প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ফিসফাস কিচেন

অগাস্ট ৩০, ২০১৬

 

ফিসফাস কিচেন- চাপানেই স্বর্গ  

সৌরাংশু


চেনা বাস, চেনা রুট
চেনা রুটি বিস্কুট
চেনা চেনা চায়ের গেলাস
চেনা সিগারেট খাওয়া
চেনা পথে হেঁটে যাওয়া
চেনা ছবি স্বপ্নের লাশ...

ইনফ্যাক্ট সুমনকে নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছিল চায়ের পেয়ালায়। সালটা সেই ১৯৯০। কালীপুজোর সময় মানিকতলা হাউজিং এস্টেটের পাশের চায়ের ঠেকে গ্লাস হাতে বসেছি। গানটা ভেসে এল... ‘কে রে?’ ‘সুমন চট্টো’। তারপর কফি হাউসের আড্ডা পেরিয়ে বাঙালির হাতে হাতে পৌঁছে গেল পঞ্চাশ পয়সা একটাকা দুটাকা পাঁচটাকা খুব বেশি হলে দশটাকার স্পেশাল চায়ের গ্লাস বা ভাঁড়।

না পাহিলে যারে চাওয়া যায়
না চাহিলে যারে পাওয়া যায়...

সেই চা কিন্তু আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের একমাত্র বিলাসিতা! দার্জিলিং ডবল ফ্লাশ বা অধুনা এক হাফডাস্টের চা কেমন জানি ছেলেবেলার জমানায় নিয়ে চলে যায়। চা নিয়ে রোমান্স তো হয়েই গেছে, এবার বরং একটু কচকচিতে যাই!

বাচ্চা বাচ্চা জানতা হ্যায় কে চায়ের প্রথম স্বাদ গ্রহণ চীনদেশেই হয়। চীনে চায়ের নামকরণও হয় বটে। ম্যান্ডারিন ও ক্যান্টনিজ ভাষায় ‘চা’কে চা বলেই ডাকা হত। কারণ তখনও বিদ্যাসাগর মহাশয় লেখেন নি যে কানাকে কানা বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিও না। অথচ চীনের দক্ষিণ পূর্ব উপকূলের হোক্কাইয়ান চৈনিক ভাষায় চাকে ডাকা হত ‘টেহ’ বলে। সেই থেকেই বোধয় ইংরাজি টি, স্পেনীয় টে, জার্মান টী এবং ডাচ থী।

আর যদি উৎসের কথা ধরি তাহলে উত্তর মিয়ানমার এবং দক্ষিণ পূর্ব চীনের সিচুয়ান এবং ইউনান প্রদেশে চায়ে জন্ম বলেই ধরে নেওয়া হয়। চৈনিক জনশ্রুতি বলছে যে, হান বংশের রাজা রাজড়ারা ক্যামেলিয়া সিনেন্সিসের নির্‍্যাস গ্রহণ করতেন। তা সে খৃষ্টজন্মের দুশো বছর আগের কথা!

কথিত আছে যে চিনের সম্রাট শেনং একদিন গরম জল খাচ্ছিলেন। কারণ হজমের গোলমাল এবং ইত্যাদি ও প্রভৃতি। তা সেই সময় কয়েকটি পাতা উড়ে এসে তার পাত্রে পড়ে। কল্পনা করে দেখুন পাঠক পাঠিকারা, মন্দ মন্দ হাওয়া বইছে, বাতাসে সোঁদা গন্ধ মাটির, পাখিদের কলকাকলির মাঝে ২৭৩৭ খৃষ্টপূর্বাব্দে সম্রাট চেনং চুমুক দিচ্ছেন চীনেমাটির পাত্রে, কুসুম কুসম গরম জল থেকে হালকা হালকা ধোঁয়া বেরোচ্ছে, এই সময় বায়ুর তরণী বেয়ে কয়েকটি প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পাতা বিশাল বিশাল চৈনিক জানালা দিয়ে উড়ে এল! আর পড়বি তো পড় সম্রাটের পাত্রেই! সম্রাটের সেদিকে নজর ছিল না! তিনি তখন পিড়িং পিড়িং চৈনিক বাদ্যযন্ত্রের আনন্দ উপভোগ করছিলেন আর কি না কি ভাবছিলেন! দিলেন সুরর করে এক চুমুক! আর এক চুমুকেই চমক! জল তো একদম সুগন্ধী হয়ে গেছে! অন্য পৃথিবীর স্বাদ নিয়ে আসছে! তাকালেন পাত্রের দিকে! দু চারিটি ভিজে যাওয়া পাতা লজ্জাবতী হয়ে জলের মধ্যে ভাসতে ভাসতে আনত চোখে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে! আহা প্রথম দর্শনেই প্রেম! ওয়াহ!

