চন্দ্র তাল
শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী
হিমাচল প্রদেশের লাহ্য়ুল-স্পিতি জেলার সদর শহর কেলং থেকে পূর্ব-দক্ষিণে আমরা যাবো প্রথমে বাতাল ও সেখানে রাতের বিশ্রামের পর পরের দিন চন্দ্রতাল হবে আমাদের গন্তব্য। কেলং থেকে বাতালের দূরত্ব ১১৮কিমি। পথ সরল হলে কম বেশি চার ঘণ্টা সময় লাগবার কথা, তবে পথের যা অবস্থা, তাতে কত সময় লাগবে আপাতত চিন্তা করবার দরকার নেই, সে দেখা যাবে সফরান্তে।
চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করা সম্ভব হোল না, ৯:১৫ মিনিট হয়ে গেল। তার পরেও আবার চালক পথে বেরিয়ে গ্যারাজে বেশ কিছু সময় ব্যয় করলো, আমাদের দুটো গাড়ির মধ্যে একটা গাড়ির নাকি কিছু যান্ত্রিক গোলযোগ হয়েছিল। গত কাল ফেরার পর কেন সারায়নি জিজ্ঞাসা করতে বলে যে দুপুরের পরেই কাছাকাছি এখানকার একমাত্র গ্যারাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কেলং থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে টান্ডি, ভাগা আর চন্দ্র নদীর সঙ্গম আর পরে ভাগা নদী পার হয়ে ক্রমশ পূর্ব দিকে মোড় নিয়ে চন্দ্র নদীর পাড় বরাবর প্রথমে গোন্ধলা, তারপর সিস্সু ও পরে গ্রাম্ফো পার হলাম। বর্ণনীয় অনেক কিছুই চলার পথে পেলাম তবে পাখির চোখ আমাদের অন্য যায়গায় তাই রচনা অযথা ভারি করলাম না ওগুলোর বর্ণনা করে। এই গ্রাম্ফো থেকেই পথ সম্পূর্ণ দক্ষিণে চলে যাচ্ছে মানালির দিকে রোটাং লা পার করে। আমরা সেদিকে গেলাম না। পূর্ব দিকে সোজা পথ ধরে এগোতে থাকলাম। বেশ কিছু আগে থেকেই আশপাশের দৃশ্যের পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল, এবার তা আরও বেড়ে গেল। বড় গাছ প্রায় নেই, যেখানে কিছুটা সমভূমি দেখা যাচ্ছে, তাই বা কেন, পাহাড়ের গায়েও ঘাসের আকারের গাছ হয়ে আছে, যদিও অক্টোবর মাসের আজ ৪ তারিখ, গাছ সবুজের বদলে বেশিটাই ফিকে খয়েরি। তবে বোঝা যাচ্ছে মাস দুয়েক আগে এলে এখানে ফুলের সমারোহ দেখা যেতো, এখনও কিছু কিছু গাছে ফুলের শুকিয়ে যাওয়া ডাঁটি চোখে পড়ছে। অনেক জায়গায় চন্দ্র নদী তার দেহকে বিস্তার করে বালি ঢাকা বিরাট সমভূমিতে পরিণত করেছে, যদিও সেই সমভূমির অল্প অংশ দিয়েই স্রোত বয়ে যাচ্ছে, তাও এক নয় একাধিক ধারা হয়ে। বিপরীত সূর্যের আলোয় অনেক জায়গায় সেই স্রোত শিহরিত রূপালী রেখায় পরিণত হচ্ছে। এক জায়গায়, যেখানে আমাদের পথ নদী খাতের অনেকটা ওপর দিয়ে আর সেই পথ খণ্ড খণ্ড ছোট বড় প্রায় কালো রঙের পাথর বিছানো, আমার মনে হল আমরা যেন অমরনাথের পথের পঞ্চতরণী পার করে যাচ্ছি। অবশ্য এখানে পায়ে হেঁটে নয়, ১৫ আসনের টেম্পো ট্র্যাভলারে চেপে দোল খেতে খেতে। আবার সেই দোলা, দোলনার নিয়মিত দোলন নয়, দোলনায় একই সঙ্গে যদি চতুর্দিকে আর ওপর-নিচে দোল দেওয়া যেতে পারলে যেমন হতে পারত, তেমন। পথের ধারে প্রথম দিকে ধূসর আর কয়লার মত কালো পাথর দেখা যাচ্ছিল, ক্রমশ পাথরের রঙের ভিন্নতা দেখা যেতে লাগলো। অনেক জায়গায় প্রায় মার্বেলের মত সাদা, ঘিয়ে অথবা হাতির দাঁতের রঙের মত ছোট বড় প্রায় বর্গাকার পাথর পড়ে আছে, মনে হচ্ছিল যেন মানুষের কীর্তি, বিক্রির জন্যে দোকানে নিয়ে যাবে বলে জড়ো করে রেখেছে বা রাস্তা নির্মাণের জন্যে ফেলে রাখা আছে।
