ফিসফাস কিচেন
অগাস্ট ১৫, ২০১৬
ফিসফাস কিচেন- চা শিঙাড়া ইত্যাদি
সৌরাংশু
ছোটবেলায় আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমার চা খাবার অনুমতি ছিল না। তারপর যখন একটু বড় হলাম তখন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে একটু আধটু চা মুখে পড়েছিল বোধহয়। তবে সঠিকভাবে চা খেতে শুরু করি মাধ্যমিকের পরে। মানে আমার ক্ষেত্রে চাপানের যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিক পাশ।
আমাদের বাড়িটা এমনিতে মধ্যবিত্ত হলেও একমাত্র চায়ের বিষয়ে একটু আধটু সৌখিনতা চলত। দার্জিলিং-এর শুকোনো পাতাগুলো যখন ফুটে যাওয়া গরম জলে পড়ে চুপ্পুড় হয়ে ভিজত আর মিনিট তিনেক পরেই কাপে কাপে জীবনদায়ী ঔষধের মতো পরিবেশিত হতো সুগন্ধি চা। চিনি দিলে দিন, দুধ নৈব নৈব চ। মাথা খারাপ নাকি? চায়ের ফ্লেভারটাই তো মার্ডার হয়ে যাবে।
মাঝে মাঝেই বাবা বাজার থেকে ফেরার পথে নন্দবাবুর দোকানের জিলিপি নিমকি আর শিঙাড়া নিয়ে আসতো। আমার কেন জানি না, আলু ফুলকপি বাদাম দিয়ে করা মনোলোভা শিঙাড়ার থেকে তখন খাস্তা কালো জিরে দেওয়া নিমকি খেতে ভালো লাগত। ডালডায় ভাজা হলেও গায়ে জবজবে তেলের লেশমাত্র থাকত না তার। এরপর পা একটু বাড়ার পর এদিক ওদিক একা, বন্ধুদের সঙ্গে পা বাড়ানো বাড়তে থাকলো...
আর তখনই হল রাস্তার ধারের বেঞ্চির চায়ের সঙ্গে পরিচয়। ক্যান্টিনের চা তো ছিলই, কিন্তু তারপরেও খুঁজে পেতে সুস্বাদু চায়ের দোকান খুঁজে বার করা হবি হয়ে গেল। খেলাধুলোর চক্করে চায়ে চুমুক তখন দু কাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু চায়ের সঙ্গে প্রেমটা তখন বোধহয় শুরুই হয়ে গিয়েছিল।
ট্রেনে যেতে যেতে মাটির গন্ধওলা ভাঁড়ের দু তিন চুমুকই ক্লান্তি ভুলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিল। আর সাউথ ইস্টার্নের কোন সফরে সঙ্গী হতো ফটাসজল। পিন দিয়ে ফট করে গুলি ঢুকিয়ে ভ্যানিলা স্বাদের সোডার স্বাদ নিতে তখন কি দারুণই না লাগত।
আমার মাসতুতো দাদার বন্ধুর বাড়ি ছিল পাঁশকুড়া লাইনে। তার দিদির বিয়েতে একবার ফুল লটবহর নিয়ে হাজির হলাম। পাঁশকুড়ার শিঙাড়া বলতে লোকে অজ্ঞান সত্যি বলতে কি আলু সেদ্ধকে ময়দার মোড়কে মুড়ে শালপাতায় পরিবেশনের মধ্যে কোন দেখনদারি নেই কিন্তু ট্রেনের হাওয়ায় এমন কিছু থাকে যা সেই আলুর চপ শিঙাড়াকেই চেটেপুটে খেতে আকুল করে দিত
তা সেই বিয়ে বাড়িটা আমাদের কাছে অত্যাশ্চর্য কিছু ছিল। পুকুরের মাছ থেকে দই মিষ্টি সব তাজা তাজা। একটু দই বা একটু রসগোল্লা খেতে চাইলেই এক হাঁড়ি এগিয়ে দেওয়া। সে সব পেরিয়ে মনে থেকে যায় আলপথ বেয়ে সাইকেল চালিয়ে ঘাটাল রাজপথের ধারে বাঁশের মাচায় বসে খুপরির চায়ে সুখটান।
বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময় সন্ধ্যাবেলা বীণা সিনেমার গায়েই একটা মিষ্টির দোকানে গরম গরম শিঙারা ভাজত। বন্ধুদের সঙ্গে সেখানে দুটো করে শিঙাড়ার অর্ডার দেবার পর শর্ত থাকত যে নিজের প্লেট শেষ করতে পারবে সে অন্যের প্লেটে হাল্লা বোল করতে পারবে। কেমন করে জানি না গরম শিঙাড়া খাবার টেকনিকটা রপ্ত করে ফেলেছিলাম অতএব। বন্ধুদের মুখে ছাই দিয়ে দুইয়ের জায়গায় তিন চারটে শিঙাড়া প্রতিদিনই পেটে যেত। তবে কি না তখনো খেলাধুলোর মধ্যে ছিলাম বলে হজম করে ফেলতেও দেরী হতো না।
শীতকালে ক্রিকেট সিজনে আমার প্রিয় ছিল পাশ বালিশের মতো তন্দুরি রুটি আর স্টু। আর প্র্যাকটিসের শেষ চার পিস পাঁউরুটি দিয়ে ডবল ডিমের ডবল সাইডেড পোচ। এখনকার ছেলেপুলেরা হয়তো মাঠে ময়দানে অনেক পুষ্টিকর খাবার পায়। কিন্তু আমাদের সময়ে সেটাই ছিল স্টেপল ডায়েট।
