প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সুকুমার রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, এপ্রিল ৩০, ২০১৬

 

চিরনবীন সুকুমার রায়

দীপক সেনগুপ্ত


ভূমিকা

সুকুমার রায়

এখনকার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সুকুমার রায় ও তার লেখার সঙ্গে কতটা পরিচিত বলা শক্ত। ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেও সুকুমারের কবিতার অন্তত দু’এক লাইন অথবা তার ‘হযবরল’-র সঙ্গে পরিচয় ছিল না এরকম লোকের সংখ্যা খুব কমই ছিল। দক্ষিণারঞ্জনের রূপকথার বিষয় ছেড়েই দিলাম, এখনকার বাস্তববাদী যুক্তিনির্ভর ও তথ্যনিবিড় জীবনযাত্রায় অবাস্তবতা ও রূপকথার প্রবেশ নিষিদ্ধ। কল্পনাশক্তির অভাব ও আবেগহীন গতিময়তা জীবনকে যান্ত্রিক করে তুলতে পারে। শরীরকে কর্মক্ষম রাখতে সুষম খাদ্যের মতই মনকে সুন্দর সজীব রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বাঁধাধরা ছকের মধ্যে কল্পনা-জগতের স্বপ্নময়তা ও অনাবিল হাস্যরস আমাদের সে প্রয়োজন কিছুটা মেটায়। উদ্ভট খেয়াল রসের অফুরন্ত ভাণ্ডার সুকুমার রায় তাই চিরকালই প্রাসঙ্গিক।


বংশ পরিচয়

সুকুমার রায়ের পরিচয় উপেন্দ্রকিশোরকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন একাধারে শিশু-সাহিত্যিক, মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ, চিত্রশিল্পী ও সংগীতজ্ঞ। তার হাত ধরে ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশে’র আবির্ভাব। ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৮শে বৈশাখ (১৮৬৩ খ্রীঃ , ১২ই মে) ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম। পিতা ও মাতা ছিলেন কালীনাথ রায় ও জয়তারা দেবী। কালীনাথের ছিল পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। ছেলেরা ছিল সারদারঞ্জন, কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন ও প্রমদারঞ্জন। প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক লীলা মজুমদার ছিলেন প্রমদারঞ্জনের কন্যা। জ্ঞাতিভাই জমিদার হরকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন প্রতিবেশী ও অপুত্রক। তার একান্ত অনুরোধে কালীনাথ তার দ্বিতীয় পুত্র কামদারঞ্জনকে দত্তক দিতে রাজি হন। সেটা ছিল ১৮৬৮ সাল। কামদারঞ্জনের নতুন নাম হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। পরে তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। ১৮৮৫ সালের ১৫ই জুন উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্মসমাজের নেতা দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম পক্ষের কন্যা বিধুমুখীকে বিয়ে করেন। তিনি তখন থাকতেন ১৩নং কর্নওয়ালিস স্ট্রীটের ‘লাহাবাড়ি’তে। এখানেই তার প্রথম পাঁচ পুত্রকন্যার জন্ম। এদের নাম – সুখলতা, সুকুমার, পুণ্যলতা, সুবিনয় ও শান্তিলতা। সুকুমারের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর। স্থানাভাবের জন্য উপেন্দ্রকিশোর ১৮৯৫ সাল নাগাদ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে পাশেই ৩৮/১নং শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে উঠে আসেন। সেখানেই জন্ম হয় তার কনিষ্ঠ পুত্র ও সুকুমারের ছোট ভাই সুবিমলের। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের দুই শিশু চরিত্রের নামানুসারে সুখলতা ও সুকুমারের ডাক নাম হয় ‘হাসি’ ও ‘তাতা’।


বাল্য ও শিক্ষা

ছোটবেলা থেকেই সুকুমারের প্রতিভার উন্মেষ লক্ষ্য করা যায়। তিনি গান গাইতেন, নাটক করতেন, কবিতা লিখতেন, মুখে মুখে তৈরি করে ফেলতেন নানা ধরণের ছড়া। পড়াশোনায় মেধাবী সুকুমার স্বাভাবিক ভাবেই ভাইবোনদের নেতৃত্ব দিতেন, গান ও মজাদার ছড়ায় বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে তুলতেন। পুণ্যলতার ভাষায় – “দাদা যেমন আমাদের খেলাধুলা ও সব কিছুরই পাণ্ডা ছিল, তেমনি বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের মধ্যেও সে সর্দার হল। ...... তার মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল যার জন্য সবাই তাকে বেশ মানত। ...... বড়রাও তার কথার বেশ মূল্য দিতেন।” খুড়তুতো বোন লীলা মজুমদার লিখেছেন তার ‘বড়দা’ সুকুমারের কথা – “চেহারার মধ্যে কি যেন একটা ছিল, যা তার সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মত ঝড়ে পড়ত।”

সিটি স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করে ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রিতে ডাবল অনার্স নিয়ে ১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এস-সি পাশ করেন সুকুমার। কলেজে থাকতে গড়ে তোলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। তার শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত রসায়নবিদ প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ক্লাবের মুখপত্র ছিল হাতে লেখা কাগজ-‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ (৩২II ভাজা)। সুকুমারের খেয়াল রসাস্রিত লেখা প্রথম ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’র পাতাতেই বেরিয়েছিল। ননসেন্স ক্লাবের সভ্যদের নিয়ে অভিনয় করার জন্য দু’টি নাটক লিখেছিলেন সুকুমার – ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। ‘ঝালাপালা’তেই রয়েছে তার সেই বিখ্যাত রসসৃষ্টি –

“পণ্ডিত। বটে! তোর বাড়ি কদ্দুর ?
কেষ্টা। আজ্ঞে, ওই তালতলায় – ‘আই গো আপ, ইউ গো ডাউন-’ মানে কি ?
পণ্ডিত। ‘আই’ - ‘আই’ কিনা চক্ষুঃ, ‘গো’ - গয়ে ওকার গো - গৌ গাবৌ গাবঃ, ইত্যমরঃ, ‘আপ’ কিনা আপঃ সলিলং বারি অর্থাৎ জল - গরুর চক্ষে জল - অর্থাৎ কিনা গরু কাঁদিতেছে - কেন কাঁদিতেছে - না উই গো ডাউন, কিনা ‘উই’ যাকে বলে উইপোকা - ‘গো ডাউন’, অর্থাৎ গুদোমখানা - গুদোমঘরে উই ধরে আর কিছু রাখলে না - তাই না দেখে, ‘আই গো আপ’ – গরু কেবলই কাঁদিতেছে -”

‘ননসেন্স ক্লাবে’র নাটক দেখার জন্য ছেলেবুড়ো সকলেই ভিড় জমাতো। পুণ্যলতা লিখেছেন –“বাঁধা স্টেজ নেই, সীন নেই, সাজসজ্জা ও মেকআপ বিশেষ কিছুই নেই, শুধু কথা সুরে ভাবে ভঙ্গিতেই তাদের অভিনয়ের বাহাদুরি ফুটে উঠত, দাদা নাটক লিখত, অভিনয় শেখাত। ... হাঁদারামের অভিনয় করতে দাদার জুড়ি কেউ ছিল না। অভিনয় করতে ওরা নিজেরা যেমন আমোদ পেত, তেমনি সবাইকে আমোদে মাতিয়ে তুলত। চারিদিকে উচ্ছ্বসিত হাসির স্রোত বইয়ে দিত। ...... ননসেন্স ক্লাবের অভিনয় দেখার জন্য সবাই উৎসুক হয়ে থাকত।”

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের আদেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হয়। পরে অবশ্য বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতায় সেটা হয়ে ওঠেনি। তখন শিক্ষিত বাঙালিরা অনেকেই শপথ নিয়েছিলেন যে তারা বিদেশী জিনিস ব্যবহার করবেন না। উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারেও এর ব্যতিক্রম ঘটে নি। পুণ্যলতা লিখেছেন –“মেজভাই মণি (সুবিনয় রায়) দেশি সুতোর মোটা কাপড়, হাতে তৈরি তুলোট কাগজ, ট্যারা ব্যাঁকা পেয়ালা পিরিচ খুঁজে পেতে নিয়ে আসত।” লীলা মজুমদারের ভাষায় –“বাড়িসুদ্ধ সবাই এইসব জিনিস ব্যবহার করত। বড়দাও করত। অবিশ্যি এই নিয়ে একটা গান না লিখেই সে কি করে?” গানটি ছিল –

“আমরা দেশি পাগলের দল,
দেশের জন্য ভেবে ভেবে হয়েছি পাগল,
(যদিও) দেখতে খারাপ টিকবে কম, দামটা একটু বেশী
(তাহোক) তাতে দেশেরই মঙ্গল”।

তার আরও একটি লেখা –

“লর্ড কার্জন অতি দুর্জন বঙ্গগগন শনি
কূট নিঠুর চক্রী চতুর উগ্র গরল ফণী।”

পিতা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই সূত্র ধরে বাল্য কাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের পরিচয়। কবি সুকুমারকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন, দীর্ঘদিন সুকুমার তার সান্নিধ্য পেয়েছেন। কবির নোবেল পুরস্কার পাবার বহু আগে থেকেই এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের নিয়মিত দেখা হত। কলকাতায় ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের বাসভবনেও অন্যান্য কবি ভক্তের সঙ্গে সুকুমার উপস্থিত থাকতেন। এই অন্তরঙ্গতা ও শান্তিনিকেতনের বহু অনুষ্ঠান ও উৎসবে সুকুমারের যোগদানের ঘটনা অনেক লেখকের বিবরণে লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ১৯১১ সালে ২৫শে বৈশাখ উপলক্ষে সুকুমার রায়েরা দল বেঁধে শান্তিনিকেতনে যান। ‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে সীতাদেবী লিখেছেন –“ইহারই ভিতর একদিন সুকুমার রায় তার ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ গান করিয়া শুনাইয়াছিলেন। উহা ২৪ কি ২৬ বৈশাখ হইয়া থাকিবে। এই রামায়ণ গানটি সকলেই খুব উপভোগ করিয়াছিলেন। ‘অদ্ভুত রামায়ণে’ একটি গান আছে, ‘ওরে ভাই, তোরে তাই কানে কানে কই রে, ওই আসে, ওই আসে, ওই ওই ওই রে।’ আশ্রমের ছোট ছেলেরা ঐ গানটি শোনার পর সুকুমারবাবুরই নামকরণ করিয়া বসিল, ‘ওই আসে’। একটি ছোট ছেলে মাঠের ভিতর একটি গর্তে পড়িয়া গিয়া আর উঠিতে পারিতেছিল না। সুকুমারবাবুকে সেইখান দিয়ে যাইতে দেখিয়া সে চীৎকার করিয়া বলিল, ‘ও ওই আসে, আমাকে একটু তুলে দিয়ে যাও তো’!” রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও এ প্রসঙ্গে লিখেছেন –“সুকুমার রায় তার ‘অদ্ভুত রামায়ণ’ দলবল নিয়ে গান করে শোনান। তাতাবাবুর সেই চোখ গোল গোল করে গান,

‘রাবণ রাজায় মারো, রাবণ রাজায় মারো,
তারে উলটো গাধায় তোল ......”