এমন ভাবে যেতে যেতে আমরা চন্দ্র নদীর অপর, অর্থাৎ দক্ষিণ থেকে উত্তর পারে লোহার এক মোটামুটি লম্বা ব্রিজ পার করে এলাম। ব্রিজের উচ্চতা বেশি নয়, গর্জনরত উত্তাল জলধারার তলের অল্প উঁচুতেই। মনে হল অনেক সময়ই ব্রিজের ওপরের রাস্তা জলে ডুবে যায়। তবে পাহাড়ে এমন ব্রিজের অভাব নেই। পার্থক্য এই যে তুলনায় এই ব্রিজ দীর্ঘ। আশপাশে তাকাতেই আগেকার ভাঙ্গা ও পরিত্যক্ত ব্রিজের পিলার দেখতে পাওয়া গেল।
ব্রিজ পার করার একশ মিটারের মধ্যেই পথের ধারে লোক নির্মাণ বিভাগের ফলক থেকে জানতে পারলাম স্থানের নাম ‘ছতরু’, অধিবাসীর সংখ্যা ১২০ ও উচ্চতা ১১,১০০ ফিট। বসতি কোনও দেখতে পেলাম না, অবশ্য কয়েকটা ধাবা রয়েছে বড় বড় টেন্টের মধ্যে। যদিও আর কোথাও গাছপালার চিহ্ন নেই কিন্তু বাঁ দিকের পাহাড় আশপাশের তুলনায় বেশ নিচু আর তার মাথায় এদিক-সেদিক অনেকগুলো মাঝারি আকারের গাছ রয়েছে। ঠিক মতো চিনতে না পারলেও মনে হল পাইনের কোনও ভ্যারাইটি ।
দুপুর অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে, আমাদের দুই ড্রাইভার সর্দার মিন্টু সিং আর আজব সিং দুপুরের আহার সেরে নিতে বললেন। আমরা সেই উপদেশ শিরোধার্য করে ভাত-রুটি-দাল-সবজী খেয়ে নিলাম। দাম ও স্বাদ, স্থান-কাল অনুযায়ী ঠিক বলেই মনে হল। আমি তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে ধাবার পিছন দিকে চন্দ্র নদীর পাড়ে চলে গেলাম। নদীর জল ও ভূমি প্রায় একই তলে রয়েছে। আশপাশ সহ দামাল স্রোতস্বিনীর দৃশ্য মন-মাতানো। ভিডিও ছাড়া স্থির ছবি নিতেও ভুললাম না। টেন্টের বাইরে জনা কয়েক বিদেশি ছেলেমেয়েদের বসে থাকতে দেখলাম। ধাবার মালিক লাল সিং-এর সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম যে তারা অস্ট্রিয়া থেকে এসে এখানে প্রায় এক মাস রয়েছে। রোজই বিভিন্ন দিকে ঘুরতে বেরোয় কয়েক জন আর কয়েক জন বিশ্রাম নেয় এখানেই। মে-জুন মাসে দিনে প্রায় চার-পাঁচশ যাত্রী আসা অস্বাভাবিক নয় যদিও এখন অক্টোবর মাসে খুবই কম, প্রায় শখানেক যাত্রীরই আগমন হয়ে থাকে দিনে।
প্রায় তিনটের সময় আমরা ছতরু ছেড়ে বাতালের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। মিনিট ৩৫/৪০ পরে গাড়ি থামিয়ে আমাদের গাইড (মানালির ট্যুরিস্ট কোম্পানি তাদের নিজেদের সুবিধার জন্যে গাইড বলে এক জনকে আমাদের সঙ্গে দিয়েছে, এই প্রথম বার সে আশপাশের কিছু পরিচয় দিলো) জানালো যে সামনে ‘বড়া সিগরি গ্লেসিয়ার’ আর একটু দূরে ‘ছোটা সিগরি গ্লেসিয়ার’ দেখা যাচ্ছে। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে, আর পশ্চিম দিকেই এই গ্লেসিয়ারগুলো, তাই রোদের তেজ না থাকলেও ছবি পছন্দের হল না ।
