প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাহিত্য

অগাস্ট ৩০ , ২০১৫

 

কবিতার অনুবাদের উদ্দেশ্য কি? - ভাষান্তর , রূপান্তর নাকি জন্মান্তর?

সোমেন দে

সাম্প্রতিক খবরের কাগজে একটি খবর চোখ এবং মনোযোগ টানলো। খবরটি হল গুলজার   রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা  অনুবাদ করেছেন, এবং তাতে সুরারোপ করছেন শান্তনু মৈত্র।

গুলজার সাহেব যে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদ করছেন এটা জানা ছিল। কিন্তু  শান্তনু মৈত্র তাতে সুরও দিচ্ছেন সেটা জানা ছিল না। এই যুগ্ম প্রয়াস ঠিক কেমন দাঁড়াবে তা শোনার জন্যে খোলা মন নিয়ে অপেক্ষা করবো।
তবে বলে রাখি যে গুলজারের রবীন্দ্র কবিতা অনুবাদ পড়বার জন্যে আমি সাদর আগ্রহে  অপেক্ষা করছি। কেন সে কথায় পরে আসছি। 

এ পর্যন্ত হিন্দিতে যে সব রবীন্দ্র কবিতা এবং গানের যে হিন্দি ভাষান্তরিত চেহারা দেখেছি  তাতে মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারিনি। কোথাও মনে হয়েছে খুব আড়ষ্ট, কোথাও মনে হয়েছে শুধুই অনুবাদ হয়েছে কবিতা হয়নি, কোথাও বা মনে হয়েছে কিছুই হয় নি।

দু একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে। অমল ধবল পালে লেগেছে, গীতাঞ্জলির এই কবিতাটি, যা গান হিসেবেই আমার এবং অনেকেরই খুব প্রিয়।  এ গানের সঞ্চারীর  মাত্র চার পঙক্তির মধ্যে আমাদের কাছে একটি অনবদ্য শরৎকালের চিত্রকল্প ফুটে ওঠে।  শব্দচয়ন, অন্ত্যমিল, ছন্দ এ সব  মিলে আমাদের মানসলোকে যে  ছবিটি আঁকা হয়ে যায়  সেটাই  কবিতার গুণ। লাইন গুলি এ রকম   -      

পিছনে ঝরিছে ঝর ঝর জল,
গুরু গুরু দেয়া ডাকে--
মুখে এসে পড়ে অরুণকিরণ
ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।

 এর হিন্দি অনুবাদ হয়েছে - 

পিছে ঝরঝর করতা হৈ জল,
গুরুগম্ভীর স্বর আতা হৈ;
মুখ পর অরুণ কিরণ পড়তি হৈ,
ছনকর ছিন্ন মেঘ-ছিদ্রোঁ সে। 

নিষ্প্রাণ অনুবাদের একটি নমুনা। বোঝাই যাচ্ছে বাংলা শব্দগুলি যথা সম্ভব বজায় রাখবার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে করে যে বাংলা-না-জানা পাঠক শুধু হিন্দিতে এই অংশটি পড়বেন তাঁর কাছে এই কবিতার কাব্যগুণ আদৌ পৌঁছাবে না। এ রকম উদাহরণ প্রচুর দেওয়া যায়। তাতে অযথা এই নিবন্ধ দীর্ঘায়িত হবে।  তার চেয়ে পবিত্র সরকার মহাশয়ের কাছে শোনা একটি ভয়াবহ উদাহরণ দিই। এটিও গীতাঞ্জলির একটি কবিতা যার প্রথম লাইনগুলি এই রকম  -

বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি /সেকি সহজ গান /সেই সুরেতে জাগবো আমি /দাও মোরে সেই কান  