এছাড়াও চৈনিক জনশ্রুতি বলছে, যে কৃষির দেবতা প্রতিটি পাতা কন্দ মূল চিবিয়ে দেখতেন যে তার মধ্যে ভেষজ উপাদান আছে কি না! যদি তা করতে গিয়ে বিষময় কিছু মুখে চলে গেল তাহলে তার প্রতিরোধক হিসাবে চা পাতা চিবিয়ে নিতেন তিনি!

এর পর তো চা চীনের জীবন যাপনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। ওয়াং বাও রচিত হান বংশের নতুন প্রজন্মের জন্য নির্দেশিকায় লেখা ছিল, ‘তারা চা ফুটিয়ে পাত্রে ভরবে” আর “উওয়োউয়ং থেকে চা কিনবে!” হুঁ হুঁ বাওয়া, সাদে কি কম্যুনিজম এদ্দিন ধরে চীনে পথ চিনে চলতে পারছে?

চা কিভাবে খাওয়া হতো তারও বেশ পদ্ধতিগত পার্থক্যের ইতিহাস রয়েছে! শুরুতে তাং বংশের রাজত্বে চা ফুটিয়ে নিয়ে বেটে কেকের মতো তৈরী করা হত। পরে সং বংশের রাজত্বের সময় পাতাগুলিকে এমনি ভিজিয়েই তার নির্যাস খাওয়া হত। শুকিয়ে নিয়ে চা তৈরী করা আরও পরে। পাতাগুলো রোস্ট করে নিয়ে তা শুকিয়ে নিয়ে পরে ভিজিয়ে খাওয়া হত।

মোটামুটি পঞ্চদশ শতকে উলঙ চা তৈরী শুরু হয় যেখানে পাতাগুলোকে অর্ধেক শুকিয়ে নিয়ে রোস্ট করে নেওয়া হত। তবে ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ইউরোপে চায়ের প্রসার হতে শুরু করে এবং ইউরোপীয়রা হলদে সবুজ ওরাংওটাং চায়ের বদলে পুরোপুরো শুকিয়ে  তা ভিজিয়ে নিয়েই খেতে পছন্দ করতে শুরু করে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং ইংরাজরাও তাদের স্যাঁতস্যাঁতে জীবনে চায়ের স্বর্গীয় স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করে। অস্টদশ শতাব্দীর শেষার্ধ্বে অ্যামেরিকার ইতিহাসের সোনার পাতায় চিরদিনের জন্য চায়ের প্রবেশ ঘটে যায়। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে সুবিধা প্রদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার চা আইন, ১৭৭৩ নিয়ে আসে ফলে ইস্ট ইণ্ডিয়ার গুদামে রাখা চা তারা অ্যামেরিকায় রপ্তানী করার নির্দেশ পায়। কিন্তু ইতিমধ্যেই টাউন্সেন্ড ট্যাক্সের ভারে জেরবার অ্যামেরিকীয়রা প্রতিবাদ স্বরূপ ১৭৭৩-এ বোস্টনের বন্দরে দাঁড়ানো চা নিয়ে আসা জাহাজে হামলা করে সব চায়ের পেটি জলে ফেলে দেয়। এর ফলে যে টেনশন শুরু হয় তারই ফলশ্রুতি অ্যামেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, যা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ১৭৭৬এর ৪ঠা জুলাই, যখন ১৩টি অ্যামেরিকান কলোনিয়ান প্রদেশ নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে।

