ফিসফাস কিচেন
মে ৩০, ২০১৬
বিরিয়ানি
সৌরাংশু
প্রাক কথন
এসব কথা সবাই জানে! তবু কর্তব্যের খাতিরে বিসমিল্লাহ্ করে এগোতে হয়! কথাটা হল বিরিয়ানি কথাটা এসেছে ফারসি ‘বিরান’ শব্দটি থেকে! অর্থাৎ ‘রন্ধনের আগে ভেজে নেওয়া’। তা বিরিয়ানি শব্দটাতো এল! কিন্তু বিরিয়ানি রান্নাটা কোথা থেকে এল, কী বৃত্তান্ত? সেখানেও একটু খোঁজাখুঁজি করি না হয়?
ভিন্ন মত আছে! থাকতেই পারে! একটি কথন বলছে তৈমুর লঙ্গের সঙ্গে এই রান্নার পদ্ধতিটি প্রাচীন কাজাখস্থান থেকে আফগানিস্তান ছুঁয়ে হিন্দুস্তানে আসে। অপরটি বলছে যে উত্তর পশ্চিম অখণ্ড ভারতের সৈন্য শিবির পরিদর্শনকালীন অপুষ্টি দূর করতে শাহজাহানের দুনিয়াজাদি মমতাজমহল এই অভূতপূর্ব ভোজটির প্রবর্তন করেন। তবে আরব বেদুইনরা মাংস, মশলা, চাল টাল একটা মাটির পাত্রে ভরে গরম বালির মধ্যে গর্ত খুঁড়ে রেখে দিত গরমে নিজে রান্না হবার জন্য! তারপর নাকি তা বার করে খাওয়া হত! ওহো আরও একটা মত আছে কিন্তু! সেটা বলে বিরিয়ানির জন্মই হয় দাক্ষিণাত্যের কালিকটে! আরবী ব্যবসায়ীরা কালিকটের বন্দরে নিয়ে আসে ‘পিলাফ’। আরবী ‘পিলাফ’ বা পোলাও-এর সঙ্গে মাংস আর মশলা মিশিয়ে একই পাত্রে রান্না করা হত দম স্টাইলে। আর সেই থেকেই দাক্ষিণাত্যের বিরিয়ানি।
তবে কিনা নিন্দুকে বলে যে তামিল ইতিহাস দ্বিতীয় শতাব্দীতেও ‘ঊন সরু’ বলে চাল, মাংস, ঘি, হলুদ, ধনে, জিরে এবং তেজপাতার একটি মিশ্রিত রান্নার দিকে দিকনির্দেশ করছে। সবকিছুই ঘেঁটে যাচ্ছে দেখছি। যাই হোক তাহলে এভাবে ভেবে দেখলেও হয় যে বিরিয়ানি দুটো আলাদা আলাদা রন্ধ্রণ প্রণালী উত্তর এবং দক্ষিণের পথ দিয়ে ঢুকে ভারতীয় পাকস্থলী ও জিভের সাম্রাজ্য দখল করে নিয়েছে।
যাই হোক না কেন এই চাল ভেজে মাংস ভেজে রান্নার পদ্ধতিটি দেখা যাচ্ছে ভারতের আপামর মাংসভোজী মানুষের মন জয় করে নিয়েছে এবং বর্তমান যুগে আসতে আসতে তার বিভিন্ন প্রাদেশিক প্রারূপও তৈরী হয়ে গেছে! সেসব আসার আগে আসুন বিরান নিয়ে আরও একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি!
প্রাকপরবর্তী কথন
চাল ঘিয়ে ভেজে নিয়ে ভাত করতে গেলে কি সুবিধা হয়? এক তো চালগুলির উপর স্টার্চের একটি পরত পড়ে যায় ফলে ভাত গলে গিয়ে লেগে যাবার সম্ভাবনা না থাকে! দুই হল এক অন্যরকম স্বাদ তৈরী হয় সিদ্ধ হবার পর! তৃতীয়ত ঘি এবং সুগন্ধি চালের গন্ধ মিলিয়ে অমৃতভোগ্য হয়ে ওঠে!
এই সূত্রে চলুন একবার ইরানি বা আরবী পিলাফ ঘুরে আসা যাক!