ক্রমে পথ উত্তর দিকে ঘুরে গেল এবং অল্প পরেই অনেকটা বড়, প্রায় সমতল এক উপত্যকায় এসে পৌঁছোলাম। সময় তখন বিকাল ৪টে ৩০ মিনিট। সামনে বন-বিভাগের বোর্ড রয়েছে, বড় হরফে লেখা “চন্দ্রতাল স্যাঙ্কচিউয়্যারি”, “কাজা ওয়াইল্ড লাইফ রেঞ্জ।” বন বিভাগের বোর্ডগুলো লাল-সবুজ রঙের হয় সারা ভারতে, জানি না কেন এই বোর্ড হলুদ রঙের। গোটা কয়েক পাকা বাড়ি-ঘর দেখতে পেলাম, প্রায় সবগুলোই কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হল। একটা বাড়ি আধুনিক বাংলোর মতো এবং নির্মীয়মাণ। লেখা নেই কিছু, শুনলাম ‘নির্মাণ-বিভাগ’ অর্থাৎ পিডাব্লুডি-র ( আমাদের এখানে নির্মীয়মাণ বাড়িগুলোর অন্দরের কাজ সাধারণত আগে সম্পূর্ণ করা হয় এবং পরে বাইরের কাজ হয়। এই বাংলোর বাইরের কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে যদিও আশপাশ সাজানো হয়নি কিন্তু ভিতরের বেশি ভাগ কাজই অসম্পূর্ণ, বিশেষ করে স্নানঘর। তাই বসবাসের উপযুক্ত হয়নি এখনো।
কাছেই ফাইবার গ্লাসের ‘পদি-পিসির বর্মী-বাক্স’র আকারে অর্ধ-নলাকার ছাদ সহ এক স্ট্রাক্চার দেখতে পেলাম , আন্দাজে তার মাপ ৫x৪x৩ ঘন মিটার। আর রয়েছে একটা মাত্র বড় কালো হয়ে যাওয়া টেন্টের মধ্যে ‘দোরজী’র ধাবা। অবশ্য নাম লেখা নেই। বাইরে হাড় হিম করা বাতাস। আমরা তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লাম, ধাবার ভিতরে গন-গনে জ্বলন্ত কাঠের ফায়ার প্লেসের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুটো বড় বড় স্টোভের ওপর ডেকচিতে কিছু রান্না হচ্ছে। এখানে চার জোড়া যুবক-যুবতীদের দেখতে পেলাম। তারা কিছুক্ষণ আগে মটর-সাইকেলে চন্দ্রতাল দেখে ফিরে এসেছে। মহারাষ্ট্র থেকে আসা এদের একজনের সঙ্গে আলাপ করলাম। এই প্রথম কারও কাছে শুনলাম যে তালে যাওয়া অত্যন্ত সহজ। বিভিন্ন ভ্রমণ পত্রিকায় যা পড়েছিলাম তাতে মনে হয়েছিল এখানে যদি কেউ যেতে পারে তবে তার এভারেস্টে ওঠা ঠেকায় কে। আমরা মোট ২১ জন, এবং এর মধ্যে তিন জন বাদে সকলেই ষাট বছরে আশপাশের মহিলা ও পুরুষ। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ওই তিন জন ছাড়া আর দুই-চার জন হয়ত তালের পাশে বিচরণ করতে পারবেন, বাকিদের গাড়ি চলা পথ পর্যন্তই যাওয়া সম্ভব হবে। কি হয়েছিল, সে কথা পরে হবে।
এই জায়গাই হল ‘বাতাল’, পশ্চিম দিক, অর্থাৎ লাহ্য়ুলের দিক থেকে চন্দ্রতালে যাবার প্রবেশ-দ্বার। আজ আর সম্ভব নয় তালের দিকে যাওয়া, অবশ্য আমাদের সে প্ল্যান ছিলও না, তাই এখানেই রাত কাটাতে হবে। মাথা গুঁজবো কোথায়? এই ধাবায় থাকা যায়, তবে আমাদের স্থান সঙ্কুলান হবে না। কারণ এই মহারাষ্ট্রীয়রা আগে থেকেই এখানে রাতের ব্যবস্থা করে নিয়েছে। শুনলাম ওই ‘বাক্স’ই নাকি ‘ট্রেকার্স হাট,’ যে কেউ সেখানে সফরের পথে রাত কাটাতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে অন্য কোনও যাত্রী আসেননি, তাই আমাদের সেই ঘর দখল করতে অসুবিধা হল না। তবে দেখা গেল বাক্সর মধ্যে কোনও মতে ১৬ জনের শোবার জায়গা হতে পারে, বাকি ৫ জনের? দুই গাড়ির দুই চালক আর গাইডের? তারা বলল যে তা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না। শেষ পর্যন্ত নির্মীয়মাণ বাংলোর একটা ঘরের মেঝেতেই ব্যবস্থা করা গেল। লেপ-তোষকের যোগানও ধাবা থেকেই হয়ে গেল। হ্যাঁ, ‘হাট’-এর মধ্যেই মোটামুটি ১৬ জনের লেপ-তোষকের ব্যবস্থা ছিল।
রাতে মাথা গোঁজবার নিশ্চয়তা করার পর ধাবায় সন্ধ্যা ৬টা বাজতে না বাজতেই রাতের খাবারের জোগাড় করা হল। সেই সময়ই ধাবার মালিকের সঙ্গে আলাপ করে তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করে উত্তর পেলাম, “দোরজী।” বোঝালাম যে দোরজী তো পদবী বা সারনেম, দোরজীর আগে নিশ্চয় আর একটি শব্দ আছে। এবার অশ্রুতপূর্ব এক উত্তর পেলাম, “উসে চোর লে গয়া!” যাক চোরে নাম নিয়ে পালিয়ে যাওয়া মানালির অধিবাসী দোরজী মশায়ের কাছে জানলাম যে উনি সেই প্রায় ১৯৮০ সাল থেকে এখানে এই ধাবা চালাচ্ছেন। মোটামুটি প্রতি বছর জুন মাস থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাঁর এই সেবা চালানো সম্ভব হয়। এই পর্যন্ত আমাদের ভ্রমণের অভিজ্ঞতার চলচ্চিত্রায়ণ ইউটিউবের এই ক্লিপে দেখতে পাবেন।
কোনও রকমে পেটে কিছু দিয়ে ধাবার বাইরে এলাম তখন বেজেছে ৬:৩০। বাইরে অন্ধকার হলেও কষ্ট করে যে যার শোবার জায়গায় চলে গেলাম। মোমবাতি আর টর্চের আলোয় কিছুক্ষণ শুয়ে বসে আজকের অভিজ্ঞতার রোমন্থন করতে করতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেলাম ৭টার মধ্যেই।
ঘুম ভেঙ্গে গেল যখন হঠাৎ শুনলাম কেউ বলছেন, “চাঁদের আলোয় বাইরের বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো কেমন অপূর্ব দেখতে লাগছে।” আমরা কয়েকজন হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যেই বাইরে গিয়ে দেখি সত্যই কী অপরূপ দৃশ্য। বিকালে এখানে পৌঁছোবার সময়ই দেখেছিলাম যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বে পশ্চিম আর উত্তর দিকে সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা দুটি শীর্ষ, “টাইগার টিথ” আর “হোয়াইট পিক।” সেই দুটিই পূর্ণিমার আগের রাতের চাঁদের আলোয় অপূর্ব মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এর সঙ্গে সম্পূর্ণ চরাচরও মনে হচ্ছে যেন দুধের চাদর জড়িয়ে আছে। ভাবলাম যে পূর্ণিমায় তাহলে কেমন লাগবে। কিছুক্ষণ সেই স্বর্গীয় পরিবেশ উপভোগ করার পর আবার ঘরে ঢুকলাম, তখন সময় দেখি রাত ১টা।
অক্টোবর ৫এর সকাল হল। যে যার সুবিধে মত প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যেই প্রাতঃকৃত্য সারলাম ও মুখে কিছু দিয়ে প্রধান লক্ষের দিকে এগোবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলাম ৭টা নাগাদ। সকালের রোদে রাঙ্গা হওয়া পর্বতশীর্ষদ্বয়ের ছবি নিলাম ।