হিন্দি ভাষার জনৈক পণ্ডিত এটি অনুবাদ করেছেন – ব্রজমে তেরি বজে বংশী। মানে অনুবাদকের মনে হয়েছিল আসলে নিশ্চয় প্রথম লাইনে ‘বজ্রে’ র জায়গায় হবে ‘ব্রজে’। অর্থাৎ লাইনটি  আসলে হবে - ব্রজে তোমার বাজে বাঁশি। ছাপার ভুলে ওটা ‘বজ্রে’ হয়ে গেছে।   কারণ বাঁশি বাজার সঙ্গে  তো  ব্রজেরই সম্পর্ক আছে। বজ্র আবার কি করে বাঁশি বাজাতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে সহজ সমাধানের পথ খুঁজে নিয়েছেন। 

সম্প্রতি একজন বাংলাগানের প্রথিতযশা গায়ক একটি হিন্দি ‘রবীন্দ্রগীত’ (?) এর একটি এলবাম বার করেছেন। সেটি নাকি যথেষ্ট জনপ্রিয়ও হয়েছে। কৌতূহলবশে  এই এলবামের  গানগুলি শুনতে গিয়ে চমকে উঠলাম। বলা উচিত আঁতকে উঠলাম। গায়ক এই সব গান  কোনো অনুষ্ঠানে গাইতে গেলে বলে দেন এ গুলি নাকি মূল গানের ভাবানুবাদ। ভাবানুবাদের দোহাই দিয়ে কিছুটা স্বাধীনতা নেওয়া যায় হয়তো। কিন্তু কতখানি ? রবীন্দ্রনাথের একটি অতি পরিচিত প্রেমের গান – মনে রবে কিনা রবে আমারে। এ গানের প্রথম চার লাইন সবারই মনে আছে  তাও সরাসরি মিলিয়ে নেবার জন্যে তুলে দিচ্ছি -  

মনে রবে কি না রবে আমারে    সে আমার মনে নাই।
ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে,    অকারণে গান গাই॥
চলে যায় দিন যত ক্ষণ আছি     পথে যেতে যদি আসি কাছাকাছি
তোমার মুখের চকিত সুখের    হাসি দেখিতে যে চাই--
তাই    অকারণে গান গাই॥

হিন্দি ‘রবীন্দ্রগীতে’ এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে –

কঁহি রহে ইয়া না রহে দিলমে   মেরি ইয়াদ, মেরে যানে কে বাদ 
রহতা হ্যায় ইয়ে হরদম  মেহবুব তেরা অহসাস
জীন্দগী হ্যায় এক অভিলাষা   রস্তে মে মুসাফির প্যায়াসা
কহতা হ্যায় দিল মুস্কান তেরা  হোঁটো মে রহে
মেহবুব তেরা অহসাস।

‘তেমনি একটুকু ছোঁয়া লাগে’ গানের প্রথম চার লাইনের অনুবাদ –

প্যার কা এ মুস্কুরানা
হো গয়া মেরে দিল দিওয়ানা  
তু হ্যায় মেরে সাথ     সপনা ভী ক্যায়া বাত
মনমে আয়ে এক গীত তরানা।

এগুলো কি ভাবানুবাদ বলবো নাকি বলবো  অভাবানুবাদ? যারা বাংলা ভাষা বোঝেন না তাঁরা এই গানের লিরিক্স শুনে যদি রবীন্দ্রনাথের গান সম্বন্ধে একটি ধারনা নিজেদের মনে তৈরি করে নেন তা হলে  কি সেটা ঘোরতর অন্যায় হবে না?    

******

 কবিতা (গান তো আসলে সুরারোপিত কবিতা) অনুবাদের সমস্যা হল এই। অনুবাদক যে  কবির কবিতা অনুবাদ করবে তাঁর সমগ্র সাহিত্যের অভিমুখ, বিচরণ ক্ষেত্র, এবং জীবনদর্শন সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া যে ভাষায় মূল কবিতাটি লেখা হয়েছে সেই ভাষাটি যে অঞ্চলের সেখানকার  জীবনধারা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধেও কিছুটা ওয়াকিবহাল হওয়াটাও খুব দরকারি। নইলে হয়  ভাষান্তরিত কবিতাটির ভাব মূল কবিতার ভাব থেকে অনেক দূরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাবে, অথবা সেটির আক্ষরিক অনুবাদের আড়ষ্টতায় আবদ্ধ থেকে, সেটি প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠেনা।  