একটু গভীর পাত্রে প্রথমে ঘি মাখিয়ে তারপর চাল দিয়ে জল দিয়ে মশলা টশলা দিয়ে রান্না করলে হয় চেলভ! এখন নিচের অংশটি একটা সুন্দর ভাত ভাজার টুকরির মতো তৈরী হয়। এর মধ্যে অন্যান্য আমিষ ও নিরামিষ অনুষঙ্গ মিশিয়ে রান্না করলে হয়ে যায় পোলভ! আর ওই ভাত ভাজার যে টুকরিটা সেটা যদি উলটে রাখা হয় তাহলে দারুণ একটা ইগলুর মতো দেখতে সুগন্ধি ভাত তৈরী হয়। যার দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসে মখমলি চালের পিলাফ।
পিলাফ বা পিলাউয়ের রান্নার অন্য অনেক পদ্ধতি আছে। আর আছে বাঙালিদের রান্না ঘি ভাত। তবে এই গল্পের প্রধান চরিত্রের খাতিরে আমরা তারপরের গল্পে চলে যাই চলুন।
মূল কোর্স
আহা চাল মশলা ঘি মাংস আর সুগন্ধির এমন অটুট মিশ্রণ- মুখে ফেললে পারিজাতের গন্ধে স্বর্গোদ্যান ভ্রমণ! আর কোন রান্নায় পাবেন বলুন তো?
কাচ্চি বিরিয়ানি
|
সেই যে প্রথমেই বললাম যে বিরিয়ানি দুটো পথে ভারতে এল বা নিজের স্থান গ্রহণ করল। এখন রন্ধন পদ্ধতির বিচারে বিরিয়ানিকে ‘কাচ্চি’ ও ‘পাক্কি’ দুটি ভাগে ভাগ করা হয় আর সেই ভিন্ন পন্থা আর ভিন্ন পথ মিলিয়ে দুটি ঘরাণা তৈরী করল। উত্তরের বিরিয়ানির মারহাব্বা সরতাজ লক্ষ্ণৌই বিরিয়ানি আর দক্ষিণের মাসাল্লাহ্ নওয়াব হায়দ্রাবাদি! দুটির মধ্যে সাধারণতঃ হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি ‘কাচ্চি’ পদ্ধতিতে আর লক্ষ্ণৌই ‘পাক্কি’ পদ্ধতিতে রান্না করা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলের রান্নার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিকে রেখে বিভিন্ন বিরিয়ানি আছে! লক্ষ্ণৌই আর হায়দ্রাবাদি ছাড়াও বোম্বে বিরিয়ানি, থালিসেরি বিরিয়ানি, ভাটকলি বিরিয়ানি, মোমেনি বিরিয়ানি আর কোলকাতা বিরিয়ানি।
কোলকাতা বিরিয়ানির কথা আর কি বলব! কিন্তু দিল্লিতে সত্যি বলতে কি বিরিয়ানি খেয়ে একেবারেই মন ভরে নি! কোথায় খুঁজে খুঁজে ছুটে ছুটে গেছি তার নেই ঠিক! শাহি বাবুর্চি বলে প্রগতি ময়দানের পাশের মটকা পীরের পাশের দোকান! সে এখন জঘন্য হয়ে গেছে। করিমে মুঘলাই অন্যান্য রান্না তো মাশাল্লাহ! কিন্তু বিরিয়ানিটা ঠিক মনোলোভা নয়। জামিয়ার এক ছোট্ট খুপরি হামাদের বিরিয়ানি মন্দের ভাল! হামাদ দুটো হাঁড়ি নিয়ে সন্ধ্যা থেকে বসে! আটটা অব্ধি! তারপর অবিক্রীত বিরিয়ানি গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে হাঁড়ি দুটো বগলে করে বাড়ি চলে যায়। অন্ধ্র ভবনের বিরিয়ানি চলেবল! যদিও রোববার রোববার তার জন্য কম করে আধাঘণ্টা দাঁড়িয়ে খাবার সুযোগ ঘটে। কিন্তু বিশাল কিছু মহার্ঘ্য বলে কখনই মনে হয় নি!
তবে দিল্লির এখনো পর্যন্ত সেরা বিরিয়ানিটা হল বারাখাম্বা রোডে ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টারে ললিত হোটেলের আউটলেটের হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি! বোনলেস চার টুকরো মাংস দিয়ে তুলোর মতো হালকা বিরিয়ানি! মাত্র দেড়শো টাকা! না চাখলে ট্রাই করে দেখতে পারেন! তবে লিমিটেড স্টক! ভুস করে শেষ হয়ে যায় দুপুরে!
