প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

অক্টোবর ১৫, ২০১৬

 

ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন বনাম বঙ্গসম্মেলন

ডঃ সোমা মুখোপাধ্যায়


হাডসনের উপকূলে বিশ্বের মধ্যে অগ্রগণ্য শিক্ষা, শিল্প, প্র্রযুক্তি এবং সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র মহানগরী নিউ-ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন-এ ১-৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হল এবছরের ছত্রিশতম বঙ্গসম্মেলন বা NABC 2016 । নিউ ইয়র্কে 4th July-এর উইকেন্ডে ম্যানহাটান-এ যখন শুধু আমেরিকা নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণকারী এসে জড়ো হন, তখন সেখানে ৮-১০ হাজার বঙ্গসন্তানকে একত্রিত করার পরিকল্পনাটা একটা বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। নিউ ইয়র্কের বক্ষে বা প্রাণ কেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে বঙ্গসন্তান, বিশেষতঃ জমকালো সাজে দেমাকে-ঠমকে-পুলকিত প্রাণা বঙ্গললনা। জুলাই-এর এই সপ্তাহান্তে নিউ ইয়র্কের অগণিত দ্রষ্টব্যস্থানের সঙ্গে এই দৃশ্য-ও এক বিশেষ দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছিল ৩-দিনের জন্য এবছর ।

এগারো বছর আগে এই ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন-এ রজত-জয়ন্তী পূর্তি হয়েছিল বঙ্গসম্মেলন-এর বা NABC-র। কাজেই অনেক জাঁকজমকের আয়োজনই হয়েছিল সেবার। কিন্তু অনুষ্ঠানের থেকে বেশি শুনেছিলাম অভিযোগ ও অসন্তোষ দর্শকদের থেকে। যা বুঝেছিলাম অনুষ্ঠান উপভোগের প্রধান অন্তরায় ছিল বিভিন্ন জায়গায় একাধিক মঞ্চ। তবে নিউ-ইয়র্কে ম্যানহাটানের মতো জায়গায় তিনদিন ধরে বঙ্গীয় সংস্কৃতি চর্চা করতে গেলে সে যে সহজ প্রয়াস নয় তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? আশা ছিল গতবারের ভুল-ত্রুটি বা যেসব ঘটনা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো সেগুলোর উন্নতি হবে অভিজ্ঞতার জোরে। কিন্তু কথায় বলে “আশায় মরে চাষা”, আরে শুধু চাষা কেন রে বাপু! তামাম দুনিয়াই তো বেঁচে আছে, গড়িয়ে চলেছে আশায় ভর করে। কাজেই সবকিছু দারুণ হবে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হবে, ৪-ঠা জুলাই-এ নিউ ইয়র্ক ঘোরা হবে, টিকেট পেলে একটা ব্রডওয়ে শো- ও দেখা হবে ইত্যাদি পঞ্চান্ন আশান্বিত পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে তাল ঠুকে যাবার সিদ্ধান্তই নিয়ে নিয়েছিলাম । তবে এগুলোর থেকে নিজের কাছে মূল্যবান আরও কয়েকটি ঘটনাই আমার বঙ্গসম্মেলনে যোগ দেবার ইতিবাচক সিদ্ধান্তে সহায়তা করেছিল; সেগুলো ক্রমপ্রকাশ্য।

বঙ্গসম্মেলন শুরু শুক্রবার ১-লা জুলাই সন্ধ্যে থেকে; বৃহস্পতিবার পৌঁছে গিয়েছিলাম যাতে বঙ্গসম্মেলনে আটকা পড়ার আগে একটু ঘুরে নিতে পারি নিউ ইয়র্ক। হোটেল পেনসিলভানিয়ায় চেক ইন করে ঘরে ঢুকে হাঁ হয়ে গেলাম। এতো বাজে ঘর হতে পারে নিউ ইয়র্ক-এ হোটেলে! তারপর মনে হলো নিউ ইয়র্ক-এই হতে পারে, যেহেতু পর্যটকদেরই ভিড়। ভোরবেলা বেড়িয়েছি বাড়ি থেকে, প্লেন থেকে নেমে ট্রেন নিয়ে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ বিধ্বস্ত অবস্থা। কাজেই যত বাজেই হোক ঘর ও আসবাবপত্র বিছানা পাওয়া মাত্র গা এলিয়ে পড়ল। আগে শুনেছিলাম ঝড়-বৃষ্টির পূর্বাভাস। দিবানিদ্রা দিয়ে উঠে দেখি গরমের বেলা বলে তখনও রোদ ঝলমল করছে। পুত্র-ও এসেছে সঙ্গে, এরকম সুযোগ আবার কবে পাওয়া যাবে! কাজেই চটপট একটু তৈরী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

