দুনাগিরির লাহিড়ী গুম্ফা
দীপক সেনগুপ্ত
দশম শ্রেণীতে পড়বার সময় আমার এক সহপাঠী বাবলু বিকেলে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসত। দু’জনে কাছাকাছি খানিকটা বেড়িয়ে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসতাম। তখন আমি উত্তরবঙ্গের দিনহাটা হাই স্কুলে পড়ি। ফাঁকা জমি পেলেই একটা বহুতল বাসস্থান গড়ে ফেলার ‘নির্মাণ শিল্প’ তখনও আবিষ্কৃত হয় নি। দিনহাটা মহকুমা হলেও শহর হিসাবে খুব বড় ছিল না। লোকালয়ের একটু দূরে গেলেই বাড়ি ঘরের সংখ্যা এবং কোলাহল ক্রমশ: কমে আসত, দেখা মিলত রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছের। এরকমই কোন একটা রাস্তা ধরে আমরা হাঁটতাম। এলোমেলো বিষয় আলোচনার মাঝে একদিন বাবলু আমাকে জিজ্ঞেস করল –“তুমি ‘ভারতের সাধক’ বইটা পড়েছ ?” ছোটখাটো মিথ্যে বলাটা তেমন দোষের নয় ধরে নিয়ে বললাম-“পড়েছি।” পরের প্রশ্ন – “ত্রৈলঙ্গ স্বামীর জীবনীটা আশ্চর্যজনক না ? প্রায় আড়াইশো’ বছর বেঁচেছিলেন।” আমি সংক্ষিপ্ত “হ্যাঁ” বলে সে প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে এলাম। আলোচনা দীর্ঘ হলে মিথ্যার আবরণ সরে গিয়ে সত্যিটা বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা প্রবল।
সাধু-সন্তদের জীবন বা তাদের নানা যৌগিক ক্রিয়াকলাপে আমার যে অনাগ্রহ ছিল এমন নয়। একবার ফাইভ-সিক্সে পড়বার সময় কোন এক প্রতিবেশী ভদ্রলোক বাবার কাছে এসে নানা বিষয়ে গল্প করতেন। একদিন তাদের আলোচনায় শুনেছি লোকনাথ ব্রহ্মচারীর অদ্ভুত কাহিনী। একবার তিনি ট্রেনে চেপে তার এক শিষ্যকে কোন স্থানে যেতে বলায়, শিষ্য প্রশ্ন করেন –“আপনি যাবেন না ?” লোকনাথেরও সেখানে যাবার কথা ছিল। তিনি শিষ্যকে বলেন –“তুমি যাও, আমি ঠিক পৌঁছে যাব।” চলন্ত ট্রেনের জানালার বাইরে হঠাৎ শিষ্যের দৃষ্টি পড়ে; তিনি দেখতে পান তার গুরু আকাশপথে ভেসে ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গেই চলেছেন। শিষ্যটি যথাস্থানে পৌঁছে দেখতে পান, গুরু সেখানে আগেই পৌঁছে বসে আছেন।
ছোটবেলায় আমি ছিলাম বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ ভক্ত। কম্প্যুটারের নাম তখন শোনা যায় নি, টেপ রেকর্ডার সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বাড়িতে একটা পুরানো যুগের গ্রামোফোন ছিল। সেটা ছিল একটা বিস্ময়কর বস্তু। একটা ঘূর্ণায়মান চাকতির সঙ্গে পিনের স্পর্শে ও সংঘর্ষে কি করে একজন ব্যক্তির কণ্ঠস্বর বারবার অবিকল ফিরে আসে, সেটাই তখন মহা আশ্চর্যের বিষয় বলে মনে হত। দূরের কথাবার্তা অদৃশ্যপথে কোন জাদুবলে রেডিও নামক বাক্সের ভিতর থেকে নির্গত হয় সেটা ছিল আর এক বিস্ময়। এসব যারা আবিষ্কার করেছেন সাধক শ্রেণীর সেই সব জ্ঞান তপস্বীদের অন্য জগতের মানুষ বলে মনে হত। এ সত্ত্বেও আপাতভাবে ব্যাখ্যার অতীত কোন ঘটনার অস্তিত্বে অবিশ্বাস কখনো ছিল না, আজও নেই। এসবের পিছনেও কারণ অবশ্যই আছে, তবে তা প্রথাগত বা চর্চিত বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু থেকে পৃথক।
