ফিসফাস কিচেন
জুলাই ৩০, ২০১৬
লঙ্কাকাণ্ড
সৌরাংশু
বাল্যকালে এক্সরসিস্ট বলে একখান সিনেমা দেখেছিলাম। আর বেশ বয়সকালে আমার গৃহকর্ত্রীর অতিরিক্ত পছন্দের কারণে একটা ফিল্মকে বার ছয়েক দেখতে হয়েছিল নাম ‘হাম দিল দে চুকে সনম’। বিজ্ঞজনেরা এক্সরসিস্টের সেই বাচ্চাটার সঙ্গে ঐশ্বর্য রাইয়ের মিল খুঁজতে যাবেন না! অথবা পাদ্রির সঙ্গে অজয় দেবগণের! বরং চুপটি করে বসে শুনুন! এবারের ফিসফাস কিচেন হচ্ছে সাসপেন্স থ্রিলার। সাসপেন্স আছে আর থ্রিলও! আর আছে লঙ্কা! এক্সরসিস্টের নির্মাতারা নাকি চ্যালেঞ্জ করেছিল যে এই সিনেমা একা বসে দেখতে পারলে মালামাল করে দেবেন! অর্থাৎ পোস্কার কথা হল একা দেখবেন না! ঠিক যেমনটি হল লঙ্কাকে একা চিবোবেন না! চিবোলে ঐশ্বর্য রাইয়ের বিরহিণী রাধার মতো নালে ঝোলে অবস্থা হবে।
তা বলে কি জনবহুল স্থানে চিবিয়ে শান্তি পাবেন ভাবছেন? হেহ! চিল্লিয়ে পাবলিকের কানের পোকা নড়িয়ে দিলেও জিভ টাগরা হৃদয় পেট এবং সর্বশেষে সেই গুহ্য স্থানটি জ্বলা থেকে রেহাই পাবেন না। তাই আসল কথা হল লঙ্কার সঙ্গে অবশ্যই টঙ্কা ফঙ্কা খাবেন! লঙ্কা এমন একটি জিনিস যা যে কোন খাদ্যদ্রব্যকে স্বাদে গন্ধে সর্বোত্তম পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। যেখানে ছবি বিশ্বাস বা কমল মিত্ররাও জাঁক দেখিয়ে ফাঁক খুঁজে পায় না।
সব মশলার সেরা মশলা, সব ফোড়নের সেরা ফোড়ন হল লঙ্কা। অথচ মশলার দেশ ভারতবর্ষে এই লঙ্কার কোন হদিশ পাওয়া যায় না প্রাচীন কালে। পুরাতত্ব বলছে প্রাচীন ভারতে শুধুমাত্র তিনখানা মশলা ছিল! জিরা, পিপুলি (মরিচ) এবং সর্ষপ (সর্ষে)!
এই যে লাল সবুজ তেল চুকচুকে চেহারার চলমান অগ্নিকুণ্ডটি ভারতবর্ষে আসেই পর্তুগীজদের হাত ধরে মোগল আমলে! বস্তুত: কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে এই বস্তুটির কথা বাকি পৃথিবী জানতই না! যদিও সাড়ে সাত হাজার বছর ধরে লঙ্কার চরিত্রচঞ্চরী করে বেড়াচ্ছেন আম্রিগাবাসী। ও হ্যাঁ! এই যে লঙ্কা, একে স্পেনীয়রা আবিষ্কার করেও শুধুমাত্র হটনেস কোসেন্টের কারণে চিলি পেপার নাম দিয়েছিল। চিলি পেপার আর ব্ল্যাক বা হোয়াইট পেপারের স্বাদ একই গোত্রের কি না! আর পেপার যে পিপুলি থেকে এসেছে এ আর নতুন করে বলার কি আছে বলুন!
যাই হোক আম্রিগার পোলা বিশ্বজয়ে বেরিয়ে কবে যে ভারতবর্ষ বিশেষত: বঙ্গরসভুবন জয় করে ফেলল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! ভারতীয় খানায় আজকের দিনে মরিচের ব্যবহার যত না, তার থেকে বেশী হয় লঙ্কার ব্যবহার!
তাহলে আসুন লঙ্কার ধরণ ধারণের সঙ্গে একটু আধটু পরিচিতি লাভ করি!