নিউ ইয়র্ক সেভাবে আমাদের দেখা হয়নি, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং আর স্ট্যাচু অফ লিবার্টি ছাড়া, নিউ ইয়র্ক-এর পথে নিজের মতো করে হাঁটা হয়নি। ছোটবেলার পুজো দেখার উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম, শুরু হলো অভিযান। বৈচিত্র্যের পাখা মেলা নগরী কি আর এক সন্ধ্যেতে ধরা দেয়? "এই রোকো রোকো গাড়িটা থামাও", নাও না- আমার অনুরোধে কাজ হলো; চড়ে বসলাম এক ছাদখোলা বাসে। নতুনের হাল্কা গন্ধ আর মিষ্টি ভিজে বাতাস, সাথে ভ্রমণ প্রদর্শকের ধারাবিবরণী নিয়ে ঘুরে চললাম নিউ ইয়র্ক এর পথে পথে। সেন্ট্রাল পার্ক, উঁচু উঁচু অট্টালিকা, হাডসন নদী, টাপ্পান ব্রীজ, সেন্ট্রাল লাইব্রেরী - একের পর এক ধারাবিবরণ চলেছে, জানা হচ্ছে পথ-ঘাট, ইতিহাস। তার মাঝে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি-র কাছ দিয়ে যেতে যেতে আমি ও পুত্র নীলাভ্র দুজনেই নড়ে চড়ে উঠলাম। মনে পড়ে গেলো একই সাথে যে মূর্তিটি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একশততম স্বাধীনতাদিবস উপলক্ষ্যে (১৮৭৬) ফ্রান্সের পক্ষ থেকে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উপহার। তবে এতো বড় মূর্তিকে নিয়ে আসা ও অন্যান্য নানা সমস্যার কারণে তার দশ বছর বাদে ১৮৮৬ সালে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হয় অতলান্তিক উপকূলে বেডলোস আইল্যান্ড-এ, যা এখন লিবার্টি আইল্যান্ড বলে পরিচিত। মূর্তিটি তৈরী হয়েছিল রোমান দেবী লিবার্তার আদলে, শিল্পী ছিলেন ফরাসী ফ্রেডেরিক অগাস্টে বারথোল্ডি এবং ভাস্কর গুস্তাভে আইফেল। মজা লাগলো এইভেবে মূর্তিটি তৈরী হয়েছিল তামা দিয়ে, রঙ ছিল খয়েরী ঘেঁষা, তারপর প্রকৃতির নিয়মে রাসায়নিক পরিবর্তনে তামার রঙ ধীরে ধীরে বদলে সবুজ হতে থাকে। কিছুদিন চেষ্টা করা হয়েছিল পরিষ্কার করার, কিন্তু তাতে মূর্তিটির সৌন্দর্য রক্ষা হলেও আয়ু যাবে ক্রমে তাই আর সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেওয়া হয় এবং মূর্তিটি আজ প্রায় একশো বছর সবুজ রঙেই উজ্জ্বল। ঐতিহাসিকদের মতে স্বাধীনতা ও মুক্তি ছাড়াও মূর্তিটির প্রায় প্রত্যেকটি অংশই এক একটি প্রতীক; হাতের মশালটি আলোর, অন্য হাতে বইটি স্বাধীনতার দস্তাক্ষর, মাথার মুকুটটি সাত-সমুদ্র ও সাতটি মহাদেশের প্রতীক ইত্যাদি ইত্যাদি। ১৮৮৬ সালে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত হবার আগে নিউ ইয়র্কে ম্যানহাটান, ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন ঘুরে এক বিরাট মিছিল বেরোয় আর আজ তার ১১০ বছর বাদে জুলাই এর সেই একই সময়ে আমরা বেড়িয়েছি নিউ ইয়র্কের সেই একই পথ ধরে পরিভ্রমণে। ইতিহাস কিভাবে নিজেকে মঞ্চে নিয়ে আসে বারবার !! ভাবনা ও দৃশ্য বদলের মাঝে চলতে চলতে অস্তগামী সূর্য বিদায় নিল আর জ্বলে উঠলো আলোর শহর তার নিজের রূপ-মহিমায়। সেদিনের যাত্রা শেষে ফিরে গেলাম হোটেলে।

শুক্রবার সকাল থেকেই অনেক ব্যস্ততা, তার মাঝে জোর করেই ঘুরে এলাম নিউ ইয়র্ক ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম। মানুষের বিবর্তন নিয়ে আমার নিজের কিছু গবেষণার কাজ চলছে; কিছু তথ্য সংগ্রহ করার পরিকল্পনা ছিল। বিকেল থেকেই শুরু হলো বঙ্গসম্মেলন দর্শনের তোড়জোড়। অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা হয়ে গেছে, অনেকের সাথে দেখা হবার প্রচেষ্টায় অনন্ত টেক্সট ও ফেসবুক মেসেজ চালাচালি হয়ে চলেছে। ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন ও নিউ ইয়র্কার হোটেলের পরিমণ্ডলে বেশ কয়েকটা ব্লক জুড়ে বঙ্গসন্তানরাই রাজত্ব চালাচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে পথচারীরা চকিত চমকে ঘুরে ঘুরে দেখেছে কখনো নূপুরের নিক্কণ, কাঁকনের ঠুন-ঠুন আবার উছ্বসিত আলাপন। আর কঠিন চোখে শীতল দৃষ্টিতে এই হাজার হাজার বাঙালিকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে ম্যাডিসন স্কোয়ার ঘিরে রাখা সশস্ত্র প্রহরীর অভিব্যক্তিবিহীন কয়েক শত চোখ। কিছুদিন আগেই ঘটে গেছে অরল্যান্ডো, ফ্লোরিডায় "হেট ক্রাইম", সমকামিতার বিরুদ্ধে। কাজেই ফোর্থ অফ জুলাই-এর উইকেন্ডে আরো কড়া নজরদারি, বিশেষ করে মানহাট্টান, ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন জাতীয় জনপ্রিয় ও জনবহুল পর্যটন এলাকায়। বাঙালি চিত্র তারকা ও শিল্পী প্রায় সকলেই এই ক’টাদিন কলকাতা ছেড়ে নিউ ইয়র্কে। ভাগ্যিস বিদেশিরা এত পরিচিত নন, নাহলে আরও কত শত  শতন্ত্র প্রহরার ব্যবস্থা করতে হতো নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে কে জানে !

