ফিসফাস কিচেন
জুন ৩০, ২০১৬
চিংড়ি
সৌরাংশু
কে জানে কোন কাক ডাকা ভোরে, চিংড়ি মাছ রুইয়ের জায়গা নিয়ে নিল! মানে আমি ছেলেবেলায় ঘটি-বাঙালের লড়াইয়ে জানতাম ইলিশ বনাম রুই- কাতলাই প্রতিযোগী। চিংড়িকে কি তখন মাছ হিসাবে ধরা হত না? নাকি আমার জানার মধ্যে গলদ ছিল? কে জানে! যাই হোক এখন ঘটি-বাঙাল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান লড়াইয়ে রুই-কাতলাকে সরিয়ে দিয়ে চিংড়িই চলে এসেছে অগ্রভাগে। বনেদিয়ানার জায়গা নিয়েছে সার্বজনিনতা।
কিন্তু চিংড়ি কি শুধু ঘটিদের প্রতীক? মঙ্গলকাব্য যদি ঘুরে দেখি, বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’-কাব্যে সণকার রান্নাঘরে উঁকি মারলে দেখা যায়ঃ
‘ভিতরে মরিচ-গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সূতা।
তৈলে পাক করি রান্ধে চিংড়ির মাথা।’
আবার দ্বিজ বংশীদাসের মনসামঙ্গলেও পাই ‘বড় বড় ইঁচা মৎস করিল তলিত।’ চণ্ডীমঙ্গলের খুলনা চিংড়ির বড়া বা অন্নদামঙ্গলের পদ্মমুখী ‘চিঙ্গরির ঝোল’ রান্না করছেন বলেও দেখতে পাই। তাহলে?
তাহলে আর কী? ফরাক্কা বা বাগবাজারে বা শ্রীরামপুরে কি ইলিশ পাওয়া যায় না? নাকি গঙ্গার ইলিশ স্বাদে গন্ধে পদ্মার ইলিশের থেকে কোন অংশে কম? আর ইলিশ তো শুধুমাত্র এই গাঙ্গেয় বদ্বীপেই আটকে, চিংড়ি সেখানে বিশ্বজনীন।
মার্কিন দেশ থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে তুরস্কের গলিখুঁজি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ছুঁয়ে ভারতবর্ষের আসমুদ্র হিমাচল ডিঙিয়ে মালয়প্রান্তরে বা চীনদেশ হতে জাপানি ডাইডোকোরোতেও এর সমান কদর। তবে বিশ্বজনীননতার হিসেবে বাংলায় কিন্তু ভাষাভিত্তিক একটা শোধ আমরা তুলে নিয়েছি। সেই যে সাহেবরা মামা কাকা মেসো পিসে সবাইকে অ্যাসেমব্লি লাইনে ডাকে আঙ্কল আর স্ত্রী লিঙ্গে আন্টি। আমরা তার শোধ তুলেছি চিংড়িতে। চিংড়ি সর্বজনীন দাদা! লবস্টারও চিংড়ি, প্রণও চিংড়ি, শ্রিম্পও চিংড়ি। হ্যাঁ ভাগ আছে! নিশ্চয় আছে। দু বাংলা মিলিয়ে চাপড়া, কুচো, ঘুষো, কাদা হয়ে গলদা, বাগদায় প্রায় ৫৬ রকমের চিংড়ির দেখা পাওয়া যায়। তার মধ্যে ৩৭টি নোনা জলের, ১২টি কম নোনা জলের এবং ৭টি মিষ্টি জলের চিংড়ি।
এতো গেল হিসাব আর পরিসংখ্যান। নামকরণ আর দাঁত ব্যথার গল্প! তা খাওয়াটা নিয়ে কি হচ্ছে? খাওয়া? আরে খাওয়া নিয়েই তো এত মাথাব্যথা? আরে এ কি ললিত লবঙ্গ লতা ইলিশ নাকি? এই চলবে না সেই চলবে না তাই চলবে না? এ হল চিংড়ি। যাতে দেবেন মহায় তাতেই মহার্ঘ্য!