জমে যাওয়া ধাবার জলের নালার ধারে ‘হিল ময়না’ আর চড়াই-এর দলের খাবার খোঁজার চেষ্টা দেখা গেল। ছবি নিলাম আমাদের অগ্রবর্তী পথের । কিন্তু দেখি আমাদের গাড়ির কোনও নড়ন-চড়ন নেই। “কী ব্যাপার? দেরি হয়ে যাচ্ছে যে?” সদা হাস্যময় আমাদের একটি গাড়ির চালক সর্দার মিন্টু সিং হেসেই উত্তর দিলেন, “স্টার্ট না নিচ্ছে। গোরোম হোবে, ফির চোলবে।” মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, পাহাড়ের যাত্রীদের এ অভিজ্ঞতা হয়েই থাকে। মিন্টু সিং বাঙ্গালীদের যাত্রা করিয়ে করিয়ে বাংলা বলার চেষ্টা করা অভ্যাস করে ফেলেছে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ডিজেলে স্পার্ক ধরছে না, এই হল গাড়ি না চলার কারণ।
ইতিমধ্যে একটা বড় বাসে করে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৫/৪০ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যাপক-অধ্যাপিকা এসে হাজির হলেন। কিছুক্ষণ হই হই করে আর এদিক সেদিক ঘুরে বাতাল থেকে চলে গেল। শুনলাম তারা কুঞ্জুম লার পাশ দিয়ে প্রায় ৭কিমি ট্রেক করে চন্দ্রতালে যাবেন। এই সুযোগে বলি যে বাতাল থেকে প্রায় ১কিমি দূরে পথ দু ভাগ হয়ে গেছে। প্রধান পথ পূর্ব দিকে কুঞ্জুম লা হয়ে লোসার পার করে কাজার দিকে গেছে। আর অন্য পথটা উত্তর দিকে প্রায় ১১কিমি দূরে চন্দ্রতালের কাছে গিয়ে শেষ হচ্ছে। দোরজির ধাবার সামনেই বোর্ডে লেখা দেখেছিলাম এই রাস্তার পর ৩কিমি হাঁটতে হবে তালের ধারে পৌঁছোবার জন্যে। কুঞ্জুম লার কাছ দিয়েই প্রায় ৬কিমির ট্রেক পথও আছে তালের জন্যে। আমি জানতে পারিনি এই মোটর চলা পথ কবে নির্মিত হয়েছে। আগেই বলেছি আমাদের গাইড এই সব বিষয়ে খুব একটা জ্ঞানী নয়। আর বোর্ডেও সে বিষয়ে কিছু লেখা নেই।
অনেক দেরি করে প্রায় ১০টার সময় আমাদের গাড়িতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হল এবং আমাদের যাত্রা শুরু হল। পথ কিছুক্ষণের মধ্যে চন্দ্র নদী বাঁয়ে এবং অনেকটা নিচেতে রেখে এঁকে বেঁকে এগোতে থাকলো। নদীর গর্ভ বিরাট প্রস্থ যুক্ত। একেবারে ঊষর, এখানে শুকনো ঘাসেরও চিহ্ন মাত্র নেই। পথের ডান দিকের পাহাড়শ্রেণী থেকে নেমে আসা ও বাঁ দিকে চন্দ্র নদীতে মিশতে যাওয়া গোটা কয়েক ঝোরা পার হলাম। প্রত্যেকটা ঝোরার প্রান্ত গুলোয় বরফের ছড়ি হয়ে রয়েছে, ইংরাজিতে যেগুলোকে ‘আইসিকিল্স’ বলে। গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার ইচ্ছা হলেও সময়ের অভাবে সে ইচ্ছা দমন করে রাখলাম।