যে কোনো বঙ্গসম্মেলনের প্রস্তুতি ও প্রচার জোরকদমে চলে প্রায় বছরখানেক ধরে। আর এবারের বঙ্গসম্মেলনের প্রচার বিশেষ করে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে বঙ্গসম্মেলন এর আয়োজন প্রায় বছর দুয়েক থেকে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে বার বার পৌঁছে যাচ্ছিলো। গত দুবছর থেকেই বঙ্গসম্মেলনের থেকেও বেশি  জোর দেওয়া হচ্ছিল ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন-এর ওপর। কথাটা এইভাবে বিজ্ঞাপিত হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়; তিনদিনের টানা অনুষ্ঠান ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন এ করা আর্থিক ও অন্যান্য আরও অনেক রকম দিক দিয়েই একটু কঠিন তাই প্রথম থেকেই উৎসবস্থলের তালিকায় তার সাথে যুক্ত ছিল আর এক কুলীন মঞ্চ - হামেরস্টাইন হল। অর্থাৎ গোড়া থেকেই আড়াই ব্লক দূরে দুই মঞ্চ অনুষ্ঠানের এবং তার সাথে দোকান বাজারের পসরা পেনসিলভানিয়া হোটেলে মানে তিন নম্বর জায়গা ও তৎসহ নিউ ইয়র্কার বলরুমে বিভিন্ন প্রদর্শনী এবং সেমিনার এবং সাহিত্যসভার আয়োজন। তাল রাখা খুব মুশকিল। একদিকে চাঁদের হাট ম্যানহাট্টান জুড়ে, শুধু চাঁদ নয় চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারায় উজ্জ্বল আকাশ ম্যানহাট্টান-এ। অন্যদিকে   অজস্র অনুষ্ঠান, অজস্র শিল্পী, অসংখ্য অসন্তোষ - বঙ্গসম্মেলন-এর শুরু থেকেই। রথ আর পথের মতোই শিল্পী না দর্শক না ভলেন্টিয়ার কে যে বেশি দিকভ্রান্ত বলা মুশকিল।                      

শুক্রবারের বড় আকর্ষণ ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন থিয়েটার-এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বিরজু মহারাজের নির্দেশনা ও পরিকল্পনায়; দেশ ও এদেশের বহু শিল্পীর সম্মিলিত চোখ কাড়া অনুষ্ঠান হবে দেখার আগেই অনুমান করা যায়। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান-এর আগে হলে ঢোকার জন্য এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির মতোই নজরদারী ও কড়া ব্যবস্থা; জল, খাবার কিছুই সঙ্গে নেওয়া চলবে না। সরু জায়গা দিয়ে ৮/১০ হাজার লোকের প্রবেশ এম.এস.জি. হলে। হলে ঢুকলে অন্য অনুভূতি, বাতাবরণ-ই ভিন্ন। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে খেলে যাচ্ছিলো ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের নানা ইতিহাস। হিপোড্রোম তৈরী হয়েছিল যেখানে বারনাম এন্ড বেইলি সার্কাস খেলা দেখাতো, এই জায়গার শুরু প্রফেশনাল বক্সিং শো-এর জন্য যা ১৮০০ সালের শেষ পর্যন্তও ছিল বেআইনি, এখানে ছিল রেলস্টেশন যার মালিক ছিলেন ভ্যান্ডারবিল্ট, এখানে ঘটেছিলো সেই একনারী নিয়ে দুই বিত্তশালীর মাঝে অমিল থেকে খুন আরও আরও কত ঘটনা! 

ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন এ বর্তমানে বঙ্গসম্মেলনের জাঁকজমক, ইতিহাসের পাতাতেও জাঁকজমক আর প্রাচুর্যের সমারোহ থেকে মাঝে মাঝেই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছিলো। বিকেলের দিকেই খবর পেয়েছি বাংলাদেশে "গুলশান"-এ ঘটে যাওয়া সেই আতঙ্কময় ঘটনা; কিছু বেহেস্তের মোহাচ্ছন্ন উগ্রপন্থীর হাতে প্রাণ চলে গেছে নিরীহ সাধারণ কিছু মানুষের, কিছু যুবক-যুবতীর।  মনের মধ্যে তোলপাড় খাচ্ছিলো কিছুটা অপরাধবোধ, কিছুটা আশংকা, কোনো কিছুই না করতে পারার একটা তীব্র বেদনা ও অসহায়তা। সব ভাবনার মধ্যেই দেখা হয়ে চলেছে অনেক বন্ধু বান্ধব, পরিচিতদের সাথে। কে জানে কোন অজানা বিদ্বেষের আগুনে শিকার হয়ে যাওয়া অস্পষ্ট কিছু মুখ ভেসে আসলেও ঝলমলে অনুষ্ঠানের আবহে তখনকার মতো চাপা পড়ে গিয়েছিলো গুলশনের ঘটনা। ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনকে সার্থকভাবে বঙ্গীয় সংস্কৃতির আঙিনায় পরিণত করার পরিতৃপ্তি  নিয়ে ইংরাজীতে কিছু ভাষণ হয়ে যাবার পর এলেন বিরজু মহারাজ। প্রথমে কিছুটা অংশ তার একক অনুষ্ঠানের এবং তারপর  মেহফিল সাজিয়ে শুরু হলো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। প্রখর সূর্যের আলোর রোশনাই নিয়ে লাল ঘাগড়ায় কথকের বোল তুলে যখন স্টেজে মেয়েরা নৃত্য পরিবেশন করছিলো তখন  তার দৃষ্টিনান্দনিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্নই চলে না।  

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর মঞ্চের উপস্থাপনা বদলে গেলো সাংঘাতিক ভাবে। বঙ্গসম্মেলনে প্রথমবারের মতো    আয়োজিত হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বেঙ্গলি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড সেরিমনি। অনেক সাজ পোশাক, অনেক জাঁকজমক, অনেক অর্থ ছড়িয়ে এই আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান। পুরস্কার প্রাপ্তির দলে অনেকেই আছেন, ছিলেন ঋতুপর্ণা, প্রসেনজিৎ, আবির বন্দ্যোপাধ্যায়, পরমব্রত, কৌশিক সেন, ইমন চক্রবর্তী ও আরও আরও অনেকে দীর্ঘ তালিকা আর এখানে দিতে চাইছি না কারণ সব নাম ঠিক যে মনে আছে তাও নয়। অনুষ্ঠানের এই অংশটির জন্য NABC-র কোনো খরচ হয়নি, দেশের থেকেই আর্থিক-সহায়তা এসেছে পুরোপুরি। নিজেকে মনে করিয়ে দিতে লাগলাম এই জায়গায় তো প্রাচুর্যের প্রতীক ভুলে গেলে কি চলে? শান্ত করতে চেষ্টা করলেও কয়েকটা চিন্তা বড্ড জ্বালাতে লাগলো; এক নম্বর ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পেলো "বেলাশেষে"।  পুরস্কার গ্রহণ করলেন টিম হিসেবে অনেকে, কিন্তু উপস্থিত ছিলেন না কোনোভাবেই দুই প্রধান চরিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। আবার দেখলাম অত্যন্তসুন্দর অভিনয়ের পুরস্কার পাবার পর বেশ কয়েকজন শিল্পীর এক মোটা দাগের হাসির নাটিকা; হাসি-ই পেলো পরিবেশনায়, আসল নাটকে নয়।

গতবছর (২০১৫) বঙ্গসম্মেলনে টেক্সাসের হিউস্টন টেগোর সোসাইটির উদ্যোগে একটি অভিনব রবীন্দ্রসংগীত (এদেশে) এর অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় নাম  - "শতকন্ঠে রবীন্দ্রনাথ", যেখানে মার্কিনরাজ্যের পঞ্চাশটি রাজ্যের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করবে। । শুধু যে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচিত বিশিষ্ট গায়ক-গায়িকাদের সমবেত কন্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত পরিবেশনার এটি একটি মহা প্রয়াস তা নয়, বঙ্গসম্মেলনের পঁয়তিরিশ বছরের ইতিহাসেও এইধরণের অনুষ্ঠান-এর প্রয়াস এই প্রথম । অনুষ্ঠান-এর পরিচালনার দ্বায়িত্বে ছিলেন শান্তিনিকেতনে শিক্ষণপ্রাপ্তা হিউস্টনবাসী কমলপ্রিয়া রায়। কমলপ্রিয়া সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে হিউস্টন ও অন্যান্য শহরে অনেকের কাছেই বেশ পরিচিত ও সমাদৃত।  মার্কিনদেশের প্রায় সমস্ত রাজ্যের থেকে সঙ্গীতশিল্পীদের আগ্রহী সাড়া পাওয়া গেলো । রবীন্দ্রসঙ্গীত-এর প্রতি ভালবাসার একাত্ম বন্ধনে একমঞ্চে এলেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, অধ্যাপক, বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়ী, কম্পুটার বিশেষজ্ঞ, পদার্থবিদ, ভূতাত্ত্বিক ও আরও আরও ভিন্ন পেশার মানুষ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সনাতন ধারার সুর-তাল-আবেগ মেনে সাজানো হয়েছিল অনুষ্ঠান।  অনুষ্ঠানের আগে দুদিন ছাড়া সমস্ত রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা শিল্পীদের অনুশীলন চলেছিল স্কাইপ-এর মাধ্যমে প্রায় ছ'মাস ধরে। আবহসঙ্গীত আয়োজক ছিলেন কলকাতা থেকে শান্তনু ব্যানার্জী।