একটু পেঁয়াজ রসুন শুকনো লঙ্কা কুঁচিয়ে অ্যাভোক্যাডো (না পেলে চীনেবাদাম বাটা) দিয়ে অলিভ অয়েল টম্যাটো বাটা দিয়ে মেখে খুব কড়া আঁচে হালকা নেড়ে ধনে পাতা কুঁচি দিয়ে টরটিয়া (ভুট্টার শুকনো পাঁপড়) দিয়ে কুড়মুড়িয়ে খান। আহা মেক্সিকান ‘ম্যাক্সি খান’! আর তা না হলে অলিভ অয়েলে বেশ করে পেঁয়াজ রসুন শুকনো লঙ্কা টম্যাটো দিয়ে নেড়ে তাতে ক্রিম মিশিয়ে চিংড়ি কুঁচি কুঁচি করে দিয়ে জল ঢেলে কর্ণফ্লাওয়ার ঢেলে হালকা আঁচে নেড়েচেড়ে শেষে চীজ দিয়ে নামিয়ে নিন। প্রণ বিস্ত্রো।
ফ্রেঞ্চ ক্যুজিনে আসুন। প্যাঁজকলি রসুন ক্রিম চীজ পার্স্লে মেয়োনিজ আর গোল মরিচ নাড়তে চাড়তে তার মধ্যে চিংড়িগুলি দিন। নামিয়ে নিয়ে ঠাণ্ডা করুন। গোল পাঁউরুটির উপর মিশ্রণটি লাগান আর একটা করে চিংড়ি মাছ লম্বা কাটা টম্যাটো আর পার্শ্লে কুঁচি রাখুন। ব্যাস ফরাসি প্রণ ক্রস্তিনি তৈরী।
মুসুর ডাল চিংড়ি
|
ভূমধ্য সাগরে আসুন। অলিভ অয়েলে পেঁয়াজ নুন গোল মরিচ গুঁড়ো দিয়ে ভেজে বাদামী করে নিন। একটি পাত্রে বালসামিক ভিনিগার মাস্টার্ড সস ভাল করে ফেটিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে অলিভ অয়েল ঢালতে থাকুন থকথকে করতে। অপর পাত্রে তেল গরম করে রসুন ফেলে তাতে চিংড়িগুলি হালকা নেড়ে নিন। এবার পাত্রে চিংড়িগুলি রেখে ঝট পট লেবুর রস দিন। আর তাতে ভাজা পেঁয়াজ ও মিশ্রণটি হালকা করে ঢেলে দিন। অবশ্য পালং পাতা নিয়ে সেটিও উপরোক্ত মিশ্রণে নেড়ে ভাপিয়ে নিয়ে। তা বেস হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন।
চলুন মরক্কোয় যাই। হারিসা বা লঙ্কাবাটা আর তেল দিয়ে প্রি হিটেড বেকিং ট্রে গ্রীজ করুন। তাতে রোজমেরি রেখে লম্বা লম্বা করে কাটা আলু, বেসিল পাতা, টমাটো আর লেবুর খোসা গ্রেট করে দিয়ে ওভেনে রাখুন যতক্ষণ না পর্যন্ত আলুগুলি প্রায় রান্না হয়ে যাচ্ছে। তার উপর চিংড়ি রেখে লেবুর রস দিয়ে আরও দশ মিনিট ওভেনে রাখুন। আর শেষে বেসিল পাতা দিয়ে সার্ভ করুন।
এই রান্না টা সার্ভ করার সময় ঐতিহ্যশালী মরোক্কান পাত্রে করুন। যা অনেকটা উল্টানো ধুনুচির মতো দেখতে।
পুঁইশাক চিংড়ি
|
ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইটালিতে যাওয়া যাক। বড় বড় গলদা চিংড়ির মাথা আর গায়ের খোল খুলে নিয়ে স্কিউয়ারে লাগান। তেল গরম করে তাতে মুড়োগুলো দিয়ে দিন। কমলা রঙ হলেই তাতে ছোট পেঁয়াজ কুঁচি রসুন কুঁচি গাজর কুঁচি আর পার্শ্লে কুঁচি দিন আর তাতে জল দিয়ে ফুটতে দিন। হয়ে গেলে পুরোটা ব্লেন্ডারে মিশিয়ে নিন আর ছেঁকে নিন। অপর পাত্রে