চা চলত, কিন্তু দুধ ছাড়া। তারপর যখন গাঁ উজিয়ে দিল্লিতে এসে ঘর বাঁধলাম তখন বছরে দুবার ঘরে ফেরার সময় রামপিয়ারী চা ট্রেনে উঠলেই যেন বুঝতে পারতাম আমার দেশে পৌঁছে গেছি। তারপর লেবু আর বিটনুন দেওয়া লাল চা পেরিয়ে বাড়ি।
দিল্লিতে এসে এক অদ্ভুত ধরণের চা দেখলাম। তাতে কিরকিরে মিষ্টি আর দুধের আধিক্য। মালাই মারকে, চিনি ডালকে গরম লস্যিকেই চা হিসাবে পরিচয় দেবার জন্য সিটিসি দানা চাকে বেশ করে ফুটিয়ে নেওয়া। তাতে আবার গরম মশলা দিয়ে স্বাদ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা। যত বেশী দুধ আর চিনি, তত তার কদর বেশী, ইস্পেশাল চায়ে। হরিয়ানাতে তো তারা আবার দু চামচের কমে চিনি ঢালেই না। তারপর বরফি বা মণ্ডা সহযোগে চা সেবন।
কলকাতার কড়ক চায়ের স্বাদ এখন ভাঁড়হীন হয়ে ভারহীন প্লাস্টিকের কাপে ঠেকেছে। তাতে জিভের তেষ্টা মেটে কিন্তু মনের নয়।
কফির সঙ্গে আমার প্রেম কন্যাকুমারীতে মধ্য নব্বই দশকে। কন্যাকুমারীর বিবেকানন্দপুরমে ফিল্টার কফি দুধ আর চিনি ছাড়া মুখে এক অদ্ভুত তিক্তমধুর স্বাদ রেখে যেত। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পর হৃদয় ও ত্বকের কারণ দেখিয়ে কেন জানি না ব্ল্যাক কফির শখ ছাড়তে হয়েছিল।
পরবর্তীকালে, বিভিন্ন কফিশপের রমরমার মধ্যে ফিল্টার কফি প্রেমটা আবার ফিরে আসে। নীলগিরির বুকের কফি বিনসের গুঁড়ো যখন কাপড়ের পুঁটুলি বেয়ে গরম ভাপে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামতে থাকে তখন যে কি অমৃত তৈরী হয়, মনে হয়। মুখে এক চুমুক নিয়ে বসে থাকি আর সে মুখ থেকে মন ছুঁয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাক। যাই হোক, দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে কফি সেবনের সুখটা পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে।
ও হ্যাঁ, একবার লীলা মজুমদারের গুপী পানু আর সত্যজিতের গ্যাংটকে গণ্ডগোল পড়ে খুব ইচ্ছা হয়েছিল যে তিব্বতী চা খেয়ে দেখি। শোভাবাজারের মিত্র কেবিনে বসে মাখন আর নুন দিয়ে চা খেতে যে কি মরমিয়া হয়েছিল তা আর কি বলি।
যাই হোক, কোলকাতা যাবার একটা কারণ থাকে এখন বাৎসরিক চায়ের ভাণ্ডার ভরার জন্য। সেই সুবোধ ব্রাদার্স, পাল টি হাউস, মকাইবারি পেরিয়ে পাড়াতুতো এক চায়ের দোকানে রত্নভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া এবং তার ষাণ্মাসিক খননের মাধ্যমে চাপ্রেম জিইয়ে রাখা। কফি তো নীলগিরি বেয়ে মাঝে মধ্যেই চলে আসে কিচেন ক্যাবিনেটে। বাঙালীর সঙ্গে নেশার একটা যোগ আছে বটে, তবে পরিমাণ মতো চা বা সীমিত কফিতেই যদি তা আটকে রাখতে পারা যায় তাহলে কেয়া বাত মিয়াঁ।
প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ শিঙাড়া নিয়ে তো লেখাই হল না। শিঙাড়ার হিন্দি সামোসা হলেও সামোসার বাংলা কিন্তু শিঙাড়া নয়। আলু টুকরো টুকরো করে গরম মশলা ফুলকপি নারকোল বাদামে জারিয়ে নিয়ে ময়দার খামে ভরে মুখবন্ধ চিঠিকে সাদা তেল বা ডালডায় ভেজে তোলা যে অমৃত তার সঙ্গে কি সেদ্ধ আলুতে গোটা ধনে আর শুকনো লঙ্কার চমকানির তুলনা চলে? সে যতই পনির, কিসমিস আর কাজুর টুকরো দিয়ে ইজ্জত বাড়াবার চেষ্টা করা হোক না কেন?
প্রয়োজনহীন পুনশ্চ ২- চা আর শিঙাড়া নিয়ে আরও বড় করে লেখা না হয়ে পরেই আসছে। ততক্ষণে খাস্তা কামড়ের সঙ্গে একটু আধটু চুমুক চলতে থাকুক।
লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।