প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

মার্চ ১৫, ২০১৭

 

একটি গোরস্থান এবং কিছু খণ্ডিত ইতিহাস

সোমেন দে


এ রাস্তার সনাতন নাম পার্ক স্ট্রিট। বাসের কন্ডাকটার বলে পার্কস্ট্রীট।মেট্রোরেলের মহিলা ঘোষিকা বলেন পাআআক স্ট্রীট। আর এই রাস্তার সরকারি নাম ,যেটা অনেকের মনেই থাকেনা , সেটা হল মাদার টেরিজা সরণি।

কলকাতার অন্যতম অভিজাত, ব্যস্ত এবং বর্ণময় পাড়া। এককালে এই গোটা অঞ্চলটাকে সাহেবপাড়া বলা হত। বলার যথেষ্ট কারণও ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা এই অঞ্চলটাকে তাদের মনের মতন করে বানিয়ে তুলতে চেয়েছিল।কালাআদমি নেটিভদের পাড়া থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে এখানেই তারা বানিয়ে ছিল তাদের ধম্মকম্মো, ব্যাবসাপত্তর এবং ফূর্তিফার্তা জায়গাগুলো। কলুদের জন্যে কলুটোলা, কুমোরদের জন্যে কুমোরটুলি, মুচিদের জন্যে মুচিপাড়া ইত্যাদি এলাকা নির্দিষ্ট করে নিজেদের জন্যে চৌরঙ্গীর আশে পাশের এই অঞ্চলটাকে তারা লন্ডনের আদলেই তারা গড়ে তুলতে চেয়েছিল । গোরা সাহেবরা এ দেশ থেকে রাজত্ব গুটিয়ে প্রস্থান করেছে সত্তর বছর আগে। তবে নেই নেই করে এ শহরে কলোনিয়াল হ্যাংওভার বলে যা কিছু খ্যাত তার বেশিরভাগটাই আছে এই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

সার্কুলার রোড দিয়ে প্রবেশ করে একটু এগিয়ে পার্ক স্ট্রিটের মত এমন একটা হৈ হুল্লোড় আর জাঁকজমকের রাস্তা থেকে একটু বাঁক নিয়ে ছোট্ট একটা গলি ,যেটা চট করে চোখেই পড়েনা , সেটাতে ঢুকলেই এক অবাক কাণ্ড অপেক্ষা করে আছে। যেন টাইম-মেশিনে চড়ে এক ধাপে আড়াই শতাব্দী পেরিয়ে হাজির হওয়া শহর কলকাতার শহরের হামাগুড়ি দেওয়ার দিনে।

মন্দিরের আদলে চার্লস হিন্দু স্টুয়ার্টের সমাধি Cemetery র মূল মারবেল ফলক

উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত এক ফালি জমি, তার মধ্যে বড় বড় গাছপালার ছায়াচ্ছন্ন আলো আঁধারিতে পৌঁছালেই কেমন একটা রোমাঞ্চ লাগে। লোহার গেটের উপরে লেখা South Park Street Cemetery । পাশের দেয়ালে ইতিহাস-গন্ধমাখা শ্বেতপাথরের ছোট্ট ফলকে লেখা
OPENED 1767
CLOSED 1790।

গোরস্থানের গেটে টেবিল চেয়ার নিয়ে এক নির্লিপ্ত দারোয়ান বসে থাকে। টেবিলে একটা বড় খাতা খোলা আছে। তাকে দেখে মনে হয় না সারাদিন তাকে খুব একটা ব্যস্ত থাকতে হয়। একটা খাতায় আমাদের নাম ঠিকানা লিখে আমরা ঢুকে পড়লাম আদিমকালের চাঁদের হিম মাখা এক দেশে। হিসেব মত মাত্র বাইশ বছর খোলা ছিল এই কবরখানা। তাতেই এখানে সমাধির সংখ্যা প্রায় দু হাজার।সবচেয়ে পুরনো কবরটি যা এখনো অটুট আছে তার তারিখ ১৭৭৯ সালের ২৮ শে জুলাই। একেবারে ঠেসাঠেসি করে শেষ ঘুমে শুয়ে আছেন হাজার দুয়েক ব্রিটিশ, স্কটিশ, আর্মেনিয়ান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মানুষ। এঁদের মধ্যে কয়েকজন কে আমরা খুব ভালো ভাবে চিনি, তাদের কথা পরে আসছি।

