প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সুকুমার রায় স্মরণে

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা, এপ্রিল ৩০, ২০১৬

 

তকাই, তাতাবাবু ও ‘অনর্থে’র ভুবন

শিবাংশু দে

 

কতোটা লেখা লিখলে তবে, লেখক বলা যায়
কতোটা কথা বললে তবে, কথক হবে মানা.......?

অনেক লিখে 'কালজয়ী' লেখক হবার প্রয়াস অবিরাম দেখা যায়। কখনও পেশা, কখনও নেশা, কখনও শুদ্ধ ভালোবাসা। লেখালিখি করার নানা কারণ থাকে। একজন অকালপ্রয়াত কবি, যাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিলো তাঁর মৃত্যুর পরে। হয়তো আরো কিছু লেখা আছে তাঁর। সে গুলো'ও পরবর্তীকালে কিংবদন্তি। কিন্তু যদি প্রথম কাব্যসংকলনটি ব্যতিরেকে তিনি আর অন্য কিছুই না লিখতেন, তবু এই বিপুল বাংলা সাহিত্যের পরিসরে একটা গুরুত্বপূর্ণ, বড়ো জমিদারি তাঁর অধিকারে থাকতে পারতো। তিনি সেকালে তাঁর শৈলীর সঙ্গে অপরিচিত, অনভ্যস্ত বাংলা পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,

".... বলবো যা মোর চিত্তে লাগে,
নাই বুঝি তার অর্থ হোক
নাই বা বুঝুক বেবাক লোক..."

'অর্থ' শব্দটার নানা অর্থ হয়। এমন কি 'অনর্থ' শব্দটিরও নানা পরিভাষা, বহু ব্যঞ্জনা। কোথাও লেখে এই শব্দের মানে, অমঙ্গল, অশুভ, অনিষ্ট, ভুল অর্থ, কুকাজ, দুর্ঘটনা। অন্যত্র কোথাও যোগ হয়, নিষ্প্রয়োজন, অনাবশ্যক, ব্যর্থ, অর্থহীন, যার 'অভিধ্যেয়' নেই। এইখানটিতে একটু মন দেওয়া যাক। 'অভিধ্যেয়' মানে চিন্তার বিষয়, যা ধ্যানের বিন্দু হতে পারে। অতএব 'অনর্থ' শব্দের একটা ব্যঞ্জনা পাচ্ছি, যেখানে 'চিন্তা'র পরিসর নেই। 'চিন্তা' মানে অনুভব ও মননের একটা ক্রমপর্যায় শৃঙ্খল। যেখানে এক জায়গা থেকে শুরু করে অন্য এক জায়গায় মানসিক অবস্থানটিকে তুলে নেওয়া যায়। অর্থাৎ শাস্ত্র মতে মানুষের সরলরৈখিক, স্বীকৃত, নিয়মবদ্ধ, ব্যাকরণভিত্তিক যে আর্ষ মননপদ্ধতি, তার বাইরে বেরোতে গেলেই 'অনর্থে'র ঝুঁকি এসে যায়।

বাংলাকবিতার জন্মলগ্ন থেকে, অর্থাৎ চর্যাপদে'র সময় থেকেই কবিদের 'অনর্থ' নামক ট্যাবু চিহ্নের দায় বহন করতে হয়। শুধু বাংলা কেন? সারা পৃথিবীতেই কবিদের সামনেই এই চ্যালেঞ্জটি প্রবল।কতোটা 'বুঝিয়ে' বলবো? কতোটা মৌন ইশারার রাজত্ব? 'সাহিত্য' কি বেবাক লোকের মৌরসিপট্টা? বেবাক লোক যা বুঝতে পারে তা কি সত্যি শিল্প হয়ে ওঠে ? বেবাক লোককে 'বোঝানো'র দায় শিল্পীর কতোটা থাকে ? অর্থাৎ সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য 'মানে বই' লিখে রাখাটি কি শিল্পীর দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে ?

এই চির জাগরূক পুরাতন প্রশ্নগুলির প্রাসঙ্গিকতা কখনও ফুরায় না। তাই একজন শিল্পী যখন তাঁর কবিতায় প্রায় এক শতক আগে এই প্রশ্নটি নথিবদ্ধ করেছিলেন, সাধারণ বাঙালি পাঠকের পক্ষে তা ছিলো একটু বেশি অগ্রসর, স্মার্ট একটি প্রশ্ন। এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা তাঁদের ছিলোনা। কিন্তু যখন এই কবি একটি মাত্র কাব্যগ্রন্থ লিখে বাংলা কবিতার সমাকীর্ণ জগতে চিরস্থায়ী স্থান করে নেন তখন ঘটনাটি খুব মামুলি থাকেনা। পরবর্তীকালে সেই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পঙক্তি বাংলাভাষায় ইডিয়ম হয়ে স্বীকৃত হয়ে যায় তখন তারও কোনও দ্বিতীয় নজির আমরা ইতিহাসে খুঁজে পাইনা। অতএব এটা ভাবা যেতে পারে, যে লেখা দিনের শেষে 'কবিতা' হয়ে ওঠে তার কোনও মানেবই প্রয়োজন হয়না। পাঠকই এগিয়ে এসে নিজেকে তৈরি করে নেয়।

