প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

শরদিন্দু সংখ্যা

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , এপ্রিল ৩০, ২০১৫

 

অক্ষরের বাইরে শরদিন্দু

কেয়া মুখোপাধ্যায়


ফেলে আসা দিনের যা কিছু নিয়ে আজও ভারি মন কেমন, তা হল শনি কি রোববারের বিকেল থেকে সন্ধ্যে বাড়ির সবাই একসঙ্গে বসে টিভির পর্দায় কোন ভাল ছবি দেখা। এইটুকু লিখতে লিখতেই টাইমমেশিনে চেপে নস্ট্যালজিক মন উড়ে গেল সেই ছোটবেলায়।

শনিবারের সন্ধ্যেয় টিভিতে জানিয়ে দেওয়া হত পরের এক সপ্তাহের সব অনুষ্ঠানের খবরাখবর। সাপ্তাহিকী-তে। ভাল কোন ছবির নাম শোনা গেলে তারপর এক সপ্তাহ হাপিত্যেশ প্রতীক্ষা। আর ভগবানও একটু নড়ে চড়ে বসতেন নির্ঘাৎ! কেননা, ঘোর নাস্তিকও খুব পছন্দের কোনও ছবি দেখার অপেক্ষায় থেকে এক দু’বার ডেকেই ফেলত তাঁকে, ‘হে ভগবান! আর যাই হোক না কেন, লোডশেডিং যেন না হয়।’ হ্যাঁ- বাড়াবাড়ি রকম লোডশেডিং এর যুগ ছিল সেটা।

ওই সময়েরই একটা শনিবারের গল্প। বিকেল থেকেই বেশ একটা উত্তেজনার আঁচ পাচ্ছি। বিকেলের এক রাউন্ড চায়ের কাপ হাতে মা, জেঠিমা, পিসি, জেঠু, কাকু, বাবা- সবারই আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে একটা নাম। না, আসলে দুটো নাম। ব্যোমকেশ আর বাসু চ্যাটার্জি। বাসু চ্যাটার্জির নাম আগে শোনা। মধ্যবিত্ত জীবনকে ঘিরে চমৎকার গল্প বলতেন ছবিতে। মূলত শহুরে জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক, প্রেম, বিয়ে এইসব নানা হাল্কা হাসি আর চোখের জলের গল্প মানুষের মন ছুঁয়ে যেত। কখনো সখনো অবশ্য তার ব্যতিক্রম হয়েছে। যেমন ‘কমলা কি মৌত’, সামাজিক আর মানবিক ইস্যুগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে ছবিতে। তাছাড়া টিভি সিরিয়াল এর শুরুর যুগে ‘রজনী’ তৈরি করে তিনি মধ্যবিত্ত দর্শকদের মন জিতে নিয়েছিলেন আগেই। সেদিন সন্ধ্যেয় সেই বাসু চ্যাটার্জির পরিচালনায় শুরু ব্যোমকেশ বক্সী। কাহিনি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাংলা ছবি নিয়ে আলোচনা হলে উত্তমকুমার আসবেনই। বিশেষত তিনি যখন ব্যোমকেশ বক্সী রূপে দেখা দিয়েছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনা করা ব্যোমকেশের ছবিতে। দেখা গেল, সকলেই দ্বিধায় আছেন। উত্তমকুমার এর অভিনীত চরিত্রটি অজানা অভিনেতা না জানি কেমন করবেন! ভরসা একটাই, পরিচালক বাসু চ্যাটার্জি। এদিকে আমার মনে প্রবল অস্বস্তি। আমাদের বাড়িতে বই পড়া নিয়ে কোনদিনই কোন বাধা ছিল না। দেয়ালজোড়া আলমারি থেকে ইচ্ছে মত বই বের করে পড়তাম। কখনো কখনো কোন আত্মীয়-স্বজন যে তা দেখে ভুরু কোঁচকাননি তা নয়। তাঁদের গভীর আশঙ্কা ছিল, অকালে এঁচোড়ে পাকা হয়ে পড়ব। কিন্তু মা বলেছিলেন যা ভাল লাগবে না, তা থেকে চোখ আর মন দুই-ই সরে যাবে। অকারণে পাহারাদারি করে লাভ নেই। সেভাবেই শরদিন্দু সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে আগেই। ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-সহ শরদিন্দুর অসামান্য রোম্যান্টিক বাংলা উপন্যাস আর নানা গল্প পড়ে ফেলেছি। কিন্তু ব্যোমকেশ চরিত্রটির সঙ্গে পরিচয় হয়নি। পড়াই হয়নি মোটে! 

