প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সুকুমার রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, এপ্রিল ৩০, ২০১৬

 

আমি, ন্যাড়া আর ডায়রির ছেঁড়া পাতা

ঈশানী রায়চৌধুরী

 

 আমরা একই ইশকুলে পড়তুম। আমি আর দাশু। এই দ্যাখো, নিজের নামটাই বলিনি! ন্যাড়া। আমি ন্যাড়া। ভালো নামও একটা আছে বটে, ললিতমোহন, কিন্তু ঘরে বাইরে ওই ন্যাড়া। সেই যেবার মেলা অসুখ করল আমার, ঠাম্মা নাপিত ডেকে মাথা মুড়িয়ে দিল ইশকুল খোলার ঠিক আগে আগে...সেই থেকে আমার অমন সুন্দর ভালো নাম গেল চুলোর দোরে। এমনকি ইশকুলের বদমাস ছেলেদের দৌলতে বাড়িতেও সব্বাই ন্যাড়া বলেই ডাকতে লাগল।

 ইশকুলে বসি দাশুর পাশে। দাশু আমার প্রাণের বন্ধু। পণ্ডিতমশাই বলেন, ' জগাই মাধাই '। খুব রাগ হয় আমার। জগাই মাধাই যে ভালো লোক নয়, এ তো জানা কথা! তা দাশু আমাকে চুপিচুপি বলে কিনা, ' দাঁড়া, ওই কলসির কানা একবার হাতে পাই, দেখব পণ্ডিতমশাই কেমন প্রেম বিলিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভু হন!' আমার তো মাথায় হাত। এই রে, পাগলা খেপেছে! এমনিতেই দাশুটাকে কেমন একটা দেখতে! ঠাম্মা বলে, ' ছি ন্যাড়া, চেহারা নিয়ে কু -কথা বলতে নেই।' কিন্তু দাশু? 

' ক্ষীণদেহ খর্বকায় মুণ্ড তাহে ভারী,
 যশোরের কই যেন নরমূর্তিধারী।’

দাশু আবার ছিল রায়চৌধুরী বাড়ির উপেন কর্তার ছেলে সুকুমারদাদার বেজায় কাছের লোক। সুকুমারদাদা অবিশ্যি কেন কে জানে বাপ পিতেমোর উপাধিটির মুড়োটি রেখে ন্যাজাটি কুচ করে কেটে দিয়েছিল। কেন, জিজ্ঞেস করাতে মিটমিট করে হেসে বলত, "ও তোরা বুঝবি নে।' দাশুর যত ফন্দিফিকির আরও জম্পেশ করে তুলত সুকুমারদাদার পাকা বুদ্ধি। তবে সে সব হত তলে তলে। সুকুমারদাদার পড়ার টেবিলে বসে। আমরা বলতুম ' গোল টেবিল চক্রান্ত '। রামপদর সঙ্গে দাশুর মোটে বনিবনা হয় না, এদিকে পণ্ডিতমশাইয়ের শ্লেষ গায়ে বেঁধে হুলের মতো। অবিশ্যি এমনিতে দেখতে গেলে ….

‘পণ্ডিত মহাশয় মানুষটি মন্দ নহেন।  পড়ার জন্য প্রায়ই কোনো তাড়াহুড়ো করেন না।  কেবল মাঝে মাঝে একটু বেশি গোল করিলে হঠাৎ সাংঘাতিক চটিয়া যান।  সে সময়ে তাঁহার মেজাজটি আশ্চর্য রকম ধারাল হইয়া ওঠে। ’ 
তা সেদিন ….
‘পণ্ডিত মহাশয় চেয়ারে বসিয়াই "নদী শব্দের রূপ কর" বলিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন।  আমরা বই খুলিয়া হড়বড় করিয়া যা-তা খানিকটা বলিয়া গেলাম এবং তাহার উত্তরে, পণ্ডিত মহাশয়ের নাকের ভিতর হইতে অতি সুন্দর ঘড়্‌ঘড়্‌ শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম, নিদ্রা বেশ গভীর হইয়াছে।  কাজেই আমরাও শ্লেট লইয়া 'কাটকুট' আর 'দশপঁচিশ' খেলা শুরু করিলাম।’ 