এখানে কবরের অবশ্য কোন নির্দিষ্ট মাপ নেই। কারো জন্যে সাত বাই তিন আবার কারো জন্যে বারো বাই আট ফুটের মাটির দখলদারি। কারো জন্যে গথিক স্টাইলের থাম দেওয়া স্থাপত্য , কারো জন্যে সাদামাটা শ্যাওলা পড়া চাতাল। কারো এপিটাফ দু লাইনেই শেষ , কারো বা এক দীর্ঘ কবিতা। শুধু জমির মাপে নয় , কবরের নির্মাণেও নানা বৈচিত্র্য। গম্বুজ , মিনার , পিরামিড ,ডোম, মন্দিরচুড়া কিছুই বাদ নেই। মরণের পরেও এখানে জাতিভেদ ঘোচেনই।ইহলোক ছাড়িয়ে গিয়েও সাম্যবাদ এখানেও অনায়ত্ত রয়ে গেছে।

উর্দু ভাষার কবি ক্যায়-ফি আজমই বলেছিলেন –

‘ইনসান কি খোয়াইব কি কোই ইন্তেহাঁ নহি
দো গজ জমিন চাহিয়ে , দো গজ কফন কে বাদ।‘
কিন্তু সবার জন্যে দু গজ যথেষ্ট নয়।
ক্ষমতা আর কবে কবিতার কথায় কান দেয়।

গোরস্থানে কিছু indo-gothic বা indo-saracenic স্টাইলের স্তাপত্য

ভাবতে অবাক লাগে এই শহরে আড়াই শো বছরের পুরনো এমন একটা জায়গা আছে যেটা প্রায় সেদিনের সেই চেহারাটা প্রায় একই রকম রেখে দিয়েছে। যখন আশে পাশের সবই তো আমূল বদলে গেছে। এখানে যারা শান্তিতে শয়ান , তারা যে শুধু অর্থ কৌলীন্যে বা মর্যাদায় একে অন্যের থেকে আলাদা তাই নয়, তাদের বয়সের তফাৎও চোখে পড়ার মত। এখানে আছেন সৈনিক, আছেন নাবিক, আছেন সিভিল সারভেন্ট, আছেন ব্যবসায়ী, আছেন শিক্ষক, আছেন বিচারক, আবার আছেন গৃহবধূ, কিশোর কিশোরী এমন কি শিশুও।

আড়াই শো বছর আগে এই শহরটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর ছিল না। জলা জমি, ঝোপ ঝাড় , মশা মাছি , পোকামাকড়, সাপখোপ এ সব তো ছিলই। ছিল ম্যালেরিয়া , ছিল কালা আজর , ছিল কলেরা ছিল প্লেগ।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী হয়ে , ব্রিটিশ সরকারের সৈনিক হয়ে , ধর্মযাজক হয়ে , ব্যবসা করে অর্থোপার্জন এর আশায় , যারা স্বেচ্ছায় বা নেহাত অনিচ্ছায় এ দেশে এসেছিল , তাদের অনেকেই সহ্য করতে পারেন নি এ শহরের অকরুণ পরিবেশ।

অকটারলি মনুমেন্টের ধাঁচে একটি মিনার

আর ভুলে গেলে চলবে না , এই গোরস্থান খোলার দু বছর আগে ইংরেজরা পেয়ে গেছে বাংলা বিহার ওড়িশার দেওয়ানি। প্রশাসন নবাবের হাতে থাকলেও কার্যত ইংরেজরাই তা চালাত। এ সময়ে ছোটোখাটো লড়াই দাঙ্গা লেগেই থাকত। তাতে কিছু ইংরেজ সৈনিক মারা যেত নিয়মিত ভাবে। কিছু ইংরেজ বনিক এবং ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির কর্মচারীদের মাত্রাছাড়া মুনাফা লুট এবং রাজস্ব আদায়ের বাড়াবাড়ির কারণে ১৭৭০ সালে ঘটে যায় সেই কালান্তক দুর্ভিক্ষ , যাকে আমরা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ( বাংলা সন ১১৭৬) বলে জানি। এই দুর্ভিক্ষে দশ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। তাদের বেশির ভাগই অবশ্য নেটিভ প্রজা। তবে দুর্ভিক্ষের কিছু আঁচ হয়ত শাসকশ্রেণীকেও পোহাতে হয়েছিল।তাদের কিছু হয়ত শুয়ে আছেন এই গোরস্থানে। এই সময়ে বাংলার গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড রবার্ট ক্লাইভ। ক্লাইভের এই পদে উত্তরণের পটভূমিকাটি একটু বুঝে নেওয়া যাক।

