ফিসফাস কিচেন
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৬
ফিসফাস কিচেন- সিলেটী রান্না- বিলেতি রান্না
সৌরাংশু
এই কদিন আগেই গিয়েছিলাম কোলকাতা। বাড়ি যাওয়া চেনা পরিবেশ আড্ডা দেখা সাক্ষাত বুক ভরে সোঁদা গন্ধ নেওয়া ছাড়াও একটা হিডেন এজেণ্ডা ছিল। এই যে একখান কাজে হাত দিয়েচি না! না বললে বিশ্বাস করবেন না! জীবনে যা করি নি তাই করতে হচ্ছে! প্রচুর পড়াশুনো।
করতে করতেই টপাত করে মোশারফ আলির গল্পটা এসে গেল হাতের নাগালে। সিনেমার মতন পুরো। ১৯৩১ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে সিলেটের কুচাই গ্রাম থেকে মোশারফ কোলকাতা এলেন তারপর পাকে চক্রে গিয়ে পৌঁছলেন লন্ডন। এদিক সেদিক ছুটকো ছাটকা কাজ টাজ করে টরে ভবিতব্য তাঁকে টেনে আনল শালিমার রেস্তোরাঁয়। সেখান থেকে তাজমহল আর দরবার।
কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। মোশারফ পাড়ি জমালেন মার্চেন্ট নেভির পথে। ফিরলেন লন্ডনে আবার ১৯৪২-এ। এবারে সঙ্গে জুটল ইজরায়েল মিয়াঁ। রেস্তোরাঁর নাম হল অ্যাংলো এশিয়া! তারপর আর কি ভারতীয় হাইকমিশনের সহায়তা নিয়ে লাইসেন্স পেয়ে গেলেন। তারপরেও ভদ্রলোক প্রায় ১৮টা রেস্তোরাঁ খুলেছেন।
আর ইজরায়েল মিয়াঁ? তিনিও ১৯৩৭ লন্ডনে যান ভাগ্য অন্বেষণে কিন্তু ইংরাজি অক্ষর জ্ঞান ছিল না! কিন্তু তাও স্রেফ উপস্থিত বুদ্ধি আর অধ্যাবসায়ের জোরে লন্ডনে টিকে যান। আর যথাসময় মশারফের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আর বাকিটা ইতিহাস!
এবারেই কথা ওঠে! এই মোশারফ আর ইজরায়েল কে? ঠিকই ধরেছেন এরাই ব্রিটেনের বুকে কারি বিপ্লব আনয়নকারী সিলেটী রেস্তোরাঁর পূর্বপুরুষ। বা ঘুরিয়ে বললে এদের অ্যাংলো এশিয়াই প্রথম সিলেটী রেস্তোরাঁ!
তা সিলেটী রেস্তোরাঁ নিয়ে কথা বলব আর সিলেটে যাব না তা কি হয়?
গড়পড়তা বাঙালি, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের এবং উত্তরপূর্ব ছাড়া অন্যত্র বসবাসকারী বাঙালি কিন্তু সিলেট বলতে বাংলাদেশের একটি জেলা, যেখানের ভাষা অন্যদের মতই পূর্ববঙ্গীয় বাঙাল বলে জানে। কিন্তু আপনার যদি কোন শিলচরি বন্ধু থাকে তারে জিগান! কওন লাগভ ফাগোল! সিলেট বা শ্রীহট্টের ভাষা এবং সংস্কৃতি বাংলাদেশের অন্যত্রের থেকে আলাদা। বলা যেতে পারে বাঙলা আর রোহিঙ্গাদের মাঝামাঝি একটি ভাষা! তাকে বাঙালি বলবেন কি না তা আপনি জানেন! কিন্তু না বললেও কিস্যু আসে যায় না! সিলেটী একটা আলাদা ভাষা, সংস্কৃতি এবং কৃষ্টি... রামায়ণ শুনবেন?
“ওই যে পূর্বদিকে সূর্য উঠে বিয়ানবেলা!
ওই বংশর দশরথ রাজা বড় ভালা।।
করলা কপাল পুড়িয়া তিনটা বিয়া!
