শরদিন্দু সংখ্যা
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , এপ্রিল ৩০, ২০১৫
ব্যোমকেশের ‘সখা’, সত্যবতীর ‘ঠাকুরপো’
ভাস্কর বসু
লেখাটা শুরু করেই মনে পড়লো আমার শরদিন্দু প্রেম এর সূত্রপাত এর ঘুটনাটি। ১৯৭০ সালে শরদিন্দু মারা যাওয়ার পর শুরু হল শরদিন্দু অমনিবাস বেরোন। প্রথম খন্ডেই ব্যোমকেশের গল্প। তখনো বয়স দুই-সংখ্যায় যায়নি, কিন্তু বই নিয়ে টানাটানি শুরু করেছি। বাড়ীতে বাবা ও কাকা আদ্যন্ত শরদিন্দুপ্রেমী, তাঁদের কাছে শরদিন্দু পড়ার উৎসাহ পেলাম। কিন্তু উৎসাহ আরো বাড়াল ‘আকাশবাণী কলকাতা’!! তক্ষুনি তাঁরা শুরু করলেন ব্যোমকেশ নাটকের প্রচার, প্রতি রবিবার। ব্যোমকেশের ভূমিকায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, অজিত সম্ভবত শৈলেন মুখোপাধ্যায়। নাটক শুনেই পড়ার কৌতূহল বেড়েই গেল, পড়তে থাকলাম আর ডুবতে থাকলাম, চোরাবালির মধ্যে।
সদ্যপ্রয়াত গুণী পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ অনেকের মত আমারও খুব প্রিয় পরিচালক। কিন্তু শরদিন্দুর ‘চোরাবালি’ অবলম্বনে সে কাহিনীচিত্রটি করেছিলেন তা আমার একেবারেই মনঃপূত হয়নি। অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ, ব্যোমকেশকে ছাপিয়ে অজিতের প্রাধান্য। অন্য এক পরিচালক, অঞ্জন দত্তও, তাঁর পরিচালিত ব্যোমকেশ কাহিনীচিত্রগুলিতে অজিতকে ভালোই গুরুত্ব দিয়েছেন এবং সেই ভূমিকাতে অভিনয় করে অভিনেতার বেশ কিছু পুরস্কারও লাভ হয়ে গেছে। প্রখ্যাত পরিচালক বাসু চ্যাটার্জী যখন হিন্দী দূরদর্শনে করছিলেন ব্যোমকেশ, তখনো লক্ষ করেছি অজিত চরিত্রটি অনেকেরই মন কেড়েছিল। ঋতুপর্ণ হয়তো একটু বেশীমাত্রায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকবেন, তাই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলেন। কিন্তু আপামর ব্যোমকেশপ্রেমী বাঙালীর অজিতপ্রেম ও কিছু মাত্রায় কম নয়।
সুকুমার সেন লিখেছেন –
“অজিত কিন্তু ওয়াটসনের বাংলা সংস্করণ নয়। হোমস ও ওয়াটসনের মধ্যে বয়সের তফাৎ ছিল, মানসিক বৃত্তিতে অসমতা ছিল। অজিত ব্যোমকেশের প্রায় সমান বয়সী তাহাদের মনোবৃত্তি সমান ভূমির!”
ক্ষেত্র গুপ্ত লিখেছেন –
“আপাতদৃষ্টিতে অজিতের গুরুত্ব সবসময় ঠিক ধরা যায় না। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে তার অভাব যে অনেকটা তা অনুভব করা যায়। আসলে শরদিন্দু নিজেকে দুই ভাগ করে ব্যোমকেশ আর অজিতকে গড়েছেন। একজন দর্শক ও লেখক, অন্যজন নায়ক। দর্শক-লেখক চলে যাওয়ায় নায়ক নিজেকে একা বলে নিশ্চয় মনে করবে।”
তবে অজিত সম্পর্কে যে বিশেষণটি আমার সবচেয়ে মনোগ্রাহী লেগেছে, তা দিয়েছেন আরেক বরেণ্য সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধায়, -
“ব্যোমকেশের বয়স বাড়ছে, বয়স বাড়ছে অজিতেরও। সে যে ব্যোমকেশের ‘সুবল সখা’, বন্ধুর কীর্তি লিখে লিখে তার বন্ধুকে বিখ্যাত করে তুলেছে”!
