শরদিন্দু সংখ্যা

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , এপ্রিল ৩০, ২০১৫
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্প এবং কিছু কথা
অভীক দত্ত
একজন পাঠক হিসেবে আমি কখনও কখনও খুব অলস। অফিস থেকে ফিরে বই খুলে বসলে সাধারণত হালকা বইপত্তর পড়া পছন্দ করি। তখন দেখেছি বেশি কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে ইচ্ছা করে না। ভাষার মারপ্যাঁচ তো ছেড়েই দিলাম। কায়দার জিনিস এড়িয়ে যাই সেই সময়টা।
আর ছুটির দুপুরে আরাম করে বসে কোন বই খুলে বসব জিজ্ঞেস করলেও হয়ত একই উত্তর দিতাম- শরদিন্দু। গল্প আরও এই কারণে যে গল্পগুলিতে চমৎকার সমাপ্তি আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রেম কিংবা রহস্য
কিংবা প্রেতের বিষয় বরাবরই আমার পছন্দের জিনিস। আর তা যদি শরদিন্দুর হয় তাহলে তো কথাই নেই। বিষয় বৈচিত্র্য কিংবা ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আকর্ষণীয় আখ্যান রচনার ক্ষেত্রে শরদিন্দু অতুলনীয়। পাঠক অপছন্দ করবেন, এমন কাজ শরদিন্দু খুব কম করেছেন। সাবলীল সহজ ভাষায় লিখে যাওয়া গল্পগুলি বারবার পড়া সত্ত্বেও মজলিসি কায়দায় গল্প বলার কারণে চুম্বকের মত আকর্ষণ করে।
এবার কথা হল “সাহিত্যই সমাজকে প্রতিফলন করে”, এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে যদি লেখা পড়তে বসি তাহলে বেশ কিছু ব্যাপার চোখে পড়ে যায়। “ডমরু চরিত” পড়ার সময় যেমন দেখেছি সেই সময় বিধবাদের সম্পর্কে ঠিক কি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলতেন তৎকালীন সাধারণ মানুষেরা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “দোরোখা একাদশী”তেও বিধবাদের করুণ অবস্থার বর্ণনা পেয়েছি। আরও অসংখ্য অগণিত লেখা, যা বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে, তা সেই সময়কে ধরতে সফল হয়েছে এ নিয়ে কোন দ্বিধা নেই। শরদিন্দুর গল্প পড়লে দেখা যাবে কোন কোন গল্পে গল্পের মূল পুরুষ চরিত্রের দুবার বিয়ে করা খুব স্বাভাবিকভাবে এসেছে। যে বিষয়গুলি কিংবা পরিণতির ক্ষেত্রে তিনি যে সময়টাকে ধরেছিলেন, তখন এই ব্যাপারগুলি খুব স্বাভাবিক ছিল সেটা তাঁর গল্প পড়লে বোঝা যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে তাঁর আধুনিক মননের পরিচয়ও পেয়েছি বিভিন্ন গল্পে। প্রেত, রহস্য, পৌরাণিক... বিষয়বৈচিত্র্যে খুব কম বাঙালি গল্পকারই শরদিন্দুর ধারে কাছে আসতে পারবেন । এবং তাঁর ধারাবাহিকতা। গল্প সমগ্রের প্রথম গল্প এবং শেষ গল্প (যা শরদিন্দুর লেখালেখির টাইমলাইন হিসেবেই সম্পাদিত হয়েছিল) পড়লে বোঝা যাবে সময়ের সাথে সাথে তিনি কিভাবে নিজেকে ভেঙে নিয়ে কিভাবে আরও নিখুঁতভাবে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন। আজকালকার দিনে অনেক প্রবীণ লেখকদের মধ্যেই এইরকম উপরের দিকে উঠতে থাকা সরলরেখায় নিজেকে তুলে রাখা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। যেটা শরদিন্দুর ক্ষেত্রে কখনোই ঘটে নি। কম করে এবং এক বাক্যে বললে বলা যায়,আমাদের মত পাঠকের কাছে শরদিন্দু আসলে এক মণি মুক্তোর খনি। আমরা যত ভিতরে প্রবেশ করেছি, তত আমাদের মুগ্ধতার পরিমাণ বেড়েছে।