প্রথম এপিসোড। কাহিনি- ‘সত্যান্বেষী’। নামগুলো পর্দায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুরন্ত ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর। আনন্দশঙ্কর। থানায় এসে ঢুকলেন লম্বা ছিপছিপে, ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক যুবক। চায়না টাউনের খুনের তদন্ত করতে চান। অফিসার রাজি নন। একেবারেই কোনও  অভিজ্ঞতা নেই যুবকটির। ক্যামেরা অফিসার আর যুবকের ওপর প্যান করে গিয়ে যুবকটিকে ধরল। ক্লোজ আপে যুবকটি। গালে হাল্কা দাড়ি। উজ্জ্বল দুটি চোখ। দারুণ সপ্রতিভ। ঝকঝকে অথচ একেবারে ঘরোয়া। অফিসার কনভিন্সড্। আমি ততোধিক।

৪০ মিনিট কোথা দিতে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। শেষ হতে বুঝতে পারলাম, প্রবলভাবে ব্যোমকেশের প্রেমে পড়েছি। এখানে একটা প্রশ্ন কারও মনে উঁকি দিলেও দিতে পারে। ব্যোমকেশের প্রেমে পড়লাম না অভিনেতার! তবে সেসব কূট তর্কে না গিয়ে এইটুকু বলা যায়, দেশ জুড়ে সত্যান্বেষী অভিনেতাটির অগুন্তি গুণমুগ্ধ তৈরি হয়েছিল রাতারাতি। 

এপিসোড শেষ হতে না হতেই আর এক রাউন্ড চা-এর সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা শুরু। দেখা গেল জেঠু, বাবা, কাকু সকলেই প্রথম এপিসোড থেকেই বেশ পছন্দ করে ফেলেছেন নতুন ব্যোমকেশকে। ঠিক এই জায়গায় জেঠিমা কি মা-র সঙ্গে মতবিরোধের একটা প্রবল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য! মোটেই সেটা হল না! তাঁদেরও দিব্যি পছন্দ হয়েছে নতুন ব্যোমকেশকে। এটা কিন্তু সত্যি বিরাট ব্যাপার। কারণ যে বাঙালি  উত্তমকুমারের ব্যোমকেশ দেখেছেন, বিশেষ করে মহিলাকুল- নবীনা কি প্রবীণা, তাঁদের কাছে উত্তমকুমার অভিনীত চরিত্রে অন্য এক অভিনেতার গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা শুধু মুশকিলই নয়, প্রায় অসম্ভব ছিল। 

আবার এক সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় এপিসোড। এর মাঝে একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম। একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পড়ে ফেললাম ব্যোমকেশের সবকটা গল্প। ব্যোমকেশের প্রেমে পড়ে এই হোমওয়ার্কটুকু খুব জরুরি ছিল। আর যত পড়ি, প্রেম তত বাড়ে! 

ব্রিটিশ মডেলের গোয়েন্দা গল্পের কেন্দ্র চরিত্র শার্লক হোমসেরই উত্তরসূরী শরদিন্দুর ব্যোমকেশ বা সত্যজিতের ফেলুদা। ফেলুদার সব বই-ই ততদিনে পড়া। সোনার কেল্লা আর জয়বাবা ফেলুনাথও দেখে ফেলেছি। কিন্তু নারীচরিত্র বর্জিত সেসব গল্পে মগজাস্ত্রই প্রধান। ফেলুদা তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন, আবেগহীন, যুক্তিবাদী। তবু যত ঝকঝকে আধুনিকই হোন ফেলুদা, যতই দেশবিদেশের খবর নখদর্পণে রাখুন, কোথায় যেন  কিশোরপাঠ্য ফ্লেভারটাই ডমিনেট করে এইসব গল্পে। সেটা স্বাভাবিকও, কারণ কিশোরপত্রিকা ‘সন্দেশ’-এই প্রথম আবির্ভাব ফেলুদার। অন্যদিকে ব্যোমকেশ যুক্তিবাদী, কিন্তু আবেগহীন নন। মগজাস্ত্র চর্চা কি সত্য অনুসন্ধানের পাশাপাশি তিনি প্রেমে পড়েন।  সংসারও করেন। স্ত্রী সত্যবতী অভিমান করে দাদার বাড়ি চলে গেলে, তার মান ভাঙ্গাতে পশ্চিমে ছোটেন। পাশাপাশি ব্যোমকেশের বিবেকবোধ আর ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠিটাও একেবারেই তাঁর নিজস্ব। সবসময় সেটা সমাজের নিয়ম-নীতির সঙ্গে মেলে না। আর সেখানেই তাঁর বৈশিষ্ট্য। সবমিলিয়ে, ব্যোমকেশই প্রথম বড়দের গোয়েন্দা। উঁহু, সত্যান্বেষী। তাই ফেলুদা দূরে থাকলেও, ব্যোমকেশ মনের অন্দরে ঢুকে পড়েন  সহজেই।

আমাদের পরিবারকে যদি সে সময়ের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের একটা আয়না ধরি, তাহলে তাতে ব্যোমকেশকে ঘিরে এই যে প্রতিফলন দেখা গেল, তার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল চেনা জানা  অন্যান্য পরিবারের ছবিও। আর সেইসঙ্গে হিন্দিতে তৈরি ও দূরদর্শনের ন্যাশনাল নেটওয়ার্কে দেখানো হল বলে বাঙালির এই একান্ত নিজস্ব আটপৌরে সত্যান্বেষী পৌঁছে গেলেন সারা ভারতে। বিপুল জনপ্রিয়ও হলেন। তৃতীয় এপিসোড ‘সীমন্ত হীরা’-তে স্যর দিগিন্দ্রনারায়ণের চরিত্রে ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতিতে উৎপল দত্ত। আর ঐ দু’-তিন নম্বর এপিসোড থেকেই ভারত জুড়ে তুমুল হিট বাংলার এই সত্যান্বেষীর গল্প।