বস্তুতঃ বেশ কিছু প্রাবন্ধিকের শরদিন্দু সংক্রান্ত লেখা পড়ে এবং আরো কিছু সাহিত্য-মনস্ক মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে মনে হয়, ‘ব্যোমকেশ’ চরিত্রের উপর যদি বা পৃথিবীর অন্য ডিটেকটিভ চরিত্রের ছায়া থেকেও থাকে, অজিত একেবারেই শরদিন্দুর নিজস্ব সৃষ্টি। ‘সত্যান্বেষী’ গল্পে সে যখন নিজের পরিচয় দেয় ------
“পয়সার বিশেষ টানাটানি ছিল না, পিতৃদেব ব্যাঙ্কে যে টাকা রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার সুদে আমার একক জীবনের খরচা কলিকাতার মেসে থাকিয়া বেশ ভদ্রভাবেই চলিয়া যাইত। তাই স্থির করিয়াছিলাম, কৌমার্য ব্রত অবলম্বন করিয়া সাহিত্যচর্চায় জীবন অতিবাহিত করিব”।
ওঃ! এই প্রথম পরিচয়তেই একেবারে কেল্লা ফতে। এক্কেবারে তিনি বাঙালীর সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটিতে ঘা দিয়ে ফেলেন আর তখনই সাহিত্যচর্চা প্রেমী বাঙালী ঈর্ষাতুর হয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলে। যে চরিত্রের প্রতি স্রষ্টার এমন দরদ, শক্তিশালী স্রষ্টার কলমের জোরে তা মননশীল পাঠকের মনেও বেশ দানা বেঁধে যায় আর সেই কারণে ঋতুপর্ণকে ও পুরোপুরি দোষ দিতে পারিনা, তাঁর অত্যধিক ‘অজিত-মনস্কতা’র জন্য,- অল্প-বিস্তর আমরা সবাই যে সেই দোষে দোষী।
অজিতকে সাহিত্যিক করে শরদিন্দু একটি অসাধারণ বাজি জিতে ফেললেন। অজিতের হাত ধরেই কাহিনীতে আসতে শুরু করে সাহিত্যর যাবতীয় অসাধারণ উপকরণ আর তা বাঙালী পাঠকের মননে দারুণ প্রভাব সৃষ্টি করে। সাহিত্যিক হিসেবে মাঝে মাঝে তাকে ব্যোমকেশের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, ‘অর্থমনর্থম’ গল্পে দেখছি ব্যোমকেশ জিগ্যেস করে অজিতকে-
- “তুমি তো একজন সাহিত্যিক, বল দেখি Thimble এর বাংলা কি?
আমি আশ্চর্য হইয়া বলিলাম – “Thimble ? যা পরে দর্জিরা সেলাই করে?” - হ্যাঁ!
আমি ভাবিতে ভাবিতে বলিলাম - অঙ্গুলিত্রাণ হতে পারে – কিম্বা –সূচীবর্ম!
ব্যোমকেশ বলিল – ‘ওসব চালাকি চলবে না, খাঁটি বাংলা প্রতিশব্দ বল।’
স্বীকার করিতে হইল, বাংলা প্রতিশব্দ নাই, অন্ততঃ আমার জানা নাই।”
খুব সূক্ষ ভাবে এমন একটি বিষয়ের অবতারণা করা হল যা মনস্ক পাঠককে ভাবাবে আর মুগ্ধ করবে, হয়তো গোয়েন্দা গল্পের সঙ্গে তার সেভাবে কোন যোগাযোগ না থাকা সত্বেও। সাহিত্যিক অজিতের প্রতি কিন্তু ব্যোমকেশ আবার গভীর শ্রদ্ধাশীলও। অগ্নিবাণ গল্পে এর শেষ পর্বে এসে আমরা দেখেছি যে ব্যোমকেশ তার কাহিনী শেষ করে অজিতকে বলছে –
“ ‘অজিত, তুমি তো লেখক, দেবকুমারবাবুর এই ব্যাপারের মধ্যে একটা প্রকান্ড রূপক দেখতে পাচ্ছ না ? মানুষ যেদিন প্রথম অন্যকে হত্যা করবার অস্ত্র আবিষ্কার করেছিল, সেদিন সে নিজেরই মৃত্যুবাণ নির্মাণ করেছিল; আর আজ সারা পৃথিবী জুড়ে গোপনে গোপনে যে হিংসার কুটিল বিষ তৈরী হচ্ছে, এও মানুষ জাতটাকে একদিন নিঃশেষে ধ্বংস করে ফেলবে - -ব্রহ্মার ধ্যান-উদ্ভুত দৈত্যের মত সে স্রষ্টাকেও রেয়াৎ করবে না। মনে হয় না কি?’