তা সেই বোস্টন টি পার্টি পেরিয়ে আজকের হাই টি আর চা চক্র চাকে দরে উঠিয়ে নিয়ে গেছে বটে। কিন্তু বাঙালির কাছে চায়ের আবেদন সেই পল্টুদার দোকানের বেঞ্চিতে একটি তিন ইঞ্চির ভাঁড়ে অথবা উত্তর বাংলার টি এস্টেটগুলোতেই।

চাগাছের রকম ফের মোটামুটি তিনপ্রকার। চীন, তিব্বত, জাপান ও উত্তর ভারত এবং এখন তো সারা বিশ্বজুড়ে ছোট পাতার চা গাছ যার পোশাকি নাম ক্যামেলিয়া সিনেন্সিস, যা প্রধানত উচ্চতর পার্বত্য অঞ্চলে হয়। সিনেন্সিস আসামিকা বা আসাম চা, যা উত্তর পূর্ব ভারত এবং চীনের সিজুয়ান ও ইউনান প্রদেশে হয়, যার পটা একটু বড় হয়। আর শেষ মেশ কম্বোডিয়ান চা, সিনেন্সিস পার্ভিফ্লোরা না ঘরকা না ঘাটকা পাতা অর্থাৎ না ছোট না বড়। আর দার্জিলিং? না না এটা অন্য কিছু না, ওই ক্যামেলিয়া সিনেন্সিসই বটে তবে এর জন্য একটু পরে একটু বড় করে জায়গা ছাড়তে হবে কেমন?

তার থেকে আসুন বিভিন্ন দেশের চাপান উতোরের সম্পর্কে একটু খোঁজ নিই! তবে তারও আগে চায়ের ভ্যারাইটিগুলো তো জানি”

কালো চা বা ব্ল্যাক টিঃ  চা পাতাগুলিকে মুড়ে নিয়ে সবথেকে বেশী সময় ধরে শুকোতে হয়। ফলে এর মধ্যে অক্সিজেন প্রবেশ করেও প্রচুর এবং চায়ের স্বাদ সব থেকে কড়া হয়।

ডার্ক টি বা চায়ের কেকঃ এটি চীনের সিচুয়ান এবং হুনান প্রদেশের প্রোবায়োটিক চা, যা বহুদিন ধরে সংরক্ষিত করা হ অয়।

গ্রীন টি বা সবুজ চাঃ গ্রীণ টিকে সবচেয়ে কম সময়ের জন্য শুকোতে দেওয়া হয় এবং তারপর দ্রুত সেঁকে নেওয়া হয়। ফলে ক্যাফিন খুব বেশী জমতে পারে না এবং স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী।

উলং চাঃ গ্রীন টি এবং ব্ল্যাক টিয়ের মধ্যেকার অবস্থা। গ্রীন টির মতো হালকাও নয়, আবার ব্ল্যাক টির মতো কড়াও নয়। মাঝামাঝি স্বাদ ও গন্ধ, যাকে তাজা ফল বা ফুলের গন্ধের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

সাদা চা বা হোয়াইট টিঃ সর্বাধিক মনোরম স্বাদের চা। একদম কচি অবস্থায় এর চা গাছের কাণ্ডগুলিকে নিয়ে শুকিয়ে নিয়ে খুবই কম তাপমাত্রায় খুব কম সময়ের জন্য জলে ভেজানো হয়। অত্যন্ত মনোরম স্বাদ এবং স্বাভাবিক মিষ্টত্ব নিয়ে উপস্থিত হয় এটি।