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলুম। রামপদর সঙ্গে দাশুর তো আকচাআকচি লেগেই থাকত। রামপদ ব্যাটা ভারী শয়তান। আচ্ছা, তুই সব্বাইকে মিহিদানা দিবি, শুধু দাশুর বেলায় অমন ইল্লুতেপনা করবি! ব্যাটা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ দেখেনি! টিফিনের ছুটিতে দাশু একদৌড়ে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল! তারপর তো ..আরিব্বাস! সে কী হই হই রই রই কাণ্ড! সুকুমারদা নাকি চীনে পটকা ফাটানোর বুদ্ধি জুগিয়েছিল, মায় তিন আনা পয়সা পর্যন্ত ...তারপর তো সেই মিহিদানার হাঁড়িতে চীনে পটকার ধুন্ধুমার কাণ্ড। সে গল্প তো আবার সুকুমারদাদা নিজেই খাতায় লিখে আমাদের শুনিয়েওছিল। ইচ্ছে হলে তোমরা পড়েও নিতে পারো।

সুকুমারদাদা যা জম্পেশ করে লিখেছে না! পুরো জমে ক্ষীর। যেন ছবির মতো দেখতে পাওয়া যায়।

 ' মনে হইল যেন, যত রাজ্যের মিস্ত্রী মজুর সবাই এক জোটে বিকট তালে ছাদ পিটাইতে লাগিয়েছে- দুনিয়ার যত কাঁসারি আর লাঠিয়াল সবাই যেন পাল্লা দিয়া হাতুড়ি আর লাঠি ঠুকিতেছে, খানিকক্ষণ পর্যন্ত আমরা, যাকে পড়ার বইয়ে 'কিংকর্তব্যবিমুঢ়' বলে, তেমনি হইয়া হাঁ করিয়া রহিলাম।  পণ্ডিত মহাশয় একবার মাত্র বিকট শব্দ করিয়া, তার পর হঠাৎ হাত পা ছুঁড়িয়া একলাফে টেবিল ডিঙ্গাইয়া, একেবারে ক্লাসের মাঝখানে ধড়্‌ফড় করিয়া পড়িয়া গেলেন।  সরকারী কলেজের নবীন পাল বরাবরই হাই জাম্পে ফার্স্ট প্রাইজ পায়, তাহাকেও আমরা এরকম লাফাইতে দেখি নাই।  পাশের ঘরে নিচের ক্লাশের ছেলেরা চিৎকার করিয়া 'কড়াকিয়া' নামতা আওড়াইতেছিল- তাহারাও হঠাৎ ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া থামিয়া গেল।  দেখিতে দেখিতে ইস্কুলময় হুলুস্থুল পড়িয়া গেল- দারোয়ানের কুকুরটা পর্যন্ত যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া বিকট ঘেঁউ ঘেঁউ শব্দে গোলমালের মাত্রা ভীষণ রকম বাড়াইয়া তুলিল। '

কিন্তু দাশুর কি কোনো হেলদোল আছে? সে বলে, ' বেশ করব। মিহিদানা দিল না কেন? ওর হাঁড়ি, আমার পটকা। যদি আমার দোষ হয়, তবে রামপদরও দোষ।' আচ্ছা পাগল কিন্তু! তবে এ বড় সেয়ানা পাগল, মজার পাগল ...তাই না? 

দাশুর কীর্তির কি শেষ আছে? সুকুমারদাদারও বলিহারি যাই বাপু! আহ্লাদে আহ্লাদে একেবারে ধোপাবাড়ি পাঠিয়ে দিল! আরে বাবা, আমরা ছোট ছেলেপুলে, আমাদের কৌতূহল একটু না হয় বেশি। তা বলে দাশুকে দুষ্টুবুদ্ধি দিয়ে আমাদের বোকা বানাবে? সেদিন টিফিনবেলায় কী কেলেঙ্কারীই না হল! ব্যাটা বগলে করে একটা বাক্স নিয়ে এল, কিছুতেই আমাদের বলবে না কী আছে। তারপর যেই না আমাদের কাছে ওই বাক্সের চাবি আর দারোয়ানের জিম্মায় বাক্স রেখে অন্যদিকে গেছে ....আচ্ছা, আমরা হামলে পড়ব না, বল তো? আমরাও তো ছোট ছেলে! কী করে জানব ব্যাটার পেটে পেটে দুর্বুদ্ধি! করেছে কী, বাক্সের মধ্যে গুচ্ছের মোড়ক রেখেছে। খুলতে খুলতে যখন হয়রান হয়ে গেছি, তখন দেখি একটা কার্ডে একপিঠে লেখা 'কাঁচকলা খাও', অন্য পিঠে 'অতিরিক্ত কৌতূহল ভালো নয়'। আবার চুপিচুপি সব রেখে দিতে গিয়ে দেখি ব্যাটা পাঁচিলের ওপর বসে হো হো করে হাসছে। গা এইসা জ্বলে গেল! আবার চাপে পড়ে বলে কিনা, এও নাকি সুকুমারদাদারই বুদ্ধি! কী অন্যায়, কী অন্যায়! একজন বড় মানুষের সঙ্গে আমরা কি পারি বুদ্ধিতে পাল্লা দিতে?