 ১৯৯৩-তে প্রথম সিজনে ব্যোমকেশ বক্সীর ১৪-টা এপিসোড দেখানো হয়। ‘সত্যান্বেষী’ থেকে ‘চিড়িয়া ঘর’ (চিড়িয়াখানা)।  শেষ হওয়াতে দেশ জুড়ে রীতিমতো গণপ্রতিবাদ। আরও অনেক পর্ব দেখার প্রত্যাশা সবার মনে। ওই বছরই শেষের দিকে রিলিজ করল শ্যাম বেনেগালের ছবি ‘সূরজ কা সাতবাঁ ঘোড়া’। মুখ্য চরিত্রে রজিত কাপুর। সেরা ছবির জাতীয় পুরস্কার পেল ছবিটা। ততদিনে ছোটপর্দায় রজিত কাপুর ব্যোমকেশ হিসেবে সুপরিচিত।  আর বড়পর্দার প্যারালাল ছবিতেও দুর্দান্ত কাজ করছেন।

ব্যোমকেশ বক্সীর দ্বিতীয়  সিজন টিভির পর্দায় ফিরে এল চার বছর পরে। ১৯৯৭-তে। এই চার বছরে বেশ কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে। দারুণ কিছু ধারাবাহিক দেখা গেছে টিভির পর্দায়। মানুষের ভালও লেগেছে।  আর মুখ্য চরিত্র রজিত ততদিনে ভারত সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কারটিও জিতে নিয়েছেন শ্যাম বেনেগালের ‘দ্য মেকিং অফ মহাত্মা’ ছবিতে গান্ধীজির ভূমিকায়। কিন্তু টিভির পর্দায় টেলিকাস্ট শুরু হতেই তিনি আবারও ভীষণ চেনা ঘরোয়া ব্যোমকেশ। দ্বিতীয় সিজনে ‘আদিম রিপু’ দিয়ে শুরু করে ‘লোহার বিস্কুট’-এ শেষ। ২০ টা এপিসোড। আবারও সুপার হিট সিরিয়াল। 

বাসু চ্যাটার্জির ব্যোমকেশ একেবারে শরদিন্দুর বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছেন।  “গায়ের রং ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা— মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে।”  “বাহির হইতে তাহাকে দেখিয়া বা তাহার কথা শুনিয়া এক বারও মনে হয় না যে, তাহার মধ্যে অসামান্য কিছু আছে...”।  নিজেই স্ক্রিপ্ট করেছিলেন বাসু চ্যাটার্জি। তাঁর ব্যোমকেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাঙালির এতটুকুও অসুবিধে হয়নি, যদিও সিরিয়ালটা হিন্দিতে হয়েছিল। দারুণ সপ্রতিভ, বুদ্ধিদীপ্ত আবার একইসঙ্গে ভীষণ আটপৌরে মধ্যবিত্তপনায় ভীষণ চেনা পাড়ার যুবকটি যেন। মহানায়ক বা নায়ক হয়ে নয়, একেবারে ঘরোয়া  ইমেজ নিয়ে রজিত কাপুর বাঙালির মনে একটা  চিরকালের জায়গা করে নিয়েছেন।

এই ভীষণ ঘরোয়া বাঙালিয়ানা ব্যাপারটা যেন ব্যোমকেশের জিনে ইম্প্রিন্টেড। আর সেটাই ব্যোমকেশের ইউএসপি।  আত্মপ্রত্যয়ী ব্যোমকেশের পাশে, কে কে রায়নার কিছুটা নিচু সুরের অজিতকেও চমৎকার মানিয়েছিল। অনেকের মতে আজ অবধি সেরা  অজিত তিনিই। যুগলবন্দী সুপারহিট। অন্যান্য অভিনেতাদের বেশির ভাগই হিন্দি সিরিয়াল কি থিয়েটারের বলিষ্ঠ অভিনেতা। সব মিলিয়ে, সফল প্রোডাকশন।  বিশাল বাজেট নয়। চোখ ধাঁধাঁনো সেট নয়। অনেকটা থিয়েট্রিকাল ট্রিটমেন্ট। পর্ব ধরে নয়, একসঙ্গেই শ্যুটিং হয়েছিল শুনেছি।  বলতে গেলে, বাসু চ্যাটার্জির হাত ধরেই শরদিন্দুর ব্যোমকেশের প্রথম ভারত বিজয়। ঘরের ছেলের জাতীয় চরিত্র হয়ে ওঠা।  

এখনও যে কোন ব্যোমকেশ এর তুলনায় রজিত প্রসঙ্গ আসবেই আসবে। কদিন আগেও রজিত কাপুর একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাঁর সবচেয়ে ভাল লেগেছিল ব্যোমকেশ চরিত্রের simplicity।

“Even in these days, among the multiple renditions of Sherlock and Doctor Who, young minds seem fascinated by the character. He’s the “Classic Detective” – and, even after 22 years, people call in to ask for the show to be reinstated. So Byomkesh Bakshi continues to lurk in my shadow – or rather, I in his.”

