প্রথম পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
শরদিন্দু সংখ্যা
অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , এপ্রিল ৩০, ২০১৫
প্রসঙ্গ: শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
সুমিত রায়
ভূমিকা
সেই পঞ্চাশের দশকে আমরা যখন কৈশোরের গণ্ডী ছেড়ে বড়োদের পৃথিবীতে পা দিচ্ছি, "যখের
ধন" তো নয়ই, এমনকি "আবার যখের ধন"-এও মন ভরে না, তখন পত্র-পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার
খুব রমরমা। বইয়ের দাম মাত্র দুতিনটাকা হতে পারে কিন্তু তা কেনার রেস্ত নেই, আমাদের
ব্যাঙের আধুলি ছিলো শারদীয়া সংখ্যা। কম পয়সায় দুই মলাটের মধ্যে একাধিক উপন্যাস,
অনেক গল্প আর কবিতা, একআধটা প্রবন্ধের ভূরিভোজ। আজকাল যেমন হয় তেমনই, তফাৎ এই যে
লিখতেন সেকালের সব তাবড় তাবড় লেখকেরা। তারাশঙ্কর, অচিন্ত্যকুমার, বিমল মিত্র, ...
সবায়েরই দেখা পাওয়া যেতো এই শারদীয়াতে।
দেখা পাইনি কেবল শরদিন্দুর, অন্তত আমার স্মৃতি যা বলছে। মনে হয় একটা সাময়িক সমাপতন।
শরদিন্দুর দেখা পেতে হলে যেতে হতো পাড়ার লাইব্রেরীতে। দেখা না-পেতে বলাটা আরো ঠিক
হবে, কেননা শরদিন্দুর বই কখনো বইয়ের তাকে পাওয়া যেতো না, ইস্যু হয়ে গেছে।
খদ্দের-পাঠকদের লাইন পঞ্চাশ-ষাটের কম নয়। প্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে আবার দুতিনজন করে
রবাহূত বই ধার নিতেন, এভাবে একশো হাত ঘুরে যদি এবং যখন আমাদের হাতে পৌঁছতে পারতো
তখন তা দিয়ে ঠোঙাও হয়না। আমাদের কালে অসাধারণ জনপ্রিয় ছিলেন শরদিন্দু। সত্তরের দশক
পর্যন্ত যা দেখছি তাতে তাঁর বইয়ের তৃতীয় বা চতুর্থ মুদ্রণ হওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক,
বেশ কিছু বইয়ের আবার একাধিক সংস্করণও হয়েছে। এছাড়া শ্রেষ্ঠ গল্প, অমনিবাস তো আছেই,
তারপরেও শরদিন্দু-সরষে থেকে আরো তেল বার করবার জন্য প্রকাশকের ঘানি ঘুরেই যাচ্ছে,
বার হচ্ছে ঐতিহাসিক সমগ্র, সরস গল্প ইত্যাদি বহু সঙ্কলন। ১৯৭০ সালে ব্যোমকেশ
অমনিবাসের প্রথম খণ্ড দিয়ে আনন্দ পাবলিশার্স এক জলোচ্ছ্বাস শুরু করেন, তারপর
অমনিবাসেরই এগারোটা খণ্ড প্রকাশ হয়েছে। তাতে আর যার যাই সুবিধা হোক না কেন, আমাদের
মতো পাতচাটা পাঠকদের কিছু বাড়তি লাভ হয়েছে-- যথা, তাবড় তাবড় সাহিত্যরসিকদের
(উদাহরণ: সুকুমার সেন) লেখা মোটামুটি প্রমাণ সাইজের ভূমিকা, ক্রোড়পত্র, বিজ্ঞাপনের
উদ্ধৃতি, গ্রন্থপরিচয় আর সবচেয়ে যা মুখরোচক তা হলো নিজের লেখা নিয়ে শরদিন্দুর নিজের
মন্তব্য। আমাদের এই রচনার প্রায় সব তথ্যই আমরা সংগ্রহ করেছি সেখান থেকে। ভুলে যাবার
আগে বলি, পাড়ার লাইব্রেরীতে যানজট ছাড়ানো গিয়েছিলো বইয়ের পোকা দিদিমাকে লাইফ
মেম্বার করে দিয়ে, লাইফ মেম্বারদের খাতির হতো বেশী, নতুন বই সবার আগে তাঁরাই
চাখবার সুযোগ পেতেন।
জীবনকথা
১৮৯৯ সালে জৌনপুরে শরদিন্দুর জন্ম, বড়ো হয়েছেন মুঙ্গেরে আর পাটনায়। বংশে ওকালতি
করার চল ছিলো। প্রথম কবিতা লেখেন চোদ্দো বছর বয়সে, প্রথম সম্পূর্ণ গল্পের কালে বয়স
ষোলো, প্রথম ছাপা হচ্ছে একটি কবিতার বই, তাঁর বয়স তখন কুড়ি। উনিশ বছরের পাত্র বিয়ে
করলেন এগারো বছর বয়সের পাত্রীকে। তারপর আইন পড়া, ছাড়া, বাবার আগ্রহাতিশয্যে ওকালতি
শুরু, তিন বছর পরে তা ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যজীবী। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত গল্প
লিখেছেন, তারপর খুব একটা ঘোরাঘুরি না করেই তখনকার নামকরা মাসিক পত্রিকার
লেখকগোষ্ঠীতে ঢুকে গেছেন তাঁর লেখার গুণের জোরে। প্রথম গল্পের বই জাতিস্মর, প্রকাশ
১৯৩২। ১৯৩৮ সালে মুম্বই যান বোম্বে টকীজে চিত্রনাট্য লেখার চাকরী নিয়ে, সেখানে
রইলেন ১৯৪১ পর্যন্ত। তারপর স্বাধীন চিত্রনাট্যকার, সেখানে সফল হওয়া সত্ত্বেও
সিনেমার জগত ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় ফিরে আসেন ১৯৫২ সালে। সে সঙ্গে আবাস
পরিবর্তন, মুম্বই থেকে পুণেতে। জীবনের শেষ পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন, মৃত্যু ১৯৭০
সালে।
১৯৩২ সালে প্রথম প্রকাশ থেকে ১৯৭০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শরদিন্দুর চল্লিশাধিক
বছরের সাহিত্যচর্চার ধারা তারাশঙ্করের মতো বাঁধভাঙা জলস্রোত না হলেও ক্ষীণতোয়া বলা
যায় না। তেষট্টিটি মৌলিক বইয়ের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, এ ছাড়া সঙ্কলন ও রূপান্তর-- যথা
গল্পের ভিত্তিতে উপন্যাস, চিত্রনাট্যের উপন্যাসরূপ ইত্যাদি-- আছে বেশ কয়েকটি।
সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ, তার মধ্যে আছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক,
কিশোর সাহিত্য, অনুবাদ। রেকর্ডের জন্য পালাও লিখেছেন। অনুবাদ করেছেন একটিই, ঠিক
ভাষান্তর বলা যায় না, ছায়া অবলম্বনে বলা ঠিক হবে, সেটি এতোই উৎকৃষ্ট যে সেটিকে
মৌলিক সাহিত্যের তকমা দিলে গর্হিত অপরাধ হবে না। প্রবন্ধও লিখেছেন, তবে তা
'চন্দ্রহাস' ছদ্মনামে, আমরা তার সংগ্রহ কোথাও খুঁজে পেলাম না। এই ছদ্মনামে কিছু
কবিতাও লিখেছেন। সংখ্যা গুণলে ছোটো গল্পই সবচেয়ে বেশী, সংখ্যায় দুশো বাইশ, ছত্রিশটি
বইতে সংগৃহীত; উপন্যাস তেরোটি, নাটক ও চিত্রনাট্য তেরোটি, কিশোরপাঠ্য কাহিনী
আটাশটি। জনপ্রিয়তা তো ছিলোই, তাছাড়াও 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র
পুরস্কার পেয়েছেন, কিশোর সাহিত্যের জন্য ভারত সরকারের দেওয়া পুরস্কার, কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎস্মৃতি পুরস্কার, এছাড়া আর কিছু পত্রপত্রিকার পুরস্কারও তাঁর
ভাগ্যে জুটেছিলো।
পরিবেশ
শরদিন্দুর সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের পরিবেশটা একটু দেখা যাক। তাঁর জন্ম থেকে
সাহিত্যজগতে প্রবেশ আর স্বীকৃতি পর্যন্ত, অর্থাৎ শতাব্দীর শেষ থেকে চতুর্থ দশক অবধি
একদিকে রবীন্দ্রনাথ আর অন্যদিকে শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের আকাশে পূর্ণগৌরবে শোভা
পাচ্ছেন। কবিতার জগতে যাঁদের রবীন্দ্র-অনুসারী বা "ভারতী" গোষ্ঠী বলা হয়, --
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত পুরোধা, আর কাছাকাছি আছেন করুণানিধান, কুমুদরঞ্জন, যতীন্দ্রনাথ
বাগচী, কালিদাস রায় -- তাঁরা প্রকাশ হয়ে অস্তমুখী কিন্তু আকাশে আলোর রেশ রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের রোমাণ্টিকতার বদলে বাস্তব অভিজ্ঞতার রূপায়ণ চেয়ে আর একটু পরে এসেছেন
মোহিতলাল আর যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। কল্লোল গোষ্ঠীর লেখকেরা -- অচিন্ত্যকুমার,
প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু -- এঁরা সবাই শরদিন্দুর প্রায় সমবয়সী ,
মোহিতলাল-যতীন্দ্রনাথের বাস্তবতার দাবীকে আরো জোরদার করে তাঁরা দেখা দিয়েছেন
ত্রিশের দশক থেকে। কল্লোল পত্রিকা বাহন করে একই সময়ে এসেছেন বিষ্ণু দে,
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বিদেশী কবিতার ছোঁয়াচ নিয়ে। আর ছিলেন জীবনানন্দ আর নজরুল, যাঁদের
ঠিক কোনো গোষ্ঠীর তকমাই পরানো যায় না। প্রসঙ্গত, এর মধ্যেই মোহিতলাল আর কল্লোল
গোষ্ঠীকে ব্যঙ্গ করার সূত্রে উদ্ভব "শনিবারের চিঠি" পত্রিকার, সুখের কথা যে কটু
ব্যঙ্গ ছাড়াও তার কলেবর ভরাবার জন্য সেখানে তখনকার বেশ কয়েকজন উদীয়মান সাহিত্যিক
সহজ সরল গদ্য, ব্যঙ্গ কবিতা, প্যারডি ইত্যাদি প্রকাশ করার সুযোগ পান। এঁদের মধ্যে
শরদিন্দুও ছিলেন।
শরদিন্দুর জন্ম হবার সময় থেকেই বাংলা গদ্যে চলিত ভাষার ব্যবহার নিয়ে লিখতে থাকেন
প্রমথ চৌধুরী (ভারতী, ১৯০২) আর তার অপ্রতিরোধ্য প্রকাশ ১৯১৪ সালে জাত "সবুজপত্র"
পত্রিকার মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এ আন্দোলনকে সমর্থন করেন আর একে ঘিরে এক
লেখকগোষ্ঠীও গড়ে এবং বেড়ে ওঠে। বিরোধিতার প্রবলতাও কিছু কম ছিলো না। সাহিত্যজগতে
শরদিন্দুর প্রবেশ আর স্থিতু হবার কাল জুড়ে এই বিরোধিতা চলেছে, তারপর আস্তে আস্তে
পাল্লা চলিত ভাষার দিকে ঝুঁকেছে। শরদিন্দুর লেখার ক্রমবিকাশ দেখলে সেখানে বাংলা
সাহিত্যে ভাষার বিবর্তনের একটা চলমান ছাপ স্পষ্ট দেখা যাবে। একটা কথা ভুললে চলবে না
যে চল্লিশের দশক ঘিরে প্রায় পনেরো বছর শরদিন্দু মুখ্যত চিত্রনাট্য আর নাটক
লিখছিলেন, সেখানে এই সাধু-চলিত ভাষার বিরোধের কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কাজেই শরদিন্দু
কিছুদিন অন্তত এই বিরোধে লিপ্ত হবার দায় থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
যেখানে শরদিন্দুর যাতায়াত বেশী সেই কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রও আমাদের আলোচনার এই
সময়টিতে ঘটনাবহুল। রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র তো তাঁদের সৃষ্টির চমক নিয়ে উপস্থিত
আছেনই, এছাড়াও নতুন লেখকেরা সমাজ, সমাজব্যবস্থা, জীবন, জীবনদর্শন, সবকিছু নতুন
দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখতে চেয়েছেন, নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন , সাহিত্যের গণ্ডী ক্রমাগত
প্রসার করতে চেয়েছেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অকল্পনীয় মারণলীলা মানুষের পুরোনো চিন্তা
আর বিশ্বাসের ভিত্তি নির্মূল করে দিয়েছে, বাংলাদেশেও তার অভিঘাত এসে পৌঁছেছে। এদিকে
ইংরেজ শাসন থেকে মুক্তি পাবার ইচ্ছা আর প্রয়াস আস্তে আস্তে শুরু হয়ে রূপ নিয়েছে
প্রলয়ের। বাংলা কথাসাহিত্যে সাড়া জেগেছে, কল্লোল-ত্রয়ী পথনির্দেশ করেছেন --
অচিন্ত্যকুমার বলেছেন প্রেম আর যৌনতার কথা, প্রেমেন্দ্র মিত্র সহজ কথায় লিখেছেন
হেরে যাওয়া মানুষদের কাহিনী, বুদ্ধদেব বসু প্রতিদিনের সাধারণ ব্যাপার আর মনের আয়নায়
তার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতি আর পল্লীজীবনের কথা
বলেছেন। শৈলজারঞ্জন বললেন সাঁওতাল আর কয়লাখনির লোকেদের কথা, তারাশঙ্কর শোনালেন
বীরভূমের মাটির কাছাকাছি মানুষদের কাহিনী। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় ফ্রয়েডীয়
দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে দেখলেন, লিখলেন মানুষের আদিম প্রয়োজন আর প্রবৃত্তির কথা --
ক্ষুধা আর যৌনবিকারের। অন্য অনেক লেখার মধ্যেও প্রমথনাথ বিশী ঐতিহাসিক উপন্যাস
লিখেছেন গুটিদুই। বনফুল লিখেছেন নানা চরিত্রের কথা আর যারা আমাদের মতোই কিন্তু
কোনোভাবে বিশিষ্ট, সে সব মানুষদের ভাবনার জটিলতা নিয়ে অন্নদাশঙ্কর। সাহিত্য এঁদের
প্রত্যেকেরই জীবিকা, এঁদের দৃষ্টি গভীর, কৃতির ফসল প্রতুল।
ওপরের লেখকদের প্রায় সবাই ছোটো গল্পও লিখেছেন, সেখানেও বিষয় নির্বাচনে তাঁদের
দর্শনের প্রতিফলনই দেখা যায়। শরদিন্দুর লেখার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে আরো দুয়েকজনের
কথা মনে আসতে পারে। তার প্রথম হলেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, কিছু উপন্যাস লিখে
থাকলেও গাল্পিক হিসেবেই তাঁর বেশী খ্যাতি। প্রভাতকুমার খুব জমিয়ে গল্প বলতেন--
জীবনের সহজ সমস্যা, সরল সমাধান, কৌতুকে অম্ল, ভাবাবেগে মধুর, ভারী মনোহারী।
শরদিন্দু যখন কিশোর আর তরুণ, তখনই প্রভাতকুমারের বেশীর ভাগ গল্প ছাপা হয়। আবেদনে
তার কাছাকাছি হলো কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গল্প যা আপাত লঘু কিন্তু
মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্ঘাত আর বেদনার মৃদু সুর কৌশলে লুকিয়ে থাকে বলে পাঠককে বিচলিত
করে। রাজশেখর বসু 'পরশুরাম' ছদ্মনামে বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গাত্মক গল্প লিখে গেছেন,
যদিও ব্যঙ্গ কখনোই দুঃসহভাবে প্রখর নয় কিন্তু দৃষ্টি শাণিত আর মনোগ্রাহীভাবে
তির্যক। অনেকে তাঁর লেখায় প্রভাতকুমারের প্রভাব দেখতে পান। শরদিন্দু আর রাজশেখরের
মধ্যে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো। পরিমল গোস্বামী কম লিখলেও নির্মল কৌতুকে ভরা ছোটো ছোটো
গল্প আর নাটক লিখে নাম করেছিলেন, শরদিন্দুর একেবারে সমকালীন বলা যায়। আর একজন লেখক
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁর মজার গল্পের জন্যই, যদিও তাঁর
দুতিনটি উপন্যাস ধ্রুপদী সাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে। তিনি ছিলেন জীবন-অনুরাগী, তাঁর
অনুভূতি ছিলো সূক্ষ্ম আর প্রকাশ কণ্টকহীন, তাঁর লেখা গল্প যাকে বলে feel-good
stories, পড়লেই মন ভালো হয়ে যায়।
শরদিন্দু যখন কিশোরমাত্র তখন বাংলা রঙ্গমঞ্চে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আর গিরিশচন্দ্র
ঘোষের নাটকের জয়জয়কার। তার পরে আবার রঙ্গমঞ্চের কাছ থেকে নাটকের তাগিদ আসতে থাকে
ত্রিশের দশকে যখন শিশিরকুমার ভাদুড়ী, নরেশ মিত্র আদি প্রতিভাবান অভিনেতা আর
পরিচালকেরা দেখা দেন। প্রথমে এঁদের চাহিদা মেটে প্রতিষ্ঠিত উপন্যাসের নাট্যরূপে --
সর্বাগ্রে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস। পরে মন্মথ রায়, মহেন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ কিছু
নাট্যকার সাধারণ রঙ্গমঞ্চের উপযোগী নাটক রচনা আরম্ভ করেন, মুখ্য উদ্দেশ্য
দর্শকরঞ্জন। এই সময়, ত্রিশ-চল্লিশ দশকে, শরদিন্দুকেও এই দলে দেখা যায়। বনফুল বিশেষ
রীতিতে দুটি জীবনীমূলক নাটক -- "বিদ্যাসাগর" আর "শ্রীমধুসূদন" -- লিখে নাম করেন।
চল্লিশের দশকের শেষদিকে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গীর নাটক রচনায় সার্থক হয়েছিলেন তুলসী
লাহিড়ী আর বিজন ভট্টাচার্য। ততোদিনে অপেশাদারী রঙ্গমঞ্চও আস্তে আস্তে আত্মপ্রকাশ
আরম্ভ করে দিয়েছে।
রহস্য কাহিনী
১৯৭০ সালে মৃত্যুর অব্যবহিত আগে শরদিন্দু তাঁর সমগ্র রচনা সঙ্কলনের প্রথমটি ছাপা
দেখে গেলেন, "শরদিন্দু অমনিবাস - প্রথম খণ্ড - ব্যোমকেশ", প্রকাশক আনন্দ
পাবলিশার্স। ছাপার পর বই আর পড়তে পায় না (আনন্দ পাবলিশার্স চতুর ব্যবসায়ীগোষ্ঠী),
মে ১৯৭২-এর মধ্যে চারটি মুদ্রণ, পরে আরো কতো হয়েছে জানি না। এর থেকে শরদিন্দুর
জনপ্রিয়তা যে কতোখানি তা বোঝা যায়, নাকি শরদিন্দুর বদলে ব্যোমকেশ বলাটা আরো
যুক্তিযুক্ত হবে? বাঙালী যেন এতোদিন রুদ্ধনিঃশ্বাসে প্রতীক্ষা করছিলো কবে
ব্যোমকেশকে দুই মলাটের ভেতর পাবে, এই উচ্ছ্বাস সেই পাবার স্বীকৃতি। বাকী সব
ব্যোমকেশকাহিনী নিয়ে দ্বিতীয় খণ্ড বার হয় ঠিক একবছর পরে, মুদ্রণের ব্যাপারে সেটিরও
ওই একইরকম সাফল্যের ইতিহাস। এই অমনিবাসের গ্রন্থপরিচয়, ভূমিকা ও ক্রোড়পত্রে অনেক
প্রয়োজনীয় তথ্য আছে, আমরা তার বহুল ব্যবহার করবো।
ব্যোমকেশের আগে যেসব গোয়েন্দা -- আমরা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য রহস্য কাহিনীর কথা বলছি
-- বাংলাসাহিত্যের অঙ্গনে বিরাজ করতেন তাঁদের ঠিক রসিক, রহস্যরসিক, সমাজে বার করা
যায় না। ব্যোমকেশের পরে উৎসাহিত হয়ে যে সে ধরনের গোয়েন্দা ভীড় করে এসেছেন তা বলতে
পারলে ভালো লাগতো কিন্তু তা বলা যাচ্ছে না। আমরা কিশোরপাঠ্য কাহিনীর কথা বাদ
দিচ্ছি। কিছুদিন যাবৎ একেন সেন নামে এক পুলিস কর্মচারীর কীর্তিকলাপের কাহিনী আমাদের
একটু আশা দিচ্ছে। দুঃখের কথা এই যে একেনবাবুর যশ আর সেই সঙ্গে কীর্তির সংখ্যা যেমন
লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাঁর বসওয়েলের উৎসাহ সেই অনুপাতে বাড়ছে না।
ব্যোমকেশ বক্সী ত্রিশের দশকে এক বুদ্ধিমান বাঙালী তরুণ, জীবিকা বেসরকারী ডিটেকটিভ।
আমাদের সঙ্গে তার ছাপার অক্ষরে কেতামাফিক পরিচয় "সত্যান্বেষী" গল্পে (তার অব্যবহিত
আগে আরো দুটো গল্পে তাকে দেখা গিয়েছিলো, তা ধর্তব্যে না আনলেও চলবে)। সেখানে
পিতৃস্বত্ত্বভোগী, মেসবাসী এক সাহিত্যান্বেষীর সঙ্গে রুমমেট হয়ে ব্যোমকেশের পরিচয়
১৩৩১ বঙ্গাব্দে। এর নাম অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, আর কাজের খাতিরে ব্যোমকেশ তখন অতুল
মিত্র ছদ্মনামের আড়ালে লুকিয়ে আছে। রহস্যভেদের সূত্রে অজিত আর ব্যোমকেশের মধ্যে
বন্ধুত্ব গাঢ় হয়ে যায়। তারপর অনেকদিন তারা এক বাসায় কাটিয়েছে আর অজিত বাঁড়ুজ্যে
হয়েছে ব্যোমকেশের কীর্তির কাহিনীকার। শার্লক হোম্স্ আর ওয়াটসনের সঙ্গে সাদৃশ্য
অতি পরিষ্কার।
সুকুমার সেন (অমনিবাস-১), প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর স্বয়ং
শরদিন্দু ( অমনিবাস-২) ব্যোমকেশ সম্বন্ধে বেশ কিছু বলেছেন, তার সারাংশ দেখা যাক।
হোম্সের সঙ্গে তুলনা টেনে সুকুমার সেন বলছেন যে ব্যোমকেশ হোম্সের মতো
"উৎকেন্দ্রিক নয়। সে শিক্ষিত, মেধাবী, তীক্ষ্ণদৃষ্টি, সংযতবাক, সহৃদয়। তাঁর চরিত্রে
মনস্বিতা ও গাম্ভীর্য ছাড়া এমন কিছু নেই যাতে তাকে সমান বয়সের বাঙালী ছেলের থেকে
স্বতন্ত্র মনে করতে হয়।" সত্যান্বেষী খেতাবটা ডিটেকটিভের বিকল্প, ব্যোমকেশের নিজস্ব
আবিষ্কার। দশম গল্পে (শরদিন্দুর জবানীতে; আমরা দেখছি প্রকাশের ইতিহাস দেখলে সেই
"অর্থমনর্থম্" গল্পটি পঞ্চম, তবে তিলকে তাল করার দরকার নেই, কলম থেকে বার হবার
তারিখ মিলিয়ে দেখলে দশম হতেও পারে) শরদিন্দু তার বিয়ে দিলেন, কারণ "কী আর করবে --
বেচারা প্রেমে পড়ে গেল।" ভেবেছিলেন "বিয়ে হলে বাঙালীর ছেলের আর পদার্থ থাকে না, তাই
ব্যোমকেশকে তখনই রিটায়ার করিয়ে দিয়েছিলাম"। হোম্সের কাহিনী যাঁদের পড়া আছে তাঁরা
জানবেন যে কোনান ডয়েল তাকে মেরেই ফেলেছিলেন। দুষ্ট লোকে বলে যে সৃষ্টি স্রষ্টার
চেয়ে বেশী নাম কিনছে, এটা ডয়েল সায়েবের পছন্দ হয়নি। শরদিন্দু আর ব্যোমকেশের
ব্যাপারটা ততোটা ঘোরালো মনে হয় না, ওই সময় বরাবর শরদিন্দু ভাগ্যান্বেষণে মুম্বই
গিয়ে চিত্রনাট্য নিয়ে জড়িয়ে পড়েন, অন্য কোনো কিছু লেখার ব্যাপারেই আর নজর দিতে
পারেননি। কোনান ডয়েল অনিচ্ছাসত্ত্বেও হোম্সকে ফেরৎ আনতে বাধ্য হন পাঠক আর
প্রকাশকদের চাপে। শরদিন্দুর বেলাতে তেমন চাপ ছিলো না, মুম্বই থেকে ফিরে আসার পর
"পরিমল গোস্বামীর বাড়ীর ছেলেমেয়েরা তাঁর কাছে অভিযোগ করেন -- কেন আপনি আর
ব্যোমকেশকে নিয়ে লিখছেন না?" শরদিন্দু তাদের কথা শুনে একাদশ কাহিনী "চিত্রচোর"-তে
ব্যোমকেশকে ফেরৎ এনেছেন। সে গল্পে পত্নী সত্যবতীও উপস্থিত আর বিয়ের এতোদিন পরেও
ব্যোমকেশের ক্ষুরধার বুদ্ধি বা দুজনের ভালোবাসায় কোনো কমতি দেখা যায় না। বাঙালীর
বিবাহোত্তর অধঃপতন সম্পর্কে শরদিন্দুর ধারণা যে ভুল হতে পারে, ব্যোমকেশকে দিয়ে তা
বুঝতে পেরে তিনি তাকে নিয়ে আরো বাইশটি কাহিনী লেখেন, তাদের কয়েকটিকে শরদিন্দুর
শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে ধরা হয়ে থাকে
ডিটেকটিভ গল্পের ধরণ দুটোর একটা রূপ নেয় -- "হত্যাকারী-কে", whodunit সেখানে
হত্যাকারী কে তা গোয়েন্দাও জানেন না, আমরাও জানিনা ; আর "ক্যামনে-ধরি-তায়",
howcatchem, যেখানে গল্পের শুরুতেই অপরাধ আর অপরাধীর পরিচয় আমরা জানি, মজা হচ্ছে
গোয়েন্দা কী ভাবে তাকে ধরবেন তার ব্যাখ্যানে। ব্যোমকেশ দুভাবেই আমাদের দেখা দিয়েছে,