আবোল তাবোলের বিজ্ঞপ্তি

হ্যাঁ, সেই কবিতা সংকলনটির নাম 'আবোলতাবোল' আর কবির নাম না হয় নাই বললাম।

সাহিত্য পাঠকের কি কোনও 'বয়স' থাকে? যেমন শিশু পাঠক, কিশোর পাঠক বা প্রাপ্তবয়স্ক পাঠক। এইধরনের মাত্রাভেদকে মাথায় রেখে কি কোনো শাশ্বত সাহিত্য সৃষ্টি করা যায়? বোধ হয় এর উত্তর হবে 'না' । যেকোনো 'প্রাপ্তবয়স্ক' পাঠক তথাকথিত কিশোর সাহিত্য থেকে যথেষ্ট মনের খোরাক পেয়ে যান। সাহিত্য পাঠকের শুধু 'মন' থাকে। অর্থাৎ সাহিত্য উপভোগ করতে হলে 'প্রাপ্তবয়স্ক' নয়, প্রাপ্তমনস্ক' হওয়া দরকার। বুদ্ধদেব বসু একবার বলেছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বড়োদের জন্য লিখলেও পড়ে আনন্দ পায় ছোটোরা। আবার সুকুমার ছোটোদের জন্য লিখলেও তা আনন্দ দেয় বড়োদের। এই 'বড়ো' বলতে যেসব লোকজন তাঁরা মনস্কতার সূত্রে বড়ো, বয়সের গুণিতকে হয়তো 'প্রাপ্তবয়স্ক' নাও হতে পারেন। অর্থাৎ মননশীলতার পরিণতির বিচারে সুকুমার ছিলেন বেশি পরিণত। তাঁর গুরু রবীন্দ্রনাথের মতো তাঁরও বিশ্বাস ছিলো, তিনি শিশু-বুড়ো সবারই সমবয়সী। আবোল-তাবোলের অনুরাগী পাঠকের বয়স আট থেকে অষ্ট আশি সবই হয়। তাই শরীরের মৃত্যুর তিরানব্বই বছর পরেও সুকুমার একজন প্রাসঙ্গিক 'আধুনিক' কবি, উষ্ণ, জীবন্ত ও অসম্ভব জনপ্রিয়।

শুধু 'আবোলতাবোল' নয়। আর একটি লেখার কথা স্মরণ করি, সেটি কিন্তু গদ্য। নাতিদীর্ঘ এই গদ্যটি ব্যতিরেকে যদি এই কবি আর কিছুই না লিখতেন, এমন কি 'আবোলতাবোল'ও যদি না থাকতো, তবু বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠসাহিত্যিকদের শীর্ষে কোথাও তাঁর স্বীকৃতি অমলিন থাকতে পারতো। সেই লেখাটি 'হযবরল'। তাতাবাবু এই লেখাটির একটি চরিত্র, হিজিবিজবিজ ওরফে তকাইয়ের মাধ্যমে তাঁর 'অনর্থ'যানকে রূপ দিতে চেয়েছেন। যার কাজ শুধু জগতের যাবতীয় 'অসঙ্গতি' দেখে হেসে যাওয়া। অথচ জাগতিক অসঙ্গতির সব অর্থকেই সেখানে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হচ্ছে। আপাতভাবে এই লেখা বালক-কিশোরদের জন্য। কিন্তু 'প্রাপ্তমনস্ক'রা যখন থেকে এই সব লেখার রস পেতে শুরু করেছেন, বাংলাসাহিত্যের রসগ্রাহিতার মানদণ্ডগুলো নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হতে শুরু হয়েছে ।

জন্মসূত্রে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অনুগামী। উনিশ শতকের শেষদিকে বেড়ে ওঠা ব্রাহ্ম আদর্শে 'নৈতিকতা'র বাড়াবাড়ি নিয়ে ঐ সমাজের অনেক মননশীল ব্যক্তি আশংকিত ছিলেন। সংখ্যাগুরু সনাতন ধর্মীয় জনগণের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে 'পবিত্রতর' বিকল্প মূল্যবোধ স্থাপন করতে চাওয়া ব্রাহ্মপণ্ডিতেরা প্রায়শ: অতিবাদী অবস্থান নিতেন। ফলশ্রুতি, ক্রমাগত দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধ ও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনাক্রম এই সংখ্যালঘু, কিন্তু প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীটিকে মূলস্রোত থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছিলো। নিজের মুদ্রাদোষে আলাদা হয়ে যাওয়ার দুর্ভাগ্য গ্রাস করে নিচ্ছিলো ব্রাহ্মসমাজকে। ততোদিনে তিনটি ভাগ হয়ে গেছে। আদি, সাধারণ ও নববিধান। বাংলার চিরাচরিত 'তৈলাধার পাত্র'পন্থী পাণ্ডিত্যগর্বী প্রবীণদের আধিপত্য থেকে ব্রাহ্মসমাজ'কে মুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ বিশেষভাবে সচেষ্ট ছিলেন। লেখালিখি ও অন্যান্য কার্যকলাপের সূত্রে এই অবস্থানটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তিনি অবিশ্রাম কাজ করে যেতেন। তাঁর এই প্রয়াসে তৎকালীন ব্রাহ্ম যুবসমাজের যে অংশ সক্রিয়ভাবে তাঁর সঙ্গে থাকতেন, সুকুমার ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। ব্রাহ্মসমাজের পণ্ডিতমন্যতার বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ও প্রায় বিদ্রোহ কবি'কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।