প্রেমের কাহিনীগুলির ক্ষেত্রে বলতে পারি আমার পরিষ্কার মনে আছে যখন মাধ্যমিকের পর বাড়ির বড়দের বইয়ের আলমারি থেকে বই পড়ার ছাড়পত্র পেয়েছিলাম, তখন শরদিন্দুর প্রেমের কাহিনী আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়ে যেত। সে সময়টা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি রোমান্টিকতা থাকে। সেসময়ে “বিজ্ঞাপন বিভ্রাট”, “কানু কহে রাই”, “মনে মনে” “নারীর মূল্য” ইত্যাদি গল্প আমার কল্পনাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করত। এবার আপনি একটা প্রশ্ন করতেই পারেন। যে এখন, এত বছর পরেও এই গল্পগুলি আমাকে সেই একইভাবে নাড়া দেয় নাকি? আমি বলব সেই অনুভূতিগুলি অনেকটাই হারিয়ে গেছে, কিন্তু গল্পগুলি পড়ার পরে যে ভাললাগার রেশটা থেকে যায় সেই রেশটা প্রথম পাঠের সাথে এখনও অপরিবর্তিতই রয়েছে।
আসুন তাঁর একটা গল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক। এক অদ্ভুত গল্প “আলোর নেশা”।
গল্পের শুরুতে একটা ভূমিকা দিয়ে গল্প শুরু করা তার সমসাময়িক গল্পকারদের মত শরদিন্দুও করেছেন। “আলোর নেশা”র ভূমিকাটা পড়া যাক:
“আমরা ‘আরও আলো’ ‘আরও আলো’ করিয়া গ্যেটের মতো খুঁজিয়া বেড়াইতেছি; কিন্তু হঠাৎ তীব্র আলোর সাক্ষাৎকার ঘটিলে চট করিয়া চোখ বুজিয়া ফেলি। অনাবৃত আলোকের উদ্র দেবসুরা আকণ্ঠ পান করিতে পারি না; নেশা হয়, টলিতে টলিতে আবার নর্দমার অন্ধকারে হোঁচট খাইয়া গিয়া পড়ি। আলোকের ঝরনা-ধারায় ধৌত হইবার প্রস্তাবটা মন্দ নহে, কিন্তু ঝরনার তোড়ে ডুবিয়া মরিবার আশঙ্কা আছে কিনা, সে দিকেও লক্ষ্য রাখা উচিত।
একরাশ এলোমেলো উপমার মধ্যে আসল কথাটা জট পাকাইয়া গেল। ইহাকেই বলে ধান ভানিতে শিবের গীত”।
সাধু ভাষার আলাদা মিষ্টত্ব আছে সে নিয়ে তো কোন কথা হবে না। কিন্তু শরদিন্দুর সাধু ভাষা অতুলনীয়। লেখার মধ্যে লুকানো থাকে একটা হালকা মজলিসি ভঙ্গি, তার সাথে মজা, মাঝে মাঝে আমার বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় কিংবা প্রভাতকুমারের কথা মনে পড়ে যায়, জানিনা বাকি পাঠকের সেটা মনে পড়ে নাকি। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, এই “আলোর নেশা” গল্প মূলত একটা ব্যর্থ প্রেমের গল্প। গল্পের মূল চরিত্র এক ছেলে যার নাম হারাণ, যার সম্পর্কে লেখক বলছেন:
“হারাণ নাম শুনিয়া ঘৃণায় শিহরিয়া উঠিবেন না। সে বাঙালি যুবক-সম্প্রদায়ের মূর্তিমান নমুনা,- অর্থাৎ তাহাকে দেখিলেই বাঙালী যুবক বলিতে কি বুঝায়, তাহা মোটামুটি আন্দাজ করিয়া লওয়া যায়। সে কলেজে পড়ে, সে রোগা ও কালো, লম্বাও নহে, বেঁটেও নহে। সে বুদ্ধিমান, কিন্তু বুদ্ধির লক্ষণ মুখে কিছু প্রকাশ পায় না। মুখখানি ঈষৎ শীর্ণ, চোখে একটা অস্বচ্ছন্দ সঙ্কোচের ভাব; কখনো কখনো আঘাত পাইয়া তা রূঢ়তার শিখায় জ্বলিয়া ওঠে। বাঙালির মজ্জাগত অভিমান – sensitiveness – চারিদিক হইতে খোঁচা খাইয়া যেন একই কালে ভীরু ও দুঃসাহসী হইয়া উঠিয়াছে। শিক্ষার ধারা যে পথে গিয়াছে, সহবৎ সে পথে যাইতে পারে নাই- তাই মনটা তাহার আশ্রয়হীন নিরালম্ব হইয়া আছে”।