প্রিনসেপ ঘাটের ধাঁচে একটি সমাধি

এই গোরস্থান তৈরি হবার ঠিক সাতাশি বছর আগে ১৬৯০ সালে জোব চার্ণক ব্যাবসা পত্তর বাড়াবার তাগিদে ঘুরতে ঘুরতে এসে জাহাজ ভেড়ালেন গঙ্গার সুতানুটি ঘাটে। জায়গাটা তাঁর পছন্দ হল।তাছাড়া এ অঞ্চলের উৎকৃষ্ট মসলিন এবং মশলাপাতির খবর ইয়োরোপেও পৌঁছে গেছল। তাই জোবের মাথায় ছিল আর কিছু না হোক এখনে ব্যাবসার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এখানে আসার মাত্র তিন বছর পরেই তিনি এই শহরেই দেহ রাখলেন। তাঁর জামাই চার্লস আয়ার সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের কাছে তেরশো টাকায় কিনে নিলেন সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা নামের তিনটি গ্রাম। অবশ্য বাংলার নবাবের অনুমতি পাবার জন্যে খরচা করতে হল ষোলো হাজার টাকা। একটু একটু করে ব্যাবসা জমতে লাগল আর একটি শহরের পত্তন শুরু হল।

সে সময় ছোটো খাটো লড়াই ঝগড়া লেগেই থাকত। কখনো স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কখনো মোগলদের সঙ্গে। তাই ইংরেজরা ঠিক করল পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে একটা কেল্লা বানানো হবে। ১৬৯৬ সালে শুরু হয় কেল্লা বানানোর কাজ। শেষ হয় ১৭০৬ সালে। তখন ভারতের সম্রাট ঔরঙ্গজেব আর ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়াম। কেল্লার নাম রাখা হল ফোর্ট উইলিয়াম।

এর কিছুদিন পরে দিল্লীর মসনদে তখন ফাররুখশিয়র। সম্রাট হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে সারিয়ে তুললেন এক ব্রিটিশ ডাক্তার হ্যামিলটন। খুশি হয়ে ফাররুখশিয়র ইংরেজদের দিয়ে দিলেন এ দেশে অবাধ বাণিজ্যের অধিকার। এতে করে ইংরেজদের ব্যাবসা এবং কলকাতা শহর আরও বেড়ে ওঠার সুযোগ সামনে এসে গেল। বাড়তে লাগলো শহর কলকাতা। কিন্তু কলকাতা পত্তনের বছর পঞ্চাশ পরেই হল এক সাঙ্ঘাতিক ঝড়ে তছনছ হয়ে গেল এই শহর।ধূলিসাৎ হয়ে গেল অনেক নূতন গড়ে তোলা বাড়ি ,ডুবে গেল মালপত্র সমেত অনেক জাহাজ ,ভেঙ্গে পড়ল অনেক গির্জা , মন্দির, মসজিদ।

ইংরেজরা এতে দমে না গিয়ে আবার লেগে পড়ল শহর গড়ে তুলতে। কিন্তু এই সময়ে ঘটল আরেক বিপর্যয়। বর্গীরা আক্রমণ করল বাঙলাকে। গ্রামের পর গ্রাম তারা আক্রমণ করে লুঠতরাজ আরম্ভ করল। তখন মোগল শাসন দুর্বল হয়ে গেছে। তাই বর্গীরা প্রায় কোনও বাধাই পেল না।গ্রাম থেকে অনেক লোক পালিয়ে এলো কলকাতা শহরে। তারা ভাবল ইংরেজদের শাসন মোগলদের চেয়ে ভালো।