এছাড়াও হার্বাল টি, পু-এর টি এবং বিভিন্ন ফ্লেভারড টি আছে।

এবারে ভিন্ন ভিন্ন দেশে চা পানের হিসাব কিতাব। সেক্ষেত্রে স্বভাবতই সবার আগে আসবে চীনঃ চীনের সমাজ এবং সংস্কৃতিতে চায়ের গুরুত্ব অপরিসীম তার ফলে চীনের পথেঘাটে টি হাউস হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়।  চা খাওয়াটা সামাজিকতার প্রতীক। চীনে চতুর্দশ শতকের শেষ দশকের আগে পর্যন্ত চায়ের কেক তৈরী করে তা ভিজিয়ে খাওয়া হত। মিং বংশের সময় থেকেই টিকেকের জায়গায় চা পাতা চায়ের রস আস্বাদনের মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে।

চীনের টি সেরিমনি বা চা উৎসব একটি বিশেষ সামাজিক উৎসব। যদিও এটি অষ্টদশ শতাব্দীতে জাপানী টি সেরিমনিকে নকল করেই রূপায়িত হয় নাম হয় গুংফু টি সেরিমনি। যেখানে টি মাস্টার সঠিক তাপমাত্রা নির্ণয় করবেন ফুটন্ত জলের এবং কি কি চা পাতা কত কত মাত্রায় ব্যবহার করা হবে, তার।

প্রথমে চায়ের জন্য ব্যবহৃত পাত্র ও চায়ের কাপ গরম জল দিয়ে জীবাণু মুক্ত করে নিতে হবে। এই পদ্ধতির নাম হল ‘ওয়েন হু তাং বে’। পরবর্তী পদক্ষেপ হল সঠিক চা বেছে নেওয়া। এর নাম ‘জীয়ান শ্যাং জিয়ামিন’। এরপর ‘উলং রু গং’ অর্থাৎ কালো ড্রাগনের পাত্রে প্রবেশ! এই ক্ষেত্রে উলং চাই ব্যবহৃত হয়, যার অর্থই হল কালো ড্রাগন। এরপর ‘জুয়ান হু গাও চং’, গরম জল সামান্য উচ্চতা থেকে চায়ের পাত্রে ঢালা। তারপর ‘চুন ফেং ফু মিয়ান’ অর্থাৎ, মনোরম বাতাস বয়ে যাওয়া, অর্থাৎ, চায়ের পাত্রটি ডাকনা দিয়ে ঢেকে দেওয়া যাতে চায়ের গন্ধ ভিতরেই থেকে অক্সিজেনের সঙ্গে আরও মনোরম হয়ে ওঠে। এরপর চায়ের কাপ বা ডিম্বাকৃতি চাপানের পাত্রে ঢালা হয় ‘চোঙ জি জিয়ান ইয়ান’। কিন্তু দাঁড়ান দাঁড়ান এটি পান করা হয় না!

এরপর আবার গরম জল ঢালা হয় চা ভিজানোর পাত্রে, ‘জিন ইউ লিউ শুই’, অর্থাৎ মেঘ সরে গিয়ে জল বইতে শুরু করবে। এ ক্ষেত্রে জল খুব কাছ থেকে ঢালতে হবে। চা পাতা ধুয়ে নেবার জন্য উঁচু থেকে আর চা পানের সময় নিচু থেকে, ‘হুই ঝুয়ান ডি ঝেন’! তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা, প্রথম চা পাতা ধোয়া জল টিপটে ফেলে দিতে হবে। আর দ্বিতীয়বার পান করার জন্য ভেজানো চা, ছাঁকনির মাধ্যমে চা পানের পাত্রে ঢালতে হবে বৃত্তাকার পদ্ধতিতে। চা পানের জন্য প্রস্তুত! কিন্তু সরাসরি তো চা পান করা যাবে না! আগে তার গন্ধ নিয়ে নাক মুখ মন শরীরকে সমৃদ্ধ করুন তারপর তো ছোট ছোট চুমুকে চায়ের তল পাবেন।

