সুকুমার রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, এপ্রিল ৩০, ২০১৬
সুকুমার রায়ের 'ননসেন্স'
শর্মিলা সেন
জি কে চেষ্টারটন বলেছিলেন "That divine lunacy that God has given to men as a holiday of the intellect." Nonsense literature এর এই মানে ননসেন্স সাহিত্যের সম্পূর্ণ রসকে প্রকাশ করতে পারে না। ননসেন্স সাহিত্য রসমধুর কিন্তু ঋজু কারণ সে সমাজের দর্পণ। দর্পণে নিজের চেহারা দেখতে ভয় পেলে চলবে না। নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা করতে গেলে সাহসও দরকার।
ননসেন্স বা absurd সাহিত্য রচনার নিয়ম অন্যান্য সাহিত্য রচনার নিয়মের মতই। ব্যতিক্রম হল এই সাহিত্য নিয়ম মেনেই বেনিয়ম করে। বোধহয় এই খাতিরেই শিশুসাহিত্য হিসেবে এর খ্যাতি। শিশুরা নিয়মে চলার দুনিয়াকে হঠাৎ বেনিয়মে চলতে দেখলে হাসি চাপতে পারে না। এই কারণে ননসেন্স সাহিত্যে শিশুদের এত আকর্ষণ।
কেউ কি জানে সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা
ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
(সুকুমার রায়)
বোম্বাগড় বলে একটা দেশ থাকতেই পারে। আর ছবি তো ফ্রেম বন্দীই হয়। এটাও খাঁটি কথা যে আমসত্বর স্বাদ আকর্ষণীয়, তবে সেই আমসত্ব ভেজে ফ্রেমবন্দী করাটা ভারী আজগুবি।
লুইস ক্যারল
|
ননসেন্স বা আজগুবি সাহিত্য ১৯ শতকের ভিক্টোরীয় আইনের বন্দী ইংরেজ সমাজের ফসল। বোধকরি আইনি ও সামাজিক বন্ধনের ফাঁসে জর্জরিত মানুষকে, বিশেষত শিশুদের, দমবন্ধ পরিবেশ থেকে একটু নির্মল আনন্দের খোলা হাওয়ায় এনে দেওয়ার সফল প্রচেষ্টা। অক্সফোর্ডের অধ্যাপক চার্লস লাটউইজ ডবসন (লুইস ক্যারল) তাঁর গণিতশাস্ত্রের শিক্ষা দিয়ে সৃষ্টি করলেন "Alice in Wonderland" (১৮৬৫) আর "Through the Looking Glass" (১৮৭২)। নিয়মের মধ্যে বেনিয়মের হল শুরু।
এর আগে ননসেন্স সাহিত্যের অভিভাবক ছিলেন নিসর্গ চিত্রকর এডওয়ার্ড লিয়র।
বাংলার নবজাগরণের সময়টাতে ব্রিটিশ প্রভাব নিয়ে শুরু হল কিশোর কিশোরী সাহিত্য। ঠিক ভিক্টোরীয় সমাজের মত বাঙালি সমাজ ভাবেনি যে শিশু ও তাদের শৈশব পূর্ণবয়স্কদের থেকে আলাদা, তাদের যে নিজস্ব কল্পনাশক্তি আছে, তাদের সম্পূর্ণ আলাদা প্রয়োজন থাকতে পারে। শৈশব থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হবার সময় ছিল সামান্য। নবজাগরণের পরবর্তীকাল চিনিয়ে দিল যে শৈশব দাবী করে আলাদা মনোযোগ, আলাদা সাহিত্য। বাংলার ননসেন্স এর সূত্রপাত, মাইকেল হেমান আর রাস্কিন বন্ডের ("Wordy Guardyboom") মতে, এইখানে। বাংলা ফোক সাহিত্য, ঘুমপাড়ানি গানের মত, ধর্মীয় সাহিত্য থেকে আলাদা।
সুকুমার রায় এলেন এইবার শৈশবের পরিত্রাতা হয়ে। নিয়ে এলেন মজার ছড়া, মজার ছবি। ঘটনাগুলোর মর্যাদা হয়ত প্রাপ্তবয়স্ক মহলে ভিন্ন ধরনের কিন্তু সুকুমার রায়ের হাতে বড়রাও শৈশবে পৌঁছল। একই জিনিষ ছোটদের দৃষ্টিপাতে হয়ে উঠল দমফাটানো হাসির।
শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে—
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে ?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে ?