হিউস্টনের বঙ্গসম্মেলনে অভূতপূর্বভাবে সমাদৃত সেই "শতকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ" জনপ্রিয়তার ও অভিনবত্বে এতো সুন্দর ছাপ রেখে যাওয়ায় আবারও আমন্ত্রিত হয়েছিল নিউ ইয়র্কে । শিল্পীদের নেওয়া হয়েছিল অডিশন করে আর এই ছিল আমার অন্যতম কারণ বঙ্গসম্মেলনে আসার। গতবছর থেকেই আমিও এক শিল্পী এই অনুষ্ঠানের। শিল্পীর সংখ্যা বেড়ে এবারে প্রায় আশির কাছাকাছি। কমলপ্রিয়ার সাথে নিউ ইয়র্কের পড়শী শহর লং আইল্যান্ড -এর ডঃ দেবাশিস অধিকারী ছিলেন পরিচালনা সহায়তায় ।  দেবাশিস পেশায় ডাক্তার হলেও গানের জগতে বিশেভাবে যুক্ত।

শনিবারে বঙ্গসম্মেলনে হ্যামেরস্টাইন হলে একটি বিশেষ আকর্ষণ হয়ে উঠেছিল এই সঙ্গীতানুষ্ঠান । এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণে সুযোগ পাওয়ায় একদিকে যেমন সম্মানিত মনে হয়েছে নিজেকে তেমনি হয়েছি সমৃদ্ধ। দূরে দূরে থেকেও সম্মিলিত ভাবে কাজ করেছেন সবাই একাগ্রচিত্তে ও আন্তরিকতার সাথে।  অনেকেই অনেকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন আরো সুন্দর পরিবেশনার আনন্দে। প্রায় একঘন্টার অনুষ্ঠানে হল ভর্তি দর্শকদের উপস্থিতি শনিবারের সকলকে করেছিল আরো সুমধুর। সেইসঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত আবারো হয়েছিল সমাদৃত তার আপন মহিমায়। হ্যামেরস্টাইন হলে শনিবার সকালবেলা ছিল রবীন্দ্রময় ; শতকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও ছিল শ্রেয়া গুহঠাকুরতার গান, ছিলেন কমলিনী মুখার্জী ও তার পরে আরও একটি অনুষ্ঠান এখানকার বিভিন্ন রাজ্যের শিল্পীদের নিয়ে কবিতাঞ্জলি। শ্রেয়া আনলেন বর্ষা, কমলিনী বসন্তে ভরালেন হল ও দর্শকদের মন।  এই সব ক'টি রাবীন্দ্রিক অনুষ্ঠানেই সঞ্চালনার দ্বায়িত্বে ছিলাম, গানে গানে কেটে যাচ্ছিলো সকাল।   

নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত বঙ্গসম্মেলন-এর স্লোগান ছিল “ভাষাকে ভালোবেসে”। নিউ ইয়র্কার হোটেলে সেমিনার রুমে ছিল সকালের প্রথম অধিবেশন সাহিত্যের আসরে। হ্যামেরস্টাইন হল থেকে সঞ্চালনার ফাঁকে দৌড়ে গিয়েছিলাম দেখা করতে সবার সাথে কারণ বঙ্গসম্মেলনের অন্যতম আকর্ষণ আমার এই সাহিত্য আসরে। দেশ থেকে এসেছেন শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ সাহা, তিলোত্তমা মজুমদার, কানাডা থেকে এসেছেন অলকেশ দত্তরায়  এবং আছেন সাহিত্য জগতে বিশেষভাবেই পরিচিত নিউ জার্সির আলোলিকা মুখোপাধ্যায়। এখানে পরিচালনার দ্বায়িত্বে রয়েছেন নিউ জার্সির সুদীপ্ত ভৌমিক। গত বেশ কয়েকবছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি সুদীপ্ত-দা যখন সাহিত্য আসরের দ্বায়িত্বে থাকেন অনেক সুন্দর ভাবে সাজানো হয় ও আয়োজিত হয় আলোচনা ও সাহিত্য পাঠের আসর। সকালে মোড়ক উন্মোচন হলো এবারের সাহিত্য পত্রিকার, সম্পাদনায় ছিলেন আলোলিকা-দি। এবারে আমার একটি কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে, আর এক ভালোলাগার স্থান ও সম্মানপ্রাপ্তি। সকালের অনুষ্ঠানে বেশীক্ষণ থাকতে পারি নি, শনিবারের বিকেলে সাহিত্য পাঠের আসরে ছিলাম। ভালো লাগছিলো কবিদের কথা ও এদেশের সাহিত্য চর্চা যারা করছেন তাদের সাহিত্য পাঠে। উপস্থিত ছিলেন এদেশে দীর্ঘিদিন সাহিত্যচর্চায় কৌশিক সেন, মৃণাল চৌধুরী, রাহুল রায়, স্বপ্না রায় ও আরো অনেকে।