বিদেশ যাত্রা

U. Ray & sons

১৮৯৫ সালে শিবনারায়ণ দাস লেনের বাড়িতে উপেন্দ্রকিশোর U. Ray নামে একটি ব্লক তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন; পরে নামকরণ হয় U. Ray & sons। তিনি কখনও বিলেত যান নি। কিন্তু মুদ্রণ শিল্পে তার গবেষণা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। ১৮৯৭ থেকে ১৯১২ সালের মধ্যে লন্ডন থেকে প্রকাশিত মুদ্রণ সম্বন্ধে বিখ্যাত পত্রিকা Penrose’s Pictorial Annual-এ তার ন’টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোরের তোলা ছবিও থাকত। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয়েছে –“Mr U. Ray of Calcutta is far ahead of European and American workers in originality”। এটি কম স্বীকৃতির কথা নয়। নিজে বিলেতে না গেলেও পুত্র সুকুমার বিদেশে গিয়ে মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করুক এ বাসনা তার ছিল। ১৯১১ সালের অক্টোবর মাসে ২৩ বছর বয়সে গুরুপ্রসন্ন বৃত্তি নিয়ে সুকুমার বিলেতে যান। প্রথমে লন্ডনে এক বছর County Council School of Photoengraving and Lithography-তে পড়াশোনা করে পরে ম্যানচেস্টারে Municipal School of Technology-তে chomolithography and litho-drawing সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করেন। বিলেত থেকে সুকুমার বাবাকে যেসব চিঠি লিখেছেন তাতে তার কাজের বিস্তৃত বিবরণ মেলে। বিলেতে শেষ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে bronze পদক লাভ করেন সুকুমার। তার গবেষণা-পত্র Penrose’s Pictorial Annual এবং The British Journal of Photography পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ১৯২২ সালে তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে Royal Photographic Society-এর সদস্য নির্বাচিত হন।

ইংল্যান্ডে একটি সভায় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে The spirit of Rabindranath Tagore নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন সুকুমার। ১৯১৩ সালের ২১ শে জুলাই প্রবন্ধটি তিনি পাঠ করেছিলেন East and West Society-তে। আমেরিকায় ছ’মাস কাটিয়ে লন্ডনে ফিরে অর্শ রোগের চিকিৎসার জন্য রবীন্দ্রনাথ তখন একটি নার্সিং হোমে ভর্তি। দু’সপ্তাহ সেখানে ছিলেন তিনি। নার্সিং হোমে কবিকে দেখতে যেতেন সুকুমার। পঠিত প্রবন্ধটির মাধ্যমে বিলেতে অনেক বিদ্বজ্জনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ইহাই বোধ হয় রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ভারতীয়দের পক্ষে প্রথম পাবলিক ভাষণ।” প্রবন্ধটি বিখ্যাত পত্রিকা Quest-এ প্রকাশিত হয়।

১৯১৩ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ‘সিটি অব লাহোর’ নামক জাহাজে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন সুকুমার, সঙ্গে ছিলেন কালীমোহন ঘোষ। অমিতাভ চৌধুরী লিখেছেন –“কুড়ি দিনের এই দীর্ঘ পথে কবির সঙ্গে সুকুমারের কি কি বিষয়ে আলাপ হয়েছিল, কেমন কেটেছিল কবিসঙ্গ, তার কোন লিপিবদ্ধ বিবরণ মেলে নি। সত্যজিৎ রায়কে এই প্রসঙ্গে পরে যখন জিজ্ঞাসা করি, তিনি বলেন “আপশোসের কথা, শৈশবে বাড়ি বদলের সময় বাবা ও ঠাকুরদার অনেক কাগজপত্র হারিয়ে যায়।” হারিয়ে যাওয়াটা আমাদের সকলের পক্ষেই দুর্ভাগ্য। থাকলে হয়ত আরও অনেক কিছুই জানা যেত।”

বিবাহ, সত্যজিৎ, রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন

সুকুমার রায় ও সুপ্রভা

বিলেত থেকে ফেরার দু’মাস পরেই সুকুমারের বিয়ে হয় কে. জি. গুপ্তর ভাগ্নি এবং সরলা ও জগৎচন্দ্র দাশের মেজ মেয়ে সুগায়িকা সুপ্রভার সঙ্গে। সুপ্রভার ডাক নাম ছিল টুলু। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে শান্তা দেবীর কথায় –“সুকুমারবাবু বিবাহ করেন আমার সহপাঠিনী এবং বন্ধু টুলুকে। তারপর ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে চায়ের নিমন্ত্রণে যেতাম।” সুপ্রভা ও শান্তা একই সঙ্গে বেথুন স্কুল ও কলেজে পড়তেন। বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। কিন্তু কবি চিঠি দিয়ে জানান শিলাইদহে জমিদারীর কাজে ব্যস্ত থাকায় তিনি বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত ছিলেন সীতা দেবী। তিনি তার ‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন –“এই বৎসর অর্থাৎ ১৯১৩-র ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি বোধ হয় সুকুমার রায়ের বিবাহ হয়। রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে ছিলেন শুনিয়াছিলাম। বিবাহ প্রায় আরম্ভ হইতে যাইতেছে এমন সময় গেটের কাছে করতালিধ্বনি শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইয়া গেলাম। পরক্ষণেই দেখিলাম কবি আসিয়া সভাস্থলে প্রবেশ করিলেন। পরে শুনিয়াছিলাম, এই বিবাহে উপস্থিত থাকিবার জন্যই তিনি কলিকাতায় আসিয়াছিলেন। সুকুমারবাবুকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করিতেন।”

বিয়ের পরে সুপ্রভাকে সঙ্গে নিয়ে সুকুমার শিলং-এ এলেন। সেখানে তার কাকা প্রমদারঞ্জন তার স্ত্রী সুরমা ও মেয়ে লীলাকে নিয়ে থাকতেন। রামকুমার বিদ্যারত্নের (‘হিমারণ্য’ গ্রন্থের লেখক) মেয়ে সুরমা মানুষ হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের পরিবারে। লীলা মজুমদার মা’র কাছে ‘তাতা’ অর্থাৎ সুকুমারের নাম শুনেছেন কিন্তু কখনও চোখে দেখেন নি। তিনি বড়দা (সুকুমার) সম্বন্ধে লিখেছেন –“লম্বা দোহারা মানুষটি। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। চোখ দুটি প্রায় সব সময় হাসত। কিন্তু গম্ভীর হলে এমন গম্ভীর হত যে কাছে যেতে ঘেঁষতে ভয় পেতাম। বড়দা ছিল যেমন আমুদে তেমনি রাশভারী। অন্যায় সে কখনো সইত না। যতদূর মনে পড়ে বড়দার বাঁ-গালে একটা বড় তিল ছিল, আমাদের সেটিকে ভারি পছন্দ ছিল।” সুপ্রভা বৌঠানকে প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা –“তখন বিকেল বেলা। পড়ন্ত রোদে বৌঠানকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছিল। পড়নে ঢাকাই শাড়ি। গলায় লম্বা মটরমালা, শ্যামলা রঙের উপর অমন সুন্দর মুখ কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।”

সীতা দেবী তার ‘পুণ্যস্মৃতি’ গ্রন্থে শান্তিনিকেতনে অনুষ্ঠিত ‘বাঙাল সভা’র এক কৌতুকপূর্ণ বিবরণ দিয়েছেন –“সকলে মিলিয়া আবার বাহির হইবার উপক্রম করিতেছি এমন সময় একটি ছোট ছেলে আসিয়া খবর দিল যে, ‘বাঙাল সভা’ হইবে, আমাদের সেখানে উপস্থিতি প্রার্থনীয়। সকলেই উৎসুক হইয়া চলিলাম। বাঙাল-সভার নাম ইতিপূর্বেই শুনিয়াছিলাম, তবে কোনো অধিবেশনে কখনো উপস্থিত থাকি নাই। শুনিলাম অন্যান্য অতিথিরাও আসিতেছেন এবং স্বয়ং কবিও উপস্থিত থাকিবেন। পথেই তাঁহাদের সঙ্গে দেখা হইল। রবীন্দ্রনাথ সর্বাগ্রে খোঁজ করিলেন যে আমার মাথা-ধরা কেমন আছে; তাহার পর বলিলেন, ‘আচ্ছা, চলো বাঙাল-সভায়, তাদের কথা শুনলে বোধ হয় তোমার মাথা ছেড়ে যেতে পারে।

