাওয়া যায় ভৈরবী। রাত্রি পেরিয়ে ভোর এসে পড়ছে। তাই রাতের রাগ মালকোষ থেকে ভৈরবীতে বিচরণ সুরে সুরে।  এভাবেই এগিয়ে চলে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সুর পরিক্রমা। অনুষ্ঠানের শেষ দিকে ‘রূপং দেহি’ শুরু হয় সমবেত কন্ঠে। পঙ্কজকুমার মল্লিক তাঁর একক অংশে নিজের কণ্ঠটি তুলে নিয়ে যান তারসপ্তকের এক অশ্রুতপূর্ব স্তরে। স্বরপ্রক্ষেপণে ধরা দেয় আজানের সুর।

‘রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি’-র পরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পাঠ যখন আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় তখন যে গানটিতে ধরা পরে ভোরের আশ্চর্য সুন্দর, স্নিগ্ধ রূপ, সেই শেষ গান- ‘শান্তি দিলে ভরি দুখরজনী গেল তিমির হরি’-তে সুর আর এক অসামান্য গুণীজন, উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ-র।

তানপুরা, ভাইব্রাফোন, স্বরমণ্ডল ও নানাবিধ যন্ত্রের স্থির, অনুচ্চ প্রয়োগ ভাষ্যের নেপথ্যে । ওজস্বী কন্ঠের সুললিত ভাষ্যপাঠে অসামান্য পরিমিতিবোধ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের। সম্পূর্ণ সুরে ও ছন্দে থেকেও কখনও গান গেয়ে ওঠার উপক্রম করেননি। আবার ভক্তিগদগদ চিত্তেও পাঠ করেননি। তাঁর কন্ঠের দৃপ্ত মেদহীন, ঋজুতা ভাষ্যকে আলাদা চরিত্র দিয়েছে। শুধু সুরে অবস্থিত থেকে সমগ্র সঙ্গীতের আবহের সঙ্গে সাযুজ্য রক্ষা করে গেছেন তিনি।  তাঁর ভাষ্যপাঠ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র প্রাণ, বেতার সম্প্রচারের ইতিহাসে একটি আলাদা ঘরাণা। আর অন্তরালের সুনিপুণ পরিচালক বাণীকুমার।

মাত্র একবারই মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র সম্প্রচার বন্ধ হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে। দেশে তখন জরুরী অবস্থা। দিল্লি থেকে নির্দেশ এল, চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র পরিবর্তে নতুন অনুষ্ঠান করা হোক।  আকাশবাণীর কর্তৃপক্ষ ঠিক করলেন অন্য কিছু করা যাক। ভাষ্যে উত্তমকুমারকে রাখা হোক। মিটিং হল। সেই মিটিং-এ  বাদ পড়লেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বাদ পঙ্কজ কুমার মল্লিক-ও। এর কিছুদিন আগেই, দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর আকাশবাণীর ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ পরিচালনা করার পর সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাঁকে। এই নতুন উদ্যোগ তাঁদের অগোচরেই শুরু হয়েছিল। বাণীকুমারকে অবশ্য এসব দেখতে হয়নি। ১৯৭৪ সালেই প্রয়াত হয়েছেন তিনি। 

নতুন স্ক্রিপ্ট লিখলেন অধ্যাপক ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। সঙ্গীত রচনায় শ্যামল গুপ্ত। সঙ্গীত পরিচালনায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীতে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী সেনগুপ্ত, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, অসীমা ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, অপর্ণা সেনগুপ্ত, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে। স্তোত্ররচনা ও পাঠে ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় এবং মাধুরী চট্টোপাধ্যায়। বাংলা ও সংস্কৃত ভাষ্যপাঠে উত্তমকুমার, বসন্ত চৌধুরী, পার্থ ঘোষ, ছন্দা সেন ও রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।