গোয়েন্দা সাহিত্যের রীতি অনুযায়ী প্রথমটাই বেশী। দ্বিতীয়টির প্রমাণ "মাকড়সার রস",
সেখানে ব্যোমকেশকে অকুস্থলেও যেতে হলো না, অজিতের প্রক্সিতেই কাজ চালিয়ে নিলো।
"সীমন্তহীরা"ও এই ধাঁচের গল্প। ত্রিশের দশকে ইংরেজী গোয়েন্দা কাহিনীর জগতে এই
"হত্যাকারী-কে" জাঁরটির আবার দুটো শাখা দেখা যায়। তার একটি কোনান ডয়েল আদি
পূর্বসুরীদের প্রতিষ্ঠিত চলনের অনুসারী, সেখানে অতিপ্রাকৃত ঘটনার স্থান নেই,
গুলিগোলা না থাকলেই ভালো, সামান্য ধ্বস্তাধ্বস্তি সহ্য করা যেতে পারে। কাহিনীর
স্থান-কাল-পাত্র মোটামুটি সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতাসম্মত, চমৎকারিত্ব একটুআধটু
অবশ্যই থাকতে হবে, কিন্তু ঘটনা আর চরিত্রের বিশ্লেষণে অসাধারণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে
গোয়েন্দা কী ভাবে রহস্য উন্মোচন করলেন, গল্প দৌড়োয় তার ওপর ভর করে। প্রসঙ্গত এই
শাখাটির বিশাল জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে গোয়েন্দা কাহিনীর এই যুগকে "স্বর্ণযুগ"
বলা হয়। এদিকে মার্কিন লেখকরা যথা রেমণ্ড চ্যাণ্ডলার, ড্যাশিয়েল হ্যামেট এই দশকেই
"হত্যাকারী-কে" জাঁরে বৈচিত্র্য আনেন তাঁদের কাহিনীতে অপরাধ জগতের আর সমাজের নীচের
তলার লোকেদের সরাসরি উপস্থিত করে। সেখানে বলপ্রয়োগ আর গুলি ছোঁড়াছুঁড়ি চালু,
ভাষাটাও সাধারণ সভ্য ব্যবহারের একটু বাইরে আর এদের কব্জায় আনা আর রাখবার জন্য
গোয়েন্দাদের নির্ভীক আর বলশালী হতে হয়। এই দ্বিতীয় শাখাকে "ঝানু-গোয়েন্দা" বলা যেতে
পারে, ইংরেজীতে একে hard-boiled বলা হয়। ব্যোমকেশকে শরদিন্দু এদিকে আসতে দেননি,
ক্লাসিক "হত্যাকারী-কে"-তেই আটকে রেখেছেন। এবিষয়ে শরদিন্দু বলছেন, "... আগাথা
ক্রিসটি ও কোনান ডয়েলের আমি দারুণ ভক্ত ছিলাম। ১৯২৯ সালে ... মনে হলো এত ডিটেকটিভ
বই পড়েছি, টেকনিকটা আয়ত্ত হয়েছে। এবার নিজে গোয়েন্দা কাহিনী লিখলে কেমন হয়।"
এই আগ্রহ নিয়ে শুরু করে শরদিন্দু ব্যোমকেশকে খুব যত্ন করে গড়লেন। ব্যোমকেশের
কাহিনীকার অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাদ গেলো না। বললেন "... চেয়েছিলাম ব্যোমকেশ নিজে
যেমন অসাধারণ, নামটির মধ্যেও তেমনি যেন অসাধারণত্ব থাকে। ...[ব্যোমকেশের
গোয়েন্দাগিরি] স্রেফ ইনটিউশন। ব্যোমকেশ অঙ্কে খুব দড়। তার বাবাও ছিলেন বড়ো
ম্যাথামেটিসিয়ান। মা বৈষ্ণব বংশের মেয়ে। এই দুয়ের সংমিশ্রণে ব্যোমকেশের বুদ্ধি খুব
দৃঢ় হয়েছে। এই বুদ্ধি দিয়েই সে জটিল রহস্যের জট ছাড়ায়।" স্বয়ং ব্যোমকেশ জানাচ্ছে যে
কলেজে প্রোফেসররা তাকে bomb-case বলে ডাকতেন ("আদিম রিপু")। আর অজিত সম্পর্কে
বলছেন, "অজিত সিনথিটিক চরিত্র। আমার বাল্যবন্ধু অজিত সেনের নামে নাম।" ব্যোমকেশের
চেহারা নিয়ে কথা হচ্ছিলো, বললেন, "ব্যোমকেশের নাক হল ধারালো, বেশ লম্বা, নাতিস্থূল
চেহারা। ...[পুরোটাই] কল্পনা ঠিক নয়। বলতে পারেন সেলফ প্রজেকশান। নিজেরই আত্মকৃতি।"
একটু বিস্তৃত অর্থে দেখলে ব্যোমকেশের যা চিন্তাভাবনা, যা বিশ্বাস, যা মূল্যবোধ, এ
সবের মধ্যে শরদিন্দু নিজেকেই ছড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যোমকেশকে নিয়ে যা গল্প লিখেছেন তার
প্রতিটিতে লেখকের অতি সতর্ক যত্নের ছাপ স্পষ্ট। তেমনই হওয়া উচিত, ব্যোমকেশের কাহিনী
যদি হলেও-হতে-পারতো আত্মজীবনী হয় তাহলে সেখানে আলস্য আর অমনোযোগের স্থান হওয়া উচিত
নয়। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করার লোভ সামলানো যাচ্ছে না, রাজশেখর বসু,
'পরশুরাম', তাঁর (দুটির) একটি গোয়েন্দা গল্পে গোয়েন্দার নাম রেখেছেন সরলাক্ষ হোম আর
বসওয়েল বটুক সেন -- অনুপ্রাসটা চোখে পড়তেই হবে। শরদিন্দু কিন্তু গোয়েন্দা গল্পের
জগতে পাকা খেলুড়ে হতে ঢুকছেন, তাঁর পক্ষে এমন প্রগল্ভতা ঠিক হতো না।
ব্যোমকেশ দৈহিক শক্তিপ্রয়োগ, গুলিগোলা-- এসব পছন্দ করে না। যে সব ব্যাপারে
প্রাণসংশয় হতে পারে সে সবও তার পছন্দ নয়, অবশ্য সবসময়ে সেটা তার ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপর
নির্ভর করে না। শরদিন্দু বলছেন, "আমার মেজাজের সঙ্গে গুলিগোলা খাপ খায় না। তাছাড়া
গোয়েন্দা কাহিনীকে আমি ইনটেলেকচুয়াল লেভেলে রেখে দিতে চাই।" হোম্সের সবচেয়ে
বদমায়েস প্রতিদ্বন্দ্বী মোরান সায়েব দুবার হোম্সকে বধ করা চেষ্টা করেছিলো।
ব্যোমকেশের কপালেও তাই। আমরা সাতটা কাহিনীতে দেখছি ব্যোমকেশকে ঘুষোঘুষি বা
গোলাগুলির চক্করে পা দিতে হয়েছে, তিন বার অজিতকেও জড়িয়ে ফেলতে হয়েছে। ব্যোমকেশের
ইচ্ছে মতো যদি সব করা যেতো তাহলে ও বোধহয় বৈঠকখানায় বসে শুধু বুদ্ধি খাটিয়েই সব
রহস্যের কিনারা করে ফেলতো। তবে দরকার হলে, অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহের জন্য অকুস্থল তো
বটেই, আরো এদিক ওদিক যাওয়া, নানা লোকের সঙ্গে কথা বলা, ছদ্মবেশ ধারণ-- এসব কাজে তার
কোনো শৈথিল্য কিন্তু আমরা দেখি না। আমাদের বিশেষ সৌভাগ্য যে শরদিন্দু তার একহাতে
টর্চ, একহাতে পিস্তল ধরিয়ে জলের পাইপ বেয়ে ওঠাননি। শরদিন্দুর রহস্য কাহিনী সাধারণত
বেশ ঠাসবুনুনির, অনেক চরিত্র আনেন না, ছোটো গল্পে তো নয়ই। গল্প শেষও করেন
নিপুণভাবে, সব আলগা সূত্র গুছিয়ে বেঁধে দিয়ে। ঘটনার যাথার্থ্য বোঝাবার জন্য যতোটা
প্রাক্কথন দরকার ততোটুকুই রাখেন। ভুল সূত্রের, red herring সরাসরি ব্যবহার নেই
বললেই হয় ("চোরাবালি'" গল্পে সরকারের ব্যাপারটা ব্যতিক্রম, আরো দুয়েকটা ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে)। শরদিন্দুর গল্প ছোটো ছোটো প্রায় অদৃশ্য সূত্র খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে
আবছাভাবে দেখিয়ে তার অমোঘ পরিণামের দিকে এগিয়ে যায়, শ্লথতা নেই তাতে। একটু ভুল বলা
হলো, মাঝে মাঝে ব্যোমকেশের দাম্পত্যজীবনের কিছু ছবি ঝলক দিয়ে যায়, কিন্তু তা
সাধারণত এতো মধুর -- কম কথায় মধুর প্রেমের আভাস দেওয়া শরদিন্দুর রচনাশৈলীর একটা
বৈশিষ্ট্য -- যে তা সামান্য বিক্ষেপ ঘটালেও তা কমিক রিলিফ মাত্র, তার বিপক্ষে নালিশ
চলে না।
হত্যারহস্য কাহিনীতে মাঝে মধ্যে পুলিশের উপস্থিতি প্রয়োজনীয় হয়। তার একরকম হলো
কাহিনীর শেষ অঙ্কে, সেখানে বলপ্রয়োগ, হাতকড়া পরানো ইত্যাদি কিছু অবশ্যকর্তব্য
সমাধার দায়িত্ব নিয়ে হাজির থাকা,-- গোয়েন্দার সহকারী হিসেবে বলা যেতে পারে -- যাতে
গোয়েন্দা স্বয়ং রহস্য উন্মোচনের ব্যাপারটায় অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে সেটাকে যতোটা নাটকীয়
করা যায় ততোটা করতে পারে। আর এই বর্ণালীর একেবারে অন্য ধারে হলো যেখানে পুলিশের
ক্ষমতার চৌহদ্দিতে গোয়েন্দাকে জোর করে ঢোকানো হয়েছে -- বড়ো কর্তার নির্দেশে বা
কুশীলবের অনুরোধে -- পুলিশ সেটা মোটেই পছন্দ করছেন না, নানা ভাবে গোয়েন্দাকে
হেনস্তা করছেন। আর আমরা পুলিশের বোকামিতে কৌতুক, গোয়েন্দার শাণিত ব্যঙ্গোক্তিতে
হর্ষ আর শেষপর্যন্ত গোয়েন্দার কথাই ঠিক হলো দেখে আত্মপ্রসাদ লাভ করছি। এই বর্ণালীর
মাঝে যে কোনো জায়গা থেকে কাহিনীতে পুলিশ আনা যেতে পারে। ব্যোমকেশের সব গল্প মেলালে
আমরা দেখি যে পুলিশ প্রায় সবরকমভাবেই এসেছে-- সে সহপাঠী বন্ধু, বর্তমান পুলিশ
ইন্স্পেক্টর এ কে রে ("মগ্নমৈনাক") অথবা বাল্যবন্ধু বর্তমান ডি এস্ পি শশাঙ্ক
বাবু (ব্যোমকেশ ও বরদা) থেকে শুরু করে সপ্রশংস সহযোগী পুরন্দর পাণ্ডে (চিত্রচোর ও
অন্যান্য) বা অসহনীয় আত্মম্ভরি বিধুবাবু (অর্থমনর্থম) পর্যন্ত। এর মধ্যে তো
শশাঙ্কবাবুর সঙ্গে মতান্তর দীর্ঘস্থায়ী মনান্তরে পৌঁছে যেতে চলেছিলো। কাজেই পুলিশের
ভূমিকা নিয়ে প্রচলিত রহস্যকাহিনীর সঙ্গে ব্যোমকেশের কাহিনীর খুব একটা তফাৎ দেখা
যাবে না। রহস্যকাহিনীর আর একটা বৈশিষ্ট্য হলো গোয়েন্দার ছদ্মবেশ ধারণ, গোয়েন্দা হতে
গেলে এই কর্মে কুশলী হওয়াটা অপরিহার্য, তবে এ ভাঁওতাটা বেশী ব্যবহার করা যায়না।
ব্যোমকেশও ব্যতিক্রম নয়, যদিও শরদিন্দু চিত্রজগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, মেকআপের
ব্যাপারটা ভালো করেই জানতেন, তবুও তিন বারের বেশী ব্যোমকেশকে ছদ্মবেশ ধরাননি।
"চিড়িয়াখানা" উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপ দেবার সময় পরিচালক এই সংযম দেখালে ভালো করতেন
বলে আমাদের বিশ্বাস। অর্থাৎ ছদ্মবেশের ব্যাপারেও ব্যোমকেশ ব্যতিক্রম নয়। এ ছাড়া
কোনো বিশেষ চরিত্রের কার্যকলাপের ওপর নজর রাখা বা বিশেষ কিছু খবর বার করার জন্য
ছায়া-সহকারী ব্যবহার করার চল আছে গোয়েন্দাজগতে, যেমন হোম্সের বেকার স্ট্রীট
ইরেগুলার্স। শরদিন্দু ব্যোমকেশকে তার থেকে বঞ্চিত করেননি, বিকাশ দত্ত প্রমুখ
সহযোগীরা মাঝে মাঝেই ব্যোমকেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এসে কাহিনীতে প্রয়োজনীয় তথ্য
সরবরাহ করে গেছে।
দুটো ব্যতিক্রম আমাদের অবশ্যই চোখে পড়ে। তার প্রথমটা হলো যে ভালো-মন্দ, ঠিক-ভুল,
অপরাধ-শাস্তি নিয়ে ব্যোমকেশের একটা নিজস্ব দর্শন আর চিন্তা আছে যা অনেক সময় আমাদের
প্রচলিত ধারণাকে উত্তরণ করে যায়, এবং কাহিনীর সূত্রে সুযোগ পেলে ব্যোমকেশ সেই
দর্শনের অনুজ্ঞা পালন করে থাকে। তার একটা প্রকাশ হচ্ছে যখন সে অপরাধের পরিবেশ আর
গুরুত্ব, অপরাধীর চরিত্র, আইনের সম্ভাব্য গতি, এসব বিচার করে নিজেই শাস্তির মাত্রা
ধার্য করে। তার একরকম প্রয়োগ হতে পারে বেকসুর খালাস -- যেমন, কাহিনীর শুরু যে
মৃত্যু দিয়ে তা যদি কোনো পাপের প্রতিহিংসা হিসেবে এসে থাকে তাহলে ব্যোমকেশ
হত্যাকারীকে আইনের হাত এড়িয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ দিতে রাজী আছে। আর এক প্রয়োগ হতে
পারে জেনে শুনে অপরাধীকে আত্মহত্যায় বাধা না দেওয়া, আবার অন্য এক হতে পারে যাতে
অপরাধীর আশু মৃত্যু হয় তেমন ঘটনাচক্রের সৃষ্টি। অন্য প্রকাশ হতে পারে অবিচারের
শিকার কোনো চরিত্র যখন ব্যোমকেশের চেষ্টায় কোনোভাবে পুরস্কৃত হয়। কিন্তু এহ বাহ্য।
আর একটু খুঁটিয়ে দেখলে আমরা দেখবো যে বেশ কিছু গল্পে ব্যোমকেশের জড়িত থাকার কোনো
সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও অপরাধীরা আত্মহত্যা করে আইন এড়াতে পেরেছে। ব্যোমকেশ যাঁর
মানসপুত্র সেই শরদিন্দুর ইচ্ছে না থাকলে এ অবশ্যই সম্ভব হতো না। তার থেকে আমরা বুঝি
যে ব্যোমকেশের পাপপুণ্যের যে মূল্যবোধ তা মানসপিতৃসূত্রেই পাওয়া। এই পথে চললে
শরদিন্দুর রহস্য রচনাবলীতে এক সুন্দর অন্তর্দৃষ্টি পাওয়া যায়, কিন্তু তার জন্য
প্রতি উদাহরণের বিশদ বিশ্লেষণ দরকার। আমরা পরে এ বিষয়ে আর একটু বলবো, কিন্তু
রহস্যকাহিনী থেকে খোলসা করে উদাহরণ দেবার মুস্কিল এই যে তাতে আলটপকা রহস্য ফাঁস করে
(স্পয়লার বলা হয়) নতুন পাঠকের সর্বনাশ করার ভয় আছে। তাই শুধু গল্পের নাম দিয়ে ক্ষান্ত দিতে হলো, ভক্ত পাঠক স্মৃতি থেকে ঠিক বুঝতে পারবেন আর আশা যে নতুন পাঠক আরো
আগ্রহী হয়ে ব্যোমকেশের গল্প পড়বেন। ব্যোমকেশের বিচার: "অর্থমনর্থম", "আদিম রিপু",
"কহেন কবি কালিদাস", "চোরাবালি", "দুর্গরহস্য", "রক্তের দাগ", "পথের কাঁটা",
"হেঁয়ালির ছন্দ"। শরদিন্দুর বিচার: "অগ্নিবাণ ", "চিড়িয়াখানা", "দুর্গরহস্য",
"মগ্নমৈনাক"।
আর একটা ব্যতিক্রম হলো যে প্রায় সব রহস্যকাহিনীতে গোয়েন্দাদের যেমন দেখি, -- তারা
আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের থেকে ব্যতিক্রম -- ব্যোমকেশ নিজে সেই ব্যতিক্রমের
ব্যতিক্রম। সুকুমার সেনের কথা আবার বলি, " ... তার এমন কিছু নেই যাতে তাকে সমান
বয়সের বাঙালী ছেলের থেকে স্বতন্ত্র মনে করতে হয়।" তার উদ্ভট কোনো শখ নেই, সে
নেশাভাঙ করে না (সিগারেট ছাড়া, তা সে সময়ে সিগারেট না খাওয়াটাই হতো ব্যতিক্রম), সে
ভোজনরসিক যদিও বা হয় (তার কোনো উল্লেখ নেই) সে তা জাহির করে না, পোষাক নিয়ে
সৌখীনতার বাহুল্য নেই। তার জীবনে একবারই প্রেম এসেছে, সহজভাবে তা পৌঁছেছে বিবাহে,
তারপর সে তার ঘরণীর সঙ্গে যথারীতি বাঙালী প্রথায় কলহ-মিলন-মধুর সন্তানসার্থক
দাম্পত্যজীবন যাপন করেছে। বন্ধু অজিত অতি স্বচ্ছন্দে ব্যোমকেশের সংসারে রয়ে গেছে,
কোনো খটাখটি নেই। সঞ্চয়ী লোক মনে হয়, কেয়াতলাতে বাড়ী কিনেছে। দোষের মধ্যে সঞ্চয়ে
একটু বাড়াবাড়ি করে হয়তো, সত্যবতীকে গাড়ী কিনে দিচ্ছে না। অবশ্য এর কারণ তার
মানসপিতার প্রতি অত্যধিক আনুগত্যও হতে পারে, গাড়ী না কিনতে দেওয়াটা শরদিন্দুর জেদ
("ব্যোমকেশ, সত্যবতী, সত্যবতীর গাড়ী", প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত, শরদিন্দু অমনিবাস ২য়
খণ্ড)। এর ওপর আমরা দেখছি শরদিন্দু জেদ করে অজিতকে ব্যোমকেশের লিপিকারের কাজ থেকে
ছাড়িয়ে দিয়েছেন, বলেছেন, "অজিতকে দিয়ে ব্যোমকেশের গল্প লেখানো আর চলছে না। একে তো
তার ভাষা সেকেলে হয়ে গেছে, এখনো চলতি ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি, ..."। যে কোনো পাঠকের
মতেই এটা ঘোর অবিচার, কিন্তু অনুগত সৃষ্টি ব্যোমকেশ বাধ্য ছেলের মতো নির্দয় স্রষ্টা
শরদিন্দুর এই অন্যায় মেনে নিয়েছে, কোনো প্রতিবাদ করেনি। এটা কিন্তু ব্যোমকেশের মতো
ন্যায়নিষ্ঠ লোকের কাছে আশা করা যায় না।
আমাদের মনে হয় যৌবনে যখন ব্যোমকেশের রক্ত গরম ছিলো তখন সে শরদিন্দুর এমন সব
অন্যায্য দাবী উড়িয়ে দিতে পারতো। ভূতের ব্যাপারটা ধরা যাক। আমরা জানি যে যতোই সাফাই
দিন না কেন, শরদিন্দু ভূতে বিশ্বাস করতেন, "ভূতের গল্প সম্পর্কে আমার একটু দুর্বলতা
আছে" বলে লিখেও গেছেন। সেই ভালো লাগার তাগিদে তাঁর ভূতজ্ঞানী বরদাকে ব্যোমকেশের
পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলেন ("ব্যোমকেশ ও বরদা") কিন্তু সে কাহিনীর সব ভৌতিক ব্যাপারই
যে হত্যাকারীর চক্রান্ত সেটা প্রমাণ করে ব্যোমকেশ সে চেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়।
শরদিন্দু কিন্তু ছাড়বার পাত্র নয়, আড়ালে আড়ালে কলকাঠি নেড়ে প্রায় পঁচিশ বছর পরে
ব্যোমকেশকে একা পেয়ে তাকে ভূত দেখালেন, ভূতে বিশ্বাস করালেন, ভূতের কেস হাতে
নেওয়ালেন ("শৈল রহস্য")। শুধু তাই নয়, অজুহাত হিসেবে ব্যোমকেশকে দিয়ে যেসব
যুক্তিহীন কথা বলালেন তা একেবারেই তার চরিত্রবহির্ভূত, আমরা তো মনে করি এতে
ব্যোমকেশের চরিত্রে একটা দুরপনেয় কলঙ্ক লেগে গেলো। এমন যে হতে পারে তা নিয়ে অবশ্য
শরদিন্দু আগে থেকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন, বলেছিলেন "ঐতিহাসিক গল্প লিখেই বেশী তৃপ্তি
পেয়েছি ... ব্যোমকেশ লিখে কিন্তু এমন বোধ হয়নি।" এইজন্যই বোধহয় শাস্ত্রে খোদার ওপর
খোদকারি করার মানা আছে।
সুকুমার সেন যা বলেছেন, তার সঙ্গে এই ব্যতিক্রমের (তার মধ্যে ব্যতিক্রম না
থাকাটাকেও ধরতে হবে) কারণ যোগ করলেই বোঝা যায় কেন ব্যোমকেশ বাঙালীর মনের মানুষ।
খেয়াল রাখুন আমরা পুজোর পাত্র বা অতিমানব বলছি না, -- সে সব মোহন, স্বপনকুমার বা
ফেলুদার জন্য তোলা থাক -- বলছি কাছের মানুষ, যার সঙ্গে আমরা অভিন্নরূপ বোধ করতে
পারি। আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালী, কুস্তিটুস্তি আমাদের আসে না, বেআইনী নেশা করার
সাহস আমাদের নেই, গিন্নির সঙ্গে সম্পর্ক মধুরেণ সমাপয়েৎ হলেই আমরা খুসি, দেবতা
হিসেবে আলাভোলা শিব আমাদের পছন্দ। তীক্ষ্ণবুদ্ধির হঠাৎ-আলোর ঝলকানি দেখিয়ে সবাইকে
চমক লাগিয়ে যাবো -- আমরা বড়ো হয়েছি "বীরপুরুষ" কবিতা মুখস্থ করে -- এ আশা কিন্তু
থেকে থেকে আমাদের "মর্মে [যবে] মত্ত আশা সর্পসম ফোঁসে"। সরকারী আইন আমরা মানি, না
মানার মতো হিম্মৎ আমাদের নেই, কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে সেই আইনের কদর
বেশী যার ভিত্তি সহজ মানবিকতাবোধে। আমরা সেই আইনমতো দুষ্টকে শাস্তি আর শিষ্টকে
পুরস্কার দিতে চাই আর তেমনটি হচ্ছে দেখতে পেলে ভারী খুসি হই, তা ভাগ্যচক্রে ঘটতে
পারে, আর যদি আমাদের গোয়েন্দার হাত দিয়ে এসে থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। অর্থাৎ
ব্যোমকেশের মধ্যে আমরা আমাদের প্রয়োজনের একেবারে মাপে মাপে গড়া আদর্শ পুরুষকে দেখতে
পাই -- আমরা যা হতে চাই, শুধু যে চাই তাই নয়, আমরা যা হতেও পারি। শরদিন্দু স্বয়ং
আমাদের মতোই মধ্যবিত্ত বাঙালী সন্তান, ব্যোমকেশকে গড়েছেন নিজের ছায়ায়, একথা আগে
বলেছি। কাজেই এমন এক ধীরোদাত্ত (ঠিক আছে ধীরোদ্ধত) নায়ক শরদিন্দু পছন্দ করবেন তাঁর
জাঁরের জন্য এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তারপর আমাদের চমৎকৃত হতে হয় যখন দেখি কী আশ্চর্য
কৌশলে তিনি সেই চরিত্রে প্রাণসঞ্চার করে গেছেন, যাতে বারবার পড়ার পরেও ঘুষঘুষে
জ্বরের দিনে, হাসপাতালে বা আরোগ্যের পথে ব্যোমকেশকে না পেলে আমাদের চলে না।
ডিটেকটিভ গল্প নিয়ে শরদিন্দুর যা বক্তব্য তা আরো খুঁজলে আমরা দেখি তিনি বলছেন,
"ডিটেকটিভ বা রহস্য গল্প সম্বন্ধে বাংলাদেশে কম লোকই গভীরভাবে ভেবেছেন। অনেকের
ধারণা এ যেন অন্ত্যজ শ্রেণীর সাহিত্য। আমি তা মনে করি না। ... গোয়েন্দা কাহিনীকে
আমি ইনটেলেকচুয়াল লেভেলে রেখে দিতে চাই। ও গুলো নিছক গোয়েন্দা কাহিনী নয়। প্রতিটি
কাহিনীকে আপনি শুধু সামাজিক উপন্যাস হিসাবেও পড়তে পারেন। ... কখনও কখনও সামাজিক
সমস্যাও এর মধ্যে দেখাবার চেষ্টা করেছি। যেমন 'চোরাবালি' গল্পে আছে বিধবার
পদস্খলন।"
এবং গল্পের ঘটনা আর চরিত্রচিত্রণের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ সমাজব্যবস্থার
ওপর আলোকসম্পাত করে তিনি তাই করেছেন। যেমন, ১৯৩৫ সালে লেখা "অগ্নিবাণ" গল্পের শেষে
হিংসার কুটিল বিষ আর মানুষের মৃত্যুবাণ নিয়ে ব্যোমকেশের ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেছে আর
এক দশকের মধ্যে। যেমন ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা দিবসের ঊষায় মানুষের রক্তের কলঙ্ক
আর তার থেকে উত্তরণ নিয়ে ব্যোমকেশ যে উৎসাহবাণী শুনিয়েছে ("আদিম রিপু")। আমরা
ব্যোমকেশের ব্যক্তিগত মূল্যবোধ আর কুশীলবদের শাস্তি বা পুরস্কার নির্ধারণে তার
প্রয়োগ নিয়ে আগে যা বলেছি, তার (এবং যেখানে ব্যোমকেশ জড়িত নয় সেখানেও) মারফৎ
শরদিন্দু বিশেষ সমাজব্যবস্থার দিকে শুধু আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তাই নয়, সে
বিষয়ে তাঁর মতও বলিষ্ঠভাবে জানিয়েছেন। আমরা সেসব গল্পের তালিকা দিয়েছি, উৎসাহী পাঠক
একটু সন্ধানী মন নিয়ে পড়লে এগুলো খুঁজে পেয়ে পুরস্কৃত হতে পারবেন। প্রথাগত ভাবে
"সামাজিক" বলে আখ্যা দেওয়া যায় শরদিন্দুর এমন বহু গল্প ও উপন্যাস আছে, আমরা পরে তা
নিয়ে আলোচনা করেছি। সে সব রচনার কথা মনে রেখে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে এই
ব্যোমকেশকাহিনী মারফৎ সমাজের সমস্যার ওপর শরদিন্দু যে আলোকপাত করেছেন তাই সবচেয়ে
বেশী দীপ্ত। মনে রাখতে হবে যে শরদিন্দু এই অঘটন ঘটিয়েছেন যাকে বলে "অন্ত্যজ শ্রেণীর
সাহিত্যের" প্রেক্ষাপটে। অপ্রত্যাশিত, বিস্ময়কর ও প্রশংসনীয়!