কিন্তু শরদিন্দুর বইয়ের পাতা থেকে সত্যান্বেষী প্রথম পর্দায় এসেছিলেন বাসু চ্যাটার্জির সিরিয়ালের আরও বছর ছাব্বিশ আগে। ১৯৬৭-তে। পরিচালক সত্যজিৎ রায়। ‘চিড়িয়াখানা’। এর দু’বছর আগে ১৯৬৫-তে বাংলা সাহিত্যের দুনিয়ায় আবির্ভাব হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের নিজের ডিটেকটিভের। প্রদোষচন্দ্র মিটার, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর,  আমাদের ফেলুদা। তাকে নিয়ে ছবি করার পরিকল্পনা নেই তখনও। আরো অনেকের মত আমারও একাধিকবার চিড়িয়াখানা ছবিটা দেখে মনে হয়েছে এটা সত্যজিতের অন্যতম  দুর্বল ছবি। অনেক হোমওয়ার্ক কি সত্যজিৎ ঘরানার মনন এই ছবিতে অনুপস্থিত। এমনকি সত্যজিতের নিজেরও খুব একটা আস্থা কি ভালবাসা এই ছবির প্রতি ছিল না। পরের বছর সেরা ছবির জাতীয় পুরস্কার পায় চিড়িয়াখানা। সেরা অভিনেতা উত্তমকুমার। জুরিদের সিদ্ধান্তে রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন সত্যজিৎ। মারি সিটন-কে চিঠিতে লিখেছিলেন— ‘এ দেশে কি ভাল পরিচালকের আকাল পড়ল নাকি? ভাবো, চিড়িয়াখানা-র মতো ছবির জন্য আমি পুরস্কার পাচ্ছি!’ সে যাই হোক, ছবিটা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও শরদিন্দুর গল্পের কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন সত্যজিৎ। । 

এর কয়েক বছর পরে, ১৯৭৪ এ শরদিন্দু কাহিনি অবলম্বনে  ‘শজারুর কাঁটা’ ছবি করেন মঞ্জু দে। ব্যোমকেশের ভূমিকায়  শ্যামল ঘোষাল। এই ছবিটা আমার দেখা নেই।  পরিচিত অন্য কারোর থেকেও জানা যায়নি কিছু। তবে দীর্ঘস্থায়ী কোন ছাপ মানুষের মনে ফেলেছিল বলে  মনে হয় না।
কয়েক বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক। আর ব্যোমকেশ থেকে সরে গিয়ে তাকানো যাক শরদিন্দুর অন্যান্য গল্প থেকে তৈরি ছবির দিকে। 

১৯৬১। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে পরিচালক তপন সিংহ তৈরি করলেন  ‘ঝিন্দের বন্দী’। ১৮৯৪ তে অ্যান্টনি হোপ লিখেছিলেন ‘The Prisoner of Zenda’. সেই কাহিনির ছায়াতেই শরদিন্দুর ঝিন্দের বন্দী। পিরিয়ড পিস তৈরিতে তপন সিংহ সুদক্ষ। ঠিক এক বছর আগেই রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীতে তৈরি করেছেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, যে ছবি তৈরি কোন পরিচালকের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ, সচরাচর যে ছবি করতে চাইবেন না কেউ। তারপরই আর এক ক্লাসিক- “ঝিন্দের বন্দী"। ভারি সুন্দর মানিয়েছিল  উত্তমকুমারকে। আর সেই প্রথম কোন খলনায়কের চরিত্রে সৌমিত্র। নায়িকা অরুন্ধতী দেবী, ভীষণ গ্রেসফুল। সংগীত উস্তাদ আলি আকবর খাঁ।  টালিগঞ্জের উদীয়মান নায়ক চরিত্রের অভিনেতাকে প্রতিনায়কের ভূমিকায় নির্বাচন করাটা পরিচালকের বিচক্ষণতা। এক তরুণ অভিনেতার অভিনয়  বিকাশের পথে অন্যরকম চ্যালেঞ্জও। কলকাতার ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের সময়ে দেশ বিদেশের ছবি দেখার নেশায় আক্রান্ত ছিলেন যাঁরা, তাঁদের দলটিতে মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকদের সঙ্গেই ছিলেন তপন সিংহও।  সিনেমা মাধ্যম সম্পর্কে এই প্রবল আগ্রহই সম্ভবত মেইন স্ট্রিম সিনেমার স্রোত থেকে তপন সিংহকে ক্রমাগত তাৎপর্যপূর্ণ সিরিয়াস সিনেমার সন্ধানে টেনে এনেছিল। উৎকৃষ্টতর চলচ্চিত্রের নির্মাতা হিসেবে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান দিয়েছিল তাঁকে। শরদিন্দুর কাহিনির প্রতি বিশ্বস্ত থেকে চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন নিজেই। এমন পিরিয়ড পিস নির্মাণ তাঁর পক্ষেই সম্ভব।

শরদিন্দুর ঐতিহাসিক গল্প কি উপন্যাস নিয়ে খুব বেশি ছবি তৈরি হয়নি। ১৯৬৬-তে শরদিন্দুর গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছিল 'রাজদ্রোহী'। মুখ্য ভূমিকায়, উত্তমকুমার আর অঞ্জনা ভৌমিক।
গৌতম বুদ্ধের সময়ে মধ্য এশিয়ার এক ঊষর মরুর পটভূমিতে রচিত শরদিন্দুর কাহিনি 'মরু ও সঙ্ঘ' অবলম্বনে ১৯৮৮-তে নবেন্দু ঘোষ করলেন হিন্দি ছবি 'তৃষাগ্নি।' কোন পরিচালকের তৈরি প্রথম সেরা ছবি হিসেবে ছবিটি জাতীয় পুরস্কার পেল। অলোকনাথ, নানা পাটেকর, পল্লবী যোশি প্রত্যেকেই দারুণ অভিনয় করেছিলেন এই ছবিতে।
শরদিন্দুর অসামান্য উপন্যাস ছিল ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’। আমার খুব মনে হয় এই উপন্যাসটিরও সার্থক চলচ্চিত্রায়ণ করতে পারতেন তপন সিংহই। তবে রেডিওতে এর একটি সফল প্রযোজনা হয়েছিল।