ঘর অন্ধকার হইয়া গিয়াছিল, ব্যোমকেশকে ভাল দেখা যাইতে ছিল না। আমার মনে হইল, তাহার শেষ কথাগুলো কেবল কল্পনা নয় – ভবিষ্যদ্বাণী।”।
কাহিনীর শেষাংশে আমরা অভিভূত হয়ে যাই, ভুলে যাই এটি আসলে একটি গোয়েন্দা গল্প। কারণ ছোট গল্পের সেই “শেষ হইয়াও না হইল শেষ”, আস্বাদটুকু যে আমাদের মনে থেকে যায়। আর তার জন্য সাহিত্যিক অজিত অনেকটাই কৃতিত্ব দাবী করতে পারে।
আবার অজিত থাকার ফলে ভাষার সীমাবদ্ধতা প্রকাশের ও একটা সুযোগ আসে। ‘চিত্রচোর’ গল্পে কেন ছবি চুরি করত অপরাধী তার কারণ হিসেবে ব্যোমকেশ ব্যাখ্যা করে-
“অজিত, তুমি তো লেখক, শুধু ভাষার দ্বারা একটা লোকের এমন হুবহু বর্ণনা দিতে পার যাতে তাকে দেখলেই চেনা যায়? – পারবে না; বিশেষতঃ তার চেহারা যদি মামুলী হয় তাহলে একেবারেই পারবে না। কিন্তু একটা ফটোগ্রাফ মুহূর্তমধ্যে তার চেহারাখানা আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরতে পারে।”
অজিতের সাহিত্যিক সঙ্গ একেবারে যে গোয়েন্দার রহস্যভেদে কাজে লাগেনি তা নয়। সাহিত্য অর্থাৎ মহাকাব্য ‘সত্যান্বেষী’ কে পথ দেখিয়েছে ‘দুর্গ রহস্য’ গল্পে। গল্পে জানা গেল রামকিশোরবাবুর পূর্বপুরুষ রাজা রাজারাম গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে গেছেন এইভাবে –
“যদি আমি বা জয়রাম বাঁচিয়া না থাকি আমাদের তামাম ধনসম্পত্তি সোনাদানা মোহনলালের জিম্মায় গচ্ছিত রহিল।”।
কিন্তু কে এই মোহনলাল, ব্যোমকেশ খুবই চিন্তায় পড়ে। রহস্যের সমাধানে ‘মোহনলালে’র স্বরূপ প্রকাশ একান্ত প্রয়োজনীয়।
“মোহনলাল কেমন জীব? আমিও প্রথমটা কিছু ধরতে পারছিলাম না। তারপর অজিত হঠাৎ একদিন ‘পলাশীর যুদ্ধ’ আবৃত্তি করল- ‘আবার আবার সেই কামান গর্জন – গর্জিল মোহনলাল--’। কামান – মোহনলাল। সেকালে বড় বড় বীরের নামে কামানের নামকরণ হত। বিদ্যুতের মত আমার মাথায়় খেলে গেল মোহনলাল কে! কার জিম্মায় সোনাদানা আছে। ঐ যে মোহনলাল’। ব্যোমকেশ অঙ্গুলি দিয়া ভূমি শয়ান কামানটি দেখাইল।”
পাকেচক্রে অজিত হয়ে গেল সত্যবতীর ঠাকুরপো কিন্তু ‘অর্থমনর্থম’ গল্পতে, যেখানে সত্যবতীর সঙ্গে আলাপ তাদের, সেখানে কিন্তু অন্যরকমই ছিল। যখন ব্যোমকেশ ‘সত্যান্বেষণে’ যাচ্ছে, তখনই সে সাবধান করে অজিতকে, -
“খবরদার! তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড়, অর্থাৎ সম্পর্কে তার ভাশুর। ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলবে না। এবার থেকে আমিও তোমায় দাদা বলে ডাকব।”