ঐতিহাসিক কাহিনী
শরদিন্দুর ব্যোমকেশ কাহিনী যদি হয় শরৎ তবে তাঁর ঐতিহাসিক রচনাবলীকে ইন্দু হতে হবে।
চাঁদের আলোর মতোই তা নরম, মায়াবী, রহস্যময়, রোম্যাণ্টিক।
'ঐতিহাসিক কাহিনী' বলতে সঠিক কী বোঝায় তা নিয়ে লেখক, সমালোচক, সম্পাদক আর
প্রকাশকেরা আজও একমত হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেন ঐতিহাসিক কাহিনী হিসেবে গণ্য হতে
গেলে তা অন্তত পঞ্চাশ বছর আগের কথা হওয়া দরকার। কার কালের পঞ্চাশ বছর আগে, লেখকের
না পাঠকের? পাঠকের বললে মুস্কিল, ঠাকুর্দা আর নাতি একই কাহিনী পড়ে একজন সমসাময়িক আর
আরেকজন ঐতিহাসিক বলে ধার্য করবে, সেটা বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়। আবার যদি লেখকের কাল ধরা
যায় তাহলেও মুস্কিল কেননা আরো পঞ্চাশ বছর পরে ওই পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানটা ফিকে হয়ে
গিয়ে একই লেখকের সমসাময়িক উপন্যাসকেও ঐতিহাসিক উপন্যাস আখ্যা দিতে হবে। কাজ চালাবার
মতো যে একটা সংজ্ঞা ব্যবহার করা হয়ে থাকে তাতে লেখকের কালের পঞ্চাশ বছর পিছনের কথা,
এটা বলা হয়, আর এটাও বলা হয় যে এমন কথা বলতে হবে যা লেখকের প্রত্যক্ষ
অভিজ্ঞতাপ্রসূত নয়, যার জন্য লেখককে তথ্যাদি নিয়ে দস্তুরমতো গবেষণা করতে হয়েছে। গঠন
আর শিল্প নিয়েও মতভেদ আছে তবে তা এই জাঁরটির বৈচিত্র্য বাড়ায়, তাই সে মতানৈক্যটা
মাপ করে দেওয়া যায়। কাহিনীর প্রেক্ষাপট, চরিত্রাবলী, সংলাপ, সমাজরীতি ইত্যাদি কতোটা
সত্যানুসারী হওয়া উচিত তা নিয়ে নানা মত, কেউ কেউ বলেন এ ব্যাপারে একেবারে নিখুঁত
হতে হবে, কোনো আপোস চলবে না। আবার কেউ কেউ বলেন যে কালের কাহিনী বলা হচ্ছে সে কালের
মানুষ যা জানতো, যা বুঝতো, কালের ব্যবধানে আর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে তার অনেক পরিবর্তন
হয়ে থাকতে বাধ্য কাজেই আজকের লেখকের কলমে গড়া হয়েছে যে সেকাল সেটা সত্যানুসারী হতেই
পারে না। লেখক অসম্ভব সতর্ক না হলে শেষমেশ তা একালের মানুষ সেকালের পোষাক পরে হাতপা
ছুঁড়ছে, এমন একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, অতএব ও চেষ্টা করা বৃথা। তার থেকে ভালো করে
গল্প বলাতে মনোযোগ দেওয়াই ভালো, একটা বাতাবরণ তৈরী করতে যতোটা গবেষণা আর
সত্যনিষ্ঠার দরকার ততোটা হলেই চলবে। শরদিন্দু খুব সুন্দর কায়দা করে অনেক গল্পে এই
ফাঁদটা এড়িয়েছেন, তার কথা পরে বলা হবে। কখনো কোনো কাহিনীর পুরোটাই কোনো
ইতিহাসপ্রসিদ্ধ মানুষের কথা নিয়ে লেখা, আবার কখনো কোনো কাহিনীতে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ
মানুষ আছেন শুধুমাত্র স্থানকাল নির্দেশ করার জন্য, আর গল্পটা এই দুই সীমানার মধ্যে
যে কোনো জায়গায় খাড়া হয়ে থাকতে পারে। ইতিহাসখ্যাত চরিত্র নিয়ে নাড়াচাড়া করায় লেখকের
একটা সুবিধে যে চরিত্র আর ঘটনা তৈরীই হয়ে আছে, কাজেই চরিত্রগঠন আর ঘটনাবিন্যাসে
শ্রম দিতে হয়না। কিন্তু অসুবিধেও আছে, লেখক আর ঈশ্বরের ভূমিকায় থাকতে পারেন না,
চরিত্রের বাঁচামরা তাঁর মর্জিমতো নয় অতএব গল্পকে লাগামছাড়া ছুট করানো যায় না।
পশ্চিমী সাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসকে প্রথম জাতে তুললেন স্যার ওয়াল্টার স্কট আর
বালজাক, আর একটু পরে টলস্টয়। বাংলা সাহিত্যে তার ঢেউ নিয়ে এলেন বঙ্কিমচন্দ্র।
তারপর, পেশাদার রঙ্গমঞ্চের কথা বাদ দিলে, কথাসাহিত্যে ঐতিহাসিক উপন্যাসের বাজার
অনেকদিন মন্দা। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বা রমেশচন্দ্র দত্তের নাম শোনা যায়, তবে
তাঁদের খ্যাতি ক্ষণজীবী মাত্র। শরদিন্দু যখন সাহিত্যজগতে ঢুকলেন, তখন ঐতিহাসিক
কাহিনীকার বলতে বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া আর কারুর নাম মনে আসে না। তাঁর সাহিত্যকৃতির ওপর
বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যাপ্ত ও গভীর প্রভাব নিয়ে শরদিন্দু স্বয়ং অপরিমিত কৃতজ্ঞতা
স্বীকার করে গেছেন, কাজেই ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের পথ অনুসরণ
করবেন, এটা আশ্চর্যের কথা নয়। সে সময় ঐতিহাসিক কাহিনীকার হিসেবে শরদিন্দুর
প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ ছিলেন না আর আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে -- যদিও শরদিন্দুর পরে
ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা হয়েছে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দুটি উপন্যাস তার উদাহরণ --
শরদিন্দু যে ধরণের কাহিনী লিখতেন, রোম্যাণ্টিক ঐতিহাসিক উপন্যাস, সেখানে তাঁর
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উপযুক্ত কেউ বাংলা সাহিত্যক্ষেত্রে আসেননি।
পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আর সতেরোটি গল্প নিয়ে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনীর
ভাণ্ডার। ১৯৩২ সালে "জাতিস্মর" নামের বইতে তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প "অমিতাভ"।
প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস "কালের মন্দিরা" ১৯৩৮ সালে শুরু করেন, সিনেমার কাজ করতে যখন
মুম্বই ছিলেন তখন কুলুঙ্গীতে তুলে রাখতে হয়, তারপর ১৯৫০ সালে শেষ করতে পারেন।
ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক বলে তিনি বিশেষ খ্যাত হয়েছিলেন, অনেক বিদ্বজ্জন তাঁর ঐতিহাসিক
রচনা পড়ে মন্তব্য লেখেন। শরদিন্দু নিজেও তাঁর এই জাঁরের লেখা নিয়ে বেশ কিছু কথা
লিখেছেন। অম্নিবাস তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ডের গ্রন্থপরিচয়ে তার অনেক উদ্ধৃতি দেওয়া
হয়েছে। এ ছাড়া অম্নিবাস-৪ ভূমিকায় (এই খণ্ডে সতেরোটি ঐতিহাসিক কাহিনী ছাড়াও অন্য
জাঁরের কিছু গল্প আছে) সুকুমার সেন জোর দিয়েছেন ঐতিহাসিক কাহিনীর ওপরেই। আমরা এই সব
উৎস থেকে কিছু তথ্য উদ্ধৃত করবো।
যাঁরা রোম্যাণ্টিক কাহিনী লিখতে চান, ঐতিহাসিক পটভূমিকাতে গল্প খাড়া করার এক বিরাট
সুবিধে, যে ইতিহাসের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে আমাদের সবায়ের মনে একটা মোহ আছে। কথাতেই
বলে দূরত্ব দৃশ্যকে মোহময় করে, "distance lends enchantment to the view", তা সে
দূরত্ব স্থানেরই হোক বা কালেরই হোক। একটু ভেবেচিন্তে স্থানকালপাত্র ঠিক করে নিতে
পারলে তার মাহাত্ম্যেই লেখায় রোমান্স এসে যেতে থাকবে। কালের মাত্রায় যতো বেশী
পেছিয়ে যাওয়া যাবে, এই মুগ্ধকারিতাও ততো বেড়ে যাবে, অবশ্যই একটা সীমা পর্যন্ত। আসলে
সভ্য হবার খেসারৎ হিসেবে আমরা যে ভদ্রতা, সৌজন্য, সংযম শিখতে বাধ্য হয়েছি তা আমাদের
প্রকৃতিদত্ত প্রকৃতির ঝাঁজ কমিয়ে পান্সে করে দিয়েছে, হ্রাস পেয়েছে পুরুষের পৌরুষ
আর রমণীর রমণীয়তা। শরদিন্দু স্বয়ং তাঁর এক চরিত্রের বকলমে ("অমিতাভ") বলেছেন, "...
একালের মানুষ যেন সব দিক্ দিয়াই ছোট হইয়া গিয়াছে। দেহের, মনের, হৃদয়ধর্মের সে
প্রসার আর নাই। যেন মানুষ তখন তরুণ ছিল, এখন বৃদ্ধ হইয়া গিয়াছে।"
এই কালের ব্যবধান ব্যাপারটা শরদিন্দু খুব মুন্সীয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।
সুকুমার সেন লিখছেন, "আগেকার ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসে মোগল-অন্তঃপুর, শাহী দরবার,
আরাবল্লীর গিরিদুর্গ -- এসব নিয়ে অনেক অনেক লেখা হয়েছে। শরদিন্দুবাবু তাই মুসলমান
অধিকার কালে তিন-চারটের বেশী গল্প ফাঁদেননি।" শরদিন্দু তাঁর ঐতিহাসিক কাহিনী
বিস্তার করে দিয়েছেন সেই প্রাচীন মিশরের কাল থেকে সতেরো শতাব্দী পর্যন্ত। যদিও
সংখ্যাতত্ত্ব মাফিক স্থির সিদ্ধান্ত নেবার মতো পর্যাপ্ত গল্প তিনি লেখেননি তবু
গল্পগুলো কালানুক্রমে পড়লে মানবসভ্যতার বিবর্তনের একটা ছবি আবছাভাবে দেখা যায়।
সুকুমার সেনের তৈরী তালিকার সঙ্গে উপন্যাসলব্ধ তথ্য যোগ করলে বিস্তারটা এমন দাঁড়ায়:
খ্রিঃপূঃ ১১-১২ শতক, একটি গল্প, "আদিম"; খ্রিঃপূঃ দশম শতক, একটি গল্প,
"প্রাগ্জ্যোতিষ"; খ্রিঃপূঃ ৬-৫ শতক, তিনটি গল্প, "অমিতাভ", "বিষকন্যা", "সেতু";
খ্রিস্টাব্দ ৪-৫ শতক, তিনটি গল্প, "মৃৎপ্রদীপ", "অষ্টম সর্গ", "মরু ও সঙ্ঘ", দুটি
উপন্যাস, "কালের মন্দিরা", "কুমারসম্ভবের কবি"; খ্রিস্টাব্দ ৫-৬ শতক, একটি উপন্যাস,
"গৌড়মল্লার"; খ্রিস্টাব্দ এগারো শতক, একটি উপন্যাস, "তুমি সন্ধ্যার মেঘ";
খ্রিস্টাব্দ ১২-১৩ শতক, দুটি গল্প, "শঙ্খ-কঙ্কণ", "রেবা রোধসি"; খ্রিস্টাব্দ ১৪-১৫
শতক, দুটি গল্প, "রক্তসন্ধ্যা", "চুয়াচন্দন", একটি উপন্যাস, "তুঙ্গভদ্রার তীরে";
খ্রিস্টাব্দ সতেরো শতক, দুটি গল্প, "বাঘের বাচ্চা", "তক্ত মোবারক"। বাকী তিনটির
মধ্যে দুটির ("ইন্দ্রতূলক", "রুমাহরণ") কাল ঠিক করা যায় না, তবে অতি প্রাচীন বলা
যায়, অন্যটির ("চন্দন মূর্তি") কাল অধুনা।
ঐতিহাসিক কাহিনী লেখার একটা মুস্কিলের কথা আমরা আগে লিখেছিলাম -- যতোই চেষ্টা করুন
না কেন, পুরাকালের মানুষের মনের কথা লিখতে গিয়ে আজকের লেখক সেই কথাকে তাঁর আজকের
মানসিকতা আর মূল্যবোধের ছোঁয়াচ থেকে বাঁচাতে পারেন না, কাজেই ইতিহাস শুদ্ধ রাখছি
বললেও সে রচনা হয় সঙ্কর। আর্থার কোনান ডয়েল এর চমৎকার সমাধান বার করেছিলেন, তা হলো
আজকের দিনে কোনো জাতিস্মরের জবানীতে গল্পটা বলানো, তাতে সাপও মরে আর লাঠিও ভাঙ্গে
না। শরদিন্দু সকৃতজ্ঞ স্বীকৃতি দিয়ে এই পন্থাটা কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর "জাতিস্মর"
বইয়ের তিনটে গল্পই এমনভাবে লেখা, তার প্রথম কাহিনী "অমিতাভ"-র মুখবন্ধ হিসেবে
জাতিস্মরতার যে পরিচিতি লিখেছেন সংজ্ঞাদান আর পরিবেশসৃষ্টি হিসেবে তা অনুপম।
"বিষকন্যা" কাহিনীটিও যে এই জাতীয়, শরদিন্দু নিজে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ
করেছেন। এই জাতিস্মর ব্যাপারটা তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন, তাঁর ঐতিহাসিক কাহিনী বলে
খ্যাত গল্প ছাড়াও বেশ কয়েকটা অলৌকিক কাহিনীতে জাতিস্মরের দেখা পাওয়া যায়। আমরা
যথাস্থানে তার উল্লেখ করবো। "অমিতাভ" গল্পে জাতিস্মরই একমাত্র কথক, সতর্ক পাঠক
লক্ষ্য করবেন যে সারা গল্পে শরদিন্দু তার ব্যত্যয় হতে দেননি। "রক্তসন্ধ্যা" গল্পে
আর একটু কুশলী প্রয়োগ, এ গল্পের যিনি কথক তিনি যেন একজন জাতিস্মরের বলা গল্প
লিপিবদ্ধ করছেন। তাতে গল্পে দুটো দৃষ্টিকোণ সহজভাবে যোগ করা গেছে, এক তো জাতিস্মরের
আর দুই, যেসব কথা জাতিস্মরের জানার কথা নয়, সেগুলো জানানোর জন্য কথক স্বয়ং।
"বিষকন্যা" আর "মৃৎপ্রদীপ" গল্পে জাতিস্মরকে দিয়ে গল্প বলাতে শুরু করে শরদিন্দু আর
এই শৃঙ্খলা রক্ষা করেননি। কাহিনীর দুর্দম গতি আর শরদিন্দুর প্রসাদগুণে এই চ্যুতি চট
করে নজরে আসে না তবু শরদিন্দুর মতো বিচক্ষণ কথাকুশলীর কাছে এটা আশা করা যায়নি।
"রুমাহরণ" গল্পটি "মৃৎপ্রদীপ" গল্পের জাতিস্মরই বলেছে, শরদিন্দু তাকে দিয়ে
"মৃৎপ্রদীপ" গল্প শেষ হয়ে যাবার পরের কথা বলিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ এনে তাকে
বহু প্রাচীন কালে নিয়ে গেছেন। "সেতু" কাহিনী স্বপ্নাদ্য কিন্তু কথকের কোনো এক
পূর্বজন্মের গল্প তাই আক্ষরিকভাবে জাতিস্মর কাহিনী না হলেও সেই গোত্রে ফেলা যায়।
তা না হয় হলো! শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনী পড়ে আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়েছে শরদিন্দু কী
মন্ত্রে তাঁর রচনায় এমন মাদকতা দিতে পেরেছেন যাতে সেসব গল্প বারবার পড়েও আমাদের আশ
মেটেনা। এ পর্যায়ের সমস্ত কাহিনী একসঙ্গে দেখলে এটা বোঝা যায় যে সে মাদকতার একটা
উপাদান শরদিন্দুর ভাষা। এ পর্যায়ের সবকটি রচনারই বাহন সাধুভাষা, কিন্তু আশ্চর্য
কৌশলে তিনি কাহিনীর স্থানকালপাত্র বিচার করে ভাষার "সাধুত্ব" নিয়ন্ত্রণ করেছেন --
সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারে, তৎসম শব্দের গুরুত্বের মাত্রায়, তৎসম আর তদ্ভব শব্দের
আপেক্ষিক মিশ্রণে, সংলাপ সাধু না কথ্য ভাষায় তা স্থির করে আর ভাষা কথ্য হলে আবার
তার মাত্রায়। দুয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তাঁর প্রথম উপন্যাস "কালের
মন্দিরা"তে তিনি সাধুভাষার দিকে সবচেয়ে বেশী ঝুঁকেছেন, ঠিক বঙ্কিমী নয় তবে প্রায়
কাছাকাছি। সেখানে পোট্টলিতে রোটিকা বেঁধে পথিকেরা যাত্রা করে, সেই কাহিনীর সংলাপের
উদাহরণ: "বৈশ্বানর জ্বলিলে তিন্তিড়ীও মিষ্টি লাগে"। আর "চুয়াচন্দন" গল্পের ভাষা
শরদিন্দুর কালে গদ্যরচনায় যেমন সাধুভাষা ব্যবহার হতো তেমনই, তার থেকে কঠিন নয় আর
সংলাপে ".. নাপতিনী বুড়ীর সঙ্গে কোঁদল করছে।" প্রথম উপন্যাসটি যুদ্ধবিগ্রহ,
অত্যাচার-অবিচার, ষড়যন্ত্র-রক্তক্ষয়ের জটিল পারিপার্শ্বিকে গড়ে ওঠা এক অসম্ভাব্য
প্রেমকাহিনী আর সামান্য দুর্জনের উৎপাত থাকলেও চুয়াচন্দন এক মধুর প্রেমের গল্প,
তাতে বাঙালী জীবনে যিনি প্রেমের প্রতীক সেই চৈতন্যদেবের স্পর্শ আছে। ভাষার তফাৎ তো
থাকতেই হবে। আবার তার ওপর শরদিন্দু বিশ্বাস করতেন যে "ঐতিহাসিক গল্পের ভাষাও হবে
যুগোপযোগী" এবং সে বিশ্বাস কার্যকরী করতে তিনি পেছপা হননি। এ প্রসঙ্গে রাজশেখর বসু
যা বলেছেন তা বিশেষ মূল্যবান, "[সকলের ওপরে]... আপনার পরিচ্ছন্ন শুদ্ধ ভাষা।
...সংস্কৃত শব্দ, বিশেষত সেকেলে শব্দ দেখলে আধুনিক পাঠক ভড়কে যায়। আশ্চর্য এই --
আপনার লেখায় এ রকম শব্দ প্রচুর থাকলেও পাঠক ভড়কায় না। বোধহয় তার কারণ আপনার প্লটের
বা বর্ণনার দুর্নিবার আকর্ষণ।"
এবার "দুর্নিবার আকর্ষণের" কথাটা একটু তলিয়ে দেখা যাক। শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনী
প্রসঙ্গে সুকুমার সেন লিখছেন, "সাধারণ পাঠক স্বচ্ছন্দে 'ঐতিহাসিক' মন্তব্যটুকু বাদ
দিতে পারেন। তাতে গল্পগুলির ঘটনার বৈচিত্র্য ও নাটকীয়তার এবং বর্ণনার জাদুর
কিছুমাত্র খর্বতা ঘটবে না। ... এগুলি বিশুদ্ধ রোমাণ্টিক এবং সহৃদয় ও উপাদেয় গল্প।"
শরদিন্দু নিজেই বেশ কয়েকবার তাঁর এই পর্যায়ের লেখায় ইতিহাস আর গল্পের মিশেল নিয়ে
বলেছেন: " ... ইতিহাসগন্ধী গল্প"; "ইতিহাসের ঘটনাকে যথাযথ বিবৃত করাই ঐতিহাসিক
গল্পের উদ্দেশ্য বলিয়া আমার মনে হয় না"; "আমার কাহিনী Fictionised [sic] history
নয়, Historical Fiction"। আমরা আগে যা বলেছি, কাহিনীর কাল অতীতে রাখবার প্রধান লাভ
এই, যে অতীত তার সঙ্গে সঙ্গে রোমান্সের পশরা নিয়ে আসে, অতীতের মানুষ, অতীতের ঘটনা,
সবই আমাদের কাছে আসে একটা মায়াজাল দিয়ে মোড়া হয়ে। যাকে তিনি historical বলছেন, সেই
মোড়কের আড়ালে শরদিন্দু আসল গল্পের শরীর গড়েন, সেটাই হয় গল্পের সারবস্তু, historical
fiction-এর fiction। ইতিহাসের বাতাবরণে রাখার ফলে একই ঘটনা আরো মনোগ্রাহী হয়, যেমন
কিস্তা নদী সাঁতরে নায়ক যে প্রেমের খোঁজ পান সে প্রেম সোশ্যাল মিডিয়া মারফৎ যে
প্রেম দানা বাঁধে তার থেকে অনেক বেশী মনোগ্রাহী। তেমনই তরোয়াল নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে
রোমাঞ্চের উপাদান উড়োজাহাজে এসে বোমা ফেলার থেকে আরো প্রতুল। শরদিন্দু লিখছেন,
"ইতিহাস থেকে চরিত্রগুলো শুধু নিয়েছি; কিন্তু গল্প আমার নিজের। সর্বদা লক্ষ্য
রেখেছি কি করে সেই যুগকে ফুটিয়ে তোলা যায়।" আবার চরিত্র গ্রহণের ব্যাপারেও শরদিন্দু
খুব সতর্ক, তাঁর এ পর্যায়ের গল্পে ইতিহাসখ্যাত লোকেদের চরিত্র তিনি এঁকেছেন বটে
কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সে তুলির ছোঁয়া লেগেছে অতি আলগোছে যাতে ইতিহাসের
শুদ্ধতা রক্ষার দায় দুর্বহ হয়ে গল্পের রসবিকৃতি না ঘটায়। "অমিতাভ" গল্পে গৌতম বুদ্ধ
এসে মাত্র তিনচার অনুচ্ছেদে এক সাধারণ হিংসাদ্বেষের কাহিনীকে দিব্যলোকে নিয়ে গেছেন:
"চুয়াচন্দন" গল্পে শরদিন্দু আরো চতুর, সেখানে চৈতন্যদেবের যে রূপের সঙ্গে আমাদের
পরিচয় আছে, সেই চৈতন্যদেবেরই এক সম্পূর্ণ ভিন্ন, অথচ পুরো মাত্রায় সত্যানুগ
চরিত্রচিত্রণ দেখিয়ে আমাদের মুগ্ধ করেছেন। এ গল্পে তাঁর ভূমিকাও খুব প্রকট নয়, তিনি
আড়ালে থেকে গল্পকে এগোতে সাহায্য করেছেন আর শেষের দুতিন অনুচ্ছেদে তাঁর দুচার কথার
বলিষ্ঠ সংলাপে (যথা "নিমাই পণ্ডিত যে বিয়ের পুরুত, সে-বিয়ে অমান্য করে কে?") তাঁর
কুসুমকোমল বহিরঙ্গের আড়ালে থাকা দৃঢ়চেতা মানুষটিকে প্রকাশ দেখে আমাদের বাক্রুদ্ধ
হয়ে আসে। প্রসঙ্গত, শরদিন্দু লিখছেন, " 'চুয়াচন্দন' লিখে [খুব তৃপ্তি] হয়েছিলো", আর
চুয়া যে তাঁর একটি প্রিয় চরিত্র আমরা সে খবরও পেয়েছি পরে, অন্য এক কাহিনীতে।
"ইতিহাসগন্ধী" বলতে শরদিন্দু কী বোঝাতে চেয়েছেন তা এবার পরিষ্কার হওয়া উচিত।
ব্যতিক্রমও আছে, যেমন "রক্তসন্ধ্যা" গল্পে নিষ্ঠুর ভাস্কো-ডা-গামার উপস্থিতি খুবই
প্রকট, শরদিন্দু লিখছেন, "[এর] চরিত্র সম্পূর্ণ ইতিহাসসম্মত, কোথাও রঙ চড়াইবার
চেষ্টা করি নাই।" "কুমারসম্ভবের কবি"-তে তো মহাকবি কালিদাস নামভূমিকায়, কিন্তু
রূপান্তরিত উপন্যাস তার চিত্রনাট্য-উৎসের দায় কাটাতে পারেনি তাই আমরা এটিকে তাঁর
উৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক রচনাগুলোর একটি বলে মানতে পারলাম না। সে তুলনায় মোটামুটি মোদ্দা
একই কথা নিয়ে লেখা গল্প "অষ্টম সর্গ" কাহিনী হিসেবে আরো রসোত্তীর্ণ, গল্পলেখক
হিসেবে শরদিন্দুর প্রতিভার প্রকাশ আরো উজ্জ্বল। শরদিন্দুর হাতে এই "ইতিহাসগন্ধী"
গল্পশিল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ "মরু ও সঙ্ঘ", যা শুধু অসাধারণ প্রেমকাহিনীই নয়, যা
আদিম মানবপ্রকৃতি আর প্রয়োজনীয় সমাজব্যবস্থার মধ্যেকার নিরন্তর সংগ্রামের কাহিনী,
যে দ্বন্দ্ব আজও আমাদের দর্শনে আর জীবনযাত্রায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে সেই
দ্বন্দ্বের এক কাব্যিক বর্ণনা। এর মধ্যে ইতিহাসের যে অংশ, চীনদেশে বৌদ্ধধর্মের
প্রচার, সঙ্ঘস্থাপন, পরে গোবি মরুভূমির আগ্রাসনে তাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া -- এসব তথ্য
সর্বৈব সত্য, বিশ শতকের গোড়ায় প্রত্নতত্ত্ববিদেরা খোঁড়াখুঁড়ি করে সেসব বিহার, চৈত্য
ইত্যাদির ভগ্নাবশেষ পেয়েছেন। গল্পের চরিত্রেরা কিন্তু সাধারণ মানুষ, কোনো ইতিহাসের
বইতে তাদের নাম কখনো ওঠেনি। সঙ্ঘের নিয়মকানুন আর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বর্ণনাগুলো
ফাউ!
