শরদিন্দু সংখ্যা
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , এপ্রিল ৩০, ২০১৫
"ছবি" লেখা
ঈশানী রায়চৌধুরী
আমি ছোটবেলা থেকেই একটু পাকা। তাতে আবার বাড়ির কিঞ্চিৎ ইন্ধনও ছিল। এখন অবশ্য মনে হয়, খানিক গোপন উদ্দেশ্যও ছিল হয়ত বা, যে বই নিয়ে বসিয়ে দিতে পারলে বায়নাবাটি কান্নাকাটি কিছুটা কম হবে। ছোটবেলা থেকেই তাই হয়ত আমার আশেপাশে বন্ধু কম, বই বেশি। একটা খুব সুবিধা ছিল , বাড়িশুদ্ধু লোকের নেশার ক্ষেত্র এক। অক্ষরপ্রেম। কেউ মাথাই ঘামাত না , ছোট মেয়েটার হাতে "বড়দের " বই আছে কি না। আপ্তবাক্য ছিল , "বই পড়ে কেউ গোল্লায় যায় না। সব বই সবার জন্য। বুঝতে না পারলে, ভালো না লাগলে নিজেই রেখে দেবে।"
ফলে আমিও হৈ হৈ করে প্রবল উৎসাহে যা পারছি গোগ্রাসে গিলছি। রথী মহারথী থেকে চুনোপুঁটি কেউ বাদ নেই। এই স্রোতে ভেসে একদিন হঠাৎ শরদিন্দু। শুরুটা অবশ্য খুনখারাপি দিয়ে। বেণীসংহার। এবং আমিও বধ হলাম। আকন্ঠ নিমজ্জিত প্রেম। তখন সম্ভবত ক্লাস টু-তে পড়ি। প্রতি রবিবার আনন্দবাজার পত্রিকার "রবিবাসরীয় "তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে "বেণীসংহার "। সকালবেলা কাগজ এলেই আমি ছোঁ মেরে নিয়ে নিই এবং খুদি খুদি ছাপা অক্ষরের নীচে আঙুল রেখে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে গোগ্রাসে গিলি। যতক্ষণ না পড়া শেষ হয়, কেউ কাগজের নাগাল পায় না। প্রসঙ্গত বলি, সেই প্রথম আমার "প্রেমে" হাতেখড়ি। ওই উপন্যাসে একটু প্রেমট্রেমের আভাস তো ছিল। তাই রহস্য এবং রোমাঞ্চ। আমার অসহ্য আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা "আনন্দবাজার" রাখা বন্ধ করে "যুগান্তর" রাখতে শুরু করলেন। আমার তাতে ভারী বয়েই গেল। আমি এবাড়ি-ওবাড়ি গিয়ে কৌতূহল চরিতার্থ করে আসতাম। বাবার কানে সে খবর যেতে বাবা আবার "আনন্দবাজার" রাখা শুরু করলেন।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করে পারছিনা একটি অত্যন্ত মধুর ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা । এইরকম সময়েই আমার ঠাকুমা-দাদু পুনে গেলেন বেড়াতে। আমার পিসি-পিসেমশাই তখন ওখানে থাকেন। পিসেমশাই আর্মির ডাক্তার। শরদিন্দুবাবু ওই শহরের বাসিন্দা। দুটি পরিবারে হৃদ্যতা ছিল। সেই সুবাদেই একদিন ঠাকুমা-দাদু ওবাড়ি গেলেন নেমন্তন্ন খেতে। আড্ডা জমে উঠলে লেখালেখির প্রসঙ্গও এল। ঠাকুমা শরদিন্দুবাবুকে বললেন, " আমরা সকলেই আপনার ভক্ত। তবে আমার নাতনিটি একেবারে "অন্ধ" ভক্ত! আপনার লেখা বেরোলে সে স্নান-খাওয়া ভুলে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।" শরদিন্দুবাবু খুশি খুশি মুখে জানতে চাইলেন, " তা নাতনি কোন কলেজে পড়ছে?" ঠাকুমা বলেছিলেন, "কলেজে নয় তো! ও ক্লাস টু -তে পড়ে।"
শরদিন্দুবাবু চমকিত ও চমৎকৃত। জানতে চাইলেন, " আপনারা আপত্তি করেন না?" ঠাকুমা বললেন , "প্রশ্নই ওঠে না। বাড়িতে না পড়তে পারলে পাড়ায় বেপাড়ায় গিয়ে পড়ে আসবে সে।"