অজিতও তাকে আশীর্বাদ করে,
“ বেশ দাদাই হলুম তাহলে --- আশীর্বাদ করি, সত্যের প্রতি তোমার যেন অবিচলিত ভক্তি থাকে।”
এরপর কিন্তু অনেকদিনের ব্যবধান, প্রায় পনের - ষোল বচ্ছর!! অনেকদিন শরদিন্দু লেখা বন্ধ রেখেছিলেন। কারণ –
“ব্যোমকেশের দশম গল্পে সত্যবতীর সঙ্গে তার বিয়ে হল। আমি ভাবলাম বিয়ে হলে বাঙালীর ছেলের আর পদার্থ থাকেনা। তাই তাকে তখনই রিটায়ার করিয়ে দিয়েছিলাম। ষোল বচ্ছর আর লিখিনি। তারপর কলকাতায় এসেছিলাম কিছুদিন। সে সময় অনেকে আমাকে ধরলেন, আবার লিখুন। যখন দেখলাম, আজকালকার ছেলেমেয়েরা চায়, তখন আবার লিখতে শুরু করলাম।”
কাজেই “চিত্রচোর” গল্পে যখন দেখি সম্পর্ক পালটে গেছে, সেটা সম্ভবত শরদিন্দুর নিজের অজ্ঞাতসারেই। প্রথম ‘ঠাকুরপো’র আবির্ভাব সেই খানেই। গল্পের শুরুতেই দেখি, অসুস্থ ব্যোমকেশকে সত্যবতী মুর্গীর সুরুয়া আর টোস্ট খাওয়ানোর কথা বলছে। ব্যোমকেশ যখন বিরস-বদনে জিজ্ঞেস করে,
মুর্গীটা খাবে কে?
“সত্যবতী মুখ টিপিয়া বলিল – ‘ঠাকুরপো’।
আমি তাড়াতাড়ি বলিলাম – ‘শুধু ঠাকুরপো নয়, তোমার অর্ধাঙ্গিনীও ভাগ পাবেন।’”
ব্যাস!! দুটি মাত্র ছোট্ট বাক্যের মধ্যে দিয়ে এক শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক এমন এক সম্পর্কের সৃষ্টি করলেন, বিশ্বসাহিত্যেও যার জুড়ি মেলা ভার। বাঙালীয়ানার যেসব উপাদান শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনীকে আমাদের এত ঘরের কাছে নিয়ে এসেছে, তার শ্রেষ্ঠ উপাদান সম্ভবতঃ অজিত আর সত্যবতীর মধুর সম্পর্ক। একথা সত্যি যে ব্যোমকেশ ছাড়া পৃথিবীতে বিবাহিত ডিটেকটিভ আছে, কিন্তু তাঁদের স্ত্রীর এইরকম ‘ঠাকুরপো’ নেই। চিত্রচোর গল্পেই আছে, সাঁওতাল পরগনাতে এসে ব্যোমকেশ সুস্থ হয়েছে। কিন্তু অধিক সুস্থতাও সমস্যার কারণ। আর সেই সমস্যার সমাধানেও সত্যবতীর সহচর অজিত।
“দীর্ঘ রোগভোগের পর তাহার স্বভাব অবুঝ বালকের ন্যায় হইয়া গিয়াছে; সে দিবারাত্র খাই-খাই করিতেছে। আমরা দুজনে তাহাকে অতিকষ্টে সামলাইয়া রাখিতেছি।”
বিভিন্ন গল্পে দেখছি সাংসারিক ব্যাপারে অজিতের ওপরই ভরসা বেশী সত্যবতীর। ‘রক্তের দাগ’ গল্পে দেখছি –
- “ সত্যবতীর শৌখিন জিনিষের কেনাকাটা অবশ্য চিরকাল আমিই করিয়া থাকি। কিন্তু এখন বসন্তকাল পড়িয়াছে, ফাগুন মাস চলিতেছে-“!!
অবশ্য জিনিষপত্র কিনে ফেরার পর –
“সত্যবতী খুবই আহ্লাদিত হইল এবং নির্বাচন নৈপুণ্যের সমস্ত প্রশংসা নির্বিচারে ব্যোমকেশকে অর্পণ করিল। বসন্তকালের এমনই মহিমা!”