দাশুর বড্ড জেদ। নাটকে বড় পার্ট চাই। আবার যে সে পার্ট নয়, দেবদূতের পার্ট! ফোর্থ ক্লাসের গনশা ফুটফুটে ছেলে, দারুণ মানাবে ওকে দেবদূত সাজলে। হতচ্ছাড়া দাশু মিষ্টিমাষ্টা, ফুটবলের লোভ দেখিয়ে তাকে এমন হাত করে নিলে, যে সে আসল দিনে পার্ট করতেই রাজি হল না। তাকে টানাহ্যাঁচড়া করতে গিয়ে মাঝখান থেকে আমরা অঙ্কের স্যার হরিবাবুর কাছে কানে আড়াই প্যাঁচ খেলুম। শেষমেষ আমরা বাধ্য হলুম দাশুকে দেবদূতের পার্ট দিতে। তারপর যে কী মারাত্মক কেলোর কীর্তি হল, সেও ওই সুকুমারদাদার খাতাতেই লেখা আছে। আমার তো মনে হয়, নির্ঘাত দাশুকে গনশাকে ঘুষ দেবার বুদ্ধিটাও দিয়েছিল সুকুমারদাদা। কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করল না। যত বলি, 'তুমি তাহলে গপ্পো লিখলে কেমন করে', ফিকফিকিয়ে হাসে আর বলে, 'আহা, সেদিন আমিও তো গেছলুম তোদের নাটক দেখতে।' যে যাই বলুক, আমি জানি ...এই বুদ্ধিটাও সুকুমারদাদার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল।

তারপর এই ধর নবীনচাঁদ। ছোঁড়ার যেমন বাবুয়ানা, তেমনি দেমাক। কেউ তাকে পছন্দ করে না। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজটি করবে কে? পাগলা দাশু ছাড়া? তাকে কি কম হেনস্তা হতে হয়েছে দাশুর কাছে? কেষ্টাদের জিলিপির লোভ দেখিয়ে ডাকাত সাজিয়ে দাশু এমন মতলবটি আঁটল যে ‘ ডাকাতরা তাকে ধরে তার মাথায় চাঁটি মেরে, তার নতুন কেনা শখের পিরানটিতে কাদাজলের পিচ্‌কিরি দিয়ে গেল।  আর যাবার সময় ব'লে গেল, "চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক- নইলে দড়াম্‌ করে তোর মাথা উড়িয়ে দেব। ’

আর তারপর কী হল, বলি তবে।

'যাহোক ইস্কুলে এসে তার দুঃখ অনেকটা বোধ হয় দূর করতে পেরেছিল, কারণ স্কুলে অন্তত অর্ধেক ছেলে তার কথা শুনবার জন্য একেবারে ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েছিল, এবং তার প্রত্যেকটি ঘামাচি, ফুস্‌কুড়ি আর চুলকানির দাগটি পর্যন্ত তারা আগ্রহ করে ডাকাতির সুস্পষ্ট প্রমাণ ব'লে স্বীকার করেছিল।  দু একজন যারা তার কনুয়ের আঁচড়টাকে পুরনো ব'লে সন্দেহ করেছিল, তারাও বলল যে হাঁটুর কাছে যে ছড়ে গেছে, সেটা একেবারে টাটকা নতুন।  কিন্তু তার পায়ের গোড়ালিতে যে ঘায়ের মতো ছিল সেটাকে দেখে কেষ্টা যখন বললে, "ওটা তো জুতোর ফোস্কা", তখন নবীনচাঁদ ভয়ানক চটে বললে, "যাও, তোমাদের কাছে আর কিছুই বলব না। ' 

এ পর্যন্ত তবু যাহোক ঠিক ছিল। কিন্তু হতভাগা দাশু এসে এইসা গোল বাধাল! শুনবে কী রকম?