আদি ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য সুকুমার ও অমল হোমের মতো তরুণ ব্রাহ্মরা ১৯১১ সালের ২৬শে জানুয়ারি ( মাঘোৎসবের পরদিন) সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের উপাসনায় কবি'কে বেদীগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান। তৎকালীন পরিস্থিতিতে এটা যথেষ্ট দুঃসাহসিক বলা যেতে পারে। কারণ প্রবীণ, প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মরা কবি'র 'ধর্মপ্রচার' প্রবন্ধ বা 'নৌকাডুবি' এবং 'গোরা' উপন্যাসে ব্রাহ্মসমাজের সংকীর্ণতার যে ছবি আঁকা হয়েছিলো, তা নিয়ে বিশেষ ক্ষুব্ধ ও বিরূপ ছিলেন। এই সভায় কবি তাঁর 'ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা' শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করেন। সেই সভায় সমবেত ব্রাহ্মদের মধ্যে এই অনুষ্ঠানটির সার্থকতা বিশেষভাবে অনুভূত হয়। সুকুমার নিজেও তাঁর 'চলচ্চিত্তচঞ্চরী' নাটকে ব্রাহ্মসমাজের 'নৈতিক' অচলায়তনকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত করেন, গুরুর পথে, যা বহু ব্রাহ্ম প্রাচীনপন্থীর উষ্মার কারণ হয়েছিলো।

উপেন্দ্রকিশোর কবি'র রাজর্ষি উপন্যাসের দুটি চরিত্র, তাতা ও হাসি'র নামে তাঁর পুত্র সুকুমার ও কন্যা সুখলতার নামকরণ করেন। সুকুমার পরিজন মহলে 'তাতা' নামেই পরিচিত ছিলেন। ১৯১৩ সালের জুনমাসে কবি যখন লন্ডনে রোটেনস্টাইন সাহেবের বাড়িতে কবিতা শোনাতে গিয়েছিলেন, তখন সুকুমার লন্ডনেই থাকতেন। পিয়ারসন সাহেবের হ্যাম্পস্টেড হিথের বাড়িতে যখন কবি'কে নিয়ে একটি সভা আয়োজন করা হয়, তখন সুকুমার একটি প্রবন্ধপাঠ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি তাঁর বোন পুণ্যলতা চক্রবর্তীকে ২১শে জুন একটি চিঠি লেখেন, "..... পরশুদিন Mr. Pearson -তাঁর বাড়িতে আমার Bengali literature সম্বন্ধে একটা paper পড়ার নেমন্তন্ন। .....সেখানে গিয়ে (দেখি) Mr. & Mrs. Rothenstein, Dr.P.C.Ray, Mr. Sarbadhicary প্রভৃতি অনেক (পরিচিত) তা ছাড়া অনেক অচেনা সাহেব মেম সব উপস্থিত। শুধু তাই নয়, ঘরে ঢুকে দেখি রবিবাবু ব'সে রয়েছেন। বুঝতেই পারছিস আমার কি অবস্থা। যা হো'ক চোখকান বুজে প'ড়ে দিলাম। লেখাটার জন্য খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। India Office Library থেকে বইটই এনে material জোগাড় করতে হয়েছিল।তা' ছাড়া রবিবাবুর কয়েকটি poetry translate করেছিলাম। সেগুলো সকলেরই খুব ভালো লেগেছিলো।......... রবিবাবু আমাকে দেখেই বললেন, " এখানে এসে তোমার চেহারা improve করেছে।" এছাড়া ২১শে জুলাই ১৯১৩'তে সুকুমার লন্ডনের ইস্ট-ওয়েস্ট সোসাইটিতে Spirit of Rabindranath Tagore শীর্ষক প্রবন্ধটিও পাঠ করেন। এই আলোচনাটিই বিদেশে রবীন্দ্রনাথের রচনা সম্বন্ধে প্রথম সামগ্রিক মূল্যায়ন। সুকুমার এ বিষয়ে পথিকৃৎ। এই সব ঘটনাক্রম প্রমাণ করে তিনি বস্তুত একজন সিরিয়াস, মননশীল যুবক। সেকালের নামী পরিবারের ব্রাহ্ম যুবকরা যেমন হতেন। তাঁরা জাগতিক, মহাজাগতিক সব কিছুর অর্থ সন্ধান করতে সতত নিয়োজিত থাকতেন। তৎকালীন বাংলা ইন্টেলেনজেন্সিয়ার ('বুদ্ধিজীবী' শব্দটি গালাগালির পর্যায়ে চলে যেতে আর ব্যবহার করিনা) যাঁরা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন, সুকুমার তাঁদের অগ্রগণ্য। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিনি ছিলেন 'সৃষ্টিছাড়া'। এই সব কাজের মধ্যে থেকেই তাঁর ভিতরে জন্ম নিচ্ছিলো আবোলতাবোল বা হযবরলের বীজ। 'অনর্থ'শিল্পের অঙ্কুর।