“খোলা মাঠেই সভা হইতেছিল। মেয়েরা এবং মান্যগণ্য অতিথিবর্গ তক্তপোষে বসিলেন, ছেলের দল বসিল মাটিতে শতরঞ্চি বিছাইয়া। সর্বসম্মতিক্রমে সুকুমারবাবু সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করিলেন যে সুকুমারবাবুর পত্নী শ্রীমতি সুপ্রভাকেই সভানেত্রী করা হোক, কারণ আজন্ম কলিকাতায় বাস করিয়া সুকুমারবাবুর বাঙালত্ব খানিকটা লোপ পাইয়াছে। কিন্তু সুপ্রভা রাজি না হওয়াতে সুকুমারবাবুই সভাপতির পদে বহাল রহিলেন। সভার কার্যতালিকা বেশি বড়ো ছিল না। একটি গল্প, একটি বিজ্ঞাপন ও একটি রিপোর্ট পড়া হইল, সবই বাঙাল ভাষায়। দুইটি গান হইল, একটি বাঙাল ভাষায়, অন্যটি সাধারণ বাংলা ভাষায়। সভার কার্য যথাসম্ভব বাঙাল ভাষাতেই হইতেছিল। অনেকে উঠিয়া ছোট ছোট বক্তৃতা দিলেন, বক্তব্য সকলেরই প্রায় এক, ‘তাহাদের বিশেষ কিছু বলিবার নাই।’ বক্তাদিগের ভিতর নাম মনে পড়ে দুইজনের শ্রীযুক্ত সুধাকান্ত রায়চৌধুরী ও শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন, তাঁহাকেও তাহার মামার বাড়ির (মালদহ) ভাষায় বক্তৃতা করিতে হইল। রবীন্দ্রনাথকেও সভাপতি অনুরোধ করিলেন তাঁহার মামার বাড়ির ভাষায় কিছু বলিতে। রবীন্দ্রনাথ অসম্মতি জানাইয়া বলিলেন, খুলনার ভাষায় মাত্র দুটি কথা তিনি জানেন, তাহাতে বক্তৃতা দেওয়া চলে না। সে কথা দুটি হইতেছে ‘কুলির অম্বল ও মুগির ডাল।’ অতঃপর সভাপতি তাঁহার অভিভাষণ দিলেন অতি কষ্টে।”

বাঙাল-সভার মতই আর একটি অনুষ্ঠান ছিল ‘হৈ হৈ সঙ্ঘ’। এখানে গাইবার জন্যই রবীন্দ্রনাথ সুকুমারের সেই বিখ্যাত কবিতা –‘গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা’-তে সুর সংযোগ করেন।
অমিতাভ চৌধুরী একটি অপ্রকাশিত চিঠির কথা জানিয়েছেন। ১৯৪০ সালের সেই চিঠিতে ইন্দিরা দেবী (চৌধুরাণী) সুকুমার-পত্নী সুপ্রভাকে তাদের বাড়িতে গিয়ে ভজন ও হিমাংশু দত্তের গান শোনাবার জন্য নেমন্তন্ন করেছেন। বিমলাংশুপ্রকাশ রায় তার স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, একবার সুকুমার রায়কে দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “সুকুমার তুমি যে লিখেছ, ‘ভাব এক্কে ভাব, ভাব দুগণে ধোঁয়া তিন ভাবে ডিসপেপসিয়া ঢেঁকুর উঠবে চোঁয়া’- আমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছ কি?”

সুকুমারের মত পত্নী সুপ্রভাও রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ছিলেন। কবির কাছে গান শেখার সৌভাগ্যও তার হয়েছে। অমিতাভ চৌধুরী লেখায় রয়েছে –“সুপ্রভা রায়ের একটি খাতায় দেখা যায় ১৯২১ সালের পূজার ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ অনেকগুলি পাতায় একটি করে গান নিজের হাতে লিখে দিয়েছেন। দিন অবসান হল, আমার দোসর যে জন, আকাশে আজ কোন চরণের আসা যাওয়া ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের স্বহস্তে ঐ খাতায় লেখা শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত-সকাল বেলার বাদল আঁধারে। তারিখ ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯।” অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে সুপ্রভা মাঝে মাঝেই চলে গিয়েছেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথও তার স্নেহের টুলুকে স্নেহের স্পর্শে সান্ত্বনা দিয়েছেন, গানের জগতে টেনে নিয়েছেন।

সুকুমার রায়ের সঙ্গে সুপ্রভা দাশের বিয়ে হয় ১৯১৩ সালে ডিসেম্বর মাসে। একমাত্র পুত্র সত্যজিতের জন্ম ১৯২১-এর ২রা মে। সে বছরেই নিতান্তই শিশু চার মাসের সত্যজিৎ বাবা ও মায়ের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে যান। এ সময়ে সুপ্রভা বেশ কিছু গান শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ছোট বেলার স্মৃতিচারণ করে সত্যজিৎ তার ‘যখন ছোট ছিলাম’ রচনায় বলেছেন –“আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার বয়স আড়াই বছর। সে ঘটনা আমার মনে নেই। কিন্তু বাবা যখন অসুস্থ, এবং আমার বয়স দুই কিম্বা আরও কম তখনকার দুটো ঘটনা আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা অসুখে পড়েন আমি জন্মাবার কিছুদিনের মধ্যেই। এ অসুখ আর সারে নি, তবে মাঝে মাঝে একটু সুস্থ বোধ করলে বাবাকে বাইরে চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া হত। বাবার সঙ্গেই আমি গিয়েছিলাম একবার সোদপুর আর একবার গিরিডি। গঙ্গার উপর সোদপুরের বাড়ির উঠোনটা আমার মনে আছে। একদিন বাবা ছবি আঁকছেন, ঘরে জানালার ধারে বসে, এমন সময় হঠাৎ বললেন, ‘জাহাজ যাচ্ছে।’ আমি দৌড়ে উঠোনে বেরিয়ে এসে দেখলাম একটা স্টীমার চলে গেল।”


মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’ ও সুকুমারের রচনা বৈশিষ্ট্য

‘সন্দেশ’ মাসিক পত্রিকা উপেন্দ্রকিশোরের এক অনবদ্য সৃষ্টি। ছোটদের এরকম সর্বাঙ্গসুন্দর পত্রিকা আর হয়েছে কিনা সন্দেহ। ১৯১৩ সালের মে মাসে (বৈশাখ, ১৩২০) ‘সন্দেশে’র প্রথম সংখ্যা যখন প্রকাশিত হয় সুকুমার তখন মুদ্রণ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলেতে রয়েছেন। উপেন্দ্রকিশোর একই সঙ্গে লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, প্রুফ দেখেছেন ও ছাপাখানার কাজ দেখাশোনা করেছেন। এর কয়েকমাস পরেই দেশে ফিরে সুকুমার পুরোপুরি পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে উপেন্দ্রকিশোরের মৃত্যুর পর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সুকুমার। ১৯২৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর তার অকাল মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মোট তেত্রিশটি সংখ্যা সম্পাদনা করে গেছেন উপেন্দ্রকিশোর। সুকুমারের পর পরের ভাই সুবিনয় রায়ের সম্পাদনায় ‘সন্দেশ’ চলেছিল দু’বছর। সব মিলিয়ে প্রথম পর্যায়ের ’সন্দেশ’ বারো বছরের সামান্য বেশি চলেছিল। বারো বছরের মধ্যে সুকুমার সম্পাদক ছিলেন আট বছর। ‘সন্দেশ’ তাই সুকুমারময়।

সুকুমারের পরিবারের অনেকেই পত্রিকায় লিখেছেন। কাকা কুলদারঞ্জন ছোটদের প্রিয় হয়েছিলেন ‘রবিনহুড’ লিখে। ছোটকাকা প্রমদারঞ্জন কর্মজীবনে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার কাজে ব্রহ্মদেশ সীমান্তের দুর্গম অঞ্চলে ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ধারাবাহিক ভাবে ছোটদের পরিবেশন করেছেন ‘বনের খবর’ নামক সত্যি ঘটনায়। ছোটদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়েছিল ঘটনার সত্যতা। বড়দিদি সুখলতা, মেজদিদি পুণ্যলতা গল্প ও কবিতা লিখেছেন। মেজভাই সুবিনয় ছিলেন হেঁয়ালি ও ধাঁধা রচনায় সিদ্ধহস্ত। ছোটভাই সুবিমল ও ছোটবোন স্বল্পায়ু শান্তিলতাও কলম ধরেছেন ‘সন্দেশে’র জন্য। প্রমদারঞ্জনের মেয়ে লীলা রায় (পরে যিনি লীলা মজুমদার নামে খ্যাত) এই পত্রিকায় লিখেই হাত পাকিয়েছেন।

সুকুমারের আট বছরের সম্পাদনা কালের মধ্যে শেষ আড়াই বছরই কেটেছে রোগশয্যায়। বিছানায় শুয়ে বসেই তিনি লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, প্রুফ দেখেছেন। কোন কোন সংখ্যায় তার সাত আটটা লেখাও বেরিয়েছে। তবে ‘সন্দেশ’ শুধু পারিবারিক পত্রিকা হয়ে থাকে নি। এতে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী, কালিদাস রায়, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ রায়, সীতা দেবী, শান্তা দেবী, প্রিয়ম্বদা দেবী, কামিনী রায়, কাজি নজরুল ইসলাম, অসিতকুমার হালদার, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অবনীন্দ্র-দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকেরা। সুনির্মল বসুকে পরিণত হতে সাহায্য করেছে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা। এদের রচনা যোগাড় করতে সুকুমারকে নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত ভাবে যোগাযোগ করতে হয়েছে।

‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক হবার আগেই সুকুমারের কিছু প্রবন্ধ ও দুটি নাটক-‘শব্দকল্পদ্রুম’ ও ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ প্রকাশিত হয়েছে। ‘প্রবাসী’-তে লেখা এসব রচনা ঠিক ছোটদের জন্য নয়। ‘নাটক দুটি প্রধানত আইডিয়ার আধার। ... এর উপভোগ্যতার প্রধান কারণ হল এর শাণিত কমিক সংলাপ। সুকুমারের ... মজলিসি মেজাজের ষোল আনা পরিচয় মেলে এ দুটি নাটকে।’

বিদেশে থাকার জন্য প্রথম দিকে প্রকাশিত সংখ্যাগুলিতে সুকুমারের লেখা তেমন বেরোয় নি। তার প্রথম আবির্ভাব ১৩২০’র শ্রাবণ সংখ্যায় কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গল্প ‘ভবম হাজাম’-এর চিত্রকর রূপে। এটি তিনি পাঠিয়েছিলেন বিলেত থেকে। রবীন্দ্রনাথও তখন সেখানে। বিলেতে বসেই কবির হাতে ‘সন্দেশে’র প্রথম সংখ্যাটি তুলে দিয়েছিলেন সুকুমার। খুব খুশি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং কথা দিয়েছিলেন সময় পেলেই ‘সন্দেশে’র জন্য তিনি লিখবেন। সুকুমার বিলেত থেকে বাবা উপেন্দ্রকিশোরকে চিঠি লিখে একথা জানিয়েছিলেন।