এ দিকে ঘটল আরেক বিপত্তি।মুর্শিদাবাদে তখন আলি বর্দি খাঁর পরে নবাব তখন তরুণ শিরাজ উদ উলহা। ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বনিবনা হল না। ১৭৫৭ সালে শিরাজ কলকাতা আক্রমণ করে বসলেন।ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে সিরাজের সেনার প্রথম লড়াই বাধল বাগবাজারে। ইংরেজ সৈন্যরা হেরে গিয়ে পিছু হটতে লাগল। কিছু ইংরেজ সপরিবারে আশ্রয় নিলো ফোর্ট উইলিয়ামে। কিছু ইংরেজ জাহাজে করে পালালেন প্রাণের দায়ে। নবাব দখল করে ফেললেন ফোর্ট উইলিয়াম। ইংরেজ সৈন্যাধ্যক্ষ হলওয়েল তাঁর ১৩৭ জন অনুচর সমেত বন্দী হলেন নবাবের সৈন্য দ্বারা। নবাব ভেবেছিলেন ফোর্টের কোষাখানায় প্রচুর ধনসম্পত্তি ইংরেজরা জমা করে রেখেছে। কিন্তু তিনি হতাশ হলেন। কলকাতায় সম্পত্তি বলতে কলকাতায় তখন চারশো আটানব্বইটি পাকা বাড়ি , খড়মাটির বাড়ি প্রায় সাড়ে চোদ্দ হাজার । বিরক্ত নবাব ইংরেজদের একটা চোরা কুঠুরিতে বন্দী করে , শহরের নাম পালটে আলিনগর রেখে ,পাহারাদারির জন্যে কিছু সৈন্য রেখে ফিরে গেলেন মুর্শিদাবাদে। কলকাতা সে সময় হয়ে উঠলো প্রায় ইংরেজ শূন্য। কিন্তু এমন অবস্থা বেশি দিন থাকল না। কারণ ইংরেজ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে গেছে কলকাতাকে কেন্দ্র করে এই দেশটাকে দখল করতে হবে।

ঠিক একবছর পরে কয়েকটি যুদ্ধ জাহাজের বহর নিয়ে কলকাতার বন্দরে নামলেন এক অত্যন্ত সাহসী এবং ধূর্ত সেনানায়ক। তার মান রবার্ট ক্লাইভ। সামান্য যে কটি নবাবের সেনা ছিল কলকাতা পাহারা দেওয়ার জন্য তারা ইংরেজদের লটবহর দেখেই বিনা যুদ্ধে পালাল কলকাতা ছেড়ে। শেষ পর্যন্ত ১৭৫৭ সালে সিরাজকে শায়েস্তা করার জন্যে আক্রমণ করল মুর্শিদাবাদ। লেগে গেল সেই বিখ্যাত পলাশির যুদ্ধ। রবার্ট ক্লাইভ এসে পরিচালনা করলেন। ধূর্ত ক্লাইভ বুঝলেন শুধু বীরত্ব দেখিয়ে যুদ্ধ জেতা যাবে না। বুঝলেন এ দেশে যেমন দেশের জন্যে লড়াই করার জন্য অনেক বীর সৈনিকরা আছেন তেমনি আছেন ক্ষমতা লোভী মীরজাফররাও। মীরজাফরদের খুঁজে বার করলেন এবং কাজে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়ার কাজে লাগালেন এবং এ দেশের ভাগ্য পালটে দেওয়ার যুদ্ধে জিতলেন। ভারতে ব্রিটিশদের রাজত্ব কায়েম করার প্রথম দরজাটি উন্মুক্ত হল।

ডিরোজিয়োর সমাধি

ফিরে আসি গোরস্থানে। এই গোরস্থানে যারা শুয়ে আছেন তাঁরা যে সবাই শুধু ইংরেজদের অপশাসনের প্রতিভূ তা নয়। এমন কয়েকজন মানুষ আছেন যাঁদের কাছে বাঙালি আজও কৃতজ্ঞ হয়ে আছে।তাঁর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও। ডিরোজিওকে অবশ্য খাঁটি ইউরোপিয়ান বলা যায় না। হেনরির জন্ম ১৮০৯-এর ১৮ এপ্রিল কলকাতার মৌলালি অঞ্চলে এক ইউরেশীয় পরিবারে। জন্মসূত্রে বাঙালি না হলেও বাঙালি সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে মনে প্রাণে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। অসাধারণ মেধা সম্পন্ন ডিরোজিওকে মাত্র ১৪ বছর বয়সে শিক্ষা জীবন শেষ করে উচ্চতর বিদ্যার্জনে না গিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। ডিরোজিও হিন্দু কলেজে যোগদান করেন। তাঁর পাণ্ডিত্য ও মেধার জন্যই কলেজের খ্যাতি ও গৌরব বেড়েছিল। মাত্র সতেরো বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন বলে ডিরোজিওর ছাত্রদের সঙ্গে বয়সের ব্যবধান ছিল খুব কম। কেউ কেউ ছিলেন তাঁর সমবয়সী। তাঁর প্রত্যক্ষ ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব, দিগম্বর মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র বসাক। তেমনই হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রসিককৃষ্ণ মল্লিক ছিলেন তাঁর ভাবশিষ্য।তিনি চেয়েছিলেন বাংলার বহু যুগের কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। সেকেলে রক্ষণশীল বাঙালি ব্যঙ্গ করে তাঁর নাম দিয়েছিল ‘দ্রজু ফিরিঙ্গি’। আমরা জানি তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই বাংলার নবজাগরণ আন্দোলনের পুরোধা হয়ে উঠেছিলেন।তার পিছনে ডিরোজিওর প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। পরে হিন্দু কলেজে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিলেও থেমে যায়নি তার জীবন সংগ্রাম। এ সবের মাঝেই চলতে লাগলো ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। থেমে যায়নি ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর লেখালেখি। ১৮৩১-এর ২৬ ডিসেম্বর কলেরা রোগে ডিরোজিওর মৃত্যু হয়। এই গোরস্থানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই গোরস্থানের তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি সমেত তাঁর সমাধিটি এখানের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ।



