রবীন্দ্রনাথ যে এই দুর্দিনেও দারুণ ভাবে জীবিত আছেন সেটা তাঁর গানের দৌলতে। ভাগ্যিস বঙ্কিমচন্দ্রের অন্তত: এক পিস গান পাকে চক্রে একটা দেশজোড়া ফেনোমেনন হয়ে গেছলো , তাই বাঙ্গালির কাছে এখনো তিনি কল্কে পেয়ে থাকেন।আর শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বেঁচে গেলেন তার গল্পের সিনেমায় জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণে। নইলে বাঙ্গালির বিস্মৃতিশক্তির প্রবলতা তো সর্বজনবিদিত।রবীন্দ্রনাথের অগ্রপথিক ঈশ্বর গুপ্ত, প্যারিচাঁদ মিত্র, দীনবন্ধু মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, অক্ষয় চন্দ্র বড়াল , নবীন চন্দ্র সেন এঁদের সবাইকে বাঙালি সযত্নে কিছু পুরনো লাইব্রেরির আধো আলো আধো অন্ধকার আলমারিতে নির্বাসিত করে রেখে পবিত্র কর্তব্য পালন সেরে রেখেছে। তার কারণ তাঁদের তেমন বিশেষ কোনো গান নেই যা বাঙালি এই সময়েও গেয়ে যেতে পারে।
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পঁচিশ বছরের ছোটো সুকুমার রায় , কিছু ব্রাহ্ম সঙ্গীত আর কিছু নাটকের জন্যে তৈরি করা গান ছাড়া আর তেমন কোনো গান রেখে যাননি। সে গান গুলি এমনিতে বাঙ্গালি নাড়া চাড়া করে না। তবুও আজও তিনি যে ভীষণ ভাবে জীবিত আছেন , বাঙ্গালির কাছে , তার কারণ গুলো একটু খুঁজে দেখা যাক। যে সব মনীষীদের বাঙালি প্রাতঃস্মরণীয় তালিকাতে ফেলেছে , সুকুমার রায় কে তারা তার বাইরেই রাখে। অন্য সব বিখ্যাতদের মত এই শহরের অলিগলি-চলিরামে তাঁর মর্মর মূর্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিতে বাঙ্গালিকে বিশেষ দেখা যায় না। শুনেছি এই বছর চারেক আগে গড়পাড়ের রায়পরিবারের সেই বিখ্যাত বাড়িটিতে তাঁর পিতা এবং পুত্রের দুই খানি আবক্ষ মূর্তির মাঝখানে তিনিও স্থান পেয়েছেন। এ শহরে কোনো বড় রাস্তা ঘাট তাঁর নামে , মানে সরণী অথবা ধরণী, আছে বলে শুনিনি। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কিছু কিছু ‘সাহিত্যিক’ দের ছবিতে কোনো কোনো ক্লাবে বা সভাঘর বছরে একবার গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে জন্মদিন-উদযাপন করে। সুকুমার রায়ের ভাগ্যে সে রকম সম্মান জোটে বলে শোনা যায় না। কিন্তু তবুও আমবাঙ্গালির কাছে সুকুমার রায় ভীষণ জীবন্ত, এবং তিন চারটে প্রজন্ম পার করে দিয়েও তিনি যে বাঙ্গালির জীবনে বেশ ভালো রকম জড়িয়ে মড়িয়ে রয়ে গেছেন।
আসলে তিনি বাংলা-সংস্কৃতির গভীরে, তার চেয়ে বলা ভালো বাঙ্গালির মনোলোকের অন্তঃপুরে, এমন কিছু অসম্ভব রকমের খাপছাড়া, ছন্নছাড়া, উদ্ভট অথচ জ্যান্ত কিছু চরিত্রকে ছেড়ে দিয়ে গেছেন যারা চিরকাল দাপিয়ে কাঁপিয়ে মাতিয়ে ঘুরে বেড়ায় , আর তাদের বয়স হযবরল আড়াই ফুটিয়া বুড়োটির হিসেব করার কায়দায় কিছুদিন ধরে বাড়ে তার পর আবার কমতে থাকে। তাদের ভুলে যাবে বাঙ্গালির এমন সাধ্য কি ?