বঙ্গসম্মেলন বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে হলেও সাহিত্যের দিকটা দুয়োরানীর মতোই যেন একপেশে পড়ে থাকে। মুষ্টিমেয় কিছু সাহিত্যচর্চায় আগ্রহী পাঠক ও সাহিত্যিক থাকেন এই সাহিত্যআসরে। সুদীপ্ত-দা নাট্যব্যক্তিত্ব, ওঁর নাটক আমেরিকায় ও দেশে বিভিন্ন মঞ্চে মঞ্চস্থ হচ্ছে। সাহিত্য আসরকে নানাভাবে সাজান সুদীপ্ত-দা।  পাওয়া যায় সুন্দর কিছু মুহূর্ত কবি সাহিত্যিকদের সাথে আলোচনায়, কথোপকথনে ও তাদের নিজেদের সাহিত্য পাঠে। সেমিনার হল  ছোট, কিন্তু ভর্তি ছিল শনিবারের সকালে ও বিকেলের অনুষ্ঠানে। ড: রূপালী বসু এসেছিলেন কলকাতা থেকে, উন্মোচন হলো "আজকের সম্পূর্ণা" পত্রিকার আন্তর্জাল সংখ্যা ও প্রকাশনা। রবিবার সাহিত্যপাঠের আসর ছিল হোটেল পেনসিলভানিয়ার বলরুমে; দর্শক-শ্রোতায় পরিপূর্ণ হল।  শ্রীজাত পড়লেন গুলশান নিয়ে লেখা ওর কবিতা, বিনায়ক-এর কবিতায় নানা রূপক, পঙ্কজ সাহার কবিতা মানুষ চিরকালীন দর্শন নিয়ে এবং তিলোত্তমা পড়লেন প্রথমবার নিউ ইয়র্কে এসে ওনার মানসিক অবস্থা নিয়ে লেখা একটি কবিতা। তাছাড়া অবশ্যই ছিল সবার-ই লেখা আরো কিছু তাদের সংগ্রহ থেকে।  তিলোত্তমা এসেছেন সাহিত্যাসরে সাহিত্য পাঠে। কিন্তু বললেন  নিজের কোনো লেখা আনতে ভুলে গেছেন। মুক্তধারা থেকে নিজের লেখা একটি বই নিয়ে পাঠ করে শোনালেন এক অংশ, মানুষের যৌনতার প্রকাশ ঘিরে, কেমন যেন বড্ডো খাপছাড়া লাগলো, পুরো উপন্যাসটি না পড়লে ঘটনাটা কী বোঝা দুস্কর। ওখানে উপস্থিত ছিলেন শুভাপ্রসন্ন শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে কিছু আলোচনার জন্য।  কিন্তু শেষ অবধি আর থাকতে পারিনি সেদিন।

শনিবার অলকানন্দা রায়ের পরিচালনায় ছিল একটি অসম্ভব সুন্দর নৃত্যানুষ্ঠান। দৌড়াদৌড়ির মাঝে কিছুতেই আর সময় করে উঠতে পারিনি সেখানে যাবার। মিত্রা পুরকায়স্থ  ও আনন্দমন্দিরের যুগ্ম প্রয়াসে আয়োজিত হয়েছিল নৃত্যনাট্য "প্রকৃতি ও আনন্দ"; রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা অবলম্বনে। মিত্রা-দিকে বলা যায় এক সাধিকা, নিউ জার্সিতে ওড়িশি নৃত্যের স্কুল ওনার RDM - Rhythm of Dance and Music। আর.ডি.এম এর ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছিল এই উপস্থাপনা, সঙ্গে ছিলেন মিত্রা-দি নিজে মা-এর ভূমিকার-য় ও দেশের থেকে এসেছিলেন ইন্দ্রাণী হালদার কন্যার ভূমিকায়। নৃত্যনাট্যটিতে রবীন্দ্র-নৃত্যের সঙ্গে মেশানো হয়েছে সাম্প্রতিক নাট্যনৃত্যধারা সুন্দর ভাবে। উল্লেখযোগ্য সুকল্যাণ ভট্টাচার্যের কোরিওগ্রাফি ও নৃত্যপরিচালনা। মানুষের সংস্কার ও চিরাচরিত আচারকে ঝেড়ে ফেলে আলোর পথে যাবার কাহিনীই ফুটে উঠলো "প্রকৃতি ও আনন্দে"। দেশের থেকে শিল্পীসহ এদেশের তিনপ্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে আর একটি সার্থক প্রয়াস ও পরিবেশনা।             

বিভিন্ন মঞ্চে হয়ে চলেছে অজস্র সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নৃত্য-গীত-যন্ত্রবাদনই অধিগ্রহণ করে রেখেছে সিংহভাগ। এতো জাঁকজমক, এতো পয়সার ভেল্কি-বাজী ভালো লাগার-ই কথা; ভালো লাগছে না বললেও ভুল হবে। কিন্তু চিরকালীন সেই জ্বালা মনকে নিয়ে, "ও আমি মন নিয়ে কি মরবো নাকি শেষে"!!!!!মরতেই হয়, কখনো পিরীতে বা কখনো ভাবনায় নিপীড়িতের। উঁকি মারছিলো বার বার গুলশান, ফ্লোরিডা, উঁকি মারছিলো কলকাতার পথের বাসিন্দা আর তার সঙ্গে ম্যানহাট্টানেরও ভবঘুরে, বাস্তুহারা ফুটপথবাসীদের মুখ। কি বৈপরীত্য !!!!                    