এটা মোটামুটি পাক্কা খবর যে বলিভিয়াতেই প্রথম লঙ্কার ব্যবহার নজরে আসে। সে লঙ্কার নাম ছিল ‘উলুপিকা’।
এই যে লঙ্কার লঙ্কার ঝাল বা তেজ আমাদের জিভের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে প্রাণ আকুল করে তোলে এর পিছনে আছে ‘ক্যাপসাইসিন’! নামটা কোথা থেকে এসেছে বুঝতেই পারছেন! ক্যাপ্সিকাম! লঙ্কা যে প্রজাতির সদস্য। একদম সিনিকাল ব্যাপার একদম মশায়! সারা মামল্লপুরমের বাসিন্দারা অর্থাৎ ম্যামেল বা স্তন্যপায়ীরা এই ক্যাপ্সাইসিনের কবলে পড়ে হাসফাঁসিয়ে ওঠে। তবে এ একা নয়! একদম দলবল নিয়ে হামলা করে। দলটার নাম ক্যাপ্সাইসিনোড! আর এর নেতা হল ক্যাপসাইসিন আর তার সহোদর ডিহাইড্রোক্যাপসাইসিন। এরাই মূলত: ঝামেলা করে! আর ছোটো মোটো যারা আছে তারা নরডিহাইড্রো, হোমোডিহাইড্রো, হোমো এই সব নাম নিয়ে ক্যাপসাইসিন পদবী জুড়ে লেজুড় লেগে যায়। আর এই পরিবারের খালাতো বা মামাতো ভাই হল নোনিভিমাইড! যে লঙ্কার বিশেষ গন্ধটি যোগ করে যা থেকে ঝালের অনুমান আসে। একটা বিশেষ তথ্যঃ পেপার স্প্রে বলে যে মালটি নারীসহায়ক হিসাবে বাজারে পরিচিত, তা কিন্তু তৈরিই হয় এই ক্যাপসাইসিন দিয়ে। পারলে একবার বদ্ধ ঘরে এক ফোঁটা ফোঁত করে ছেড়ে দেখবেন। পুরো সাড়ে সাত হাজার বছরের ইতিহাস দিব্যচক্ষে দেখতে পাবেন কথা দিচ্ছি!
এবারে আসি স্কোভিলের কথায়। স্কোভিল মানে অ্যামেরিকান ফার্মাসিস্ট উইলবার স্কোভিল। ১৯১২ সালে তিনি ঝালের একক তৈরি করেন। স্কোভিল হিট ইউনিট। এই পদ্ধতিতে প্রথমে লঙ্কাকে শুকিয়ে অ্যালকোহলে এবং তার পর চিনির জলে ভিজিয়ে তাকে ঘন দ্রবণ করে পাঁচজন প্রশিক্ষিত স্বাদ পরীক্ষককে দেওয়া হয়। তবে স্কোভিল পদ্ধতিতে পরিমাপ একেবারেই ত্রুটিমুক্ত নয় কারণ মানবিক এলিমেন্ট থাকে বলে! পরবর্তীকালে যদিও হাই পারফরম্যান্স লিক্যুইড ক্রোমাটোগ্রাফি পদ্ধতি অথবা অ্যামেরিকান স্পাইস ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের ঝাল পরিমাপ পদ্ধতি অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক বলে স্বীকৃত। তবুও জনপ্রিয়তা এবং সহজভাবে বোঝার জন্য স্কোভিল পদ্ধতি এখনও নিজের বাদশাহিত্ব কায়েম করে আছে।
এবারে স্কোভিল হিট ইউনিট বা এসএইচইউ দিয়ে যাচাই করে নিই আক্রমণের তীব্রতায় কোন লঙ্কা ব্রাজিল আর্জেন্টিনা জার্মানি আর কোন লঙ্কা হাইতি গুয়াম পাপুয়া নিউগিনি। হিসাব বুঝতে প্রথমেই ধরে নিই শিমলা মির্চ বা ক্যাপ্সিকামকে, যার এসএইচইউ হল শূন্য। এরপরে ধরে নিই আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হ্যালেপানো-আড়াই হাজার থেকে আটহাজার এসএইচইউ। বাঙালির বাড়ির কাঁচা লঙ্কা বা ধানি লঙ্কা যাকে আদর করে বার্ডস আই পেপার বলা হয় তার এসএইচইউ হল এক থেকে দুলাখ পঁচিশ হাজার।