’৭০ এর দশকে বিবিধভারতী কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল রেডিও শ্রোতাদের শ্রবণসুখের একটা স্বর্ণযুগ। তখনই শুরু হয়েছিল বিজ্ঞাপন কার্যক্রমের অনুষ্ঠান। বাইরের প্রোডিউসাররা বিজ্ঞাপনদাতাদের স্পনসর্ড প্রোগ্রাম পৌঁছে দিতে লাগলেন রেডিওতে। একেবারে অন্য মাত্রা পেতে শুরু করল শ্রবণ বিনোদন।  নাটকের বৈচিত্রের কোন সীমা পরিসীমা ছিল না বিবিধ ভারতীতে। একদিনের পূর্ণাঙ্গ নাটক বা গল্প, আবার বছরের পর বছর ধরে চলা ধারাবাহিক নাটক- দুই-ই খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।  তখনই ধারাবাহিক সম্প্রচার হয়েছিল শরদিন্দুর ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র। শরদিন্দুর অপরূপ ভাষা আর ইতিহাসের বিরাট পটভূমিতে বিপুল বিন্যাস নিয়ে একটুকরো অতীত তুলে ধরেছিল ‘লিভিং সাউন্ড’ স্টুডিওতে সেইসময়ের বিজ্ঞাপনরাণী শ্রাবন্তী মজুমদারের প্রযোজনায় এই নাটক। শরদিন্দুর উপন্যাসের সার্থক বেতার নাট্যরূপ দিয়েছিলেন শ্যামল সেন, রাজা প্রথম দেবরায়ও তিনিই। অর্জুনবর্মা গৌতম চক্রবর্তী, বিদ্যুন্মালা শাঁওলি মিত্র, আর চিপিটকমূর্তির কমিক রিলিফে ধীমান চক্রবর্তী। শ্রোতাদের উচ্ছ্বাসও ছিল প্রবল। রুদ্ধশ্বাসে তাঁরা অপেক্ষা করে থাকতেন পরের পর্বের জন্যে।

১৯৮০। কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণের গল্প নিয়ে বড় ক্যানভাসে অনেক চরিত্রের সমাহারে তরুণ মজুমদার তৈরি করলেন দাদার কীর্তি। নিটোল পারিবারিক বিনোদনের ছবি। মোটে চার-পাঁচ পাতার একটা ছোটগল্প। আর তার ওপর ভিত্তি করে উজ্জ্বল একটা পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছায়াছবি।  এ ছবির লাবণ্যে আজও মুগ্ধ  বাঙালি। পরিচালকের অজান্তেই অন্যান্য ছবির মত এই ছবিতেও তাঁর  জীবন-দর্শনের সনাতন সুরটি বার বার বেজেছে। বার বার ছবিতে এসেছে রবীন্দ্রসঙ্গীত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায়। সেইসঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে,মান্না দে-র কন্ঠে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা “জনম অবধি কার/ তোমা’পরে অধিকার/ ‘প্রিয়’ বলে ডাকিবার দিয়েছেন বিধি,” গানটাও ব্যবহার হয়েছিল ছবিতে।

সবসময় অবশ্য ছোটগল্প থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্যের তৈরি সিনেমা হয় না।  টুকরো টুকরো ছোটগল্প থেকে টুকরো টুকরো ছবিও তৈরি হতে পারে। তারপর সেগুলোকে একসঙ্গে জুড়ে সেলুলয়েডে গোটা একটা ছবি। এই ঘরানাতেই তৈরি  সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১, তিনটি ছোটগল্প), ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ (১৯৬৫, দুটি গল্প)। সেভাবেই ২০১২ তে সন্দীপ রায় করলেন ‘যেখানে ভূতের ভয়’, আর ২০১৪-তে ‘চার’। ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’ আর ‘অনাথবাবুর ভয়’- সত্যজিৎ রায়ের তারিণীখুড়োর দুটো গল্পের সঙ্গে পরিচালক জোর করে জুড়ে দিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভূত ভবিষ্যৎ’। এক ফ্রেমে ধরা এই তিনটে গল্প আমাদের অনেকেরই ফেলে আসা কৈশোরের বড় আদরের বন্ধু।  কিন্তু রাইটস কিনেছেন বলেই জোর করে শরদিন্দুর কাহিনিতে সত্যজিতের তৈরি চরিত্রকে ফিট করিয়ে দিয়ে যা দাঁড়াল, তাতে প্রত্যাশার সীমারেখাটা ছুঁতে পারা তো  দূরের কথা, রীতিমতো হতাশ হতে হল দর্শকদের।

