ফিসফাস কিচেন
জুলাই ১৫, ২০১৬
ছ্যাঁচড়া-চচ্চড়ি-ঘণ্ট
সৌরাংশু
সরি পাঠক পাঠিকারা, এই বস্তুটির কোন সালতামামি খুঁজে পাই নি! মানে এই ছ্যাঁচড়া চচ্চড়ি ঘণ্ট জাতীয় ডিশগুলি আমাদের মিটসেফে কবে জায়গা করে নিল আর কি! মানে বড় বড় বিশেষজ্ঞদেরও প্রশ্ন করে জানতে পারি নি এর উৎপত্তি। যদিও মধ্যযুগের বাঙালি রান্নাঘরের হিসেব দিতে এসে এটুকু জানিয়েছেন যে, মুসলিম রাঁধুনেদের হাত ধরেই ভারী ভারী মশলাদার রান্না ঢুকল। কিন্তু এই হালকা মশলা ফোড়নে বানানো ‘কারি’র কারিকুরির ইতিহাস কেন জানা যাচ্ছে না কে জানে। এসব নিয়ে ঘাঁটতে বসার আগে আগে ফারাকটা একবার টুক করে দেখে নিই কি বলেন?
ঘণ্ট: বিভিন্ন রকম সবজিকে যদি হেইসান ঘাঁটেন যে তার পাসপোর্টের থোবড়া চেনার জো থাকে না আর বেশ নরম নরমও থাকে, তাইলে সেটা ঘণ্ট। তবে অনেক সময় একাধিক সবজি ব্যবহার নাও হতে পারে। মুড়ো ঘণ্ট, মোচার ঘণ্ট ইত্যাদি। সবজিকে বা সবজিদের ডুমো ডুমো কেটে নিয়ে মশলা পাতি দিয়ে ঘ্যাঁট বানান! ব্যাস ঘণ্ট!
চিংড়ি দিয়ে পালং ঘণ্ট
|
চচ্চড়ি: এর ক্ষেত্রে আবার স্বাস্থ্য বিধি মেনে কাজ একটু কম হয়। ডাঁটা চচ্চড়ি- কাঁটা চচ্চড়ি এমন কি পাঁঠা চচ্চড়ির ক্ষেত্রেও একটু তেল বেশি লাগে আর তা কষতে গিয়ে “চড়চড়” করে আওয়াজ করে বলেই এর নাম বোধহয় চচ্চড়ি। তবে চচ্চড়ির সাত্ত্বিকতর সংস্করণ হল ছেঁচকি। একটু পাঁচ ফোড়ন আর লঙ্কা দিয়ে আলুটা মুলোটা কলাটা ডুমো ডুমো করে কেটে, কম তেলে জল ছড়া দিয়ে রান্না। আর শেষে রুটি লুচি পরোটার সঙ্গে সাপ্টিয়ে জলখাবার।
মুড়ি ঘণ্ট
|
ছ্যাঁচড়া: উপরে যা সব করলেন তার সঙ্গে একটু মাছের কাঁটাকুটো মিশিয়ে দিলেই ছ্যাঁচড়া।
খুব সহজ লাগল! না? এহে তা কি হয়? ঘণ্ট ছ্যাঁচড়া চচ্চড়ি রান্না করতে গিয়ে ঘেঁটে ঘ হয় নি এমন বাঙালির সংখ্যা হাতে গোনা। সবজিগুলোকে এক পাত্রে চড়ানো আর তা খুন্তি দিয়ে নাড়া কি সাধারণ মানুষের কম্ম?
তবে ঘণ্ট নিয়ে আমার কিছু ছেলেবেলার নিবেদন আছে। ছেলেবেলায় আমি যখন একটু ছেলে ছেলে হয়ে উঠেছি সেই সময় মুড়ি ঘণ্টতে মুড়ি মেশাচ্ছিলাম এক এক করে। বলুন নাম দিয়েছে মুড়ি আর মুড়িই নেই! হয় কখনও। আমার মা হাতের কাছে পেল খুন্তি! আর একদম স্টেফি গ্রাফের ব্যাক হ্যান্ড স্লাইসের মতো দিলো চালিয়ে আমার উদ্দেশ্যে। আমার রিফ্লেক্স অ্যাকশনে ডান হাত তুলতেই কনুইয়ে খটাৎ করে বাধাপ্রাপ্ত হল সেই স্লাইস। আর সেদিনই স্কুলে নাটক ছিল! পাঞ্জাবির নীচ দিয়ে মারকিউরিক্রোমে চোবানো তুলো আমার অভিনয়কে বড়ই দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছিল তা আর বলার অপেক্ষা লাগে না।
তা শুরুতেই মুড়ি ঘণ্ট? তাই সই! আদতে ফ্যান্সি রান্নার মধ্যে আমরা ঘটিদের অবদান বলতে শুধু ধোকা। আর বাকি সবকিছুই নাকি ওপার বাংলার বাঙালদের। গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে মুড়ো ঘণ্টটাও তো তাই বলে। কেন বলুন দিকি? এপারে কি রুই মাছ পাওয়া যেত না? নাকি রুই মাছগুলোর মাথা থাকত না?