যেমন কোলকাতায় একটা শহীদ মিনার আছে, একটা পাঁচমাথার মোড় আছে , একটা গোলদিঘি আছে , তেমনি ক্লাইভ রো বা ম্যাঙ্গো লেনে কোথাও একটা হারুদের আফিসও ঠিক আছে। আর সেখানে গেলেই আমরা যখন খুশি দেখে আসতে পারি ট্যাঁশগরু কে। ট্যাঁশগরুর স্রষ্টা লিখেছিলেন বটে ‘বর্ণিতে রূপ গুণ সাধ্য কি কবিতার’। কিন্তু কবিতায় মাত্র ছ লাইনে যা একখানা চৌকস বর্ণনা দিয়েছেন তাতে করে এমনিতেই ট্যাঁশ গরুর চেহারাটা আমাদের কাছে জেবরা কিম্বা জিরাফের চেয়েও বেশি চেনা হয়ে গেছে। তার উপরে একখানা ছবি নিজেই এঁকে দিয়ে ট্যাঁশ গরুকে আমাদের কাছে একেবারে চিরকালের জন্যে জ্যান্ত করে দিয়েছেন। আমার মনে হয় স্পিলবার্গ সাহেবকে কেও যদি বাংলা ভাষাটা শিখিয়ে দিতে পারতেন তাহলে তিনি ইটির মতন ট্যাঁশ গরুকে নিয়ে নির্ঘাত একটা ছবি বানাতেন।
ট্যাঁশ গরু
ট্যাঁশগরুর শুধু চেহারা নয় তার আচার আচরণ এবং খাদ্য তালিকাও খুব স্পেসিফিক। সে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে খাবি খায়, কি জানি কি খেয়ালে মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে , রেগে যায় , তেড়ে ওঠে। আর ডায়েট ? খুব সিম্পল। সাবানের সুপ আর মোমবাতি।
হারুদের আফিস থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আছে সে এক কোম্পানীর কোম্পানির হেড আফিস। সেখানকার বড়বাবু কেও আমরা খুব চিনি। দিব্যি শান্ত শিষ্ট ভদ্রলোক। নইলে আর কি করে আফিস সামলাবেন ! কিন্তু তিনি হঠাৎ একদিন ক্ষেপে গেলেন। পৃথিবীর সব আফিসের বড়বাবু বা বড়সাহেবরাই হঠাৎ হঠাৎ ক্ষেপে যান বটে। ‘আফিসের বাঁদরগুলো মাথায় খালি গোবর’ এমন বকুনি সব চাকুরে মানুষদের কপালেই কখনো না কখনো জুটেছে। সে রকম ক্ষেপা বসের গল্পও তো আমরা কতই পড়েছি বা শুনেছি। তবে এনার ক্ষেপে যাওয়ার কারণটি এক কথায় অনন্য। কত কি যে চুরি হয় আজকাল। স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি। কলের বিবকক, ম্যানহোলের ঢাকনা, পেতলের নেমপ্লেট, পাখার ব্লেড, দরজার হাতল, সোফার কুশন এমন সব সম্পত্তি যেমন চুরি হয় আকছার। আবার গল্পের প্লট, গানের সুর, জামার পকেটের ডিজাইন, চানাচুরের ফরমুলা, চুলের স্টাইল এ রকম মেধা-সম্পত্তির চুরির কথাও আমরা আজকাল শুনছি মাঝে মাঝে। কিন্তু গোঁফ চুরি ! এর চেয়ে অভিনব চুরি আর কিই বা হতে পারে। খুব জোর দিয়ে বলা যায় ইহজগতের এখন পর্যন্ত এটাই সব চেয়ে weird চুরি।