কৌশিকী চক্রবর্তীর অনুষ্ঠান দেওয়া হয়েছিল পেনসিলভানিয়া বলরুমে যেখানে পাঁচশ’ লোকের বাসার জায়গা, অনেক ক্ষোভ। অল্প সময়েই  সুযোগ হলো শোনার। "কৃষ্ণের রাধা" - সত্যম রায়চৌধুরী, ঋতুপর্ণা দাশগুপ্ত, ইমন চক্রবর্তী, সাহেব চ্যাটার্জী, সৌমিলি ও অর্ণব-এর মনোগ্রাহী পরিবেশনা। কোনও পূর্ণাঙ্গ নাটক ছিল না ; ছিল রায়া ভট্টাচার্য্য ও কৌশিক সেন-এর দুটো শ্রুতিনাটক। ভালো লাগলো কৌশিক ও রায়ার অনুষ্ঠান। তার পাশেই হয়ে চলেছে সিনেমা-প্রদর্শনী।                 

এতো সবকিছুর ফাঁকে শনিবার অনেকটা সময় অনেক অনুষ্ঠান-এ কাটালাম আমার বাল্যবন্ধু ও দাদার সাথে, আমার ভাইয়াদা ও নিউ ইয়র্কের সৌরভ মুখার্জী। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে ছোটবেলাকার স্মৃতি, এখনকার ব্যস্ততা নিয়ে নানা গল্পে সময় কেটে যাচ্ছিলো ভালোই। পুত্রের সাথেও সব সময় যে দেখা হচ্ছে তা নয়।  ওর কিছু বন্ধু এসেছে এখানে, হয়েছে আবার কিছু নতুন পরিচয়। আমার বাল্যবান্ধবী কন্যা উজ্জয়িনী, তার বর ময়ূর ও সাথে কন্যা উপাসনা ওরফে উপু-র সাথে শনিবার সন্ধ্যেবেলার অনেক অনুষ্ঠান একসাথে দেখা হলো। যেমন সুন্দর স্বভাব উজ্জ্বয়িনীর তেমন ময়ূরের। এরকম সঙ্গ পেলে আরও সুন্দর কাটে সময়। উজ্জ্বয়িনীরা নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা, ওদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম নিউ ইয়র্কে রোলের দোকানে। ভালোই হলো খাওয়া, শুধু সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত আমাদের উপুদেবী। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন, টাইমস স্কোয়ার-এর প্রাচুর্যের পাশাপাশি গৃহহীন ও দারিদ্র্যের বৈপরীত্যের সহাবস্থান।

রবিবার দিনটা নিজের মতো করে কাটাবো ঠিক করেছিলাম, অনেক অনেক অনুষ্ঠান দেখার তালিকায়, তা কোনোদিন-ই সম্ভব হবে না; কাজেই নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়া যাতে আনন্দ আর উপভোগ্যতা থাকে।  খবর পেয়েছিলাম বাংলার শিল্পীদের হাতের কাজ নিয়ে একটি এক্সিবিশন হচ্ছে ক্রিস্টাল বলরুম, নিউ ইয়র্কার হোটেল। বহুবছর ধরে বাংলার বিভিন্ন লোকধারা, সংস্কৃতি ও শিল্পকে নিয়ে মনোগ্রাহী প্রদর্শনী করেছেন নিউ জার্সির ধৃতি বাগচী। অতিরিক্ত ধকলের জন্য এখন কিছুদিন একটু বিরতি বললেন ধৃতিদি। রাস্তার মাঝে বন্ধুদের সাথে দেখা, নতুন হওয়া বন্ধুদের কে দেখলে মিষ্টি হাসি দিয়ে পরিচয়টা ঝালিয়ে নেওয়া, দেখা করবো কথা দেওয়ায় প্রতীক্ষারত বন্ধুদের সাথে সেলফি তোলা সেরে যখন উপস্থিত হলাম তখন সুন্দরী এবং সুন্দর দুইজনদের নিয়েই উচ্ছল উচ্ছ্বাসে চলছে কাঁথা, গামছা, সিল্ক, তাঁতের নানা মিশ্রণে শাড়ি-পাঞ্জাবীর ফ্যাশন-প্যারেড।  সুন্দর হাতের কাজ, কারুকীর্তি, মডেলদের কখনও স্মিত কখনো প্রগলভ হাসির সাথে আনন্দিত করতালিতে ভরে উঠছে হল।  সঞ্চালনায় কাঁথা শাড়ি পরনে নিউ জার্সির নীনা গাঙ্গুলী। সারাদিন অনেক মেসেজ চালাচালির পর অবশেষে দেখা হলো নীনা-র সাথে অনুষ্ঠান শেষে; আলাপ করিয়ে দিলেন শান্তা বোস ও রুবি পাল চৌধুরীর সাথে। দেশ থেকে এসেছেন শান্তা বোস অনেক কারুশিল্প ও শিল্পীদের নিয়ে। হাতের কাজের প্রদর্শনীর মূল বিষয় নীল - বললেন এক্সিবিশন-এর মূল রূপকার রুবি পাল চৌধুরী । বাংলা সাহিত্যে ও সমাজে নীলের প্রবাহ তাকে প্রভাবিত করেছে, কখনো নীল যমুনা, কখনো নীলাম্বরী কখনো নীল-দর্পন। মুগ্ধ-দৃষ্টিতে দেখে ভরে রাখছিলাম মনের ক্যানভাস-এ। কোনো জিনিস কেনার ক্ষমতা নেই আমার; চোখধাঁধানো কাজের মন কাঁপানো দাম।