তেব হইল না তার এগুও পুয়া।।”
যান যান কত্তা বাঙ্গাল না কইও তারে! পুরোদস্তুর সিলেটী সে। তার অক্ষর নাগরি। তার নদী সুরমা, তার খাবার লাল, মুখ দিয়া লালা ফড়ফড়িয়া বাইরায়! বস্তুত, সিলেট বা শ্রীহট্ট প্রাচীনকাল থেকেই প্রাগজ্যোতিষপুরের অধীনে স্বাধীন অঙ্গরাজ্য হিসাবে ছিল। অহমীয়াদের আসার আগে থেকেই। চতুর্দশ শতক থেকে ইসলামী প্রভাব সিলেটে বিস্তার করতে শুরু করে, যা ভাষা, সংস্কৃতি এবং উপজীব্যতায় লক্ষ্য করা যায়। খাদ্যাভ্যাসেও!
আসলে এটার কথা ছিল কিচেন ফিসফাস হবার! কিন্তু ফটর ফটর কইরা ইতিহাস ফাঁইদ্যা ফিরস। আরে আরে ঠ্যারান দাও হে! আসুন একটি সিলেটী ডিশ ফট করে আপনাদের সামনে ফেলে দিই।
বিরিয়ানিতে সেই আখনি নিয়ে লিখলাম না? আসুন দেখি আখনি পুলাউ বানিয়ে।
পোলাওয়ের জন্য সুগন্ধি চাল ও গোরুর মাংস দিয়ে মূলত সিলেটী আখনি পুলাউ তৈরী হয়। কিন্তু খাসি বা মোরগের মাংসও ব্যবহৃত হয়। কানা উঁচু গভীর পাত্রে তেল গরম করে পেঁয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বাদামী করে নিন তারপর আদা রসুন বাটা দিয়ে নেড়ে নিয়ে, জায়ফল, দারুচিনি, জিরে, এলাচ, জয়িত্রী বাটা দিয়ে নাড়তে হবে। তেল উপরে উঠে এলে লেবুর রসে রাখা মাংস দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিয়ে নাড়তে হবে। মাংস সিদ্ধ হয়ে গেলে আগে থেকে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখা চাল দিয়ে কিছুক্ষণ ভেজে নিয়ে তারপর জল ঢেলে দিন। মনে রাখতে হবে চালের প্রলেপের দুই ইঞ্চি উপর পর্যন্ত জল দিতে হবে। এর পর ঢাকা দিয়ে মধ্যম আঁচে রান্না হতে দিতে হবে। জল শুকিয়ে এলে দম পদ্ধতিতে রাঁধতে পারেন। ডবল বয়লার পদ্ধতিতে। আর পোলাও বলে কথা। কিছু সব্জি যেমন, আলু গাজর বিন্স এমন কি আলুবোখরাও ভেজে এতে দেওয়া যায় স্বাদ বৃদ্ধির জন্য।
সিলেটের এক বিশেষ ধরণের লেবু পাওয়া যায়। যার পাতার গন্ধ সুন্দর। সিলেটী রান্নায় এর বিশেষ ব্যবহার আছে। এই লেবুটিকে সাতকড়া বলা হয়। যে কোন রান্নায় এই সামান্য তিক্ত ও টক ফলটির ব্যবহার রান্নাটিকে বরণীয় করে তোলে।
আসুন একটা সিলেটী রেজালা বানাই। এ রান্না অবশ্য বৃহত্তর সিলেটে মেজওয়ান বলেও পরিচিত। হাঁড়িতে তেল দিয়ে তেল গরম হলে এতে তেজপাতা, লবঙ্গ, দারচিনি দিন। তারপরে পেঁয়াজ কুচি দিন। পেঁয়াজটা বেশ লাল করে ভাজা হলে একে একে পেঁয়াজ বাটা, রসুন বাটা, আদা বাটা, হলুদ লঙ্কা ধনে গুঁড়ো, কাজু বাদাম পোস্ত বাটা, গরম মশলা গুঁড়ো, ,জিরে বাটা দিয়ে অল্প জল দিয়ে মশলা কষিয়ে নিন। এবার মাংস দিয়ে নাড়াচাড়া করে কষিয়ে নিন কিছুক্ষণ। এখন সাতকড়া (না হলে গন্ধরাজ লেবু দেবেন? ভেবে দেখুন) একদম মিহি করে কষানো মাংস -তে দিন,এবার মাংসতে টমেটো বাটা, নারকেল দুধ দিয়ে নাড়াচাড়া করে কম আঁচে রান্না করুন কিছুক্ষণ। তারপর মাংসটা নরম হয়ে সুন্দর কষানো হবে। তেল ছেড়ে দিলে নামিয়ে নিন। সুন্দর একটা লেবুর গন্ধ পাবেন মাংস থেকে। তারপর তো পরোটা বানাও রে আর পটাপট ওড়াও রে।