‘হযবরল’ লেখাটি আসলে কি? সুকুমার-সমগ্রে হযবরল কে গল্প সমগ্রের অন্তর্গত রাখা হয়েছে। এটা কি সত্যিই একটা গল্প? এখানে কিন্তু ঠিক কোনো গল্প দানা বাঁধে না। কোনো নাটকীয়তাও তৈরি হয় না, চিত্রনাট্য তৈরি হবার মত কোনো মেলোড্রামা নেই। স্যাটায়ারে যেমন তীক্ষ্ণ ব্যাঙ্গ লুকানো থাকে তাও নেই।। তা হলে এখানে আছেটা কি? এখানে আছে শুধু নির্ভেজাল অসংলগ্নতার মজা। পরতে পরতে মজা। মজা দিয়ে ঠাসা, মজা দিয়ে মোড়া। এ বড় কঠিন কাজ। খাদ ছাড়া গয়না বানানোর মত , কথা ছাড়া উচ্চাঙ্গের গান বানানোর মত। আবার যদি কেও ‘হযবরল’র আপাত-অর্থহীন ঘটনাবলীর মধ্যে খুঁজতে থাকে বৃহত্তর কোন অর্থ তাহলেও কিন্তু নিরাশ হবেন না তিনি।
‘হযবরল’-র সেই বেড়াল
সেই যে বেড়ালটিকে মনে করুন, একটা সামনের একটা পা মুঠো করে একটু তুলে, আপনার দিকে তাকিয়ে একটা ফিচেল হাসি হাসছে। যেন আপনাকে অনবরত outwit করার চেষ্টা করছে। এই বেড়ালটির সঙ্গে তো আমাদের প্রায়শই দেখা হয়, সার্ট প্যান্ট অথবা ধুতি পাঞ্জাবী পরে, আফিস কাছারিতে, পাড়ায়, অথবা মাঠে ময়দানে। তারা ঠিক ‘চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা – হল চশমা, কেমন হল তো ?’ এ ভাবেই তারা সরল বিষয়কে গুলিয়ে দিয়ে জটিল করে এবং তার তার পরে নিজেদের মত চাপিয়ে দেয় আপনার উপর।
আর যারা এ সময়ে ক্ষমতাবান মানুষ, মানে কিছু কিছু সময়ে যাদের সাহায্য, অনুগ্রহ, বিবেচনা নাহলে আপনার অনেক দরকারি কাজ আটকে যেতে পারে, মানে এককথায় ‘প্রভাবশালী’ মানুষ, তারা তো আসলে গেছো-দাদাই হন।ছবিতে-টিবিতে তাদের দেখা গেলেও সশরীরে দেখা পাওয়া খুব দুষ্কর , অথবা দেখা পেলেও ধরা ছোঁওয়া যায় না। এমন কি পুলিশও কখনো কখনো এই সব গেছো দাদাদের খুঁজে পায় না।
আর যদি হিজবিজবিজের কথা ধরি। তার সব মন্তব্য গুলো কি নেহাতই হযবরল? নাকি সে আসলে একজন দ্রষ্টা। তার আপাত-আজগুবি গল্পের মধ্যে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আমাদের চেনা চেনা চরিত্র। যেমন তার এই কথাটি ধরা যাক –
‘একজনের মাথার ব্যারাম ছিল , সে সব জিনিষের নামকরণ করত।তার জুতোর নাম ছিল অবিমিশ্রকারিতা, আর ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যানবরেষু , কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অমনি ভূমিকম্পে বাড়ি টাড়ি সব পড়ে গিয়েছে। ’
ওই যে বাড়ির নাম ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূমিকম্পে সব পড়ে যাওয়া , আজকাল এই জায়গাটা পড়লেই আমার মনে হয় যেন বলা আছে পূর্ব ইয়োরোপের কমিউনিজমের কথা। আসলে তো কম্যুনিস্টরা তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল বলেই দুদ্দাড় করে পড়ে গিয়েছিল তাদের সাজানো দুর্গ।