সেখানে দাঁড়িয়ে ভূত জালোকিয়ার মতো টাওয়ারিং পার্সোনালিটি,
যাকে সেই দিন পর্যন্তও আপামর লঙ্কাকুল সেলাম ঠুকত তার এসএইচইউ
হল ষোলো লাখের কাছাকাছি। যদিও এখন সেই রাবণও নেই আর নেই সে লঙ্কাও।
ভুত জালোকিয়াকে ডিঙিয়ে চলে গেছে ত্রিনিদাদের মুরুগা বৃশ্চিক
বা মুরুগা স্কর্পিয়ন (কুড়ি লাখ এসএইচইউ) আর বিশ্বের সবথেকে প্রতাপশালী,
লঙ্কার দুনিয়ার আলেকজান্ডার, প্রতাপাদিত্য, সমুদ্রগুপ্ত বা আলাউদ্দিন
খলজি হচ্ছে খোদ অ্যামেরিকার ক্যারোলিনা রিপার। উনবিংশ শতকের শেষ
যুগের জ্যাক দ্য রিপারের বংশধর হাইব্রিড ক্যারোলিনার হটনেস কোশেন্ট
হল বাইশ লক্ষ্ এসএইচইউ। ভুত জালোকিয়া আর ক্যারাবিয়ানের
হাবানেরো লঙ্কার সন্তান এই ক্যারোলিনা! কোয়ালিটি আইসক্রিম মুখে
দিলে গলে যেত, ক্যারোলিনার চুমু খেলে আপনি গলে যেতে বেশী সময়
নেবেন না বলেই মনে হয়! যাই হোক এসব তত্ত্ব কথা ছেড়ে আসুন কিছু
রান্নাবান্না নিয়ে মাথা ঘামাই।
লঙ্কাকে তিনরকম ভাবে ব্যবহার করা হয়; কাঁচা, শুকিয়ে এবং গুঁড়ো করে। কাঁচা তো কাঁচা রইলই, কিন্তু শুকিয়ে বা গুঁড়ো করে ব্যবহার করার মধ্যে বেশ কিছু চমক আছে।
হ্যালেপানো লঙ্কাকে ধোঁয়ায় শুকিয়ে, মেক্সিকান রান্নায় ব্যবহার করা হয়। নাম- চিপটলে।
লাল লঙ্কা এবং মজানো চিংড়ি বাটা মালয় বা ইন্দোনেশীয় রান্নায় সাম্বল ব্লাচান বা আচার হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
থাইল্যান্ডের ‘নম ফির্ক’ শুকনো লঙ্কা, ফিশ সস, লেবুর রস এবং অন্যান্য মশলার সঙ্গে মিশিয়ে একধরণের পেস্ট তৈরি হয় যা রান্নায় ব্যবহৃত হয়।
হাঙ্গেরির ‘পাপ্রিকাজ’, প্যাপ্রিকা, হাল্কা ঝাল লঙ্কা শুকিয়ে তার পেস্ট বানিয়ে মাংস রান্নায় ব্যবহৃত হয়।
চিনের ‘সিচুয়ান’ প্রদেশের ‘কুং পাও’ রন্ধনশৈলীতে তেলে ছোট ছোট শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে হটনেস কোশেন্ট বাড়ানো হয়।
ঝাল নিয়ে কথা হবে আর মেক্সিকো আসবে না তা হয়? মেক্সিকোর জাতীয় রান্না হল পুয়েবলো প্রদেশের মোল পোব্লানো। যা লঙ্কার সঙ্গে চকোলেট মিশিয়ে সস তৈরী করা হয় এবং টার্কি, চিংড়ি, পর্ক, চিকেন ইত্যাদির সঙ্গে ব্যবহৃত হয়। মোল পোব্লানোতে ব্যবহৃত হয় কালচে বাদামী রঙের শুকনো মুলাটো পেপার যার হটনেস কোশেন্ট মাত্র আড়াই হাজার এসএইচইউ।