এইবার আসুন এবার একটু আগু বাইর্যা খ্যালি। শুটকি সিরা দিয়ে লাউপাতা মাছ। শুঁটকি মাছকে সিদ্ধ করে তার স্টকটি নিয়ে নিলে তা হল শুটকি সিরা। এটা বিনা তেলে রান্না! গন্ধ বর্জন করে যদি হাসের মতো দুধটুকু খেয়ে নিতে পারেন তাহলেই করুন। আলু বেগুন লম্বা লম্বা করে কেটে আর লাউপাতা কুঁচিকুঁচি করে কেটে গভীর পাত্রে দিন। সঙ্গে দিন পেঁয়াজ বাটা রসুন বাটা কাঁচা লঙ্কা আর ভুটজালোকার জাত ভাই নাগামরিচ দিয়ে তার উপর শুঁটকি স্টক দিয়ে সিদ্ধ করুন। মিনিট দশেক পর এতে রুই মাছের টুকরো (এটা কিন্তু শুঁটকি নয়) দিয়ে দু কাপ জল দিয়ে ঢাকা দিয়ে ঢিমে আঁচে রান্না করুন। সঙ্গে নুন হলুদ গুঁড়ো লঙ্কা গুঁড়ো তো রইলই। মিনিট পনেরো পর শুটকি সিরার ঝুল তইরি হইল্যা। ভাত দিয়ে মেখে খেয়ে ফেলুন।
আর একটা? টম্যাটো দিয়া মাছের খাট্টা! এটাও খাস সিলেটী রান্না! তবে লন্ডনের কারি রেস্তোরাঁগুলিতে এটা পাবেন না! পাতিলায় তেল দিয়া মাস বিরান করুন! হাল্কা ভাজা হইলেই অইব! এরপর সেই তেলে কাঁসা মরিস সাইর্যা রসুন বাটা দিয়ে বিরান করুন। তারপর পেঁয়াজ বাটা দিয়া দশ মিনিট বিরান করুন। তেল উপরে সলে আইলে বেশীমাত্রায় কাঁসা টম্যাটো দিন। শ্যাষে টম্যাটো সিদ্ধ হইয়া আইলে মাস সারুন। আর লবণ অলদি মরিস গুঁড়া দিয়া ফরিমান মত ফানি দিয়ে রান্না করুন। ফনরো মিনিট ফর মাসের খাট্টা ফ্রস্তুত।
অবশ্য সিলেটের হিলটি রান্না হিদল মাছ ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। পুঁটি মাছ বা সিদল মাছের শুঁটকি বড়া, ভর্তা বা চাটনি সিলেটী সমাজের প্রতিচ্ছবি। সারা বিশ্বের সিলেটী সম্মেলনে হিদল মাস না অইলে বয়কট অই যাবা।
ভর্তা বা চাটনির ক্ষেত্রে বেশি বেশি করে পেঁয়াজ রসুন দিয়ে নেড়ে বাদামি হলে হলুদ লঙ্কা আর নুন দিয়ে শুঁটকি দিয়ে দিন। তারপর কষতে থাকুন। মাখো মাখো হলে নামিয়ে ফেলুন। তারপর শিলে বেটে নিন! তারপর আর কি! গরম ভাত দিয়ে হুলুশ। তবে লঙ্কার পরিমাণ একটু বেশি না পড়লে জমবে না বলে রাখলাম! আর রান্নার সময় গ্যাসমাস্ক, এয়ার ফ্রেসনার, অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে রাখবেন, না হলে? লিপ্টনের বিজ্ঞাপনে মুনমুন সেন- “সুন্দর গন্ধ... ভোলা যায় না!
আর বড়া? কুমড়ো পাতায় হিদোল মাছ পেঁয়াজ, থেঁতো করা রসুন, নুন, লঙ্কা বাটা মুড়ে তাকে চালগুঁড়ির ব্যাটারে চুবিয়ে ভাজা। এ ছাড়া সিলেটী রান্না জমে নাকি। ও সিলেটী হিঁদু বাড়ির রসুন পেঁয়াজ ছাড়া নিরামিষ পাঁঠার মাংসর কথাই বা ভুলি কেমন করে!
এসব তো গেল সিলেটের সিলেটী রান্নার কথা। ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে সুরমা হয়ে নেমে এসে মিলিয়ে দিয়ে যায় যে সম্পর্কের কথা। কিন্তু বিলেতে এই কারি বিপ্লব হলই বা কি করে?