শরদিন্দুবাবুর মতে ওঁর লেখার নাকি আমিই সর্বকনিষ্ঠ প্রেমিকা! আমার ঠাকুমা -দাদুকে অন্তত সেদিন তাই বলেছিলেন।
বয়স বাড়ছে শম্বুক গতিতে। প্রেম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। সেই প্রেম দিব্যি মাখো মাখো হল ঐতিহাসিক উপন্যাসের হাত ধরে।
পাঁচটি উপন্যাস। কালের মন্দিরা, গৌড়মল্লার , তুমি সন্ধ্যার মেঘ , কুমারসম্ভবের কবি আর তুঙ্গভদ্রার তীরে।
শরদিন্দু নিজেই বলেছিলেন, “এই ঐতিহাসিক উপন্যাস fictional history নয় , historical fiction”। রমেশ মজুমদার শরদিন্দুকে জানান, " আলেকজান্ডার দ্যুমা যে উদ্দেশ্য নিয়ে থ্রি মাস্কেটিয়ার্স লিখেছিলেন, আপনার দুইটি উপন্যাসের মধ্য দিয়া তেমনই শশাঙ্কের পরবর্তী সময়কার বাংলা ও প্রথম দেবরায়ের বিজয়নগর সম্বন্ধে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল।"
শরদিন্দু ঐতিহাসিক উপন্যাসে হাত দেবার আগে বিশদে নির্ভর করেছিলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাসের ওপর।
প্রথম লিখলেন "কালের মন্দিরা"। প্রথম প্রকাশ : শ্রাবণ, ১৩৫৮।
প্রেক্ষাপট মগধ। স্কন্দগুপ্ত। ছোট্ট রাজ্য বিটঙ্ক। রাজধানী কপোতকূট। পুরুষ বেশে রাজকুমারী রট্টা যশোধরা। নায়ক এক অসমসাহসী তরুণ। চিত্রক। মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার আলোয় ছায়ার মতো মিশে রয়েছে চিত্রক আর রট্টার প্রণয়কথা। রট্টার প্রণয়প্রার্থী স্বয়ং স্কন্দগুপ্ত! স্কন্দগুপ্তের কথা আমরা ইতিহাসে পড়েছি। সুতরাং আমাদের আগ্রহ বাড়ে। রট্টা চিত্রকের প্রেমে নিমজ্জমান। সে সশ্রদ্ধভাবে স্কন্দগুপ্তের প্রণয়প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে। রাজাধিরাজ উদারভাবে তা স্বীকার করে নেন, জানান-
“কিছুক্ষণ পূর্বে আমি বলিয়াছিলাম, পুরুষকার দ্বারা অপ্রাপ্য বস্তুও লাভ করা যায়। ভুল বলিয়াছিলাম। ভাগ্যই বলবান। কিন্তু তুমি ধন্য, ধন্য তোমার প্রেম। তোমার প্রেম পাইলাম না, এ ক্ষোভ মরিলেও যাইবে না।”
এরপর লেখা হলো "গৌড়মল্লার "। প্রথম প্রকাশ জ্যৈষ্ঠ , ১৩৬১।
পটভূমি অন্য। শশাঙ্কের মৃত্যুর পর কুড়ি বছরের মাৎস্যন্যায়ের প্রেক্ষাপট : গৌড়বঙ্গ। এই কাহিনীতে দুটি সমান্তরাল প্রণয়কথা আছে। মানবদেব-রঙ্গিনী আর বজ্র- গুঞ্জা। অন্ধ মানবদেব , রাজ্যহারা মানবদেবকে খুঁজে বেড়ায় বজ্র। আমিও হেঁটেছি বজ্রের হাত ধরে , ভয়ে, রোমাঞ্চে, শিহরণে, মাৎস্যন্যায়ে উত্তাল বঙ্গভূমের অলিতে গলিতে। রাজদ্বার থেকে গণিকালয়ে। আমাদের বাল্যকালে পড়া একটি ছড়া – “কুঁচবরণ কন্যা তোমার মেঘ বরণ চুল”, এর একটি অদ্ভুত সুন্দর প্রয়োগ পাইঃ
“ একদিন কুটীর প্রাঙ্গনে বসিয়া বজ্র ধনুকে নূতন ছিলা পরাইতেছিল, গুঞ্জা আসিয়া পিছন হইতে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল; কানে কানে বলিল –‘মধুমথন।’ বজ্র তাহাকে টানিয়া সম্মুখে আনিল-‘কি বললে?’
