শরদিন্দু সংখ্যা
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , এপ্রিল ৩০, ২০১৫
ইতিহাসের কথাকার
দিলীপ দাস
আমরা অনেকেই ইতিহাসকে দেখি ধোঁয়া কাঁচের মধ্যে দিয়ে, যেখানে সব কিছু ধূসর, প্রাণের কোনো সাড়া নেই, খালি শুকনো কিছু তথ্য আর তারিখ। কিন্তু একবার যদি কেউ সেই যাদুকাঠি খুঁজে পায়, যা ইতিহাসের চরিত্রগুলি করে তোলে সজীব, প্রাণবন্ত, তাহলে সে ইতিহাস-সুন্দরীর প্রেমে পড়তে বাধ্য। ইতিহাস-সুন্দরী তার হাত ধরে বিদিশা থেকে কাঞ্চীর রাজপথে ঘু্রিয়ে আনে। আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস-ভিত্তিক গল্প-উপন্যাস সেই যাদুকাঠির কাজটাই করে, অন্ততঃ আমার বেলায় করেছিল।
রুমা বক্তা, আমি টেবিলে কনুই রেখে, দু-হাতের ওপর মুখ রেখে শুনছিলাম। শিক্ষকরা সবাই উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন, আজকের সব ক্লাস বাতিল, তাই আমরা দুজন ইউনিভার্সিটি ক্যাফেটেরিয়াতে সময় কাটাচ্ছি।
আমি বললাম, ‘কিন্তু শরদিন্দুবাবু তো নিজেই বলেছেন যে তিনি Historical fiction লিখেছেন, Fictionalized history লেখেননি। তাহলে তাঁর গল্পে উপন্যাসে ইতিহাস আর কতটুকু? কল্পনাই তো বেশী’।
রুমা মুচকি হাসল। বলল, ‘জানি একথা বলবি। তোর মতো অনেকেই ভাবে কল্পকাহিনী মানেই অবাস্তব, তাই গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন থেকে যায়। শরদিন্দুবাবু ইতিহাস থেকে কিছু ঘটনা ও গোটা কয়েক চরিত্র নিয়েছেন। আর সেই কাঠামোর ওপর ইতিহাসের স্থান, কাল, রীতি নীতি, আচার ব্যবহার, খাবার-দাবার এই সব কিছু অক্ষুণ্ণ রেখে যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তাই Historical fiction. তাই এখানে যেমন পুরোটা ইতিহাস নয়, তেমন পুরোটা কল্পনাও নয়’।
‘তাহলে কতটা History আর কতটুকু Fiction, সেটা কি করে বুঝব?’
রুমা বরাভয়ের ভঙ্গী দিয়ে বলল, ‘কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি তাহলে বুঝবি - যেমন ধর ‘অমিতাভ’ গল্পটি। অজাতশত্রু যে অবন্তীরাজ চণ্ড প্রদ্যোতের আক্রমণের আশংকায় রাজধানী গিরিব্রজ থেকে গঙ্গা ও শোনের সঙ্গমে পাটল গ্রামে সরিয়ে নিয়েছিলেন সেটা ইতিহাসে আছে। বুদ্ধদেব পাটলিপুত্র সম্বন্ধে যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তাও বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থে দেখতে পাবি। আবার ‘মৃৎপ্রদীপ’ গল্পটি পুরোপুরি কাল্পনিক, খালি চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবী ছাড়া। তবে লিচ্ছবিদের সাথে আত্মীয়তা যে গুপ্তবংশের পক্ষে একটা গৌরবের ব্যাপার ছিল সেটা সঠিক। চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় কুমারদেবীর ছবি আছে, চন্দ্রগুপ্তের সন্তান সমুদ্রগুপ্ত তাঁর এলাহাবাদ শিলালিপিতে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন গুপ্তপৌত্র এবং লিচ্ছবিদৌহিত্র বলে। এটা নিছক মামাবাড়ির আদিখ্যেতা নয়’।
রুমার উদাহরণগুলি মিলিয়ে নিতে নিতে বললাম, ‘তবে ইতিহাস-সুন্দরী তার ঘোমটার নীচে সবসময় কিছুটা আবছা-অন্ধকার করে লুকিয়ে রাখেন, সমস্যাটা হয় সেইখানেই, কল্প-কাহিনী আর ইতিহাসের সীমারেখা টানা মুস্কিল হয়ে পড়ে’।
আমার উপমাটা লাগসই হয়েছে বুঝতে পারলাম। রুমা উচ্ছসিত হয়ে বলল, ‘সুন্দর বলেছিস, ভারতের ইতিহাসে এমনটা বহুবার হয়েছে। আসলে ইতিহাসেরও নিজস্ব একটা গতি আছে, তাই যুগে যুগে তার ছবি বদলায়। তাই ‘অমিতাভ’ বা ‘মৃৎপ্রদীপ’-এ ইতিহাসকে কিছুটা ধূসর লাগলেও, ‘গৌড়মল্লার’-এ কিন্তু সবকিছু স্পষ্ট, সবাই যেন আমাদের কত চেনা, কোথাও কোনো কুয়াশা নেই। আর তার সাথে ভেসে আসছে নির্ভেজাল বাংলার মাটির গন্ধ’।
‘আমার কিন্তু গৌড়মল্লার পড়ার পর মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় বজ্রদেব কেন আবার গৌড়ের রাজা হলেন না। কেন রূপকথার মত শেষ হল না - লেখক তো সেটা করতেই পারতেন’।
রুমা মাথা নাড়ে, ‘তাহলে ইতিহাসকে বিকৃত করা হত, শরদিন্দুবাবু সেটা হতে দেন নি। বেশীর ভাগ সময়েই ইতিহাস থেকে চরিত্রগুলি সাজিয়েছেন, কিন্তু তাদের উত্তরণ হয়েছে ইতিহাসের সীমা ছাড়িয়ে। তাই বজ্রদেব কাল্পনিক চরিত্র হয়েও আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়, তার জন্য আমরা মন খারাপ করি, তখন ইতিহাস হয়ে ওঠে সাহিত্য। আর তোর কথামত উপন্যাস সাজাতে গেলে তো আর সাহিত্য হতো না, সেটা বলিউডি সিনেমা হয়ে যেত’।
‘বজ্রদেব কাল্পনিক চরিত্র! আমি জানতাম না’। নায়ক কাল্পনিক মেনে নিতে আমার কষ্ট হচ্ছিল। ‘আর রানী শিখরিণী? তিনি কি সত্যি সত্যি ইতিহাসে ছিলেন?’