সুকুমারের আট বছর বয়সে ‘নদী’ নামে তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘মুকুল পত্রিকার ১৩০২ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। পরের বছর ১৩০৩ জ্যৈষ্ঠেই এই পত্রিকায় বেরিয়েছে বিখ্যাত Hickory Dickory Dock অবলম্বনে তার কবিতা ‘টিক-টিক-টং’। (প্রসঙ্গত, ‘অবসরে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘পুরানো সাময়িক পত্রিকায়’ ‘মুকুল’ পত্রিকা প্রসঙ্গে সুকুমারের ‘নদী’ কবিতাটি উদ্ধৃত হয়েছে)। ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা দু’টি ছিল ‘বেজায় রাগ’ (১৩২০, অগ্রহায়ণ) ও ‘খোকা ঘুমায়’ (১৩২০ পৌষ)। বিলেত থেকে দেশে ফিরে আসার পর ‘সন্দেশে’ তার উদ্ভট কবিতার প্রথম প্রকাশ ‘খিচুড়ি’ নামক কবিতায় (মাঘ ১৩২১)। কবিতার নামে না চিনলেও রচনাটি নিশ্চয়ই অনেকেরই পরিচিত –

“হাঁস ছিল সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল হাঁসজারু কেমনে তা জানি না।” ...... ইত্যাদি।

কবিতার সঙ্গে ছিল ‘হাঁসজারু’, ‘বকচ্ছপ’, ‘বিছাগল’, ‘গিরিগিটিয়া’ প্রভৃতি সন্ধিযুক্ত কল্পিত প্রাণীর বিচিত্র সব ছবির সমাহার। তার ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের সব কবিতাই ‘সন্দেশে’ ছাপা হয়েছে, তবে অনেক সময়ে ভিন্ন নামে। যেমন, ‘বাবুরাম সাপুড়ে’ (‘সন্দেশ’র নাম ‘বাপরে’, আষাঢ়, ১৩২৮), ‘রামগরুরের ছানা’ (‘সন্দেশে’র নাম ‘হেস’ না!’, বৈশাখ, ১৩২৫), ‘নোটবই’ (‘সন্দেশে’র নাম ‘জিজ্ঞাসু’, বৈশাখ, ১৩২৭) ইত্যাদি। পত্রিকায় ‘আবোল তাবোল’ নাম দিয়ে বেরিয়েছে তার বিখ্যাত কবিতা ‘খুড়োর কল’, ‘দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম’, ‘গানের গুঁতো’ প্রভৃতি। সুকুমার বেঁচে থাকতে তার তিনটি নাটক ‘সন্দেশে’ প্রকাশিত হয়েছিল –‘অবাক জলপান’, ‘হিংসুটে’ ও ‘মামা গো’। মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে ‘ঝালাপালা’ ও ‘লক্ষণের শক্তিশেল’। অতুলনীয় ‘হ-য-ব-র-ল’ বেরিয়েছে ১৩২৯-এর জ্যৈষ্ঠ থেকে পরপর চারটি সংখ্যায়। ‘পাগলা দাশু’র কুড়িটি গল্পই ‘সন্দেশে’ ছাপা হয়েছে। ‘বহুরূপী’ ও আরও কয়েকটি গল্প বেরিয়েছে এই পত্রিকায়। ‘খাইখাই’-এর বিভিন্ন কবিতাও প্রথমে ছোটদের হাতে এসেছে ‘সন্দেশে’র মাধ্যমেই। ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’ প্রকাশিত হয়েছে ১৩২৯ সালের বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। এটি পড়ে পরবর্তী কালে সত্যজিতের লেখা প্রফেসর শঙ্কুর কথা মনে পড়ে যায়।



সুকুমারের হস্তাক্ষরে ‘আবোল তাবোল’ কবিতার কিছু অংশ।

দুঃখের কথা ‘আবোল তাবোল’ পুস্তকটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৩-এর ১৯শে সেপ্টেম্বর, সুকুমারের মৃত্যুর ন’দিন পরে। অন্যান্য বই বেরিয়েছে অনেক পরে। ‘পাগলা দাশু’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪০-এর ২২শে নভেম্বর, এম. সি. সরকার এন্ড সন্স থেকে। সিগনেট প্রেস থেকে ‘বহুরূপী’র প্রকাশ ১৯৪৪ সালে। ‘পাগলা দাশু’ প্রকাশের সময় সুপ্রভা রায় রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন একটি ‘ভূমিকা’ লিখে দিতে। কালিম্পঙ থেকে ১৯৪০-এর ১লা জুন তারিখে লেখা ‘ভূমিকা’টি ছিল – “সুকুমারের লেখনী থেকে যে অবিমিশ্র হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর সুনিপুণ ছন্দের বিচিত্র ও স্বচ্ছন্দ গতি, তার ভাব সমাবেশের অভাবনীয় অসংলগ্নতা পদে পদে চমৎকৃতি আনে। তাঁর স্বভাবে মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল, সেই জন্যই তিনি তাঁর বৈপরীত্য এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন। বঙ্গসাহিত্যে ব্যঙ্গ রসিকতার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত আরো কয়েকটি দেখা গিয়েছে কিন্তু সুকুমারের অজস্র হাস্যোচ্ছ্বাসের বিশেষত্ব তাঁর প্রতিভার যে স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছে তার ঠিক সমশ্রেণীর রচনা দেখা যায় না। তাঁর এই বিশুদ্ধ হাসির দানের সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অকাল মৃত্যুর সকরুণতা পাঠকদের মনে চিরকালের জন্য জড়িত হয়ে রইল।” এই মুদ্রণটি এখন দুষ্প্রাপ্য। পরবর্তী সিগনেট প্রেসের সংস্করণে রবীন্দ্রনাথের ‘ভূমিকা’টি বর্জিত হয়েছে।

‘দ্রিঘাংচু’ নামে সুকুমারের একটি গল্প বেরোয় ‘সন্দেশে’র ১৩২৩-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায়। সত্যজিৎ রায় লিখেছেন –“সুকুমার সম্পাদক হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই একটি ছোট গল্প সন্দেশে বেরোয় যেটি আমার মতে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। গল্পের নাম ‘দ্রিঘাংচু’। এক রাজসভায় অকস্মাৎ একটি দাঁড়কাক প্রবেশ করে গম্ভীর কণ্ঠে ‘কঃ’ শব্দটি উচ্চারণ করার ফলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তাই নিয়েই গল্প। গল্পের শেষে রাজামশাইকে রাজপ্রাসাদের ছাতে একটি দাঁড়কাকের সামনে দাঁড়িয়ে চার লাইনের একটি মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়। মন্ত্রটি হ’ল –

“হলদে সবুজ ওরাং ওটাং
ইঁট পাটকেল চিৎ পটাং
গন্ধ গোকুল হিজিবিজি
নো অ্যাডমিশন ভেরি বিজি...”

“খাঁটি ননসেন্সের এর চেয়ে সার্থক উদাহরণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।” এটি সত্যজিৎ তার একটি ছায়াছবিতেও ব্যবহার করেছেন। প্যারোডি রচনাতেও সুকুমার ছিলেন সিদ্ধহস্ত। শান্তিনিকেতনে গিয়ে রান্নায় আলু খেতে খেতে, রবীন্দ্রনাথের ‘এই ত ভাল লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’ গানের অনুকরণে নিজেই গেয়ে ওঠেন ‘এইতো ভাল লেগেছিল আলুর নাচন হাতায় হাতায় ...’।

সুকুমার ভাষা, শব্দ, এদের ব্যবহার ও প্রকৃত অর্থ নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন তার সাক্ষাৎ মেলে তার ‘ভাষার অত্যাচার’ নামক প্রবন্ধে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’র ১৩২২-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। অপর একটি রচনা শব্দ-ঝঙ্কার সমৃদ্ধ অনুপ্রাসকেন্দ্রিক কবিতা ‘বর্ণমালাতত্ত্ব’ পড়লে এ ধরণের রচনায় সুকুমারের অনায়াস এবং অসাধারণ দক্ষতা সহজেই চোখে পড়ে। কয়েকটি পংক্তি –

“অকূল আঁধারে কুহকপাথারে কে আমি একেলা কবি
হেরি একাকার সকল আকার সকলি আপন ছবি ।
কহে, কই কে গো, কোথায় কবে গো, কেন বা কাহারে ডাকি?
কহে কহ-কহ, কেন অহরহ, কালের কবলে থাকি?
কহে কানে কানে করুণ কুজনে কলকল কত ভাষে,
কহে কোলাহলে কলহ কুহরে কাষ্ঠ কঠোর হাসে।”

উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশে’র সঙ্গে সুকুমারের ‘সন্দেশে’র একটা পার্থক্য সত্যজিতের চোখে পড়েছে, সেটি হ’ল –“বাবার সন্দেশের চেহারাটা ঠাকুর্দার সন্দেশের থেকে আলাদা হয়ে গেল। শিশুদের পত্রিকা থেকে হঠাৎই কিশোরদের পত্রিকা হয়ে উঠল।” ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় একটা বড় অংশ ছিল এর ছবি বা ‘ইলাস্ট্রেশন’। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ লিখেছেন –“উপেন্দ্রকিশোর বা সুকুমার কেউই আঁকা শেখেন নি। উপেন্দ্রকিশোরের কাজ দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। কিন্তু সুকুমারের কাজে বোঝা যায়। নিছক অঙ্কনকৌশলে সুকুমার উপেন্দ্রকিশোরের সমকক্ষ ছিলেন না। কিন্তু এই কৌশলের অভাব তিমি পূরণ করেছিলেন দুটি দুর্লভ গুণের সাহায্যে। এক হল তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, আর এক হল অফুরন্ত কল্পনাশক্তি। এই দুইয়ের সমন্বয়ে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু টেকনিককে অতিক্রম করে চোখের সামনে জলজ্যান্ত রূপ ধারণ করে।”