যাই হোক রান্নার পদ্ধতি আর স্থান বিচারের লক্ষ্ণৌই আর হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি এখনো প্রধান শিরোপা সযত্নে রেখে দিয়েছে। এই প্রধান দুটিকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাব আর শেষে দেখব হোমমেড বিরিয়ানি কিভাবে করতে স্বর্গীয় আভা নিয়ে ম ম করে।
লক্ষ্ণৌই বিরিয়ানির ক্ষেত্রেঃ
বাসমতী বা লম্বা দানার যে কোন সুগন্ধী চাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখুন। অপর দিকে মাংসের বড় বড় টুকরো দই, নুন, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো মাখিয়ে ম্যারিনেট করুন। তারপর ভাত রান্না করুন যাতে চাল গলে না যায়! মাংস রান্না করুন পেঁয়াজ আদা রসুন গরম মশলা দিয়ে। তারপর গভীর পাত্রে ঘি মাখিয়ে ভাত ও মাংসের স্তর তৈরী করে তা দমে রান্না করুন। শেষে কেওড়া ও গোলাপ জল দিয়ে নামিয়ে নিন। চাইলে দুধে কেসর গুলেও দিতে পারেন!
মাটন বিরিয়ানি
|
আর লক্ষ্ণৌই বিরিয়ানির জন্য হজরতগঞ্জের কাছে ওয়াহিদ অথবা ভুলভুলাইয়ার কাছে লালা বিরিয়ানি ঢুঁ মারতে ভুলবেন না! বিরিয়ানী সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম, সেই গপ্প বলি... তবে এই গপ্প লখনৌই বিরিয়ানী'র গপ্প, যাকে কলকাতা বিরিয়ানী'র পূর্বজ বলা যায়।
সন ১৭৫৩, আওয়াধ-এ তখন দুর্ভিক্ষ চলছে। নবাব আসফ-উদ-দ্দৌলা সেই সময়ে শুরু করলেন এক অদ্ভুত প্রকল্প, "কাজের বিনিময়ে খাদ্য"... শুরু করলেন ইমামবাড়া তৈরী'র কাজ। যারা কাজ করবে, তারা খেতে পাবে। দিনের বেলা একদল যা তৈরী করত, রাত্রে আরেক দল তা ভেঙ্গে দিত... দুই দলই খেতে পেত... আর এইভাবে কাজ চালানো হয়েছিল, বহু বহু বছর ধরে, যাতে শ্রমের সরবরাহ অব্যাহত থাকে। শ্রমিকদের খাবারের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল দু টুকরো মাংস, আর সঙ্গে ভাত। নবাবী খানসামা "কোনওরকমে" চাল, মাংস আর কিছু মশলা দিয়ে সেই হাঁড়ি "দমে" বসিয়ে দিত। হাঁড়ি থেকে যা বেরোত, সেটাই আজকের লাখনৌয়ি বিরিয়ানি। লখনৌ অঞ্চলে তাই এখনও খানদানি বাড়িতে "দাওয়াত"এ বিরিয়ানী নাস্তি... হলে, পোলাও হবে, কিন্তু বিরিয়ানী নৈব নৈব চ। কারণ, ওটা "গরীবের খাদ্য"!
সেই আওয়াধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ যখন কলকাতায় এলেন, মেটিয়াবুরিজে তৈরী হল আরেক লখনৌ, এল বাই নাচ, এল বুলবুলির লড়াই, এল মোরগ লড়াই, এল ঘুড়ি... আর এল বিরিয়ানী।
তবে গত দুই শতাব্দীতে সেখানেও কিছু ফারাক সৃষ্টি হয়েছে... দু টুকরো মাংসের বদলে এক টুকরো মাংস আর এক টুকরো আলু এসেছে, মশলাপাতিও কিছু কমে গেছে।
হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানির ক্ষেত্রেঃ
গভীর পাত্রে অধিক পরিমাণে দই ও আদা রসুন পেঁয়াজ বাটা এবং পুদিনা পাতা ও অন্যান্য গরম মশলা দিয়ে তা নীচে দিয়ে তার উপর চাল দিয়ে পাত্রটি একটু হেলিয়ে হাল্কা আঁচে দমে রান্না করুন! আর মাঝে মাঝে ঘুরিয়ে দিন! শেষে নামানোর আগে কেওড়া ও গোলাপ জল দিয়ে নামিয়ে নিন।
৯৬ সালে চারমিনারের কাছে হোটেল নূরজাহান ছিল! জাস্ট ঘুরতে ঘুরতে ঢুঁ মেরেছিলাম। সেখানের হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি এখনো মুখে এমন লেগে আছে যে গত বছর যখন প্রায় উনিশ বছর পর যাবার সুযোগ ঘটে হায়দ্রাবাদে, তখন অনেক খুঁজে সেই দোকান না পেয়ে সাদাব বলে একটি বেশ পরিচিত বিরিয়ানির দোকানে হাত কমলা করে অখাদ্য চিবিয়ে ফিরে আসি। হায়দ্রাবাদের প্যারাডাইসের কথা না বললে অবশ্য নিজাম শহরের বদনাম হয়! তবে প্যারাডাইসের বিরিয়ানি প্যাক করে নিয়ে আসার জন্য বিখ্যাত! অবশ্য সেই স্বাদ সেরকম কিছু মনে হয় নি। তবে পরের বার গিয়ে ওখানে বসেই খেয়ে দেখতে হবে।
বাকি পদ্ধতিগুলোও এদিক ওদিক করে প্রায় এই দুই পদ্ধতিতেই ম্যানেজ করা হয়!