আমরা এই গল্পের শেষে এসেও দেখছি যে ব্যোমকেশ যখন তার কাজের জন্য সমর্থন আশা করে, সেখানেও অজিত ও সত্যবতী সমস্বর-
“’কিন্তু আইনের চেয়েও একটা বড় জিনিষ আছে – ন্যায়ধর্ম। তোমাদের কি মনে হয়, আমি অন্যায় করেছি?’- সত্যবতী ও আমি সমস্বরে বলিলাম – ‘না।’”
সত্যবতী ও ব্যোমকেশের দাম্পত্য কলহের মধ্যেও অজিতের প্রবেশ হত। অদ্বিতীয় গল্পের শুরুতেই আছে,-
“প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় বিধানে ব্যোমকেশের সঙ্গে যখন সত্যবতীর দাম্পত্য কলহ বাধিয়া যাইত , তখন আমি নিরপেক্ষভাবে বসিয়া তাহা উপভোগ করিতাম। কিন্তু দাম্পত্য কলহে যখন স্ত্রীজাতি এবং পুরুষজাতির আপেক্ষিক উৎকর্ষের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িত, তখন বাধ্য হইয়া আমাকে ব্যোমকেশের পক্ষ অবলম্বন করিতে হইত। তবু দুই বন্ধু একজোট হইয়াও সবসময় সত্যবতীর সহিত আঁটিয়া উঠিতে পারিতাম না। বস্তুত মানুষের ইতিহাসে পুরুষজাতির দুষ্কৃতির নজির এত অপর্যাপ্ত লিপিবদ্ধ হইয়া আছে যে তাহা খন্ডন করা এক প্রকার অসম্ভব। শেষ অবধি আমাদের রণে ভঙ্গ দিতে হইত।”
এই গল্পে সত্যবতী কিন্তু একেবারে শুরুতেই ঘোর নারীবাদী। অজিতের লেখনীতে তার এই দুর্দম রূপটি আমরা প্রত্যক্ষ করি। তর্কের শেষে দুই বন্ধু যথারীতি হার মানে –সত্যবতীর কঠোর সমালোচনা –
“সত্যবতী নির্দয় হাসিয়া বলিল – ‘মিছে কথা বলতেও তোমাদের জোড়া নেই। তোমরা সবাই চোর ডাকাত খুনী’ - আমাদের তর্ক কতদূর গড়াইত বলা যায় না, কিন্তু এই সময় বহির্দ্বারের কড়া খটখট শব্দে নড়িয়া উঠিল। সত্যবতী বিজয়িনীর ন্যায় উন্নত মস্তকে ভিতরে চলিয়া গেল।”
অজিতের তুলিতে অঙ্কিত সত্যবতীর এই সম্রাজ্ঞী রূপটি আমরা যেন চোখের সামনে দেখতে পাই।
অজিতের লেখনীতে শেষ গল্প ‘হেঁয়ালীর ছন্দ’! এখানেও দেখি পরম মমতার সঙ্গে অজিত সত্যবতী-ব্যোমকেশের দাম্পত্য জীবনের এক ঘরোয়া ছবি দিয়েছেন। হঠাৎ আচমকা ব্যোমকেশ ফিরে আসে।
“সত্যবতী ভিতর হইতে ব্যোমকেশের কন্ঠস্বর শুনিতে পাইয়াছিল, আঁচলে হাত মুছিতে মুছিতে ছুটিয়া আসিল। তাহাদের দাম্পত্য জীবন নূতন নয়, কিন্তু এখনো ব্যোমকেশকে অপ্রত্যাশিত ভাবে কাছে পাইলে সত্যবতীর চোখে আনন্দ বিহ্বল জ্যোতি ফুটে ওঠে।”
অজিতের সাথে সত্যবতীর ঠিক কি ধরণের সম্পর্ক ছিল? ভাসুর, দেওর, ভাই, সখা...না তার চেয়েও কিছু বেশী। না এর কোনটাই নয়, অথচ এর থেকে কম বা বেশীও নয়, একটা সম্পূর্ণ অন্যধরণের পরিভাষাহীন সম্পর্ক। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘নীলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাসে কিছুটা এরকম সম্পর্ক ছিল পরস্পর কুটুম্বিতাহীন শৈলেন ও তাঁর আবাল্যসুহৃদ অনিলের স্ত্রী অম্বুরীর মধ্যে। শ্বশুরবাড়ির তরফে অম্বুরীর কোনও আত্মীয় ছিলনা, তাই সে শৈলেনকে দেওর, বা স্বামীর বন্ধু বলে দেওরের থেকেও কিছু বেশী বলে মনে করত, ফলে আরও কিছুটা বেশী জোরেই সে শৈলকে আঁকড়ে থাকত। এই প্রসঙ্গে লেখকের মন্তব্য অনুধাবনযোগ্য-