সমালোচকদের মতে সুকুমার পৌরাণিক ও অনুবাদ গল্পে তার পিতা উপেন্দ্রকিশোর ও খুল্লতাত কুলদারঞ্জনের মত স্বচ্ছন্দ ও সফল নন। ব্যতিক্রম হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে ‘খৃষ্টবাহন’ ও ‘ভাঙাতারা’ গল্প দুটি।

‘সন্দেশে’ সুকুমারের অপর একটি অবদান ছিল তার বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাগুলি। ছোটদের উপযোগী করে সহজ ভাবে তিনি বিজ্ঞানের জটিল বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন অজস্র রচনার মাধ্যমে। নিজে বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র হওয়ায় এ কাজটা তিনি অনায়াসে সাবলীল ভঙ্গীতে করতে পেরেছেন। এ বিষয়ে তার প্রথম লেখা প্রবন্ধ ‘সূক্ষ্ম হিসাব’। ১৩২৫ কার্ত্তিক সংখ্যায় লিখেছেন ‘বেগের কথা’। কত সহজ ভাবে ছোটদের তিনি উপমা সহকারে ‘বেগ’ ও ‘বল’ সম্বন্ধে বুঝিয়েছেন তার সামান্য উদাহরণ –“তাল গাছের উপর হইতে ভাদ্র মাসের তাল যদি ধুপ করিয়া পিঠে পড়ে তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়; কিন্তু ঐ তালটাই যদি তাল গাছ হইতে না পড়িয়া ঐ পেয়ারা গাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, বেগ কম হইত। কোন জিনিস যখন উপর হইতে পড়িতে থাকে তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে। ......”। বেতার যন্ত্র বোঝাতে ‘আকাশবাণীর কল’ যখন লিখেছেন, আমাদের দূরশ্রবণ ‘আকাশবাণী’র তখন সৃষ্টিই হয় নি। ‘আকাশবাণী’ নামটা কি সুকুমারের কাছ থেকেই পাওয়া?

সুকুমার তার ‘ননসেন্স’ ও উদ্ভট ধরণের রচনায় এডওয়ার্ড লিয়রের (Edward Lear, 1812-1888) ‘A Book of Nonsense’, লুইস ক্যারলের (Lewis Carroll, 1832-1898 ) ‘Alices Adventure in Wonderland’ প্রভৃতি লেখার দ্বারা নিশ্চয়ই প্রভাবিত হয়েছেন, হয়ত রয়েছে চ্যাপলিনের খামখেয়ালিপনার প্রভাবও। ‘হেঁশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’-তে কোনান ডয়েলের প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের ছায়াও রয়েছে। কিন্তু সুকুমারের লেখায় মনে হয় তার সৃষ্ট উদ্ভট চরিত্র ও ছবিগুলি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ, সুপ্রযুক্ত ও ঘরোয়া।

বিদেশী লেখক ও তাদের রচনার দ্বারা উৎসাহিত বা প্রভাবিত হলেও সুকুমারের লেখা ছিল স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। তার লেখায় ব্যঙ্গ বা হাস্যরস অফুরন্ত ভাবে উপস্থিত থাকলেও কোন শ্লেষাত্মক ভাব ছিল না। পাঠকদের তিনি আগেই তার রচনার ধরণ ও বৈশিষ্ট্য খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছেন তার ‘আবোল তাবোল’-এর ভূমিকায় –“ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।” সুকুমার তার লেখার অন্য কোন উদ্দেশ্য বা গূঢ়ার্থ সম্বন্ধে কোথাও মন্তব্য করেছেন কিনা জানা নেই; কিন্তু কিছু বিদগ্ধ পাঠক তার রচনায় সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিছু রাজনৈতিক ঘটনার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন। হতে পারে, প্রতিভাধর ব্যক্তিদের চিন্তা ও মননে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী অবচেতন ভাবে তাদের রচনায় প্রতিফলিত হয়। সুকুমারের রচনা ‘বাবুরাম সাপুড়ে’-তে বর্ণিত চোখ-শিং-নখ বিহীন সাপ হ’ল আমাদের সমস্ত জীবনের প্রতীক, এটাই অনেকের ধারনা। আমরা চাই আমাদের জীবনের সমস্ত সমস্যা যেন ঐ নিস্তেজ সাপের মত হয়, যাতে মুখোমুখি হয়ে সংগ্রাম না করে বাধাহীন ভাবে অনায়াসেই আমরা প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে পারি। অনেকে তার কবিতার নিহিতার্থ ব্যাখ্যায় ব্রিটিশ সরকার, গান্ধীজী এবং নানা আন্দোলনকেও এনে উপস্থিত করেছেন। এ নিয়ে বেশি কথা বলে কাজ নেই। সুকুমার আমাদের কাছে সরস ও সজীবতার মূর্ত প্রতীক হয়েই থাকুন। জীবনের শেষ আড়াই বছর রোগ শয্যায় শুয়ে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও অচঞ্চল ও অবিচলিত চিত্তে যেভাবে তিনি একনিষ্ঠ ভাবে পত্রিকার কাজ করে গেছেন, তার এই কর্মযোগের আদর্শ যেন আমাদের চিরদিন অনুপ্রাণিত করে।


সুকুমারের ‘মন্ডা’ ক্লাব ও ৩২II ভাজা

সুকুমার রায়ের সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন তারা এক অর্থে সৌভাগ্যবান, কারণ জীবনে বন্ধুর চলার পথকে তিনি মসৃণ করে দিয়েছিলেন তার স্বতঃস্ফূর্ত হাস্যরসের সঞ্জীবন ধারায়। সে সময়ের বহু মানুষের স্মৃতিতে বিধৃত রয়েছে তার রসসৃষ্টির টুকরো টুকরো উদাহরণ। লেখক কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন –“সেদিন তাঁর এক লেখার-খাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে : ‘নোটিস, এই খাতা হারাইলে কাহারও নিস্তার নাই, আদায় না করিয়া ছাড়িব না – না পাইলে গালি দিব’ ।”

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সুগায়িকা ভাগ্নি সাহানা দেবী (বসু) লিখেছেন –“১৯১৬ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী (৬ই ফাল্গুন) রসা রোডের বাড়িতে আমার বিবাহ হয় ডাঃ বিজয়কুমার বসুর সঙ্গে। ... মনে আছে বিয়ের পরের দিন মামাবাড়ির সুবৃহৎ বৈঠকখানার ঘরে আমাদের পিসতুতো ভগ্নীপতি তাতাবাবু (সুকুমার রায়) কি রকম জমিয়েছিলেন তাঁর ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’র পাণ্ডুলিপি আবৃত্তি করে এবং তাঁরই অন্যান্য লেখা থেকে কিছু কিছু পাঠ করে। এখনও কানে বাজে সেই অসাধারণ একেবারে নিজস্ব ঢঙে এই লাইনগুলি তাঁর পড়া –

“কাছে এসে ঘেঁষে ঘেঁষে
হেসে হেসে কেশে কেশে
এত ভালো বেসে বেসে
টাকা মেরে পালালি শেষে-”

ঘরভর্তি লোক সেদিন কি হাসিটাই হেসেছিলেন। কি অদ্ভুত ঢঙই যে ছিল তাতাবাবুর এসব পড়ার। ওরকম আর শুনিনি। ... অমন প্রতিভা আর হল না।”

মণ্ডা ক্লাবের তৃতীয় জন্মদিনে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা গান

সুকুমার কলেজে পড়ার সময়েই ‘ননসেন্সে ক্লাব’ গড়ে তোলেন। এর মুখপত্র ছিল ‘৩২II ভাজা’ (সাড়ে বত্রিশ ভাজা)। বিলেত থেকে ফিরে এসে তিনি ‘মন্ডা ক্লাব’ (ইংরেজিতে Monday Club) নামে এক সাহিত্য-আসর প্রতিষ্ঠা করেন। এটিরও মুখপত্র সাড়ে বত্রিশ ভাজা বলে উল্লেখিত হয়েছে। মনে হয়, ‘ননসেন্স ক্লাবে’র মুখপত্রটিই চালু ছিল এবং পরে সেটি ‘মন্ডা ক্লাবে’রও মুখপত্র হিসাবে গণ্য হয়। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি ‘মন্ডা ক্লাবে’র সভ্য ছিলে। এদের মধ্যে ছিলেন – সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, নির্মলকুমার সিদ্ধান্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস নাগ, অজিতকুমার চক্রবর্তী, সুবিনয় রায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণশঙ্কর রায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ক্লাবের সম্পাদক ছিলেন সুকুমারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু শিশিরকুমার দত্ত। সভ্যদের নামের তালিকায় তার নামের সঙ্গে ‘এ.বি.সি.ডি.’ এবং পাশে বন্ধনীতে ‘সম্পাদক’ ছাপা হত।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ক্লাবের তৃতীয় জন্মদিন উপলক্ষে ১৯১৮ সালের ১৮ই আগস্ট ‘মন্ডা-সম্মিলন’ নামে একটি গান রচনা করেছিলেন। সুরটি ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের শান্তিনিকেতন’-এর অনুরূপ। গানটি ছিল –

“মন্ডা-সম্মিলন
(সুর : আমাদের শান্তিনিকেতন)
আমাদের মন্ডা-সম্মিলন।
আরে না – তা’ না, না –
আমাদের Monday সম্মিলন।
আমাদের হল্লারই কুপন।
তার উড়ো চিঠির তাড়া
মোদের ঘোরায় পাড়া পাড়া,
কভু পশুশালে হাসপাতালে আজব আমন্ত্রণ।
( কভু কলেজ-ঘাটে ধাপার মাঠে ভোজের আকর্ষণ )।” ... ইত্যাদি।

এই সম্মিলনীর আয়-ব্যয়ের একটি হিসেব ছাপা হয়েছে। হিসাবের শেষে দেখানো হয়েছে নগদ চোদ্দ আনা তখনও মজুদ আছে। সম্পাদক সেই হিসেবের নীচে লিখেছেন :

