প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সুকুমার রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, এপ্রিল ৩০, ২০১৬

 

আবোল তাবোলঃ ব্যক্তিগত পাঠ

রোহণ কুদ্দুস

 

সুকুমার রায়

গডফাদার উপন্যাসে মারিও পুজো এক জায়গায় লিখেছেন, “Time erodes gratitude more quickly than it does beauty!” আমরা যারা একটু-আধটু লিখে অন্যদের দেখাতে চাই, তাদের জন্যে এই কথাটা খুব খাটে। আমরা খুব সহজেই কৃতজ্ঞতার জায়গাটা ভুলে যাই। বাংলা লেখেন, অথচ ছোটবেলায় আবোল তাবোল পড়েননি, এমন বাঙালি বিরল। অসম্ভবের সেই ছন্দে মনে দোলা লাগেনি, এমন পাষাণ খুঁজে পাওয়া ভার হবে। কিন্তু নিজেদের পড়াশোনা বা লেখালেখির শুরুটা বলতে গিয়ে আমরা বেমালুম ভুলে যাই আবোল তাবোলের কথা। যখন বাংলা কবিতার ইতিহাস আলোচিত হয়, কখনও চোখে পড়ল না, কেউ গুরুত্ব দিয়ে সুকুমার রায়ের লেখা নিয়ে আলোচনা করলেন সেখানে। বছর দুয়েক আগে বইমেলায় এক ভদ্রলোক আড্ডার মাঝে হঠাৎ বলে বসলেন, “আমার কবিতার দৌড় ঐ সুকুমার রায় পর্যন্তই।” উনি হয়তো ওঁর কবিতাপাঠের সীমা নির্ধারণে কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু কথাটার মধ্যে কোথাও যেন সুকুমার রায়ের প্রতি একটা তাচ্ছিল্য রয়েই গিয়েছিল। কোনও উত্তর দিচ্ছি না দেখে ভদ্রলোক একই কথা বারদুয়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন। খুব ইচ্ছা হচ্ছিল একটা আবোল তাবোল খুলে জিজ্ঞাসা করি, ‘খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’-র মানেটা বুঝিয়ে দিতে বা ‘সারে গামা টিম্‌টিম্‌’ গেয়ে শোনাতে। খুব সম্ভবত বিরক্তিটা আমার মুখে পড়াই যাচ্ছিল, তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে পাশ থেকে দেবজ্যোতিদা (লেখক-সম্পাদক দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য) বললেন, “আপনি গুরুদেবকে পড়ে ফেলেছেন, সেটাই যথেষ্ট। বাংলা কবিতার অনেকটাই আপনার পড়া হয়ে গেছে।” আজও কোনও বিচিত্র কারণে আপামর বাঙালি পাঠক সুকুমার রায়ের কবিতায় শুধু ছন্দটাই দেখল, ভাষার ব্যবহার আর তার অতুলনীয় ব্যঞ্জনাটা নিয়ে একটা কথাও খরচ করল না।

যখন নিজে বাংলা পড়তে পারতাম না, তখন মায়ের মুখে শুনতাম। গন্ধবিচার কবিতাটা বিশেষ প্রিয় ছিল, তাই শুনে শুনেই পুরো মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে পরিচিত কেউ এলে আমার ওপর একটা আলাদা অত্যাচার চলতই কবিতাটা আরও একবার শোনানোর জন্যে। যদিও পুরোটা যে বুঝতে পারতাম না, বলাই বাহুল্য। কিন্তু গন্ধ শুঁকতে একের পর এক মানুষ আসছেন, শেষে একজন পালোয়ানকেও ডাকতে হচ্ছে, এটা বেশ মজার ব্যাপার ছিল আমার কাছে। তারপর শিশু সাহিত্য সংসদের প্রকাশিত রামায়ণ থেকে আমার নিজে নিজে বাংলা পড়ার শুরুয়াত হল। বুভুক্ষু ডেঁয়ো পিপড়ের মতো পড়তাম। যা হাতের কাছে পেতাম। মানে বুঝতাম না প্রায়শই। তবু বয়সের তুলনায় অনুপযুক্ত কোনও বই না পড়ে ফেলি, এই ভয়ে সবাই কাঁটা হয়ে থাকত। নিয়মিত বইয়ের জোগান দিয়ে যেত বাপি, সেজোকাকু, ফুলকাকু আর রাঙাকাকু। ফুলকাকুই এক বছর বইমেলা থেকে আবোল তাবোল কিনে এনে উপহার দিয়েছিল। রুপোলি জমির ওপর ট্যাঁশ গরুর মুন্ডুটা দিয়ে পূর্ণেন্দু পত্রীর করা প্রচ্ছদে সে অতুলনীয় এক উপহার। ভেতরে প্রচ্ছদশিল্পীর শুভেচ্ছাসহ অটোগ্রাফ। আজও সে বই আমাদের বুকশেলফ-এ ‘সোনার হাতে সোনার কাঁকন’ জাতীয় অহংকার।