"আদিম" গল্পের মূলে যে কথাটা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলো যে নায়ক এবং নায়িকার
মধ্যে ভাইবোনের সম্পর্ক এবং যে কালে যে সমাজের কথা বলা হচ্ছে, সেই কালে সে সমাজে
ভাইবোনের মধ্যে এই প্রণয়ের সম্পর্ককে খুব মূল্য দেওয়া হতো। মজার কথা হচ্ছে যে
সুকুমার সেন শরদিন্দুর ঐতিহাসিক গল্পসংগ্রহের যে নাতিদীর্ঘ ভূমিকা লিখেছেন তাতে
আজকের ঐতিহাসিকের দৃষ্টি আর মূল্যবোধ থেকে গল্পটির বিচার করে প্রথাটি ও কাহিনী,
দুটিরই শুচিবায়ুগ্রস্ত কঠোর সমালোচনা করেছেন। ঐতিহাসিক কাহিনী লেখার মুস্কিল নিয়ে
আমরা আগে যা বলেছি এ তারই উদাহরণ। সুখের কথা যে রচয়িতা হলেন শরদিন্দু, যিনি জানতেন
যে লেখকের দায়িত্ব কখনো কখনো লিপিকর্মের বেশী হওয়া উচিত নয়। এবং তিনি এই
পক্ষপাতদুষ্ট (আমরা অন্যায্য বলছি না কিন্তু) দৃষ্টিভঙ্গী এড়াতে পেরেছিলেন আমাদের
এই বিশ্বাস।
বাঙালীর ইতিহাস ভিত্তি করে শরদিন্দু দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন, "গৌড় মল্লার" আর পরে
সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে "তুমি সন্ধ্যার মেঘ" (প্রথমে
নাম দেওয়া হয় "রেবা রোধসি")। যদিও তাঁর পাঁচটির মধ্যে শেষটি, অর্থাৎ "তুঙ্গভদ্রার
তীরে" ঐতিহাসিক উপন্যাসের জন্য তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর
রচনাবলীতে এই দুটো উপন্যাসের বিশেষ স্থান আছে -- এ দুটি উপন্যাসই বাঙালীর ইতিহাস
ভিত্তি করে রচিত। "কালের মন্দিরা" লেখার পর তিনি হাত গুটিয়ে আনছিলেন, সে সময়
নীহাররঞ্জন রায়ের "বাঙালীর ইতিহাস" পড়ে তিনি প্রথম উপন্যাসটি লেখার প্রেরণা পান
আর বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা পণ্ডিতের (যথা যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি, সুকুমার সেন,
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়) কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই উপন্যাসটি লেখেন। তাঁর সেই
অনুসন্ধানের চিহ্ন রচনাটির অঙ্গে অঙ্গে। যথা প্রথম পরিচ্ছেদেই তিনি সেই কালের
শান্তিময় গ্রামবাংলার একটা ছবি দিয়েছেন যা খুব খুঁটিয়ে পড়লে তবেই বোঝা যায় কতো তথ্য
তিনি মাত্র কয়েকটা অনুচ্ছেদে উপস্থিত করেছেন, কিন্তু তা সাজিয়েছেন এমন কৌশলে যে
পড়লে নিছক , তথ্যসঙ্কুলতা ছাপিয়ে একটা নিশ্ছিদ্র, অখণ্ড ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তবে এ কাহিনীর আসল আকর্ষণ হলো যেখানে শরদিন্দু উপন্যাসটিকে বসিয়েছেন, মহাকালের সেই
মুহূর্তটিতে। শরদিন্দুর নিজের ভাষায়, "শশাঙ্কদেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে বাংলা দেশে
যে শতাব্দীব্যাপী মাৎস্যন্যায় আরম্ভ হইয়াছিল ... বাঙালীর জীবনে [ইহা] এক মহা
ক্রান্তিকাল। আধুনিক বাঙালীর জন্ম এই সময়ে।" অবক্ষয়ের বেদনার মধ্য দিয়ে আমাদের
জন্ম, এই ঘোষণা শিহরণ জাগায়।
এ দুটি উপন্যাসকে জড়িয়ে শরদিন্দু তাঁর ডায়েরিতে যা লিখেছেন তার অভিঘাত গভীর। তিনি
লিখছেন, "ইতিহাস অবলম্বন করিয়া কাহিনী লেখা বঙ্গভাষায় প্রচলিত নয়। ...
প্রাক্-মুসলমান যুগের ঐতিহ্য বাঙ্গালী যেন ভুলিয়া গিয়াছে। ... বাঙ্গালী জাতির
হৃদয়ে 'শশাঙ্ক', 'ধর্মপাল' স্থান করিয়া লইতে পারে নাই। ... আমি বাঙ্গালীকে তাহার
প্রাচীন tradition-এর সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিতে চেষ্টা করিয়াছি। এ চেষ্টা আর কেহ করে
না কেন? বাঙ্গালী যতদিন না নিজের বংশগরিমার কথা জানিতে পারিবে ততদিন তাহার চরিত্র
গঠিত হইবে না; ততদিন তাহার কোন আশা নাই। যে জাতির ইতিহাস নাই তাহার ভবিষ্যৎ নাই।"
শরদিন্দুর সতর্কবাণীতে কিছু কাজ হয়েছিলো কিনা সে আলোচনার স্থান এটা নয়। তবে এমন কথা
এতো মনোজ্ঞ করে একদিন আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন বলেই শরদিন্দু আর তাঁর ঐতিহাসিক
রচনাবলী আজও আমাদের এতো প্রিয়।
অলৌকিক কাহিনী
শরদিন্দু ভূতের গল্প লিখেছেন অনেক। আর গল্পে প্রেতযোনি থাকতেই হবে, এই শর্ত না
চাপিয়ে যদি অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতকেও ধরতে দেওয়া হয় তাহলে আরো অনেক। শরদিন্দুর আগে
এই জাঁরটির খুবই কম নমুনা দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্ক বাংলা গদ্যসাহিত্যে। তখন একআধটা
লেখা এদিকওদিক পাওয়া যায়, ত্রৈলোক্যনাথকে গুরুত্ব দেওয়া কঠিন, রবীন্দ্রনাথ ভূতের
গল্প লিখেছেন মাত্র তিনটি। তারানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা তারিণী খুড়োর মারফৎ সত্যজিৎ
রায় কিছু লিখেছেন বটে কিন্তু তা শরদিন্দুর পরে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের শরদিন্দুকে
পথিকৃৎ বলতেই হবে। সঠিক সংখ্যা দেবার চেষ্টা না করা ভালো কেননা তাতে কী অলৌকিক, কী
অলৌকিক নয় এসবের কূটকচালে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে, তবে অমনিবাসের হিসেব মানলে এই
শ্রেণীর গল্প চৌত্রিশটি (অমনিবাস ৫ম খণ্ডের ১-৩১, "ব্যোমকেশ ও বরদা", "শৈল রহস্য",
"মরণ দোল")। তাতে সরাসরি ভূতের দেখা পাওয়া যাচ্ছে এমন গল্পের সংখ্যা বিশ। লক্ষ্যণীয়
যে বেশ কিছু গল্পে ভৌতিক ব্যাপারের সঙ্গে জন্তুরা জড়িত, কিছু না হোক অন্তত অমঙ্গলের
সূচক হিসেবে। আর বেশীর ভাগ ভূতই মোটামুটি নির্বিরোধী, তাদের ছোটোখাটো কিছু
দাবীদাওয়া মেটাবার জন্য যদি একটু দাঁত খিঁচোতে হয় তা ঠিক আছে কিন্তু তার বেশী কিছু
নয়। ব্যতিক্রমও আছে। জগদীশ ভট্টাচার্য বলছেন শরদিন্দুর "ভূতের গল্পে ভয়ের চেয়ে
বিস্ময়ের উপাদানই বেশী।" ঠিক কথা, এর ওপরে মাঝে মাঝে শরদিন্দু যে রোমান্সের টাকনা
দিয়ে রেখেছেন (যথা মধুমালতী, অশরীরী) তা আবিষ্কার করে অপ্রত্যাশিত তৃপ্তি পাওয়া
যায়।
"ভূতজ্ঞানী" বরদার চরিত্র এই গল্পগুচ্ছের এক চমৎকার উপহার। শরদিন্দুর ছোটো গল্পের
পশরার বৌনি হয়েছে বরদাকে দিয়ে ("প্রেতপুরী")। বরদা এক প্রবাসী বাঙালী যুবক,
বিবাহিত, পৈতৃক সম্পত্তির কৃপায় অবস্থা মোটামুটি সচ্ছল, চেহারা "নৈনিতাল আলুর কথা
স্মরণ করাইয়া দেয়।" সম্পত্তি দেখাশোনা করে, ভূত নিয়ে নাড়াচাড়া করে আর অবসর সময়ে
ক্লাবে আড্ডা দেয়। প্রেততত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা আছে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে বলে দাবী
করে, গোল বাধে যখন সে ক্লাবে তার অত্যন্ত অনিচ্ছুক শ্রোতাদের জোর করে সেই অভিজ্ঞতার
কথা শোনাতে চায় -- "বরদার আষাঢ়ে গল্পের আসর"। তার প্রধান গুণ হলো সে নাছোড়বান্দা,
সে গল্প শুনিয়ে ছাড়ে, আর তার প্রধান হাতিয়ার হলো মাতিয়ে গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা,
"ব্যোমকেশ ও বরদা" গল্প থেকে তার ধরণটার আন্দাজ পাওয়া যায়। তার গল্প একবার শুনতে
শুরু করলে আর থামা যায়না। আবার শরদিন্দুর গল্প বলার অসাধারণ কৌশল হলো বরদার গল্পের
আশেপাশে এমন দুয়েকটা সন্দেহের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া যাতে গল্প শেষ হবার পরে বরদা সত্যি
বলছে কিনা তা নিয়ে পাঠকদের মনে একটু সংশয় থেকেই যায়। বরদা একসময়ে নাস্তিক ছিলো
কিন্তু এক মারাত্মক অভিজ্ঞতার পর তার বিশ্বাসের ভিত্তি একেবারে পাল্টে যায়। তারপর
বরদাকে সুইস আর্মি নাইফের মতো নানা কাজে লাগিয়েছেন শরদিন্দু-- সে নিজে ভূত দেখেছে,
প্ল্যানচেট করেছে, ভূতের লেখা ডায়েরী পড়েছে, পিণ্ডি দিয়েছে এবং অন্তত দুবার
অবিশ্বাসী বন্ধুবান্ধবদেরও ভূত দেখিয়েছে বা দেখতে সাহায্য করেছে। ব্যোমকেশের সঙ্গে
একটা গল্পে শরদিন্দু তাকে টেনে এনে শেষ অবধি হারিয়ে দিয়েছেন, এটা অবিচার। অবশ্য
ব্যোমকেশ অতি ভদ্রলোক, সে গাঁজাখোর বলে বরদাকে লাঞ্ছনা করেনি। শরদিন্দু অব্শ্য
ব্যোমকেশকেও ছাড়েননি, "ব্যোমকেশ ও বরদা" গল্পে সে বস্তুতন্ত্রের পক্ষে ও
অতীন্দ্রিয়ের বিপক্ষে লেকচার ঝেড়েছে বটে, কিন্তু পরে "শৈল রহস্য" গল্পে শরদিন্দু
তাকে ভূত শুধু দেখিয়েছেন তাই নয়, তাকে দিয়ে ভূতের কাজ হাসিল করিয়েছেন, এমন কি শেষ
পর্যন্ত সে বলতে বাধ্য হয়েছে, "যা প্রত্যক্ষ করেছি তা বিশ্বাস করা বা না-করার কোনো
প্রশ্নই ওঠে না।" একে 'ভূতের মুখে রামনাম' বা 'ভূতের কাছে মামদোবাজি', যাই বলা হোক
না কেন, অস্তি-নাস্তির তর্কে শরদিন্দুর পাল্লা যে কোনদিকে ঝুঁকছে তার নিশ্চিত
প্রমাণ পাওয়া গেলো, তা সে তিনি গল্পের খাতিরে বরদাকে যতোই হেনস্তা করুন না কেন।
তেরোবার দেখা দেবার পর বরদা আর গল্প শোনাতে আসেনি, ভূতের গল্প সরাসরি ফেঁদেছেন
শরদিন্দুই। এ সম্বন্ধে শরদিন্দুর উক্তি: "ভূতের গল্প সম্পর্কে আমার একটু দুর্বলতা
আছে। বরদা চরিত্র কাল্পনিক। ... আসলে বরদাই আমাকে ছেড়ে গেছে, আমি বরদাকে ছাড়িনি।"
বাকী ভূতের গল্পে ভালো মন্দ সবই আছে কিন্তু পড়ে মনে হয় শরদিন্দু বরদাকে একটু তোষণ
করে ধরে রাখলেই পারতেন, জাফরানের মতো ওর কী একটা গুণ আছে, গল্পে দিলেই স্বাদ বদলে
যায়। প্রেতযোনি ছাড়াও শরদিন্দু অলৌকিক ঘটনা নিয়ে আমাদের হিসেবে আরো তেরোটি গল্প
লিখেছেন, তার মধ্যে সিদ্ধাই (যথা "নখদর্পণ"), কল্পবিজ্ঞান (যথা "শূন্য শুধুই শূন্য
নয়" বা "ধীরেন ঘোষের বিবাহ"), দৈবী শক্তি ("নিরুত্তর") আর জাতিস্মরতার (যথা "মায়া
কুরঙ্গী"; জাতিস্মরতার ব্যবহার তাঁর কিছু ঐতিহাসিক কাহিনীতেও দেখা যায়) কাহিনী আছে।
এ সব গল্পই মনোরম কিন্তু দুয়েকটি গল্প আছে যা কখনো ভোলা যায় না। যথা, "শূন্য শুধু
শূন্য নয়", সেখানে গল্পের নায়ক একজন শিল্পী, সে তার মানসপ্রতিমাকে রঙে রেখায় ধরেছে
-- আক্ষরিকভাবেই। নর্সিং দারোগা এক ঘোর পাপাচারী, কোন এক বিপত্তারণ দৈবী শক্তি এসে
তাকে শুদ্ধ পথে চলায়, নর্সিং বোঝে না কোন হিসেবে তার মতো পাপী এই দয়ার ভাগ পায়
("নিরুত্তর"), শেষে তার বুকফাটা প্রশ্ন, কেন, কেন? প্রসঙ্গত গল্পলেখার ব্যাপারে যে
বিদেশী লেখককে শরদিন্দুর সবচেয়ে কাছের লোক বলা যায়, সেই আর্থার কোনান ডয়েল
প্রেততত্ত্বে বিশ্বাস করতেন, তা নিয়ে গল্পও লিখেছেন। শরদিন্দুর সমসাময়িক বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ও অলৌকিকে বিশ্বাসী ছিলেন, লিখেছেনও, যদিও সে রচনার সংখ্যা মাত্র দুই
কি তিন।
অন্য গল্প
গোয়েন্দা, একটু বিস্তৃত অর্থে অলৌকিক. কিশোরপাঠ্য আর ঐতিহাসিক কাহিনী বাদ দিলে
শরদিন্দু আরো একশো ছত্রিশটি ছোটো গল্প লিখেছেন, সে সব অমনিবাসের পঞ্চম, ষষ্ঠ আর
সপ্তম খণ্ডে সংগৃহীত। সম্পাদক প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত সেগুলোকে রেখেছেন তিনটে স্বতন্ত্র
ভাগে -- কৌতুক, প্রেম আর সামাজিক কাহিনী। তা সব গল্পের ছাপই যে আমাদের মতের সঙ্গে
মিলছে তা নয়, যেমন সামাজিক শ্রেণীতে ফেলা দুয়েকটা গল্পের ভিত্তি কল্পবিজ্ঞানে (যথা
"মায়ামৃগ"), তারা সহজেই অলৌকিক গল্পের দলে যেতে পারতো। তেমনি কিছু ব্যঙ্গাত্মক
রচনায় (যথা "ঘড়ি") কৌতুকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে কাজেই তাদের কৌতুককাহিনীর দলে ফেলা
যেতে পারে, আবার এদিকে ব্যঙ্গটা হচ্ছে সমাজব্যবস্থা নিয়ে, তাই তাদের সামাজিক
কাহিনীর তকমাও দেওয়া যায়। প্রেমের গল্প বলা হচ্ছে যাদের তাদের মুখ্য উপজীব্য অবশ্যই
প্রেম কিন্তু শ্রেণীবিভাগের তোয়াক্কা না করে প্রেমের কথা কোনো ফাঁকফোকর দিয়ে
অনায়াসে এবং অত্যন্ত মধুর ভাবে অনুপ্রবেশ করেছে তাঁর বহু গল্পে, তা সে
গোয়েন্দাকাহিনীই হোক বা নিছক সামাজিক কথাই হোক। তাঁর কলমের গুণে মূল গল্পের থীমকে
টেক্কা দিয়ে সে প্রেমকথার মায়া এমন যে তা কাটিয়ে ওঠা যায় না। আত্মজীবনীমূলক গল্প
আছে, তার মধ্যে "চলচ্চিত্র প্রবেশিকা" গল্পে তখনকার মুম্বই ফিল্মজগতের কিছু ঘটনার
আর খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের সুন্দর একটা ছবি পাওয়া যায়। তেমন উপন্যাসও একটা আছে, তার
কথা যথাস্থানে বলা হবে।
কৌতুক কাহিনী
শরদিন্দুর লেখা কৌতুকরসের গল্পে তিনরকম স্বাদ পাওয়া যায় -- এক, নিছকই কৌতুক (যথা
"ভল্লু সর্দার"); দুই, কৌতুকরসের সঙ্গে একটু ব্যঙ্গের মিশেল দিয়েছেন (যথা
"গ্রন্থকার"); আর তিন, ঝাঁজালো ঝাল মশলার ব্যঙ্গ (যথা "স্বর্গের বিচার")। শরদিন্দু
বাঙালী ঘরের আটপৌরে রান্নার রাঁধুনী, তাঁর হাতে কম ব্যঙ্গের রান্নার স্বাদ যেমন
খোলে, কড়া মোগলাই ব্যঙ্গ তেমন খোলে না, যদিও প্রসাদগুণের প্রসাদে পড়তে কোনো অসুবিধে
নেই। তবে চেয়ে চেয়ে খেতে সাধ যায় না। সুখের কথা শরদিন্দু নিজে একথা জানতেন তাই ওই
তৃতীয় শ্রেণীর লেখা বিশেষ লেখেননি। আরো একটা সুখের কথা যে বেশীর ভাগ রচনাতেই
জাফরানের মতো মানুষী প্রেমের ছিটে পড়েছে, ( কয়েকটা অপূর্ব রচনা তো শুধু জাফরান
দিয়েই রাঁধা) আর তাতে অমৃতের স্বাদ। অন্ধকার ঘরে সলাজ নববধূর প্রথম চুম্বনের "ভারি
মিষ্টি ছোট্ট শব্দ" শুনে এক বেয়াদব ময়না পাখি বলে "রাধে কৃষ্ণ", আমরা বলি "মধু,
মধু" ("বহুবিঘ্নানি")। প্রায় অনাত্মীয় মিলু আর নীরেন অবিশ্রাম ঝগড়াঝাঁটি আর
খেয়োখেয়ি করে তাদের অভিভাবক এক "ধূর্ত এবং ফন্দিবাজ" বিজ্ঞানীর ডারউইন-বিরোধী
তত্ত্বের গিনিপিগ হিসেবে বড়ো হয়েছে ("প্রতিদ্বন্দ্বী")। সেই নিরীক্ষার শেষ ধাপ হলো
তাদের বিবাহ, আর বাসরঘরে বিজ্ঞানীর মুখে ছাই দিয়ে নীরেন "পলায়নপরা মিলুকে চাপিয়া
গাঢ় স্বরে বলিল, 'তবে রে'--"। মাত্র তিনটি কথায় শরদিন্দু আমাদের সমস্ত ব্যাপারটা
বুঝিয়ে দিলেন, আর আমরা "জৈব ধর্মের" জয় হলো দেখে আশ্বস্ত হলাম। এতো পুরো তিনটে কথা,
"তন্দ্রাহরণ" গল্পে রাজকুমারী তন্দ্রা মাতৃভাষা পর্যন্ত ভুলে গিয়ে কী যে চরম
বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, শরদিন্দুর দাক্ষিণ্যে তা বোঝা গেলো মাত্র তিনটে শব্দের
প্রয়োগে -- "পারমু"। যুগপৎ রাজকুমার চন্দ্রমাণিক্যের আর বাকচতুর শরদিন্দুর কেরামতি
দেখে আমাদের "সাবাস" বলতেই হলো। গোঁয়ারগোবিন্দ বিভূতি, বা ভূতো, সে পাড়ার গুণ্ডাদের
দলপতি হয়ে লোকজনকে ঠেঙিয়ে 'চন্দ্রবিন্দু' করে বেড়ায়। তার বরাতে যে স্ত্রীরত্নটি
জুটেছেন, পুষ্পরানী ওরফে ক্ষান্ত, জেদে তিনিও কম যাননা, ফুলশয্যার দিন থেকেই তাদের
বাক্যালাপ বন্ধ। জৈব ধর্মের ব্যত্যয় ঘটতে চলেছে ভেবে আমাদের শঙ্কিত হবার কারণ নেই,
গুণ্ডামিতে ক্ষান্ত দিয়ে ভূতো নিজেই কী করে চন্দ্রবিন্দু হয়ে গেলো শরদিন্দু সে কথা
আমাদের জন্য লিখে রেখে গেছেন ("ভূতোর চন্দ্রবিন্দু")। আরব্ধাকে পাবার জন্য
স্বেচ্ছায় চাকরের কাজ নিয়েছে, আমরা এমন লোকের দেখা পাচ্ছি ("সন্দেহজনক ব্যাপার")।
এদিকে তরুণ এলোপাথিক ডাক্তারকে প্রতিবেশী পাবার পরেই দেখছি বিয়ের কথা উঠলে
কবিরাজকন্যা শৈলর পায়ে ঘটি পড়ে বা হাতে ফুটন্ত তেলের ছ্যাঁকা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে,
কবিরাজীতে যার চিকিৎসা নেই ("সেকালিনী")।
অবশ্য সবসময়েই যে প্রেমের পিছন পিছন কৌতুককে আসতে হবে তা নয়, যেখানে প্রেম পূর্ণ
গর্বে অধিষ্ঠিত, সেখানেও যে কৌতুক এসে পড়তে পারে, তাও শরদিন্দু আমাদের দেখিয়েছেন।
অর্থাৎ দাম্পত্য প্রেম। পাঁচ বছরের সংসারাভিজ্ঞ দ্বিজেন আর মিনতির মধ্যে ভুল
বোঝাবুঝি শুধু মনের কথা লুকিয়ে রাখার কারণে, যাকে second guessing বলে ("মনে মনে")।
শাস্ত্রে বলছে এ লঘুক্রিয়া মাত্র, এখানেও তাই, যদি শেষমেশ এক বালিশে মাথা দিয়ে
শোয়াকে লঘু বলা যায়। তবে মিনতি উদ্যোগ না নিলে তা কিন্তু নাও হতে পারতো। বিয়ের
তৃতীয় বছরে একটা জটার পরচুলা পরে স্ত্রীর সঙ্গে মজা করতে এসে কথকের নিজেরই
নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম, এখানেও উদ্যোগী হলেন স্ত্রী প্রমীলা ("জটিল ব্যাপার")।
দক্ষিণ আমেরিকায় দূতাবাসের চাকরী নিয়ে আছেন দুটি দম্পতী। তাদের মধ্যে এক জোড়ার
বদলীর হুকুম এসেছে, সে শ্রীমতী আবার স্থানত্যাগে সমূহ অনিচ্ছুক। আপ্তবাক্য একটু
বদলে নিলে হয় 'যস্মিন্ কালে যদাচারঃ' আর তা মানলে পত্নীবদল করে এ সমস্যার আশু
সমাধান করা যায়, শেষ পর্যন্ত ওরাও তাইই করলো ("কা তব কান্তা")। এ গল্পের প্রকাশ
১৯৬১ সালে, তখন আমেরিকাতে হিপি সংস্কৃতি আর বৌবদল ব্যাপারটা আসবো-আসবো করছে। এখন
প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে এই কালান্তকারী চিন্তার জনক কে -- শরদিন্দু না হিপির দল?