১৯১৮-১৯ সাল নাগাদ তাঁর স্মৃতি খুড়তুতো বোন লীলা মজুমদারের স্মৃতিকথায় পরবর্তীকালে এই ভাবে এসেছিলো।

'... বড়দা যেখানেই যেতো একটা আনন্দের তুফান সঙ্গে সঙ্গে যেতো। বড়দা যেখানে থাকতো, অন্য কারো দিকে লোকের চোখ পড়তো না। তাই বলে বড়দার কিছু কার্তিকের মতো চেহারা ছিলোনা। তবে চেহারার মধ্যে কী একটা যেন ছিলো যার সঙ্গে মুখায়ববের কোনো সম্পর্ক ছিলোনা, কিন্তু যা তার সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মতো ঝরে পড়তো। এখন বুঝি সেটি তার ব্যক্তিত্ব।

লম্বা দোহারা মানুষটি, একমাথা কালো কোঁকড়া চুল, চোখ দুটি প্রায় সব সময় হাসতো, কিন্তু গম্ভীর হলে এমনি গম্ভীর হতো যে কাছে ঘেঁষতে ভয় পেতাম। বড়দা ছিলো যেমন আমুদে, তেমনি রাশভারী, অন্যায় সে কখনো সইতো না। যতদূর মনে পড়ছে, বড়দার গালে একটা বড়ো তিল ছিলো, আমাদের সেটিকে ভারি পছন্দ ছিলো। '

 

তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে লঘুরস ও গুরুপ্রত্যয়ের মেরু কখনও অচল অবস্থানে থাকতো না। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বভাবের এই দুই প্রান্তে আসাযাওয়া করতেন। ব্যক্তিজীবন বা সৃষ্টিজীবনে, সমান মসৃণতায়। লীলা মজুমদারের মতো অনেকেই যেমন বলেছেন, সুকুমার যেখানে যেতেন একটা প্রসন্নতার আবহ তৈরি হয়ে যেতো। জীবনের সর্বক্ষেত্রে রসবোধ প্রয়োগের যে কৌশল তাঁর আয়ত্ত ছিলো, তা বিরল। একটা গল্প আমরা শুনেছি যখন কবির সাতান্নতম জন্মদিন শান্তিনিকেতনে আয়োজন করা হয়েছিলো। কালিদাস নাগের বর্ণনায় পাই এই উপলক্ষে সস্ত্রীক রথীন্দ্রনাথ, সস্ত্রীক সুকুমার, সপরিবার রামানন্দ, কালিদাস নাগ, সবাই হৈ হৈ করে রেলগাড়িতে শান্তিনিকেতন যাত্রা করলেন। "....বিকেলে পৌঁছে দেখি, কবি দিনুবাবুর ঘরে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন- সকলকে খুব খাওয়ালেন, তারপর সন্ধ্যায় আশ্রমের ছেলেরা এক বাঙ্গাল সভা করলে-নানা প্রদেশের চলতি ভাষায় ঠাট্টা, বিদ্রূপ, গান চললো- চমৎকার হলো-সুকুমার মৈমনসিংহের বাঙ্গাল-সভাপতি হলেন।" (কালিদাস নাগ)। এই 'বাঙাল-সভা' অনুষ্ঠানটির আরেকটি বিশদ বর্ণনা আমরা সীতাদেবীর রচনাতেও পাই।

"....খোলা মাঠেই সভা হইতেছিল। মেয়েরা ও মান্যগণ্য অতিথিবর্গ তক্তপোষে বসিলেন, ছেলেরা মাটিতে শতরঞ্চি বিছাইয়া। সর্বসম্মতিক্রমে সুকুমারবাবু সভাপতি নির্বাচিত হইলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাব করিলেন যে সুকুমারবাবুর পত্নী শ্রীমতী সুপ্রভাকেই সভানেত্রী করা হোক, কারণ আজন্ম কলিকাতায় বাস বলিয়া সুকুমারবাবুর বাঙালত্ব খানিকটা লোপ পাইয়াছে। কিন্তু সুপ্রভা রাজী না হওয়াতে সুকুমারবাবুই সভাপতির পদে বাহাল রহিলেন। ...সভার কার্য যথাসম্ভব বাঙালভাষাতেই হইতেছিল। .... অতঃপর সভাপতি তাঁহার অভিভাষণ দিলেন অতি কষ্টে। বেশ পুরাপুরি বাঙাল ভাষা হইলো না।"

এর পরের দিন চব্বিশে বৈশাখ,

" সভাস্থ সকলের অনুরোধে সুকুমারবাবু তাঁহার 'শব্দকল্পদ্রুম' কৌতুকনাট্যটি পাঠ করিলেন। ইহার গানগুলিও হইলো বটে, তবে তাঁহার দলের লোকেরা এখানে কিঞ্চিৎ সলজ্জভাবে গান গাহিলেন।"