'যেই না আমরা বললাম, "শুনেছিস? কাল নবুকে ডাকাতে ধরেছিল। " অমনি দাশরথি হঠাৎ হাত পা ছুঁড়ে বই-টই ফেলে, খ্যাঃ-খ্যাঃ-খ্যাঃ-খ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একেবারে মেঝের উপর বসে পড়ল।  পেটে হাত দিয়ে গড়াগড়ি করে, একবার চিৎ হয়ে, একবার উপুড় হয়ে, তার হাসি আর কিছুতেই থামে না। '

তারপর টিফিনের সময়ে চেপে ধরতে শুনলুম সে বেত্তান্ত।

'দাশু বললে, "কালকে শেঠেদের বাগানের পিছন দিয়ে নবু একলা একলা বাড়ি যাচ্ছিল, এমন সময় দুটো ছেলে— তাদের নাম বলা বারণ— তারা দৌড়ে এসে নবুর মাথায় ধুনচির মত কি একটা চাপিয়ে, তার গায়ের উপর আচ্ছা করে পিচ্‌কিরি দিয়ে পালিয়ে গেল। " নবু ভয়ানক রেগে বলল, "তুই তখন কি করছিলি?" দাশু বললে, "তুমি তখন মাথার থলি খুলবার জন্য ব্যাঙের মত হাত পা ছুঁড়ে লাফাচ্ছিলে দেখে আমি বললাম— ফের নড়বি তো দড়াম করে মাথা উড়িয়ে দেব।  শুনে তুমি রাস্তার মধ্যে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলে, তাই আমি তোমার বড়মামাকে ডেকে আনলাম। " 

আবার এও ফাঁস করে দিলে, বড়মামা নাকি নবুর কান পেঁচিয়ে লাল করে দিয়েছেন।

নবু তো বেদম চটে গিয়ে তার দাদা মোহনচাঁদকে ডেকে আনলে। সে ঢের বড় আমাদের চেয়ে, ম্যাট্রিক ক্লাসে পড়ে। কিন্তু কী আর বলব! এমন ফাজিল হয়েছে দাশুটা! কী বলল জানো?

‘ মোহন বললে, "কি হে ছোকরা, তুমি সব জানো নাকি?" দাশু বললে, "না, সব আর জানব কোত্থেকে- এইতো সবে ফোর্থ ক্লাশে পড়ি, একটু ইংরিজি জানি, ভূগোল বাংলা জিওমেট্রি—" মোহনচাঁদ ধমক দিয়ে বললে, "সেদিন নবুকে যে কারা সব ঠেঙিয়েছিল, তুমি তার কিছু জানো কিনা?" দাশু বললে, "ঠাঙায়নি তো- মেরেছিল, খুব অল্প মেরেছিল। " মোহন একটুখানি ভেংচিয়ে বললে, "খুব অল্প মেরেছে, না? তবু কতখানি শুনি?" দাশু বললে, "সে কিছুই না— ওরকম মারলে একটুও লাগে না। " মোহন আবার ব্যাঙ্গ করে বললে, "তাই নাকি? কি রকম মারলে পরে লাগে?" দাশু খানিকটা মাথা চুলকিয়ে তারপর বললে, "ঐ সেবার হেডমাস্টার মশাই তোমায় যেমন বেত মেরেছিলেন সেই রকম!"

তারপর যা ধুমধাড়াক্কা বেধে গেল, সে আর বলে কাজ নেই। সব সুকুমারদাদার জাবদাখাতায় লেখা আছে। তবে এই শয়তানির মতলবটা মনে হয় দাশুর নিজের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। কারণ সবটা নিজে কলকাঠি নেড়ে করে থাকলে সুকুমারদাদা দাশুকে আর আমাদের সব্বাইকে ডেকে আসর বসিয়ে শুনত না। সবটা শুনে দাশুর পিঠ চাপড়ে আবার বলে কিনা, 'এ হল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। ' কী দাঁতভাঙা কথা! আচ্ছা, ওটা কি দাশুর নতুন নাম? 