ডিরোজিওর আবক্ষ মূর্তি এপিটাফ সহ।

উইলিয়াম জোন্সের সমাধি

আরেকজন ইংরেজ যিনি এই দেশটাকে একজন শুধু শাসকের নজরে না দেখে সন্ধান করেছিলেন এ দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের। তাঁর নামা উইলিয়াম জোন্স। ১৭৮৩ সালে তিনি এ দেশে আসেন সুপ্রিম কোর্টের জজ হয়ে। তখন তিনি একজন ভাষাতত্ববিদ হিসেবে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে গেছেন। ইয়োরোপের সব ভাষাই তাঁর জানা ছিল। এ ছাড়া তিনি একজন Radical Political Thinker বলে খ্যাত ছিলেন। এ দেশে এসে তিনি সংস্কৃত ভাষা শিখে ফেললেন। ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেললেন ভগবৎ গীতা। তারপরে অনুবাদ করলেন অভিজ্ঞান শকুন্তলম , মনু সংহিতা, হিতোপদেশ , গীতগোবিন্দ ইত্যাদি। এ দেশের কিছু পণ্ডিতের সহায়তায় বেদ , জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন। এ ছাড়া এদেশের আইন , সঙ্গীত , সাহিত্য ,প্রাণীবিদ্যা, ভূগোল নিয়ে পড়াশোনা করে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তবে এ দেশে সবচেয়ে বড় কীর্তি হল ১৭৮৪ সালের ১৫ই জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করেন এশিয়াটিক সোসাইটি। এই সোসাইটিতে প্রাচ্য-বিদ্যাচর্চার সূচনা করে তিনি ভারতের ইতিহাসকে বিশ্বের অন্য সভ্যতার সঙ্গে যুক্ত করার প্রথম ধাপ তৈরি করে দিলেন, যা নিয়ে এই শহর এখনো গর্ব করতে পারে। মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়েসে ১৭৯৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি মারা যান। তিনি এই গোরস্থানে শায়িত আছেন।

আর একজন অদ্ভুত মানুষের কথা আমরা হয়ত ততটা জানি না। তাঁর নাম চার্লস স্টুয়ার্ট। আয়ারল্যান্ড থেকে তিনি বেঙ্গল আর্মির সৈনিক হয়ে এদেশে আসেন পরে কর্নেল পদে উন্নীত হন। তিনি এ দেশে এসে হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি এতটাই অনুরক্ত হয়ে পড়েন যে নিজে একজন হিন্দু রমণীকে বিবাহ করেন, ব্রিটিশ সৈনিকদের পাকানো গোঁফ রাখা আর রাজস্থানি পোশাক পরার জন্য এবং মেমসাহেবদের এদেশে এসে তাদের ধড়াচূড়া মার্কা পোশাক ছেড়ে সাড়ি পরবার জন্যে প্রচার আরম্ভ করেন। তিনি রোজ গঙ্গা স্নান করতেন এবং বাড়িতে নানা হিন্দু দেব দেবীর মূর্তি সংগ্রহ করে রাখতেন। স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজ মহলে তাঁর এই আচরণ কে ভালো চোখে দেখা হয়নি। অনেকে তাঁকে পাগল প্রতিপন্ন করারও চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে তিনি দমে যান নি। তাঁর স্পষ্ট মত দেন-

‘ The sari is the most alluring dress in the world and woman of Hindustan are enchanting in their beauty .