‘চার’-ছবিটাও আসলে চারটে ছোটগল্পের একত্র সমাহার।  চরিত্র ও মেজাজে চারটে গল্পই আলাদা৷‌ আপাতদৃষ্টিতে কোনও যোগসূত্র নেই। চারটে গল্পেই মানবিক মূল্যবোধের ছোঁয়া। এরও প্রথম গল্প শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরীক্ষা।’ পরীক্ষা গল্পটা একটা বিশেষ সময়ের ফ্রেমে বন্দী৷‌ তাই ছবিটা সাদা-কালোয় ধরা। গল্পটার সময় ৪০-এর দশক৷‌ ঠিক স্বাধীনতা লাভের আগের ঘটনা৷‌ এই গল্প কি গোটা সিনেমার সঙ্গেও দর্শকের যতটুকু আত্মীয়তা তৈরি হয়, তার কৃতিত্বের দাবিদার গল্পের বরেণ্য লেখকরা এবং এই সময়ের বাংলা সিনেমার সুদক্ষ  অভিনেতারা। পরিচালক কখনোই নন।

ছোটগল্প থেকে আবারও ফেরা যাক সত্যান্বেষীতে। না ফিরে উপায় নেই। কারণ মোটামুটি ২০০৯ থেকে এই একান্ত ঘরোয়া সত্যান্বেষীটিকে ঘিরে যে ভালোবাসা ফল্গুর মত অগুন্তি বাঙালির মনের আনাচ-কানাচ ছুঁয়ে অন্তরালে বয়ে যেত, তা একেবারে বিপুল তরঙ্গ হয়ে উঠে, ‘সব গগন উদ্বেলিয়া- মগন করি অতীত অনাগত’ আমাদের  সংস্কৃতিতে এসে আছড়ে পড়েছে। আপামর বাঙালির চেতনাধারা কাঁপিয়ে দিয়েছে। তাই চাইলেও সেই তরঙ্গ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার উপায় নেই। চার দশকের ওপর ব্যোমকেশকে নিয়ে কোন পূর্ণদৈর্ঘ্যের সিনেমা ছিল না, টিভির পর্দাতেও শেষ দুরন্ত উপস্থিতি সেই ১৯৯৭ তে। কিন্তু ২০০৯ থেকে যেন ছোট-বড় সব পর্দা থেকে স্টেজ –সব পরিচালকরাই একেবারে তেড়েফুঁড়ে উঠলেন ব্যোমকেশকে নিয়ে! এর মধ্যে আবার শুধু গত চার মাসেই নানা বয়সের, নানা রূপের চারচারজন ব্যোমকেশের আবির্ভাব হয়েছে ছোট আর বড় পর্দায়।

২০০৯-এ 'মগ্ন মৈনাক'। পরিচালনায় স্বপন ঘোষাল। থিয়েটার আর সিরিয়ালের চেনামুখ শুভ্রজিৎ দত্ত  ব্যোমকেশের ভূমিকায়। সেরকম চলেনি ছবিটা।

২০১০। শরদিন্দুর ‘আদিম রিপু’ নিয়ে হল ‘ব্যোমকেশ বক্সী’। পরিচালনায় অঞ্জন দত্ত। অঞ্জনের পরের ছবি ২০১২-তে, 'চিত্রচোর' অবলম্বনে ‘আবার ব্যোমকেশ’। ২০১৪-এ ‘বেণীসংহার’ নিয়ে ‘ব্যোমকেশ ফিরে এল’। আবারও অঞ্জন দত্ত। অঞ্জনের এই ব্যোমকেশ ট্রিলজিতে ব্যোমকেশ আবীর চ্যাটার্জি, অজিত শাশ্বত চ্যাটার্জি।

লক্ষণীয় যে তিনটে ছবির নামেই গল্পের নামের বদলে ‘ব্যোমকেশ’ এর অবশ্যম্ভাবী উপস্থিতি।  ব্যোমকেশ বক্সী নামটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ব্র্যান্ড ভ্যালুকে কাজে লাগাবার সহজতম রাস্তা। আবীরের ফ্যান ফলোয়িং বেশ ভাল। তবে এক্সপ্রেশনে বৈচিত্র্যের অভাবে অভিনয় বড় রিপিটেশন মনে হয়। অজিতের ভূমিকায় শাশ্বতর অভিনয় কিন্তু নজরকাড়া। ছবি নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। ‘আবার ব্যোমকেশ’-এ ১৯৪৬-৪৭ এর সময়কালকে পর্দায় বিশ্বাসযোগ্য করে হাজির করা কঠিন হত বলেই বোধহয় সময় পাল্টে এনে ফেলা হয়েছিল ষাটের দশকে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। এখনকার ভাষায় বলতে গেলে,  বলা যায় ছড়িয়ে লাট! শোনা যাচ্ছে অঞ্জন আবারও ফিরবেন ব্যোমকেশ নিয়ে। তবে অভিনেতা পাল্টে যাবেন। কারণ বাংলায় অভিনেতাদের নাকি এমন আকাল যে দুই পরিচালকের দড়ি টানাটানির শেষে ব্যোমকেশের অভিনেতাই এখন ফেলুদায় ট্রান্সফর্মড। পৈতৃক রাইটস এর জোরে দেড়-দু'বছর অন্তর সন্দীপ রায় কৈলাসে কি গোরস্থানে যেসব কান্ডকারখানা ঘটান ফেলুদার গল্প নিয়ে, তাতেই তিনি ফেলুদা হয়ে আবির্ভূত হবেন। 