সুমনের লেখায় জানতে পারি বব ডিলানের গানের লাইন – the answer is my friend is blowing in the wind  এই অংশটির সার্থক অনুবাদ করার জন্যে বহু বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ এই লাইনটির আক্ষরিক অনুবাদ করে - উত্তর ভাসে হাওয়ায় হাওয়ার বা এ ধরণের কিছু করে দিলে – ‘প্রশ্নটা তো সহজ আর উত্তরও তো জানা’ এই বার বার ফিরে আসা লাইনটি তে যে অভিঘাত বাঙালি শ্রোতার মনে সৃষ্টি হয়, তা আসতো না ।এটা অবশ্যই ভাবানুবাদ এবং সার্থক ভাবানুবাদ।   

ভুপেন হাজারিকার বিখ্যাত গান ‘আমি এক যাযাবর’ গানটি অনুবাদ করতে গিয়ে যাযাবর শব্দের সঠিক অনুবাদ করতে গিয়ে মুস্কিলে পড়েছিলেন গুলজার। কারণ আক্ষরিক অনুবাদের  যাযাবরের প্রতিশব্দ হতে পারত – মুসাফির বা বনজারা। কিন্তু এই গানটির সঙ্গে যেহেতু গুলজারের সম্যক পরিচয় ছিল, তিনি মনে করেছিলেন মুসাফির বা বনজারা কোনোটাই এই গানের মেজাজের মর্মে পৌঁছাতে পারছিলনা। তাই তিনি বেছে নিলেন আওয়ারা শব্দটি। আমি এক যাযাবর এর ভাষান্তর করলেন – আওয়ারা হুঁ, হাঁ ম্যায় আওয়ারা। কারণ তিনি মনে করলেন যে মানুষ লক্ষ্যবিহীন যাত্রাপথে ঘুরে বেড়ায়, একটি পৃথিবীতে, এবং সেই পৃথিবীতে সমস্ত জায়গায় নিজের ঘর মনে করে তার জন্যে – ‘আওয়ারা’ শব্দটিই  ‘সবসে করীব’। কবিতার অনুবাদকের এই ধরণের অনুসন্ধিৎসা থাকা বড় প্রয়োজন।        

******

কবিতার সার্থক অনুবাদ নিয়ে  সব কবিরই কিছু সংশয়, সন্দেহ, অনুযোগ আছে।  যাঁরা নিজেরা অন্য কবির কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাঁরাও স্বীকার করে নিয়েছেন কবিতা একশো ভাগ যথার্থ অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তবুও কোনো সংস্কৃতিকে জীবন্ত থাকতে গেলে তাকে শুধু নিজেকে নিয়ে চললেই হয় না। দেওয়া নেওয়ার জন্যে জানলা খুলে রাখতে হয়। কোনো এক ভাষার সাধারণ পাঠকের পক্ষে অন্য অজানা কোনো ভাষার একটি সুন্দর কবিতার নাগাল পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। আমাদের পক্ষে মূল ভাষা থেকে পাবলো নেরুদা, বোদলেয়ার বা ব্রেখটের কবিতার রসাস্বাদন সম্ভব নয়। কিন্তু কোনো কবি যদি আমাদের জন্যে এঁদের কবিতা  অনুদিত করে দেন, তাতে অন্তত আমাদের একটা প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয় সেই কবিতা সম্বন্ধে। অনূদিত কবিতা বিশুদ্ধ কবিতা হয়ে ওঠার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও অনুবাদ দিয়ে নানা কবির নানা মত  আছে। 