পথের অবস্থা বিচার করলে মাত্র ৪৫ মিনিট পরেই আমাদের গাড়ি এই ১১কিমি পার করে সামনে পাথর সাজানো পাঁচিল দেওয়া এক ছোট মাঠে এসে দাঁড়ালো। এই পর্যন্তই গাড়ির পথ, বাকিটা হাঁটা পথ। একটু সময়ও নষ্ট না করে আগের দিনের মহারাষ্ট্রীয় যুবকের আশ্বাসবাণীতে বলীয়ান হয়ে সকলেই হাঁটা আরম্ভ করে দিলাম। না, একটু ভুল হল। ৫৫ বছরের এক মহিলা, যাঁর একটা পা প্রায় অথর্ব, লাঠিতে ভর দিয়েই হাঁটেন, আর ৬৪ বছরের এক ভদ্রলোক, যাঁর কয়েক বছর আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছে আর একটা হাঁটু অকেজো, ওনারা সাহস করলেন না, তাই গাড়ির বাইরে বেরিয়ে বসে রইলেন। হাঁটা পথ অল্পই চড়াই, যাঁদের যমুনোত্রীর প্রথম দিকের বা কেদারনাথের রামওয়াড়া পর্যন্ত পথে (অবশ্য দুর্ঘটনার পরের অবস্থার কথা আমি বলছি না) হাঁটার অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের কাছে এই পথ একই রকম লাগবে, অর্থাৎ খুবই সরল মনে হবে। তবে ওই দুয়ের মতো সিমেন্টে বাঁধানো পথ এ নয়, ছোট বড় পাথর ছড়িয়ে আছে। মিনিট ১৫ হাঁটার পরই কিছুটা নিচের দিকে চন্দ্রতালের প্রথম দর্শন পেলাম এবং আরও ৫/৭ মিনিট পরে একেবারে তালের ধারে পৌঁছে গেলাম, চন্দ্রতাল থেকে সদ্য নিষ্কাশিত নালার মতো চন্দ্র নদী পার করে। মনে হল না যে এই হাঁটা পথ ৩কিমির, বড় জোর ১.৫কিমি হতে পারে।
তালে স্বচ্ছ নির্মল জল, অনেকটা দূর পর্যন্ত তাল-তলে বিভিন্ন রঙের ছোট বড় নুড়ি দেখা যাচ্ছে। প্রায় ১ কিমি দৈর্ঘ্যের আর প্রস্থে প্রায় তার অর্ধেক ডিম্বাকার এই তাল, উচ্চতা গড় সমুদ্র তল থেকে ৪২৭০মি। কোন কারণে তালের এই প্রান্তর ‘সমুদ্র-টাপু মালভূমি’ নামে পরিচিত আমি বলতে পারবো না, তবে ধারণা হয় সমগ্র হিমালয়ই সমুদ্র থেকে উত্থিত এক দ্বীপের আকারে তাই বোধ হয় এই নামকরণ। যাই হোক, উত্তর দিকের পাহাড় শ্রেণী তুলনায় নিচু, পূর্ব ও পশ্চিম দিকের পাহাড়ের থেকে। অবশ্য শীর্ষ গুলির উচ্চতা ৫০০০মি বা তার বেশিই হবে। দক্ষিণ দিকে, অর্থাৎ যেদিক থেকে আমরা দেখছি, অনেকটা দূর পর্যন্ত প্রায় সমতল। মনে হল হয়ত এই দিকে তালের আয়তন বৃদ্ধি পায়। এই দিকের পাড় সরল রৈখিক নয়, জলরেখা এক জায়গায় কিছুটা এগিয়ে এসেছে, অনেকটা লাদাখের প্যাংগং সো-র মত। প্যাংগং-এর মতই চন্দ্র তালের জলে গাঢ় নীল-সবুজ-লাল রঙের খেলা দেখতে পাচ্ছিলাম । আমরা যে সময় এসেছি, তালের ধারের পাহাড়গুলোতে বরফ নেই তাই জলে শুভ্র-শীর্ষের শিহরণ দেখতে না পেলেও নীল আকাশে শরতের পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘের প্রতিফলন দেখার সৌভাগ্য হল। শুনেছিলাম এই তালের জলের প্রধান উৎস গ্লেসিয়ার গলা জল নয়, প্রস্রবণ। তার প্রমাণ পেলাম খুব সহজেই যখন দেখলাম চন্দ্র নদীতে জলের ধারা রয়েছে অথচ গ্লেসিয়ার অনুপস্থিত, যদিও তার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে ।
গাঢ় নীল আকাশ, পাহাড়ের মাথায় আকাশে সাদা মেঘ আর নিচে তালের গাঢ় নীল জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল এক সুররিয়াল ছবি। আমি যেন দেখলাম এই যে জলে পাথর খণ্ড জেগে আছে তার ওপর বসে গাংপা তার সর্ব সময়ের সঙ্গী লিংপু-তে স্বর্গীয় সুরের বিস্তার করছে, আর শুভ্র সুদীর্ঘ পোশাক পরিহিতা ‘চন্দ্রতালের পরি’ গাংপার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে কাছে আসতে আহ্বান জানাচ্ছে। এর মধ্যেই দেখতে পেলাম গাংপার পরবর্তী জীবন যেখানে সে পরির অনুরোধ ভুলে গিয়ে তাদের এক সঙ্গে বছর কাটাবার কথা প্রকাশ করে দেয় আর ফলস্বরূপ তাদের মিলনের অন্ত হয়ে যায়।
