প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ফিসফাস কিচেন

জুন ১৫, ২০১৬

 

সাতরঙা ইলিশ

সৌরাংশু


পাগল না প্রতিভাধর? মহম্মদ বিন তুঘলককে ইতিহাস কি ভাবে মনে রেখেছে তা ইতিহাস পাঠক পাঠিকারাই বিচার করুন। কিন্তু আমি মনে রেখেছি অন্য কারণে। আলি সাহেব একবার তা বলেছিলেন বটে।

বিশাল বড় সাম্রাজ্য চালাতে তিনি তো ১৩৩১-এ ঝেঁটিয়ে সবাইকে নিয়ে দেবগিরি নিয়ে গেলেন। নাম রাখলেন দৌলতাবাদ। কিন্তু তার পর সেখান থেকেও ফিরে এলেন দিল্লি ১৩৩৫-এ। এই সব খামখেয়ালের চক্করে দাক্ষিণাত্যে ইতিমধ্যেই সাম্রাজ্যের উপর থেকে কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল।

এবার সিন্ধু প্রদেশে গুর্জররা (তাঘি) বিদ্রোহ করে বসল। সালটা ছিল ১৩৫১। তা সে সামলাতে সুলতান নিজেই ছুটলেন। তা সুলতান মানুষ শুধু কি যুদ্ধ করেই থাকতে পারেন? একটু খাওয়া দাওয়া করতে হবে তো! সময়টা ছিল বর্ষার আগে পিছে। আর সিন্ধু নদে তখন পাল্লা মাছের খুব আনাগোনা। তাহলে আর কি, জাল ফেলরে! মাছ তোলরে! আর সে মাছের কি অপূর্ব স্বাদ। তা একটু কাঁটা আছে বটে কিন্তু মুখে দিলে কোয়ালিটি আইসক্রিমের মতই গলে চলে যায়। আহা অল্পেতে আশ মেটে না এ স্বাদের ভাগ হবে না।

তা এই করতে গিয়েই তো আর সংখ্যার মাপজোক ঠিক থাকে না। আর যা হবার তাই হল, পেট পাতলা পাগলা রাজা তিন দিনেই সিন্ধু প্রদেশে পটল চাষ করে ফসল কেটে ফেললেন।

এর পরেও একবার পাল্লার কথা এসেছে বটে, সেটা ১৫৪১ খৃষ্টাব্দ। শেরশাহের তাড়া খেয়ে দিল্লির গদিচ্যুত বাদশা নামদার হুমায়ুন সামান্য কয়েকজন অনুচরকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পৌঁছলেন সিন্ধু প্রদেশে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কাছে। তা যে ক মাস ছিলেন সুখে শান্তিতেই পাল্লা খেয়ে কাটিয়েছিলেন। তারপর আর কি, সেখান থেকেও তাড়া খেয়ে চলে গেলেন পারস্য। ভাগ্যের চাকা এদিক ওদিক দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে এসে বসলেন দিল্লির মসনদে ১৫৫৫তে। কিন্তু পড়াশুনো করে যে গাড়িচাপা পড়ে সে... তাই লাইব্রেরি থেকে নিচে নামতে গিয়ে পপাত চ মমাত চ! কিন্তু সে তো অন্য প্রসঙ্গ।

তার আগে আসুন একবার পাল্লা মাছের একটা রেসিপি ঘেঁটে দেখিঃ পেঁয়াজ, আদা, ধনে পাতা, টমেটো, লঙ্কা, ধনে গুঁড়ো, দই আর আমচুর পরিমাণমতো নিয়ে নেড়ে চেড়ে তুলে রেখে তারপর পাল্লা মাছটাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দু ভাগে কেটে তা হাল্কা আঁচে তেলে দিয়ে দু পিঠ সামান্য নেড়ে নিয়ে গরম প্যানে রাখুন যাতে ভিতরের মাংসল দিকটি উপরে থাকে তার উপর উপরোক্ত মিশ্রণটি দিয়ে ঢাকা দিয়ে ভাপে রান্না করুন কিছুক্ষণ। তারপর আর কি! রবিবারের দুপুরে মোচ্ছব।

এতক্ষণ ধরে এই ভ্যান্তারা যখন পড়েছেন তখন... আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন এই পাল্লাই হল আমাদের ইলিশা হিলসা বা বাঙালদের প্রিয় ইলিশ। নেবারস এনভি ওনারস প্রাইড। তবে বাঙালরা আমাগো ইলিশ করে নাচলে কি হবে, ঘটি এমন কি পার্শ্ববর্তী ওড়িয়াদের ব্যঞ্জনে রসনার বাসনায় ইলিশ সরতাজ নিয়ে বসে আছে।

ঘটি হয়েও যখন ইলিশ নিয়ে আমরা আঠারো পর্বের মহাভারত লিখতে বসি তখন বাঙালদের কথা আর কি বলব? পদ্মার ইলিশের কথা কইতে এহনো পানি বয় গো কত্তা! জিভ জুইড়্যা পানি,  চক্ষু জুইড়্যা পানি। ইলিশ আমার সে পানিতে ভাইস্যা গ্যাসে গো কত্তা।