সুধীন্দ্রনাথ তাঁর অনূদিত কবিতার সংকলন প্রতিধ্বনি-র ভূমিকায় স্বীকার করে নিয়েছেন:  ‘আমার মতে কাব্য যেহেতু উক্তি ও উপলব্ধির অদ্বৈত, তাই আমি এও মানতে বাধ্য যে তার রূপান্তর অসম্ভব;...।’ 
বিষ্ণু দে তাঁর অনূদিত কবিতার সংকলন ‘হে বিদেশি ফুল’-এর মুখবন্ধে কবিতার বিশুদ্ধ অনুবাদ অসম্ভব মেনে নিয়েই কবিতার মেজাজ রক্ষা করার চেষ্টার কথা লিখেছেন :  ‘যথাসম্ভব চেষ্টা করেছি মূল কবিতার বিন্যাস, ছন্দ বা নিদেনপক্ষে মেজাজ অনুবাদের আভাসে রক্ষা করা’।

নিজের  অনুবাদ করা কবিতার সঙ্কলন ‘বহুল দেবতার স্বর’ এ শঙ্খ ঘোষ নিজেই প্রশ্ন  রেখেছেন  ‘অনেকের মতো আমিও একথা জানি যে কবিতার ঠিক ঠিক অনুবাদ হয় না... এসব লেখাকে অনুবাদ না বলে অনুসর্জন বলাই কি তাই সংগত?’

 ‘অন্য দেশের কবিতা’ নামে  সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনূদিত বিদেশি কবিতার সংকলনের  ভূমিকায় তিনি লিখেছেন: ‘এ বইতে যাঁরা বিশুদ্ধ কবিতার রস খুঁজতে যাবেন, তাঁদের নিরাশ  হওয়ার সম্ভাবনাই খুব বেশি। এই বইতে কবিতা নেই আছে অনুবাদ কবিতা।...আমি এতগুলি কবিতার অনুবাদক তবু আমার ব্যক্তিগত দৃঢ় বিশ্বাস, অনুবাদ কবিতার পক্ষে কিছুতেই বিশুদ্ধ কবিতা হওয়া সম্ভব নয়, কখনো হয়নি। কবিতার সংজ্ঞা, ব্রহ্মেরই মতন, অনুচ্ছিষ্ট।’

এবার স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কথাতেই আসি। তিনিও অনেক কবিতা অনুবাদ করেছেন। সে কথায় পরে আসছি। আগে জেনে নিই অনুবাদ সম্বন্ধে তাঁর কিছু উক্তি।

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বিদেশি কবিতার অনুদিত সঙ্কলন ‘তীর্থরেণু’ পড়ে রবীন্দ্রনাথ  একটা চিঠিতে লিখেছিলেন: : ‘এই অনুবাদগুলি যেন জন্মান্তর প্রাপ্তি — আত্মা এক দেহ হইতে অন্য দেহে সঞ্চারিত হইয়াছে — ইহা শিল্পকার্য নহে, ইহা সৃষ্টিকার্য।’

ধরে নেওয়া যেতে পারে কবিতার অনুবাদের সময় জন্মান্তর প্রাপ্তি ব্যাপারটাকে রবীন্দ্রনাথ অনুমোদন করেছেন।  আর এক জায়গায়,   কান্তিচন্দ্র ঘোষের ওমর খৈয়ামের অনুবাদ পড়ে তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন: ‘ভাল কবিতা মাত্রকেই তর্জ্জমায় নূতন করে সৃষ্টি করা দরকার। … মূল কাব্যের এই রস-লীলা যে তুমি বাংলা ছন্দে এমন সহজে বহমান করতে পেরেচ এতে তোমার বিশেষ ক্ষমতা প্রকাশ পেয়েচে। কবিতা লাজুক বধূর মত এক ভাষার অন্তঃপুর থেকে অন্য ভাষার অন্তঃপুরে আসতে গেলে আড়ষ্ট আড়ষ্ট হয়ে যায়। তোমার তর্জ্জমায় তুমি তার লজ্জা ভেঙেচ,তার ঘোমটার ভিতর থেকে হাসি দেখা যাচ্ছে ‘