আর এই সব কিছুর নাম দেওয়ার ব্যারামওয়ালা মানুষটির কথা শুনে পাঠকের যদি নাম সব কিছুর দিতে সদা-উৎসুক বর্তমানকালের কোনো বিখ্যাত চরিত্রের কথা মনে পড়ে যায়, এই লেখক তার জন্যে কিন্তু দায়ী নয়।
‘দ্রিঘাংচু’ নামের সেই গল্পটির কথা ধরা যাক। রাজা-মন্ত্রী কে নিয়ে রঙ্গ রসিকতার গল্প আমাদের সাহিত্যে বিস্তর। আসলে গরীব গুর্বো প্রজাদের তো রাজাদের সঙ্গে পাঙ্গা নেবার শক্তি নেই , তাই তারা রাজাদের (এককালে রাজা নেই মন্ত্রীরা আছেন ) নিয়ে হাসির গল্প ফেঁদে রাজার অবিচার অত্যাচারের কিছুটা শোধ তোলে।
কিন্তু এই গল্পে ঠিক তেমন কোনো শ্লেষ নেই। বরং হাসির সঙ্গে একটা সমান্তরাল রহস্য গল্পও যেন এগোতে থাকে।
প্রথমেই আমরা দেখি রাজসভায় একটি দাঁড়কাকের আবির্ভাব। দাঁড়কাক আমাদের গল্পে সাহিত্যে খুবই অপাংক্তেয়। এমন কি ছোটদের রূপকথার গল্পেও তাদের দেখা যায় না। কিন্তু এখানে তার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তার প্রথম আবির্ভাব ঘটে এরকম – সিংহাসনের ডান দিকে উঁচু থামের উপর বসে ঘাড় নিচু করে চারদিক তাকিয়ে , অত্যন্ত গম্ভীর গলায় সে বলল , “ক:”। এবং এই যে দাঁড়কাকের আবির্ভাব তাতে করে কি চেইন রি-একশন ঘটে গেল আমরা একবার দেখে নিই। মন্ত্রী একতাড়া কাগজ নিয়ে কি যেন বোঝাতে যাচ্ছিলেন , তিনি বক্তিতার খেই হারিয়ে বোকার মত চেয়ে রইলেন , দরজার কাছে একটা ছেলে বসে ছিল সে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো ,যে লোকটা চামর দোলাচ্ছিল তার চামরটা হাত থেকে ঠাঁই করে রাজার উপর পড়ে গেল , এবং রাজা মশাই , যিনি ঘুমে ঢুলছিলেন , জেগে উঠেই বললেন ‘জল্লাদ ডাকো’।
জল্লাদ তো এসে হাজির হল। রাজা বললেন ‘মাথা কেটে ফেল’। এই অবস্থায় সভার উপস্থিত লোকজনদের কথা ভাবুন। কেও জানেনা কার মাথা কাটা যাবে। সকলে নিজের মাথায় হাত বুলাচ্ছে।এ রকম একটা সময়ে রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন। রাজা খানিকক্ষণ ঝিমিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন ‘কই মাথা কোথায়?’
জল্লাদ বেচারা হাত জোড় করে বলে উঠলো , আজ্ঞে মহারাজ কার মাথা? রাজার উত্তর –বেটা গোমুখ্যু কোথাকার, কার মাথা কিরে ! যে ঐ রকম বিটকেল শব্দ করছিল , তার মাথা। রাজার জবাব শুনে সভা শুদ্ধ লোক হাঁফ ছেড়ে এমন ভয়ানক নিশ্বাস ফেলল যে কাকটা ধড়ফড় করে সেখান থেকে উড়ে পালালো। রাজা ডেকে পাঠালেন তাঁর সমস্ত মাইনে করা পণ্ডিতদের। তাদের কাছে প্রশ্ন রাখলেন আসলে কাকটি ঠিক কি বলতে চেয়েছিল?