অসামান্য বর্ণনা। শুনে যেন হারাণ আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠল। এক অনবদ্য ভঙ্গিমায় এ গল্প এগিয়ে গেছে। গল্পে হারাণ এক উচ্চ বংশীয়া মেয়ের গাড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট করে এবং যথারীতি সে মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। বারবার সে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে বিফল মনোরথ হয় এবং গল্পের শেষে গিয়ে দেখা যায় ব্যর্থ প্রেমের প্রতিশোধ সে কিভাবে নেয়।
গল্পের গতি বজায় রাখা, তা বলার ভঙ্গি এবং একই সাথে সিনেমার মত করে বলে যাওয়া, এ বড় সহজ কাজ নয়। গল্পের পরিণতি যেভাবে শরদিন্দু এঁকেছেন গল্পটিতে হারাণকেও শুরু থেকেই আমাদের সেভাবেই যেন উপস্থাপিত করেছেন। শুরু থেকেই যেন হারাণ তার অ্যাপিয়ারেন্সে “বিয়ের আগে সারেন্ডার আর প্রেমের আগে লেঙ্গি” ভাব নিয়ে চলেছিল, যেন এই পরিণতিই তার হবার ছিল, আর কিছু নয়। এ গল্পের শেষ প্যারাটাও তুলে দেবার লোভ সংবরণ করা গেল না:
“দেয়ালীর সময় অসংখ্য পোকা পুড়িয়া মরিতে দেখিয়া মনে হয় বুঝি পোকার বংশ নিঃশেষ হইয়া গেল, পৃথিবীতে আর পোকা নাই। পরের বৎসর আবার অসংখ্য পোকার আবির্ভাব হয়- যুগে যুগে এই চলিতেছে। আলো যতদিন আছে ততদিন পতঙ্গ পুড়িয়া মরিবে। দোষ কাহার?”
তবে শরদিন্দুকে আলোচনা করা খুব কঠিন কাজ। একটি দুটি লেখা তুলে ওনাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করা বোকামি। আর এই প্রেমের গল্প, ভূতের গল্প দিয়ে সেই ছোট বেলার শুকতারার মত আলাদাও করা যাবে না
শরদিন্দুকে। নইলে বলুন না “বহুবিঘ্নানি” “তিমিঙ্গিল” “ঘড়িদাসের গুপ্তকথা” “মটরমাস্টারের কৃতজ্ঞতা” “বক্কেশ্বরী” “ভাই ভাই” “সুন্দরী ঝর্ণা” “চিড়িকদাস” “আরবসাগরের রসিকতা” এই গল্পগুলিকে কোন ক্যাটাগরিতে ফেলা যায়? সম্পাদক মহাশয়েরা তো পাগল হয়ে যাবেন এই ভদ্রলোকের গল্পগুলিকে আলাদা করতে দিলে। তার চলচ্চিত্র জীবনের কথাও যেমন তিনি লিখেছেন “চলচ্চিত্র প্রবেশিকা”য়। এই লেখাগুলি প্রত্যেকটা প্রত্যেকটা থেকে আলাদা, প্রত্যেকেই স্বকীয়তায় উজ্জ্বল এবং একথা বলতেই হয় তাঁর প্রথম থেকে শেষ গল্প অবধি শরদিন্দুবাবুর ধারাবাহিকতা ঈর্ষণীয়।
হাস্যরসাত্মক গল্প কিংবা ভূতের গল্পেও তিনি অনবদ্য। বরদার ওই প্রেতযোনি নিয়ে অনবদ্য ভঙ্গিমায় গল্প বলা কখনোই ভোলা যাবে না। আর আমার কাছে আদিম, বীর্যশুল্কা ইত্যাদি ঐতিহাসিক গল্পও ভীষণ প্রিয়।
আর যে গল্পটা আমার কেন জানি না, সব থেকে ভাল লেগেছিল সে বয়সে, সেটা হল “কামিনী”। কি কারণ সেটা এখন বুঝতে পারি। গল্পটা পড়ার সময় আমার মধ্যে এক অদ্ভুত শিরশিরানি কাজ করেছিল, যেটা ভয় আর যৌন উত্তেজনার মধ্যে কাকে ছুঁই কাকে ছুঁই করে গেছিল। বেশ কয়েকবছর পরে আবার পড়লাম। অনুভূতিটা দেখলাম সেই একই থেকে গেছে।
লেখক পরিচিতি - পেশায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আর ভালবাসা সাহিত্য। 'আদরের নৌকা' লিটল ম্যাগের সম্পাদক। মূলত গদ্যকার। প্রকাশিত গ্রন্থ- এক কুড়ি গল্প, কেউ কোথাও যাবে না।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।