কাতুকুতু বুড়ো

শুরু হল আবোল তাবোল পড়া। বাংলা বইয়ের থাকার কারণে কাতুকুতু বুড়ো কবিতাটাই একমাত্র আগে পড়েছিলাম। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে থাকলে যে কোনও কবিতাই যেমন বহুচর্চায় বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, এ কবিতাটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। তাই আমি শুরু করেছিলাম সৎ পাত্র দিয়ে। বেচারা গঙ্গারামের জন্যে দারুণ করুণা হত। যাও বা একটা বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়েছিল, সেটাও শেষমেশ কেঁচেই গেল বোধ হয়। কিন্তু গঙ্গারামের ভাইদের কথা পড়ে বেশ মজা পেতাম। তাদের গুণকীর্তনের সঙ্গে আমার পরিচিত মানুষগুলোকে মেলানোর চেষ্টা করতাম। সত্যি বলতে কী, নোট জাল করে বা যাত্রাদলে তবলা বাজায় – এমন লোকজনকে তখনও চিনতাম না। কিন্তু মনে মনে কল্পনা করতাম আমার পরিচিতদের মধ্যে কে গঙ্গারামের কোন ভাই। যেমন আমাদের পাশের বাড়ির এক দাদা আমাদের ফুটবল প্রায়ই বাজেয়াপ্ত করত বলটা পাঁচিল টপকে তাদের এলাকায় গিয়ে পড়ার অভিযোগে। গায়ের জোরে পারব না জেনেই, তাকে গঙ্গারামের গোঁয়ার ভাই হিসাবে কল্পনা করে দারুণ প্রতিশোধ নিতাম। এভাবেই কেউ হুঁকোমুখো, কেউ ষষ্ঠিচরণ। আমাদের পাড়ায় এক লেখক থাকতেন, যিনি তাঁর বাড়ির কাছাকাছি কোনও বাচ্চা ছেলে খেলতে গেলে তাড়া করতেন। তাঁর নাকি দারুণ ভয় ছিল, ছোট ছেলেরা তাঁর কাগজপত্র ছড়িয়ে ছত্রখান করবে। তাঁর নাম দিয়েছিলাম ছায়াবাজ।     

আশেপাশের লোকজনকে দিয়ে আমার এই আবোল তাবোল রোলপ্লে করানোর ব্যাপারটা কথায় কথায় একবার মাকে বলে ফেলেছিলাম। মা পাতা উলটে দেখিয়েছিল, “এটা আমি।” আঙুলের তলায় ‘নারদ! নারদ!’ কবিতার সেই ঘুষি বাগানো ছাগলদাড়ি লোকটা। ব্যাপারটা কী? জানা গেল, মায়েদের স্কুলের কোনও এক ফাংশানে মা ধুতি শার্ট পরে এই কবিতাটা মঞ্চস্থ করেছিল। এরপর ঘর ফাঁকা পেলে বিছানাটা স্টেজ ভেবে নিয়ে তার ওপর উঠে ঘুঁষি বাগিয়ে বলতাম, “জানিস্‌ আমি স্যান্ডো করি?”