‘আচ্ছা, গৌড়মল্লারে এত চরিত্র থাকতে রানী শিখরিণীর কথা মাথায় এলো কেন? তোদের পুরুষমানুষদের মাথায় সব সময়--’ রুমার ভ্রু কুঁচকে গেছে। কপালের মাঝে তৃতীয় নয়ন ফুটে ওঠার উপক্রম হচ্ছে।
‘ঘাট হয়েছে, এবারে প্রথম থেকে বল’। আমি চট করে আত্মসমর্পণ করে আত্মরক্ষা করি।
ভ্রু সোজা হয়, তৃতীয় নয়ন মিলিয়ে যায়। রুমা আরম্ভ করে ‘আমার মতে শরদিন্দুবাবুর উপন্যাসগুলির মধ্যে ইতিহাসের কাঠামোর দিক থেকে গৌড়মল্লার Historically most accurate. ৬৩৭-৬৩৮ সালে গৌড়ের সম্রাট শশাঙ্কদেবের মৃত্যুর পরের কয়েকবছর গৌড়মল্লারের সময়কাল। এতে তিনি সেই যুগের ঘটনাবলী ও বাংলার ছবি প্রায় নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন। শশাঙ্কদেব যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন হর্ষবর্ধন ও তাঁর বন্ধু কামরূপরাজ ভাস্করবর্মা গৌড়ের ক্ষমতায় আঁচড় লাগাতে পারে নি, কিন্তু শশাঙ্কদেবের ছেলে মানবদেবের সময় এরা গৌড়ে হামলা করেন ও ভাস্করবর্মা গৌড়ের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ অধিকার করেন। গৌড় রাজ্য ভেঙ্গে কর্ণসুবর্ণ, সমতট, পুণ্ড্রবর্ধন, আর তাম্রলিপ্ত এই চার ভাগে ভাগ হয়ে যায় ও তার পরে শুরু হয় শতাব্দী-ব্যাপী মাৎস্যন্যায়’।
‘তুই খালি এর জন্য গৌড়মল্লারকে Historically most accurate বলছিস? এ তো সবাই জানে’।
‘না, সবাই জানে না এবং আরো কারণ আছে। শরদিন্দুবাবুর তথ্য কেমন নিখুঁত ছিল দ্যাখ - মানবদেব ভাস্করবর্মার সাথে যুদ্ধে হেরে গিয়ে গোপাকে বলছেন মহারাজ শশাঙ্কদেব আট মাস হল দেহরক্ষা করেছেন। আর মঞ্জুশ্রী-মূল-কল্প নামে এক বৌদ্ধ শাস্ত্রে লেখা আছে মানবদেব আট মাস পাঁচ দিন রাজত্ব করেছিলেন। শুধু তাই নয়, শরদিন্দুবাবু সে যুগে বাঙ্গালীর পোশাক-আশাক, খাবার-দাবার, অস্ট্রিক ভাষাভাষী বাংলার আদিম অধিবাসী, এসব প্রায় নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন। যেমন ধর, যে বনায়ু জলদস্যুদের জন্য বাংলার নৌবাণিজ্যের ক্ষতির উল্লেখ করেছেন তারা সম্ভবত বোর্ণিওর লোক। যদিও সেযুগে বাংলার নৌবাণিজ্য মার খাওয়ার প্রধান কারণ তাম্রলিপ্ত বন্দরের নাব্যতা কমে যাওয়া ও আরব বণিকদের স্থলপথ বাণিজ্য, জলদস্যুরা নয়। আবার শশাঙ্কর পর, সুলতানি আমল পর্যন্ত, গৌড়-বঙ্গে আর কেউ স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন করেন নি সেজন্য সেই যুগে সোনা দুষ্প্রাপ্য হয়েছিল এটাও সত্যি কথা’।
শশাঙ্ক সম্বন্ধে কিছু একটা বাদ পড়ে যাচ্ছে ভেবে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিন্তু শশাঙ্কর ব্যাপারে শরদিন্দুবাবু একটু পক্ষপাতিত্ব করেছে, তিনি যে বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন এত বড় একটা কথা তো তিনি কিছুই উল্লেখ করেন নি কাহিনীতে’।
রুমা সজোরে মাথা নাড়ে। ‘বুঝেছি তোর আপত্তি কোথায়। শীলভদ্র প্রথম সাক্ষাতের সময় বজ্রকে বলছেন যে হর্ষবর্ধনের সাথে যুদ্ধের উত্তেজনায় শশাঙ্ক বৌদ্ধদের ওপর কিছু হামলা করেছিলেন ও পরে ভুল বুঝতে পেরে বিরত হন। এখানে তিনি শশাঙ্কের বৌদ্ধবিদ্বেষ নিয়ে কিছু বলেন নি তাই এটা তোর কাছে পক্ষপাতিত্ব লাগলেও, এর সাথে কিন্তু বর্তমানের কিছু বিখ্যাত ঐতিহাসিক একমত। বাণভট্ট ও হিউয়েন সাং-এর লেখা অনুযায়ী শশাঙ্ক বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন এবং বোধিবৃক্ষ কেটে দেবার পর তিনি যন্ত্রণা দায়ক অসুখে মারা যান, এসব সঠিক নাও হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে শশাঙ্ক যদি এত বৌদ্ধবিদ্বেষী ছিলেন তাহলে তিনি কর্ণসুবর্ণের রক্তমৃত্তিকা বৌদ্ধবিহারের পৃষ্ঠপোষক কি ভাবে হলেন? অথবা তার পঞ্চাশ বছর পর চীনা পরিব্রাজক ই-সিং বাংলায় বৌদ্ধধর্মের বাড়বাড়ন্ত কি ভাবে দেখলেন? মনে রাখিস, হিউয়েন সাং নিজে বৌদ্ধ ছিলেন ও শ্রীহর্ষের সভাকবি বাণভট্ট শশাঙ্ককে গৌড়াধম,গৌড়ভূজঙ্গ বলে গালি দিয়েছেন - তাই তাঁরা অপক্ষপাত ছিলেন না এটা মনে করা যায় না।কাজেই শরদিন্দুবাবুই ঠিক লিখেছেন’।
আমি হাঁ করে ইতিহাস-সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমাকে অবাক দেখে রুমা বলল, ‘অবাক হচ্ছিস, আরো আছে। জয়নাগ বলে একটা চরিত্র আছে মনে পড়ছে তোর?’