অবশ্য এখানেই শেষ নয়, চীনের চা উৎসবের শেষ অঙ্গ হল পরিষ্কার করা। চায়ের পটে কোনমতেই চা পাতা বা তরল রয়ে যাবে না। প্রথমবারের চা ধোয়া জল দিয়ে পাত্রগুলির ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার করতে হবে। তারপর গরম জল দিয়ে জীবাণু মুক্ত করতে হবে। শুকনো কাপড় দিয়ে সন্তপর্ণে মুছে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে শুকিয়ে নিতে হবে পাত্রগুলি। তবেই ছুটি!

জাপানঃ জাপানে অতিথি আপ্যায়ন বা বিশেষ অনুষ্ঠানে গ্রীন টি পান সংস্কারের মধ্যে পড়ে। এই টি সেরিমনি কিন্তু চীনেরও আগে জাপানে নিয়মিত পালিত হতো। যদিও চা পানের প্রথা চীন থেকেই এসেছে জাপানে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে নবম শতাব্দীতে বৌদ্ধ ভিক্ষু ইচু, চীন থেকে গ্রীন টি পানের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরেন এবং জাপানে চালু করেন তৎকালীন সম্রাটকে চা পরিবেশন করে। প্রথম প্রথম জাপানে চা খাওয়া হতো ভেষজ প্রোডাক্ট হিসাবে পরে এটি ‘প্লেজার ড্রিঙ্ক’এ পরিণত হয়।

জাপানী টি সেরিমনি ঋতুভিত্তিক হয়। গরমের সময়ের জন্য বিশেষ সেরিমনি এবং শীতের জন্য আলাদা।

জাপানে টি সেরমনির ভেন্যুগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর মেঝের উপর টাটামি বা ধানের খড় দিয়ে বিশেষ মাদুর ব্যবহার করা হয় বসার জন্য।  যে ঘরে চা পরিবেশন করা হয় অভ্যাগতদের উপস্থিতিতে তার নাম ‘চাসিৎসু’। এর ছাদ নিচু হয়।

টি সেরিমনিতে যে সব উপকরণ ব্যবহৃত হয় সেগুলি হলঃ চাকিন (মোছার জন্য চৌকো কাপড়), চায়ের ঢাকা পট, গুঁড়ো গ্রীণ টি রাখার পট, চা মেলানোর জন্য বাঁশের টি হুইস্কার এবং চা খাবার পাত্র। চা বেছে নেবার জন্য এবং পরিবেশনের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে, সার্বিক ভাবে যাকে তেমায় বলা হয়।

তিব্বতঃ তিব্বতকে আর কোন দেশ বলা যায়? অন্ততঃ চীন কি সেই যো রেখেছে? যাই হোক তিব্বতের চা খাওয়া নিয়ে গপ্প আছে! তখন বয়স অল্প, চমরী গাইয়ের মাখন আর নুন দিয়ে চা খাওয়া হয় শুনে একদিন মিত্র কাফেতে গিয়ে লাল চায়ে, আমূল বাটার আর নুন দিয়ে চেখে দেখলাম। আহা ‘পো চা’ বা পচা যাই হোক না কেন তার ইমপ্যাক্ট ছিল ওয়র্ল্ড ওয়র জেডের মতো। সেই যে সেই ছবিতে ব্র্যাড পিটকে জমবিগুলো দেখতেই পেল না না! তারা ওই আমূল বাটার দিয়ে চা খেয়েছিল নির্ঘাত। আরে বাবা লাসার ঠাণ্ডা আর কোলকাতার বর্ষার মধ্যে পার্থক্য নেই গা? তা সে যা হোক তিব্বতে, চমরী গাইয়ের মাখন আর নুন দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ফোটানো ব্ল্যাক টি খাওয়া হয় ঠাণ্ডার মোকাবিলা করার জন্য। এটুকু জানলেই চলে এর বেশী আর দরকার নেই।