মাখন গরম করে চেলে নেওয়া ময়দা ধীরে ধীরে ঢালুন যাতে দানার সৃষ্টি না হয়। তাতে গরম দুধ দিয়ে নাড়তে নাড়তে মোলায়েম পেস্ট তৈরী করুন। লেবুর রস নুন আর পার্স্লে কুঁচি দিয়ে ভাল করে নেড়ে নিন। অপর একটি পাত্রে মাখন দিয়ে রসুন কুঁচি দিয়ে স্কিউয়ারে রাখা চিংড়িগুলি হালকা করে ভেজে নিন। এবারে লাসানিয়া সিটগুলি তেল জল ও নুনের মিশ্রণে হালকা রান্না করে নিয়ে ঠাণ্ডা করে রাখুন। বেকিং ট্রেতে প্রি হিট করে মাখন মাখান। সসটি ১/৩ অংশে স্কিউয়ারে রাখা চিংড়িগুলি মেরিনেট করে রাখুন। লাসানিয়া সিটগুলি রেখে তার উপর মেরিনেটেড চিংড়ি রেখে প্রতিটি চিংড়িকে ঘিরে একটি করে রোল তৈরী করুন। বেকিং ট্রে তে বাকি সস দিয়ে তাতে একটি একটি করে চিংড়ি সমৃদ্ধ লাসানিয়াগুলি রাখুন তার উপর সসটি এবং টম্যাটো সস ও পার্মেসান চিস গ্রেট করে দিন। এর পর মিনিট দশেক ওভেনের ভিতর রাখুন। রান্না হয়ে এলে দরজা খুলে আরও মিনিট দশে ঠাণ্ডা হতে দিন। ব্যাস বেকড প্রণ ক্যানেলোনিস তৈরী। অবশ্য এর মধ্যে পারেন তো ইটালির সর্বত্র একটু ঘুরেও আসতে পারেন। তবে কি না যত বড় রেসিপি তত বেশী সময় লাগবে না এটা গ্যারান্টি। যদি সমস্ত উপকরণ হাতের কাছে থাকে।
এবারে একটু খাওয়া দাওয়ায় বিশ্রাম দিই। আসুন চিংড়ি নিয়ে গান শুনি! চিংড়ি নিয়ে গান? আরে রাজেশ খান্নার ঠোঁটে শোনেন নি? কিশোর কুমারের ব্যারিটোনে? ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে...’ আরে চিংড়ির বারবিকিউয়ের গান না সেটা?
চিংড়ি বন ফায়ার
|
বিশ্রামের পর এবারে আসি লবস্টারের প্রসঙ্গে। দামড়া দামড়া নীল নীল গলদা চিংড়ি, যার দু দুটো কাঁকড়ার মতো দাঁড়া রয়েছে তার ঘিলুর স্বাদেই তো মাতোয়ারা। আলাদা করে মাংস খাবেন তো মাখনের সমুদ্রে ডুবে যাবেন। (চিংড়ির মাংস কথাটা ভাবলেই কেমন একটা প্যাণ্ডেমোনিয়াম এফেক্ট হচ্ছে বটে! সে যা হোক)
এই লবস্টারের মুড়ো দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করলেও তার যা খোশবু আর সোয়াদ তা লাগে কোন সাধ্যি। এই যে সমস্ত রেসিপিগুলো আলোচনা করলাম সেগুলো তো ভিনদেশী পশ্চিমী রান্না। মশলার বালাই নেই খালি নুন মরিচ আর চিংড়ি দিয়ে ওয়াহ জনাব বাহ ওস্তাদ গিরেত মঁসিয়ে সেনোর করে বেরানো। আসুন দিকি একটু এই সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ভারতবর্ষের মাটিতে। চিংড়ি দিয়ে বিরিয়ানি, গোয়ানিজ প্রণ বা প্রণ বালচো, প্রণ ফ্রাই কেরালা স্টাইল, প্রণ কোলিওয়াড়া, প্রণ পোলাও, প্রণ মালাইকারি আর ডাব চিংড়ি। পৃথিবীতে এমন দৃষ্টিনন্দন ডিশ আর আছে বলুন?