অবশ্য মেক্সিকান রান্নায় মোল সস তৈরী করতে বিভিন্ন ধরণের লঙ্কাবাটা ব্যবহৃত হয়। মোল কথার অর্থই হল মিশ্রণ। মোল পোব্লানো নিয়ে গল্প আছে যে বহুকাল আগে পুয়েবলো প্রদেশে কনভেন্ট অফ সান্টা রোজায় আর্চবিশপের আগমন সংবাদে গির্জার সাধ্বীরা মিলে যা যার কাছে আছে নিয়ে এসে একটা মিশ্রণ তৈরী করে। লঙ্কা, মশলা, বাসি রুটি, বাদাম এবং সামান্য চকোলেট! তারপর টার্কি মেরে তার মাংস সিদ্ধ করে এই মিশ্রণটি উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর আর্চবিশপের কাছে বলা হয় যে তারা ‘মোল’ বা মিশ্রণ তৈরী করেছে শুধুমাত্র তাঁর আগমন উপলক্ষে। ব্যাস, তাই জনশ্রুতি বেয়ে মেক্সিকোর জাতীয় ডিশ।
ইতালিয় রান্নায় লঙ্কার ব্যবহার বিশেষ স্থান নিয়েছে: আরাবিয়েতা
সস, যা শুকনো লঙ্কা বেসিল, পার্স্লে, ওরেগ্যানো, টম্যাটো এবং রসুন
অলিভ
অয়েলে বেটে পাস্তা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও পুত্তানেস্কা
সস টম্যাটো, ক্যাপারস (একধরণের গুল্মের ফুলের কুঁড়ি), অ্যানচোভি
(চ্যালা মাছের বিলাইতি ভাই) এবং লঙ্কা বেটে তৈরী হয়, যা স্প্যাগেতি
বানাতে ব্যবহৃত হয়।
ফরাসি রান্নায় এক এক পদে এক এক রকম লঙ্কা ব্যবহার করা হয়। ফ্রেঞ্চ অমলেটে কার্গো পেপার। পাস্তা জাতীয় রান্নায় কাইন। কোল্ড স্যালাডে সার্ভানো ইত্যাদি।
আর আম্রিগা? সেখানে তো একটা আস্ত ডিশের নামই চিলি! যদিও তাতে একটা এল কম থাকে! আমাদের পাঁঠার ঘুগনির জাতভাই সেই চিলি! রাজমা ভিজিয়ে প্রেশারকুকারে কটা সিটি দিয়ে রেখে দিন। বিফের জায়গায় চিকেন বা মাটন কিমা ব্যবহার করে হাল্কা তেল দিয়ে স্লো কুক করতে থাকুন। রসুন বাটা দিন। তেল ছেড়ে দিলে উপরে তেলটা সরিয়ে রাখুন। তারপর টম্যাটো পেস্ট, পেঁয়াজ ভাজা, ওরেগ্যানো আর তেড়ে লঙ্কা বাটা দিয়ে ভাল করে মাখিয়ে নিন। তারপর সিদ্ধ রাজমা দিয়ে বসিয়ে রাখুন কম আঁচে। নামাবার পরে চীজ গ্রেট করে দিয়ে দিন আর সেলান্ত্রো বা ধনেপাতা কুঁচি আর পেঁয়াজ কুঁচি দিয়ে পরিবেশন করুন। চিলি তৈয়ার।
এবার দেশের মাটিতে আসি! অন্ধ্রের গুন্টুর জেলাকে তো সারা বিশ্বের লঙ্কা রাজধানী বলা হয়। কারণ গুন্টুর জেলা থেকে উৎপাদিত লঙ্কা শুকিয়ে সারা বিশ্বে সরবরাহ করা হয়। শুকনো লঙ্কার বাজার অন্ধ্র ছাড়াও গুজরাট, রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশে ছড়িয়ে আছে। লঙ্কা বলতেই দুটো সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়! এক হল মির্চ মশালা। যেখানে শুকনো লঙ্কা শিল্পের নারীরা এক দুশ্চরিত্র শাসকের বিরুদ্ধে কিভাবে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল তার গল্প আর হল জন ম্যাথিউ মাথানের সরফরোজ। মির্চি শেঠকে কিভাবে ভুলি বলুন! লঙ্কার বস্তায় ভরে দেশের সর্বনাশের সামান বীরণ পর্যন্ত কি অম্লানবদনেই চালান করত সে!