তুরস্কঃ তুরস্কের কালো চা, যা রাইজ টি থেকে বানানো হয়। এটিও একধরণের সামাজিক কাস্টম। অতিথিকে কাঁচের ছোট ফুলদানির মতো পাত্রে চা পরিবেশন করা তুর্কী রেওয়াজ। তার সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন হার্বাল টিও।

ইরান বা মধ্যপ্রাচ্যঃ পার্শিয়ান চা বানাবার পদ্ধতিটি বেশ সুন্দর। প্রথমে ছাঁকনিতে চা পাতা দিয়ে তাতে শুকনো গোলাপ পাতা ফেলে দিয়ে তা সামোভারের মুখে রেখে গরম জল ঢালতে হবে। তারপর ঢাকা বন্ধ করে ভিজতে দিতে হবে। এরপর কাপে একবার ঢেলে তার রঙ ও গন্ধ পরীক্ষা করে নিতে হবে এবং আবার তা সামোভারে ফিরিয়ে দিতে হবে। যদি হাল্কা হয় তাহলে আরও একটু চা পাতা এবং গাঢ় হলে গরম জল ঢেলে চায়ের কাপে বা পাত্রে ঢেলে দিলেই ইরানী ‘চায়ী’ তৈরী।

ইংল্যণ্ডঃ নাকের জলে চোখের জলের দেশ! বারোমাসের মধ্যে ন মাসই কেঁদে আকুল। হয় ফোঁপাচ্ছে না হলে চিৎকার করে কাঁদছে। তা এমন দেশে চায়ের মতো শরীর মন গরম করা একটি পানীয় জনপ্রিয় হবে না তা কি হতে পারে? অষ্টদশ শতাব্দী থেকেই চাপানকারী দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে ব্রিটেন উঠে এসেছে। চাকে কলুষিত করার জন্য ব্রিটেনের নাম সর্বাগ্রে থাকবে। কয়েকটি বিশেষ প্রকার ব্রিটিশ চা হলঃ
আর্ল গ্রে চাঃ ব্ল্যাক টিয়ের সঙ্গে বার্গামোট সুগন্ধ যা কোলনের উৎস থেকেই আসে। মিশিয়ে হয় আর্ল গ্রে চা। আর্ল গ্রে চা প্রধানত গরম জল টিপটে চায়ের পাতার উপর ঢেলে ভিজিয়ে তারপর চায়ের কাপে ছেঁকে দিয়ে খাওয়া হয়।   

ইংলিশ ব্রেকফাস্ট চাঃ নিজের উপনিবেশ অর্থাৎ আসাম শ্রীলঙ্কা এবং কেনিয়া থেকে আনা চাকে ক্রিম সমৃদ্ধ দুধে মিশিয়ে তারপর পরিবেশন করা হয়।

এখন যে হেতু এককালের প্রভুদের জাত। তাই এইভাবে চা খাওয়া আজকের দিনে আভিজাত্যের প্রতীক।

রাশিয়াঃ রাশিয়ার আবহাওয়ার জন্যই বোধহয় অষ্টদশ শতাব্দী থেকেই চা পান বিশেষ সামাজিক কেতার পর্যায়ে পড়েছে। রাশিয়ান চায়ের আরেকটি বিশেষ ব্যাপার হল সামোভার। যা সাধারণত মধ্যপ্রাচ্য বা তুরস্কে ব্যবহৃত হয়। সামোভার একটি ট্রফির মতো দেখতে ঢাকনাওলা একটি পাত্র যেখানে চায়ের জল ফোটানো হয় এবং চা ভেজানো হয়। এর পর চায়ের ঘন একটি তরল তৈরী হয়। যা নিজের নিজের কাপে ঢেলে লোকে চিনি, লেবু, মধু, ফলের রস ইত্যাদি নিজের পছন্দ মতো ঢেলে উপভোগ করে।

এবারে আর বেশী দরকার নেই, মরক্কোর সামোভারে ভরা চা এবং আর্জেন্টিনার ইয়ের্বা মাহ-টে-র কথা উল্লেখ করেই চলে আসি আমাগো দেশে!