পণ্ডিতদের, ওই যাকে বলে vague উত্তর শুনে রাজা আরো ক্ষেপে গেলেন। হুকুম দিলেন এর জবাব না পাওয়া পর্যন্ত কেও যেন সভা ছেড়ে না ওঠে। তখন কি হল – ভাবতে ভাবতে কেও ঘেমে ঝোল হয়ে উঠলো, চুলকিয়ে কারো মাথায় টাক পরে গেল। আর রাজা মশাই খিদেও নেই তেষ্টাও নেই , তিনি বসে বসে ঝিমুতে লাগলেন।
এর পর গল্পের আসল ক্লাইমেক্স। হঠাৎ এক রোগা সুঁটকো মতন লোক চিৎকার করে সভার মাঝে এসে পড়ে যায়। সেই জানায় দ্রিঘাংচু র কথা। এবং রাজার কে জানায় সে বিখ্যাত গোপন মন্ত্রটি যেটিকে আসল দ্রিঘাংচুর সামনে পড়তে হবে-
রাজা সেই থেকে দাঁড়কাক দেখলেই লোকজন কে তাড়িয়ে দিয়ে তার সামনে মন্ত্রটি বলেন , কিন্তু দ্রিঘাংচুর দেখা পান নি কোনোদিন, যেমন দেখতে পায় নি সেই সুঁটকো লোকটি।
এই ‘দ্রিঘাংচু’ কি নেহাতই এক খেয়ালরসের সৃষ্টি ? নাকি এই ‘দ্রিঘাংচু’ ই সেই চিরায়ত সোনার হরিণ হরিণের প্রতীক , যাকে রামায়ণের লক্ষণ থেকে দেবব্রত বিশ্বাস সবাই খোঁজেন কিন্তু পান না ! সে তর্কটা হয়ত অমীমাংসিত থেকে যাবে চিরকাল। ঠিক যেমন গুপী বাঘা ছবির সেই ভুতের নাচের interpretation নিয়ে তর্কটা আজও আমরা শেষ করে উঠতে পারিনি। আমার কেন যেন মনে হয় এই দ্রিঘাংচু গল্পটি থেকেই সুকুমার-পুত্র সত্যজিৎ তাঁর হীরক রাজাকে খুঁজে পেয়েছিলেন।
কবীর সুমন প্রায়শই বলে থাকেন সুকুমার রায় না পড়লে তাঁর গান লেখা সুর করা গান গাওয়া কোনটাই হয়ে উঠত না। আপাত দৃষ্টিতে সুমনের গানের প্রকৃতির সঙ্গে সুকুমার রায়ের কবিতার ঘরানার কোনো মিল আমাদের চোখে পড়ে না। তবু খুঁজে দেখলে শব্দ প্রয়োগের পরিমিতি বোধ এবং এক একটি আটপৌরে শব্দবন্ধের মোক্ষম প্রয়োগে পাঠক বা শ্রোতার অন্তরে আলোড়ন তোলা , এ সব আহরণের পিছনে হয়ত সুকুমার রায় বিরাজ করেন। আমাদের আর এক প্রবাদ প্রতিম সঙ্গীতাচার্য শ্রী জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ মহাশয় সুকুমার রায় দ্বারা নানা ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি কবিতায় অসাধারণ সুরারোপ করেছিলেন এবং অননুকরণীয় ভঙ্গীতে কণ্ঠদান করেছিলেন। তার একটা শুনে নিলে বেশ হয়।
এই যে অসম্ভব রকমের অসংলগ্নতাকে ছন্দের বাঁধনে বেঁধে তাকে শুদ্ধ বাঙালি রসে ডুবিয়ে দিয়ে পাঠকের পাতে দেওয়া , তা কি একান্ত ভাবে বাঙ্গালির উপভোগ্য ? সৈয়দ মুজতবা আলির লেখায় কিন্তু আমাদের এ ধারণা পালটে যায়।