১৯৭৬-এর ২৩শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র বদলে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে উঠল বিকল্প অনুষ্ঠান- ‘দেবীং ‘দুর্গতিহারিণীম্’। সে অনুষ্ঠান চূড়ান্ত ফ্লপ।

উত্তমকুমার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়- আপামর বাঙালির প্রিয় এক সোনালি জুটি। কত মনের মত ছবি, মনে রাখার মত গান দু’জনে মিলে! কিন্তু অন্তত সেই একবার, বাঙালির প্রাণের আবেগের কাছে হেরে গিয়েছিল এই জুটি। হারিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। হারিয়েছিলেন অন্তরালে থাকা পঙ্কজ কুমার মল্লিক আর বাণীকুমার। সেই ১৯৭৬-এ। 

বোম্বে আর কলকাতার নামীদামী শিল্পী অনুষ্ঠানে- ‘তবু ভরিল না চিত্ত’। বহু প্রত্যাশিত  ‘মহিষাসুরমর্দিনী’  শুনতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়লেন মানুষ। সকালবেলায় রেডিয়ো স্টেশনের গেটে অগুন্তি লোক।  ভাঙচুরের উপক্রম। কেন বন্ধ হল মহিষাসুরমর্দিনী, তার জবাবদিহি চাই। পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড়। শেষে সে বছর ষষ্ঠীর সকালে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুনিয়ে শান্ত করা হল জনরোষ।

শোনা যায়, উত্তমকুমার নিজে ভাষ্যে অংশ নেবার দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কাছে গিয়ে নিজের অস্বস্তি আর অযোগ্যতার কথা বলেছিলেন। তাঁকে আশ্বস্ত করে উৎসাহ দিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বলেছিলেন,

“আমি তো অমর নই, একদিন না একদিন অন্যদের তো এগিয়ে আসতেই হবে এ কাজে।” 

আসলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অভিমান ছিল আকশবাণী কর্তৃপক্ষের ওপর। ভোর হবার আগে রাত্রিবেলাতেই বেতারকেন্দ্রে চলে আসতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত থেকে তারপরে বাড়ি যেতেন। রেকর্ডেড অনুষ্ঠান চালু হলেও এ অভ্যাস তিনি চালিয়ে গেছেন বরাবর। কিন্তু ১৯৭৬ সালের পর থেকে তিনি আর কখনও মহালয়ার আগের রাত্রিবেলা আকাশবাণী যাননি। অভিমান করে বলেছিলেন,

 “ওরা একবার আমায় জানালোও না। আমি কি নতুন কিছুকে কোনও দিন বাধা দিয়েছি?” 

আশ্চর্যের কথা, যখন শুনলেন, মানুষের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে আবার সম্প্রচার হবে, তখন অভিমান, ক্ষোভ সব ভুলে আবার কাজে নেমে পড়েছিলেন। 

আর ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’-এর অশেষ দুর্গতি-র পরে উত্তমকুমার নিজে বলেছিলেন,

‘‘ঠাকুর ঘরকে রিনোভেট করে ড্রয়িং রুম বানালে যা হয়, তাই-ই হয়েছে।’’

‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সংগীত আলেখ্যটি রচনা ও সম্প্রচারের মাধ্যমে বাণীকুমার যে অসামান্য কাজটি করেছিলেন, রেডিয়োর সেইসময়ের স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপকুমার সেনগুপ্ত সে প্রসঙ্গে বলেছেন,

“বাণীকুমার যদি আর কোনো কাজ নাও করতেন, তাহলেও শুধু ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র জন্যই মানুষ তাকে মনে রাখত। ...... শাজাহান যেমন তাজমহল গড়েছিলেন, যা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের একটা হয়ে আছে, আমাদের বাণীদা হাওয়ায় তাজমহল গড়ে গেলেন, যা মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

এ যে কত বড় সত্যি, বাংলার অনেকগুলো প্রজন্ম অন্তর দিয়ে তা জানে। এখনও মহিষাসুরমর্দিনী ছাড়া বাঙালির দেবীপক্ষের আগমনী গান অসম্পূর্ণ। বাণীকুমারের লেখা ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’-র সুর সুপ্রীতি ঘোষের কন্ঠে ইথারতরঙ্গে ছড়িয়ে পড়তেই মনে হয় পুজো এসে গেল!

হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, ফেসবুক, ট্যুইটারের জগতের বাইরে এই একটা দিনে রেডিয়োর মনোপলি। নস্ট্যালজিক প্রৌঢ়দের কাছে তো বটেই, হয়তো জেন ওয়াই-এর কাছেও। সারা বছরের দুয়োরাণী রেডিয়োর খোঁজ পড়ে ঠিক মহালয়ার আগে। আলমারির মাথা থেকে যত্ন করে নামানো। ঝেড়ে-মুছে রাখা। নতুন ব্যাটারি লাগিয়ে চালিয়ে দেখা। ইউটিউবে বা সিডি-তে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ থাকলই বা! ভোরের নরম আলো ফোটার আগের হাল্কা ঠাণ্ডার আমেজ-মাখা শরতের ভোরে আকাশবাণীর সম্প্রচারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠ আর চিরকালের প্রিয় অসামান্য কিছু গানের যুগলবন্দীর উত্তেজনা, হঠাৎ কোনোবার ভোরের অ্যালার্মের বিশ্বাসঘাতকতায় আশেপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসা চণ্ডীপাঠে ঘুম ভাঙার পর ‘ইস, শুরুটা শোনা হল না’-র আক্ষেপ- এই সব কিছু নিয়ে মহালয়ার ছবি আজও অমলিন। এ ছবি চিরকালীন।

ছোটবেলায় শরতের ঝকঝকে নীল আকাশটা দেখলেই মনের মধ্যেও একদল মেঘ খুশিতে আমাদেরই মতো হুটোপাটি করে উঠত। তখনই একদিন ভোরবেলা বেজে উঠত এক অপার্থিব আলোর বেণু। মন্দ্রকন্ঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের উচ্চারণে যেন কৈলাস থেকে আশ্চর্য নীলকন্ঠ পাখিটি উড়ে আসত শারদপ্রাতে। আসতেন মা দুগগা।

আজ যখন শরতের মিহি হিম, পাল্টে যাওয়া রোদ্দুরের রং জানান দেয় মহিষাসুরমর্দিনী আসছেন, এক অজানা মনখারাপ ছেয়ে ফেলে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করি, চার পাশে প্রিয় মানুষ যত আছে, তার চেয়ে বড় কম নয়, যারা আর আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই। আজ শরতে আমার মহালয়া মানেই এক রকমের মনখারাপের অতীতে ফেরা।

শরৎ এলে হারিয়ে যাওয়া সবাই নাকি ফিরে আসে। শরতের রোদ্দুর হয়ে, শরতের আলোর রথে চড়ে, হিম-ছোঁয়ানো বাতাস হয়ে। এই ফিরে আসাটাই বোধহয় মহালয়া। এ মহালয়ায় কোনও আনুষ্ঠানিকতা থাকে না। গঙ্গা আর পুরুতমশাই থাকে না। শুধু শরতের আকাশ-বাতাসে ভেসে থাকা অদৃশ্য অতীতের ছোট ছোট কণাই অমোঘ মন্ত্র হয়ে ওঠে। ভেজা ঘাসের ওপর আলতো বিছিয়ে থাকা ফেলা আসা সময় আমাকে ত্রাণ করে। তাতে সবার অলক্ষ্যে মিশে থাকে কিছু সুর, কিছু ছন্দ, উচ্চারণ, অনুভব। বড় অনিবার্যভাবে থাকেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সেই নীলকন্ঠ পাখিটি নিয়ে।

তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা: 
‘মহিষাসুরমর্দিনী’: বাণীকুমার
শ্রীমতী আরতি মুখোপাধ্যায়



লেখক পরিচিতি - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এখন আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা। আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রথম বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।