তবে বাংলা যখন তখন ঢাকাইয়া কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়ি কিভাবে? ঢাকাইয়া কাচ্চি বিরিয়ানিতে সর্ষের তেল আর আলু বোখরা আলাদা ‘র্যালা’ নিয়ে আসে। মাংসটা দই এবং অন্যান্যতে ম্যারিনেট করা অথচ ভাতটা মোটামুটি করে রাখা এই অবস্থায় দমে বসিয়ে বানানো ডেগচির মুখ আটা দিয়ে আটকে। আর শেষে হজম করার জন্য বুরহানি।
তবে কয়েকটা কথা বলে ফেলি এই ফাঁকে! কাজের কথা!
চালঃ বিরিয়ানির চাল খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিকভাবে লম্বা এবং সরু চাল নেওয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে ব্রাউন রাইস এবং দাক্ষিণাত্যের কিছু কিছু ক্ষেত্রে খিমা বলে একটু মোটা ছোট চাল ব্যবহার করা হয়। তবে যে চালই হোক না কেন, দেখার দরকার যাতে তা সহজেই গলে না যায়! আর সুগন্ধি হলে তো কেয়াবাত!
আখনিঃ এটি খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি! ভাত রান্নার সময় চালের মধ্যে নিজস্ব সুগন্ধ ছাড়াও যদি মশলার সুগন্ধ বুকে নিয়ে তৈরী হয় তাহলে আহারে বাহার আসে। তাই আখনি! কিস্যু না! একটা পাতলা কাপড় (ধুতি বা শাড়ি ছেঁড়া এই সব ক্ষেত্রে একদম ঝক্কাস!)- তার মধ্যে তেজপাতা, দারুচিনি, লবঙ্গ, ছোট এলাচ, বড় এলাচ, শাহজিরা, শাহমরিচ, জায়ফল, জয়িত্রী, শুকনো বা কাঁচা লঙ্কা, গোল মরিচ, ধনে, জিরে, আর মনে হলে ধনেপাতা এবং পুদিনা পাতা দিয়ে ভাল করে গিঁট বেঁধে ভাত রান্নার ডেকচি বা হাঁড়িতে ঝুলিয়ে দিন! যাতে জল না ছোয় কিন্তু ধোঁয়া ছুঁয়ে চুঁইয়ে পড়ে টুপ টুপ করে! ঠিক সেই ‘ঘর’ সিনেমার গানটার মতো! আজকাল পাও জমি পর নেহি পড়তে মেরে...!! এই বাষ্প আর ধোঁয়া মিসিয়ে যে জল তৈরী হবে সে একদম বিয়েবাড়ির বেনারসির মতো জেল্লা মারবে!
ভাত রান্নার পদ্ধতিঃ ‘এক ফুট’। এই একফুট কিন্তু বারো ইঞ্চি নয়! একবার জল ফুটে গেলে তাতে চাল ফেলুন! আর পরের বার জল ফুটলে ফ্যান গালুন! অবশ্য আখনির জল হলে একটু সরিয়ে রাখবেন! কেন? বলছি বলছি! এত তাড়াতাড়ি বলে দিলে লেখাটা যথেষ্ট বড় হবে না তো!