ব্যোমকেশ সিন্ড্রোমের এমনই মহিমা যে ২০১৩-তে ঋতুপর্ণ ঘোষের শেষ ছবিও সেই ব্যোমকেশকে ঘিরেই। চোরাবালি অবলম্বনে ‘সত্যান্বেষী’। ঋতুপর্ণর ‘শুভ মহরৎ’ আমার খুব প্রিয় থ্রিলার ছবি। পিসিমার মধ্যে মিলেমিশে গেছেন মিস মার্পল। কিন্তু তারপরেও ‘সত্যান্বেষী’-র চোরাবালিতে ডোবা আটকানো যায়নি। আমার কাছে অন্তত এ ছবি একটা ডিজাস্টার! বিশেষত ব্যোমকেশের ভূমিকায় পরিচালক সুজয় ঘোষের নির্বাচন হতবাক করে। আগাগোড়া যেন অসুস্থ দেখায় তাঁকে। ওদিকে অজিত আবার কিঞ্চিত বেশিই সুস্থ, পুঁটিরামের রান্না খেয়ে দেয়ে একেবারে গোলগাল। মোটের ওপর বেমানান জুটি। 

কদিন আগে, ২০১৫-র মার্চে এসেছে ‘শজারুর কাঁটা’। পরিচালনায় শৈবাল মিত্র। এখানে আবার আর এক মুশকিল!  বাসু চ্যাটার্জি মধ্য তিরিশের অভিনেতাকে মেক আপে বছর ষাটের ব্যোমকেশ করেছিলেন। এখানে প্রবীণ অভিনেতা ধৃতিমান ব্যোমকেশ। বয়সটা যদি মেনেও নিই, হোঁচট খাই এই ব্যোমকেশ মুখ খুললে কি তাকালে বা হেঁটে চলে বেড়ালে! ইনি যেন আসন পেতে বসে গুছিয়ে মাছ-ভাত খেতে খেতে সত্যবতী আর অজিতকে কেস বোঝানো ব্যোমকেশ নন। ইনি দাঁত চেপে ইংরেজি অ্যাকসেন্টে বাংলা বলা কেতাদুরস্ত কর্পোরেট। ডিজাইনার চশমা পরে কায়দা করে তাকান। এর সঙ্গে ঠোঁটে একখানা পাইপ গুঁজে দিলে বেশ লাগসই হত! ব্যোমকেশের ইউএসপি, সেই আপন আপন ব্যাপারটাই উধাও। চেহারা কি অভিনয় শরদিন্দুর ব্যোমকেশ থেকে অনেক দূরের গ্রহের।

এরপর ২০১৫-র এপ্রিলে ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশ বক্সীর আবির্ভাব। দেশে বিদেশে একসঙ্গে রিলিজ। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে আর একবার অন্য দিকে চোখ ফেরানো যাক।  

হুডানিট? কে অপরাধী? হত্যাকারী কে? সারা দুনিয়ার রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি ঘুরপাক খায় এই একটা শব্দকে ঘিরে – ‘কে?’ এই ‘কে’-র অদম্য টানেই বাঙালি  দেশ-বিদেশের শ্রেষ্ঠ থ্রিলার থেকে শুরু করে চটি সিরিজের রহস্য গল্পও গোগ্রাসে গিলেছে। অথচ সিনেমায় ফিরে ফিরে এলেও রহস্যকাহিনি নিয়ে বাংলা থিয়েটারে মঞ্চ সফল প্রযোজনা খুব বেশি নেই। 

অন্য দিকে,  রেডিও নাটকে কিন্তু  রহস্য রোমাঞ্চের গল্প কিন্তু চিরকালই হিট। আকাশবাণীর পুরোদস্তুর  নাটকই হোক কিংবা এফএম জমানার পাঠাভিনয়- রেডিওর রুদ্ধশ্বাস রহস্য নাটকের  আকর্ষণ এতটুকু ম্লান হয়নি। কলকাতা ‘ক’-এর আকাশবাণীর নিজস্ব প্রযোজনা আর বিবিধভারতীর বিজ্ঞাপনী নাটক, দুয়েরই জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। ব্যোমকেশকে ঘিরে এই তুমুল জোয়ারের মধ্যে গত দু’ তিন বছরে আকাশবাণীতে শরদিন্দুর বেশ কয়েকটা ব্যোমকেশ-কাহিনির বেতার নাট্যরূপ প্রচারিত হল- মাকড়সার রস, অর্থমনর্থম্, দুর্গরহস্য, অচিন পাখি, অগ্নিবাণ ইত্যাদি। রেডিও নাটকে ব্যোমকেশ বলতে প্রথমই মনে পড়ে জয়ন্ত চৌধুরীর কথা।  পরবর্তীতে ব্যোমকেশ চরিত্রে ঘুরে ফিরে দেবাশিস বসু বা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। অভিনয় নিয়ে কোনো কথা হবে না। তবে নাট্যরূপ কখনো কখনো দুর্বল মনে হয়েছে, গল্পের সেই ফ্লেভারটাকে ধরতে পারেনি। (নাটকটা শুনতে চাইলে নীচে ক্লিক করুন।)