সিলেটের নুরুল ইসলাম মহাশয় গবেষণা করে দাবী করছেন লন্ডনে প্রথম ভারতীয় খানার আমদানি করেন সিলেটী সৈয়দ তফুজ্জুল আলির। ভিক্টোরিয়া ডক রোডে একটি ক্যাফে খোলেন যেখানে আর সব কিছুর সঙ্গে পাওয়া যেতো ভাত ও কারি। এ কারি কিন্তু ওই মাসের ঝুল নয়। এ কারি খানিক উত্তরভারতীয় খানিক বাংলাদেশি আর খানিক না জানি কোন মাতৃভূমিকে ছেড়ে আসার বেদনা।
এর পরে আরও এদিক সেদিক খুচরো খাচরা ভারতীয় রেস্তোরাঁ চলতে শুরু করে। কিন্তু অ্যাংলো এশিয়াই প্রথম সিলেটী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁ। তা সে রেস্তোরাঁ চালাবার আগে মোশারফ ও ইজরায়েল উভয়কেই লড়াই কম করতে হয়নি।
ইজরায়েলের একটি গল্প আপনাদের বলি শুনুন। লন্ডনের জেরার্ড প্লেসে ইজরায়েল মিয়ার ইণ্ডিয়া কফি বার। যুদ্ধের মধ্যেই দুই মার্কিন টমি খেয়ে দেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যাচ্ছিলা। মিয়াঁ ডেকে আনলেন তাদের। দরজায় তালা! দুই টমি তো খেপে গিয়ে গাল মন্দ করে বলল নিগারদের রেস্তোরাঁয় খেয়ে তারা পয়সা দেয় না। সাদা আদমি খানাপিনা করেছে এতেই কত সম্মান বৃদ্ধি হয়েছে! ইজরায়েলও দমবার পাত্র নয় কিচেন নাইফ হাতে নিয়ে রুখে দাঁড়াল। টমিগুলো বার করল বন্দুক। ইজরায়েল বলে উঠল, সাত সমুদ্দুর পেরিয়ে এখানে এসেছে সে, ভয় ডর সব ভূমধ্যসাগরে পানিতে মিশিয়ে এসেছে। টমিরা মুগ্ধ হয়ে ১৩ শিলিং-এর বিলে এক পাউণ্ড দিয়ে পিঠ চাপড়ে দিয়ে গেল। এ যেন সেই আলেকজান্ডার আর পুরুরাজের গল্প, বন্দীর সঙ্গে কেমন ব্যবহার আশা কর? জবাব এল, রাজার সঙ্গে রাজার মত! আইলা! মর্দ কো কভি দর্দ নহি হোতা বাবুজি, নফরত সে নেহি পেয়ার সে ডর লাগতা হ্যায়।
তা এসব তো গেল অ্যাংলো ইণ্ডিয়ার গল্প, কিন্তু বাকি সিলেটীদের রান্নাঘরই কি করে ছড়িয়ে গেল বিলেতময়? ইতিহাস দেখে নাম ধাম কাম লেখার অনেক বই পাবেন, আসুন আসল কারণটা খুঁজি! আসলে সাহেবরা খাবার বলতে ছুটকো ছুটকো ‘ফাইন’ (ব্ল্যাণ্ডও বলতে পারেন অবশ্য) ফ্লেভার নিয়ে কাজ কারবার করত। কিন্তু শীতের দেশে টাক গরম করা খাবার খেয়ে চরম আনন্দ পাবার কথা তারা আবিষ্কার করে ভারতীয় ঝাল ঝাল লাল লাল লালা ঝরানো রান্নাতেই। কিন্তু পাবে কোথায়? ভারতীয় বলতে গুজরাটি, আর তাদের রান্নায় আর যাই হোক চলে ফেরা জিনিসপত্রের বড়ই অভাব! মিষ্টি দিয়ে সৃষ্টি করা কৃষ্টি তাতে টাকে চুলকুনি হতে পারে কিন্তু বুজগুরি ঘামের সম্ভাবনা নেই! অথচ পোড়ার আইল্যান্ডে ৯ মাসই অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। তাহলে আর কি! সিলেটী গরীব মানুষগুলো যারা টু পাইস রোজগারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল টেমসের তীরে তাদের হাত ধরেই এসে গেল কারি বিপ্লব। ভারতীয় রান্না কিন্তু বাংলাদেশী বা আরও পষ্ট করে বললে সিলেটী হাতে। বিলেতে কারির নাকি তিন প্রকারঃ হট, ভেরি হট এবং সুইসাইড। শাহরুখ, সলমন এবং হৃত্তিক/ জন। অথবা অন্যভাবে বলতে গেলে, নাহ মহিলাদের ঠিক আলাদা করে দেখা যায় না! সকলেই এক একজন মূর্তিমান রূপকথা! হটনেস কোসেন্টে আবার মাপব কি ভাবে হে?