“আমার হাতে অর্থাৎ বাক্সে এই সোয়া চৌদ্দ আনা পয়সা মজুদ আছে। সভ্যেরা যদি অসভ্যের মতো খাই-খাই না করিয়া চা-বিস্কুটে খুসী থাকিতেন – যাক সে কথা বলিয়া কোন লাভ নাই।
শ্রীশিশিরকুমার দত্তদাস
অনাহারী সম্পাদক।”

এই বিবরণীতে একটি বিজ্ঞাপনও ছাপা হয়েছিল। সেটি হল :

“আমাদের অভূতপূর্ব সম্পাদক সংসার বিমুখ ও উদাসীন হইয়া লোটাকম্বল ও চা-বিস্কুট সহযোগে বাণপ্রস্থ অবলম্বনের সংকল্প জানাইয়া, ক্লাবের মায়া কাটাইবার উদ্যোগ করিয়াছেন। তাঁহাকে উক্ত সংকল্প হইতে নিরস্ত করিবার জন্য কয়েকটি বলিষ্ঠ ভক্তের প্রয়োজন। ভক্তসভ্যগণ সত্ত্বর হউন।”

কিন্তু সংসার তিনি ত্যাগ করেন নি। কারণ, ক্লাবের যেমন তাকে ছাড়া চলত না, তেমনি তারও ক্লাব ছাড়া চলত না। এ কারণেই একটি ‘প্রতিবাদ সভা’র চিঠি পাওয়া গিয়েছে, সেটি হ’ল –

“সম্প্রতি ক্লাবের সর্ব্বজনস্বীকৃত সম্পাদকরূপে আমি ‘অধিকারী’ উপাধি গ্রহণ করিয়াছি। ইহাতে কোন কোন ঈর্ষাপরায়ণ ‘সভ্য’ অসঙ্গতভাবে আপত্তি করিতেছেন। কালিদাসবাবু আপত্তি করিতে চান করুন, কিন্তু আমি স্বোপার্জ্জিত উপাধি ছাড়িব না।
“এইরূপ অন্যায় আপত্তির বিশেষ প্রতিবাদ বাঞ্ছনীয়। অনেক হিসাব করিয়া দেখিলাম, আগামী মঙ্গলবার ২১শে আগষ্ট, বাংলা তারিখ জানি না, আমাদের ক্লাবের জন্মদিন, অর্থাৎ প্রায় জন্মদিন। ঐ দিনই সন্ধ্যার সময় ১০০নং গড়পার রোড, অর্থাৎ কালাবোবা ইস্কুলের পশ্চাতে, সুকুমারবাবু নামক ক্লাবের একজন আদিম ও প্রাচীন সভ্যের বাড়ীতে সভার আয়োজন হইয়াছে। বক্তা প্রায় সকলে, সভাপতি আপনি, বিষয় গম্ভীর – সুতরাং খুব জমিবার সম্ভাবনা।
“আসিবার সময় একখানা সেকেন্ডক্লাস গাড়ী সঙ্গে আনিবেন – আমায় ফিরিবার পথে নামাইয়া দিতে হইবে। খাওয়া গুরুতর হইবার আশঙ্কা আছে। ইতি
শশব্যস্ত –
শ্রীশিশিরকুমার দত্তাধিকারী
সুযোগ্য সম্পাদক।”

ভোজের ব্যবস্থা ছাড়া যে সাহিত্য আলোচনা নিষ্ফল, সেটা বোধ হয় সব সভ্যই মেনে নিয়েছিলেন। অপর একটি নিমন্ত্রণের চিঠি ছিল এই রকম –

“আঃ ! আবার খাওয়া !!
এইত সেদিন সবাইকে বুঝিয়ে বললুম যে আর ‘খাই খাই’ ক’রো না – এর মধ্যে সুনীতিবাবু খাওয়াতে চাচ্ছেন। আমার হাতে কতকগুলো টাকা গছিয়ে দিয়ে এখন বলছেন, না খাওয়ালে জংলিবাবুকে দিয়ে মোকদ্দমা করাবেন। আমি হাতে পায়ে ধরে নিষেধ করলুম, তা তিনি কিছুতেই শুনলেন না, উলটে আমায় তেড়ে মারতে আসলেন। দেখুন দেখি কি অন্যায়! তা আপনারা যখন উপদেশমত চলবেন না, কাজেই অগত্যা সুকুমারবাবুকে বলে কয়ে এই ব্যবস্থা করে এসেছি যে তাঁর বাড়ীতে আগামী মঙ্গলবার (৩০শে জুলাই) সন্ধ্যা ৭টার সময় আপনি সুস্থদেহে হাজির হবেন। সুনীতিবাবুর ভোজের পাত সেখানেই পড়বে। এখন খুসী হলেন ত ?
ত্যক্তবিরক্ত
শ্রীসম্পাদক।”

প্রায় সব নিমন্ত্রণই করা হত পদ্য লিখে। আরও কয়েকটি নিমন্ত্রণ পত্র এখানে দেওয়া হ’ল –

(১)
“আসছে কাল, শনিবার
অপরাহ্ণ সাড়ে চার,
আসিয়া মোদের বাড়ি,
কৃতার্থ করিলে সবে
টুলুপুষু খুশি হবে।”

[ সুকুমারের স্ত্রী সুপ্রভার ডাক নাম ছিল টুলু এবং ভাই সুবিনয়ের স্ত্রী ছিলেন পুষ্পলতা। টুলু এবং পুষু বলতে সম্ভবত এদেরই বোঝানো হয়েছে ]।

(২)
“রবিবার ১০ই চৈত্র
প্রফেসর সুরেন মৈত্র
আবাহন করেন সবে
শিবপুরে আপন ভবে
মহাশয় সময় বুঝে
চাঁদপালে জাহাজ খুঁজে
চড়িবেন যেমন রীতি
নিবেদন সাদর ইতি।”

(৩)
“শনিবার ১৭ই
সাড়ে পাঁচ বেলা,
গড়পারে হৈ হৈ
সরবতী মেলা।
অতএব ঘড়ি ধ’রে-
সাবকাশ হয়ে,
আসিবেন দয়া করে
হাসি মুখ লয়ে।
সরবৎ, সদালাপ,
সঙ্গীত ভীতি –
ফাঁকি দিলে নাহি মাপ,
জেনে রাখ – ইতি।”
(এটি ‘সরবৎ সম্মিলন’-এর নিমন্ত্রণ, কার লেখা জানা নেই। সুকুমারেরও হতে পারে)।

একদিন সম্পাদক কোথায় ডুব দিলেন জানা নেই। ‘সভ্যদের মাথায় তো প্রায় বজ্রাঘাত হবার জোগাড়। ক্লাবটিও টলমল করে উঠলো’। সে সময়ে সুকুমার রায় একটি চিঠি লিখে সেটি বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। সম্পাদক না থাকায় চিঠির চারদিকে শোকচিহ্নস্বরূপ কালো বর্ডার ছিল। এই পদ্যটি বহুল প্রচলিত এবং অনেকেই পড়েছেন –

“সম্পাদক বেয়াকুব
কোথা যে দিয়েছে ডুব-
এদিকেতে হায় হায়
ক্লাবটি ত যায় যায়।
তাই বলি, সোমবারে
মদগৃহে গড়পারে
দিলে সবে পদধুলি
ক্লাবটিরে ঠেলে তুলি।
রকমারি পুঁথি যত
নিজ নিজ রুচিমত
আনিবেন সাথে সবে
কিছু কিছু পাঠ হবে।
করজোড়ে বারবার
নিবেদিছে সুকুমার।”

কিন্তু ইতিমধ্যেই সম্পাদকের খোঁজ পাওয়া গেল। কাজেই এর পরের চিঠি –

“শুভ সংবাদ, সম্পাদক জীবিত আছেন। আগামী সোমবার ২৫নং সুকিয়া ষ্ট্রীটে ৬II ঘটিকায় তাঁহার শ্রীমুখচন্দ্র দর্শনার্থ ভক্ত সমাগম হইবে।”
এবার সম্পাদক ফিরে এসে নিজেই পদ্যে চিঠি লিখলেন –
“আমি অর্থাৎ সেক্রেটারি
মাস তিনেক কলকেতা ছাড়ি
যেই গিয়েছি অন্য দেশে-
অমনি কি সব গেছে ফেঁসে !!
বদলে গেছে ক্লাবের হাওয়া
কাজের মধ্যে কেবল খাওয়া
চিন্তা নেইক গভীর বিষয়-
আমার প্রাণে এসব কি সয় ?
এখন থেকে সমঝে রাখ
এ সমস্ত চলবে নাকো,-
আমি এবার এইছি ঘুরে
তান ধরেছি সাবেক সুরে।–
শুনবে এস সুপ্রবন্ধ
গিরিজার ‘বিবেকানন্দ’,
মঙ্গলবার আমার বাসায়-
(আর থেকো না ভোজের আশায়)।”

একটি বিষয় পরিষ্কার যে মজলিশি মেজাজে এধরণের সম্মেলন প্রায়ই হোত, এবং খুব ঘন ঘনই হোত। আলোচ্য প্রসঙ্গেই সুকুমারের ‘সম্পাদকের দশা’ কবিতাটি অনেকেই পড়েছেন। সেটি আর এখানে উধৃত করছি না। এটি সুকুমারের মৃত্যুর পর সুবিনয়ের সম্পাদনায় ‘সন্দেশে’র ১৩৩১ ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু শেষের কিছু অংশ বাদ দিয়ে। কবিতার শেষে সুকুমারের নিজের কিছু মন্তব্য ছিল। এই অংশটি হয় ত অনায়াসলভ্য নাও হতে পারে। সেজন্য এই বর্জিত অংশটি মন্তব্য সহ তুলে দেওয়া হল –