যাই হোক, ‘ভারতের সাধক’ বইটির কথা মনের মধ্যে ছিলই। আই. এস. সি পরীক্ষার পর সেকালের গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স নামক বিখ্যাত বইয়ের দোকানের একপাতা জোড়া এক বিজ্ঞাপন কোনো পত্রিকায় দেখে আড়াই টাকা পকেটে নিয়ে সেই দোকানে গিয়ে হাজির হলাম। এখনকার বিবেকানন্দ রোড ও বিধান সরণির মোড়ে দোকানটা ছিল। বহু দিনের ঐতিহ্যবাহী পুস্তক বিক্রেতার দোকানটা এখন আর নেই। অনেক দিন হল উঠে গিয়েছে। ‘ভারতের সাধকে’র প্রথম খণ্ডটি সেখান থেকে কিনলাম। বইটি কিনতে গিয়ে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল, তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ, এখানে সেটা আর টেনে আনতে চাই না। প্রথম খণ্ডে যাদের জীবনী ছিল তারা হলেন – শ্রী ত্রৈলঙ্গ স্বামী, যোগীরাজ শ্রী শ্যামাচরণ লাহিড়ী, যোগীবর গম্ভীরনাথজী, স্বামী ভাস্করানন্দ সরস্বতী, শ্রী রামদাস কাঠিয়াবাবা, বামা ক্ষ্যাপা, বালানন্দ ব্রহ্মচারী ও স্বামী নিগমানন্দ। বইটি এখন আর আমার কাছে নেই। গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের দোকানের মতই বহু দিন হল সেটা অন্তর্হিত হয়েছে।
সাধু সন্তদের জীবন তো স্বেচ্ছায় ত্যাগ তিতিক্ষা বরণের মাধ্যমে মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হবার প্রয়াসে নিরন্তর অনুশীলন। বিচ্ছেদ বেদনামুক্ত এক আনন্দময় অবস্থা লাভের অমোঘ আকর্ষণে আপাত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের হাতছানি উপেক্ষা করে তাদের যে এই যাত্রা, জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েও অভীষ্ট লাভ তাদের অনেকের কাছেই অধরা থাকে। এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষায়তনে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলে সকলেই কি সফলতার শীর্ষে পৌঁছোতে পারে ? তবু ত জ্ঞানান্বেষণ কোন দিন থেমে থাকে নি। যুগ যুগ ধরে ভূমার আকর্ষণে মানুষের এই মনন স্পৃহা অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
সে যুগের সাধু সন্ন্যাসীদের মধ্যে দুটি শ্রেণীর দেখা মেলে। এক শ্রেণীর সাধক সংসার ত্যাগ করে কোন সিদ্ধ পুরুষের উপদেশ অনুসারে সাধনা করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। অনেকে আবার এই সংসারাশ্রমে থেকেই শত আকর্ষণ ও বিক্ষেপ উপেক্ষা করে অবিচল থেকে যোগাভ্যাসের মাধ্যমে মায়াতীত সেই স্বত্বার সন্ধান লাভ করেছেন। এরকমই একজন যোগী ছিলেন শ্যামাচরণ লাহিড়ী। একবার তিনি ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে সাধারণ বাঙালির বেশে বারাণসীর গঙ্গার ঘাটে মহাত্মা ত্রৈলঙ্গ স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যান। ত্রৈলঙ্গ স্বামী তখন সবার কাছে কাশীর ‘সচল বিশ্বনাথ’ নামে অভিহিত। দুপুরের প্রখর রৌদ্রে তেতে ওঠা বালিতে পা রাখে কার সাধ্য। স্বামীজী সেই বালির উপরেই নিশ্চিন্তে শুয়ে আছেন। কখনো বা তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেসে বেড়ান বারাণসী গঙ্গার পুণ্য সলিলে। দূর থেকে শ্যামাচরণকে