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় সুশোভন সরকারের স্মৃতিচারণ। 'লক্ষ্মণের শক্তিশেল' নাটকে তাতাবাবু'র হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে " রাবণ রাজায় মারো, রাবণরাজায় মারো" স্ফূর্তির রসে উজ্জ্বল গান তাঁর মনে থেকে গিয়েছিলো আজীবন।

ঔপনিবেশিক চিন্তায় লালিত বাঙালির একটা অভ্যেস আছে। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে কোনও বাঙালির সার্থকতা বা সফলতাকে বিদেশি নাম দিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা তার প্রিয় ব্যসন। যেমন বাংলার মিল্টন মধু, বাংলার স্কট বঙ্কিম, বাংলার শেলী রবি, বাংলার এলিয়ট জীবনানন্দ এবং বাংলার লীয়র বা ক্যারল সুকুমার। এতো স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বীকৃত প্রয়াসে এই সব খেতাব দেওয়া হয়ে থাকে, যে তেমন তৎপর পাঠক না হলে এইসব ছাঁচ নীরবে ও নিশ্চিতভাবে মনের মধ্যে গৃহীত হয়ে যায়। এই আলোচনায় অন্যদের কথা বাদ দিচ্ছি। সুকুমারের ক্ষেত্রে এই ধরনের 'নামাঙ্কণ' নিতান্ত বাতুলতা। আমরা সাহেবশাসনে না থাকলে এক্ষেত্রে সুকুমারই দৃষ্টান্ত হতেন। অন্যের নামে তাঁকে চিহ্নিত করতে হতোনা।

এই 'অনর্থশিল্প' সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ এর আগে বেশ মনোযোগ দিয়েছিলেন। একবার অবনীন্দ্রনাথের একটি লেখা পড়ে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, যে এইধরনের 'বিশুদ্ধ পাগলামির কারুশিল্প' অবন ঠাকুরের পক্ষেই সম্ভব। 'দুয়ে দুয়ে চার ' এই যুক্তিধারার বাইরে 'যুক্তিহীন রসবোধের' সমান্তরাল ধারা পৃথিবীর প্রায় সাহিত্যেই দেখা যায়। পণ্ডিতদের মতে 'স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত যুক্তি পরম্পরা'র বাইরে মতপ্রকাশ করা 'পাগলামি'র প্রথম লক্ষণ। কিন্তু ইতিহাস বলছে, তথাকথিত মানসিকভাবে 'স্বাভাবিক' মানুষদেরও মধ্যেও সতত এইসব 'অস্বাভাবিক' রসানুভূতি ও রসগ্রাহিতা সর্বকালেই দেখা যায়। আমাদের শাস্ত্রে একেই 'উদ্ভট রস' এবং পশ্চিমে একে 'ননসেন্স' বলা হয়ে থাকে। আপাতভাবে এইধরনের লেখায় মনে হতে পারে বল্গাহীন কল্পনার ঘোড়া বাস্তবের সব বন্ধনকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলছে। কিন্তু এই 'ছিন্নভিন্ন' করার যে 'কারুশিল্প' তার মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন কিন্তু প্রভাবশীল সৃজনশীল সিস্টেম কাজ করে চলেছে। তার নির্দিষ্ট বিন্যাস আছে, নিশ্চিত ছক আছে, আর আছে সূক্ষ্ম শিল্পবোধ। রবীন্দ্রনাথ তা বুঝেই এর নাম দিয়েছিলেন 'বিশুদ্ধ পাগলামির কারুশিল্প'।

এ প্রসঙ্গে আবার সুকুমারের ' হযবরল' আসবে। এই লেখাটির প্রতিটি শব্দ পরবর্তীকালে প্রবাদ হয়ে গেছে। অবনীন্দ্রনাথ বা ত্রৈলোক্যনাথের কথা মনে রেখেও বলা যায়, এই লেখাটির স্তরের সূক্ষ্ম উদ্ভট রস বাংলাভাষায় এর আগে ছিলোনা এবং পরেও বিরল। এই লেখা লীয়র বা ক্যারলকে নকল করে লেখা দূরস্থান, ভাবাও যায়না। একথা সত্যি, যে যখন সুকুমার লিখতে শুরু করেন, তখন লীয়র ও ক্যারলের মুখ্য লেখাগুলি অনায়াসলব্ধ ছিলো এবং তিনি হয়তো তার সঙ্গে পরিচিতও ছিলেন। কিন্তু যাঁরা এই দুই লেখকের রচনারীতির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা দেখবেন, সুকুমারের লেখায় Nonsense ও Farce যেভাবে ওতপ্রোতভাবে পারদর্শিতার সঙ্গে বোনা থাকে, লীয়র বা ক্যারলের মধ্যে সেই ধার আমরা দেখতে পাইনা।