একবার প্যারিস শহরে কয়েকজন হাস্যরসিক ভদ্রলোকের কাছে , মুজতবা আলি মহাশয় ‘বোম্বাগড়ের রাজা’ কবিতাটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে তাঁদের শুনিয়েছিলেন। আমরা জানি এই কবিতাটির যাবতীয় অনুষঙ্গ এতোটাই বঙ্গদেশীয় যে তাকে রসবোধ বজায় রেখে অনুবাদ করা প্রায় অসম্ভব কাজ। আমসত্ত্ব বা আলতা সম্বন্ধে ধারণা যাদের নেই তাদের আমসত্ত্ব ভাজা ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা এবং পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকা ব্যাপারটা ভিসুয়ালাইজ করানো অসম্ভব ব্যাপার। (সত্যজিৎ রায় এই কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে একই রকম মুস্কিলে পড়েছিলেন , তাই তিনি ফ্রেমে আমসত্ত্ব বাঁধানো কে ভাবানুবাদে Gilded frames for chocolates এবং পাঁউরুটিতে পেরেক ঠোকা কে করেছিলেন Sticking nails in custard pies )। মুজতবা আলির পক্ষে ফরাসীতে অনুবাদের চেষ্টা আরো কঠিন ছিল হয়ত , কিন্তু সেই অনুবাদ শুনে শ্রোতাদের কি প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তা তাঁর লেখা থেকেই আমরা জেনে নিই।
“ফরাসী কাফেতে লোকে হোহো করে হাসে না, এটিকেটে বারণ, কিন্তু আমার সঙ্গীগণের হাসির হররা দেখে আমি পর্যন্ত বিচলিত হয়ে তাঁদের হাসি বন্ধ করতে বার বার অনুরোধ করেছিলাম। কিছুতেই থামেন না , শেষটায় বললুম ‘ তোমারা যে ভাবে হাসছ , তাতে লোকে ভাববে , আমি বিদেশী গাড়ল, বেফাঁস কিছু একটা বলে ফেলেছি আর তোমরা তাই আমাকে নিয়ে হাসছ , আমার বড় লজ্জা করছে। তখন তারা থামলেন।”
এর পর সেই ফরাসী রসিক ব্যক্তিরা স্বীকার করেছিলেন – এমন wired , এমন ছন্নছাড়া , ছিষ্টিছাড়া কর্মের ফিরিস্তি তাঁরা জীবনে কখনো শোনেননি। এর পর তারা সবাই মিলে চেষ্টা করেছিলেন বোম্বাগড়ের রাজবাড়ির এমন ছন্নছাড়া কর্মকাণ্ডের তালিকায় তাঁরা নিজেরা কিছু যোগ করতে পারে কি না। অনেক চেষ্টা করেও তাঁরা একটিও নতুন কিছু যোগ করতে পারেন নি।
আজকের এই প্রযুক্তিময় , গ্যাজেট-বন্দি দুনিয়াতেও সুকুমার রায় নামক বিস্ময়নগরীর পথ ঘাটে কোনোদিন ধুলো জমবে না। আগামী পৃথিবীর বাঙ্গালিদের সঙ্গে ঠিক দেখা হয়ে যাবে কুমড়ো পটাশ , ট্যাঁস গরু , পাগলা দাশু, পান্তভুতের জ্যান্তছানা, গেছো দাদা , কাকেশ্বর কুচকুচে , ষষ্টিচরণ , ভীষ্মলোচন দের সঙ্গে।
কারণ একদিকে তিনি যেমন বাঙ্গালির শৈশবের চিরায়ত উৎসব , তেমনি আবার তিনি ফিরে আসেন আমাদের বোধ বুদ্ধির কিছুটা পক্কতা ঘটলে একেবারে অন্য ভাবে। তখন মনে হয় আমাদের চারিপাশের জগতে সাধারণ ভাবে যা কিছু আমাদের বোধের আয়ত্তে আসে, তার বাইরে একটা একটা অপার্থিব জগত আছে যার মধ্যে আছে অনেক স্তর, যার মধ্যে অনেক অচেনা আলো ছায়া, যার মধ্যে আছে