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ দু ধরণের অনুবাদকেই প্রশংসা করেছেন এক হচ্ছে যে অনুদিত কবিতায়  ঘোমটার ভিতর থেকে মূল কবিতার হাসি টুকু দেখা যায়, মানে করা যেতে পারে যেখানে ভাষান্তরের আড়ষ্টতা কাটিয়ে মূল কবিতার রূপটি কিছুটা হলেও পরিস্ফুট হচ্ছে আর  দুই হচ্ছে  যেখানে অনূদিত কবিতা  মুল কবিতার জন্মান্তর ঘটিয়ে দিয়ে নূতন সৃষ্টি হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।  

রবীন্দ্রনাথ নিজে তাঁর ২৫ /২৬ বছর বয়সে বেশ কিছু বিদেশী কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। তিনি চয়ন করেছিলেন – থমাস মুর, ম্যাথু আরনল্ড, ভিক্টর হুগো, লর্ড বাইরন,   হেইনেরিখ হেইন দের মতন  ইয়োরোপের নামজাদা কবিদের কবিতা।এই সময়টায় সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপের সাহিত্য গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছিলেন। অথবা বলা যেতে পারে ব্লটিং পেপারের মত শুষে নিচ্ছিলেন। এই অনুবাদ গুলি তারই ফল। সাধারণ পাঠক হিসেবে  আমার  মনে হয় যেন ছন্দ এবং অন্ত্যমিল বজায় রাখতে গিয়ে অনূদিত কবিতাগুলি খুব উচ্চ মানের হয়ে  ওঠেনি।

তবে  প্রায় ৭৭ বছর বয়সে টি এস এলিয়টের The Journey Of The Magi namer একটি কবিতার অনুবাদ করেছিলেন। মূল কবিতার কিছু অংশ এবং সেই অংশের রবীন্দ্রনাথ কৃত অনুদিত অংশ এখানে তুলে  দিচ্ছি। 

'A cold coming we had of it,
Just the worst time of the year
For a journey, and such a long journey:
The ways deep and the weather sharp,
The very dead of winter.'
And the camels galled, sorefooted, refractory,
Lying down in the melting snow.
There were times we regretted
The summer palaces on slopes, the terraces,
And the silken girls bringing sherbet.
Then the camel men cursing and grumbling
and running away, and wanting their liquor and women,
And the night-fires going out, and the lack of shelters,
And the cities hostile and the towns unfriendly
And the villages dirty and charging high prices:
A hard time we had of it.
At the end we preferred to travel all night,
Sleeping in snatches,
With the voices singing in our ears, saying
That this was all folly.

কনকনে ঠাণ্ডায় আমাদের যাত্রা--
ভ্রমণটা বিষম দীর্ঘ, সময়টা সব চেয়ে খারাপ,
রাস্তা ঘোরালো, ধারালো বাতাসের চোট,
একেবারে দুর্জয় শীত।
ঘাড়ে ক্ষত, পায়ে ব্যথা, মেজাজ-চড়া উটগুলো
শুয়ে শুয়ে পড়ে গলা বরফে।
মাঝে মাঝে মন যায় বিগড়ে
যখন মনে পড়ে পাহাড়তলিতে বসন্তমঞ্জিল, তার চাতাল,
আর শর্বতের পেয়ালা হাতে রেশমি সাজে যুবতীর দল।
এ দিকে উটওয়ালারা গাল পাড়ে, গন্‌গন্‌ করে রাগে,
ছুটে পালায় মদ আর মেয়ের খোঁজে।
মশাল যায় নিভে, মাথা রাখবার জায়গা জোটে না।
নগরে যাই, সেখানে বৈরিতা; নগরীতে সন্দেহ।
গ্রামগুলো নোংরা, তারা চড়া দাম হাঁকে।
কঠিন মুশকিল।
শেষে ঠাওরালেম চলব সারারাত,
মাঝে মাঝে নেব ঝিমিয়ে
আর কানে কানে কেউ বা গান গাবে--
এ সমস্তই পাগলামি।

এই অনুবাদ ভাষান্তর, রূপান্তর নাকি জন্মান্তর কি হয়েছে, তা নিয়ে মন্তব্য করার ধৃষ্টতা অন্তত আমি দেখাবো না।পাঠকরাই বিচার করুন।