আসতে দেখে মৌনী স্বামীজি উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানান। কিছুক্ষণ পরে লাহিড়ী মশায় বিদায় নিলে উপস্থিত ভক্তরা, যারা স্বামীজীকে বিশেষ নড়াচড়া করতে দেখেন না, স্বামীজীর কাছে জানতে চান, কে এই ব্যক্তি যাকে তিনি এমন ভাবে অভ্যর্থনা জানাতে উঠে দাঁড়ালেন। স্বামীজীর উত্তর – “ যোগ সাধনাকি যিস উন্নতি করনেকে লিয়ে সাধকোঁকো লঙোটিতক ছোড়নী পড়ি হ্যায়, গৃহস্থীনে রহতে হুয়েভী ইস পুরুষনে উস পদবীকো প্রাপ্ত কর লিয়া।” অর্থাৎ যোগ সাধন পথে যে উন্নতি করবার জন্য সাধককে নেঙটিটি পর্যন্ত ছাড়তে হয়, গৃহস্থাশ্রমে থেকেই এই ব্যক্তি সেই অবস্থায় উপনীত হয়েছেন। শ্যামাচরণ লোকচক্ষুর অন্তরালে নিভৃত বাস করতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু এই ঘটনার পরেই তার নাম কাশীর সাধক সমাজে ও বিদগ্ধ মহলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
শ্যামাচরণের অধ্যাত্ম জগতে প্রবেশের কাহিনী যেমন বিস্ময়কর তেমনি চমকপ্রদ। জীবনের ত্রিশ বছর বয়সেরও বেশি সময় পর্যন্ত যোগ শিক্ষা বা সাধনা সম্বন্ধে বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল বলে জানা যায় না। ১৮২৮ খৃষ্টাব্দের ৩০শে সেপ্টেম্বর (১৬ই আশ্বিন, ১২৩৫ বঙ্গাব্দ) নদীয়া জেলার ঘূর্ণি গ্রামে খোড়ে নদীর তীরে এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ পরিবারে তার জন্ম। পিতা ছিলেন গৌর মোহন লাহিড়ী সরকার ও মাতা মুক্তকেশী দেবী। শ্যামাচরণের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর এক বিধ্বংসী বন্যায় তাদের ঘর বাড়ি ও ভূসম্পত্তি বিনষ্ট হওয়ায় তার বাবা সপরিবারে কাশীবাসি হন এবং গড়ুরেশ্বর পল্লীতে বাস করতে শুরু করেন। কিছুকাল পরেই শ্যামাচরণের মাতৃবিয়োগ হয়। গড়ুরেশ্বর মন্দিরের সন্নিহিত পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ শেষ করে শ্যামাচরণ জয়নারায়ণ ঘোষাল প্রতিষ্ঠিত ইংরাজি স্কুলে ভর্তি হন। তিনি যত্নের সঙ্গে ইংরাজি, হিন্দি, উর্দু, পার্সি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। নাগভট্ট নামে এক মহারাষ্ট্রীয় পণ্ডিত তাকে বেদ ও উপনিষদ সম্বন্ধে শিক্ষা দান করেন। সংস্কৃতে বিশেষ বুৎপত্তি অর্জন করেন দেবনারায়ণ বাচস্পতি মহাশয়ের সহায়তায়। বাচস্পতি মহাশয় শ্যামাচরণের বুদ্ধি ও জ্ঞানস্পৃহায় মুগ্ধ হয়ে তার নিজের কন্যা কাশীমণি দেবীর সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাব দেন ও পিতার সম্মতি ক্রমে আঠারো বছর বয়সে শ্যামাচরণের বিবাহ হয় ও তার কয়েকটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে।
১৮৫১ খৃষ্টাব্দে উত্তর প্রদেশের (তখন সংযুক্ত প্রদেশ) দানাপুর সামরিক পূর্তবিভাগে কেরানীর পদে যোগদান করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন শ্যামাচরণ। এর বছর খানেক পরে তার পিতার মৃত্যু হয়। শ্যামাচরণ তখন ২৪ বছরের যুবক।