গুঞ্জা বলিল-‘আমি তোমাকে মধুমথন বলে ডাকব।’
বজ্র হাসিল। বলিল-‘আমিও তোমাকে অন্য নামে ডাকব, গুঞ্জা বলে ডাকব না।’
উৎসুক চক্ষে চাহিয়া গুঞ্জা জিজ্ঞাসা করিল-‘কি বলে ডাকবে?’
গুঞ্জার মেঘবরণ চুল ধরিয়া টানিয়া বজ্র বলিল – ‘কুঁচবরণ কন্যা।’”
এরপর প্রকাশিত হল আশ্বিন ১৩৬৫ তে "তুমি সন্ধ্যার মেঘ"।
কোথায় লাগে হলিউড -বলিউড! ইতিহাস আশ্রয় করে এত রোম্যান্টিক বাংলা উপন্যাস পড়িনি আর। নামেই জানিয়ে দিলেন এই কাহিনীর মূল উপজীব্য – প্রেম, “তুমি আমারই, ুমি আমারই, মম অসীম – গগন -বিহারী!” কাহিনীর শুরু মগধের অক্ষদেশে গঙ্গাতীরে বিক্রমশীলা মহাবিহারে। একদিকে সত্যনিষ্ঠ রাজা নয়পাল। তাঁর যুদ্ধবিমুখ আড়বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া যুবকপুত্র বিগ্রহপাল, বিগ্রহের চতুর বয়স্য পুতুল গড়ার কারিগর অনঙ্গ। অন্যদিকে গোঁয়ার কুদর্শন রাজা লক্ষ্মীকর্ণদেব , তাঁকে এক হাটে কিনে এক হাটে বেচে দেবার মতো অসীম ক্ষমতাবতী বৃদ্ধা ও পঙ্গু রাজমাতা অম্বিকা দেবী। বড় রাজকন্যাটি বিবাহিতা। বঙ্গালদেশের যুবরানী বীরশ্রী। ছোটটি বিবাহযোগ্যা , অনিন্দ্যানন্দিনী যৌবনশ্রী। এছাড়া আছে যৌবনার পিয়সহি বান্ধুলি, বান্ধুলির রুগ্ন দিদি বেতসী, জামাইবাবু লম্বোদর। নৈবেদ্যর চুড়োতে সন্দেশটি হয়ে জ্যোতিষাচার্য রন্তিদেব, কী টানটান উত্তেজনায় দু'জোড়া সুভদ্রাহরণ পর্ব। বিগ্রহ-যৌবনা, অনঙ্গ-বান্ধুলি। শেষে আবার বোমাবাজিও আছে। আবার পুরো কাহিনীতে ফল্গুধারার মতো অন্ত:সলিলা স্রোতে বয়ে চলেছে বৌদ্ধধর্মের মূল বাণীটি। শান্তির, সৌহার্দ্যের। বিগ্রহপাল যৌবনশ্রীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, দিদি বীরশ্রীর শরণাপন্ন!! পালানোর পরিকল্পনা ভন্ডুল হল যৌবনশ্রীর অকস্মাৎ নীতিবোধের উন্মেষে। এই পরিকল্পনাতে মাথা ঘামিয়েছিলেন যৌবনশ্রীর জামাইবাবু জাতবর্মা। তাঁকে বীরশ্রী সবকিছুই জানালেন,
“শুনিয়া জাতবর্মা বড়ই বিরক্ত হইলেন। স্ত্রীলোকের আর কোন কাজ নেই, কেবল পিন্ড পাকাইতে জানে। এতটা যদি নীতিজ্ঞান, প্রেম করিবার কি প্রয়োজন ছিল, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী। তিনি পাশ ফিরিয়া শুইলেন।”
এই যে দু'ছত্র তুলে দিলাম, এর একটাই কারণ। যদিও ভাষার সামান্য ইতরবিশেষ , তবু... বিয়ের আগে দাদুকে বলতে শুনেছি ঠাকুমার উদ্দেশ্যে , বাবাকেও ..মাকে। তখন মজা পেতাম। এখন আঠাশ বছরের দাম্পত্যের পর হাসি পায় যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি নারীবাদী হয়ে উঠে মনে মনে পুরুষতন্ত্রকে নস্যাত করে দিই। এবং পরে যখন জাতবর্মাকে স্ত্রীবুদ্ধির কাছে হার মানতে দেখি, মনে মনে উল্লসিত হয়ে উঠি।
এরপর শরদিন্দু লিখলেন "কুমারসম্ভবের কবি "।
উজ্জয়িনী। রানী হৈমশ্রী , কবি কালিদাস। মুর্খ কবি , যিনি উষ্ট্রকে বলেন, "উষ্ট" , "না না , উট্র"। হৈমশ্রীর বীতরাগ, কালিদাসের মালিনীর কাছে আশ্রয় খোঁজা, সাধারণ ফুলের বেসাতি করা নারী...কালিদাসের স্বপ্নসুন্দরী। কালিদাস একেই শোনান কাব্য। মালিনী চিবুকে হাতটি রেখে মগ্ন। মগ্ন কবি নিজেও। পাখিরা ঘরে ফেরে, নির্জন সন্ধ্যা নামে। প্রদীপ জ্বলে ওঠে, ঘরে। মনের আনাচে,কানাচে। কি মনোগ্রাহী ঐ চিত্রকল্পটি যেখানে কালিদাস বিদ্যা ভিক্ষার জন্য উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে গিয়েছেন-
উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দির। কৃষ্ণপ্রস্তরনির্মিত মন্দির আকাশে চূড়া তুলিয়াছে; চূড়ার স্বর্ণত্রিশূল দিনান্তের অস্তরাগ অঙ্গে মাখিয়া জ্বলিতেছে। সন্ধ্যারতির শঙ্খঘন্টা ঘোর রবে বাজিতেছে। মন্দিরের বহিরঙ্গনে লোকারণ্য, স্ত্রী পুরুষ সকলে জোড়হস্তে তদগত-মুখে দাঁড়াইয়া আছে। আরতি শেষ হইলে সকলে অঙ্গনে সাষ্টাঙ্গ প্রণত হইল। অঙ্গনের এক কোনে এক বৃদ্ধ প্রণাম শেষ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, যুক্তকরে মন্দিরের পানে চাহিয়া প্রার্থনা করিল – ‘মহাকাল, আয়ু দাও’।
অনতিদূরে একটি নারী নতজানু অবস্থায় মন্দির উদ্দেশ করিয়া বলিল – ‘মহাকাল, পুত্র দাও’।
বর্মশিরস্ত্রাণধারী এক যোদ্ধা উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল - ‘মহাকাল, বিজয় দাও’।
বিনত ভুবনবিজয়িনীনয়না একটি যুবতী লজ্জাজড়িত কন্ঠে বলিল - ‘মহাকাল, মনোমত পতি দাও’।
দীনবেশী, শীর্ণমুখ, কালিদাস অবরুদ্ধ কন্ঠে বলিলেন - ‘মহাকাল, বিদ্যা দাও’।
আমরা মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে দেখতে পাই সেই কালের ছবিটিকে।
অগ্রহায়ণ ১৩৭২। ঐতিহাসিক উপন্যাস "তুঙ্গভদ্রার তীরে"।
বিজয়নগর বিপর্যস্ত। রাজা প্রথম দেবরায় বরবেশে বেরোনোর ফুরসত পাচ্ছেন না। একদিকে বাহমনী, অন্যদিকে অজানা শত্রুর ঢল। অগত্যা কলিঙ্গরাজ রাজকন্যা বিদ্যুন্মালাকে পাঠিয়ে দিলেন নদীপথে। সঙ্গে রাজার ঔরসেই জাতা কৌতুকপ্রিয়, হাস্যমুখী চটুলা ও আহ্লাদী স্বভাবের মণিকঙ্কনা। সঙ্গে দুই কমিক রিলিফ চরিত্র হিসেবে চিপিটকমূর্তি আর মন্দোদরী। চিপিটকমূর্তি চিপিটক সদৃশ , মন্দোদরী বিপুলা। পথে ঝড় , জল, নৌকাডুবি। চিপিটক আর মন্দোদরী অন্যত্র। সুখে বসবাস। এদিকে বিদ্যুন্মালাকে বাঁচাতে অজ্ঞাতপরিচয় যুবক অর্জুনবর্মা। প্রথম দর্শনেই প্রেম। তারপর অনেক জল বয়ে গেল তুঙ্গভদ্রায়। অর্জুনের বঙ্গাল দেশের সুহৃদ বলরাম। অর্জুন রণ পা ব্যবহার করে, আর বলরামের পটুতা ছোট হালকা কামান তৈরীতে , যা দুজন মানুষ অক্লেশে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেতে পারে। এরপর রাজার হুকুমে রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার কাজ বর্তায় দুই বন্ধুর ওপর। সফল হয়ে রাজকন্যা লাভ হয় অর্জুনের। ততদিনে মহারাজা দেবরায় মণিকঙ্কনায় দিব্যি অভ্যস্ত। তবে কিনা...যতই হোক..দাসীকন্যা। তাই ঠিক হয় নামের বদল হবে দুই কন্যার মধ্যে।
‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসটি শারদীয়া আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয় ১৩৭২ সালে (ইং ১৯৬৫ সালে)। এই উপন্যাস পড়ে সুকুমার সেন, প্রমথনাথ বিশী, রমেশচন্দ্র মজুমদার উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। তখন "দেশ" পত্রিকায় বইয়ের সমালোচনা করতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। "সনাতন পাঠক" ছদ্মনামে। সুনীল লিখেছিলেন, “পুজোর দিনে এই উপন্যাসটি আমি পড়েছি খুব ধীরে ধীরে, যাতে ফুরিয়ে না যায়। এ যেন অনেকটা গরীবের ছেলের সন্দেশ খাওয়ার মত, একটু করে খাচ্ছে আর রেখে দিচ্ছে যাতে এই দুর্লভ বস্তুটি খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে না যায়।”
"তুঙ্গভদ্রার তীরে"তে কমিক রিলিফ এনেছিলেন শরদিন্দু। চিপিটকমূর্তি আর মন্দোদরী --এই দুই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। চিপিটকমূর্তির দেহটি চিঁড়েচ্যাপ্টা, কিন্তু মাথাটি ( অর্থাৎ বুদ্ধি) স্থূল ।
চিপিটকমূর্তি যাচাই করছেন অর্জুনবর্মার পরিচয়। সে আদৌ হিন্দু, নাকি যবন?
“- হুঁ, অর্জুনের বাবার নাম কি ছিল?”
- শুনেছি দেবরাজ ইন্দ্র।
চিপিটক অমনি কল কোলাহল করিয়া উঠিলেন- ‘ধরেছি, ধরেছি! আর যাবে কোথায় যে অর্জুনের বাবার নাম জানেনা, সে কখনো হিন্দু হতে পারে না, নিশ্চয়ই যবনের গুপ্তচর। - রক্ষি তোমরা ওকে বেঁধে নিয়ে যাও।
রসরাজ রুক্ষস্বরে বাঁধা দিলেন – ‘চিপিটক তুমি থামো, চীৎকার করো না। অর্জুনের বাবার নাম ও ঠিক বলেছে। তুমিই অর্জুনের বাবার নাম জাননা। সুতরাং, বেঁধে রাখতে গেলে তোমাকেই বেঁধে রাখতে হয়।‘
চিপিটক থতমত খাইয়া গেলেন, ক্ষীণকন্ঠে বলিলেন –‘কিন্তু অর্জুনের বাবার নাম তো পাণ্ডু!’
রসরাজ বলিলেন –‘পান্ডু নামমাত্র বাবা, আসল বাবা ইন্দ্র।’
প্রথমেই যা আমাকে আকর্ষণ করেছিল, তা অভিনব শৈলীতে কাহিনীর বিন্যাস ভাষাটি আধুনিক সাধু। এতই অলঙ্কৃত আর মধুর, যে উচ্চমেধার পাঠক উদ্বেলিত হবেন, মধ্যমেধারা উপভোগ করবেন দারুণভাবে। দুই শ্রেণীর গ্রহণ ও পরিপাক ক্ষমতা দু'রকম হওয়া সত্ত্বেও। আশ্চর্য দক্ষতায় লেখক আধুনিক সাধুভাষা ব্যবহার করেছেন, প্রয়োজনে তৎসম শব্দ ও বাক্যবন্ধে তদ্ভব এমনকি প্রাকৃত ভাষারও সাহায্য নিয়ে। পড়তে গেলে মনে হয়, ওই সময়ে ওই পটভূমিকায় এই ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা আমাদের এভাবে তদ্গত করতে পারত না। আছে অনাবিল হাস্যরস। চরিত্রে এবং বাক্যবন্ধে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। শরদিন্দু অশেষ মমতায় নকশিকাঁথায় রংবেরঙের ফোঁড় তুলে গেছেন. কিন্তু তা এতই সূক্ষ্ম , যে সীবনের চিহ্নগুলি আমাদের চোখের আড়ালে।
কাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা হাসি, কষ্ট পাই, রোমাঞ্চিত আর উত্তেজিত হই। প্রাসাদশীর্ষে যখন সন্তানসম্ভবা রট্টা যশোধরা চিত্রকের প্রতীক্ষায়, আমরাও অস্ফুটে বলি, "আহা, ভালয় ভালয় ফিরে আসুক "। বজ্র যখন অন্ধ মানবদেবের কন্ঠলগ্ন হয়, আমাদের চোখেও জল আসে। বিগ্রহ যখন মর্কটমূর্তির অন্তরালে..যৌবনার স্বয়ম্বর সভায়, আমাদের সে কী উত্তেজনা..শেষ রক্ষা হবে তো? মালিনীর সঙ্গে চিবুকে হাতটি রেখে আনতনয়নে আমরাও কি শুনিনি কবির সর্গের পর সর্গ কাব্য? বিদ্যুন্মালার সঙ্গে অভিসারে আমরাও তো ঠিক ওর পিছনেই ছিলাম, আড়াল থেকে নজর রাখছিলাম..ধরা পড়ার উপক্রম দেখলেই সাবধান করে দিতে হবে!