“ হে পাঠক জ্ঞানবান, কর সবে অবধান।
উপদেশ লভ এই হয়ে অতি সাবধান।।
সম্পাদকী কাজ পাওয়া-সৌভাগ্য সে অতিশয়।
কিন্তু সেটা নহে ঠিক আদ্যোপান্ত মধুময়।।
তোমাদের সম্পাদক-সেও ত মানুষ বটে।
বৃথা যেন তার পরে অত্যাচার নাহি ঘটে।।
যদি এ পত্রিকা তব নাহি হয় মনোমত।
কিম্বা যদি “৩২II” বন্ধ থাকে মাসকত।।
কিম্বা যদি অন্যরূপে দোষত্রুটি ঘটে তবু।
সম্পাদকে গালি দেওয়া উচিত না হয় কভু।।
লেখকবৃন্দের প্রতি আছে এক নিবেদন।
না লিখেন কভু যেন গুরুপাক বিবরণ।।
পেচকের মত সবে হাঁড়িমুখ নিরবধি।
গম্ভীর গম্ভীরতম প্রবন্ধ লিখেন যদি।।
নির্ঘাৎ জানিহ তবে, ধ্রুব সত্য অতি খাঁটি।
নিস্ফূর্তি নির্জীব সভা একদম হবে মাটি।।
অতএব কহি শুন ছাড় শুষ্ক নীরবতা।
পেট ভরে হাস আর শুনাও হাসির কথা।।
নচেৎ এ সম্পাদক হতশ্বাস হয়ে শেষে।
একেবারে দিবে ছুট জনহীন দূর দেশে ।।”

“উৎসাহের চোটে পদ্য লিখিয়া ফেলিলাম-লেখকগণ অতি সূক্ষ্মভাবে কবিতার ভাষাগত বা ছন্দোগত দোষ গুণ বিচার না করিয়া ইহার মর্মগ্রহণ করিতে সচেষ্ট হইলে সম্পাদক বেচারা বাধিত হইবে।”

বেশ কয়েকটি কবিতা এখানে উধৃত হল, কারণ কবিতাগুলি একসঙ্গে পাওয়াটা কষ্টসাধ্য।


ব্রাহ্মসমাজ ও সুকুমার

সুকুমারের পিতা উপেন্দ্রকিশোর অল্প বয়সেই শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে ব্রাহ্মধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। সুকুমার এই পরিমণ্ডলে মানুষ হয়ে ওঠেন, তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করলেও সুকুমার সমাজের সদস্য পদ গ্রহণ করেন ১৯০৭ সালে, স্নাতক হবার পর। ১৮৭৮ সালে ব্রাহ্মসমাজ দ্বিতীয়বার বিভক্ত হয়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তরুণ সমাজকে আকর্ষণ করার জন্য আনন্দমোহন বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘Students’ Weekly Service’। সুকুমার এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বালক-বালিকাদের সমাবেশ হত রবিবারে। একবার এক বার্ষিক সম্মেলনে সুকুমারের লেখা একটা মজার নাটক পরিবেশিত হয়। এখানে কেউ সেজেছিল ‘বাঃ’, কেউ হয়েছিল ‘যদি’ আবার কেউ ‘বটে’। নাট্যালাপের কয়েকটি লাইন –

“আমার নাম বাঃ,
বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা।”
“যদি” ঢুকেই বলল :
“আমার নাম যদি,
আশায় আশায় বসে থাকি হেলান দিয়ে গদি।”
“বটে” ঢুকেই বলল :
“আমার নাম বটে,
কটমটিয়ে তাকাই যখন সবাই পালায় ছুটে।” ... ইত্যাদি।

বিদেশ থেকে ফিরে এসে সুকুমার ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে সর্বতোভাবে জড়িয়ে পড়লেও ব্রাহ্মসমাজের কাজের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভাষণ দানও করেছিলেন, বিষয় ছিল ’চিরন্তন প্রশ্ন’। তিনি ছিলেন সহকারী সম্পাদক ও উপাসকমণ্ডলীর অন্যতম আচার্য। সুকুমার অসুস্থ হয়ে পড়লে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। তিনি তখন কেম্ব্রিজ থেকে সংখ্যাতত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানার্জন করে দেশে ফিরেছেন। ১৯২০ সালের শেষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে একটা বিতর্ক দেখা দেয়। আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রবীন্দ্রনাথের সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গেও সম্পর্ক ভাল ছিল। এই সমাজের বহু তরুণ সদস্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। তাদের একটি প্রস্তাব ছিল রবীন্দ্রনাথকে যেন সম্মানিত সদস্য নির্বাচন করা হয়। প্রস্তাবটি ৫১-২৯ ভোটে গৃহীত হলেও কার্যকরী হয় নি কারণ, একদল রক্ষণশীল গোঁড়া ব্রাহ্ম সদস্য রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু বলেই মনে করতেন, ‘যথেষ্ট পরমাণে’ ব্রাহ্ম বলে মনে করতেন না। এদের মধ্যে ছিলেন কৃষ্ণকুমার মিত্র, নবদ্বীপচন্দ্র দাস, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র প্রমুখ ব্যক্তি। এ নিয়ে যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি হয়। সুকুমার তখন অসুস্থ। তিনি মনে প্রাণে প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন। অসুস্থ শরীরেই তিনি প্রশান্ত মহলানবীশকে ‘কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই’ নামক একটি ৫২ পৃষ্ঠার পুস্তিকা প্রস্তুত করতে সাহায্য করেন। ১৯২১ সালের ১৫ই মার্চ এটি প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটির কিছু অংশ –

“... রবীন্দ্রনাথের সার্বভৌমিকতার মূল মন্ত্র-বহুর মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি, বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য স্থাপন। এই একমেবাদ্বিতীয়মের সাধনাকেই রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত তপস্যা বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন।
“ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাসেও আমরা এই এক মূল আদর্শ দেখিতে পাই। রবীন্দ্রনাথ নিজে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন যে ব্রহ্মসাধনার এই সার্বভৌম আদর্শটিকে বিশ্বজগতের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করাই ব্রাহ্মসমাজের চরম সার্থকতা। তাই রবীন্দ্রনাথের বাণী ব্রাহ্মসমাজেরই বাণী।
“রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও ধর্ম্মোপদেশে তাঁহার সুমহান আদর্শ প্রকাশিত হইতেছে। রবীন্দ্রনাথের প্রতিদিনের জীবনে, তাঁহার নানা বিচিত্র প্রতিষ্ঠানে, তাঁহার সমগ্র কর্মপ্রচেষ্টায় ব্রাহ্মসমাজের সাধনা সত্য হইয়া উঠিতেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবন্ত আদর্শের প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজে নূতন প্রেরণা আসিয়াছে, এই জন্যই আমরা রবীন্দ্রনাথকে চাই। ......”।

অবশেষে ১৯২১-এর ১৯ শে মার্চ স্থগিত সভার অধিবেশনে প্রস্তাবটি ৪৯৬-২৩৩ ভোটে গৃহীত হয় এবং রবীন্দ্রনাথ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সম্মানিত সদস্য নিযুক্ত হন। সুকুমার নিশ্চয়ই এই ব্যবস্থায় খুশি হয়েছিলেন। সম্ভবত এই প্রচেষ্টাই ছিল তার কবির প্রতি নিবেদিত শেষ শ্রদ্ধার্ঘ।

রোগশয্যায় শুয়েই তিনি রচনা করেন ব্রাহ্মসমাজের অতীত ইতিহাস নিয়ে বিখ্যাত কবিতা ‘অতীতের ছবি’। ১৯২২-এর মাঘোৎসবে সমাজের বালক-বালিকাদের মধ্যে এটি বিতরণ করা হয়েছিল। ভাবগম্ভীর এই দীর্ঘ রচনাটি ছোটদের কতটা স্পর্শ করেছিল বলা যায় না; তবে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির নাম এতে উল্লেখিত হয়েছে এবং সুকুমারের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মমত লেখাটিতে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তার হতাশার চিহ্নও স্পষ্ট। কবিতাটির কিছু অংশ –

“ছিল এ ভারতে এমন দিন
মানুষের মন ছিল স্বাধীন,
সহজ উদার সরল প্রাণে
বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে।
............
অনাদি নিয়মে অনাদি স্রোতে
ভাসিয়া চলেছে অকূল পথে
প্রতি ধূলিকণা নিখিল টানে
এক হতে চায় একেরই পানে,
অজর অমর অরূপ রূপ
নহি আমি এই জড়ের স্তূপ
দেহ নহে মোর চির-নিবাস
দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ।
............
কালচক্রে হায় এমন দেশে
ঘোর দুঃখদিন আসিল শেষে।
দশদিক হতে আঁধার আসি
ভারত আকাশ ফেলিল গ্রাসি। ......” ইত্যাদি।

সুকুমার আলাদা ভাবে সেরকম গান বিশেষ লেখেন নি। তার হাল্কা ধরণের গানগুলি অনেকগুলিই ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ নাটকে ব্যবহৃত। ‘শব্দকল্পদ্রুম’ ও ‘ঝালাপালা’তেও কয়েকটি গান আছে। তার মাত্র দুটি ব্রহ্মসঙ্গীতের কথা জানা যায়। একটি ‘প্রেমের মন্দিরে তাঁর আরতি বাজে’ ও অন্যটি ‘নিখিলের আনন্দগান এই প্রেমেরই যুগল বন্দনায়’। দুটিই রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের অনুকরণে। প্রথমটির সুর ‘ছিল যে পরাণের অন্ধকারে’ ও দ্বিতীয়টি ‘শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে’র অনুরূপ। সুকুমারের যদি স্বল্পায়ু না হতেন, হয়ত সুর সহ আরও কিছু গান তিনি রেখে যেতেন।

সুকুমার ও গীতাঞ্জলির অনুবাদ

১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ডে যান, সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে করে গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদও নিয়ে গিয়েছিলেন। লন্ডনে তখন রবীন্দ্রভক্তদের মধ্যে ছিলেন রামানন্দের জ্যেষ্ঠ পুত্র কেদারনাথ, আনন্দমোহন বসুর কনিষ্ঠ পুত্র অরবিন্দ, কালীমোহন ঘোষ, প্রশান্ত মহলানবীশ ও সুকুমার রায়। বিলেতে সুকুমারের রচিত এবং একটি সভায় পঠিত The spirit of Rabindranath Tagore নামক একটি রচনার মাধ্যমে কবি প্রাথমিক ভাবে বিদ্বজ্জনের কাছে পরিচিত হন একথার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। রচনাটি Quest পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