অনেক পরিবর্তনশীল বর্ণময়তা, যা আমরা দেখতে পাইনা কিন্তু কবিরা পান। কবিরা সেই জগতটার সঙ্গে পাঠক দের পরিচয় করিয়ে দেন কবিতার মাধ্যমে। এই কথাটা মেনে নিলে আমাদের সুকুমার রায় কে আধুনিকতম কবি বলে মেনে নিতে কোনো অসুবিধা থাকে না। কারণ তাঁর আপাত সরল মজারু ছড়ার মধ্যে সেই কবিতার গুণগুলি সবই আছে। এই ‘খেয়াল রস’ এর ছড়া গুলির মধ্যে যেন তাঁর বাস্তব এবং পরাবাস্তব কে নিয়ে যে ষষ্ঠিচরণের হাতি লোফার মতন অনায়াস একটা লোফালুফির খেলা আছে।
কবি জীবনানন্দ বলেছিলেন – ‘আমাদের এই পৃথিবীর ভিতরেই আরও অনেক পৃথিবী রয়েছে যেন। সাধারণ চোখ দিয়ে স্বভাবত তা খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন নয়। থাকে তা সৃষ্টি পরায়ণ মানসের ভিতর; এঁরাই আমাদের দেখান। এই সব পৃথিবীর কোনো একটা যেন এই জগতেরই স্বচ্ছ মুকুরের মত , কোনো একটা কুয়াশাছন্ন , বিদ্যুতায়িত ; এই রকম আরও অনেক রকম। কিন্তু সুকুমার রায়ের পৃথিবী ‘আবোল তাবোল’ এ যা সত্য হয়ে ফলে উঠেছে , তা মোটেই আমাদের চেনা জানা পৃথিবী কিম্বা তার প্রতিচ্ছবির মত বাস্তব না হয়েও তেমনি পরিচিত এবং সত্য। এই খানেই কবি সাদাসিধে ভাবে এক সে এক অনন্য সাধারণ শক্তি ; আমি কোনো স্বদেশী বা বিদেশী লেখায় ঠিক এই ধরনের প্রতিভার পরিচয় পাইনি। সুকুমার রায়ের এই স্বকীয়তার কথা যতই ভাবা যায় , ততই বিস্ময়ে ও আনন্দে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় ’
সুকুমার রায় রসায়ন এবং পদার্থ বিদ্যায় জোড়া অনার্স নিয়ে পাশ করে বিলেতে অধ্যয়ন করতে যান ছাপাইয়ের এবং ফটোগ্রাফি সম্বন্ধে। সেখানে গিয়ে আরেক বিজ্ঞানের ছাত্র ডজসন সাহেবের লেখার ভক্ত হয়ে ওঠেন। তাঁর লেখা এলিস ইন দ্যা ওয়ান্ডারল্যান্ডের (লুইস ক্যারল ছদ্ম নামে লেখা ) নন-সেন্স ধারাটিকেই তিনি নির্ভেজাল বাঙ্গালিত্বের সাজে সাজিয়ে নিয়ে তাঁর লেখা শুরু করেন। ডজসন সাহেবের নিজের আঁকা ইলাস্ট্রেশনের মতই তিনিও তাঁর লেখা কবিতার ইলাশস্ট্রেশন নিজেই করে গেছেন। ডজসন দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও তিনি তাঁর স্বকীয়তায় কিন্তু একেবারে অনন্য।
বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলির কথায় –
‘সুকুমার রায়ের মত হাস্যরসিক বাঙ্গলা সাহিত্যে আর নেই সে কথা রসিকজন মাত্রই স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু এ কথা খুব অল্প লোকেই জানেন যে, তাঁর জুড়ি ফরাসী, ইংরেজি , জর্মন সাহিত্যেও নেই, রাশানে আছে বলে শুনি নি। এ-কথাটা আমাকে বিশেষ জোর দিয়ে বলতে হল , কারণ আমি বহু অনুসন্ধান করার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছি। ’