যাই হোক! চালটা ভাল করে ধুয়ে একটু ঘিয়ে নেড়ে নিয়ে দেখবেন তো! কেমন হল! বলে রাখছি ঠকবেন না! ও হ্যাঁ! চাল ফোটাবার সময় জলে একটু নুন আর চিনি ফেলে দেবেন! আর জল ফোটাবার সময় যদি কিছু গরম মশলা! যেমন গোল মরিচ, শাহজিরা, ধনে গোটা ফেলে দেন! তো চিবোবার সময় মুখে পড়লে বেশ লাগে কিন্তু!
ভাত হয়ে গেলে পরিষ্কার কাগজে পাখার তলায় ভাত শুকিয়ে নিতে পারেন। মনে রাখবেন, ‘একফুট’-এর ভাতের ভিতরটা হালকা স্বচ্ছ থাকে। সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয়ে গেলে দমে রান্নার সময় ঘ্যাঁট হয়ে যাবার সম্ভাবনা।
আচ্ছা জলের জায়গায় অর্ধেক জল আর অর্ধেক দুধ ব্যবহার করে দেখবেন তো! বলে দিচ্ছি ঠকবেন না!
মাংসঃ ছেলেবেলার গল্প বুঝলেন! বাড়িতে প্রথমবার ল্যাম্ব এসেছে! আর আমি তখন সদ্য সদ্য টারজান অমনিবাস পড়ে উঠেছি! টারজান কাঁচা খায় তো আমি খাব না কেন? একটুকরো মাংস চিউইং গামের মতো খলবল করে খানেক চিবিয়ে তারপর কোঁত করে গিলে হেবি বীরত্ব দেখালাম বটে। মাও ঘটনাটা বুঝে বিশেষ কিছু বলল না!
সে যা হোক! বিরিয়ানির রান্নাতে আমি সবসময় ল্যাম্ব বা মাটনে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ! তার কারণ তার তন্তু বা ফাইবার বড় এবং চট করে নিরস হয়ে পড়ে না!। তবে মাংস রেওয়াজি হলেই ভাল! মুরগী হলে বুকের কাছের ছিবড়ে হবার সম্ভাবনা থাকা টুকরোয় একটু কাট মেরে নেবেন যাতে ভিতরে মেরিনেশন ঢুকে থাকে! তবে ইলিশ বা চিংড়ি বা কাঁকড়ার বিরিয়ানিও করা যায়! তবে সে অন্য গল্প!
আচ্ছা মেরিনেট করবেন কি ভাবে? তার জন্য তো দই আছে। নুন, হলুদ আর ধনে পাতা কাঁচা লঙ্কা বাটা দইয়ে মিশিয়ে তাতে দীর্ঘসময় ধরে মেরিনেট করে রাখুন মাংস। যত বেশিক্ষণ ডুবিয়ে রাখবেন তত স্বাদ!
পেঁয়াজ ভাজাঃ যে যাই বলুক, ভাল মাংস রান্নার গোপন কথা হল পেঁয়াজ ভাজা! অনুভব করেছি! তাই বলছি! লম্বা লম্বা করে পেঁয়াজ কেটে হালকা ঘি আর সাদা তেলে মুচমুচে করে ভেজে তুলুন! করবেন কি একটু নুন আর চিনি দিয়ে দেবেন! দেখবেন চট করে বাদামী রঙ ধরে নিয়েছে! যে কোন মুঘলাই রান্নায় এই পেঁয়াজ ভাজার গুরুত্ব কিন্তু অপরিসীম! আর আধুনিক বিরিয়ানি তো মুঘলাই রান্নারই উত্তরসূরি। পেঁয়াজ ভাজার গন্ধ শুধু নয়, রান্নায় রঙ নিয়ে আস্তেও কার্যকরী হয়।
আলুঃ লক্ষ্ণৌয়ের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ যখন কোলকাতায় নির্বাসিত হলেন তখন বিরিয়ানিও কোলকাতার বুকে তার জায়গা খুঁজে পেল। ট্যাঁকের জোর না থাকুক নবাব সাবের রসনার জোর ছিল খুব! তাই তিনি শাহী খানসামা আর বাবুর্চিদের নিয়েই কোলকাতা গিয়েছিলেন। কিন্তু মাংস খেতে তো ট্যাঁক ব্রিগেড হয়ে যাচ্ছে! তাই গরীবের বিরিয়ানিতে আলু দিয়ে মেকআপ করা শুরু হল। আর ধীরে ধীরে তৈরী হল কোলকাতা বিরিয়ানির রোমান্স।
তা কোলকাতার বিরিয়ানি বলতে এক সময় বলা হত সিরাজ আর আমিনিয়া! কিন্তু এই শতাব্দীর শুরু থেকেই আর্সলানের জয়যাত্রা শুরু! আর কোন এক দাদাগিরিতে বাঙালির দাদা সৌরভ বলে বসলেন যে তাঁর আর্সলানের বিরিয়ানি সবথেকে প্রিয়! আর যায় কোথা! দেশ বিদেশ থেকে অফ সাইডের ঈশ্বরের পূজারিরা কোলকাতায় এসে আর্সলানের প্রসাদ খেয়ে যেতেন। আমিও যে খাই নি তা নয়! তবে প্রথম প্রথম বেশ ভাল লাগলেও আর্সলানের পরিষেবা এবং স্বাদে অবনতি ঘটতে শুরু করে। তখন আবার সিরাজে ফিরে যাওয়া! সিরাজের বিরিয়ানিতে একটা রাহুল দ্রাবিড়ীয় ব্যাপার আছে। পার্সেন্টেজ খেলে যাওয়া! তবে ইদানীং আর্সলান আবার স্বমহিমায় ফিরে আসছে এই বাঁচোয়া। আর আরেকটা জায়গার বিরিয়ানি বেশ টানতে শুরু করেছে কিন্তু! সেটা হল বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের আলিয়াহ (ভাট নয় কিন্তু) দেখা যাক কি দাঁড়ায়!