দেশ বলতে তো ভারতবর্ষই! সুনীল জলধি হইতে কবে যে সেই টেথিস মহাসমুদ্র পেরিয়ে ভারতীয় উপমহাদ্বীপ সৃষ্টি হল আর তারপর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে তার বিভাজন হয়ে গেল। তারপর তো সবেধন নীলমণি ইণ্ডিয়াকেই দেশ হিসাবে মেনে নিয়েছি! তা সেখানকার চা নিয়ে বলতে গেলে তিনটি জায়গার কথা তো বলতেই হয়! এক দার্জিলিং, দুই আসাম আর তিন কাশ্মীর। (হ্যাঁ কাশ্মীরটা এখনও ভারতেই আছে! অনেক রকম সমস্যা নিয়ে এবং তৈরী করেই আছে!)

তবে এতক্ষণ ধরে যার কথা চেপে রেখে ফুটবল খেলে গেলাম অথচ তাকেই আমি রাজরাজেন্দ্রানীর তকমা দিয়ে রেখেছি। সে হল দার্জিলিং চা। যা ক্যামেলিয়া সিনেন্সিসের ভারতীয় সংস্করণ এবং শুধুমাত্র দার্জিলিং জেলার চাবাগানে উৎপন্ন মনোমুগ্ধকর পানীয়ের গোড়ার কথাকেই বলা যায়। গ্রীন বা ব্ল্যাক যে কোন দার্জিলিং টিই হোক না কেন, প্রধানত সেকেণ্ড ফ্লাশের পর তার অতুলনীয় খোশবাই মন উচাটন করে। ও হ্যাঁ, ফার্স্ট ফ্লাশ মার্চে, জুনে সেকেণ্ড ফ্লাশ, ইনবিটুইন এদের দুজনের মাঝে, মনসুনাল ভ্যারাইটি এবং শেষ মেশ অটামনাল ফ্লাশ। এই হল দার্জিলিং টিয়ের সংসার। কিন্তু দার্জিলিং-এর টি এস্টেটগুলি কি আর সেই আগের মতোই আছে? সামাজিক অধিকার এবং রাজনৈতিক সালতামামি মিলিয়ে প্রতিটি টি এস্টেট আজ ধুঁকছে। শ্রমিকদের মানুষ মনে করার মধ্যেও যেমন মালিক পক্ষের বাধা আছে তেমনই দার্জিলিং চাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এস্টেটগুলি চালানোও আজকাল হটেনটট খুঁজে পাওয়ার সামিল।

তবুও তো চায়ের চুমুকে বেঁচে থাকে সুগন্ধের আশ্বাস।

আসাম চা বা সিংহলী চা নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। তবে দুধ চায়ের বিশাল ইন্ডাস্ট্রিকে ধরেই রেখেছে এই বিশেষ ধরণের চা পাতা। তবে চা নিয়ে আলোচনা করব আর কাশ্মীর আলোচনায় আসবে না তা কি হয়? চারটে ছোটখাটো রেসিপি দিয়েই দিই কি বলেন?

চার কাপ জল, ১ চা চামচ গ্রিন টি, ২টি ছোট এলাচ (গুঁড়ো করা), এক চিমটি দারুচিনি গুঁড়ো, তিন চারটে আমণ্ড কুঁচি করে নেওয়া আর চিনি। চা পাতা দিয়ে জল ফুটিয়ে নিয়ে চিনি দিয়ে বাকি মশলাগুলি দিয়ে ঢেকে দিন। তারপর নিন আপনার কাওয়া তৈরী। মিশন কাশ্মীরের সেই নামহীন ছেলেটা যা সবাইকে পান করিয়ে বেড়াচ্ছিল মনে আছে?