ঘরের কোণে মৃৎশিল্পী চোখের সামনে তৈরী করছেন মাটির পাত্র, ফুলদানী ও আরো শিল্প-কর্ম। পাশে রাখা একটা ছোট্ট কুনকে।  আমার বাপের বাড়ির পরম্পরা কালীপূজোর দিন দীপান্বিতা লক্ষ্মী-পূজো। কুনকেতে নতুন ধান দিয়ে, নতুন শাড়ী দিয়ে বৌ সাজিয়ে বাড়িতেই সাজেন মা লক্ষ্মী। বাড়ির কথা মনে পড়লো ভীষণভাবে। জিজ্ঞেস করলাম বড় দুটো কুনকে তৈরী করে দিতে পারবেন কিনা; রাজি হলেন শিল্পী। এখানে তো মাটি পোড়াবার ব্যবস্থা নেই, কাজেই যতটা সম্ভব হয় করে দিলেন।  অনেক সামান্য পারিশ্রমিকে হাতের ছোঁয়ায় চাকার ঘোরায় আমার ছেলেবেলাকে যেন আবার হাতের মাঝে এনে দিলেন। অবশ্য আমি ওই দুটোকে ফুলদানী হিসেবেই হয়তো ব্যবহার করবো, সাজিয়ে রাখবো।

ভিজে মাটি শুকোতে সময় নেবে, সন্তর্পণে হাতে কাঁখে নিয়ে সামলাতে সামলাতে বেরোলাম। কাঁখে করে বেশ বড় সাইজের দু’খানা কুনকে নিয়ে ঘুরছি দেখে অনেকেই প্রশ্ন করলেন কোথায় যাচ্ছ? কি করবে? মনে হলো কারো ভেতরে কৌতূহল লাফিয়ে বেরোবে "আলির বাড়ি যাচ্ছ নাকি?" সরাসরি কেউ প্রশ্ন করেননি আর ভাবেনও নি কারণ কাউকেই পিছু ধাওয়া করে আসতে দেখিনি। ভাগ্যিস ! নাহলে তাকে আশাহত হতেই হত।
সন্ধ্যেবেলায় সুনীধি চৌহান-এর গান শুনতে গেলাম সেই নজরদারির যন্ত্রনা সহ্য করে ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন-এ। অফুরাণ প্রাণশক্তিতে নাচ ও গানের পরিবেশনা, তবে সম্পূর্ণ হিন্দি গানের অনুষ্ঠান।  হিন্দি গান শুনি না বললে ভুল হবে।  কিন্তু সারাদিনে অনেক সুন্দর অনুষ্ঠান দেখেছি, অনেক কিছু মনের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভালো লাগলো না ওই উদ্দাম যন্ত্রের আওয়াজ ওই মুহূর্তে ।  হল থেকে বেরিয়ে হোটেলেই ফিরে গেলাম।সোমবার সকালে ঘরে ফেরার পালা। চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে পরের বছর সানফ্রান্সিসকোতে বঙ্গসম্মেলন নিয়ে পরিকল্পনা।

সমালোচনা করি, তবু মানতেই হবে অনেক ভলান্টিয়ার-এর অনেক মেহনতের বিনিময়ে মনের খোরাক পাই তাই ফিরে আসি এই বঙ্গসম্মেলনে আবার বার বার বাংলার মায়ায় ও আকর্ষণে ।



লেখক পরিচিতি : কলকাতার ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অফ কেমিক্যাল বায়োলজি থেকে ডক্টরেট করে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটিতে পোস্টডক্টরাল রিসার্চ করেন। বিগত আঠারো বছর ধরে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটি, ও সিনসিনাটির বিভিন্ন কলেজে হিউম্যান অ্যানাটমি ও ফিজিওলজি নিয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে জর্জিয়া রিজেন্ট ইউনিভার্সিটি ও ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলিনাতে যুক্ত। সঙ্গীতে ডিগ্রি ও মাস কম্যুনিকেশনে ডিপ্লোমার অধিকারী। স্কুল জীবন থেকেই পড়াশোনার সঙ্গে নাটক, আবৃত্তি, ফোটোগ্রাফিতে উৎসাহী। মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মিড আমেরিকা বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশনের 'মাতৃকা' পত্রিকার সম্পাদিকা।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।