‘হ্যাঁ, যে চোরের মতন সৈন্য ঢুকিয়ে রাজধানী অধিকারের মতলব করেছিল’।
‘অবাক হবি যে জয়নাগ বলে একজন সত্যিকারের রাজা ছিলেন গৌড়ে। তার নামের মুদ্রা ও ভূমিপত্র পাওয়া গেছে। যদিও তার সঠিক সময়কাল নিয়ে সন্দেহ আছে, অনেকে মনে করেন তিনি মাৎস্যন্যায়ের আমলের কোনো রাজা’।
আমি ভাবছিলাম কি ক্ষণজন্মা লেখক ছিলেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিহাস থেকে সরে আসেননি, কিন্তু সাহিত্যের আনন্দ পুরোমাত্রায় দিয়েছেন। বললাম, ‘গৌড়মল্লারের অন্তিমে যে মাৎস্যন্যায়ের শুরু দেখানো আছে, তা শেষ হয়ে বাঙ্গালীর গৌরব আবার ফিরে আসতে লেগেছিল একশো বছর, পাল বংশের প্রতিষ্ঠার পর। আবার সেই পাল বংশের গৌরব যখন অস্তাচলে, তখন শুরু হচ্ছে শরদিন্দুবাবুর আর এক উপন্যাস ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’। এবার এটা নিয়ে কিছু বলবি?’
অধ্যাপকদের মিছিল মুর্দাবাদ, অমুক চাই, তমুক চাই বলা স্লোগান দিতে দিতে পাশ দিয়ে গেল। আমরা চা খেতে খেতে চুপ করে দেখলাম। আমার বেশ কয়েকজন অধ্যাপককে দেখলাম মিছিলে সামিল। এখন তাঁদের অন্যরকম দেখতে লাগছে।
রুমা চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে আরম্ভ করল, ‘ঐতিহাসিক তথ্যের দিক থেকে বিচার করলে ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসের মূল কাহিনীসূত্রগুলি ইতিহাসের খুব কাছাকাছি। তবে তার চরিত্র গুলি ইতিহাসে থাকলেও শরদিন্দুবাবু তাদের অনেক অদলবদল করেছেন। প্রথমে ধর কর্ণদেব--’
‘তার মানে উপন্যাসের লক্ষ্মীকর্ণের কথা বলছিস?’
‘হ্যাঁ, ইতিহাসে তিনি কর্ণদেব নামেই বেশি পরিচিত। তিনি ছিলেন এক বীর যোদ্ধা, মোটেই গল্পের মতন হোঁৎকা কমিক চরিত্র ছিলেন না। আর আমাদের হিরো তৃতীয় বিগ্রহপাল এক দুর্বল রাজা ছিলেন, তাঁর আমলে পাল সাম্রাজ্য আরো ভেঙ্গে যায়’।
আমি খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। বললাম, ‘একটু পিছিয়ে গিয়ে গোড়া থেকে বল, আর যৌবনশ্রী সত্যি কেমন ছিলেন সেটা বলতে ভুলিস না’।
রুমা চিকন দাঁতে মুচকি হেসে শুরু করল, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসের পটভূমিকা আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে, ১০৪০ খ্রীষ্টাব্দের আশেপাশে, ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে তুর্কী আক্রমণ শুরু হয়েছে, আর ভারতের রাজারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে ব্যস্ত। এরকমই এক খানদানী যুদ্ধ চলছিল নয়পালের বাবা প্রথম মহীপাল আর কর্ণদেবের বাবা গাঙ্গেয়দেবের মধ্যে। সেই লড়াই চালু থাকে নয়পাল-কর্ণদেবের মাঝেও। তিব্বতি সাহিত্যে পাওয়া যায় যে নয়পাল-কর্ণদেবের লড়াইয়ে প্রথমে কলচুরিদের জয় হতে থাকে, কিন্তু পরে পাশা পালটে যায় ও নয়পাল কর্ণদেবের সৈন্য কচুকাটা করতে থাকেন। সেই যুদ্ধের মাঝে কোনো এক সময় কর্ণদেব কিছু বৌদ্ধবিহার লুটপাট করেছিলেন। সেই খবর পেয়ে অতীশ দীপঙ্কর ছুটে আসেন ও তাঁর মধ্যস্থতায় নয়পাল ও কর্ণদেবের সন্ধি হয়’।
‘এটা গল্পে আছে, আর এতেই যৌবনশ্রী-বিগ্রহপালের বিয়ের প্রস্তাব, তাই তো?’
‘একদল ঐতিহাসিক তাই বলেন। কিন্তু বীরভূমে কর্ণদেবের একটা শিলালিপি পাওয়া যাচ্ছে, যাতে কর্ণদেবের নাম ছাড়া আর কিছু পড়া যাচ্ছে না। সেটা দেখে আর একদল বলেন যে বিগ্রহপাল যখন রাজা সেই সময় কর্ণদেব দ্বিতীয়বার গৌড়-মগধ আক্রমণ করেন ও তখন যৌবনশ্রী-বিগ্রহপালের বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক হয়। আরেকদল বলেন, না ওটা যৌবনশ্রী-বিগ্রহপালের বিয়ে উপলক্ষে কর্ণদেব কোনো মন্দির বানিয়েছিলেন, তার শিলালিপি’।
‘যাই হোক, যৌবনশ্রী-বিগ্রহপালের বিয়েটা যে শেষে সত্যি সত্যি হয়েছিল, যুদ্ধের ডামাডোলে বাতিল হয়ে যায় নি, সেটা বাঁচোয়া’। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ি।
আমার স্বস্তিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রুমা বলে, ‘বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু স্বয়ংবর করে নয়। আর এটা জেনে দুঃখ পাবি যে যৌবনশ্রীর সাথে বিয়ের আগে বিগ্রহপালের আর এক মহিষী ছিলেন, এক রাষ্ট্রকূট কন্যা, যার নাম জানা যায় নি’।
‘তার মানে যৌবনশ্রী দুয়োরানী? যাঃ, পুরো রোমান্সটাই মাঠে মারা গেল। সত্যি কথাগুলো না জানলেই ভালো হতো মনে হচ্ছে’। আমি ব্যাজার মুখে বলি।
‘আরো শোন, বিগ্রহপালের ভায়রা-ভাই জাতবর্মা মোটেই বিগ্রহপালের বন্ধু ছিলেন না। পালবংশের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার বাবা বজ্রবর্মা পূর্ব বাংলায় এক রাজ্য ফাঁদেন আর সেটা মজবুত করে বাড়িয়ে তোলেন জাতবর্মা। যেহেতু কলচুরীরা পালেদের শত্রু, তাই জাতবর্মা কর্ণদেবের মেয়ে বীরশ্রীকে বিয়ে করেন ও নয়পালের বিপক্ষে, কর্ণদেবের পক্ষে যুদ্ধ করেন’।
‘হায় রে, গল্পে জাতবর্মা লোকটা বেশ ভদ্রলোক মনে হচ্ছিল। বেশ দুঃখ পেলাম’। একটা বড়ো শ্বাস ফেলে বললাম, ‘এবার যৌবনশ্রী কেমন ছিলেন সেটা বল’।
রুমা দাবড়ে ওঠে, ‘খালি তখন থেকে যৌবনশ্রী- যৌবনশ্রী করছিস। বললাম তো দুয়োরানী। তাঁর কোনো বর্ণনা কোথাও পাই নি। আর এতো তাড়াহুড়োই বা করছিস কেন? বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে আসা ইতিহাসের কণ্ঠস্বর শুনতে গেলে নিঃশব্দে চলাফেরা করতে হয়, একটু আওয়াজ করলেই সব ভোজবাজীর মতো অদৃশ্য হয়ে যায়’।
এবার আমি ফিস্ফিস্ করে বললাম, ‘মনে থাকবে। এবার হিরো বিগ্রহপালকে নিয়ে কিছু বল’।
‘এর আগে দু’জন বিগ্রহপাল ছিলেন, তাই গল্পের বিগ্রহপাল হচ্ছেন তৃতীয়। এর আমলে পালবংশ ভীষন দুর্বল হয়ে পড়ে। বিগ্রহপালের তিন ছেলে ছিল, তাদের মধ্যে লাঠালাঠি হয় এবং শেষ পর্যন্ত ছোটছেলে রামপাল রাজা হন। এই রামপালের জীবনী নিয়ে কবি সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিত কাব্য লিখেছেন। আর হ্যাঁ, আরো একজনের কথা বলার আছে। গল্পের নির্ভীক কর্ণাটরাজ বিক্রমাদিত্য ঐতিহাসিক চরিত্র, কিন্তু তিনিও একবার সুযোগ পেয়ে বিগ্রহপালকে আক্রমণ করেছিলেন’।
‘ধুর, বিগ্রহপালটা আসলে দেখছি একদম ইয়ে ছিল। গল্পের কোনো চরিত্রই দেখছি ইতিহাসের মত না’। হিসেব মেলে না দেখে, আমি টেবিলের ওপর কিল মারি। চায়ের কাপ-ডিস কেঁপে ওঠে। অন্য সবাই এদিকে একবার তাকায়।
রুমা আমার পাগলামো দেখে হাসে- ‘এই কথাটাই তোকে একটু আগে বলছিলাম। শিল্পীদের ইতিহাস লেখার দায় নেই। তাই তাঁরা চরিত্রগুলিকে নিজের মতো করে রং তুলি দিয়ে গড়েন। সেজন্য শরদিন্দুবাবুর পাত্র-পাত্রীরা ইতিহাসের কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়ায় নি, তারা স্নেহ-প্রেম-মমতার বাঁধনে গড়া মানুষ। কিন্তু যেখানে তিনি পাঠকের সামনে সমসাময়িক গৌড়-বাংলার ছবি তুলে ধরেছেন, সেখানে কোনো আপস করেন নি এবং ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হন নি’।
‘গৌড়-বাংলার কোন কোন ছবির কথা বলছিস তুই?’