৬ কাপ জল ৩ কাপ দুধ আধ চিমটে দারুচিনি, ৪টি ছোট এলাচ ২ চা চামচ গ্রীন টি একসঙ্গে সামোভারের বাইরের পাত্রে ঢালুন। এর পর গরম কাঠকয়লা সামোভারের ফানেলে ঢেলে একঘণ্টা ধরে ফুটতে দিন। এরপর খাবার সোডা দিয়ে রঙকে আরও সুন্দর করুন। শেষে সামোভারের নিচের নলটি খুলে চা ঢেলে নিন।

এছাড়াও চিনির জায়গায় নুন ব্যবহার করে এবং ১ টেবিল চামচ ক্রিম ব্যবহার করে শির চা বানাতেও পারেন।

রেসিপির কথাই যখন তুললাম, তখন রামপিয়ারি চায় বা আমাদের লেবু চা কোথায় যাবে?

ট্রেনে করে বিহারের উপর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করার সময় ভাঁড়ে ভাঁড়ে চলে আসবে রামপিয়ারি চা। যার ঘনতর ভার্শনটি দেখা যায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে। সেখানে তো জল ব্যবহারই হয় না। দুধেই সিটিসি চা ফেলে দিয়ে ফুটিয়ে এলাচ, দারুচিনি আদা দিয়ে আর চিনি দিয়ে চা পরিবেশন। আর চিনির কথা বললে তো হরিয়ানার চায়ের কথা বলতেই হয়! হরিয়ানভিরা আড়াই চামচ চিনি দেবে আর হাতে মণ্ডা বা বরফি নিয়ে চা খেতে বসবে। লোহা লোহে কো কাটতা হ্যায়। মিষ্টি মিষ্টিকেই কাটে কিন্তু কায়িক পরিশ্রমের দেশে সাঙ্ঘাতিক মিষ্টি চায়ের সঙ্গে মিষ্টত্ব না গেলেও প্রচুর গ্লুকোজ তো গেল শরীরে।

শেষে আমাদের বিটনুন আর লেবু দিয়ে লেবু চা। যা আজকাল প্লাস্টিকের ভাঁড় সদৃশ কাপের শোভা বাড়াচ্ছে। লালু প্রসাদের সময় থেকেই ভাঁড় ভারতীয় রেলে অদৃশ্য। হয়তো পরিচ্ছন্নতার কথা ভেবেই। কিন্তু আদরক মশালা মারকে চায়ের আসল মজাই তো মাটির গন্ধওলা ভাঁড়ে পান করতে গিয়ে।  সে যাই হোক, দেশে তো আর ভাঁড়ের অভাব নেই, শুধু শুধু মাটির ভাঁড় নিয়ে টানাটানি কেন?

চায়ের দোকানগুলি বাংলার কোণে কোণে আড্ডাকে জিইয়ে রাখুক আর রাখুক আমাদের জিভের স্বাদকোরকগুলিকে সচল। গলাটা আজ গান গান করছে, নাকি কবিতা? দুটো ছোট ছোট পেশকশ হবে নাকি?

ভেঙে গেছে চায়ের দোকান
নিভে গেছে বয়স, সময়
আমরাও ভেঙেছি বানান,
সেসব বলার মতো নয়।... শ্রীজাত

লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল, 
রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস 
দীপু তো শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল 
এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ 
তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক; 

আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল 
সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!
কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ 
সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে -
এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ 
দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ? 

গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই 
একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম 
এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই 
আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম।... সুনীল গাঙ্গুলী।    

নীচের ছবিটি দিল্লির একটি চা-বারের- আরামসে যেখানে চায়ের স্বাদ চেখে চাতাল হওয়া যায়!


লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।