[ ন্যাড়ার ডায়রির বাকিটুকু ইঁদুরে কুটিকুটি করে খেয়ে ভুষ্টিনাশ করেছে। আমি আর খুঁজেই পেলাম না। ন্যাড়া যে কে, তাও জনে জনে জিজ্ঞেস করে উত্তর পাইনি। তবে ডায়রির একদম শেষের দেড়খানা পাতা জুড়ে ছিল ন্যাড়ার সুকুমারদাদার কথা। টুকরো টুকরো, হাত দিলে ঝুরঝুর করে খসে পড়বে এমন হলুদ হয়ে আসা ওই জীর্ণ দেড়পাতায় ছিল মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের সেই সবুজ অবুঝ মনের তীক্ষ্ণধী যুবক সুকুমারের কথা। পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে দাশু, ন্যাড়ার মতো অসংখ্য গুণমুগ্ধদের জন্য যিনি রেখে গিয়েছিলেন আলিবাবার রত্নভাণ্ডার-- লেখা, ছবি, নোটবই, অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি, দুটো হাতে লেখা পত্রিকা, কিছু চিঠিপত্র ....।

ন্যাড়া লিখেছে, " সুকুমারদাদার বাবা মানে আমাদের জ্যাঠাবাবু উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। আমরা দূর থেকে দেখে অবাক হতাম। লিখতেন, ছবি আঁকতেন, পাখোয়াজ আর বেহালা বাজাতেন। ছাপাখানা বিষয়ে কত কিছু জানতেন। কত কাজকর্ম করতেন। তাঁর লেখার হাত ছিল বড্ড মিঠে। আর গল্পে ফিরে ফিরে আসত যত রাজ্যের পশু পাখি ...বাঘ থেকে পিঁপড়ে কিচ্ছুটি বাদ যেত না। আমরা খুব মজা পেতাম, কারণ এরা সব্বাই কথা বলত জ্যাঠাবাবুর লেখায়। আহা, লেখা তো নয় ..পুরো ছবি! আর ওই যত সঙ্গের ছবিছাবা ...বিদেশী ধাঁচে (বাবার মুখে শোনা ) তেলরং, জলরং, কালি কলমে আঁকা।

সুকুমারদাদার (সুকুমার রায়) হাতের লেখা

তা সুকুমারদাদাও তো এই বাপেরই ছেলে! চোখ দুটো ঝকঝক করত বুদ্ধির জৌলুসে। বন্ধুবান্ধব আসত। ক্লাব হল একটা। ননসেন্স ক্লাব। আমাদের অবিশ্যি তাতে যাবার অনুমতি ছিল না, কিন্তু আমাদের বরাদ্দ সময় তো আলাদা ছিলই! যা লিখত, আমাদের মাঝেমধ্যে পড়ে শোনাত। জ্যাঠাবাবুর লেখা যেমন পড়লে মনে হত ..গল্প, মনগড়া, কল্পনার জগত ...সুকুমারদাদার লেখাতে যেন ঠিক চিনে নিতাম এদিক ওদিক থেকে ভেসে ওঠা লোকজনকে। তারা ঠিক পুরোপুরি হয়ত গল্পটার মতো নয়, আবার গল্পটার মতোও বটে! তাই জ্যাঠাবাবুর মতো অত গুণী বাপের ছেলে হয়েও সুকুমারদাদা নিজের গুণেই আসলে আমাদের কাছে অত কম দিনেই অত আপনার জন হয়ে উঠেছিল।

আহা, তারপর তো সে চলেই গেল। আড়াই বচ্ছর বিছানায় পড়ে ছিল মানুষটা। আমরা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতুম। আমাদের দেখলেই চোখ দুটো ঝিকিয়ে উঠত। দাশুটা বড্ড ভালোবাসত তো সুকুমারদাদাকে। বেচারী শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াত। আমাদের বলেছিল, ' আর আমি দুষ্টুমি করব না রে! যে মানুষটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করত, সে যখন আর থাকবে না ....। না:, এবার আমি ঠিক আর পাঁচজনের মতো হয়ে যাব।' 

উপচে আসা চোখের জল মুছে আমরা বলতুম, 'খবদ্দার দাশু, খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু! তুই এমনি থাকিস। ঠিক সুকুমারদাদার মনের মতো হয়ে।'