ওহো আলু বলতে গিয়ে কোলকাতার আলুলায়িত কেশের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম প্রায়! যাই হোক ফিরে আসি মর্তে! তা সেই আলুকে মাংসের মেরিনেশনে একটু স্নান করিয়ে নিয়ে পেঁয়াজ ভাজার তেলেই হালকা বাদামী আধ সিদ্ধ করে ভেজে তুলে সরিয়ে রাখুন।
আখনির মশলাঃ চাল ফোটানোর সময় আখনির মশলাটি তুলে নেবেন এবং অতিরিক্ত জল ঝরিয়ে ঠাণ্ডা করে। হালকাভাবে বেটে নেবেন যাতে মশলাগুলো কিছুটা আলাদা আলাদা ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। মানে একেবারে কাদা বানিয়ে দিলে বিরিয়ানির গোপন মজাটা কাজ করবে না!
মাংস রান্নাঃ তেজপাতা কাঁচা লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে দুটো এলাচ আর একটু দারুচিনি থেঁতো করে ফেলে তার মধ্যে একটু শাহজিরা ফেলে জিরে জিরে করে কাটা একটা পেঁয়াজ ফেলুন। সামান্য নুন চিনি আদা রসুন দিয়ে নেড়ে নিয়ে এবার ম্যারিনেশন শুদ্ধু মাংস ফেলুন কড়াইতে! শাহজিরার জন্য দ্রুত মাংস সিদ্ধ হতে সুবিধা হবে! আর সময় কম থাকলে? মেরিনেটেড মাংসটি শুকনো প্রেশার কুকারের মাঝখানে একটা তেজপাতা রেখে তিনটে সিটি দিয়ে নিন। তবে মাংস কষে যে স্বাদ সে কি আর সিদ্ধ মাংসে পাবেন? মাংসটা হালকা ভাজাভাজা হয়ে এলে এবারে ভাজা আলু দিয়ে নাড়তে থাকুন। আলু আর মাংস মোটামুটি মিনিট তিনেক নাড়ার পর এবারে আখনির বাটা মশলা দিয়ে নাড়ুন। কী? কেমন গন্ধ? টের পাচ্ছেন, আপনার হাতে একটা মাস্টারপিস তৈরী হতে চলেছে? এবার আর কি আখনির জল সেই যে তুলে রেখেছিলেন মনে আছে? সেইটা এবার ব্রহ্মাস্ত্রের মতই ব্যবহার করুন একটু একটু করে। মাংসের সবুজ আর আখনির ধুসর রঙ মিশিয়ে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করেছে। মাংস রান্না হয়ে গেলে নামিয়ে নিন! তবে বিরিয়ানির মতো মাংসটাও যদি একটু দমে রান্না করতে পারেন তো কেয়া বাত।
এই মাংস রান্না করতে গিয়ে যদি কাঁচা থেকে যায়? আরে সে এক বিপত্তি হয়েছিল বটে। একটা টিপস দিয়ে রাখি। সবসময় চেনা বাসন, চেনা চাল এবং চেনা আগুন নিয়ে খেলবেন! পরের পাড়ায় পেঁয়াজী মারতে গেলে জানে মারা যাবার সম্ভাবনা।