আধুনিক জীবনের কনজুমারিজমের মোহের ইঙ্গিত পাওয়া যাবে ‘খুড়োর কল’ কবিতায়। আজকের শব্দ ব্রহ্মের চীৎকৃত রূপের রূপক ‘শব্দ কল্পদ্রুম’ । বিশ্বায়নের স্রোতে আমাদের স্বকীয়তা হারানো সংস্কৃতির প্রতি ব্যাঙ্গ আছে ‘খিচুড়ি’ কবিতায়।
আর আমাদের বাল্যকালের প্রথম আবৃত্তির কবিতা সেই বাবুরাম সাপুড়ে।সেকি নেহাত নির্দোষ এক ছড়া, নাকি এক ভণ্ড জীবন দর্শন কে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া ? কবিতার আরম্ভে এক মোড়ল সুলভ ভঙ্গীতে সাপুড়েকে বলা হচ্ছে কোথা যাস বাপুরে। তার পর খুব বীরত্ব দেখিয়ে দুটো সাপ রেখে যাবার ফরমাশ। কিন্তু এই বীরত্বের আড়ালে আছে ঝুঁকি না নেওয়ার দুর্বলতা, সাপ এমন হবে যার চোখ নেই সিং নেই নোখ নেই। সে সাপের বেহুলার লোহার বাসর ঘরে ঢুকে যাওয়ার ক্ষমতা তো দুরের কথা, শ্রী রামকৃষ্ণের কথামৃতের গল্পের সাপের মত ফোঁস করারও ক্ষমতা নেই। তেমন সাপ আনলে তবে সাহস করে –তেরে মেড়ে ডাণ্ডা মারা হবে। এতো আমাদের মত গড় বাঙ্গালির জীবন দর্শনের প্রতি সূক্ষ্ম ব্যাঙ্গ।
এ রকম ছন্দের যাদুতে মোহাবিষ্ট করে দিয়ে তিনি বেশ করে চপেটাঘাত করেছেন অনেক বার। কিন্তু তাতে নির্ভেজাল মজা কিছু কম পড়েনি। তাঁর প্রত্যেক টি লেখায়, তা সে পদ্য গদ্য প্রবন্ধ , এমন কি মণ্ডা ক্লাবের নিমন্ত্রণ পত্রেও তাঁর রসবোধ কমল হীরের দ্যুতির মতন ঠিকরে বেরিয়ে আসে। বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায় কে ছোঁবার চেষ্টা তো দুর অস্ত , তাঁকে অনুকরণ করার চেষ্টা কেও কোনোদিন করার কথা ভাববেন বলে মনে হয় না। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম।
আমাদের চেনা অন্তর্জাল এর বাইরে , আর এক বোধের অন্তর্জালে চিরকাল সুকুমার-রায়- লাইভ হয়ে থাকবেন একটি বিচিত্র সাইটে , যেখানে আবোল-তাবোল রসের ফোয়ারার কোনো এক্সপায়ারি ডেট নেই ।যে বয়সেই হোক, পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করলে সেই বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া নিয়মহারা হিসাবহীন সাইটটি আমাদের জন্যে খোলা থাকবে সর্বদা।
এই যে আমি এত অবান্তর সব বক বক করলাম , এই তো আমি সেই সাইটটাতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি তিনি তাঁর প্রশান্ত দৃষ্টিতে , ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি নিয়ে আমাকে বলছেন -
লেখক পরিচিতিঃ চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।