সর্ষে শুকনো লঙ্কা কুঁচি হলুদ তেঁতুল ফোড়ন দিয়ে কেরালা স্টাইল প্রণ ফ্রাই। তেঁতুল টম্যাটো শুকনো লংকা রসুন পেস্ট দিয়ে পেয়াজ আর কাজুর মদ ফেনি দিয়ে গোয়ানিজ প্রণ বালচো। শুকনো লঙ্কা আদা রসুন লেবু আর জোয়ানে মেরিনেট করে মাখনে ভাজা সুস্বাদু প্রণ কোলিওয়াড়া। অথবা আমাদের নিজস্ব প্রিয় আদা রসুন গরম মশলা আর নারকেল বাটা দিয়ে চিংড়ির মালাইকারি।
ভাপা চিংড়ি
|
তবে দর্শনধারীর কথা বলতে গেলে আসে ডাব চিংড়ি। রান্না যে খুব অসুবিধাজনক তা কিন্তু নয়। চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে রাখুন। একটি শাঁসওলা ডাব নিয়ে মাথাটা কেটে নিন। নিচটাও কেটে নিন যাত বসানো যায়। এবারে চার ডাবের উপর দিকটা বড় করে কেটে শাঁস বার করে নিন। এবারে সর্ষে বাটা আদা রসুন বাটা নারকেলের শাঁস বাটা নুন হলুদ গরম মশলা (সামান্য) দিয়ে এক সঙ্গে ব্লেন্ড করে নিয়ে চিংড়ি তাতে দিয়ে নেড়ে জল শুকিয়ে নিন। থকথকে কাই থাকবে। এবারে সবকিছু ডাবের খোলের মধ্যে পুরে তার উপর খান চারেক-পাঁচেক কাঁচা লঙ্কা চিরে ফেলে একটু সরষের তেল দিয়ে মুখটা কাটা টুকরো দিয়ে বন্ধ করে ওভেনে বেক করুন মিনিট দশেক। তারপর ডাবের ঢাকা খুলে পরিবেশন করুন। আরে যান মশায়, এর পর আর কিছু থাকে নাকি?
থাকে থাকে, মালয় বা শ্যাম দেশের নারকেল দিয়ে শুকনো আদা দিয়ে লেবু পাতা দিয়ে চিংড়ি আর চিন দেশের চিলি প্রণ বা গার্লিক প্রণ পেরিয়ে থাকে চিংড়ির সুশি।
সুশির জন্য বিশেষ ছোট চাল নিয়ে জল শুকনো অবধি সিদ্ধ করে ছড়িয়ে নিয়ে শুকিয়ে নিয়ে তা ভিনিগার আর নুন চিনির মিশ্রণের সঙ্গে ভাল করে মেখে নিতে হবে। এর পর সুশি শীটের উপর রেখে লম্বা লম্বা করে কেটে নিতে হবে। এরপর পাতলা পাতলা করে কাটা শসা, গ্রেট করা আভোক্যাডো, নুন সয়া সস ও নুন ও মরিচে হাল্কা নেড়ে নেওয়া চিংড়ি একত্রে মিশিয়ে নিয়ে তা সুশি শীটে রাখা নোরি (খাবার যোগ্য সামুদ্রিক আগাছার লম্বা লম্বা শীট)র উপর ভাতের শিট রেখে তার উপর চিংড়ির মিশ্রণটি রেখে একসঙ্গে মুড়ে নিয়ে তা ছোট ছোট রোলে কেটে নিতে হবে এবং পরিবেশনের সময় সয়াসস দিয়ে পরিবেশন করতে হবে। নোরি যদি নাই পান তাহলে কি পেঁয়াজ পাতা ভাপিয়ে ব্যবহার করবেন? ভেবে দেখতে পারেন কিন্তু।
চিংড়ি মালাইকারি
|
আর কি বাঙালির রসনার বাসনাকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়ে ডানা মেলে দিক চিংড়ি। মুসুর ডাল দিয়ে চিংড়ির বড়া যেমন থাক তেমনই থাক দই নারকেল রসুন আদা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বসানো ভাপা চিংড়ি।
আর বাঙালির রসনার তৃপ্তি তো গানের মাধ্যমে তার জন্য থাক গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা, রাজেন সরকারের সুরে ১৯৫৮ সালের মানময়ী গার্লস স্কুলের গান ‘চিংড়ি মাছের মালাইকারি’। বাদবাকি তো ঝালে ঝোলে অম্বলে মালাইকারিতে মিশে মিলে থাকুক মাথার মুকুট হয়ে। আমেন।
লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।