যাই হোক, আসল কথা হল লাল ঝাল দেওয়া তথাকথিত ভারতীয় সিলেটী রান্না যে ব্রিটেনকে পকেটে পুরে ঘুরছে, তা তো আমাদের উপমহাদেশেরই জয়। খামোখা আমরা ওরা করে কি হবে বলুন দিকি!
চিকেন টিক্কা মশালা! আসমুদ্রহিমাচল কক্ষনও দাবী করতে পারবে না যে এটা তারা ভেবেছে! কিন্তু ব্রিটেনের কারি বিপ্লবের কাণ্ডারি সিলেটী রেস্তোরাঁগুলো মুঘলাই চিকেন টিক্কা আর নিজস্ব কারি মশলার মিশ্রণে চিকেন টিক্কা মশালা তৈরী করে ব্রিটেন জয় করে ফেলল। সে সব নিয়ে না ভেবে আসুন না হয় নিজের তৈরী চিকেন টিক্কা মশালার রেসিপি দিয়ে দিই।
আরে রেসিপি কি গল্প বলি বলুন! সে ছিল আনন্দমেলার সময়! লাচ্চা পরোটা আর চিকেন টিক্কা মশালা! আদতে যার পিতৃ পরিচয় নেই! স্রেফ অরণ্যদেবের মত ছদ্মনামে বিচরণ করছে।
রান্না হবে বুধবার, তাই সোমবার পাঁচকিলো বোনলেস চিকেন কিনে দই পুদিনা ধনেপাতা কাঁচালঙ্কা রসুন পেঁয়াজ আদা বাটার থকথকে সমুদ্রে চুবিয়ে রাখলাম। মঙ্গলবার রাত্রে শিকে গেঁথে গেঁথে প্রত্যেকটিকে তন্দুরে ছুঁইয়ে মানুষ করে তুললাম। তারপর পেয়াঁজ গরম মশলা আদা রসুন লাল লঙ্কা ধনে জিরে আর টম্যাটো বড় বড় করে কেটে সাদা তেলে ভাল করে কষে নিয়ে মিক্সিতে ঘুরিয়ে কম আঁচে পেস্টটিকে বসালাম তরিবৎ করে। পরিমাণ মতো জল দিয়ে একে একে টিক্কাগুলোকে সাজিয়ে রাখলাম বিরাট সুইমিং পুলের মতো ডেকচিতে। তারপর থেকে থেকে ঝোল তুলে টিক্কার উপর ফেলা আর জল কমে গেলে একটু একটু করে ঝোল বাড়ানো। আর কি।
আর কি! এরপর দুর্গা পুজোর পঞ্চমীতে আনন্দমেলায় এক ডেকচি ভর্তি টিক্কা মশালা আর অপর দিকে লাচ্চা পরোটার ডালা নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসলাম। সুপারহিটের বাবা সায়গল, ভিড় সামলানো যাচ্ছে না। বিচারক এসে ভ্রু কুঁচকে উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতে শুরু করল। উত্তর দেবার সময় কই! খরিদ্দার আমার দেবতা! তার উপর এক প্রীতি জিনটা পনেরো মিনিট ধরে লাচ্চা পরোটার অপেক্ষায় (কে জানে আর কিসের অপেক্ষা! আমার মোটা মাথায় যা ঢুকলও তাই বললাম আর কি!) দাঁড়িয়ে আমার তপস্যা ভঙ্গ করছিল। তা বিচারককেও বলে বসলাম এখন সময় নেই! ব্যাস কচাত করে নম্বর কেটে নিল! আর তাতে আমার ভারি বয়েই গেল!
যাই হোক গল্প থাক- রেসিপিতে আসি! ভেরি হট করতে গেলে একেই কামসিন লঙ্কা গুঁড়োর আবিরে মাতিয়ে দেবেন রঙ বরষে! আর লাচ্চা পরোটা তো অন্য গল্প! কোনদিন আবার আসব তা নিয়ে।
তার থেকে চলুন একবার সুরমা নদীর ধারে ঘুরে আসি হাওয়া খেতে। এতো তেলে ঝোলে চুবিয়েছি লেখাটাকে। আলটিমেটলি হাতে যে পেন্সিলের জায়গায় টিক্কা মশালা এলো এই বা কম কি!
(ঋণ স্বীকারঃ শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক শংকর এবং আমার দিদি শ্রাবণী ব্রহ্মচারী)
লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।