এক বন্ধুর বাড়িতে গেট টুগেদার! অন্তত নব্বই শতাংশ অর্কুটে বন্ধুদের সেদিনই প্রথম দেখা হবে! ইতিমধ্যেই গেয়ে রেখে দিয়েছি যে বিরিয়ানি নাকি আমি হেব্বি বানাই! অতএব লেলিয়ে দিয়েছে আমায়! আগুন চিনি না বাসন চিনি না! পেঁয়াজ ভাজতে গেলাম একটা গ্যাসে! তা তার আবার মুখে কথা ফোটে না! আধঘন্টা ধরে নরম হয়ে বসে আছে! বাদামী হবার নামগন্ধ নেই! নামিয়ে যেই গনগনে আগুনে চাপিয়েছি! ব্যাস গেল হুস করে পুড়ে!। মাংসটাও ম্যারিনেট করা ছিল না! আটটায় শুরু করে বেলা এগারোটা নাগাদ দেখি মাংস সিদ্ধ হয় নি! অথচ বিরিয়ানি বসে গেছে! কেলো! তা তখন এক হিতৈষী বন্ধু বুদ্ধি দিল যে দুধে নুন গুলে দিয়ে দিন! ব্যাস দুপুর একটায় যখন দম খেয়ে নামল তখন একদম আই এম বিজয়ন, জিনেদিন জিদান! আহা মুখের ভিতরে যেন ড্রিবল খেলছে।
সাজঃ বিরিয়ানি হল বিয়ের মতো! পেডিকিওর ম্যানিকিওর করে কন্যে রেডি। এবার তার বেনারসি, চন্দন গয়না, মুকুট আর মেহেন্দি!
গভীর পাত্রে হাত দিয়ে গায়ে হলুদের মতো করে ঘি মাখিয়ে নিন। তারপর ভাত মাংস, আলু, আদার জুলিয়েন, কাঁচা লঙ্কা লম্বা করে মাঝামাঝি চিরে দেওয়া, আন্দাজমতো ঘি, খোয়া ক্ষীর বা চিনি, নুন (আন্দাজমতো), হাল্কা গরম মশলা এবং সর্বোপরি পেঁয়াজ ভাজা স্তরে স্তরে সাজান। মাঝে মাঝে একটু করে কেওড়া জল ও একটু গোলাপ জল দিতে ভুলবেন না! খেয়াল রাখবেন হাঁড়ি বা গভীর ডেকচি, যাই নিন না কেন। বিরিয়ানির মুকুট আর পাত্রের ঢাকার মধ্যে নিঃশ্বাস নেবার ফাঁক যেন থাকে।
শেষে চন্দনের প্রলেপ বা আটা মেখে ঢাকা দিয়ে সেই মাখা আটা দিয়ে পাত্রটির বাহিরপথ বন্ধ করুন। যেমন বাহিরের চক্ষু বন্ধ করলে অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়! সেই রকম।
পিঁড়িঃ খুব ভাল হয় যদি ডবল বয়লারে বসাতে পারেন! মানে একটি বড় পাত্রে জল দিয়ে তার উপরে বিরিয়ানির পাত্রটিকে রেখে ঢিমে আগুন জ্বালিয়ে দিন। হোমের আগুন। জল গরম হয়ে বাষ্প দিয়ে ডেকচি বা হাঁড়ির শরীর গরম করে তুলবে আর তার ভিতরের ইঞ্জিন চলতে আরম্ভ করবে।
থালিসেরি বিরিয়ানির ক্ষেত্রে কিন্তু হাঁড়িটাকে বসানো হয় শুকনো নারকেলের মালার আগুনে! আর হাঁড়ির উপর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে দু দিক দিয়েই চেপে ধরা হয়। তবে বাড়িতে গ্যাসের আগুনের জায়গায় কাঠকয়লার উনুন থাকলে কিন্তু দারুণ হতে পারত কেসটা।
বেশি নয়! আধা ঘন্টা! মশলা আর কেওড়ার গন্ধ বাতাসে ঘুড়ি ওড়াতে আরম্ভ করলে বুঝবেন রেডি! ও আরেকটা পথ আছে। শানের মেঝেতে বিরিয়ানির ভাত নিয়ে ফেলুন! দেখুন যদি প্রতিটি চাল আলাদা থাকে তাহলে জানবেন ভাত গলে যায় নি! আর মাংস কি করে বুঝবেন? এহ সে আবার জিজ্ঞাসা করে নাকি! দিন না মুখে ফেলে!