পাগলা দাশুর হদিশ? পেয়েছি। ন্যাড়ার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলেও গেছে গল্পের পাগলা দাশু। সে এক অত্যাশ্চর্য ফ্রি স্পিরিট! শুধু মিলেই যায়নি, এও বুঝিয়ে ছেড়েছে যে পাগলা দাশুরা আসলে অলীক, কিন্তু অলীক নয়। পাগলামি এক আশ্চর্য প্রদীপ, আলাদিনের ...যা আমাদের সকলের বুকের মধ্যে টিমটিমিয়ে জ্বলতেই থাকে, জ্বলতেই থাকে। শুধু মাঝে মাঝে তাতে তেল দিয়ে সলতেটা খানিক উস্কে দিতে হয়। পাগলা দাশুর মধ্যে , ন্যাড়ার মধ্যে, নবীনচাঁদ, রামপদর মধ্যে কোথাও না কোথাও আমরা কেউ না কেউ আছি। এমনকি পণ্ডিতমশাইকে খুঁজে পেয়েছি আমার স্কুলের হিন্দি দিদিমনি এলিজাবেথ গোমেজের মধ্যে...শুধু নদী শব্দরূপের বদলে আমরা গুনগুন করতাম 'গাধা এক থা মোটা তাজা ' পদ্যটা আর দিদিমনির নাক ডাকত ফুরফুর করে, আমরাও ক্লাসে চিনে পটকা না হোক, ডেস্কের ওপর চক ঘষে চ্যাঁক চ্যাঁক আওয়াজ করতাম। নাটকের পার্ট ভুলে গিয়ে অজস্রবার নির্দিষ্ট সময়ের আগে ড্রপসীন পড়েছে, চালিয়াত চন্দর খোকা যেমন থাকে...মেয়েদের স্কুলে তেমন অসহ্য স্বভাবের খুকিও কিছু কম থাকে না ...যাদের শায়েস্তা করতে 'পাগলি মিচকে পটাশ ' কোনো ঈশানী, সুমনা বা অনীতা থাকে।

এই পাগলামি চিনে নিতে হয় সস্নেহ প্রশ্রয়ে ...ঠিক সুকুমার যেমন চিনেছিলেন। তিনি কিন্তু কোথাও অসহিষ্ণু হয়ে এদের শাস্তি দেননি, দুষ্ট গরুর তকমা এঁটে স্কুল নামের হরি ঘোষের গোয়াল থেকে এদের নির্বাসনেও পাঠাননি। এদের হাত ধরে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন নির্দোষ নির্মল মাধ্যমে কী করে বাবুয়ানী, দেমাক, অন্যায় অন্যায্য আচরণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়। দাশু দেখতে ভারী অদ্ভুত ছিল। সত্যি তো! চেহারার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু নিজেকে নিয়ে নিজের চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতা থাকা ঠিক নয়, তাকে কৌতুকের রূপটানে ঝলমলে ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত করতে জানতে হয়, যা ওই দাশু আমাকে শিখিয়েছে।

এই মত্তমাদল বাজিয়ে হুড়মুড় করে আমার মনের সিংদরজায় ধাক্কা মেরে বৈঠকখানা পেরিয়ে সটান শোবার ঘরে ঢুকে এসেছিল পাগলা দাশু। তার অনন্ত পাগলামি নিয়ে। সেই পাগলামিতে মিশে ছিল ঝিমধরানো অচেনা ফুলের গন্ধ আর ঘরের ভেতরে পাক খেতে থাকা বাতাসে কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল ..

ওই দুটি ছত্র..

'আয় রে ভোলা খেয়াল-খোলা স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়, 
আয় রে পাগল আবোল তাবোল মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়। '

শোনা যাচ্ছিল। শোনা যায়। এখনও। আমাকে অহরহ ডাক দিয়ে যায় এই অবেলাতেও ....

পাগলা দাশু। তার ওই নাটকের পোশাকে।

সে পোশাক…দেবদূতের। ]


লেখক পরিচিতি - বিজ্ঞানের ছাত্রী । কিন্তু প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য । তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত । বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য অকাদেমি, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইত্যাদি বিখ্যাত সংস্থা থেকে । ভাষান্তরের পাশাপাশি নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক । তবে খুব নিয়মিত নয় । ভালোবাসেন টুকরো গদ্য, পদ্য লিখতে । নানা স্বাদের লেখা নিয়ে গত বছর প্রকাশিত হয়েছে ওঁর আরেকটি বই 'ম্যাজিক লণ্ঠন। এ বছর প্রকাশিত হচ্ছে আরও তিনটি বই।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।