১৮৬১ খৃষ্টাব্দে রাণীক্ষেতে একটি সেনানিবাস নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এখানেই দানাপুর থেকে শ্যামাচরণ বদলি হয়ে আসেন। কাজের চাপ খুব একটা ছিল না। অবসর সময়ে শ্যামাচরণ তার সহকর্মী ও কুলী মজুরদের সঙ্গে গল্প করে কাটাতেন, তাদের খোঁজ খবর নিতেন। দিকচক্রবালে অর্ধবৃত্তাকারে ব্যাপ্ত সারি সারি বরফাচ্ছাদিত পর্বত শৃঙ্গ অস্তমিত সূর্যের রঙিন আভায় যখন অপরূপ সৌন্দর্য ধারণ করত, তখন শ্যামাচরণ স্বপ্নাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। জনবিরল এই পার্বত্য স্থানের নির্জনতা ও বৈরাগ্যময় পরিবেশ তাকে উদাস করে তুলত। অদূরেই দুনাগিরি পাহাড়। দূরত্ব মাত্র পনেরো মাইল। এখানে নাকি অনেক সাধু সন্তদের বাস। তাদের জীবনের অলৌকিক ঘটনার নানা কাহিনী লোকের মুখে মুখে আলোচিত হয়ে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে। শ্যামাচরণের ইচ্ছা একবার পাহাড়টা ঘুরে আসে। একদিন অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে বেরিয়ে পড়েন ; আঁকাবাঁকা চড়াই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা পাহাড়ের পাদদেশে এসে পৌঁছে যান তিনি। এই কি সেই দুনাগিরি ? জনহীন স্থানে জিজ্ঞাসা করে জানার মত কোন লোক নেই। কি করণীয় বুঝতে না পেরে শ্যামাচরন যখন ইতস্তত করছেন তখন শুনতে পান কে যেন তার নাম ধরে ডাকছেন – “শ্যামাচরণ, শ্যামাচরণ লাহিড়ী।” আশ্চর্য! এই অজানা স্থানে কে তার নাম ধরে ডাকে ? রাণীক্ষেত থেকে এত দূরে নির্জন এই প্রদেশে কারো ত তাকে চিনবার কথা নয়। কিছুদূরে হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ে, এক জটাজূটধারী উজ্জ্বলতনু সন্ন্যাসী সেখানে দণ্ডায়মান। অধরে মৃদু হাসি, উদ্ভাসিত মুখমণ্ডল; সমস্ত অবয়ব থেকে যেন অপার শান্তির আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সন্ন্যাসী ইঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করতে বলে পাহাড়ের ওপরে এক গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন। সেখানে একটি আসন পাতা, পাশে কমন্ডুল। ধীর স্নেহসিক্ত স্বরে সন্ন্যাসী বলেন – “শ্যামাচরণ, আমিই তোমাকে ডাকছিলাম। খুব আশ্চর্য হয়ে গেছ তাই না ? ভেবে দেখ ত তুমি আমাকে আগে কখনও দেখেছ কিনা। এই গুহাটিও কি তোমার পরিচিত ?”
শ্যামাচরণ বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কে ইনি ? এনাকে তো তিনি কোন দিন দেখেন নি। এ স্থানটিও তো সম্পূর্ণ অপরিচিত। এবার সন্ন্যাসী এগিয়ে এসে তার ডান হাতের অঙ্গুলি দিয়ে শ্যামাচরণের মেরুদণ্ডটি একটু স্পর্শ করলেন। সহসা যেন চেতনার অন্য একটি জগত শ্যামাচরণের কাছে উন্মীলিত হল। তিনি বুঝতে পারলেন এই সন্ন্যাসী তার পূর্বজন্মের গুরু। এই স্থান ও গুহাটিও তার অপরিচিত নয়। তিনি শ্রদ্ধাভরে লুটিয়ে পড়লেন যোগী পুরুষের পায়ে। আশীর্বাদ করে সন্ন্যাসী জানালেন – “শ্যামাচরণ, বিগতজন্মে সাধনার উচ্চ মার্গে অবস্থান কালে তোমার দেহাবসান হয়। এই গুহাটিই ছিল তোমার সাধনস্থল। এই আসন কমন্ডুল তোমারই ব্যবহৃত জিনিস। এত বছর ধরে আমি এগুলি আগলে এসেছি। যেখানে তুমি ছেড়ে এসেছিলে সেখান থেকেই তোমাকে সাধনা শুরু করতে হবে। পