শরদিন্দু সংখ্যা
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , এপ্রিল ৩০, ২০১৫
শরদিন্দু স্মরণে
তাঁর মৃত্যুর পর কেটে গেছে পঁযতাল্লিশ বছর। তবু বেস্ট সেলার বইয়ের লিস্টে আজও তিনি অনিবার্য। আজও বুকসেলফে রাখা তাঁর রহস্যকাহিনি থেকে ঐতিহাসিক থেকে ভূতের গল্পের বিশাল রেঞ্জে বাঙালির মুগ্ধতা। তাঁর কলম থেমে যাবার অনেক বছর পরে জন্মেছেন যে সব বাঙালি পাঠক- তাঁদের কিশোর কি তরুণবেলাতেও আদরের বন্ধু হয়ে উঠেছে তাঁর বই। এ জনগ্রাহীতা বিস্ময়কর।
এই অসামান্য জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯-তে, জৌনপুরে। বড় হয়ে ওঠা মুঙ্গের আর পাটনায়। পারিবারিক ধারা মেনে ওকালতি শুরু করেও বছর তিনেক পরে সেসব ছেড়েছুড়ে সাহিত্যচর্চায় আত্মনিবেদন। লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশের কয়েক বছর পর প্রথমে বোম্বে টকিজে আর তারপর ফ্রিল্যান্স স্ক্রিপ্টরাইটার হিসাবে কাটিয়েছেন। খুব মনে হয়, সফল চিত্রনাট্যকার হিসেবে মানুষের ভাল লাগার রসায়নটা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই আজও তিনি ভীষণ প্রাসঙ্গিক আর বেজায় জনপ্রিয়।
সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ থেকে ভূতান্বেষী বরদা, ঐতিহাসিক গল্প উপন্যাস থেকে সদাশিব বা অন্যান্য ছোটগল্প- সবই গোগ্রাসে গিলি আমরা। ঐতিহাসিক কাহিনিগুলো তাদের রূপ-বর্ণ-গন্ধ-ভাষা দিয়ে এমন এক অসামান্য বাতাবরণ তৈরি করে যে তার সবটুকু মাধুর্য শুষে নিতে হাপিত্যেশ অপেক্ষায় থাকেন পাঠক- শুরু থেকে শেষ। বিশ শতকের তিরিশের দশকের শিক্ষিত, মেধাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি, যুক্তিবাদী যে যুবক সত্যান্বেষীটিকে সৃষ্টি করেছিলেন তিনি অনেক যত্নে,তার গল্প আজ এত বছর পরেও বেস্টসেলার। বাঙালির ঘরোয়া ইমেজ ছেড়ে, কলকাতা আর বাংলা ছেড়ে, ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে ভারত বিজয়ে সে বেরিয়েছে অনেক আগেই। এখন তার আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার দিন। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় সিনেমার জগতে যিনি কাটিয়েছেন, ব্যোমকেশকে ঘিরে তৈরি হওয়া গত কয়েক বছরের এই উন্মাদনা এক অর্থে তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মানের অভিজ্ঞান।
এইরকম এক সময়ে দাঁড়িয়ে শরদিন্দু সাহিত্যের আলোচনাতে আমরাও উত্সাহী।
তাঁর সাহিত্য নিয়ে আলোচনা আগেও হয়েছে। বিশিষ্ট মানুষরা তাঁর মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু তার অধিকাংশই সঙ্কলিত মুদ্রিত বইতে। আন্তর্জালের দুনিয়ার পাঠকের কাছে অনেক সময়েই তা অধরা থেকে যায়। তাই সকলের কাছে তাঁকে পৌঁছে দিতে অবসর-এর এই 'শরদিন্দু স্মরণে' শ্রদ্ধার্ঘ্য।
শরদিন্দুর সাহিত্য সৃষ্টির সময়ে যাঁরা কিশোর ও আজ প্রবীণ, তাঁদের লেখা যেমন অবসর-এর এই বিশেষ সঙ্কলনে আছে, তেমনি শরদিন্দুর প্রয়াণের অনেক পরে জন্মে তাঁর লেখনীর প্রসাদগুণে তাঁকে আপন করে নিয়েছেন যে নবীনরা- লিখেছেন তাঁরাও। প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের ভাললাগাকে শরদিন্দু বেঁধে দিয়েছেন এক তারে, এক সুরে। এখানেই তিনি অসাধারণ।
এই সঙ্কলনে সমগ্র শরদিন্দু সাহিত্যের ওপর এক সুচিন্তিত, মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন সুমিত রায়।
সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের নানা দিক আর অন্যান্য দেশি-বিদেশি গোয়েন্দাদের সঙ্গে তার তুলনা করেছেন সুজন দাশগুপ্ত। পল্লব চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় এসেছে ব্যোমকেশের সাহিত্যপ্রীতি আর ভাস্কর বসুর কলমে ধরা পড়েছে ব্যোমকেশের সখা তথা সত্যবতীর ঠাকুরপো।
কথাসাহিত্যিকের ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা করেছেন শেখর বসু ও অভীক দত্ত। তাঁর কিশোরসাহিত্যের মূল্যায়ন করেছেন দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য। আর ঐতিহাসিক উপন্যাস আর গল্পের কথাকার শরদিন্দু ধরা পড়েছেন দিলীপ দাস ও ঈশানী রায়চৌধুরীর লেখনীতে। শরদিন্দু সাহিত্যের নানাদিকে আলোকপাত করেছেন ঋজু গাঙ্গুলি ও সোমা মুখোপাধ্যায়। আর কালি-কলম-কাগজের জগতের বাইরের শরদিন্দু ধরা দিয়েছেন কেয়া মুখোপাধ্যায়য়ের কলমে। প্রয়াত লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর অকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন একটি রম্যরচনা। প্রয়াত প্রাবন্ধিক বিকাশ বসুর লেখাতে পেলাম শরদিন্দুর অ-গোয়েন্দা কাহিনীতেও সত্যান্বেষণের গোপন কাহিনী। এই লেখা দুটি এবং শেখর বসুর লেখাটি পূর্ব প্রকাশিত। অন্যত্র সঙ্কলিত লেখা তিনটি পাঠকের হাতে পৌঁছনো সহজ নয়, অথচ আলোচনা তিনটিই মনোজ্ঞ। সর্বোপরি, কৌতূহলী পাঠক ও তরুণ লেখকদের কিছু নতুন ভাবনার সন্ধান দেওয়ারও সমূহ সম্ভাবনা। তাই আন্তর্জালের মাধ্যমে অনেকের কাছে পৌঁছে দেবার ভাবনা থেকেই লেখা তিনটি সংযোজিত হল।
শরদিন্দু সম্পর্কে শ্রদ্ধা জানিয়ে এই সময়ের কবি যশোধরা রায়চৌধুরী লিখেছেন:
মনোজগতের বাতায়ন খোল, চারুবাক!
ভাষাঅঙ্গের কত ছল তুমি দেখেছ।
কাহিনিবয়নশিল্পের রূপদক্ষের
সূচীমুখ কারুকাজগুলি করে রেখেছ।
তুমি তো আমার বাঙলাভাষার অবধান।
তুমি তো আমার অভিধানছাড়া শিক্ষা।
হে রাজা, বৃদ্ধ-তরুণ, রসিক মহাশয়
আমাকে বানাও গল্পকথনে দক্ষা।
আমি কি তোমার সহচরী হব, অছিলায়
যদিও জানি যে কৈশোরময় সন্ধির
রতিশিখরের পাঠ দিয়েছিলে, গুরু, তাই
আমি ছাত্রী, তা, রসিকা তো হই, বন্ধুই...
প্রগল্ভতায় শাণিত বয়ান, ক্ষুরধার
আমাকে শেখাও কী করে সাজায় শব্দ
আমি জানি আজো লিখনে আমি তো পৃথুলা
ঘষেমেজে দাও এই অন্তর, মহা থির!
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাসের অপূর্ব ভাষাবিন্যাস, কল্পনা আর বাস্তবের মিল ও অমিল, অসামান্য কিছু গল্প আর যুক্তিবাদী রহস্যকাহিনির প্রতি অপার মুগ্ধতা থেকে আজও বাঙালি পাঠক ও লেখক সকলেই তাঁর কাছে সাহিত্যের পুনর্পাঠ নিয়ে থাকেন। এত বছর পরেও এভাবে সমকালীন থেকে যাওয়া আর এখনকার কবি সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করতে পারাই শরদিন্দুর বিশেষত্ব।
শরদিন্দু স্মরণে অবসরের এই সংখ্যা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত। আপনাদের ভালো লাগাতেই আমাদের এই প্রয়াসের সার্থকতা।
কেয়া মুখোপাধ্যায়
ভাস্কর বসু
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।