শেষ পাতে রায়তা না সালানঃ তারপর? তারপর আর কি? ধনেপাতা পুদিনা আদা কাঁচালংকা আর আমলকি নুন বেটে চাটনি করুন। আর ওদিকে রায়তা বানান সাদা দই ফেটিয়ে তাতে জিরে ভাজা কাঁচা লঙ্কা নুন দিয়ে। প্রকারান্তরে শসা রসুন কাঁচালংকা গ্রেট করেও রায়তা বানাতে পারেন।
দাক্ষিণাত্যে (হায়দ্রাবাদি বা থালিসেরি বা চেট্টিনাড বিরিয়ানির সঙ্গে) লঙ্কার সালান তৈরী করে বিরিয়ানির সাইড ডিস হিসাবে দেয়! কীভাবে বানাবেন? চীনে বাদাম নারকেল কোরা আর সাদা তিল শুকনো খোলায় নেড়ে নিন। পেঁয়াজ কুঁচি আদা রসুন বাটা ভাল করে তেলে কষে নিন। এরপর সবগুলি উপাদান মিক্সিতে ঘুরিয়ে পেস্ট তৈরী করুন। কাঁচা লঙ্কা শুকনো খোলায় হালকা নেড়ে নিন। এরপর পেস্টটি তেলে দিয়ে নেড়ে তাতে লঙ্কাগুলি দিয়ে দিন। তারপর আন্দাজমতো তেঁতুল জল নুন হলুদ দিয়ে লঙ্কা সিদ্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করুন। তেল ছেড়ে দিয়ে সালান ঘন হয়ে গেলে আপনার মির্চ কা সালান বা লঙ্কার সালান রেডি।
আর একটু আগে বুরহানি বললাম না? ওটা হল দইয়ের জিরে আদা ধনেপাতা পুদিনাপাতা দেওয়া ঘোল। ভারি কিছু হজমের জন্য টেরাই মেরে দেখতে পারেন বটেক।
নিন নিন! শুরু করুন! অপেক্ষায় আছেন কিসের? ও হো বিরিয়ানি তো খোলাই হয় নি তাই না? প্রথম রাত্রের নাকের নথ কানে দুল খোলার মতো আলগা করে আটার প্রলেপ সরিয়ে দিন আর প্রত্যক্ষ করুন নতুন বউয়ের অনির্বচনীয় রূপ!
তালে গোলে মালে দেখুন আমার নিজের হাতেই আপনাদের সঙ্গে সঙ্গে বিরিয়ানিটা রান্না করে ফেললাম। আরে ধুর আর কোন কথা হয় নাকি? এবারে এই পর্যন্তই! কি বলুন!
প্রয়োজনহীন পুনশ্চঃ কিছু জিনিসের পরিমাপ দিয়ে দিলে ভাল হত। তবে কি জানেন তো রান্না হল পেন্টিং-এর মতো। তুলিতে রঙ মেশাতে মেশাতে পরিমাণ নিজেই বুঝে যাবেন। তবে কি না মাথা প্রতি ১০০ গ্রাম চাল নেবেন। প্রতি ১ কিলো চালে সাধারণতওঃ ৫০০ গ্রাম মাংস নেবেন এবং পেঁয়াজও ৫০০ গ্রাম! তার এক দুটি রেখে বাকিটা ভাজার কাজে ব্যবহার করুন।
প্রঃ পুঃ ১- একটু একটু পেঁয়াজ ভাজা মাংস কষার সময় দিতে থাকা, আর বিরিয়ানির সাজের একেবারে উপরে আদা জুলিয়েন লঙ্কা চেরা আর পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে মুকুট সাজানো।
প্রঃ পুঃ২- সিদ্ধ ডিম ব্যবহার করতে পারা যায় লম্বালম্বি অর্ধেক করে। টেক্সচারে অন্য বিভবের সৃষ্টি হবে।
প্রঃ পুঃ৩- বেঁচে যাওয়া বিরিয়ানি পরের দিন হালকা গরম করে খেয়ে দেখবেন! উফ চাল আর মাংস যেন আরও সরেস হয়ে গেছে!
প্রঃ পুঃ৪- না থাক! আর বেশি কথা বলে কাজ নেই! আসুন হাত লাগাই! ওহো! ওই হাঁড়ির নিচে একটু ভাত হাঁড়ির সঙ্গে বাদামী সোনালি ভাজা ভাজা হয়ে লেগে আছে, সেটা কিন্তু আমি খাব! হি হি!
লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।