তা যাই হোক। সেই মাথাটাকে কম কম তেলে ঢেকে ঢেকে ভেজে নিয়ে সেই তেলেই পেঁয়াজ কুঁচি লাল করে ভেজে তাতে গোবিন্দভোগ চাল দিয়ে নেড়ে নিয়ে আদা হলুদ লঙ্কা বাটা দিয়ে নেড়ে নেড়ে ডুমো ডুমো করে কাটা আলুর টুকরো নুন লঙ্কা দিয়ে তারপর সেই ভাজা মুড়োগুলো দিয়ে খুব কষে চাল সিদ্ধ হবার মতো কম জল দিয়ে ঢেকে ঢেকে রান্না। মাঝে মাঝে নাড়তে হবে নাহলেই মুড়িঘণ্ট পুড়ে ছত্রখান হয়ে যাবে। জল মরে গিয়ে চাল সিদ্ধ হয়ে গেলে ঘি গরমমশলা দিয়ে নামিয়ে পরিবেশন।
বড়ি দিয়ে পালং-এর ঘণ্ট
|
এর পর যদি ঘণ্টের কথা ওঠে তাহলে আমার ফেএএএএবারিট হল পালং শাকের ঘণ্ট। সত্যি বলুন তো পালং শাকের মতো এত স্মার্ট সুন্দর জিনিসটাকে শুধু সেদ্ধ আর স্যুপ করে তার খাদ্যগুণ বজায় রাখতে গিয়ে কি বিস্বাদ ওয়াক থু বানিয়ে ফেলি না? তার থেকে পালং শাকের ঘণ্ট বানাতে কি হয়েছে? আমার মা ছড়ানো পাত্রে তেজপাতা কাঁচালংকা ফোড়ন দিয়ে ভাপানো শাক মুলো বেগুন আলু শিম দিয়ে লঙ্কা, মৌরি আর আদা বাটা দিয়ে পালং শাকের ঘণ্ট পরিবেশনের আগে উপরে মুসুর ডালের বড়ি ভেজে তা হামান দিস্তা দিয়ে গুঁড়িয়ে ছড়িয়ে দিয়ে যখন গরম গরম পরিবেশন করেন। তা দিয়ে ছোট বেলা থেকেই এক থালা ভাত উঠে যেত। আর এখন তো আমি এমনি এমনিই খেতে পারি। আপনারা? আচ্ছা এটাকে কি ঘটি রান্না বলে চালানো যায়? বাঙালরা হাঁই হাঁই করে উঠবে বলবে যে কুরো রাঙালু দিয়ে আমরাও তো এটাই রান্না করি! তাই তো! তার থেকে ভাল লাগাটাই থাক বাবা।
কচু শাকের ঘণ্ট। সত্যি দিল্লিতে এসে এই একটা জিনিসকে যা মিস করি না! কাঁচালঙ্কা ফোড়নে ধনে লঙ্কা জিরে মরিচ বাটা দিয়ে ভাপা শাক দিয়ে কষে রান্না। নিরামিষে ছোলা সিদ্ধ নারকোল কোরা আর আমিষ হলে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান উভয়েই খেলতে পারে এই মাঠে। ইলিশের মাথা বা চিংড়ি।
মোচার ঘণ্টটা নিজে খুব একটা ট্রাই করি নি বলে বলতে পারব না! তবে মাছের মাথা দিয়ে লাউয়ের ঘণ্ট না করে যদি ভেটকি মাছ দিয়ে করেন সে কিন্তু দারুণ খেতে হয়। মানে ভেটকি মাছ ভেজে নিয়ে সেই তেলে আদা পেঁয়াজ রসুন তেজপাতা গরম মশলা দিয়ে তাতে ডুমো ডুমো করে কাটা আলু ভেজে নিয়ে লাউ দিয়ে নাড়তে নাড়তে জল ছেড়ে গেলে ভেটকি মাছ দিয়ে নাড়ুন। মাছ ভেঙে গেলেও কুছ পরোটা নেহি। তারপর আর কি গুঁড়ো গরম মশলা ছড়িয়ে নামিয়ে নিন। নুন হলুদ লঙ্কা বা মিষ্টি তো আপ রুচি খানা।
চাপড় ঘণ্ট, আমি ঘটি বাড়ির ছেলে হবার জন্য ছেলেবেলায় একেবারেই খাই নি। আসলে নামটাই জানতাম না! তারপর দেখি দেশে বাঙালের সংখ্যা বেড়ে গেছে। আর আমার বন্ধু বান্ধব থেকে আরম্ভ করে আত্মীয় স্বজন সব বাঙাল হয়ে গেছে। তা সেইখানে দাঁড়িয়ে চাপড়ঘন্ট শুনব না তা কি হয় কত্তা? ঘোড়ায় হাসব তো! মটর ডাল ভিজিয়ে বেটে, আদাবাটা কাঁচা লঙ্কা নুন হলুদ দিয়ে মেখে বড়া বা চাপড় তৈরি করে নিতে হবে। তারপর আলু, মিষ্টি কুমড়ো, বেগুন টমাটো, গাজর আর পারলে বিন্স টিন্স দিয়ে নারকেল বাটা আদা রসুন বাটা কাঁচালংকা দিয়ে নেড়ে শেষে চাপড় দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন।