“অনাত্মীয় যখন আত্মীয় হয়, তার সঙ্গে যোগটা হয় আরও নিবিড় কেননা সদাই একটা বিচ্ছেদের ভয় লাগিয়া থাকে- অল্প কারণেই।”
আবার মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী দ্রৌপদীর সাথে কৃষ্ণের সম্পর্ক ছিল অনেকটা তেমনই মধুর। পাঞ্চালীর পঞ্চপতি কিন্তু কিছুটা অর্জুন ছাড়া তাঁকে ‘প্রিয়শিষ্যে ললিতে কলাবিধৌ’ বলার মত আর কেউ নেই। দুরন্ত ব্যক্তিত্বের প্রভাবে তিনি রাজনন্দিনী ও রাজবধু হয়েও সখিহীনা। তাঁর সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করেছিলেন পার্থসখা কৃষ্ণ। তাই চরম লজ্জার দিনেও তিনি ঈশ্বর নয়, স্মরণ করেছিলেন কৃষ্ণকে তাঁর লজ্জা নিবারণের জন্য।
এই সম্পর্কের মধ্যে কিন্তু ব্যোমকেশের বিরাট ভূমিকা ছিল। মুখে তিনি যতই বলুন যে লেখক জাতটাকে তিনি বিশ্বাস করেন না, তাই অজিতের জন্মের সাল-তারিখ ঘেঁটে তাঁকে দাদা বানিয়ে তবে ছেড়েছেন। কিন্তু ‘চিত্রচোর’ কাহিনীর সন্দেহপ্রবণা মহিলাটি নিশ্চয়ই এ নিয়ে কিছু কু-কথা শুনিয়েছিলেন সত্যবতীকে। সত্য ও অজিত দুজনেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে রেগে আগুন হয়ে যান, কিন্তু ব্যোমকেশ ওসব গ্রাহ্যই করেন না- এতটাই বিশ্বাস রাখতেন তিনি সহধর্মিণী ও বন্ধুর প্রতি।
শেষ কটি গল্পে শরদিন্দু অজিতকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। আর অজিত না থাকার ফলে একেবারেই ম্রিয়মাণ সত্যবতী ও। বস্তুতঃ শেষের দিকে তার দেখা পাওয়াই ভার। ফলে বিখ্যাত কাহিনীদ্বয় ‘শজারুর কাঁটা’ আর ‘বেণীসংহার’ এ আমরা যেন ব্যোমকেশকে সেই ভাবে পাই না। কাহিনীদুটিতে অজস্র চরিত্রের ভীড়, কিন্তু ব্যোমকেশ এখানে শুধুই গোয়েন্দা। যে মানবিক, গার্হস্থ্য, কৌতুকপ্রিয়, সত্যান্বেষীর আমরা গুণমুগ্ধ তাকে আমরা অনেকটাই ফিরে পাইনি। গোয়েন্দা কাহিনীরূপেও এইগুলি অনেক অন্যরকম। সত্যবতীর উপস্থিতিও নামমাত্র।
অবশ্য এটি হয়তো লেখক শরদিন্দুর এক অন্যরকম পরীক্ষা। তিনি ফর্মটিকে ভাঙচুর করে দেখতে চেয়েছিলেন। সেভাবে কিছুটা সার্থকতা ও এসেছে। ‘শজারুর কাঁটা’ শরদিন্দুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। শুধু গোয়েন্দা কাহিনী নয়, উপন্যাস রূপেও এটিকে ভীষণ সার্থক একটি উপন্যাস বলা চলে। তবে এটি কদ্দূর গোয়েন্দা গল্প, এই নিয়ে কিছু দ্বিধা শরদিন্দুর মধ্যেও ছিল। নাহলে কাহিনীর প্রারম্ভেই কেন সতর্কবাণী থাকবে –
“এই কাহিনীতে ব্যোমকেশ আছে, রহস্য আছে, খুন-জখম আছে, রহস্য ভেদ আছে, তবু এটা রহস্য কাহিনী কিনা ঠিক বুঝতে পারছি না। পাঠক-পাঠিকা বিচার করবেন।”