সুকুমার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। ১৯১২ সালের ১৯শে জুন লন্ডনে উইলিয়ম পিয়ার্সনের (পরে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক) বাড়িতে এক ঘরোয়া বৈঠকে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে সেগুলি পাঠ করেন। সুকুমার তার ছোট বোন পুণ্যলতাকে লিখেছেন –“পরশু দিন পিয়ার্সন তার বাড়িতে বেঙ্গলি লিটারেচার সম্বন্ধে একটি পেপার পড়বার নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেখানে গিয়ে দেখি মিঃ অ্যান্ড মিসেস আর্নল্ড, মিঃ অ্যান্ড মিসেস রটেনস্টাইন, ড: পি. সি. রায় প্রভৃতি অনেকে। তাছাড়া কয়েকজন অচেনা সাহেব মেম উপস্থিত। শুধু তাই নয় ঘরে ঢুকে দেখি রবিবাবু বসে আছেন। বুঝতেই পারছিস আমার অবস্থা। যা হোক, চোখ কান বুঁজে পড়েছিলাম। ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি থেকে বইটই এনে ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করতে হয়েছিল। তাছাড়া রবি বাবুর কয়েকটি কবিতা – সুদূর, পরশপাথর, সন্ধ্যা, কুঁড়ির ভিতর কাঁদিছে গন্ধ ইত্যাদি অনুবাদ করেছিলাম। মিঃ ক্র্যানমার বীং, নর্থব্রুক সোসাইটির সেক্রেটারি, আর উইজডম অব দি ইস্ট সিরিজের এডিটর খুব খুশি। আমাদের ধরেছেন অনুবাদ করতে, তিনি পাবলিশ করবেন।”

মিঃ বিং (Crammer Byng) অবশ্য সে অনুবাদ পরে আর ছাপেন নি। এই সমাবেশের পরের দিন রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে কিন্তু সুকুমারের কবিতা পাঠের কোন উল্লেখ নেই। রচনার কলেবর বৃদ্ধি করে লাভ নেই। এখানে শুধু ‘সুদূর’ কবিতাটির সুকুমার এবং রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদের কয়েক পংক্তি তুলে দিই।
মূল কবিতাটি হ’ল –

“ আমি চঞ্চল হে
আমি সুদূরের পিয়াসি
দিন চলে যায়, আমি আনমনে
তারি আশা চেয়ে থাকি বাতায়নে
ওগো, প্রাণে মনে আমি যে তাহার
পরশ পাবার পিয়াসী।
আমি সুদূরের পিয়াসি
ওগো সুদূর, বিপুল সুদূর, তুমি যে
বাজাও ব্যাকুল বাঁশরি। ......”

সুকুমারের অনুবাদটি ছিল –

“ I am restless
I am athirst for the great Beyond
Sitting at my window,
I listen for its tread upon the air, as the day weras on.
My life goes out in longing
For the thrill of its touch,
I am athirst for the great Beyond !
O Beyond! Vast Beyond!
How passionate comes thy clarion call. .......”

রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদটি ছিল –

“ I am restless. I am athirst for far-away things.
My soul goes out in a longing to touch the skirt of the dim distance.
O Great Beyond. O the keen call of thy flute ! .......”

এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট। সুকুমারের অনুবাদ সবটাই মূলানুগ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেহেতু তার স্বরচিত কবিতা নিজেই অনুবাদ করছেন, তখন অনেক সময়েই তিনি শুধু ভাবটি গ্রহণ করেছেন, আবার অনেক কিছু বাহুল্য মনে করে বর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতা সুকুমারের ছিল না। তবে ‘ব্যাকুল বাঁশরি’র অনুবাদ সুকুমার করেছিলেন ‘passionate clarion call’. এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ‘keen call of the flute’-এ ভাবের দ্যোতনা অনেক বেশি। ‘তার পরশ পাবার প্রয়াসী’ সুকুমারের অনুবাদে হয়েছে ‘for the thrill of its touch’; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হাতে সেটা হয়েছে ‘to touch the skirt of the dim distance’। এটা মূল রচনার বাইরে বেরিয়ে এসে কবি করেছেন, কিন্তু অন্য কেউ ত সেটা করতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ কি তবে সুকুমারের অনুবাদ গ্রহণ করেন নি। হয় ত তাই, স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে পরে কবি তার নিজের লেখা নিজেই অনুবাদ করেছেন।


বিদায় বেলা

সুকুমারের ‘আবোল তাবোল’ কবিতার শেষের দু’লাইন ছিল –“ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর / গানের পালা সাঙ্গ মোর”। এটি বাস্তবায়িত করেই সুকুমার পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ১৯২১ সালেই তিনি কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। এর চিকিৎসা তখনও অধরাই ছিল। শেষের আড়াই বছর তার অধিকাংশ সময়েই কেটেছে রোগশয্যায়। পুত্র সত্যজিৎ লিখেছেন –“... রুগ্ন অবস্থাতেও তাঁর কাজের পরিমাণ ও উৎকর্ষ দেখলে অবাক হতে হয়। শুধু লেখা বা আঁকার কাজেই নয়, ছাপার কাজেও যে তিনি অসুখের মধ্যে অনেক চিন্তা ব্যয় করেছেন তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি নোটবুকে তাঁর আবিষ্কৃত কয়েকটি মুদ্রণ পদ্ধতির তালিকা রয়েছে। এগুলি পেটেন্ট নেবার পরিকল্পনা তাঁর মনে ছিল, কিন্তু কাজে হয়ে ওঠে নি।”

তার অসুখের কোনও চিকিৎসা নেই এবং মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও অসাধারণ মানসিক স্থৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন সুকুমার। প্রকৃত কর্মযোগীর মত অবিচলিতভাবে তিনি তার নিজের কাজ করে গিয়েছেন। লীলা মজুমদারের স্মৃতিচারণ –“শুনলাম রোগের নাম কালাজ্বর। তার তখন কোন ভাল চিকিৎসা ছিল না। চোখের সামনে একটু একটু করে বড়দার শরীর ভাঙতে লাগল। ...। তার আগের বছরেই বড় বৌঠানের একটি সুন্দর ছেলে হয়েছিল, ঘটা করে তার নামকরণ হয়েছিল ... ছেলের নাম সত্যজিৎ। ডাক নাম মানিক।”

এসময় রবীন্দ্রনাথ এসে মৃত্যুপথযাত্রী তার ‘যুবক বন্ধু’কে মাঝে মাঝে দেখে যেতেন। একবার সুকুমারের ইচ্ছে হয় তিনি কবির স্বকন্ঠে গান শুনবেন। এলেন রবীন্দ্রনাথ। সুকুমারের অনুরোধে শোনালেন – ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’, ‘আমার সকল দুখের প্রদীপ’, ‘দুঃখ এ নয় সুখ নহে গো গভীর শান্তি এ যে’ গান কয়টি। এ প্রসঙ্গে সুকুমারের খুড়তুতো বোন মাধুরীলতা [খুল্লতাত কুলদারঞ্জনের দুই মেয়ে - ইলা ও মাধুরীলতা ] বলেছেন –“গানের পর গান চলিল, সকলে তন্ময় হইয়া গান শুনিতে লাগিল। দাদার প্রশান্ত মুখখানি দেখিয়া মনে হইতেছিল যে তিনি পরম শান্তি লাভ করিয়াছেন।”

১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে ১০০নং গড়পার রোডের বাড়িতে বিদায় নিলেন সুকুমার। লীলার কলমে –“... কত ইচ্ছা, কত আশা। ... মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বড়দা তার সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। ... জীবনে এই প্রথম ব্যক্তিগত শোকের আঘাত বুঝলাম।”

সুকুমার চলে যাবার পর রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের মন্দিরে একটি প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। আচার্যের ভাষণে তিনি বলেন –“আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যার পাশে এসে যখন বসেছি, এই কথাই বার বার মনে হয়েছে, জীব-লোকের ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মলোক আছে। যে-কোন মানুষ এই কথাটি নিঃসংশয়ে বিশ্বাসের দ্বারা নিজের জীবনে স্পষ্ট করে তোলেন, অমৃতধামের তীর্থযাত্রায় তিনি আমাদের নেতা। আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে বসে সে গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।”

১৯৮৭ সালে সুকুমারের জন্মশতবর্ষে তার সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ রায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রযোজনায় তার নিজের পরিচালনায় আধ ঘন্টার একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। অভিনয়াংশে ছিলেন উৎপল দত্ত, সৌমিত্র চ্যাটার্জি, তপেন চ্যাটার্জি, সন্তোষ দত্ত প্রভৃতি অভিনেতা। ভাষ্যপাঠ করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সত্যজিৎ নিজেই।

সুকুমারের মৃত্যু নেই। তার লেখনী থেকেই নিঃসৃত হয়েছে –“দেহ নহে মোর চির নিবাস, দেহের বিনাশে নাহি বিনাশ”। এই বিশ্বাসকে সঙ্গে করেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এই প্রাণোচ্ছল, কর্মচঞ্চল, আনন্দময় মানুষটি তার রেখে যাওয়া সাহিত্য কীর্তির মধ্য দিয়ে চির ভাস্বর হয়ে আমাদের মধ্যে বিরাজ করবেন।

( বিঃ দ্রঃ – তৃতীয় বন্ধনীর [...] মধ্যের মন্তব্য লেখকের। )

তথ্যসূত্র :
‘যখন ছোট ছিলাম’ – সত্যজিৎ রায়,
‘পুণ্যস্মৃতি’ – সীতা দেবী,
‘শতায়ু সুকুমার’ – সম্পাদনা শিশিরকুমার দাশ,
‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ’ – অমিতাভ চৌধুরী,
‘ব্রাহ্মসমাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ – বারিদবরণ ঘোষ,
‘স্মৃতির খেয়া’ – সাহানা দেবী,
‘পাকদন্ডী’ – লীলা মজুমদার,
‘ছেলেবেলার দিনগুলি’ – পুণ্যলতা চক্রবর্তী,
‘উপেন্দ্রকিশোর’ (প্রবন্ধ) – প্রসাদরঞ্জন রায়,
‘ব্যক্তি সুকুমার : স্মৃতির আলোয়’ (প্রবন্ধ) – শ্যামলী দেবী, এবং
শুভাশিস ঘোষের একটি ছোট রচনা।

 



লেখক পরিচিতি - বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।