আমার এই সুররিয়াল ছবির বর্ণনার কথা পড়ে পাঠক হয়ত মনে করবেন আমি বুঝি এই মায়াবী পরিবেশে মোহিত হয়ে কোনও কল্পলোকে পাড়ি দিয়েছি। হ্যাঁ সত্যই তাই, তবে গাংপা টান্দুপের কাহিনি স্পিতির কাজা শহরের কাছে রংরিক গ্রামে সকলেই বিশ্বাস করেন। আর বিশ্বাস করবেন নাই বা কেন, গ্রামে যে এখনোও গাংপা টান্দুপের সেই ঘর যেখানে সে বাস করে গেছে আজ থেকে প্রায় শত বছর আর এখনকার থেকে পঞ্চম ঊর্ধ্বতন পুরুষ আগে তার ধ্বংসাবশেষ যে দেখতে পাওয়া যায়। গাংপা আর চন্দ্রতালের পরির মিলনের ফল, এক মৃত কন্যা যাকে গাংপার গুরুজনেরা ‘নরটিন’ অর্থাৎ ‘সুখ-সম্পদের পরি’ রূপে পরিগণিত করে ছিলেন, তার ‘লুখাঙ’ বা স্মৃতি-সৌধ এখনও দেখা যায় গ্রামে। স্থানীয় অধিবাসীরা বলে থাকেন বাস্তবিকই ওই ঘটনার পর থেকে টান্দুপদের অসীম সমৃদ্ধি হতে থাকে।
আমার এই দিবা-স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটল আমার স্ত্রীর দুঃখ ভরা আবেদনে। আমার স্ত্রীর এক ভীষণ রোগ আছে। প্রত্যেকটি ধার্মিক স্থানের নদী (দেবপ্রয়াগের ভাগীরথী ও অলকনন্দার সঙ্গম স্থলেও) বা কুণ্ডে আর পাহাড়ের তালে, যেগুলোর সঙ্গে কিছুটাও ধর্মের সংস্রব আছে, স্নান করবেনই। এখানেও তাঁর সেই ইচ্ছা, কিন্তু গাইড বাদ সাধছিলেন। আমার স্ত্রী আমাকে সেই কথাই জানাচ্ছিলেন। গাইড কিছুতেই তাঁকে তালে স্নান করতে দেবেন না। আমিও গাইডকে তার আদেশ পরিবর্তন করাতে পারলাম না। তবে আমার থেকে বয়সে কিছু বড় আমার এক সহকর্মী, আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই স্নান সেরে নিলেন এই হিম শীতল তালের জলে। ভিডিও ছবি তুললেও স্থির ছবি তোলার সময় ও সুযোগ পেলাম না।
এর পর এখান থেকে এগিয়ে গিয়ে আমাদের কুঞ্জুম লা পার করতে হবে। প্রায় ১২:৩০ বেজেছে। অর্থাৎ মাত্র ৪৫ মিনিটের মতো চন্দ্র তালে শোভা উপভোগ করতে না করতেই আমাদের গাইডের তাড়া ওখান থাকে আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসলো। তার কথায় আর দেরি করলে নাকি কুঞ্জুম লা পার করায় সন্দেহ দেখা দেবে।
আমরা প্রায় সকলেই বিরক্ত কিন্তু বাধ্য হয়েই ওখান থেকে ফেরার পথ ধরলাম । যাত্রার পরবর্তী অংশের বর্ণনা পরে কোনও সুযোগ হলে করা যাবে। আপাতত বলি যে কুঞ্জুম লা-য়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসটি দেখতে পাইনি। যাত্রার এই অংশের চলচ্চিত্রায়ণ দেখুন ইউটিউবের এই ক্লিপে -
লেখক পরিচিত - শিক্ষাবিদ। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন বহু বছর। নেশা হচ্ছে ভ্রমণ। অবসর-এর একজন নিয়মিত লেখক।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.