ভারতের লঙ্কাদের রকমফেরগুলিতে নজর দিই বরং। এমডিএইচ-এর বিজ্ঞাপন
দেখেছেন? লঙ্কা গুঁড়োর? ওই সেই তিন ভাই তলোয়ার নিয়ে লঙ্কার
লড়াই করছে আর এমডিএইচ মশায়, যার আসল বয়স বোধহয় শেষ ডাইনোসরের
সময় তিনি তিনজনকেই শান্ত করে তিন বউয়ের
হাতে লঙ্কা তিলে দিচ্ছেন আলাদা আলাদা। দেগি মির্চ, কাশ্মীরি মির্চ
আর কুটি মির্চ। কুটি মির্চ হল কর্ণাটকের ব্যাদাগি লঙ্কা শুকিয়ে
তাকে পিষে একেবারে গুঁড়ো না করে ছোট ছোট করে রাখা। ব্যাদাগি লঙ্কার
বিশেষত্ব হল তার খোসা খুবই পাতলা হয় এবং শুকিয়ে নিলে ভিতর থেকে
একটা হলদেটে আভা বেরোয়।
কাশ্মীরি মির্চ শুধু মাত্র রঙের জন্য বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। টকটকে
লাল এই লঙ্কার এসএইচইউ মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার।
গুন্টুরের লঙ্কা তো বললামই। তার পোশাকি নাম হল সন্নম লঙ্কা। যা ভারত থেকে সর্বাধিক রপ্তানিকৃত মশলার সম্মান পেয়েছে। অন্ধ্র রান্নার বিশেষত্ব হল তার ঝাল। অন্ধ্র ক্যুজিনে এক বিশেষ ধরণের মশলা ব্যবহার করা হয় যাকে বলা হয় গান পাউডার। সত্যিকারের গান পাউডারের মতই বুকের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
গানপাউডার বানাতে গেলে এক কাপ বিউলি আর এক কাপ ছোলার ডাল শুকনো খোলায় নেড়ে নিয়ে তাতে আট দশটা গুন্টুর লঙ্কা দিয়ে আরও মিনিট দুই রোস্ট করুন। তারপর তাতে তিল দিয়ে নামিয়ে নিন। ঠাণ্ডা হলে হামান দিস্তার সাহায্যে একে গুঁড়ো করুন, সঙ্গে একটু নুন শুকনো তেঁতুল আর এক টুকরো গুড় মিশিয়ে নিন। একে শুকনো করে গুঁড়ো অবস্থায় রেখে দিন অথবা তিলের তেলে দিয়ে পেস্ট মতো করে রাখুন। রুটি ভাত ইডলি দোসা পরোটা সকলের সঙ্গেই মাশাল্লাহ স্বাদ আনবে।
দক্ষিণে আরেকটি মজার লঙ্কা হল মুণ্ডু লঙ্কা। ছোট ছোট কূলের মতো
দেখতে এই লঙ্কা ঝাল নয় বিশেষ কিন্তু একটা অদ্ভুত সুন্দ গন্ধ আছে
যা রান্নাকে উন্নত করে দেয়। তামিল রান্নায় বিশেষত সাম্বর বা
চাটনিতে এই লঙ্কার ব্যবহার! দক্ষিণী আচারেও মুণ্ডু লঙ্কা চূড়ান্ত।
এবার আসুন একটু রাজস্থানি লঙ্কার আচারের একটা রেসিপি দেখি: মোটা মোটা লাল লঙ্কা নিয়ে তার পেট লম্বালম্বিভাবে চিরে ভিতরে বীজ বার করে ফেলুন। এর পর হলুদ, মেথি, হলুদ সর্ষে, মৌরি, নুন, হিং সব কিছু গুঁড়ো করে তা সর্ষের তেল এবং ভিনিগার দিয়ে মেখে ফেলুন। তারপর প্রতিটি লঙ্কার মধ্যে পুরে তা কাঁচের বয়ামে ভরে শুকোতে দিন রোদে দিন তিনেকের জন্য। কাঁচের বয়ামটি ব্যবহারের আগে গরম জল দিয়ে ভাল করে ধুয়ে রোদে শুকিয়ে নেবেন। ভিতরে যেন কোন দূষিত পদার্থ থেকে না যায়। তিন দিন পরে আপনার লঙ্কার আচার তৈরী।
আচ্ছা একটা কথা বলুন দেখি? আমাদের ছেলেবেলায় দেখা ধানি লঙ্কাগুলো কোথায় গেল? ধানি লঙ্কার গাছগুলিও যেন আজকাল আর দেখি না। কি সুন্দর ছোট ছোট গুল্মে আকাশের দিকে মুখ করে মিটি মিটি চেয়ে থাকত লঙ্কাগুলো, ঠিক যেন সুয্যিমুখী ফুল। তাই তো ইংরাজিতে নাম বার্ড আই চিলি। ধানি লঙ্কার এসএইচইউ কিন্তু এক থেকে আড়াই লক্ষ! মাঝে সাঝে এই ধানি লঙ্কাগুলিই বুলেট লঙ্কা হিসাবে আমাদের পাতে এসে পড়ত। তবে আজকাল কাঁচা লঙ্কা বলতে যে লঙ্কাগুলি আমাদের পাতে এসে পড়ে সেগুলি মূলত গুজরাট প্রদেশের জ্বালা লঙ্কা! এই লঙ্কার মিঠে কড়া ঝাল রসনার তৃপ্তি আনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেরালায় আরেক ধরণের লঙ্কা পাওয়া যায়! যা ধানি লঙ্কার জাঠতুতো ভাই (নাকি মালায়লি ভাই হবে? কে জানে!)। কান্থারি লঙ্কাগুলি লাল বা হলুদ ধানি লঙ্কার মতই হয়। কিন্তু পেকে গেলে এই লঙ্কা সাদাটে হয়ে যায়।
ভারতীয় কোন লঙ্কার আলোচনাই কিন্তু ভুত জালোকিয়া বা নাগা মরিচ ছাড়া সম্পূর্ণ হবে না! আগেই বলেছি এর এসএইচইউ ষোলো লক্ষ! সম্প্রতি নাকি ভারতীয় সেনা ভুত জালোকিয়াকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার কথা বলছে। যা হবে তা তো পেপার স্প্রের থেকেও ভয়ঙ্কর কিছু!