বাগনানে যে এলাকায় তখন আমরা থাকতাম, তার পাশেই ছিল জাতীয় সড়ক, ‘বোম্বে রোড’। বোম্বে রোডের ওপারে একটা গাড়ির ব্যাটারি সারাইয়ের দোকান ছিল। সেখানে দিনরাত তারস্বরে গান বাজত। নব্বইয়ের বাজারচলতি সব গানই কানে আসত। তার বিভিন্ন সুর কোলাজ করে আমি নিজের মনেই ‘প্যাঁচা আর প্যাঁচানি’ গাইতাম। এই সময়ই পড়েছিলাম ‘কাকাবাবু হেরে গেলেন’। সেখানে কাকাবাবু সুর করে গাইছেন ‘শুনেছ কি বলে গেল সীতানাথ বন্দ্যো’। আমি নানা সুরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতাম ঠিক কীভাবে ওই কবিতাটা কাকাবাবু গেয়েছিলেন।        

পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় শুধু তো কবিতার গানের রূপই ছিল না। রপ্ত খিচুড়ি পাকানোর অভ্যাসও। সুকুমার রায় যদি হাঁসজারু পারেন, হাতিমি পারেন, আমি কেন পারব না! যদিও আমার জন্তুগুলো অতটা লাগসই হত না। তবুও আমাদের উঠোনে এসে শুয়ে থাকা পাড়ার কুকুরটা হয়ে গিয়েছিল কুকুমির। কারণ তার চোয়ালটা আমার মতে কুমিরের মতো লম্বা ছিল। বা উঁচু ক্লাসের এক দাদা, যে স্কুলের বারান্দা ধরে থপথপ করে হাঁটত, তার নাম হয়ে গিয়েছিল কুমড়োপটাশুভদীপ। এসব উদ্ভাবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছিল মারাত্মক। তবু কানে টান পড়া বা পিঠে গুম পড়ার ভয় কোনওকালেই আমাদের আবোল তাবোল চর্চার উৎসাহে কোনওকালেই ভাঁটা ফেলতে পারেনি।

ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না

আমাদের? হ্যাঁ, তখন তো আর আমি এক নই। আমার বয়সি আর সবাই, যারা আমার সঙ্গে বা এক ক্লাস ওপরে-নিচে পড়ে, আমরা সবাই-ই আবোল তাবোলের পড়ুয়া হয়ে উঠেছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন (সম্ভবত পূর্ব পশ্চিম-এ), ইচ্ছা করলে দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কথোপকথন রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন দিয়ে চালানো যায়। আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় না পড়েই তখন এই চেষ্টাটা আবোল তাবোলের লাইন দিয়ে করার চেষ্টা করতাম। কবাডি খেলার সময় প্রতিপক্ষকে অনায়াসেই বলা যায়, “ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না”। বা কেউ ত্যাঁদড়ামি করলে পেনসিল তাক করে ফুটোস্কোপ দিয়ে তার ঘিলু পরীক্ষা করার ঘোষণা করাটা খুব স্বাভাবিক ছিল। ভারত সেবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে গোহারা হারার পর মনে হতে লাগল, “মন বলে আর কেন সংসারে থাকি”। হাপুস নয়নে কাঁদার মাঝেও মাথায় আবোল তাবোলের লাইন পট করে এসেই যেত।

আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিলাম, কিন্ডারগার্টেন ছেড়ে ভর্তি হলাম আবাসিক এক স্কুলে। কিন্তু আবোল তাবোল ছেড়ে যায়নি কখনও। আগে আফিমের থানাদার কী, সেটা জানতে আগ্রহ হত। একটু উঁচু ক্লাসে উঠে জানতে আগ্রহ হত রাতকানা চাঁদের আসল মানেটা কী? বা শিশির ভেজা সদ্য ছায়াটা কেমন দেখতে হয়? বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আবোল তাবোল পড়ার ভঙ্গিটাও পালটে পালটে যাচ্ছিল। আরও একটু বড় হওয়ার পর হালকা গোঁফ দাড়ি নিয়ে আবোল তাবোল পড়া মানায় না বলে, সামনে ভারী ভারী কবিতার বই রেখে আড়ালে আবডালে আবোল তাবোল পড়তাম। যেমন করে পড়ার বইয়ের মলাট লাগিয়ে অনেকে গল্পের বই পড়ে। এখন আর কাগুজে আবোল তাবোল নিয়ে ঘোরা হয় না। কিন্ডল ভার্সানই ভরসা। তবু আবোল তাবোল পড়ায় ছেদ পড়েনি কখনও। ক্লান্ত দিনের শেষে মন ভালো করার এমন আশ্চর্য দাওয়াই খুব কমই আছে।   