এর আগে আমি উল্লেখ করেছি অভিধ্যেয় শিল্পের পরিসর সনাতন ভারতীয় নন্দনতত্ত্বের বিচারে তেমন আদৃত ছিলোনা। কিন্তু তা বলে এ নিয়ে যে চর্চা হয়নি, তা নয়। কারণ ব্রাহ্মণ্য সেরিব্রাল চর্চার সমান্তরাল স্রোত আমাদের দেশে চিরকালই আছে। সংস্কৃত রসশাস্ত্রে 'উদ্ভট' নামে একটি রসের উল্লেখ পাওয়া যায়। আমাদের দেশে উদ্ভট রসের যে চর্চা ছিলো তার কিছু নিদর্শন কবিরত্ন পূর্ণচন্দ্র দে কাব্যরত্ন, উদ্ভটসাগরের সঙ্কলিত ' উদ্ভট শ্লোকমালা' নামের ১৯০৪ সালে প্রকাশিত বইটিতে পাওয়া যায়। হরিচরণের অভিধানে 'উদ্ভট' শব্দের অর্থ আছে, মহাশয়, মহাত্মা, উদার, দুর্মদ, দুর্ধর্ষ, শ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্ট, অদ্ভুত, অসম্ভব, বিস্ময়কর, উৎকট, অতিপ্রবল। শব্দসূত্র হচ্ছে উদ্ভূত- উদ্ভট। অর্থাৎ 'ঊর্ধ্বে ধৃত'। তবে আমার মনে হয় 'গ্রন্থবহির্ভূত লোকপ্রসিদ্ধ অজ্ঞাত কবিকর্তৃক শ্লোক' , এই পরিভাষাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রন্থবহির্ভূত ও অজ্ঞাত কবি যখন লোকপ্রসিদ্ধ হয়ে ওঠেন, তখন তার পিছনে ইতরযানী সাহিত্যচর্চার একটি সূত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সব কবিরা ডকুমেন্টেড ও এলিট সমাজের গ্রন্থিত সাহিত্যচর্চার বাইরের লোক, কিন্তু নিজগুণে লোকপ্রসিদ্ধ হয়ে উঠতে পেরেছেন। স্থান করে নিতে পেরেছেন ব্রাহ্মণ্য রীতি নিয়ন্ত্রিত শব্দসাধনার মূলস্রোতে। তাঁদের চিন্তায় বা প্রকাশভঙ্গিতে পাথুরে 'যুক্তিবোধ'এর ( যা সচরাচর এলিট নিয়ন্ত্রিত) উপরে গিয়ে নির্বাধ কল্পনার আধারে নিজস্ব বোধ বা অভিজ্ঞতাকে নথিবদ্ধ করার যে প্রয়াস, তাকেই অর্থ সম্প্রসারিত করে 'উদ্ভট' শব্দের মধ্যে ধরা হয়েছে। আমাদের লোকসাহিত্যে এর ভূরিভূরি প্রমাণ আমরা পাই।

এতো কথা বলার উদ্দেশ্য, আমি সুকুমারের রচনার নির্মাণ প্রণালীর প্রতি অনেকের যে ধারণা, তা নেহাৎ শিশু বা কিশোরপাঠ্য, তার নিরসন করতে চাইছি। 'বড়ো'দের জন্য লেখা মানে সেখানে পাথরপ্রতিম যুক্তিবন্ধন করতে হবে, মেঘ ও হাওয়ার নির্বাধ গতায়াত শুধু অবোধ বালকদের মনোরঞ্জনের জন্যই প্রযোজ্য, এই যুক্তি আমাদের দেশীয় মৃত্তিকাজাত সাহিত্যসাধনার সঙ্গে অনেক সময়ই মেলেনা। এই বোধ সুকুমারের হয়েছিলো এবং এই কথাই বুদ্ধদেব বসু বলতে চেয়েছেন সুকুমারের মননশক্তির সার্থকতা প্রসঙ্গে।

বাঙালি শিশুর বই দেখে কবিতার সঙ্গে পরিচয় সম্ভবত সুকুমার থেকেই শুরু হয়। অন্তত আমাদের সময় তাই হতো। সেই সময় আবৃত্তি প্রতিযোগিতা নামে একটি ব্যাপার ছিলো, যেখানে নানা বয়সের বাঙালি শিশু-বালক-কিশোরেরা বাংলা কবিতা মুখস্থ করে প্রায়শই প্রথম স্টেজ ও মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে শিখতো। পড়ার বইয়ের বাইরে, যেখানে "পাখি সব করে রব" বা "নাই কিরে সুখ" অথবা খুব বেশি হলে "আমাদের ছোটো নদী" জাতীয় কবিতাই পড়ানো হতো, স্বাধীনভাবে বাংলা কবিতার প্রথম স্বাদ সুকুমারের লেখা থেকেই পাওয়া যেতো। আমার মনে আছে প্রথম স্টেজে চড়া, প্রথম মাইক্রোফোনের সামনে, চার-সাড়ে চার বছর বয়সে শুরু হয়েছিলো, 'নমস্কার, কবি সুকুমার রায়ের সৎপাত্র...' এই উচ্চারণ থেকে। রবিকবি ব্যতীত অপর কবি হিসেবে শিশু বালকদের কাছে সুকুমারই ছিলেন অবশ্য বিকল্প। আমার মতো হয়তো কোটী বাঙালি আছেন, যাঁরা শুরু করেছিলেন, 'শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে...'। আমার পিতৃদেব আবোলতাবোল শেখানোর জন্য একটি অভিনব ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ওখান থেকে কোন একটা লাইন, যেমন হয়তো বলে উঠলেন, 'টাকের পরে পণ্ডিতেরা ডাকের টিকিট মারে' বা ' গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা' অথবা 'কিন্তু সবার চাইতে ভালো' কোন কবিতায় আছে। বলতে পারলে 'দশ নয়া' । ওফফ... সাত রাজার ধন যেন... সাত আট বছরের বয়সের মধ্যে পুরো আবোলতাবোল কণ্ঠস্থ। আমার মনে হয় মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে বহুকাল থেকেই সঞ্চয়িতা না থাকলেও এক কপি আবোল তাবোল থাকতো, মনে হয় এখনও থাকে (তবে পরবর্তী কালে ঐ আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় জজিয়তি করতে গিয়ে দেখেছি কবিতাগুলি বাবা-মায়েরা বহুক্ষেত্রেই রোমান হরফে লিখে দেন)। সুকুমারের কবিতা প্রতিষ্ঠান হতে শুরু করেছে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে থেকেই।