যাই হোক লঙ্কা নিয়ে অনেক কচকচানি হল, কিন্তু চিলি নিয়ে কথা
বলব আর বাঙালির প্রিয়তম চিলি চিকেন বলব না, তা হয় নাকি?
চিকেনের থাই থেকে বোনলেস পিস নিয়ে তা চিলি সস ভিনিগার সয়াসস
নুন রসুন বাটা গোল মরিচ গুঁড়োয় ডিম আর কর্ন ফলাইয়ারে ম্যারিনেট
করে রাখুন। তারপর তেলে ভেজে তুলে নিন। লাল লঙ্কা ছোট ছোট টুকরো
করে ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ কুঁচি রসুন কুঁচি ক্যাপ্সিকাম কুঁচি পেঁয়াজ
গাছ কুঁচি সেলারি পাতা কুঁচি দিয়ে নেড়ে নিয়ে তাতে ভাজা চিকেন
দিয়ে নাড়তে থাকুন। এর পর প্যাপ্রিকা সস সয়াসস ভিনিগার লাল লঙ্কা
গুঁড়ো চিনি আর তেল দিয়ে তৈরী পেস্ট এর মধ্যে দিয়ে মিশিয়ে নিন।
পছন্দ অনুযায়ী গ্রেভি রাখুন বা শুকনো খান!
পরিশেষে শেষ পাতে লঙ্কার আইসক্রিমের মতো কয়েকটা কথা। মনস্তত্ববিদ পল রোজিন বলেছেন যেন লঙ্কা খাওয়ার অভিজ্ঞতা আর রোলার কোস্টার চড়ার অভিজ্ঞতা একেবারে এক। আমরা প্রত্যেকেই জানি এর ঝুঁকির কথা- ভয়ও আছে আবার মজাও আছে! কিন্তু পরিমিত থাকলে ক্ষতি নেই!
আর লঙ্কার ক্যাপসাইসিন কিন্তু ভেষজ গুণেও ভরপুর। আর্থারাইটিস, মাথা ব্যথা, ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি, মাস্টেক্টোমি ইত্যাদিতে ক্যাপসাইসিন খুবই উপকারী। এমনকি চর্মরোগের ক্ষেত্রেও ক্যাপসাইসিন উপকারী বলে দাবী করা হচ্ছে।
তাহলে দেখেছেন তো! লঙ্কা লঙ্কা কাণ্ড বাঁধিয়ে দিতে সক্ষম হলেও এর মনটা কিন্তু ভাল! আদতে। ও হ্যাঁ! খুব জোর ঝাল লাগলে খামোখা চিনি বা জল খাবেন না! বিশেষ উপকার হয় না! তেল জাতীয় পদার্থ কিছু জিভে লাগিয়ে নিন! দেখবেন তাৎক্ষণিক উপশম হবে। আসলে ক্যাপসাইসিন তেলে দ্রাব্য - জলে নয়!
লেখক পরিচিতি : লেখক ভারত সরকারের আধিকারি। অধুনা দিল্লিবাসী এবং নিয়মিত বাংলা ব্লগার। ফিসফাস-১ ও ফিসফাস-২ নামে লেখকের দুটি বই সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।