শুধু পোশাক আশাকই নয় তিনি হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক দিক নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন এবং একটি বই লেখেন যার নাম ‘Vindication of the Hindoo’ । এই বইয়ে এক জায়গায় তিনি লেখেন -

“Wherever I look around me, in the vast ocean of Hindu mythology, I discover Piety… Morality… and as far as I can rely on my judgment, it appears the most complete and ample system of Moral Allegory the world has ever produced.”

মন্দিরের আদলে চার্লস হিন্দু স্টুয়ার্টের সমাধি

তাঁর এই অস্বাভাবিক হিন্দু-প্রীতির জন্যে তাঁর একটি নাম চালু হয়ে যায়- চার্লস হিন্দু স্টুয়ার্ট। এই নাম তাঁর এপিটাফেও লেখা আছে। ১৮২৮ সালের ৩১শে মার্চ তিনি মারা যান। তাঁর হিন্দুপ্রীতিকে সম্মান জানিয়ে এই গোরস্থানে তাঁর সমাধি তৈরি করা হয় অনেকটা হিন্দু মন্দিরের ধাঁচে।

হিন্দুঘেঁষা আর এক সাহেব যাকে আমরা এন্টনি ফিরঙ্গি বলে জানি তিনিও প্রায় এঁর সমসাময়িক ছিলেন। একই রকম মনোভাবের মানুষ ছিলেন।কিন্তু এঁদের দুজনের দেখা হয়েছিল কিনা সে রকম কোনও তথ্য অবশ্য পাওয়া যায় না।

এ ছাড়া যারা শুয়ে আছেন এই এই কবরখানায় তাদের নিশ্চয় আলাদা আলাদা পরিচয় আছে। ছোটো খাটো কীর্তি আছে। এইখানে যারা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তাদের মধ্যে আইলমার, বারওয়েল, ম্যাকেঞ্জী, গর্ডন, ভানিস্টারট, টেম্পল্টন, গডউইন, জ্যাকসন , লারকিন্স , ওয়েলস, ওল্ডহ্যাম, গিবস ইত্যাদিদের উত্তরপুরুষরা হয়ত এখানে কখনো এসেছেন তাদের পূর্বপুরুষ কে শ্রদ্ধা জানাতে। রেখে গেছেন এক গোছা পুষ্পস্তবক।

***

‘গোরস্থানে সাবধান’ গল্পে লালমোহন বাবু এই গোরস্থানে এসে গোরস্থান লাগোয়া কিছু ফ্ল্যাট বাড়ি দেখিয়ে ফেলুদাকে বলেছিলেন আমাকে লাখ টাকা দিলেও এখানে থাকব না। তার কারণটা ছিল অবশ্যই ভূতের ভয়। ভূতদের এমন আদর্শ জায়গায় ভূত থাকবে না তা কেমন করে হয়! একটি সাইটে দেখলাম ভারতের most haunted place এর মধ্যে নাম আছে এই গোরস্থানের। অনেকে নাকি এখানে এসে অসুস্থ বোধ করেছেন। যারা এখানে ফোটো তোলবার চেষ্টা করেছেন তাদের অদের অনেকের নাকি শ্বাসকষ্ট হয়েছে।

এখানে একটি ছোটো পিরামিড আকৃতির কবরখানা আছে যেটিকে অনেকে ‘bleeding tomb’ বলে থাকে। তার কারণ বর্ষাকালে এখানে দেয়ালের গা দিয়ে রক্তর মত দেখতে কিছু নাকি চুয়ে চুয়ে পড়ে। এই কবরখানাটি এক ডেনিসন পরিবারের। এই পরিবারটি নাকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একজনের পর আরেকজন কোনও এক অজানা কারণে মারা পড়েছিল। হয়ত সেই জন্যেই এই কবরের সঙ্গে ভুতের গল্প জড়িয়ে পড়েছে।
আমরা অবশ্য এখানে এসে কোনও রকম অসুবিধার মধ্যে পড়িনি। দিব্যি সময় কাটিয়েছি। আমরা দেখেছি শীতের শেষবেলায় ফাগুনের শুরুতে রাশি রাশি শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে সমাধিগুলোর উপরে কোনও রকম বাছ বিচার না করে। শিরশিরে হাওয়ায় সঙ্গে গা ভাসিয়ে কবরের দুই সারির মধ্যের সরু সরু হাঁটা পথ দিয়ে ওড়া-উড়ি করে বেড়াচ্ছে শুকনো পাতা। ঠিক যেমন করে গত আড়াই শতাব্দী ধরে প্রতিটি ফাগুন মাসে ওরা এখানে ওড়া-উড়ি করে এসেছে এতকাল।

 

 



লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।