নিছকই মানবচরিত্র, প্রেমের গন্ধ পর্যন্ত নেই, তেমন কৌতুকীও আছে। যেমন সারদাচরণ গভীর
রাত্রে "তন্বী তরুণী কুহকিনীর মতো" দেবীর বর পেলেন যে তিনি মানুষের মুখ দেখে তার
মনের কথা বুঝতে পারবেন। তার ফল কী মারাত্মক হতে পারে তা যাঁরা রবীন্দ্রনাথের
"ইচ্ছাপূরণ" বা বিদেশী The Monkey's Paw গল্প পড়েছেন তাঁদের বুঝিয়ে বলতে হবে না,
অন্যরাও একটু চিন্তা করলেই কাছাকাছি আসতে পারবেন ("বরলাভ")। কথকের মেয়ের বিয়েতে
তাঁর শ্যালকের বন্ধু এক সুবেশ তরুণ এসেছেন, তাকে কীভাবে আপ্যায়ন করবেন তা নিয়ে
দোলাচল মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেলো যখন জানা গেলো তার নাম গ্যাঁড়া এবং আরো জানা গেলো
যে সে খাজা তৈরীর ওস্তাদ কারিগর ("গ্যাঁড়া")। বীরবল রাজপোষাকের ওপর রাজভোগ
ঢেলেছিলেন, সে কাহিনী মনে পড়ে যাবার কথা। কাজের ঝি থাকা না-থাকার ওপর বড়োসাহেবের
মেজাজ আর অধীনস্থদের ভাগ্য নির্ভর করে এই কথা জানানো আছে "ঝি" গল্পে। শরৎচন্দ্র
গল্পচ্ছলে নবীন সাহিত্যিকদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন "প্রকৃতি সত্যিকার আর্টিস্ট নয় ...
কেবল নোংরামি আর বাজে কথা নিয়ে তার কারবার" ("অসমাপ্ত")। কৌতুকীর তালিকায় সম্পাদক
উনপঞ্চাশটি গল্প রেখেছেন, তা এমনই মধুর আর অম্লমধুর গল্পে ভর্তি।
তাঁর ভল্লু সর্দার ("ভল্লু সর্দার") তার সমস্ত ছবছরের শিভাল্রির জোরে দুষ্টের দমন
করে বেড়ায়, সদ্যোপরিণীত কাকা তার পরম শত্রু। তারপর ভল্লু তাকে কী কৌশলে ফাঁদে ফেলে
কাকীমার সামনে কাঠগড়ায় বিচারের জন্য হাজির করলো আর কঠিন দণ্ডের প্রয়োগে কাকার সুমতি
হলো সে কথা ব্যোমকেশ-জনক শরদিন্দু ছাড়া আর কেউ আমাদের এমন করে বলতে পারতেন না।
ভল্লুর প্রতি দুর্বলতার কথা তিনি স্বীকার করেছেন। অত্যাচারী কাকাদের বিরুদ্ধে আরেক
অকুতোভয় বিপ্লবীর অভিযানের কথাও শরদিন্দু লিখেছিলেন ("সন্ধি বিগ্রহ"), তবে তার নাম
নিতাই আর তার বয়েস নয়। এখানে ঘটনার মোড় কাকাকে শাস্তি দেওয়ার দিকে ফেরেনি, বরং
নিতাইবাবুই নিশ্চিত শারীরিক ক্লেশের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন, আর গল্পের মধুর
সমাপ্তি হয়েছে নিতাই আর তার সামান্য বড়ো দিদির সন্ধিতে। ভল্লুকে দিয়ে গল্পটা ফাঁদলে
আরো ভালো হতো কিনা বলা শক্ত, তবে ভল্লু তার মতো বীরের যোগ্য আর একটু বেশী
একস্পোজার পেতে পারতো। এ দুটো লেখাই আরেক বাঙালী হাস্যরসিক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ
মুখোপাধ্যায়ের "পোনুর চিঠি" বা "রাণুর কথামালা"র কথা মনে পড়িয়ে দেয়, শরদিন্দুর হাতে
এ ধরনের জিনিষ খুলতো চমৎকার আমরা নিঃসন্দেহ। শরদিন্দু অবশ্য বলে গেছেন, "ভল্লুর
প্রেম বলে একটা গল্প লেখার ইচ্ছেও হয়েছিল। প্ল্যানও করেছিলাম; তবে লেখার মুড আর
আসেনি।" হা হতোস্মি!
জমিদার "হৃষীকেশবাবুর মতো বদরাগী অগ্নিশর্মা লোক আজকালকার দিনে বড়-একটা দেখা যায়
না।" কাঁচের গেলাস ভাঙতে দিয়ে তাঁর আসবাবধ্বংসী রাগ সামলাবার, anger management,
একটা উপায় বার হবার পর তাঁর বাড়ীর লোকেরা খানিকটা নিস্তার পেয়েছে। তাঁর রাগের
তাপমান হচ্ছে তিনি তাঁর খাস চাকর গয়ারামকে কী বলে ডাকছেন তা দিয়ে -- চটে থাকলে
"শুয়োরের বাচ্ছা" আর খুসী থাকলে "হারামজাদা"। এমন লোকের কীর্তিকলাপ নিয়ে নির্মল
আনন্দের গল্প লেখা যায়, শরদিন্দু তাই লিখেছেন ("কর্তার কীর্তি")। তাঁর সন্তানসম্ভবা
কল্যাণী পুত্রবধূ এসে কী করে তাঁর রাগের অবসান ঘটালো তাই দিয়ে কাহিনীর সমাপ্তি।
শরদিন্দুর প্রসাদগুণে চমৎকার লাগে পড়তে, আরো খুসী হওয়া যায় যখন মনে পড়ে যে জমিদারী
প্রথা বিসর্জন দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কাজের লোকেদের গালমন্দ করার বদভ্যাসটা ছাড়তে
পেরেছি। আমরা জানি যে শরদিন্দুর কালে এমনটাই হতো, তিনি সৃষ্টিছাড়া কিছু লেখেননি,
তবু তিনি আমাদের প্রিয় লেখক, তাঁর চোখে আর একটু উদার দৃষ্টি, ভবিষ্যৎদৃষ্টি, দেখতে
পেলে আমরা আরো খুসী হতাম।
প্রেমের গল্প
"প্রেম ও সামাজিক" শীর্ষে যে সাতাশিটি গল্প অমনিবাসে জড়ো করা হয়েছে, সেগুলোতে
সমাজ আর প্রেম এমনই জড়িয়ে আছে যে তাদের তফাৎ করা মুস্কিল। তবে এখানে প্রেম সবসময়
হাসতে হাসতে হাসাতে এসেছে তা বলা যায় না, কয়েক ক্ষেত্রে তো দস্তুরমতো প্রাণ নিয়ে
খেলা। আর যাই হোক, এসব প্রেম নিছক ঘরোয়া এলেবেলে প্রেম নয়, একরকম ভাবে দেখলে দেখা
যাবে যে এরা সবাই গল্পে এসেছে কিছু না কিছু বাধা অতিক্রম করে -- সে বাধা মনের,
সমাজের এমনকি প্রকৃতিরও হতে পারে। তার কয়েকটা নমুনা দেখা যাক। প্রসঙ্গত এই তালিকার
কিছু গল্প যখন"ব্যুমেরাং" নামের গল্পসঙ্কলনে প্রকাশ করা হয় তখন শরদিন্দু তাদের
"ব্যুমেরাং" আখ্যা দিয়েছিলেন -- কেননা পত্রপত্রিকার সম্পাদকদের কাছে পাঠানোর পর এ
সব গল্প ব্যুমেরাং হয়ে ফেরৎ এসেছিলো। ঠিক কোন কোনটি তা খুলে লেখেননি, তবে আমাদের
মতে এসব সম্পাদকদের বদমায়েসি ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা জানি যে সম্পাদক বৃত্তির এ
বদনাম আছে।
দুর্ঘটনার কারণে স্মৃতিভ্রংশের বাধা পার হয়ে "অভিজ্ঞান" গল্পে পত্নীপ্রেম ফিরে এলো
হীরের দুল দেখে -- কথক ভাবছেন বহু বছর আগে রাজা দুষ্মন্তেরও কি এমনই হয়েছিলো। তা
বোধহয় নয়, এখানে দয়িতালাভ করার আগে তাঁকে ত্রাণকর্ত্রী আর তার স্মৃতি ফেলে আসতে
হলো, দুষ্মন্তকে সে পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়নি। হিরণ-অরুণার প্রেম প্রথম কলহের
দুস্তর বাধা পার হলো রবীন্দ্রকাব্যের উদ্ধৃতির ওপর ভর করে ("প্রণয়-কলহ")। বিনয়ের
বাঁশির সমঝদার বিনতার সঙ্গে শুক্লা একাদশীর রাতে মুখোমুখি দেখা ছাতে, সারা দিন
উপোসের পর বিনতার মুখ শুকনো। লগ্ন সমেত সবই ছিলো অনুকূল কিন্তু বৈধব্যের বাধা সে
প্রেম আর পার হতে পারলো না ("শুক্লা একাদশী")।
পঁচিশ বছর আগে এক "নবীন যুবক" আর এক "অপরিচিতা নব-যুবতী"র মধ্যে গোপন কথার লেনদেন
হয়েছিলো। কী কথা আমরা জানিনা, শুধু জানি যে মেয়েটি "একটু হাসিয়া একটু লাল
হইয়াছিলো"। তারা তারপর জীবনের ভিন্ন পথে চলে গেছে, হঠাৎ এক রেলস্টেশনে দুই
উল্টোমুখী ট্রেনের জানলায় দুজনের ক্ষণেকের দেখা, কিন্তু তার মধ্যেই জানা গেলো যে
তাদের সে গোপন কথা গোপনই আছে। প্রেম মূর্তি পেলো না বটে কিন্তু গোপন কথায় তার আসার
খবর রেখে গেলো, আমরা তাই নিয়েই খুসী, আমাদের নাই বা সেই গোপন কথা জানা হলো ("গোপন
কথা")।
বাঘিনীর প্রাণ বাঁচিয়ে রূপদমন কৃতজ্ঞ বাঘিনীর কাছে পেয়েছিলো নির্ভেজাল প্রেম, তাতে
সে সাড়াও দিয়েছিলো। বাঘিনীর প্রেমে খুঁৎ ছিলো না কোনো, কেবল রূপদমন যখন এক মানুষীকে
বিয়ে করে আনলো তখন বাঘিনী সতীন সহ্য করতে পারলো না। রূপদমনের গ্রামের মেয়েদের বধ
করে বাঘিনীর প্রতিহিংসার শুরু, ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা নিয়ে শেষ শিকারীর গুলিতে
("বাঘিনী")। জীবগোত্রের বা জিনের বাধা প্রেমকে রুখতে পারেনি।
ব্রতীন আর তপতী স্বামী-স্ত্রী, তারা দুজনেই দেশোদ্ধারে নিয়োজিতপ্রাণ। ভারত স্বাধীন
না হওয়া পর্যন্ত তারা ব্রহ্মচর্য পালন করবে, এই অঙ্গীকার করিয়ে তাদের গুরু তাদের
বিয়ে দিয়েছেন। মায়াভরা বর্ষার রাত তাদের ব্যর্থ, তাদের প্রেম বেধে গেলো গুরুবাক্যের
অলঙ্ঘনীয় বাধায়। লেখকের প্রশ্ন -- "তাহাদের জীবনে ইহা পরম সিদ্ধি অথবা চরম
ব্যর্থতা-- তাহা কে বলিবে?" ("মেঘদূত")। যুধিষ্ঠিরের বৌ রম্ভা তাকে ছেড়ে মুম্বই চলে
যায় সিনেমা করতে, দুদিন নায়িকা থাকার পর যায় হারিয়ে। যুধিষ্ঠির কিন্তু ভোলেনি তাকে,
রম্ভাকে আবার নায়িকা হবার সুযোগ দেবার জন্য নিজের জমানো টাকায় ছবি করতে চায়।
শেষপর্যন্ত রম্ভাকে ছাড়াই ছবি হলো, হলো যুধিষ্ঠিরের টাকাতেই, ছবি লাভও করলো কিন্তু
যুধিষ্ঠির এলো না তার অংশ নিতে। যৌবনের ছলনা আর ভুলভ্রান্তির বাধা পেরিয়ে
যুধিষ্ঠিরের প্রেম স্বর্গের হদিশ পেয়েছে, সেখানে তার রম্ভাকে নিয়ে সে গেলো তার ভেঙে
যাওয়া ঘর নতুন করে বাঁধতে ("যুধিষ্ঠিরের স্বর্গ")।
কালো মেয়ে রুচিরা আর তার সুন্দরী বোন ছন্দা একসঙ্গে সরিতের কাছে পড়ে। কালো মেয়ের
কদর নেই, রুচিরা এটা জানে আর জেনে হাসে। সরিৎ খাঁটি জহুরী, চামড়ার রঙের বাধা তুচ্ছ
করে তার প্রেম কালোর আড়ালে রাজকন্যাটিকে খুঁজে পায়। যখন ছন্দাকে ছেড়ে সরিৎ রুচিরাকে
বলে "এখন তুমি আমাকে ওগো বলতে পারো" তখন হাস্যমুখী রুচিরার কান্না আর বাঁধ মানেনা।
প্রেমের এমনই রীতি, অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে হাসি-কান্নার মানেও ওলোটপালোট করে দেয়
("হাসি কান্না")।
বনবাসী মৌলিনাথ ধবলী গরু চরায় আর "কানু কহে রাই ... ধবলী চরাই মুই" গান করে। একবার
সভ্যসমাজে গিয়ে মমতার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসেছে। মৌলিনাথের বরাতে জয়লাভ এলো যখন
মোটর দুর্বিপাকে তার জঙ্গলের ডেরায় মমতা আর তার বোন সতী রাত কাটাবার পর দেখা গেলো
সতী তাকে ছেড়ে যেতে নারাজ। প্রেমের কাছে জঙ্গল, সরঞ্জামের অভাব, এসব কোনো বাধাই নয়
(আধুনিক আইনে গান্ধর্ব বিবাহের স্বীকৃতি নেই, সতীর মতে তার পরিবর্তে আছে "খোক্কস
বিবাহ"), মমতার স্বামী দুই হাত একত্র করে দিলেন, আইন সেটা মানতে বাধ্য, মমতার
স্বামী যে ম্যাজিস্ট্রেট ("কানু কহে রাই")। স্বামী-স্ত্রী সমীর আর ইরা, দুজনেরই
প্রাক্বিবাহ জীবনে নারী আর পুরুষ সান্নিধ্য হয়েছিলো। বর্ষার রাতে তা অকপটে
পরস্পরের কাছে স্বীকার করতে পেরে তাদের প্রেম দৈনন্দিন জীবন আর মতান্তর-মনান্তরের
বাধা পার করে তাদের "পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের" স্তরে পৌঁছে দিলো ("এমন দিনে")।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে বিপত্নীক হয়ে পুণেবাসী ভোজনবিলাসী রামকানাই বড়ো বিপদে পড়লেন।
রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় এলো বারো বছরের মারাঠি কিশোরী গোদাবরী, সে দিনের বেলা এসে
রান্নাবান্না করে বেলা থাকতে থাকতেই চলে যায়। সংসারের জটিল ঘটনাচক্রে গোদাবরীকে এক
রাত কাটাতে হলো রামকানাইয়ের বাড়ীতে, তা আস্তে আস্তে কায়েমী রাত্রিবাসে দাঁড়ালো,
একেবারে প্লেটোনিক। চার বছর পরে লোকনিন্দার জোর আওয়াজে আবিষ্কার করা গেলো যে
গোদাবরী এখন যুবতী এবং তার বিয়ে হওয়া আবশ্যক। আরো জানা গেলো যে গোদাবরীর প্রেম
বয়সের বাধা ডিঙিয়ে বুড়ো রামকানাইকে ভালোবেসে ফেলেছে। সে প্রেমের পরিণতি বিবাহে,
কিন্তু তার কৃতিত্ব পুরোটাই প্রেমের প্রাপ্য নয়, তার মধ্যে গোদাবরীর রন্ধনকৌশলেরও
কিছুটা হাত আছে ("গোদাবরী")। প্রসঙ্গত, জীবনের শেষ কয়েক বছর শরদিন্দু পুণেতে কাটান,
সেখানকার পরিবেশ আর লোকজনদের নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটা গল্প আছে। সেখানে মাঝে মাঝেই
বাঙালীদের সঙ্গে তাদের প্রথা আর রীতির পার্থক্য খুব মনোজ্ঞ করে শরদিন্দু দেখিয়েছেন,
পড়তে মজা লাগে।
দিল্লির নামকরা ব্যারিস্টার প্রিয়নাথের ছেলে কিষ্টোলাল এক প্রাণোচ্ছল যুবক, দিল্লি
শহরে টাঙা চালায়, সে জীবিকাই তার পছন্দ। মতিগতি ফেরাবার জন্য প্রিয়নাথ তার এক
সুন্দরী লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো বৌ এনে দিয়েছেন, তার নাম আল্পনা। আল্পনার সঙ্গে ঘর
করতে হবে সেই ভয়ে কিষ্টোলাল তার বাবার প্রাসাদোপম বাড়ীতে থাকতে চায় না, প্রিয়নাথ
বলেন "বাঘের ভয়"। সমাজের উঁচু-নীচু তলার বাধা না মেনে কিষ্টোলালের প্রেম তাকে দিয়ে
ঘর বাঁধায় এক বস্তিতে যেখানে থাকে জান্কি, তার "দিল্কা পিয়ারী" -- বধূ কিনা জানা
যায়নি। কিষ্টোলাল অতি অমায়িক ছেলে, তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না আর জান্কির
হাতের মদের চাট অমৃতবৎ। তাদের নির্বাধ প্রেমের গল্প ভালোই লাগে শুনতে কিন্তু
আল্পনার কথাটা মনের মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করেই যায় ("কিষ্টোলাল")। জমিদারপত্নী
সরয়ূকে ডাকাত খগেশ্বর হরণ করে দূর গ্রামে বাসা বেঁধেছিলো। সেখানে খগেশ্বর মাছ ধরে
জীবিকা নির্বাহ করে, সরযূ বাধ্য হয়ে তার ঘর সামলায়। তাদের জীবনযাত্রা "একপক্ষে
দুর্মদ প্রমত্ততা, অন্যপক্ষে বাক্যহীন হাস্যহীন আত্মসমর্পণ"। কিন্তু তারই মধ্যে
সমাজ, শ্রেণী, প্রবৃত্তির বাধা ঠেলে কোন বীজ থেকে অঙ্কুরিত হলো প্রেম, যাতে
জমিদারের দল যখন সরযূকে উদ্ধার করতে এলো তখন খগেশ্বরের সঙ্গে পালিয়ে গেলো সরযূ, পথও
দেখালো সে ("রমণীর মন")।
সামাজিক গল্প
বাকী গল্প অমনিবাসে "সামাজিক" আখ্যা পেয়েছে তবে তার মধ্যে কয়েকটিকে "ইত্যাদি"র
দলে ফেললে ভালো হয়। এই পর্যায়টির গোড়াতেই থাকবে তাঁর নিজের বা অন্য সাহিত্যিকের
লেখা উপন্যাসের কিছু চরিত্রের সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হবার গল্প। উদাহরণ "প্রিয়
চরিত্র", "অমরবৃন্দ", বা "মায়া কানন" কারণ চিন্তায় আর কথনে এরা অনন্য। "অসমাপ্ত"
গল্পে তো স্বয়ং শরৎচন্দ্রের জবানীতে তাঁর "গৃহদাহ" উপন্যাসের কথা শুনতে পাচ্ছি।
সত্যি না মিথ্যে জানতে পারলে ভালো লাগতো। নিদ্রালু শরদিন্দুকে দেখা দিয়ে বাংলা
সাহিত্যের কিছু অমর চরিত্র কিছু গল্পগাছা করে গেলেন ("অমরবৃন্দ")। কী বললেন তার
থেকে বড়ো এঁরা কারা: মাণিকলাল, মবারক; জাবালি; গোরা, বিনয়; দেবেন্দ্র, নিমচাঁদ;
অভয়া, শেখর; আর মেহের আলি। শরদিন্দুর লেখা থেকে জানছি যে বঙ্কিমচন্দ্র,
রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র আর পরশুরামকে তিনি গুরু মানেন। অমরবৃন্দের কুশীলবটা বোঝা
গেলো। অনেকটা এই ধরনের গল্প পরশুরাম দুয়েকটা লিখেছিলেন, তার মধ্যে "রামধনের
বৈরাগ্য" একটি, সেখানে ঔপন্যাসিক রামধনের সৃষ্ট চরিত্রেরাই তাঁর তন্দ্রায় দেখা দিয়ে
তাঁর নিগ্রহ করে। এর মধ্যে আবার বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন মহাগুরু, শরদিন্দু লিখছেন,
"বঙ্কিমচন্দ্রকে আদর্শ বলিয়া জানিবে। তিনি ভিন্ন বাংলায় অন্য আদর্শ নাই।" বঙ্কিমের
সৃষ্ট বেশ কটি কালজয়ী চরিত্র পলকের জন্য দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেলো --বঙ্কিম
শতবার্ষিকীতে প্রকাশিত সেই "মায়া কানন" কাহিনী সাহিত্যসম্রাটের উদ্দেশ্যে শরদিন্দুর
বিশেষ অর্ঘ্য। জীবানন্দ, শান্তি, দেবী, সীতারাম, রাজসিংহ -- এরা কি আর কখনো ফিরে
আসবে না, শরদিন্দুর প্রশ্ন। উত্তর পেলেন বন্দে মাতরম্ বীজমন্ত্রের আকাশবাণীতে,
জানলেন যে ওই মন্ত্রের মধ্যেই তারা সকলে লুকিয়ে আছে। অনেক বাঙালীর কাছেই এ এক বড়ো
আশ্বাসের কথা।
গল্পের মুখবন্ধ মাফিক সম্পাদকের ফরমাসে লেখা এমনই অদ্ভুত রসের আর এক কাহিনী "প্রিয়
চরিত্র", যেখানে যারা শরদিন্দুর প্রিয় হতে পারে নিজের সৃষ্টি এমনই কিছু চরিত্র এসে
দেখা দিয়ে গেছে। তার মধ্যে আছে জাতিস্মর, আছে চুয়া আর একঝাঁক যুবতীর দল, যাদের
অনেকের নামই শরদিন্দু মনে করতে পারলেন না। মহাকবি কালিদাস অবশ্যই আছেন আর হঠাৎ এসে
উপস্থিত একান্ত অনাহুত ব্যোমকেশ, যাকে (এবং অজিতকে) শরদিন্দু বলেছেন যে "দুচক্ষে