কারণ আমরা অনুধাবন করতে পারি। এই গল্পে (এবং শেষ কটি গল্পেও) ব্যোমকেশ কিন্তু আর মুখ্য চরিত্র নয়। এখানে নায়ক নায়িকা দেবাশিস ও দীপা। ব্যোমকেশের প্রবেশ একেবারে শেষের দিকে। এই কাহিনীতে কাহিনীর চরিত্রগুলির কাছে আর পাঠকদের কাছেও, ব্যোমকেশ কিন্তু খুব দূরের মানুষ।
প্রবন্ধকার ক্ষেত্র গুপ্ত আমাদের মনের কথাটি বেশ সুন্দর ভাবে ব্যাক্ত করেছেন-
“আমার শেষ কটি গল্পে ব্যোমকেশকে বড় একা মনে হয়েছে। যেন প্রতিভাধর মানুষটি একটু বুড়িয়ে গিয়েছেন। অজিতের সাহচর্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত অনুচ্চ এবং সুস্মিত কৌতুকচ্ছটা বিকীর্ণ হত তা পরের পাঁচটি গল্পে কিছুটা ম্লান হয়ে পড়েছে।”
আসলে সম্ভবতঃ শরদিন্দু ব্যোমকেশকে আস্তে আস্তে অবসরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রথমবারের ব্যোমকেশের অবসরটি (‘অর্থমনর্থমে’র পর) ছিল একেবারেই আকস্মিক। আমার মনে হয়, এবার তিনি চাইছিলেন পর্যায়ক্রমে সে ঘটনাটি ঘটাতে। প্রাচীন ভারতের প্রতি শরদিন্দুর ছিল এক গভীর শ্রদ্ধা, কাজেই ব্যোমকেশকেও তিনি ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থের মধ্যে দিয়েই ‘সন্ন্যাস’ এর পথে রওয়ানা করাচ্ছিলেন। তিনি নিঃসন্দেহে জানতেন ব্যোমকেশ এর সঙ্গে অজিত ও সত্যবতী এবং তাদের এই অসাধারণ সম্পর্কের রসায়ন ই ব্যোমকেশ কাহিনীর অন্যতম প্রাণশক্তি। তাই ব্যোমকেশকে অবসর জীবনে প্রবেশ করানোর আগেই হয়ত তিনি তার ‘সুবল-সখা’কে সেই জীবনে প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন। লেখক শরদিন্দু ও বার্ধক্যে উপনীত হচ্ছিলেন, তাই কি অজিত-ব্যোমকেশ-সত্যবতী এই ত্রয়ীর সম্মানজনক একটি অবসর জীবনের পরিকল্পনা করে ফেলছিলেন। কে জানে শেষ উপন্যাস ‘বিশুপাল-বধ’ হত্যারহস্য সমাধানের পর সদ্যলব্ধ মোটরগাড়ীতে করে ব্যোমকেশ ও সত্যবতী হয়তো রওয়ানা দিত কোন এক ‘গোলাপ-কলোনীর’ উদ্দেশে যেখানে অজিত তাদের জন্য সব রকমের সুব্যবস্থা করে ফেলেছে!!
ক্লাসিক বা চিরায়ত সৃষ্টি তাকেই বলা চলে যা পুনঃপঠনে আমাদের ক্লান্তি আসে না, বরং তার থেকে লেখকের নতুন কিছু ভাবনা চিন্তার শরিক হয়ে আমরা আরো বেশী ঋদ্ধ, আমোদিত, অনুপ্রাণিত হই। এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ-অজিত-সত্যবতী, গোয়েন্দা নায়ক, পাঠক-লেখক, পাঠিকা-নায়িকা হয়েও চিরকালই আমাদের কাছে ধ্রুপদী সাহিত্যের চরিত্র হিসেবেই গণ্য হবে।
লেখক পরিচিতি - জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিণ চব্বিশ-পরগনার
রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে
ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু
লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায়
এবং বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিন (সৃষ্টি, অবসর, ইত্যাদিতে) প্রকাশিত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।