এভাবেই আমরা ছত্রে ছত্রে মিশে যাই কাহিনীর প্রেক্ষাপটে, কুশীলবদের সঙ্গে। এই আমেজ, এই হর্ষ-বিষাদের মায়াকাননে বিচরণ ..এ কি খুব সহজলভ্য?
আর একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়। যেখানে যেখানে অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত অনভ্যস্ত শব্দ ব্যবহার করেছেন শরদিন্দু, সেখানেই কাহিনীর শেষে তালিকা আর ব্যুৎপত্তিগত অর্থটি লিপিবদ্ধ করা আছে। এটি অতিরিক্ত প্রাপ্তি আমি তো একটি খেলা খেলতাম। অপরিচিত শব্দ? ভেবে দেখি তো, চলিত ভাষায় এর অর্থ কী ! এবং পরে তা মিলিয়ে দেখতাম। এই খেলায় আমিই সমৃদ্ধ হয়েছি। শব্দের স্বর্ণভাণ্ডারের চাবির গুচ্ছটির প্রথম রত্নখচিত চাবিটি আমার হাতে তুলে দেন শরদিন্দুই!
শরদিন্দু ঐতিহাসিক উপন্যাসকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন পাঠকের দরবারে। একেবারে নতুন আঙ্গিকে।যা সেই সময়ের সাহিত্যমনস্ক মানুষের কাছে উপস্থিত হয়েছিল এক অনন্য সলমা চুমকির পোশাকে সোনালি রুপোলি ওড়নায় সেজে। গা ভর্তি গয়না পরে। মোহিনীরূপে। সেই সম্মোহন আমরা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। পরবর্তী কালে যখন কেউ ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছেন , কোনোভাবেই শরদিন্দুর রীতিপ্রকৃতিটিকে অগ্রাহ্য করতে পারেননি। চেতনে বা অবচেতনে। চেষ্টা করেছেন অনেকেই। এ প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করব বারীন্দ্রনাথ দাশ -এর "শাহেনশাহ", বাণী বসুর "মৈত্রেয় জাতক" , শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের "শাহজাদা দারাশুকো (অসমাপ্ত)" এবং নারায়ণ সান্যালের "রূপমঞ্জরী "। প্রত্যেকেই লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাকার, কিন্তু কেউই শরদিন্দুর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাবমুক্ত নন। প্রত্যেকেই শরদিন্দুর চিন্তাভাবনা, ভাষা আর রচনাশৈলীর ছত্রছায়ায় লালিত। অথচ একজনও ঐতিহাসিক রচনার ক্ষেত্রে অভিনবত্ব বা জনপ্রিয়তার নিরিখে শরদিন্দুকে স্পর্শ করতে পারেননি। শরদিন্দু নির্মেঘ আকাশে জ্যোৎস্নার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন অক্লেশে , অকাতরে আর অকৃপণ দাক্ষিণ্যে।
লেখক পরিচিতি - বিজ্ঞানের ছাত্রী । কিন্তু প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য । তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত । বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য আকাদেমি, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইত্যাদি বিখ্যাত সংস্থা থেকে । ভাষান্তরের পাশাপাশি নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক । তবে খুব নিয়মিত নয় । ভালোবাসেন টুকরো গদ্য, পদ্য লিখতে । নানা স্বাদের লেখা নিয়ে এবছর প্রকাশিত হয়েছে ওঁর আরেকটি বই 'ম্যাজিক লণ্ঠন'।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।>