দেখতে পারি না।" তবে ব্যোমকেশ অতি ঝানু গোয়েন্দা, প্রিয় চরিত্র নিয়ে তার অনুমান
কানে কানে শুনে শরদিন্দু বলতে বাধ্য হচ্ছেন, "মনের অগোচর পাপ নাই, ব্যোমকেশ ঠিক
ধরিয়াছে।" ব্যোমকেশকে ভাগিয়ে দিয়ে শরদিন্দু আর কিছু খুলে লেখেন নি তবে ব্যোমকেশের
কাহিনী খুঁটিয়ে পড়ে আর অধুনা অনেক সিনেমা দেখে আমরাও কিছু কম যাই না, প্রিয়
চরিত্রটি যে কে তা আমরা ধরতে পেরে গেছি।
এই পর্যায়ে দুতিনটে গল্প আছে আমাদের মতে যাদের অলৌকিক/কল্পবিজ্ঞান গোত্রে স্থান
পাওয়া উচিত ছিলো। আলোকবিজ্ঞানকে কলা দেখিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে এমন হরিণদের নিয়ে
লেখা গল্প "মায়ামৃগ", আর সাধুর দেওয়া ওষুধ খেয়ে আয়তনে ক্রমশ কমে যেতে থাকা
ক্ষুদিরামবাবুর দুর্ভাগ্যের কাহিনী "বালখিল্য" (তাতে ব্যঙ্গের ঝাঁজও আছে) ছাড়া
আরেকটি কাহিনী "শাদা পৃথিবী", এটি প্রকাশের পর কিছু আলোড়ন তুলেছিলো। ১৯৪৬ সালের ৬ই
অগাস্ট রাত্রে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী সার জন হোয়াইট "শাদা মানুষের মুক্তিপথ" খুঁজে
পেলেন, এই দিয়ে কাহিনীর শুরু, আর ঠিক চারবছর পরে কাহিনীর শেষ, "পৃথিবীর সবর্ণ জাতির
আর একটা মানুষও বাঁচিয়া নাই।" শরদিন্দু লিখছেন, " 'শাদা পৃথিবী' রচনাটি ঠিক গল্প
নয়; উহা আমার মনের উপর আণবিক বোমার প্রতিক্রিয়া। ... আষাঢ়ে গল্প নয়, ভবিষ্যদ্বাণীও
নয়, ইহা আশঙ্কাজাত সতর্কবাণী।" কালিদাস রায় লিখেছিলেন, "সতর্কতা বাণী -- তা নয়,
সতর্ক হবার উপায় কই? প্রস্তুত থাকার জন্য আহ্বান বলিতে পারা যায়।" আজ প্রায় সাত দশক
সেই উদ্যত খড়গের নীচে বেঁচে থেকে আমরা সংযমের পরিচয় দিয়েছি বটে তবে সে সংযমের বাঁধ
যে একদিন ভেঙে যাবে না তার নিশ্চয়তা নিয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম কই! বর্ণান্ধতাও যে
সার্বজনীন হয়েছে তা বলা যায় না।
বাকী কাহিনী শরদিন্দুর যুগের, শরদিন্দুর কালের শরদিন্দুর সমাজের সাধারণ
মানুষ-মানুষীর দুঃখ-আনন্দ, লাভ-ক্ষতি, সমস্যা-সমাধানের কাহিনী। সুকুমার সেন বলছেন,
"... সাধারণ জীবন হইতে ঘটনা লইয়া শরদিন্দুবাবু কতকগুলি ভালো ছোটগল্প লিখিয়াছেন।"
এখানে বাঙালী মধ্যবিত্তদের দেখা পাওয়া যায় বেশী, তবে নিম্নবিত্ত আর আমরা যাদের
"ছোটোলোক" বলে থাকি, তাদের কথাও আছে, সহজ করে বলা, কঠিন তত্ত্বে ভারাক্রান্ত নয়।
আমরা এদের বেশীর ভাগকেই চিনি, আমাদের ন্যায়নীতিতে এদের ধরা যায়, গল্পের শেষে তারা
ভালো কি মন্দ সে নিয়ে কোনো দ্বিধা থাকে না, আমরা তৃপ্ত হয়ে পরের গল্পে চলে যাই। এ
নিয়ে শরদিন্দু লিখছেন, "প্রায় সব গল্পের পিছনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা দৃষ্ট লোকের
ছায়া পড়েছে।" মাঝে মাঝে দুয়েক জায়গায় খটকা লাগে, আকস্মিক কোনো ঘটনা ঘটে বা কারুর
চরিত্রের এমন কোনো দিক আমাদের নজরে পড়ে যায় যা আমরা ঠিক হিসেবের মধ্যে আনতে পারিনা।
গল্প পড়া শেষ হলে একটু থেমে ভাবতে হয়, এটা কী হলো, এটা কেন হলো। আর একবার সে গল্প
পড়ার সুযোগ হলে আরো দুয়েকটা জানলা খুলে যায়, শরদিন্দুর লেখার এ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা
পরে আরো কিছু বলবো। কিছু গল্পে, বিশেষ করে কৌতুকস্নিগ্ধ গল্পে বিভূতিভূষণ
মুখোপাধ্যায়ের রচনার স্বাদ পাওয়া যায়, কয়েকটাতে বনফুলের। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের
লেখার সঙ্গে সাদৃশ্যের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। শরদিন্দু লিখছেন, "ছোটো গল্পটাই আমার
হাতে বেশী আসে।" আরো লিখছেন, "যাই লিখি না কেন যত্ন করে লিখতে হয়", তার চিহ্ন তাঁর
গল্পের প্রতিটি শব্দে প্রকট। আরো লিখেছেন, "পাঠকের বুদ্ধি, জ্ঞান ও রসবোধের উপর
শ্রদ্ধা রাখিবে। অন্যথা ঠকিতে হইবে।" এ কথা তিনি ভেবেছেন আর মনে রেখে তাঁর বেশীর
ভাগ রচনায় কাজে লাগিয়েছেন, আমরা কৃতজ্ঞ, বিশেষ করে আজ যখন উদ্দাম ব্লগ লেখার যুগ।
সুদর্শন বিত্তবান যুবক দেবব্রত বুদ্ধিমান, "তাহার বুদ্ধির [এমন] এক কুণ্ঠাহীন
অনাবৃত নগ্নতা ছিল" -- আজকাল তাকে বোধহয় আঁতেল বলা হবে। সে এক বিপন্না পতিতাকে
আশ্রয় দিয়ে বন্ধুদের বিরাগ আর বিদ্রূপের পাত্র হয়েছিলো ("বিদ্রোহী")। পরে দেবব্রত
সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে, তার বিবাহবাসরে বন্ধুরা কেউ আসেনি, যিনি এই কাহিনীর কথক সেই
অন্তরঙ্গতম বন্ধুও নয়। বিয়ের পর সস্ত্রীক দেবব্রত দেশ ছেড়ে চলে যায়। বন্ধুরা একমত,
-- বোধহয় তাদের সঙ্গে আমরাও -- এমনটাই হওয়া উচিত, অসামাজিক ব্যবহারের ঠিকমতো শাস্তি
না হলে সমাজ তো উচ্ছন্নে যাবে। কেউ কেউ আবার এটা অবিচার বলতে পারেন কিন্তু তাঁর সব
রচনার যিনি ভাগ্যবিধাতা সেই শরদিন্দু এই অন্তরঙ্গতম বন্ধুর কৃতকর্মের মোকাবেলা করার
আর একটা সুযোগ দিলেন পরের গল্পে ("স্বখাত সলিল")। ষোলো বছর পর তার সঙ্গে দেবব্রতের
আবার দেখা, দুটি সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে দেবব্রতের সচ্ছল জীবন, তার চিন্তা আর
বুদ্ধি এখনো অকুণ্ঠ, তবে পরিবারের কথা ভেবে সে সমাজকে এড়িয়ে চলে। তার ছেলেমেয়ে,
বিশেষ করে তার বারো বছরের মেয়ের বড়ো দুঃখ যে তাদের "বাড়িতে কক্খনো কেউ আসে না,
আমরাও কোথাও যেতে পাই না।" এ গল্পের শেষে তাদের একটি মামা উপহার দিয়ে, মামার বাড়ী
যাবার নেমন্তন্ন করে শিগ্গির আবার আসার কথা দিয়ে বন্ধু বেশ সস্তায় প্রায়শ্চিত্ত
করে চলে গেলেন। শরদিন্দুর এমন সৃষ্টিছাড়া ব্যবহারে আমাদের মন অপ্রসন্ন হলো বটে
কিন্তু ন্যায়নিষ্ঠার আড়ালে যে মানবিকতাবোধের বাসা, সে বেশ খুসী হয়েছে, এটা বোঝা
গেলো।
চল্লিশ বছর বয়সে সাধুচরণ সংসার ছেড়ে চলে যান, বারো বছর পরে ফিরে এসে দেখলেন তাঁর
অবর্তমানে তাঁর সংসার দাঁড়িয়ে থাকেনি। উন্নতি না হলেও অবস্থা সচ্ছল, ছেলেমেয়েরা বড়ো
হয়েছে, তারা সংসারের ভার নিয়েছে। সন্ন্যাস আশ্রমের অভ্যাস ছেড়ে তিনি আস্তে আস্তে
আবার সংসারে ঢোকবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু যে দায়িত্ব একবার ছেড়ে চলে গিয়েছেন সংসার
সে দায়িত্ব তাঁকে আবার ফিরিয়ে দিতে নারাজ। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে
বিবাদ, গঞ্জিকা সেবনের অভ্যাসটা স্ত্রীও মেনে নিতে পারলেন না। সাধুচরণ দ্বিতীয়বার
সংসার ছাড়লেন বা ছাড়তে বাধ্য হলেন। বাধা দিলো না কেউ, কেউ সঙ্গে এলো না, সাধুচরণ
একাই "নিরাশ্রয় আত্মীয়হীন পৃথিবীর পথে পা বাড়াইলেন।" আমাদের বুদ্ধি বলে সাধুচরণের
যা পাওয়া উচিত তাই পেয়েছেন, আমাদের মন থেকে নেমে আসে এই "ভুলে ভুলেই জীবনটা কেটে
গেল" যে মানুষটির, তার জন্য একটা ব্যথিত দীর্ঘশ্বাস ("একূল ওকূল")।
কুড়ি বছর বয়সের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার এক "মন্দ লোক" পতিতার তেরো বছরের মেয়েকে ওষুধ,
পথ্য, পথ্য কেনার টাকা দিয়ে দুরারোগ্য ব্যাধিমুক্ত করেছিলো। পতিতাদের সেই সমাজে
নতুন মেয়ের পতিতাবৃত্তি শুরু করার বিধি-বিধান আছে, তার শেষ কৃত্য কোনো বিশেষ
পুরুষের কাছে মেয়েটির 'বলিদান'। কৃতজ্ঞ "মন্দ লোক" ডাক্তারের কাছে সেই বিশেষ
পুরুষের ভূমিকা দিতে এসেছিলো উপহার হিসেবে -- অকিঞ্চনের ঋণশোধ। ডাক্তার অবশ্যই এমন
বেয়াদবি সহ্য করেনি, তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। আজ কুড়ি বছর পরে ডাক্তারের মনে হয়
"মন্দ লোক" কী দোষ করেছিলো, সে তো "তাহার দীন জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দান পূজারিণীর মতো
আমার পদপ্রান্তে রাখিয়াছিল।" বিশ্বসাহিত্যে স্থান পাবার মতো মাত্র তিন পাতার এক
গল্পে শরদিন্দু নড়া ধরে আমাদের মূল্যবোধ আর তার ভণ্ডামির সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে
দেন, আমরা উত্তর জানিনা, আমরা নির্বাক ("মন্দ লোক")।
"ছুরি" গল্পে ত্রিশ বছরের পূর্ণযৌবন নগেন বিবাহিত, কিন্তু তার স্ত্রী দুটি মৃত
সন্তানের জন্ম দিয়ে তেইশেই বুড়ী। নগেন এক লোন অফিসের মালিক, একদিন বন্ধক হিসেবে এক
অভিশপ্ত ছুরি তার হাতে আসে। প্রতি রাতে সেই অভিশপ্ত ছুরির প্রভাবে কুকুরছানা থেকে
শুরু করে নগেন মানুষ খুন করতে থাকে, তার শেষ বলি তার ঘুমন্ত স্ত্রী। ছুরির মালিক
এসে তারপর ছুরি ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। নগেন খালাস পায় এক ডাকাতের ঘাড়ে স্ত্রীর
মৃত্যুর দায় চাপিয়ে, তারপর সে এক নবযৌবনাকে বিয়ে করে। এ পর্যন্ত ঠিক আছে, আমরা জানি
যে দোষ নগেনের নয়, দোষ ওই শয়তান ছুরির। কিন্তু গল্প শেষ করার আগে শরদিন্দু লিখলেন,
"ছুরিটা তার জীবনে অভিশাপ কি আশীর্বাদ রূপে দেখা দিয়াছিল [নগেন] তাহা বুঝিতে পারে
না।" আমরা থমকে যাই, মানুষের ওপর এতোটা অবিশ্বাস আমরা শরদিন্দুর কাছ থেকে পেতে
অভ্যস্ত নয়, আমাদের সম্বিৎ ফিরে পেতে সময় লাগে।
শরদিন্দুর কালের বাংলা সাহিত্যে মেয়েদের ভূমিকা ছিলো সীমাবদ্ধ -- মাতৃরূপিণী,
সহধর্মিণী, কন্যা, কল্যাণী, অসচ্চরিত্রা, কুহকিনী, বা পতিতা, "মন্দ লোক" -- সমাজে
তাঁদের জন্য যে যে ভূমিকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে সে গণ্ডীর বাইরে তাঁদের দেখা পাওয়া
যেতো না। শরৎচন্দ্র বোধহয় সামান্য ব্যতিক্রমী ছিলেন, তবে শরদিন্দুকে তা বলা যায় না।
কেবল দুটি গল্পে একটু অন্য রকম দেখা যাচ্ছে। জমিদারকন্যা প্রভাবতীর ঘরজামাই স্বামী
নবগোপাল নির্বীর্য, তবু প্রভাবতী তাকে নিয়েই ঘর করেন ("বড় ঘরের কথা")। নবগোপাল
অকর্মণ্যও বটে, জমিদার মারা যাবার পর নিঃসন্তান প্রভাবতীই সব ভার নিয়ে জমিদারী
সুষ্ঠুভাবে চালাতে থাকেন, যদিও তাঁর দেহেমনে ক্লেশের ছাপ পড়তে থাকে-- ফিটের রোগ,
শুচিবাই, বদমেজাজ, ইত্যাদি। প্রভাবতীর বয়েস তখন উনিশ বছর। পাশের জমিদারের নাতির
অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণ পেয়ে তাঁর মনে কিছু একটা বাঁধ ভেঙে যায়, তিনি কৌশল করে এক
চাকর মারফৎ নিজের গর্ভাধান ঘটান, সন্তানের জন্মও দেন। তখনকার মেয়েদের বাঁধাধরা মতো
চরিত্রচিত্রণ না করে শরদিন্দু প্রভাবতীকে স্বাধীন মানুষের মতো সিদ্ধান্ত নিতে
দিলেন, নিয়ে পরপুরুষগমনের মতো পাপ করতে দিলেন, এটা দেখে ভালো লাগলো। বিচক্ষণ পাঠক
বলবেন এও তো সেই পুঁথিতে লেখা মাতৃত্বেরই জয় দেখা যাচ্ছে বাপু, আদিম রিপুর জয় হলে
তাও কথা ছিলো। আমরা বলি নেই মামার চেয়ে কাণা মামা ভালো আর আড়চোখে দেখি যে প্রভাবতী
কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলেন না। জয় হলো নবগোপালেরই, সে মারা যাবার পর গল্পের এক
চরিত্রকে দিয়ে শরদিন্দু বলালেন, "লোকটা ভারি অমায়িক ছিল, ছেলেকে ভারি আদর করত।"
"মানবী" গল্পের নায়িকার নাম দেবী, সাত বছর বয়সে বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্তের
ছেলে রাধাকান্তের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, ন-বছর পরে সে শ্বশুরঘরে আসে। সন্তানাদি হয়,
দেবী সংসারের কর্ত্রী হয়ে বসেন, নিপুণভাবে সংসার চালান, ছেলেমেয়ের বিয়েথা দেন।
শেষজীবনে দেবীর ভাগ্যতরী ডুবো পাথরে আঘাত লেগে ভেঙে পড়তে শুরু করে। রাধাকান্ত জুয়ার
দেনায় সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যা করে, জামাই লালমোহনের আচারব্যবহার ভালো ছিলো না,
একদিন দেবীর ছোটো ছেলে সূর্যকান্তের সঙ্গে সামান্য বচসার শেষ হয় তার গুলিতে
সূর্যকান্তের মৃত্যু দিয়ে। আদালতে লালমোহন বেকসুর ছাড়া পেয়ে যায়, দেবী মেয়েজামাইয়ের
সংশ্রব ত্যাগ করেন। বড়ো ছেলে ব্যবসা চালাতে পারে না, দেবী ভার তুলে নেন, ব্যবসা
প্রতিষ্ঠিত করে, স্বামীর দেনা সব শোধ করে দেবী অবসর নিলেন, "তাহার কাজ শেষ হইয়াছে,
আর বাঁচিয়া থাকিবার প্রয়োজন নাই।" ভাগ্য তাঁর ইচ্ছের কথা জানতে পেরেছিলো, দেড় বছরের
নাতিকে আগুন থেকে বাঁচিয়ে দেবী নিজেই পুড়ে মারা গেলেন। এতে সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো
না, অসামাজিক কিছু করতে হলো না আর বাঙালী মেয়েদের কাছে দেবীকে এক মহীয়সী আদর্শ
হিসেবে তুলে ধরা গেলো। গল্পের নাম দেখে আমরা কিন্তু দুঃখ-সুখ, পাপ-পুণ্যের এক
মানবীর গল্প আশা করে ছিলাম।
১৯৪৮ সালে অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় শরদিন্দুর "শ্রেষ্ঠ গল্প" প্রকাশিত
হয়, নির্বাচিত গল্পের তালিকা: প্রাগ্জ্যোতিষ, সেতু, তন্দ্রাহরণ, রক্ত-সন্ধ্যা,
চুয়াচন্দন, ভল্লু সর্দার, হাসি-কান্না, অমরবৃন্দ, গোপন কথা, বহুরূপী, মন্দ লোক,
আঙটি, মাকড়সার রস, অগ্নিবাণ, অমিতাভ। অধ্যাপক ভট্টাচার্য অতি বিচক্ষণ সম্পাদক ও
সমালোচক, তাঁর নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের একমত হতেই হবে। তবে আমরা জানি যে ১৯৪৮ সালের
পরে শরদিন্দুর যেসব গল্প প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকেও শ্রেষ্ঠ গল্পের তালিকা সমৃদ্ধ
করার উপাদান পাওয়া যাবে। কিন্তু এ কথা বলতেই হবে যে তালিকা বৃদ্ধির সেই কারণে
অধ্যাপক ভট্টাচার্যের তালিকা থেকে কোনো গল্পকেই বাদ দেওয়া চলবে না। এছাড়া
অম্নিবাস-৭ গ্রন্থপরিচয় থেকে জানা যাচ্ছে যে শরদিন্দুর গল্প হিন্দি, মারাঠি,
মালয়ালম, কানাড়ী, গুজরাতী, ইংরেজী আর ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এদের মধ্যে গুজরাতী
অনুবাদের সংখ্যা নজরে পড়ার মতো।
নাটক ও সামাজিক উপন্যাস
সুকুমার সেন লিখছেন: "রোমাণ্টিক ও রোমাঞ্চক গল্প অবলম্বনে সহজ, সরল হাল্কা এবং
চলচ্চিত্রের উপযোগী নাটক রচনায় কৃতিত্বের অধিকারী হইয়াছিলেন ঔপন্যাসিক শরদিন্দু
বন্দ্যোপাধ্যায়।" আসলে শরদিন্দুর প্রায় সব সামাজিক উপন্যাস সিনেমার, সিনেমার না হোক
নাটকের উপাদান দিয়ে লেখা বলে আমাদের মনে হয়। এর মধ্যে আশ্চর্য হবার কিছু নেই, তিনি
পেশাদার চিত্রনাট্যকার, কী করে রচনা জনরঞ্জক আর অর্থকরী করা যায় তা তিনি ভালো
জানতেন। তাঁর বেশ কিছু ছোটোগল্প সিনেমা হয়েছে, আর তা ছাড়াও সেসবে নাটকীয় উপাদান
যথেষ্ট থাকতো, তাই যেখানে শুধু সংলাপ দিয়ে নাটক সৃষ্টি করতে হয়, অর্থাৎ বেতারনাটক,
সেখানেও তাঁর গল্পের নাট্যরূপ পড়তে পেতো না। চুয়া চন্দন, বিষকন্যা আদি গল্পের বেতার
নাটক এককালে দস্তুরমতো সাড়া জাগিয়েছিলো, আজও জাগায়।
চিত্রনাট্য লেখা হয় এক বিশেষ ভাষায় এক বিশেষ জগতের লোকদের জন্য। আমরা নাটককে
সাহিত্যের উপাদান ধরলেও চিত্রনাট্যকে এখনও ঠিক সাহিত্যের জগতে আনতে পারিনি। তা
কাট-ডিজল্ভ-ওয়াইপ আদি সঙ্কেতের দুর্বোধ্যতার কারণে হতে পারে, সঞ্চরণশীল ক্যামেরার
দৃষ্টি অনুসরণ করতে হয় বলে 'দৃশ্য' হতে হয় খুব ছোটো, সাধারণ পাঠকের মনঃসংযোগ করা হয়
দুষ্কর। তার ওপর আর্থিক চিন্তা মন্ত্রগুপ্তির একটা কারণ হতে পারে আবার লেখালেখির
জগতে চিত্রনাট্য নতুন আগন্তুক সেটাও কারণ হতে পারে। শরদিন্দু এটা জানতেন, 'উত্তম
মধ্যম' (১৯৭০) বইয়ের ভূমিকায় লিখছেন: "কাহিনী রচনার দুটি প্রধান রীতি ... এক, গল্প,
উপন্যাস; দুই, মঞ্চনাট্য, চিত্রনাট্য। এই দুই রীতির টেক্নীক্ সম্পূর্ণ আলাদা। ...