‘প্রথমে ধর ভাষা। বিগ্রহপাল ও জাতবর্মার নৌকোর দিশারুরা একজন শৌরসেনী আর একজন মাগধী অপভ্রংশ ব্যবহার করছে অথচ দুজনেই দুজনকে বুঝতে পারছে, ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসের দিক দিয়ে এই প্রস্তাবনা সঠিক। সেটা ছিল অপভ্রংশের যুগ, এই দুটি ছাড়াও মহারাষ্ট্রী ও পৈশাচী এই চার ধরনের প্রাকৃত অপভ্রংশ চালু ছিল এবং এদের একে অপরকে সড়গড়ভাবে না হলেও বুঝতে অসুবিধা হত না। আবার দ্যাখ, লেখক বলছেন পাল রাজাদের স্থায়ী রাজধানী ছিল না, এটাও ঠিক, তবে তাঁদের স্কন্ধাবারগুলি জনপদ ছিল, Tent city ছিল না, আর যাকে গল্পে লেখক মুদ্গগিরি বলেছেন সেটা হচ্ছে আধুনিক মুঙ্গের’।
‘কিন্তু আমার একটা খটকা লাগে। পাল রাজারা বৌদ্ধ ছিলেন, তাই নয়পালের ভৈরবী চক্রে বসাটা কি করে সম্ভব হয়?’ আমি আমার আপত্তির কথা জানাই।
রুমা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে, বলে, ‘আলবৎ হয়, একশো বার হয়। কারণ বজ্রযান, তন্ত্রযান, কালচক্রযান, সহজযান – যে নামেই ডাকিস না কেন, সে সময় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের ঘাঁটি ছিল এই গৌড়-বাংলা। নয়পালের বাবা মহীপালও এদিকে ঝুঁকেছিলেন। আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের চুরাশী সিদ্ধাচার্যের একজন তো নয়পালের সমসাময়িক ছিলেন। কাজেই নয়পাল ভৈরবী চক্রে বসবেন সেটা আর আশ্চর্যের কি আছে। তবে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের চোখের সামনে এসব কেমন করে হল, সেটা আশ্চর্যের বিষয়’।
‘নয়পালের ভৈরবী চক্র নাহয় বুঝলাম, কিন্তু অতীশ দীপঙ্করের অগ্নিকন্দুক আর এই উপন্যাসে বিক্রমশীলার বোমাবাজী, এটা কি সময়োপযোগী?’
‘কারেকশন - অতীশ দীপঙ্করের হাতে অগ্নিকন্দুক ছিল না, ছিল তিব্বতী আচার্য বিনয়ধরের কাছে। দীপঙ্কর তিব্বত যাত্রা করেছিলেন ১০৩৮-১০৪২ সালের মধ্যে। যদি ১০৪২ সাল ধরা যায় তাহলে কাহিনীর সাথে পুরো সামঞ্জস্য থাকে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৯ বছর, যেটা শরদিন্দুবাবু ৬০ লিখেছেন। আর চীনে বারুদ আবিষ্কার হয়েছিল তার কয়েকশো বছর আগে। তাই বিক্রমশীলার বোমাবাজিটা লেখকের কল্পনা হলেও, তিব্বতী বৌদ্ধ তীর্থযাত্রীদের হাত ঘুরে ভারতে অগ্নিকন্দুক আসাটা অসম্ভব ছিল না’।
দেখলাম পাশের টেবিলে মাছের চপ অর্ডার হচ্ছে। মন মাছের দিকে ঘুরে গেল। বাঙ্গালীর মন!
মাছের কথা ওঠায় জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’-এ বাঙ্গালীদের মৎস্যপ্রীতির কথা বেশ সাড়ম্বরে উল্লেখ করেছেন লেখক। এক হাজার বছর আগেও কি আমরা এ-রকম মাছ-ভাতের আহ্লাদী মানুষ ছিলাম?’
আমার মুখের কথা খসতে না খসতে রুমা বলে ওঠে, ‘ছিলাম বৈ কি! আসলে গুপ্ত আমলে প্রায় পুরো ভারত নিরামিষ খেত, এটা ফা-হিয়েন লিখে গেছেন। তারপরের ছশো বছরে লোকে মাংস ধরলেও প্রধানত হরিণ ও ময়ূরের মাংস খেত। বাঙ্গালীরা ছাড়া বাকীরা মাছ তেমন খেত না এটাও সত্যি। মাছটা তাই আমাদের বিশেষত্ব রয়ে গেছে। কজন অবাঙ্গালী আছে বল দেখি যারা এক হাতে কাঁটা ছাড়িয়ে মাছ খেতে পারে? বাঙ্গালীর মাছ খাওয়া নিয়ে একটা প্রাচীন পদ আছে শোনাই তোকে
“ওগ্গরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জোই কান্তা খা’ই পুনবন্তা।”
‘এর মানে কি?’ আমি একেবারে গোঁত্তা খাই।
‘এটা প্রাকৃতঘেঁষা প্রাচীন বাংলা, মানে হচ্ছে কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, দুধ, মৌরলা মাছের ঝোল ও নালি শাক – যে স্ত্রী রোজ পরিবেশন করতে পারেন তার স্বামী পুণ্যবান’।
‘বাঃ সুন্দর। তুই পারিস মৌরলা মাছের ঝোল রাঁধতে?’ আমার চোখে আলো জ্বলে উঠল।
‘ধুর, আমি রান্নাই জানি না’।
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের মাঝে চেপে বললাম, ‘রান্না থাক, ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’-এ যে যুগসন্ধিক্ষণের কথা বলছিলি সেটা ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-তে কিভাবে দেখানো হয়েছে, এবার সে নিয়ে কিছু বল’।
‘বলছি, তার আগে মাছের চপ অর্ডার দে, খিদে পাচ্ছে, তার সাথে আর এক প্রস্থ চা’।