আবোলতাবোলের ডামি যখন তৈরি হচ্ছিলো তখন রোগশয্যা থেকে সুকুমার একটা ছোট্টো ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। সেখানে লেখা হয়েছিলো,

'যাহা কিছু আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই।'

যদিও আবোলতাবোল তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি, কিন্তু তিনি নিছক খেয়াল রসের কারবারি ছিলেন না। এই খেয়াল রস বা ননসেন্স তাঁর রচনার অন্যতম লক্ষণ, সম্পূর্ণ চরিত্র নয়। যেখানে তিনি লীয়র-ক্যারল যুগলের সৃষ্টির মাত্রা থেকে আলাদা হয়ে যান। তাঁর মাত্র সতেরো-আঠেরো বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি তৎকালীন বঙ্গসমাজের যে ব্যাপারগুলিকে অসঙ্গত বোধ করেছিলেন, সেগুলিকে নিয়ে নাট্যাকারে বাংলাসাহিত্যে কিছু চিরস্থায়ী সংযোজন করে গেছেন। করে গেছেন বালকদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষা, নীতিশিক্ষা ও নানা বিবিধ বিষয়ে সহজপাঠের আয়োজন। তাঁর মানসিক গঠনের মধ্যে য়ুরোপীয় স্মার্টনেস ছিলো, যা তাঁর রচনা থেকে আমরা বারবার দেখতে পাই। অবশ্য এই গুণটি তাঁর পরিবারের অনেক সদস্যের মধ্যেই পাওয়া যায়।

তাঁর নাটকগুলির তথ্যপ্রসঙ্গ সমকালীন হলেও তার সৃজনশীলতার বিস্তৃতি ছিলো চিরকালীন। আমাদের ভুয়ো গুরুবাদী চিন্তার অসারতা নিয়ে 'শব্দকল্পদ্রুম', যেখানে হয়তো তাঁকে প্রাণিত করেছিলেন তাঁর 'গুরু' 'হাস্যকৌতুকে'র শারাড জাতীয় রচনাগুলির মাধ্যমে। আবার সেই সময়ের সামন্তবাদী ও ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থাকে কটাক্ষ করে 'ঝালাপালা'। বিদেশি শাসকের অবিচারের বিরুদ্ধে নির্বিষ নির্দন্ত রাজনৈতিক প্রতিবাদ আয়োজনের ছায়া দেখতে পাই 'লক্ষ্মণের শক্তিশেল' নাটকে। ব্রাহ্মসমাজের এক অংশের বদ্ধ রক্ষণশীল চিন্তার প্রতিবাদে 'চলচ্চিত্তচঞ্চরী'। আবার মধ্যবিত্তের সাজিয়ে তোলা চিন্তার জগতে নিছক কমন সেন্সের অভাব নিয়ে 'অবাক জলপান'। গল্প লিখতে গিয়ে তিনি যে মডেলটি অনুসরণ করেছিলেন, তাঁর আগে সেরকম কিছু বাংলা গল্পে আমরা পাইনি। 'পাগলা দাশু' , 'হযবরল', বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ পর্যায়। সুকুমারের পরে অসংখ্য সিদ্ধহস্ত বাংলা কবিলেখকেরা এই ধরণের লেখায় মেধানিয়োগ করেছেন। কিন্তু কেউই তাঁর স্তরটির কাছাকাছি যেতে পারেননি। তাঁর এইসব রচনা শতবার পড়া, দেখা, কিন্তু এখনও একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত পড়ে যেতে হয়। মূলত হিউমারিস্ট হলেও ধারালো উইটের যোগান তাঁর রচনার মধ্যে বার বার চোখে পড়ে।

কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বিবাহ উপলক্ষ্যে কবি এসেছিলেন নবপরিণীতা বধূকে আশীর্বাদ জানাতে। তার পর সেখান থেকেই সীতাদেবীর স্মৃতিচারণ অনুযায়ী, "..... 'মুক্তধারা' নাটকটি বাবা'কে দিয়া গেলেন 'প্রবাসী'তে ছাপিবার জন্য...... সুকুমারবাবু তখন অত্যন্ত পীড়িত, খানিক পরে কবি তাঁহাকে দেখিতে চলিয়া গেলেন।"

' তার পর বড়দা অসুখে পড়লেন। শুনলাম রোগটার নাম কালাজ্বর, তার তখন কোনো ভালো চিকিৎসা ছিলোনা। চোখের সামনে একটু একটু করে বড়দার শরীর ভাঙ্গতে লাগলো। অমন দশাসই চেহারার আর কিছুই রইলো না। তার আগের বছরেই বিবাহের নয় বছর পরে, বড়ো বৌঠানের সুন্দর একটা ছেলে হয়েছিলো, ঘটা করে তার নামকরণ হয়েছিলো, আত্মীয়স্বজন খুব ভোজ খেয়েছিলো। ছেলের নাম সত্যজিৎ, ডাকনাম মানিক।' (লীলা মজুমদার)

যখন তিনি সৃষ্টিশীলতার চড়াই ক্রমশ অতিক্রম করছিলেন, সেই সময়ই যতি চিহ্ন আঁকা হয়ে যায়। অল্প বয়স থেকেই আলোকচিত্রশিল্পে তাঁর দক্ষতা ছিলো। সতেরো বছর বয়সে ইংল্যান্ডের Boys Own Paper পত্রিকার ফোটোগ্রাফি প্রতিযোগিতায় তাঁর তোলা ছবি পুরস্কৃত হয়েছিলো। ঊনিশ বছর বয়সে তোলা রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতিকৃতি সারাদেশে বিশেষ সমাদৃত হয়েছিলো। ফোটোগ্রাফি নিয়ে বাংলায় সম্ভবত প্রথম প্রবন্ধ তাঁরই লেখা ১৯১১ সালে প্রবাসী পত্রিকায়। পরে তো এই বিদ্যাটিকে পেশাদারি স্তরে উন্নীত করেছিলেন। ইলাস্ট্রেটর হিসেবে তিনি সেই সময় দেশের একজন অগ্রগণ্য শিল্পী ছিলেন। নিজের রচনা তো বটেই, সন্দেশের নানা লেখার সঙ্গে তাঁর আঁকা ছবিগুলি পত্রিকার সম্পদ ছিলো। আবোলতাবোলের নজিরবিহীন অলঙ্করণ তাঁর রোগশয্যায় করা।

'অনেকদিন ভুগলেন বড়দা। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স, কতো ইচ্ছা, কতো আশা। বড়দার প্রথম বই আবোল-তাবোল প্রেসের জন্য তৈরি হচ্ছে। তার ছবি আঁকা হচ্ছে বিছানায় শুয়ে বালিশে ঠেস দিয়ে। ছোটো মানিক তার মধ্যে হামা দিতে শিখলো, হাঁটা শিখলো। তার এক বছর বয়স হলো, জন্মদিনে ছোটোখাটো উৎসব হলো।... কিন্তু সবাই জানতো ও বাড়ির সূর্য অস্ত যাচ্ছে। ' (তদেব)

১৯২৩ সালে তিনি শয্যাগত হয়ে পড়েন। তবে তার মধ্যে আবোলতাবোলের মলাট আঁকছেন, ডামি সাজাচ্ছেন, লিখছেন 'ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর'। ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী এসে ভক্তিগীতি শুনিয়ে যেতেন তাঁকে। ২৯শে অগস্ট তাঁর গুরু তাঁকে দেখতে যান ১০০, গড়পার রোডের বাড়িতে। তাঁর শিষ্য, ভক্ত, বন্ধু সুকুমারকে, রবীন্দ্রনাথ শোনালেন নয়খানি গান। ১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩ সাল, প্রদীপটি নিভে গেলো।

'২৩ সালে মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে বড়দা তাঁর সাজানো সংসার ছেড়ে চলে গেলেন। মনে পড়ে মা আমাদের স্কুল থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। গড়পার রোডের সেই চেনা বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। বড়দার ঘরে কোনো শব্দ নেই। বড়দা চোখ বুজে খাটে শুয়ে আছেন, আর বড়ো বৌঠান দু হাত জোড় করে চোখ বুজে পাশে বসে আছেন, বোজা চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে স্রোতের মতো জল পড়ছে। বড়দার মা, আমার বিধবা জ্যাঠাইমা, যিনি আমার মাকে মানুষ করে ছিলেন, বড়দার খাটের অন্যপাশে মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছেন। জীবনে এই প্রথম ব্যক্তিগত শোকের আঘাত বুঝলাম। এর আগ অবধি মৃত্যুও ছিলো শোনা কথা, ছবি দেখার মতো, তার যে কতো ব্যথা এবার বুঝতে পারলাম।'

( আর কোনো খানেঃ লীলা মজুমদার)


আদিম রাতের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম
ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর....


লেখক পরিচিতিঃ শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।