******   

দেশ ভাগ হওয়ার পরে পাকিস্তানের মানচিত্রে পড়ে যাওয়া পাঞ্জাবের এক অংশে, ঝেলাম  নদীর ধারে দিনা নামের  ছোট শহর থেকে  সদ্য রিফিউজি হয়ে পালিয়ে এসেছে ছেলেটি। বাবার সঙ্গে অমৃতসরে না গিয়ে ছেলেটি জেদ করে চলে আসে বম্বে শহরে। লেখক হবার  স্বপ্ন বুকে নিয়ে। শহরে এসে কাজ জোটে এক মোটর গ্যারেজে আর থাকার জায়গা জোটে এক চায়ের দোকানে। কাছেই  একটি পুরনো বইয়ের দোকান ছিল। অবসর পেলেই ছেলেটি সেখানে গিয়ে বই নাড়াচাড়া করে। বইয়ের দোকানীর সঙ্গে চুক্তি হয় মাসে চার আনা করে সে দোকানী কে দেবে, বিনিময়ে একটি করে বই  নিয়ে যেতে পারবে। এক মাসে যত গুলি ইচ্ছে বই সে নিতে পারবে, তবে একটি ফেরত দিয়ে আর একটি নিতে  পারবে। সে প্রায় রোজ একটি করে জাসুসী বই শেষ করে আর রোজ একটি করে নতুন  নিয়ে যায়। এ ভাবে প্রায় দোকানীর সব জাসুসী বই সে শেষ করে ফেললো। দোকানী বিরক্ত হয়ে দোকানের এক কোনে পড়ে থাকা একটি বই তাকে দিয়ে বলে – যাঃ, এটা পড়বি যা। ছেলেটি একটু মনমরা হয়েই নিয়ে এলো বইটি। বাড়িতে এসে বইটি খুলে  দেখলো বইটির নাম The Gardener  by Rabindra Nath Tagore । উলটে পালটে দেখতে  দেখতে ক্রমশ সেই বইতে লেখা কবিতা গুলির গভীরে ঢুকে পড়ছিল সে।বুঝতে পারছিল তার ভিতরে একটা transformation  ঘটে যাচ্ছে। তার পরে এই লেখকের যত অনূদিত লেখা পেল সে পড়ে ফেললো।এ ঘটনার অনেক পরে তার সঙ্গে সরাসরি বাংলা ভাষার  পরিচয় ঘটলো, সে বাংলা ভাষা শিখে নিল  বাংলায় মূল রবীন্দ্রনাথ পড়ে ফেলার জন্যেই।

ছেলেটি বহু বছর পর, যখন ভারত বিখ্যাত উর্দু কবি, গীতিকার হয়ে যায় তখন একটি সাক্ষাতকারে জানায় সেই The Gardener  বইটি হাতে পাওয়াই তার জীবনের সব চেয়ে বড় Turning point । 
এতক্ষণে বোঝাই গেছে আমি গুলজারের কথাই বলছি। মূলত হিন্দি এবং উর্দু ভাষার কবি  হলেও  গুলজার সাহেব অনেক জায়গাতেই তাঁর উপর একই সঙ্গে গালিব এবং রবীন্দ্রনাথের  প্রভাবের কথা বলেছেন বিভিন্ন জায়গায়। তাই  গুলজারের রবীন্দ্র কবিতার অনুবাদ পড়ার জন্যে আমার আগ্রহ রইল। আপাতত ইউ টিউবের কল্যাণে একটি কবিতার ভাষান্তর চোখে, না চোখে নয় কানে  এলো। যা শুনেছি তার অংশ বিশেষ এখানে তুলে দিচ্ছি। শুনে শুনে লেখা বলে একটু আধটু ভুল হলেও হতে পারে। তবে এ থেকে অনুবাদের ধরন অন্তত বোঝা যাবে। পাঠকের সুবিধার প্রথমে মূল কবিতার অংশ টুকুও দিয়ে দিলাম। কবিতাটির নাম ‘ভ্রষ্ট লগ্ন’। কল্পনা কাব্যগ্রন্থ থেকে।