এই না হলে বাঙ্গালী – মাছের নাম করেতেই মাছের খিদে। মাছের চপের স্বাদ নিতে নিতে শুনতে রইলাম, ইতিহাস-সুন্দরীর মুখে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-র কথা।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রুমা আরম্ভ করে, ‘সে সময় যুগসন্ধিক্ষণ যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সেটা হয়েছিল ইউরোপে, কন্সটান্টিনোপলের পতন আর তার সাথে দেড় হাজার বছর পুরোনো রোমান সাম্রাজ্য শেষ হওয়াতে। ভারতবর্ষও তখন যুগ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে, ইসলামের প্রভাব পড়ছে ভারতীয় স্থাপত্য, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, সমাজ সব কিছুতে। সে এক আশ্চর্য সময়’।
‘আর সেই সময়ের লেখা ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’? রুমা থামতেই আমি জিজ্ঞাসা করি।
‘ঠিক, ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসের পটভূমিকা ১৪২৭ খ্রীষ্টাব্দের পর কোনো এক সময়ের হিন্দু বিজয়নগর রাজ্য, যাদের সাথে পড়শী বাহমনী সুলতানদের দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা। শরদিন্দুবাবু কিন্তু উপন্যাসের নায়ক দ্বিতীয় দেবরায়কে গড়েছেন দুজন রাজার চরিত্র একসাথে করে। তাদের একজন হচ্ছেন দ্বিতীয় দেবরায় নিজে আর অন্যজন প্রায় আশি বছর পরে বিজয়নগরের বিখ্যাত রাজা কৃষ্ণদেবরায়। রাজা দ্বিতীয় দেবরায়কে তাঁর ভাই গুপ্তহত্যা করতে চেয়েছিল এবং সেই ফাঁদে পা দিয়ে রাজার বেশ কিছু অনুচর প্রাণ হারালেও রাজা বেঁচে গিয়েছিলেন – এসব উপন্যাসেও আছে আর ইতিহাসেও আছে। সেই গণ্ডগোলের সুযোগ নিয়ে বাহমনী সুলতান বিজয়নগর আক্রমণ করে। যুদ্ধে বেশ ক্ষয়ক্ষতির পর দ্বিতীয় দেবরায় ধন-দৌলত নজরানা দিয়ে যুদ্ধবিরতি করেন। তাঁর পর রাজা হন দ্বিতীয় দেবরায়ের ছেলে মল্লিকার্জুন, যার নাম গল্পে আছে’।
‘তাহলে কি কলিঙ্গ রাজকুমারীদের ব্যাপারটা কল্পনা, ইতিহাসে নেই? আমি History আর Fiction-এর মাঝে হাবুডুবু খেতে খেতে বিদ্যুন্মালা ও মণিকঙ্কণার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠি।
‘কলিঙ্গ রাজকুমারীর সাথে বিয়ের ব্যাপারটা হয়েছিল রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের সময়। কলিঙ্গের গজপতি বংশীয় রাজাদের সাথে বিজয়নগরের বহুকালের বৈরিতা। যুদ্ধ না হলে বোধহয় দু-দলেরই হাত নিশপিশ করত। রাজা কৃষ্ণদেবরায় কলিঙ্গরাজ গজপতি-প্রতাপরুদ্রকে যুদ্ধে হারিয়ে প্রায় কটক অবধি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তখন কলিঙ্গরাজ তাঁর কন্যা অন্নপূর্ণাদেবীর সাথে কৃষ্ণদেবরায়ের বিয়ে দেন ও তার পর থেকে দুপক্ষই শান্তিতে বাস করে। তবে কলিঙ্গরাজ কুমারী কদিনে তেলেগু শিখেছিলেন সেটা ইতিহাসে লেখা নেই। কৃষ্ণদেবরায় যুদ্ধে বাহমনী সুলতানদের পুরোপুরি পর্যদুস্ত করেছিলেন ও তারা কৃষ্ণদেবরায় যত দিন বেঁচে ছিলেন আর মাথা তুলতে পারে নি। এখন বুঝলি ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’-তে বিভিন্ন সময়ের ঘটনাগুলি কেমন একসাথে সাজিয়েছেন লেখক।’
‘বুঝলাম। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। শরদিন্দুবাবু এই উপন্যাসের ভূমিকাতে লিখেছেন পর্তুগীজরা আসার আগে ভারতে বন্দুকের প্রচলন ছিল। এ সম্বন্ধে তোর কি মতামত?’
‘শরদিন্দুবাবু ঠিক লিখেছেন। দ্বিতীয় দেবরায়ের পূর্বপুরুষ বুক্করায়, গল্পের হুক্ক-বুক্কর একজন, তাঁর সাথে বাহমনী সুলতানের যুদ্ধের সময় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল। সেটা ছিল ১৩৬৭ সাল আর ভাস্কো-দা-গামা এসেছিল ১৪৯৮ সালে, এই যুদ্ধের এক শতাব্দীরও পরে। কিন্তু বন্দুক ছাড়াও আরো একটা খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে এই উপন্যাসে, সেটা তোকে এখনো বলিনি’।
একদল ছাত্র হই হই করে ক্যাফেতে ঢুকল। আমি ভালো করে শোনার আগ্রহে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লাম। দেবরূপ আমাকে দেখে আমাদের টেবিলে আসতে চাইল, আমি ইশারায় মানা করে দিলাম। রুমা এখন অন্য জগতে, পুরো ব্যাপারটা দেখতেই পেল না। সে বলে চলল-
‘উপন্যাসে বলরাম-অর্জুনবর্মা পালাতে পালাতে একটা গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল মনে আছে? যার গায়ে লেখা ছিল ‘দেবদাসী তনুশ্রী গৌড়নিবাসী শিল্পী মীনকেতুকে কামনা করিয়াছিল’। ঠিক সেই রকম গুহা একটা সত্যি সত্যিই আছে আমাদের দেশে’।
‘সেই রকম গুহা? তাতে ঐরকম লেখা আছে? সত্যি? কোথায়?’ আমার কৌতূহল কূল ছাপাল।
রুমা আমার কৌতূহল দেখে হেসে ফেলল। বলল, ‘ছত্তিশগড়ের রামগড়ের কাছে। জোগীমারা গুহা। তাতে ব্রাহ্মী হরফে লেখা আছে ‘দেবদাসী সুতনুকা-- রূপদক্ষ সুন্দর যুবক দেবদিন্না, সুতনুকাকে ভালোবেসেছিল’। খ্রীষ্টপুর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর লেখা, আজ থেকে প্রায় বাইশ-শো বছর আগে পাথরের গায়ে লেখা এক প্রেমপত্র’।
আমি সেই প্রাচীন প্রেমপত্রের কথা ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। ‘আশ্চর্য মানুষ ছিলেন শরদিন্দুবাবু! কোনো খুঁটিনাটিই তাঁর নজর এড়িয়ে যায় নি। আমার কি মনে হয় বলতো, যদি ইস্কুলে ইতিহাসের সাথে সাথে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসগুলো পড়ানো হত তাহলে আমরা পরীক্ষার জন্য ইতিহাস মুখস্থ না করে ইতিহাসকে ভালোবাসতে শিখতাম। আর বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাস একসাথে পড়া হয়ে যেত’।
‘কথাটা মন্দ বলিসনি’, রুমা আমার কথায় সায় দেয়, ‘আমাদের ইস্কুলে ইতিহাস মানে কয়েকজন রাজার নাম সাল তারিখ আর মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ টাইপের কিছু প্রশ্ন। যেমন ধর ইস্কুলের ইতিহাস বইয়ে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য নিয়ে, তাঁর নবরত্ন সভা ও কালিদাস ইত্যাদিদের নিয়ে অনেক কিছু লেখা আছে। এসব নিয়ে আমরা গল্প ফাঁদি, সিনেমা আর টি ভি সিরিয়াল তৈরি হয়। কিন্তু গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা স্কন্দগুপ্ত আমাদের কাছে তেমন সমাদর পান নি’।
‘তুই ‘কালের মন্দিরা’ উপন্যাসের কথা বলছিস কি?’ গল্প কোন দিকে এগোচ্ছে আমি বোঝার চেষ্টা করি।
‘হ্যাঁ, ভারতের ইতিহাসে মহাবীর অথচ নিঃসঙ্গ নায়কের শিরোপা যদি কাউকে দিতে হয়, তাহলে সেটা নিঃসন্দেহে গুপ্তসম্রাট স্কন্দগুপ্তের প্রাপ্য। ‘কালের মন্দিরা’-তে তাঁর ঠিক এই ছবিটিই এঁকেছেন শরদিন্দুবাবু। মোটে বারো বা পনের বছর সিংহাসনে ছিলেন তিনি, এর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব ভারতবর্ষকে হূণ আক্রমণ থেকে বাঁচানো। যারা পুরো মধ্য এশিয়াতে ধ্বংস ও ত্রাস ছড়িয়েছিল, যাদের জাতভাইরা রোমান সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল, সেই দুর্ধর্ষ হূণরা প্রথম পরাজয়ের স্বাদ পেল হূণকেশরী সম্রাট স্কন্দগুপ্তের কাছে। তিনি তাদের এমন মেরেছিলেন যে তাদের বিষদাঁতই উপড়ে ফেলেছিলেন। চিন্তা করতেও শিউরে উঠি, তিনি না থাকলে তখনকার ভারতের কি হত।’
‘হূণরা দু-বার ভারত আক্রমণ... আর দুবারই স্কন্দগুপ্ত তাদের মেরে ভাগিয়েছিলেন, তাই তো?’
‘কালের মন্দিরাতে দুবার হূণ আক্রমণের কথা বলা আছে বটে, কিন্তু বর্তমানের ঐতিহাসিকরা মনে করেন স্কন্দগুপ্তের সাথে হূণদের একটাই চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়েছিল। তাতেই তারা নির্বল হয়ে পড়েছিল। স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর আবার হূণ আক্রমণ হয় ও প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে হূণরা আবার মাথা তুলেছিল বটে কিন্তু সেবার আর এক গুপ্তসম্রাট নরসিংহগুপ্ত বলাদিত্য ও কনৌজের রাজা যশোবর্মণ, একসাথে বা আলাদা আলাদা ভাবে হূণদের হারিয়ে ছেড়েছিলেন’।
‘আচ্ছা, স্কন্দগুপ্ত কি সত্যিই বিয়ে করেন নি? ভারতের ছোটখাটো রাজাদেরও যখন অনেকগুলি করে রানী থাকত, তখন ভারতসম্রাট স্কন্দগুপ্ত বিয়ে করেন নি, এটা আমার আশ্চর্য লাগে’।
রুমা ব্যাগ থেকে আয়না বার করে মুখটা একবার চটকরে দেখে নেয়। চুলটা ঠিক করে, ঠোঁটের সিঁদুরে একবার যাদুকাঠি বুলিয়ে নেয়, তারপর বলে, ‘নাঃ, সারা জীবন তিনি তাঁর গরুড়-ধ্বজ নিয়ে শত্রুদমন করতে গিয়ে বোধহয় বিয়ে করার সময় পান নি। তাঁর মুদ্রাতে তাঁর সাথে এক নারীর ছবি আছে, কিন্তু ঐতিহাসিকরা মনে করেন সেটা শ্রী-লক্ষ্মীর ছবি’।
‘একটা কথা মনে পড়ল, কালের মন্দিরার ভূমিকাতে শরদিন্দুবাবু লিখেছেন যে স্কন্দগুপ্ত তিনরাত মাটিতে শুয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। এটা কি গল্পকথা না ইতিহাসে আছে?’