সাধারণত ক্রম মেনে আমি কখনওই আবোল তাবোল পড়ি না। কিন্তু প্রায় প্রতিবারই আবোল তাবোল হাতে তুলে এ-পাতা ও-পাতা উলটে কিছু কবিতা পড়ার পর বইটা নামিয়ে রাখার আগে শেষ কবিতাটা পড়িই। শেষের আবোল তাবোল।

মেঘ মুলুকে ঝাপ‌্সা রাতে,
রামধনুকের আব্‌ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কন্ঠ পুরে।

রবিঠাকুর যে সেই ‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে’ দাঁড়ানোর আহ্বান করেছিলেন, তার সঠিক চিত্ররূপ যেন এই কবিতায় খুঁজে পাই। নশ্বর দেহ থেকে বেরিয়ে এসে এই পরিচিত বিশ্বের সীমানা অতিক্রম করে অসীম মহাবিশ্বের এক কোণে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। এই সৃষ্টির রং-রূপ-গন্ধ প্রাণ ভরে নিতে ইচ্ছে করে। আর মন খারাপ ঠিক সেখান থেকেই শুরু হয়। মনে হয়, এই চেনা জগত, এই প্রাণচঞ্চল দুনিয়ার বাইরে, আরও বাইরে চলে যাচ্ছি। আলোয় ঢাকা অন্ধকারের গন্ধে ঘণ্টা বাজছে — চোখ বুজে এটা কল্পনা করতে গিয়ে গায়ে কাঁটা দেয়। যখন ছোট ছিলাম, তখন পড়াশোনার গণ্ডি বিশেষ বড় ছিল না। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে। তবু এমন গাঢ় মৃত্যুচেতনা কটা কবিতায় চোখে পড়ল? বিশেষত শেষ দুটি পঙক্তিতে এসে চোখ ঝাপসা হয়েই যায়।

ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,
গানের পালা সাঙ্গ মোর।

এমন অমোঘ অথচ সহজ দুটো লাইনে এমন অসম্ভবের ছন্দে মাতানো কবিতাগ্রন্থ শেষ হচ্ছে। অবশ্য আবোল তাবোলের চরিত্রগুণের সঙ্গে এই অভিনবত্ব দারুণভাবে মিলে যায়।

শুরুতে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহের যে আবোল তাবোলের কথা বলেছিলাম, আনন্দ পাবলিশার্সের সেই সংস্করণটির শেষে সুকুমার রায়ের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী ছিল। সেখান থেকে জেনেছিলাম, কবির রোগশয্যার পাশে এসে বসেছিলেন রবি ঠাকুর। দুটি গান গেয়ে শুনিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি আমার ব্যক্তিগত চার্টবাস্টারে প্রতি মাসেই প্রথম তিনের মধ্যে থাকে। দিনযাপনের হাজার ক্লান্তির মধ্যে এই গানটি পরের দিন উঠে দাঁড়ানোর শক্তি দেয়। একটু তলিয়ে ভাবলে কীভাবে যেন আবোল তাবোলের সঙ্গেও গানটির একটা গভীর সম্পর্ক আছে।

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে॥

 


লেখক পরিচিতিঃ রোহণ কুদ্দুস একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। পেশাগত কাজের বাইরে কবিতা এবং গদ্য লেখেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। সৃষ্টিসুখ নামের একটা প্রকশনা সংস্থা এবং সৃষ্টি নামের একটি অনলাইন ম্যাগাজিন চালান।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।