সুকুমার রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, এপ্রিল ৩০, ২০১৬
সম্পাদকীয়
এবারে অবসর-এর বিশেষ সংখ্যার কেন্দ্রবিন্দু কে হবেন তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছুদিন ধরে আলোচনা চলেছিল – তিন রায় পুরুষের কোন পুরুষ? উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, না সত্যজিৎ? শেষে মধ্যম পুরুষই জয়ী হলেন।
ফলে আমরা সবাই-ই জয়ী হলাম। এই সুযোগে সুকুমার রায়ের লেখা গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, বিশেষ করে ছড়াগুলো আবার নতুন করে পড়া গেল। যদিও সুকুমার রায় বলতে আমাদের প্রথম মনে পড়ে আবোলতাবোল, হযবরল, পাগলাদাশু, কিন্তু ওঁর গল্প, নাটক, বিজ্ঞানবিষয়ক রচনার অনেকগুলিই যুগোত্তীর্ণ। বাংলায় ‘ননসেন্স’লেখার ক্ষেত্রে ওঁর জুড়ি নেই। সুকুমারের উদ্ভাবিত বহু শব্দ, লেখা বহু লাইন, মনের মধ্যে গেঁথেই ছিল, কিন্তু আরেকবার পড়েও আনন্দ কিছুমাত্র কম হল না। কী আছে এই ছড়ায় যে বারবার পড়েও ক্লান্তি আসে না? সুকুমার নিজে বলেছেন তাঁর ছড়া ‘খেয়াল রসে’ টইটুম্বুর, কারো কারো মতে হয়ত এ 'উদ্ভট রস'। রসের নাম যাই হোক না কেন, সে রস যে ঘোরতর নেশা জাগায় তাতে সন্দেহ নেই। আর সেই নেশায় মন নাচে "আজ্গুবি চাল্, বেঠিক বেতাল ... অসম্ভবের ছন্দেতে।"
তিনি ছাত্র ছিলেন পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন শাস্ত্রের। শিখেছিলেন ফটোগ্রাফি এবং প্রিন্টিং টেকনোলজি। তাঁর রচিত বেশ কিছু প্রবন্ধের মধ্যে এই শিক্ষার ছায়া প্রতিফলিত। এমন কি গল্প, নাটক, ছড়াতেও সেই বৈজ্ঞানিক মনটা মাঝেমধ্যে উঁকি দিয়ে যায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ‘আবোল তাবোল’ বা 'হযবরল' পড়ে মনে হয়, এইরকম উঁচুদরের বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তি প্রযুক্তির লোক হয়ে এত আজগুবি চিন্তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন কেন? এই কৌশল - প্রচলিত শব্দগুলো ভেঙ্গে গড়ে তাদের উল্টোপাল্টা সাজানোর এই অদ্ভুত বিদ্যে - আয়ত্ত করলেন কোত্থেকে? বিদ্ঘুটে সব জন্তু কল্পনা করে এবং তাদের ছবি এঁকে, কাগজের পাতায় তাদের মিছিল তৈরির ইচ্ছেই বা জাগলো কেন? ছোটদের জন্যে লিখবেন বলে?
মানছি, ছোটদের কাছে কল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে পার্থক্যের গণ্ডি খুবই নড়বড়ে। কিন্তু বড়দের তো তা নয়! নিশ্চয়ই কোন এক জাদু এই খামখেয়ালীপনার মধ্যে লুকিয়ে আছে, যা আমাদের মজিয়েছে, আর সেই রসে এখনও মজে আছি। সত্যিই এ আমাদের সৌভাগ্য যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নিগড়ে আটকে না থেকে এই অসামান্য প্রতিভাধর মানুষটি অযৌক্তিক জগতে বিচরণ করতে আরম্ভ করেছিলেন!
তবে এ ব্যাপারে তিনিই প্রথম নন। পূর্বসুরি 'অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড' এবং ' থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস'-এর লুইস ক্যারল ছিলেন ছিলেন গণিতের অধ্যাপক!
এর পাশাপাশি ছিল তাঁর সিরিয়াস রচনার জগত। বিজ্ঞান,ইতিহাস, পুরাণ নিয়ে নানা লেখালেখি। তাতেও বেশ বৈঠকি মেজাজ, তাই পড়তে চমৎকার লাগে। আর ছবি আঁকা? সেদিকটাই বা ভুলি কী করে? অথচ এই লেখাগুলো ভুলে সুকুমার বলতে অনেক শুধু শিশু সাহিত্যিকই বোঝেন।
সুকুমার রায় বেশীদিন লেখার সুযোগ পাননি। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের জন্যে রেখে গেছেন জীবনভোর শেখা ও উপভোগ করার অফুরন্ত সম্ভার। সেখান থেকেই কিছু কিছু তুলে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে আমাদের এই শ্রদ্ধার্ঘে। ছোট বড় মোট এগারোটি লেখা, কোনটাই ফরমায়েসী নয়। যাঁর যা মনে হয়েছে তাই নিয়ে লিখেছেন। লেখাগুলো সাজানোর ক্ষেত্রেও কোনও নিয়ম বাঁধা হয়নি। চেষ্টা করলে হয়ত একটু ভালো করে সাজানো যেত, কিন্তু তাহলে অবসরের এই সংখ্যা সুকুমারীয় হত না। ধরেই নিচ্ছি সুকুমার সংখ্যা পড়তে এসে সেই খেয়ালখুশি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবেন না!
সুকুমার স্মরণ সংখ্যা সকলের কাছে আনন্দময় হয়ে উঠুক।
“যে আনন্দ ফুলের বাসে,
যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়,
যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দ বাতাস বহে,
যে আনন্দ সাগরজলে,
যে আনন্দ ধুলির কণায়,
যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দ আকাশ ভরা ,
যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে,
যে আনন্দ রক্তধারায়
সে আনন্দ মধুর হয়ে
তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত
থাকুক তব জীবন ভরি।”
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।