‘স্কন্দগুপ্তের ভিটারি শিলালিপিতে এটা সত্যিই লেখা আছে। তাঁর বাবা কুমারগুপ্তের রাজত্বের শেষ দিকে, যখন ঘরে বাইরে মাথা তুলেছে শত্রুর দল, তখন ‘বিচলিত কুললক্ষ্মী’কে সুস্থির করতে ‘ত্রিযামা ক্ষিতিতলে’ শয়ন করে কুমার স্কন্দগুপ্ত পুষ্যমিত্র জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করেন ও বিজয়ী হন’।
রুমা ঘড়ি দেখল, ব্যাগ গুছোতে লাগল। আমি বললাম, ‘এতো তাড়াতাড়ি কোথায় যাবি? বোস আর একটু, কালের মন্দিরা থেকে আরো দু-একটা হীরে মাণিক দিয়ে যা’।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতে রুমা বলে চলল, ‘হুণদের মধ্যে রোট সিদ্ধবৃত্তি ও রোট জয়বৃত্তি বলে দুজন লোক সত্যিই ছিল, যার থেকে শরদিন্দুবাবু রোট্ট ধর্মাদিত্য বা রট্টা যশোধরা নামগুলো নিয়েছেন। শরদিন্দুবাবু কেমন খুঁটিনাটির দিকে নজন রাখতেন দ্যাখ - জম্বুকের পান্থশালার পারসিক অতিথিদের দেখিয়েছেন অগ্নি উপাসক, পঞ্চম শতাব্দীতে এটা হওয়াই স্বাভাবিক। সংঘের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রট্টাকে বলছেন হাজার বছর আগে শাক্যমুনির শ্রীমুখ থেকে উপদেশ এসেছিল, হিসেব করে দেখ, স্কন্দগুপ্ত থেকে বুদ্ধ প্রায় হাজার বছরই বটে। তবে গুপ্তযুগের প্রাকৃত ভাষা জানা চিত্রকের পক্ষে পান্থশালার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের পালিভাষা বোঝা উচিত ছিল কি না সেটা নিয়ে আমি দোটানায়। আমার মতে বোঝা উচিৎ ছিল’।
আমাকে রুমার কথা শোনার নেশায় পেয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি শেষ করতে ইচ্ছে করছিল না। বললাম, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছিস? এই সমস্ত উপন্যাসগুলিতে ভারতের ইতিহাসের এক একটা গৌরবময় অধ্যায়ের শেষ দিকটা, যখন ইতিহাসের এক মস্ত পালাবদল হতে চলেছে, সেই সময়টা দেখানো হয়েছে’।
রুমা চুপ করে একটু ভাবল। বুঝতে পারলাম ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে কিন্তু ওর মন ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতিহাসের পথে পথে। ভাবুক চোখে বলল, ‘ঠিক বলেছিস, আর এটাও ঠিক যে তাঁর রচনায় যুদ্ধ বিগ্রহ, সাম্রাজ্যের ভাঙ্গা গড়া সব ছাড়িয়ে বিজয়পতাকা তুলেছে স্নেহ প্রেম-ভালোবাসা। তাই জাতবর্মাকে দেখি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আগের রাতে বাঁশী বাজাতে। বজ্র গৌড়ের সিংহাসন ভুলে ফিরে আসে বেতসগ্রামে গুঞ্জা আর মায়ের কাছে। রাজা দেবরায় ক্ষমা করে দেন অর্জুনবর্মা আর বিদ্যুন্মালার প্রেম, আর রট্টা যশোধরা সমস্ত আর্যাবর্তের সম্রাট স্কন্দগুপ্তর পট্টমহিষী হবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বিয়ে করেন হারিয়ে-ফেরা রাজকুমার চিত্রককে। এটাই মানুষের ধর্ম, আমরা ধ্বংসের মধ্যেও প্রেমের স্বপ্ন দেখতে পারি’।
আমি চমকে উঠলাম। ভীষণ ভালো লাগছিল রুমার কথা শুনতে। বললাম, ‘আমার শেষ প্রশ্ন, এই সমস্ত উপন্যাসগুলোর মধ্যে কোন জায়গাটা তোর সবচেয়ে ভালো লাগে?’
ক্যাফেটেরিয়া প্রায় খালি, দু-চার জন ছড়িয়ে ছিটিয়ে এপাশ ওপাশে বসে। শিক্ষকদের মিছিলও বোধহয় শেষ হয়েছে, চারিদিক বেশ চুপচাপ। রুমা জানালার বাইরে রোদের দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কোন জায়গাটা জানিস? সেই যখন গুহার মধ্যে রট্টা প্রথম চিত্রককে তার ভালোবাসার কথা জানাল, বলল গুহার অন্ধকার আজ আমার সব লজ্জা ঢেকে দিয়েছে, বলো - রট্টা, রট্টা যশোধরা, উঃ কি দারুণ রোমান্টিক!’
আমার ভেতরে একটা শিহরণ খেলে গেল ওর কথা শুনে। ওর হাত দুটো টেবিলের ওপর রাখা, মসৃন আঙ্গুলগুলো আলতো ভাবে শুয়ে আছে। আমি ওর হাতের ওপর হাত রেখে বললাম, ‘রুমা, তুই-ই আমার ইতিহাস সুন্দরী। আমাকে হাত ধরে অবন্তী মগধের পথে পথে ঘোরাবি?’
ওর ভ্রু-দুটো একটু বাঁকল, কিন্তু এবারে সেখানে তৃতীয় নয়নের বদলে ফুটল একটা যুঁইফুলের আভাস। খালি বলল, ‘দূর পাগল’।
যে সব বই থেকে তথ্যসূত্র সংগ্রহ করেছি তাদের কয়েকটি -
গৌড়মল্লার ও তুমি সন্ধ্যার মেঘ
Majumdar
R C, History of Ancient Bengal, G Bhadarwaj & Co,
Calcutta, 1971, pp. 72-78 and pp. 137-142,
তুঙ্গভদ্রার তীরে
Nilakantha Sastry
K A, History of South India, 3rd Ed, Oxford University
Press, Delhi, 1961, pp. 264-287
কালের মন্দিরা
Agarwala,
Asvini, Rise and Fall of the Imperial Guptas, Motilal
Banarasidas, Delhi, 1989, pp. 210-219
বাঙ্গালীর মৎস্যপ্রীতি
নীহার-রঞ্জন রায় - বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব, অষ্টম সংস্করণ, দে’জ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ-৪৪৪
রামগড় গুহালিপি
Basham A
L - The Wonder that was India, 3rd Ed, Rupa, 1967,
p. 185
লেখক পরিচিতি - যাদবপুর ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনী। বর্তমানে আমেরিকার সেন্ট লুইস্ (মিসৌরী) শহরবাসী। ইতিহাস পেশা নয়, নেশা। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও Indology নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।