কিছুদিন আগে আমার ইচ্ছা হয় এই দুই রীতিকে একত্র করে একটা নতুন রচনাশৈলী তৈরী করি
যাতে গল্প-উপন্যাসের স্বাদও থাকবে আবার নাটকের প্রত্যুৎপন্নতাও (immediacy)
অনুপস্থিত থাকবে না।" ১৯৪১ সালে 'পথ বেঁধে দিল' চিত্রনাট্য সাহিতিক বনফুলকে উৎসর্গ
করেছিলেন "এই ক্ষুদ্র নতুন শাখাটি তোমাকে উৎসর্গ করিলাম।" অর্থাৎ অনেকদিন ধরেই
শরদিন্দু সাহিত্যজগতে এই রচনারীতির প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর পরে আর কেউ সে
পতাকা তুলে নিলেন না, কাজেই তাঁর চেষ্টা সফল হয়েছে বলা যায় না। অমনিবাসে সংগৃহীত
শরদিন্দুর রচনাবলীতে চিত্রনাট্য তিনভাবে দেখা দিয়েছে -- উপন্যাস বা গল্প যা পরে
চিত্রনাট্যে রূপায়িত হয়েছে, চিত্রনাট্য যা পরে উপন্যাসে রূপ পেয়েছে, বা নির্ভেজাল
চিত্রনাট্য। এই শেষ গোত্রে পড়ে এমন রচনা হলো: "পথ বেঁধে দিল" (১৯৪১), "অভিসার"
(১৯৪১), "কালিদাস" (১৯৪৩), "বিজয়লক্ষ্মী" (১৯৪৭), "যুগে যুগে" (১৯৪৭), "কানামাছি"
(১৯৫১) অনূদিত "অভিজাতক" ও "শৈল ভবন" (১৯৭০)। চল্লিশের দশকে শরদিন্দু চিত্রনাট্য
লিখে জীবিকানির্বাহ করতেন আমরা আগে লিখেছি, কাজেই সেইসময়ে প্রকাশিত বইয়ের তালিকায়
এদের দেখা পাওয়া খুব আশ্চর্যের নয়। এদের নিয়ে আমরা আর কিছু লিখলাম না, আমাদের সে
দক্ষতাও নেই। চিত্রনাট্যের ভিত্তিতে লেখা উপন্যাস নিয়ে আলোচনার সময় যথাস্থানে এদের
উৎস হিসেবে উল্লেখ করেছি। পরের অংশে আমরা রচনাগুলিকে প্রকাশের কালানুযায়ী সাজিয়েছি।
"দাদার কীর্তি" তাঁর প্রথম পূর্ণাবয়ব গল্প (রচনা ১৯১৫)। যখন সাহিত্যের শিং গজাচ্ছে
তখন অনেক অর্ধসমাপ্ত গল্পে ঢুঁসিয়ে প্রথম এই হাসির উপন্যাস লিখে ফেলেন, 'কাঁচা
লেখা' বলে নিজে কোনো বইতে ছাপেননি। এ হচ্ছে এমন কালের কাহিনী যখন লোকে পঞ্চাশ বছর
বয়সে রিটায়ার করতো, নায়িকার বয়স পনেরো, পুতুল খেলুড়ে সহনায়িকা বারো। তখন যুবকেরা
দুতিনবার বিএ ফেল করে বিয়েপাগলা হয়ে যেতেন। খলনায়ক আছে, এবং অবশ্যই প্রেমের জয়। আজ
সেই উপন্যাস পড়লে আর কিছু না হোক ছাপায় অসম্মত হবার ব্যাপারে শরদিন্দুর বিচক্ষণতার
প্রশংসা করতে হয় কিন্তু প্রকাশকের পাল্লায় পড়ে সে বই ছাপা হয় (১৯৮৭), অন্তত তিনটি
মুদ্রণ, এবং সিনেমা হয়ে অসাধারণ জনপ্রিয়। "জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক"। বিস্ময়ের কথা
এই যে সমালোচনা করতে গিয়ে এ বই সবার ভালো লাগবে বলে দৃঢ়বিশ্বাসে জানিয়েছেন স্বয়ং
সুকুমার সেন।
'বন্ধু' (১৯৩৭) একটি পাঁচ অঙ্কের পূর্ণাঙ্গ নাটক, রঙমহলে মঞ্চস্থ হয় ১৯৩৭ সালে।
মঞ্চসফল করার প্রায় সব উপাদান শরদিন্দু ব্যবহার করেছেন এ নাটকে, কতোটা কার্যকরী
হয়েছে তার হিসেব জানা নেই। দর্শকেরা যাতে প্রতারিত না বোধ করেন সেই কারণেই বোধহয় এক
জোড়া প্রেমকাহিনী, 'রিমঝিম' উপন্যাসের মতো। শরদিন্দুর নিজের বয়ানে: "... কোনও
চরিত্রই সাধারণ বা common type নয়, ... দুএকটি চরিত্র হয়তো সম্ভাব্যতাকেও স্থানে
স্থানে লঙ্ঘন করিয়া গিয়াছে।" তাতে আপত্তি করা যায় না কিন্তু যে কাহিনীর সূত্রে
তাদের গাঁথা হয়েছে সেটি নিরেস। এই মন্তব্যের প্রসঙ্গে তাঁর 'চিড়িয়াখানা' উপন্যাসের
কথা মনে পড়লো, সেখানেও শরদিন্দু সমাজের প্রত্যন্ত প্রদেশের সব খুঁতো চরিত্র জড়ো
করেছেন কিন্তু কাহিনীর বিন্যাস আর লেখার প্রসাদগুণে সে উপন্যাস কালজয়ী।
১৯৩৭ সালেই আর একটি নাটক, এবার তিন অঙ্কের, 'লাল পাঞ্জা'-র প্রকাশ। 'বন্ধু' নাটকের
সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে লেখা বোধ হয় কেন না সেখানকার মতোই জোড়া প্রেম, আদর্শবাদী নায়ক
ইত্যাদি আছে, তার সঙ্গে মুখোসধারী দস্যু, ছদ্মবেশী পুলিস, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ
ইত্যাদি যোগ হয়ে আরো রোমাঞ্চকর হয়েছে। এই ফর্মুলাটি শরদিন্দুর পছন্দ ছিলো মনে হয়
কেননা পনেরো বছর পরে 'কানামাছি' চিত্রনাট্যে আবার এসব উপাদানের ব্যবহার দেখা গেছে,
মুখোসটা সেখানে বাদ পড়েছিলো। এসব দর্শকের পছন্দের কারণেও হতে পারে, তৃপ্ত দর্শক
মানেই দাতা দর্শক আর মঞ্চসাফল্যই তো নাটক লেখার মূল উদ্দেশ্য। 'ডিটেকটিভ' (১৯৩৭),
দশ দৃশ্যে সম্পূর্ণ এক কৌতুক-নাটিকা রঙমহলে অভিনীত হবার পর "পাঠনীয়তাকেই প্রাধান্য"
দিয়ে শরদিন্দু এক নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেন। রেকর্ডেও এর ভিত্তিতে একটি পালা
হয়েছিলো। দুজন সহনায়িকার মধ্যে নায়ক কার প্রতি আকৃষ্ট হবেন তা এই নাটকের রহস্য।
একটি তোতলা ও সব কথায় "বোঁ বোঁ শব্দে" বলার মুদ্রাদোষ আছে এমন দুটি চরিত্রের মারফৎ
এসেছে কৌতুক। আর বেশী বলা নিষ্প্রয়োজন।
'বিষের ধোঁয়া' (১৯৩৮) শরদিন্দুর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস, "এই উপন্যাসটির চিত্ররূপ
'ভাবী' লেখককে সিনেমা জগতে প্রতিষ্ঠিত করে" -- অমনিবাসের (৮) গ্রন্থপরিচয়ে লিখছেন
শোভন বসু। বাংলাতেও বইটির চিত্ররূপ দেওয়া হয়েছিলো, হিন্দি সংস্করণের অনেক বছর পরে।
স্বাস্থ্যবান তরুণ কিশোর তার বিশেষ বন্ধুর মৃত্যুতে অনাথা বিধবা বিমলার ভার নিতে
বাধ্য হয়, তাকে নিয়ে কোলকাতায় ভাড়া বাড়ীতে চলে আসে। দুজনেরই পূর্ণযৌবন, বিমলা
অপূর্ব সুন্দরী, অনেক কিছু ঘটতে পারতো, কিন্তু যে সব পাঠক সমাজব্যবস্থার তীক্ষ্ণ
বিশ্লেষণ আশা করে বই পড়তে আরম্ভ করেছিলেন তাঁদের আশা ধূলিসাৎ করে শেষপর্যন্ত কিছুই
হলো না। কিশোর আর বিমলা বিনাবাক্যব্যয়ে সঙ্গে সঙ্গে অপাপবিদ্ধ দেওর-বৌদির সম্পর্ক
গড়ে তুললো, সারা উপন্যাসে তার ব্যত্যয় দেখা গেলো না। কিশোরের বাবা কিশোরকে
ত্যাজ্যপুত্র করে একটু গণ্ডগোল বাধিয়েছিলেন কিন্তু কিশোরের কাছে তা খুব পাত্তা পেলো
না। আর কিশোরের প্রতিদ্বন্দ্বী পাণিপ্রার্থী খলনায়ক দুয়েকবার কিশোরের বিবাহ ভঙ্গ
করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তারপর সিনেমায় যেমনটি চাই তেমন চিরন্তন প্রেমকাহিনী।
উপন্যাসের আকর্ষণ বাড়াবার জন্য কিশোরের দুই অনুরাগিণী, তাদের একজন অন্যজনকে চুমা
খেতে চায়। আবার পক্ষপাতদোষ যাতে না হয় সে সম্বন্ধে সতর্ক কিশোরকে দেখা গেলো দুজনকেই
কোনো না কোনো সময়ে বুক দিয়ে বিপদ থেকে রক্ষা করতে। এসব ব্যাপার তখনকার সমাজের নজরে
পড়ার কথা, পড়েছিলো কিনা তা এখন আর জানবার উপায় নেই। এ কাহিনী বিধবাবিবাহ নিয়েও হতে
পারতো, তাতে বিদ্যাসাগর মশায়ের আত্মা শান্তি পেতো হয়তো কিন্তু সফল সিনেমা বোধহয় হতো
না।
তাঁর মৌলিক রচনা না হলেও যে উপন্যাসটি আর কারো কলম থেকে বার হতে পারতো না সেটি হলো
'ঝিন্দের বন্দী' (১৯৩৮)। অ্যান্টনি হোপের লেখা 'দি প্রিজনার অফ জেণ্ডা' (১৮৯৪) এক
অসাধারণ জনপ্রিয় রোমাঞ্চকর রচনা, বহু প্রচারিত, অনূদিত আর নাটকের উপাদান হিসেবে
ব্যবহৃত। শরদিন্দু এটির অনুবাদ করেছেন বললে ঠিক বলা হলেও কম বলা হয়, বলতে হয় যে
এটিকে এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে ভারতবর্ষের পটভূমিকায় এনে ভারতীয় তথা বাঙালী চরিত্রের
বাংলা সংলাপের সাজে দাঁড় করিয়েছেন যে আমরা মুগ্ধ তো বটেই, এ যে বিদেশী তা
ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করি না। এই রচনায় ঘটনা আর চরিত্র জোগাড় করার দায় শরদিন্দুর নয়,
তাঁর ভূমিকা কৌশলে তাদের সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন করবার। ভালো মালমশলা পেলে যেমন
কুশলী রন্ধনশিল্পী অমৃত ভোজ্য সাজিয়ে দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনই, আর যাঁরা ভোজনরসিক
তাঁরাও ঠিক বুঝে যান যে এর মূলে আছে রাঁধুনীর হাতযশ। এ বই প্রকাশের পর অবশ্যই
প্রশংসার ঢেউ ওঠে এবং যথারীতি কিছু সমালোচকের গাত্রজ্বালা ধরায়। তার উত্তরে ভূমিকায়
শরদিন্দু লিখেছেন: " ... পরদ্রব্য সম্পর্কে আমার সততায় সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছিলেন।
... সর্বপরিচিত শ্বেতাঙ্গ শিশুকে নিজের সন্তান বলিয়া চালাইবার দুরভিসন্ধি আমার
নাই।" আরো বলেছিলেন: "... প্রবীণ পাঠকগণ হয়ত এ গল্পে ছেলেমানুষীর স্বাদ পাইয়া
বিরক্ত ও নিরাশ হইবেন। বঙ্গসাহিত্যের দুর্ভাগ্য যে শরদিন্দু "প্রবীণ পাঠকদের..
বিরক্ত ও নিরাশ" করার পথে আর পা দেননি।
১৯৪৮-৪৯ সালে শরদিন্দু মুম্বই চিত্রজগতের কিছু ঘটনা আর চরিত্রের সমাহারে এক গুচ্ছ
গল্প লেখেন যা নানান মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর সব জোড়া দিয়ে 'ছায়াপথিক'
(১৯৪৯) নামে এক উপন্যাস হয়ে ছাপা হয়। প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ
সেখানে কাটিয়েছেন কাজেই সেখানকার চরিত্র আর তাদের কীর্তিকলাপ শরদিন্দুর ভালোই জানা।
রচনাটিতে আত্মজীবনীর ছোঁয়া আছে, সেখানে সাহিত্যিক ইন্দু রায় বলে যে বাঙালী চরিত্র
দেখা পাওয়া গেছে তার মূল শরদিন্দু নিজে। এ এক অদ্ভুত জগৎ, সেখানে সাধারণ মানুষের
বিশেষ যাতায়াত নেই, আমরা যা দেখি তার বেশীর ভাগই পত্রপত্রিকার অপপ্রচারের মাধ্যমে।
বাইরের জগতের মতোই সেখানেও ওই ষড়রিপুর খেলা তবে তার রীতি আর প্রকাশ ভিন্নতর, পড়ে
মজা পাওয়া যায়। সাধারণ ঘরের একজন যুবক সেখানে এসে নানা ঘটনাচক্রের মধ্যে দিয়ে কী
ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলো তারই কাহিনী, শরদিন্দুর হাতে ঘটনা আর চরিত্রগুলো
বাস্তবানুগ। নায়িকা আছেন, বহু ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যাবার পর তাঁর সঙ্গে নায়কের
মিলনও আছে, তবে তার সঙ্গে মুম্বই কেন, কোনো চিত্রজগতের কোনো সম্পর্ক নেই। সামাজিক
সমস্যা আছে, যদি তরুণ-তরুণী অবস্থাগুণে বা বৈগুণ্যে একসঙ্গে রাত কাটাতে বাধ্য হন
তাহলে তার পরিণাম কী হতে পারে? দুটি পরিস্থিতিতে প্রশ্নটি তোলা হয়েছে-- একবার প্রেম
ব্যক্ত আর একবার প্রেম গুপ্ত। পঞ্চাশের দশকে ভারতবর্ষে এ প্রশ্ন ছিলো নিঃসন্দেহে
জ্বলন্ত। স্বাধীনতার প্রায় সত্তর বছর পরেও এ প্রশ্ন উঠতে পারে না তা নয় তবে আঁচটা
অনেক কমে এসেছে বলে মনে হয়। মুখবন্ধে শরদিন্দু লিখেছেন " ... ক্ষণিকের গান গাহিয়া
যবনিকার অন্তরালে অদৃশ্য হওয়াই এদের ভূমিকা", তবে আর কিছু না হোক এই উপন্যাস পড়ে
শরদিন্দুর জীবন নিয়ে কয়েকটা কৌতূহলের অবসান হলো-- যথা, শরদিন্দু কেন ইংরেজী
চিত্রনাট্য লিখতেন বা শরদিন্দু মুম্বাই চিত্রজগৎ ছেড়ে চলে গেলেন কেন, ইত্যাদি।
'রাজদ্রোহী' (১৯৬১) লেখা হয়েছিলো চিত্রনাট্য হিসেবে, তখন নাম ছিলো 'যুগে যুগে'
(১৯৪৭)। উনিশ শতকের শেষ দিকে পশ্চিম ভারতের কাথিয়াবাড় অঞ্চলে কিছু রবিনহুড ধরণের
পরোপকারী দস্যুর আবির্ভাব হতো, কথ্য ভাষায় তাদের 'বার্বটিয়া' বলা হতো। তেমন একজনকে
ঘিরে এই ঐতিহাসিক উপন্যাস, সত্যিকার মানুষ মনে হয় না। যাঁদের তৎকালীন হিন্দি ছবির
সঙ্গে পরিচয় আছে তাঁরা এই উপন্যাসের এক পৃষ্ঠা পড়ে তার পরের পাতায় কী আছে তা বলে
দিতে পারবেন, এমনই ছকে-ফেলা গল্প এটি। সিনেমায় দেখলে হয়তো ভালো লাগতো, রূপান্তরিত
উপন্যাস হিসেবে শরদিন্দুর প্রথম শ্রেণীর অন্যান্য ঐতিহাসিক উপন্যাসের কাছে দাঁড়াতে
পারে না। সেই কারণেই বোধহয় শরদিন্দুর সাহিত্যকীর্তির তালিকায় এ উপন্যাসের উল্লেখ
মেলে না।
নিজের লেখা এক ইংরেজী চিত্রনাট্যের অনুবাদ 'কানামাছি' চিত্রনাট্য (১৯৫২) হয়েই
প্রকাশ পায়, তাকেই আবার উপন্যাসের রূপ দিয়েছেন 'মনচোরা' (১৯৬৩) বইটিতে। ভাগ্যচক্রে
চৌর্যবৃত্তি গ্রহণ করার পর নায়ক এক বড়লোকের বাড়ীতে চুরি করতে এসে প্রেমচক্রে ফেঁসে
গেলেন। যে রত্ন চুরি করতে এসেছিলেন তার বদলে রঘুবংশম্-পাঠিকা রাজকন্যার মন চুরি
করে সে বাড়ীতেই মোটামুটি স্থিতু হচ্ছিলেন। কিন্তু নিয়তি অতো চট করে ক্ষান্ত দেবার
পাত্র নয়, দুর্বল চরিত্রের এক মূর্খ, কুহকিনী এক রমণী, মারকুটে এক গুণ্ডা, সবাই এসে
নানা গণ্ডগোল পাকাতে লেগে গেলো। শেষ পর্যন্ত পরের দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে বিরাট
আত্মত্যাগের নিদর্শন রেখে নায়ক কারাবরণ করলেন। তবে মাত্র তিন বছরের জন্য যাতে
মুক্তির পরেও রাজকন্যার যৌবনের কিছু অবশিষ্ট থাকে। পঞ্চাশের দশকের দুয়েকটি অতি সফল
হিন্দি ছবি মনে পড়া উচিত। কেবল প্রশ্ন থেকে যায় যে অমন করিৎকর্মা চোর অতো
দুর্গন্ধময় জুতো পরতেন কেন? 'কানামাছি' নাটকের ভূমিকায় শরদিন্দু লিখেছিলেন: "...
একটি পুরাতন নীতিবাক্যকে নূতনের আলোকে পরীক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছি।" শরদিন্দু
জানতেন যে এ পরীক্ষার ফল সবায়ের মনোমতো নাও হতে পারে কিন্তু এধরণের পরীক্ষার
প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অবশ্যই, এতো নাট্যকার এবং ঔপন্যাসিকের হকদারীর কথা।
'রিমঝিম' (১৯৬১) উপন্যাসে নায়িকা আর সহনায়িকা, দুজনেই নার্স আর দুজনেই পরকীয় করে
যাচ্ছেন। সে সময়ের বাংলা সাহিত্য দেখলে একে খুব বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলা যাবে কি?
কাহিনীটি নায়িকার ডায়েরীর ধরণে লেখা, আঙ্গিক নতুন ও গল্প মনোহর বলে সমালোচকদের
স্বীকৃতি পেয়েছে। বিবাদী দুই চরিত্র, অর্থাৎ দুই স্ত্রী লেখকের মর্জিমাফিক একজন
সন্দেহবাতিকগ্রস্ত খাণ্ডারনী, আর একজন চরিত্রহীনা। দুজনেই লক্ষ্মী মেয়ের মতো
ভবিতব্যের হাত ধরে ঠিক সময়মতো বিদায় নিয়েছেন, খল নায়কও আছেন, তিনি এসে একটু ঘোঁট
পাকিয়ে আসল নায়কের তাড়া খেয়ে ভেগেছেন। সিনেমা হয়েছে কিনা জানা যাচ্ছে না তবে এই
উপন্যাস যে একেবারে বক্স অফিসের চাহিদার মাপে তৈরী সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন
না।
প্রথম যুগের লেখা অতি-জনপ্রিয় ছোটো গল্প 'বিষকন্যা'-র ঘটনা আর কুশীলব বাড়িয়ে
উপন্যাসের রূপ দিয়েছিলেন 'বহু যুগের ওপার হতে' (১৯৬০) বইতে। সরাসরি সংলাপ না
থাকলেও, ছোটো ছোটো দৃশ্যের আঙ্গিকে লেখাটি দেখলে চিত্রনাট্য বা অন্তত রঙ্গমঞ্চের
উদ্দেশ্যে রচনার কথা মনে আসতে বাধ্য। এছাড়া শরদিন্দুর দুটি ইংরেজী চিত্রনাট্য অন্য
লোকে অনুবাদ করে। তার একটি শরদিন্দু পরিমার্জনা করেছিলেন, মাসিক পত্রে অপরটির
প্রকাশও তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত আগে, কাজেই দেখে গিয়েছিলেন। 'অভিজাতক' ও 'শৈল ভবন',
এই দুটি অনুবাদ একত্রে বই করে 'শৈল ভবন' নাম দিয়ে ছাপা হয় (১৯৭০)। এ সম্পর্কে এর
বেশী বলার প্রয়োজন দেখি না।
শরদিন্দুর সব সামাজিক (ও রহস্য) কাহিনী পড়লে তাঁর কালের বাঙালী মধ্যবিত্ত জীবনের
একটা ছবি পাওয়া যায়। বাইরের পৃথিবীতে রাজনীতিক উত্থানপতনের কথা -- যথা দুটো
মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, দুর্ভিক্ষ, প্রযুক্তির অভিঘাত -- তিনি খুব বেশী বা
খোলসা করে লেখেননি, গল্পের সূত্র রাখার জন্য যেটুকু বলতে হয় তার বেশী কিছু নয়। এমন
যে হবে তা আমরা বুঝতে পারি যখন দেখি তিনি লিখেছেন, "Digression অতিশয় বিপজ্জনক। ...
সাময়িক রচনা (topical) পুস্তকাকারে বাহির করিবে না।" কাজেই তাঁর গল্প থেকে
সমাজব্যবস্থার বিবর্তন নিয়ে তেমন কিছু সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু সেকালের পুরুষ
আর নারী তাঁর প্রায় সব গল্পেই উপস্থিত, কাজেই তাদের চলনবলন, রীতিনীতি নিয়ে কিছু
পরিষ্কার ধারণা করা যায়। আমাদের নজর যা কেড়েছে তা হলো সেকালের মানুষদের জীবন শুরু
হয়ে যেতো তাড়াতাড়ি, আজকের তুলনায় তারা বাঁচতোও কম দিন। ধাক্কাটা পড়তো মেয়েদের ওপরেই
বেশী কেননা তাদের তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে, কোর্টশিপ সাঙ্গ করে, বিয়ে করে সংসারের ভার
নেবার জন্য তৈরী হতে হতো। মনে হচ্ছে পঞ্চদশী, খুব বেশী হলে ষোড়শী হওয়া অবধি অপেক্ষা
করা যেতো নাহলে কী হতে পারে তা শরদিন্দুর "মেথুশীলা" গল্পে মেজবৌদি বলে দিচ্ছেন,
"যে মেয়ে ষোলো-সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত আইবুড়ো থেকে বাপের বাড়িতে কাটিয়েছে সে ভেতরে
ভেতরে পেকে ঝিঁকুট হয়ে গেছে। ... এরকম মেয়েকে বিয়ে করে কেউ সুখশান্তি পায়নি।"
শরদিন্দুর প্রথম উপন্যাস "দাদার কীর্তি"তে নায়িকার বয়েস পনেরো, বাগ্দত্তা
সহনায়িকার বারো বছর। বিশ-একুশে যৌবনের মধ্যাহ্ন, ত্রিশে বিগতযৌবনা। তবে শরদিন্দু
শাস্ত্র মানতেন বোধহয়, "স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি", অতএব তাঁর গল্পে ঝড়োয়ার রানী
("ঝিন্দের বন্দী") থেকে শুরু করে "ছোটো ঘরের মেয়ে" মেদিনী ("বেণীসংহার"), সমাজের সব
স্তর থেকে মেয়েরা এসে নায়কদের, আর শরদিন্দুর প্রসাদগুণে আমাদেরও চোখ ধাঁধিয়ে গেছেন।
মেদিনীর জন্য তো দুদুটো খুনই হয়ে গেলো। মেয়েদের চারুশীলা হওয়াটা ছিলো অত্যন্ত
দরকারী, নাহলে গল্পের সমাজ পতিতা করে দিতে পারতো আর দিতো। পুরুষেরা বিএ ফেল করে
বিয়ে করতে যেতো, পঞ্চাশ-পঞ্চান্নতে রিটায়ার করার চল ছিলো। প্রেমপাত্রীকে পাবার জন্য
তারা চাকরবৃত্তি গ্রহণ বা অমনতরো উদ্ভট কিছু করতে দ্বিধা করতো না। একটা মজার কথা
আমরা লক্ষ্য করেছি যে শরদিন্দুর গল্পসমগ্রে "খাণ্ডারনী"-রা দেখা দিয়েছেন বহুবার, তা
সে কৌতুকের কারণেই হোক বা গল্পের মোড় ঘোরানোর কারণেই হোক। উদাহরণ অসংখ্য, এই
প্রবন্ধে জায়গা কুলোবে না তবে পাঠক "অগ্নিবাণ" আর "ভাগ্যবন্ত" গল্প এবং "রিমঝিম"
উপন্যাসের কথা স্মরণ করতে পারেন। "খাণ্ডারনী"-রা প্রথমটি তে খুন, দ্বিতীয়টিতে
সংসারত্যাগ আর তৃতীয়টিতে স্বামীকে পরকীয়া প্রেম করার সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে এ
পরিসংখ্যানটা শরদিন্দুর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ফল বলে মনে হয়, সত্যিই সেকালে
একালের থেকে বেশী খাণ্ডারনী জন্মাতেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে হতেও পারে,
ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন এ নিয়ে কী বলে?
কবিতা
শরদিন্দু কবিতাও লিখেছেন, প্রকাশ কিছু নিজের নামে আর কিছু 'চন্দ্রহাস' ছদ্মনামে। সব
মিলিয়ে সত্তর-পঁচাত্তরটি কবিতা হবে, দুটি বইতে-- 'যৌবনস্মৃতি' (১৯২০) আর 'তনুমন'
(১৯৬২)-- সেগুলি গ্রথিত। এছাড়া তাঁর অনেক নাটকেই গান আছে এবং তা তাঁরই লেখা, আর
পদাবলী ধাঁচে লেখা 'রাধাকৃষ্ণ পালা' (১৯৭৬) আর রেকর্ডের পালা 'উমার তপস্যা'ও (১৯৩৭)
ছন্দমিলবদ্ধ। বৈষ্ণব কবিদের মতো ব্রজবুলিতে লেখা পদ তাঁর পছন্দ ছিলো, তাঁর
কবিতাগুচ্ছে তার কিছু দেখা যায়, 'ভানুসিংহের পদাবলী'র কথা মনে আসতে পারে। এ ছাড়া যে
সামান্য কটি কবিতা বাকী থাকে তা করুণানিধান-কুমুদরঞ্জন-কালিদাস রায়ের লেখনশৈলীর
অনুগামী, রবীন্দ্রঅনুরাগী, দুয়েকটাতে নজরুলের ছোঁয়া আছে। 'যৌবনস্মৃতি' তাঁর প্রথম
ছাপা বই, তার ভূমিকায় কবি স্বয়ং লিখছেন: "ইহাতে অসাধারণত্ব কিছুই নাই। ... এগুলি
প্রকাশে কোন দোষ নাই।" যথার্থ কথা আর গভীর চিন্তার খোরাক না থাকলেও শরদিন্দুর
প্রসাদগুণে ভাষা-ছন্দ-মিল-চিত্রকল্প-কৌতুক, সব মিলিয়ে খারাপ নয়। রবীন্দ্রনাথের
বিখ্যাত কবিতা 'ঊর্বশী'-র অনুকরণে লিখেছিলেন 'শালী', তার প্রথম স্তবকটি তুলে দেবার
লোভ সামলানো গেলো না:
নহ মাতা নহ পিসী নহ শিশু নহ নাবালিকা হে অনন্তযৌবনা শ্যালিকা।
ওষ্ঠে যবে আলতা দিয়া
ভালে পর খয়েরের টীপ্
চাহিয়া তোমার পানে বুক মোর করে ঢিপ্ ঢিপ্
মনে হয়, কেন আমি
হলাম না দিল্লী-বাদশাহ,
অথবা কুলীনপুত্র -- গুষ্টিসুদ্ধ করিয়া বিবাহ
জীবন নির্বাহ
করিতাম মহানন্দে কুসুমে কুসুমে
পরিমল চুমে।
কিশোর- পাঠ্য
শরদিন্দু কিশোর-কিশোরীদের জন্যও কথা-কাহিনী লিখেছেন তবে সংখ্যায় খুবই কম, মাত্র
আটাশটি। প্রথম গল্প ১৯৩২ সালে লেখার থেকেই তিনি তখনকার রীতিমাফিক সাধুভাষা ব্যবহার
না করে লিখেছেন সহজবোধ্য কথ্য ভাষায়, আর তার ফল অপূর্ব। গল্প আছে সবরকমের, সে
রূপকথা আর পরীদের গল্প থেকে আরম্ভ করে, ভৌতিক, জন্তুজানোয়ার নিয়ে গল্প, ডাকাবুকো বা
ডানপিটে ছেলেদের মজার কথা, আর ঐতিহাসিক কাহিনী অবধি -- শরদিন্দুর বড়োদের গল্পে যেমন
দেখা যায় তেমন সব। ভূতের গল্পগুলোয় ভয়ানক থেকে বীভৎস রস বেশী বলে আমাদের মনে হয়।
সূক্ষ্ম কথার চাইতে বিকট ছবি কিশোরমনে নিশ্চিত দাগ ফেলতে পারে, সেই কারণে বোধহয়।
সুকুমার রায়ের পাগলা দাশুর আদর্শে গোটা দুই গল্প আছে তবে দাশু হলো প্রবাদপ্রতিম,
তার ধারে কাছে পৌঁছোবার চেষ্টা না করাই ভালো। বাকী সবই যেমন হতে হয়, শরদিন্দুর
প্রসাদগুণে পড়ে ফেলে যায়, তবে ওই পর্যন্তই। ব্যতিক্রম হলো তাঁর 'সদাশিব' সিরিজের
পাঁচটি গল্প, বারবার পড়ার মতো। সদাশিব এক মারাঠি যুবক, সে শিবাজীর দলে যোগ দেয় আর
এই পাঁচটি গল্প সেই দলের, বিশেষ করে সদাশিবের নানা মজার আর রোমহর্ষক কীর্তিকাহিনী।
প্রথম জীবনে শিবাজী বিজাপুরী সুলতান আর ধনীদের অবিচারের থেকে গরীব মারাঠিদের
রক্ষাকর্তার ভূমিকা নিয়েছিলেন, অনেকটা রবিনহুডের মতো। সদাশিবের কাহিনী সেই সময়
ঘিরে, এতে চিত্তাকর্ষক ঘটনা তো বটেই, শিবাজীর প্রতিভা বিকাশেরও একটা সুন্দর ছবি
দেখা গেছে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে শরদিন্দু সিদ্ধহস্ত, এই রচনাগুলোও তাঁর খ্যাতির
মাপসই। রাজশেখর বসুর অনুরোধে তিনি এই সিরিজ লিখতে শুরু করেন, তাঁর ইচ্ছে ছিলো আরো
কিছু কাহিনী যোগ করার, তা করে উঠতে পারেননি। ক্ষতি আমাদের কিশোরদেরই।
আলোচনা
শরদিন্দুর প্রথম কবিতার বইয়ের প্রকাশ ১৯১৮, প্রথম গদ্য ১৯২৯ সালে। ততোদিনে "সবুজ
পত্র" এবং তার মারফৎ বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে প্রমথ চৌধুরীর "বীরবলীয়" গদ্যের পরিচয়
হয়ে গেছে, চলিত ভাষায় লেখার আন্দোলন উঠেছে বেশ প্রবল হয়ে। সব সাহিত্যিক তাতে তখন
যোগ দেননি, শরদিন্দু তাঁদের দলে। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাঁরা তাঁদের গদ্যপদ্য
দুইই হতো সাধুভাষায়, যাঁরা মধ্যপন্থী তাঁরা সংলাপ লিখতেন চলিত ভাষায়, কিন্তু রচনার
মূল অবয়ব থাকতো সাধুভাষা। এর একটা মজা ছিলো যে কোনো গল্প যদি একজন বিশেষ বক্তার
উদ্ধৃতি হিসেবে লেখা হতো তাহলে তার প্রায় পুরোটাই চলিতভাষায় লেখা যেতো। অনেকে এই
কৌশল ব্যবহার করেছেন, রাজশেখর বসুর ('পরশুরাম') কথা মনে আসছে, বিশেষত তাঁর কেদার
চাটুজ্যের কাহিনীগুলোতে। প্রবন্ধে সংলাপের বালাই নেই, কাজেই তা পুরোপুরি সাধুভাষায়।
সেই আন্দোলনের বিবর্তন আর পরিণতির কাহিনী চিত্তাকর্ষক কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয়
নয়, তবে এটা লক্ষ্য করবার মতো যে শরদিন্দুর গল্পে পুরোপুরি চলিতভাষা পাবার জন্য
আমাদের ১৯৬২ সালের "চলচ্চিত্র প্রবেশিকা" গল্প অবধি অপেক্ষা করতে হয়েছে। একবার
আরম্ভ করে অবশ্য শরদিন্দু আর সাধুভাষায় ফিরে যাননি, যদিও আরো আট বছর তাঁর কলম
চলেছে। জানতে ইচ্ছে করে যে এতোদিন সাধুভাষার পন্থায় চলার পর কী কারণে হঠাৎ তিনি মত
আর শৈলী পরিবর্তন করলেন, তাও আবার ছোটোখাটো একটা গল্পকে উপলক্ষ্য করে। আমরা আগেই
বলেছি যে তাঁর কিশোর সাহিত্যসমগ্র দেখলে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত প্রথম অবদান "মোক্তার
ভূত" গল্প থেকে শুরু করে ১৯৬৯ সালের শেষ গল্প পর্যন্ত শরদিন্দু বরাবর একেবারে
তরতাজা চলিত ভাষা ব্যবহার করে এসেছেন।
অবশ্য কেন সাধু, কেন চলিত, এ তর্ক একেবারে নিষ্প্রয়োজন কেননা যে অপ্রত্যক্ষ
উপাদানের ছোঁয়া থাকলে যে কোনো রচনা পড়লেই খুসী লাগে, অলঙ্কারশাস্ত্রে যাকে বলে
প্রসাদগুণ শরদিন্দুর লেখা সেই গুণে নিষিক্ত -- ঝরঝরে, স্বচ্ছ, বলিষ্ঠ, বহমান
লেখনরীতি। তাঁর সমকালীন লেখকদের অনেকেরই লেখায় এই গুণ ছিলো কিন্তু শরদিন্দুর
ক্ষেত্রে যেমন বহুবিস্তৃত তেমন নয়। তার কারণ শরদিন্দুর রচনা অনেক জাঁরে ছড়ানো, আর
তিনি সাধুভাষায় লিখলেও গল্পের রস বুঝে তিনি ভাষার লঘুত্ব-গুরুত্ব এমন মুন্সিয়ানার
সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতেন যে তার থেকে বেশী মাপসই অন্য কিছু চিন্তাই করা যেতো না।
এছাড়া অসাধারণ শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস, উপমার ব্যবহার, এসব তো আছেই। এমন যাদুকর
ভাষারীতির একটা মুস্কিল আছে, তা হলো মোড়কের মোহে পড়ে মোড়কের ভেতরের আসল জিনিসটা
পাঠকের নজর এড়িয়ে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথে এই যাদু ছিলো। শরদিন্দুর ক্ষেত্রেও তাই,
তিনি তা নিয়ে অবহিত ছিলেন, তিনি লিখছেন, "আমি যত্ন করিয়া লিখি, লেখাকে চিত্তাকর্ষক
করিবার চেষ্টা করি। তাই প্রথম পাঠে বোধহয় লেখার চাকচিক্যটাই চোখে পড়ে, চাকচিক্য
ছাড়া তাহাতে যে আর কিছু আছে তাহা কেউ লক্ষ্য করেন না।" তাঁর যে কোনো রচনা
সামগ্রিকভাবে দেখলে এই যত্নের ছাপ অতি পরিষ্কার, কিন্তু প্রতিটি শব্দ তা যতোই সাধু
আর যতোই আপাতদুরূহ হোক না কেন, এতো স্বচ্ছন্দে প্রসঙ্গের সঙ্গে মিশে থাকে যে তার
চয়ন আর প্রয়োগের পিছনকার একাগ্র সাধনা আর অসাধারণ কৌশলের কথা মনেই হয় না। মোড়কের
চাকচিক্য অবশ্য কাহিনী সরেস না নিরেস তা বিচার করে না, দুটোকেই সমান আচ্ছাদন করে
রাখে, বুদ্ধিমান পাঠকের এ তথ্যটা জানা আছে।
১৯৩৩ সালে সাহিত্যজীবনের শুরুতে লেখা এক ডায়েরীতে শরদিন্দু, রচনার ভাষা আর শৈলী
নিয়ে কিছু নির্দেশ লিখে রেখেছিলেন, বোধহয় নিজের অবধানের জন্য। আর ১৯৭০ সালে জীবনের
শেষ কালে নিজের রচনা নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। সুখের কথা অমনিবাস-২ গ্রন্থপরিচয়ে
তার কিছু কিছু উদ্ধৃত করা হয়েছে। প্রথম জীবনের সে নির্দেশ তিনি আজীবন একনিষ্ঠভাবে
মেনে গেছেন, এ তাঁর রচনাবলী পড়লেই বোঝা যায়। সে সব উদ্ধৃতির সটিক সারাংশের ওপর
ভিত্তি করে নীচে তাঁর রচনারীতি নিয়ে আলোচনা করা হলো, বোদ্ধা পাঠকেরা পড়ে শরদিন্দুর
মন্তব্যের যাথার্থ্য আর রচনায় তাদের প্রয়োগ আবিষ্কার করে আনন্দ পাবেন।
আমরা যত্ন আর শব্দচয়ন নিয়ে যা আগে বলেছি, ডায়েরীতেই তার শুরু, যেখানে তিনি
প্রয়োজনের বেশী কোনো শব্দ ব্যবহার নিয়ে সতর্ক করেছেন আর বলেছেন "অখণ্ড মনোযোগ না
দিলে লেখা ভালো হয় না।" তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প "চুয়াচন্দন" এই যত্নের উৎকৃষ্ট
উদাহরণ। সে গল্পটি তিনি ছবার লিখেছিলেন। রচনার অবয়ব নিয়ে তিনি সচেতন থাকতেন। অকারণ
শব্দব্যবহারের নিষেধ ছাড়া তিনি সতর্ক করেছেন digression নিয়ে, বলেছেন দরকার পড়লে
রচনা যতোদূর সংক্ষেপ করা যায় তা করতে। প্রকৃতির বর্ণনায় দশ লাইনের বেশী ব্যয় করাতে
তাঁর আপত্তি, এবং তাঁর সতর্ক চোখ এড়িয়ে তার ব্যত্যয় দেখা যায় না। কিন্তু তাঁর রচনার
অনেক জায়গায়, বিশেষ করে ঐতিহাসিক কাহিনীতে, প্রকৃতি এবং মানুষের অনবদ্য বর্ণনা পড়ে
আমাদের আশ মেটে না, তাঁর কলমের জাদুতে সেই কাল, সেই মানুষ, সেই পরিবেশ আমাদের কাছে
এমনই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে যে আমাদের চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় থামবেন না, আমাদের তৃষ্ণা
এখনো মেটেনি। ঐতিহাসিক কাহিনীর কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে তাঁর বিশ্বাস যে "ভাষার
মধ্যেই বাতাবরণ সৃষ্টি করা যায় ... ঐতিহাসিক গল্পের ভাষাও হবে যুগোপযোগী।" এ
ব্যাপারে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে গুরু মেনেছেন (একসময় লিখেছিলেন "[বঙ্কিম] ভিন্ন
বাংলায় অন্য আদর্শ নাই"), এবং আমাদের বিশ্বাস গুরু বেঁচে থাকলে সার্থক শিষ্যকে
সাদরে বরণ করে নিতেন।
কিন্তু এহ বাহ্য, বহমান কথনের মধ্যে শরদিন্দুর গাঁথা শব্দগুচ্ছ "হঠাৎ-আলোর-ঝলকানি"
দিয়ে আমাদের চকিত, বিস্মিত আর মুগ্ধ করে দিয়ে যায়, আমরা তা ভুলি কী করে। সাধারণ
গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে পড়তে হঠাৎ দেখি তাঁর এক চরিত্র "সংযতবাক ও সংবৃতমন্ত্র" -- আর
কিছু বলার কি আর প্রয়োজন রইলো? আর এ চমক শুধু যে চরিত্রচিত্রণে আছে তা নয়, এ আছে
কৌতুকে, এ আছে ব্যঙ্গে, এ আছে মিষ্টি প্রেমের কথায়-- এ খাঁটি শরদিন্দু, ভিন্টেজ
শরদিন্দু। "... তিন্টে-পাঁচটা চুমু খাচ্ছেন" ("ভল্লু সর্দার"), চুমু খেতে হলে
এইরকমই খেতে হয় সেটা ছবছর বয়সের ভল্লু সর্দার কী করে জানলো আমরা জানি না কিন্তু
আমাদের যে জানিয়ে গেলো তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। বাঙালীর এক পরম শুভ মাঙ্গলিক যে
আমাদের বিহারী প্রতিবেশীর কাছে " ... [দাদাবাবুকে] 'উল্লু উল্লু' বলিয়া গালি
দিতেছে" মনে হতে পারে এটা কি আমরা ভেবেছিলাম ("ভেন্ডেটা")? রাঢ়ী রাজকুমারী
তন্দ্রার "সুখাবিষ্ট কণ্ঠে ... 'পারমু' " ("তন্দ্রাহরণ") শোনার জন্য কোন বঙ্গসন্তান
তার বংশপরিচয় বিসর্জন দিতে নারাজ হবে?
রচনার style নিয়ে ডায়েরীতে তাঁর নির্দেশ: "style দেখাইবার চেষ্টা করিবে না।" তাঁর
মতে বিষয়বস্তুর তাগিদেই লেখার মধ্যে হাস্য, করুণ বা অন্য ধরণের ঠিক রস ফুটে উঠবে,
তার জন্য জোর করে রসসৃষ্টির চেষ্টা করা তাঁর পছন্দ নয়। তাঁর নাটক, চিত্রনাট্য আর
মঞ্চস্থ করার তাগিদে লেখা উপন্যাস যদি না থাকতো তাহলে তাঁর লেখা যে এই দিক দিয়ে
সার্থক তা বলা যেতো -- বিশেষত রহস্য, কৌতুক, ঐতিহাসিক আর অলৌকিক কাহিনীর বেলায়।
ডায়েরীতে তিনি এও লিখেছেন যে "লিখিবার সময় পাঠক খুসী হইবে কিনা একথা ভাবিবে না।"
তবে মঞ্চ-ঘেঁষা লেখায় পাঠক না হোক, দর্শকের মনোরঞ্জন করা অতি প্রয়োজনীয় অন্তত
যতোদিন মঞ্চ বা রূপালী পর্দা সেই দর্শকদের দাক্ষিণ্যপুষ্ট, কাজেই শরদিন্দু যে
সেক্ষেত্রে তাঁর নিজের নির্দেশ মানতে পারলেন না তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। যেখানে তা
মানতে পারলেন সেখানে তিনি সম্রাট। সেখানে তিনি "নিজের যাহা ভাল বোধ হয় তাহাই"
লিখেছেন, "মনের ভাবটিকে শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি দেবার চেষ্টা" করেছেন, "style আপনিই
আসিয়া" পড়েছে। এই স্বতস্ফূর্ততা, কলমের আলতো ছোঁয়ায় প্রকাশিত মধুর প্রেমের কথা,
দুচারটে কথার আঁচড়ে ফুটে ওঠা চরিত্র, নির্মল, উজ্জ্বল কৌতুক যার মধ্যে শ্লেষের
লেশমাত্র নেই -- পাঠক শুধু শরদিন্দুর কৌতুক আর মিলনান্তক প্রেমের গল্পগুলোর কথা মনে
করুন। তাঁর "বঙ্কিমচন্দ্রের স্টাইল খুব ভালো লাগতো", "রবীন্দ্রনাথ কখন যে মনের
মধ্যে এসে গেছেন টের" পাননি তিনি, আর "শরৎচন্দ্র দীর্ঘকাল [আমাকে] আচ্ছন্ন করে
ছিলেন"। শরৎচন্দ্র তাঁর শেষ গুরু আর প্রিয় লেখক হলেন রাজশেখর বসু। এরকম জ্যোতিষ্কময়
গুরুগোষ্ঠীর দাবী শরদিন্দুকে অবশ্যই সাজে, আর যাই শিখুন আর যেভাবেই শিখুন, শেষ
পর্যন্ত শরদিন্দু যে তাঁর নিজের দীপ্ত style নিয়ে উজ্জ্বল হতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে
কোনো সন্দেহ নেই। কিছু ঐতিহাসিক কাহিনী পড়তে পড়তে ভাষার ঝঙ্কারে রাজশেখর বসুর কথা
মনে আসতে পারে, কিন্তু রাজশেখর বসু ভাষাকে খেলিয়েছেন আরো অনেক আশ্চর্য উপায়ে,
ব্যঙ্গাত্মক রচনায় তার সুযোগ অনেক বেশী আর তাঁর বিষয়বস্তুতে এতো বৈচিত্র্যও ছিলো
না।
শরদিন্দুর প্রায় চার দশক ধরে ছড়ানো দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবন কেটেছে বাংলা সাহিত্যের
ঘটনাসঙ্কুল যুগান্তরের কালে। তখন বিদ্যাসাগর-মাইকেল-বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে
প্রাণপ্রতিষ্ঠা করার পর রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ চৌধুরী বাংলা গদ্যপদ্যের ভাষাকে দৃঢ়
ভিত্তিতে বসিয়েছেন, কাব্য আর কথাসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ বহুদিনই একেশ্বর, কিন্তু
শরৎচন্দ্র কথাসাহিত্যের পরিধি আরো অনেক বাড়িয়ে দিয়ে গ্রামে-শহরে সর্বত্র ছড়ানো
বাঙালীর জীবনকে তার আওতায় এনেছেন। কল্লোল গোষ্ঠী, বিশেষ করে কল্লোল-ত্রয়ী
অচিন্ত্যকুমার, প্রেমেন্দ্র আর বুদ্ধদেব রবীন্দ্রোত্তর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে অনেক
পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেছেন, তাতে ইওরোপীয় সাহিত্যের তদানীন্তন চিন্তাধারা বাংলা
সাহিত্যে প্রবাহিত করার চেষ্টা আছে, আছে বাংলা সাহিত্যকে অনুভূতিতে, দর্শনে,
প্রকাশে মানুষের জীবনের আরো কাছে আনার আগ্রহ। যুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর,
প্রাক্-স্বাধীনতা, উত্তর-স্বাধীনতা, দেশবিভাগ -- বহির্বিশ্বের এসব ঘটনা
বিত্ত-গোত্র-স্তর নির্বিশেষে বাঙালীর জীবনযাত্রা আর সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন
এনেছে, বাঙালী কবি আর কথাসাহিত্যিকেরা তার কথা লিখেছেন নতুন উৎসাহে, নতুন চিন্তায়,
নতুন শৈলীতে।
এই পরিবেশে শরদিন্দু বেশ কিছুদিন শিক্ষানবিশী করে মঞ্চে নেমেছেন, তখন তাঁর বয়েস
ত্রিশ। আমাদের মনে হয় অনেক ভেবেচিন্তে তিনি তখনই স্থির করেছিলেন যে লেখক হিসেবে
তাঁর প্রধান লক্ষ্য হবে পাঠককে আনন্দ দেওয়া। রোমান্স তাঁর ভালো লাগতো, তিনি
রোম্যাণ্টিক লেখক হতে চেয়েছিলেন। সাহিত্যজগতে তাঁর বিচরণক্ষেত্র হিসেবে তিনি তখন
থেকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনটি জাঁর -- গোয়েন্দা, ঐতিহাসিক আর অলৌকিক কাহিনী।
বুদ্ধিমান পাঠক লক্ষ্য করবেন যে শরদিন্দুর আগে বাংলাসাহিত্যে এই তিনটি জাঁরই ছিলো
অপুষ্ট, কাজেই শরদিন্দুর গল্প বলার অসাধারণ ক্ষমতা আর অবিসংবাদী প্রসাদগুণের জোরে
বাংলা সাহিত্যের এইসব ক্ষেত্রে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অগ্রণী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
করতে তাঁর কিছুমাত্র দেরী হয়নি। তাঁর পরে কিছু লেখক এই ধরণের লেখা লিখেছেন, তার
মধ্যে কিছু ভালো লেখা যে নেই তা নয় কিন্তু আয়তন আর গভীরতায় আজও শরদিন্দু
অপ্রতিদ্বন্দ্বী, আমরা এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি। তিনি কৌতুকী আর প্রেমের বেশ
কিছু ভালো গল্পও লিখেছেন, তা অতি রমণীয় কিন্তু সেখানে তিনি একক বা অনন্য বলা যাবে
না, তাঁর অবদান ছাড়াও বাংলা সাহিত্য এধরণের রচনায় যথেষ্ট পুষ্ট।
অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য বলছেন, "শরদিন্দু মুখ্যত কবি, রহস্যরসিক কবি।"
ছোটো গল্পের জগতে মোটামুটি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর শরদিন্দু বেশ কয়েকটা মঞ্চসফল
নাটক লেখেন আর তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস থেকে "বিষের ধোঁয়া"র কৃপায় মুম্বইতে
সিনেমাজগতে ঢোকার ছাড়পত্র পান। বাংলাদেশের পেশাদার মঞ্চসফল নাটক আর সাধারণ
চিত্রনাট্যের সঙ্গে সফল সাহিত্যসৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে আমরা আগে লিখেছি, আমাদের মতে
তা হয় না। অবশ্যই এসবের প্রয়োজন আছে আর এ সবই কলমজীবীদের জীবিকার্জনের উপায়ও বটে,
যেমন শরদিন্দুর ক্ষেত্রে, তিনি প্রায় বারো বছর চিত্রনাট্য লিখে অর্থ উপার্জন
করেছেন। বাঙালী পাঠকদের সুখের কথা যে একসময় তিনি নিজেই এ পথ ছেড়ে পূর্ণাঙ্গ
সাহিত্যরচনায় মন দিয়েছিলেন। সৌভাগ্যের কথাও বটে কেননা এই সিনেমার জগৎ চোরাবালির মতো
আগন্তুককে গ্রাস করে নিতে পারে, হাতের কাছেই তার বড়ো উদাহরণ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
আর প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি সামাজিক উপন্যাস বেশী লেখেননি, মাত্র আটটি, তার থেকে
চিত্রনাট্যের রূপান্তরিত উপন্যাস আর "বিষের ধোঁয়া" ও অনুবাদ "ঝিন্দের বন্দী" বাদ
দিলে মাত্র দুটি মৌলিক উপন্যাস, এক, আত্মজীবনীমূলক "ছায়াপথিক" আর দুই, সামাজিক
কাহিনী "রিমঝিম"। আত্মজীবনীটা পড়ে কিছু মজা পাওয়া যায় বটে কিন্তু অন্য উপন্যাসটি
নিতান্তই মামুলি। তাঁর মৌলিক সামাজিক কাহিনীসমগ্রের -- গল্প, উপন্যাস, চিত্রনাট্য,
নাটক -- খতিয়ান নিলে আমরা দেখি যে শেষপর্যন্ত মহাকালের পরীক্ষায় কোনোটাই উত্তীর্ণ
হতে পারেনি।
তবে শরদিন্দু নিজে সসম্মানে জলপানি নিয়ে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন, এ আমরা জোর গলায়
বলবো। তিনি রহস্যকাহিনীর জাদুকর, তিনি রসিক, তাঁর রচনায় কৌতুকমাত্রা সূক্ষ্ম ও
প্রেমের কথা মনোহর, তাঁর রচনার প্রসাদগুণ কেবল খাঁটি কবিদের মধ্যে দেখা যায়, এ বললে
অত্যুক্তি হবে না। অধ্যাপক ভট্টাচার্যের মত অভ্রান্ত, শরদিন্দু "রহস্যরসিক কবি।"
আমাদের আর চাইবার কী থাকতে পারে!!
উৎস:
১) জগদীশ ভট্টাচার্যের উদ্ধৃতি: "আমার কালের কয়েকজন কথাশিল্পী", জগদীশ
ভট্টাচার্য, ভারবি, ১৯৯৯।
২) সুকুমার সেনের কিছু উদ্ধৃতি: "বাঙ্গালা সাহিত্যের
ইতিহাস - ৪", সুকুমার সেন, ইস্টার্ণ পাবলিশার্স, ১৯৭৬
৩) বাংলা সাহিত্যের অন্য
সাহিত্যিকদের বিষয়ে তথ্য ও মন্তব্য: "বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস", ভূদেব
চৌধুরী, দে'জ পাবলিশিং, ১৯৮২
বাকী সব তথ্য ও উদ্ধৃতি শরদিন্দু অমনিবাসের অন্তর্গত রচনা ও গ্রন্থপরিচয় থেকে
গৃহীত।
লেখক পরিচিতি - পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|