জানতে চাও সে কেমন ছেলে ?
মন্দ নয় সে পাত্র ভালো
রঙ যদিও বেজায় কালো ;
তার উপরে মুখের গঠন
অনেকটা ঠিক পেঁচার মতন ;
বিদ্যে বুদ্ধি ? বলছি মশাই—
ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় !
উনিশটিবার ম্যাট্রিকে সে
ঘায়েল হয়ে থামল শেষে ।
বিষয় আশয় ? গরীব বেজায়—
কষ্টে–সৃষ্টে দিন চলে যায় ।
মানুষ তো নয় ভাইগুলো তার—
একটা পাগল একটা গোঁয়ার ;
আরেকটি সে তৈরী ছেলে,
জাল করে নোট গেছেন জেলে ।
কনিষ্ঠটি তবলা বাজায়
যাত্রাদলে পাঁচ টাকা পায় ।
গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে
পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে ।
কিন্তু তারা উচ্চ ঘর,
কংসরাজের বংশধর !
শ্যাম লাহিড়ী বনগ্রামের
কি যেন হয় গঙ্গারামের ।—
যহোক, এবার পাত্র পেলে,
এমন কি আর মন্দ ছেলে ?
'সৎপাত্র' (আবোল তাবোল)
ভারতীয় ননসেন্স লিখলেন সুকুমার রায় ভারতীয় / বাঙালি সূক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে, সসম্মানে। 'বুড়ীর বাড়ি'
গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি,

ঝুরঝুরে পড়ো ঘরে থুর্ থুরে বুড়ী৷
কাঁথাভরা ঝুলকালি, মাথাভরা ধুলো,
মিট্মিটে ঘোলা চোখ, পিট খানা কুলো৷
কাঁটা দিয়ে আঁটা ঘর—আঠা দিয়ে সেঁটে,
সূতো দিয়ে বেঁধে রাখে থুতু দিয়ে চেটে৷
ভর দিতে ভয় হয় ঘর বুঝি পড়ে,
খক্ খক্ কাশি দিলে ঠক্ ঠক্ নড়ে৷
ডাকে যদি ফিরিওয়ালা, হাঁকে যদি গাড়ী,
খসে পড়ে কড়িকাঠ ধসে পড়ে বাড়ী৷
বাঁকাচোরা ঘরদোর ফাঁকা ফাঁকা কত
, ঝাঁট দিলে ঝরে পড়ে কাঠকুটো যত৷
ছাদগুলো ঝুলে পড়ে বাদলায় ভিজে,
একা বুড়ী কাঠি গুঁজে ঠেকা দেয় নিজে৷
মেরামত দিনরাত কেরামত ভারি,
থুর্ থুরে বুড়ী তার ঝুর ঝুরে বাড়ী৷৷
'বুড়ীর বাড়ি' কবিতা দেখাল ভাঙা বাড়িতে থাকা এক বীর রমণী তার ভাঙা বাড়ি নিজের মত করে সারিয়ে, হার না মেনে চলেছেন।
কলেজে থাকাকালে সুকুমার রায় লিখেছিলেন "সাড়ে বত্রিশ ভাজা।' হাতে লেখা হাস্যরসের পত্রিকাতে আত্মপ্রকাশ করলেন। এরপর বিলেত থেকে ফিরে নিলেন "সন্দেশ" পত্রিকার দায়িত্ব।
আয়রে ভোলা খেয়াল‐খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে

নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন সুদূর।...
আয় ক্ষ্যাপা‐মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে—
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে॥
'আবোল তাবোল' (আবোল তাবোল)
অনুপ্রাস আর ছন্দের মেলবন্ধন ঘটিয়ে, নতুন নতুন শব্দের ঝংকার তুলে সুকুমার রায় বাংলার সাহিত্যের নতুন এক দিক খুলে দিলেন যা লীয়র আর ক্যারলের সমতুল্য। সুকুমার রায় এঁদের ভাবনা নিয়ে মেশালেন বাঙালীয়ানা। ওনার কবিতা হয়ে উঠল বাঙালীয়ানায় অনন্য।
লেখক পরিচিতিঃ সব সাহিত্য ভাল লাগে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।