পুঁইশাক বা লাউ শাক বা কুমড়ো শাকের ঘণ্টের রন্ধন পদ্ধতিতে বিশেষ কায়দা নেই বটে। কিন্তু স্বাদের ক্ষেত্রে বাঙালির রান্নাঘরকে স্বতন্ত্র করে রাখতে এদের জুড়ি নেই।
যাই হোক আর বেশী রেসিপি টেসিপি ঘন্টাঘন্টির মধ্যে না গিয়ে চচ্চড়িতে চলে যাই! চচ্চড়ির পরিধি এবং ব্যাপ্তি একটু কম। পাঁচফোড়ন আদা বা শুধু কালো জিরে কাঁচালংকা দিয়ে ছেঁচকির থেকে একটু বেশী কিন্তু ঘণ্ট বা লাবড়ার কমপ্লেক্সিটিতে নেই। ও হো লাবড়াটা আবার ঘণ্টের মোক্ষলাভ। মানে ঘণ্ট যখন ঘেঁটে ঘুঁটে (এই না ঘুঁটে না) ঘেঁটে টেঁটে গিয়ে এক দেহে লীন হয়ে যায়, মানে হলুদ হলুদ কুমড়ো রঙের আলুর গায়ে বেগুনের বিচি জ্বলজ্বল করতে থাকে তখন তার রসিক নামকরণ লাবড়া।
সে বহুযুগ আগের কথা বুইলেন? উনিশশো আশিতে দিল্লি এসেছিলাম সঙ্গে মাসির পরিবার। তা আমাদের ঠিক দেড় ঘণ্টা পর দিল্লির বিখ্যাত অটোওলাদের পাল্লায় পড়া মাসি মেসো আর মাসতুতো দাদা ও তার ঠাকুমা এসে হাজির হল। কোথায়? শ্রীনিবাসপুরিতে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ। আর তার পালং শাকের লাবড়া আর খিচুড়ি প্রতিদিনের খিদের মুখে একদম অমৃত ছিল। কিচ্ছু না হয়তো আদাও পড়ত না তাতে। কিন্তু সবজির স্বাদ আর একটু ঘি মিলে একদম সমুদ্র মন্থনের টেস্ট।
পার্শে মাছের ঝাল চচ্চরি
|
তা সে যা হোক। সারাজীবন তো আর যাযাবর হতে পারব না! তাই বাড়িতেই ফিরে আসি! ও হ্যাঁ বাড়ি বলতে আমার বসত বাটিতে একটা বাটিচচ্চড়ি হত বা হয় সেটা মাসাল্লাহ। লম্বা লম্বা করে কাটা পেঁয়াজ আর ডুমো ডুমো করে কাটা আলু লঙ্কা ফোড়নে ভাল করে নেড়ে জল আর কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে একদম স্লার্প। আর তাতে যদি চাপড়া চিংড়ি পড়ল তাইলে তো...। নাহ থাক! পাতায় জল ফেলবেন না! বই নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আর চচ্চড়ির কথা এলে ডাঁটা কাঁটা পাঁঠা আর মেটে একদম মাথার উপর ফোর স্টারের মতো জ্বল জ্বল করতে থাকে। সেই রবি ঠাকুরের একটা গান আছে না, “ওরে ডাকেন তিনি যবে......... ছুটি পথের কাঁটা পায়ে দলে সাগর গিরি লঙ্ঘি!” সেটা বোধহয় ঠাকুর কাঁটা চচ্চড়ি খেতে গিয়েই লিখেছিলেন।
সে যাই হোক বেশি ভাঁটের ঘ্যাঁট না করে শেষ হচ্ছে ছ্যাঁচড়া। ছ্যাঁচড়া তো পুঁইশাক আর ইলিশ মাছ। অন্য মাথা দিয়েও করতে পারা যায়! তবে ইলিশের কেমন যেন একটা অন্য ঐশ্বরিক অনুভূতি আছে। রুইমাছের বা কাতলার মাথা দিয়েও পুঁইশাকের ছ্যাঁচড়া ভাল খেতে হয়।
যাই হোক বাঙালি ঝালে ঝোলে অম্বলের সঙ্গে চচ্চড়ি-ছ্যাঁচড়া-ঘণ্টেও থাকুক। আর ঘেঁটে যাওয়া পৃথিবীতে ঘেঁটে যাওয়া কপাল নিয়ে খেটে খাওয়া বাঙালি অমৃতের সন্ধান খুঁজে পাক এই আশাতেই আজ রাখলাম। বাকিটা? খাবার টেবিলে দেখা হচ্ছে।
লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।