বাংলাদেশে তো ইলিশ জাতীয় মৎস্য। নববর্ষের দিন দেড় দু হাজার বাংলাদেশী টাকা খরচ করে ইলিশ-পান্তা না খেলে নাকি ঘড়ির কাঁটাই ঘুরবে না বছর শুরুতে। আসুন একখান বাংলাদেশী রেসিপিও দিয়ে দিঃ ইলিশটারে নুন হলুদ মাইখ্যা হাল্কা কইর‍্যা ভেজে নিন। তারপর পেঁয়াজ কাঁসা লঙ্কা আদা রসুন দিয়ে বেশ কইর‍্যা নাইড়্যা তাতে তেঁতুলের কাথ দিয়া ইলিশ টুকরাগুলানরে তার মইধ্যা ফেইল্যা দিন। তারপর ভাপে তাপে রান্না হইলে এক থাল ভাত লইয়া সাবড়ে নিন।

আহা দাঁড়ান একটু জল খেয়ে নিয়ে আবার লিখি, এত নালঝোল পড়তে আরম্ভ করলে তো জামা কাপড়ের দফা রফা হয়ে যাবে।

যাই হোক, এই ইলিশ মহাভোজী ইলিশ বাঙালীর পাতে পাতে আস্তে আস্তেই হঠাৎ কেমন করে বহির্মুখী হয়ে গেল কে জানে। এই সেদিনও দুশোটাকার মধ্যেই পাওয়া যেত, আর এখন তো তিন পেরিয়ে চার সংখ্যায় দাম পৌঁছে যায়। দু কিলো তিন কিলোর ইলিশ তো এখন আর দেখতেই পাওয়া যায় না। দেখলেও হাত দিলেই ঈলের মতো ছ্যাঁকা মারে।

মাঝে কিরণময় নন্দ মৎস্যমন্ত্রী হলে ইলিশ দৌত্যের মাধ্যমে পদ্মাপারের ইলিশও যেমন এপারের বাঙালির পাতে পৌঁছচ্ছিল, তেমনই কোলাঘাটের ইলিশও রীতিমত প্রতিযোগিতার মুখে ফেলছিল পদ্মার পেয়ারীকে। তবে আমাকে যদি বলেন তাহলে কেন জানি না মনে হয় কোলাঘাটের ইলিশের গন্ধ বর্ণই মাসাল্লাহ! তাকে গঙ্গার পারে চাঁদের আলোয় ফেলে রাখলে বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়ের নদী পাশে পড়ে থাকা হিরের মতো ভুল হতে পারে।

নদীমাতৃক বাংলার রূপোলী ফসল আমাদের প্রাণের ফসল এই ইলিশ। কিন্তু প্রতিবেশী ওড়িশাতেও এর জনপ্রিয়তা প্রচুর। ওড়িয়ায় প্রবাদবাক্য আছে, “মাচ্ছ খাইবে ইলিশি, চাকরি করিবে পুলিশি” আবার আরও একটু দূরে অন্ধ্রউপকূলের প্রবাদ যে ইলিশের যা স্বাদ, তাতে নাকি বিয়েকেও দাঁওতে রাখা যেতে পারে।

সে সব কথা থাক, ইলিশের মরসুম শুরু সরস্বতী পুজোয় জোড়া ইলিশ দিয়ে বরণের মাধ্যমে আর শেষ হতে হতে শারদে বোধন। কিন্তু পরিস্থিতির ফেরে আম বাঙালীর পাতে ইলিশ পড়তে পড়তেই বছর পেরিয়ে যায়। খাবি কি কত্তা দামে মরে যাবি! তবু ভরিবে না চিত্ত। যদি না ইলিশ পাতে পড়ে নিত্য। নিত্য না হোক একটি বারের জন্যও যদি রান্নাঘর আলো করে ঝিলিক মারে তাহলেই পুর বছরের জন্যই দিল বাগ বাগ হয়ে যায় কত্তা। তারপর আর কি, সর্ষে বাটা বা নারকেলের দুধ বা দই দিয়ে ইলিশ মেখে টিফিন বাক্সে নুন তেল হলুদ আর কাঁচা লঙ্কা চেরা সহ বসিয়ে দিয়ে বেশি না পাঁচ মিনিট ভাপে। তারপর? হুগো বসের বা কোবরার পারফিউম ফেল মেরে যাবে গন্ধে। আর তেলটা নেড়ে ভাজা মাছ উলটে অথবা ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক বা পুঁইশাক। যাব কোথায় আহা! পথ খুঁজে না পাই।

একটা ওড়িয়া রেসিপি দিই? মাছটা ভেজে তুলে রাখুন। তারপর জলে আলু, কচু, ওল আর ছোলার ডাল সেদ্ধ করে নিয়ে পেঁয়াজ আদা রসুন টমাটো লংকা ধনে গুঁড়ো জিরে গুঁড়ো দিয়ে কসে মাছ ও সেদ্ধ সবজিগুলো ঢেলে ফোটান। নামাবার সময় দারুচিনি গুঁড়ো দিয়ে নামিয়ে নিন। ইলিশ মাচ্ছ মহুরা প্রস্তুত।

যাবার আগে কটা কথা, আমজনতার ইলিশ উৎসব এখন দেখছি ক্রমে ক্রমেই আম পেরিয়ে খাস হতে হতে দুর্লভ হয়ে উঠছে। যতই সারা বছরের রুই, কাতলা, পাবদা, ট্যাঙরা, পার্শে, চিংড়িতে ডুবতে ভাসতে থাকি না কেন, কাব্যিক বাঙালির অন্ত্যমিলের ছন্দ কিন্তু ইলিশের নামগানেই আসে। সে ঘটি কিংবা বাঙাল। ভাষার রকমফেরেও স্বাদের বদল হয় না যে। ওম ফট স্বাহা!!!    


লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারিক। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।