গ্রুপ থিয়েটারে রাজনৈতিক বা দেশি-বিদেশি ক্লাসিকেরই প্রাধান্য সচরাচর। মঞ্চে বিদেশি থ্রিলার রূপান্তরেও সে ভাবে হাত দেননি কেউ। কিন্তু বাঙালির প্রিয় সত্যান্বেষী মঞ্চে এসেছেন। শরদিন্দুর গল্প ‘অর্থমনর্থম্’ নিয়ে ব্রাত্য বসুর নির্দেশনাতে ‘ব্যোমকেশ’ মঞ্চ সফল প্রযোজনা। লাস ভেগাসে বঙ্গসম্মেলনের মঞ্চে নাটকটার অভিনয় দেখেছিলাম। ডার্ক থিমের নাটক। হোটেল প্যারিসের রঙচঙে ব্যাকড্রপের মঞ্চে এ নাটকের অভিনয় ব্যাপারটা একেবারেই মানানসই নয়।  কিন্তু সকলের অভিনয় ছিল টানটান। শুভ্রজিৎ দত্তর ব্যোমকেশ চমৎকার লেগেছিল আমার মত আরও অনেকের। 

শেষমেশ নতুন ব্যোমকেশ। হ্যাঁ, যশরাজ ফিল্মসের ব্যানারে দিবাকর ব্যানার্জির নতুন সিনেমা ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’। চলনে বলনে, অভিনয়ে বাঙালির কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রথমেই মনে রাখতে হবে শরদিন্দুর পাঠক হিসেবে এই ব্যোমকেশ দেখা একেবারেই চলবে না। এর কাহিনিকার মূলত দিবাকর ব্যানার্জি। কিছু নাম আর চরিত্র ধার করা শরদিন্দুর কাছ থেকে। বাকিটা কল্পনার আকাশে পরিচালকের নিজস্ব উড়ান। কল্পনার সেই উড়ানে ব্যোমকেশ কলেজ পাশ করে চাকরির চেষ্টা করছেন। প্রেমিকার অন্যত্র বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে তিনি মুষড়ে পড়েন। এর মধ্যেই তাঁর কলেজেরই ছাত্র অজিতের বাবা ভুবনবাবু হঠাৎ নিখোঁজ। তদন্তে নেমে পড়েন ব্যোমকেশ। ব্যস, এরপর গোটা সিনেমা জুড়ে একের পর এক রহস্য উন্মোচন।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আন্তর্জাতিক টালমাটাল পরিস্থিতি, পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক, চীনের মাফিয়া- তার মধ্যে আবার এক সেক্সি সিডাকট্রেস-এর উপস্থিতি, ভিলেনের সঙ্গে ডার্ক নাইট ছবির ভিলেনের ভীষণ মিল- সব মিলিয়ে এক জমকালো ককটেল। দেশজ হয়েও আবেদনে আন্তর্জাতিক এক ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশ-রূপী সুশান্ত সিং রাজপুতের স্ক্রিন প্রেজেন্স বেশ ভালো। অজিত আনন্দ তিওয়ারিকেও ভাল লাগে। শুধু এই অজিত বড্ড মাথা গরম, দুমদাম মেরে দেন ব্যোমকেশকে।

আসলে শরদিন্দুর ব্যোমকেশ সত্যান্বেষী,  আর দিবাকরের ব্যোমকেশ ডিটেকটিভ। শরদিন্দুর সাহিত্য থেকে সিনেমার পর্দায় ব্যোমকেশের উত্তরণে পরিচালকের স্বাধীনতাটুকু মন থেকে মেনে নিতে পারলেই আর গোলমাল নেই তত।  কিন্তু পদে পদে সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমার সেতু বাঁধার চেষ্টা করলে সমূহ বিপদ। 

এই সবে শুরু। ওয়ার্নার ব্রাদার্স যখন ‘ব্যাটম্যান’-এর ফ্র্যাঞ্চাইজি করবে ঠিক করে,  তখন  ‘ব্যাটম্যান’ সংক্রান্ত সব কিছুর স্বত্ব তারা কিনে নেন। একইরকম আন্তর্জাতিক ভাবনায় দিবাকর শরদিন্দুর সাড়ে ৩২-টি ব্যোমকেশ বক্সী গল্পের মধ্যে ৩২ টির স্বত্ব কিনে ফেলেছেন। বাংলা ছাড়া অন্য যে কোনও ভাষায় ব্যোমকেশ বক্সীর গল্প অবলম্বনে কোনও ছবি বানানোর একমাত্র অধিকার এখন দিবাকরের। তাই আরো আরো ব্যোমকেশের অপেক্ষা করা যাক।
তবে এটা নিশ্চিত, আজও আমার অবসরের দুপুরে আমি শরদিন্দুর বইটাই হাতে তুলে নেব। তাতে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে আমার কল্পনায় নিশ্চিত ঢুকে পড়বেন ব্যোমকেশ-রূপী রজিত। মাঝে মাঝে ফিরে দেখব বাসু চ্যাটার্জির সিরিয়ালের কোনও এপিসোড। সেগুলোই, আজ বাইশ বছর পরেও, শরদিন্দুর মেজাজের খুব কাছে!

 


লেখক পরিচিতি - ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। বর্তমানে আমেরিকার স্যান অ্যান্টোনিওতে প্রবাস-জীবন। ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। লেখালেখি শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকে। কলেজ জীবন থেকে রেডিওর প্রতি ভালোবাসা ও আকাশবাণী কলকাতাতে রেডিও জকি প্রায় এক দশক। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।