‘শয়নশিয়রে প্রদীপ নিবেছে সবে,
জাগিয়া উঠেছি ভোরের কোকিলরবে।
অলসচরণে বসি বাতায়নে এসে
নূতন মালিকা পরেছি শিথিল কেশে।
এমন সময়ে অরুণধূসর পথে
তরুণ পথিক দেখা দিল রাজরথে।
সোনার মুকুটে পড়েছে উষার আলো,
মুকুতার মালা গলায় সেজেছে ভালো।
শুধালো কাতরে "সে কোথায়! সে কোথায়!'
ব্যগ্রচরণে আমারি দুয়ারে নামি--
শরমে মরিয়া বলিতে নারিনু হায়,
"নবীন পথিক, সে যে আমি, সেই আমি!'

গোধূলিবেলায় তখনো জ্বলে নি দীপ,
পরিতেছিলাম কপালে সোনার টিপ--
কনকমুকুর হাতে লয়ে বাতায়নে
বাঁধিতেছিলাম কবরী আপনমনে।
হেনকালে এল সন্ধ্যাধূসর পথে
করুণনয়ন তরুণ পথিক রথে।
ফেনায় ঘর্মে আকুল অশ্বগুলি
বসনে ভূষণে ভরিয়া গিয়াছে ধূলি।
শুধালো কাতরে "সে কোথায়! সে কোথায়!'
ক্লান্ত চরণে আমারি দুয়ারে নামি--
শরমে মরিয়া বলিতে নারিনু হায়,
"শ্রান্ত পথিক, সে যে আমি, সেই আমি!'

এই অংশের গুলজার কৃত অনুবাদ-  

‘যব সরহানে বুঝ গয়া থা রাত ভর জ্বলকে দিয়া
আউর চিড়িয়োঁ কি চহকনে সে ম্যায় জাগি
আলসি কদমো মে আ বৈঠি ম্যায় খিড়কি পর
কেশ খুলে অপনি বালো মে লগা কর তাজা বেল। 
সুবহ কি হলকি গুলাবি কোহরেমে গুজরি মুসাফির রাস্তেসে।
মোতিয়ো কি মালা পহনে
ধুপ কি কিরনে চমক তি থি মুকুট পর।
মেরে দরওয়াজে মে আকে পুছা ওহ শৌক সে
‘ওহ কঁহা হ্যায়  ওহ কঁহা হ্যায়’
ম্যায় হি মারে শরম কে কহ না সকি   
‘ম্যায় ওহি হুঁ মেরে মুসাফির
ম্যায় ওহি হুঁ ’
গোধুলি কা ওয়ক্ত থা ওহ 
অউর জ্বলা না থা দিয়া
বেদিলি সে অপনি কেশ বাঁধে শ্যাম কি শুরখি রথ পর
লৌট কর আয়া মুসাফির
ঝাগ উড়তি থি বহত ঘোড়ে কি মুখ সে
গর্দ সে কপড়ে অঁটে থে
ওহ উতর কর আয়ে মেরে দরোয়াজে পে আয়া
অউর থকে আওয়াজ মে পুছে
ওহ কঁহা হ্যায়   কঁহা হ্যায় ওহ
ম্যায় হি মারে শরম কে কহ না সকি  
‘ম্যায় ওহি হুঁ মেরে মুসাফির
ম্যায় ওহি হুঁ ’।

এই অনুবাদ কেমন হয়েছে সেটা বই ছাপা হয়ে বেরোনোর পরে পণ্ডিতেরা বিচার করবেন। তবে আপাতত আমার মনে হয়েছে এই অনুবাদের ধরনে মূল কবিতাটি যেমন ঘোমটার আড়াল থেকে উঁকি মেরেছে তেমনি চেনা যাচ্ছে গুলজারের নিজের লিখনশৈলীটিও, যা হয়ত নতুন প্রজন্মের বাংলা-না-জানা পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথকে আরো একটু কাছাকাছি এনে দিতে পারে।        


লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী। বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।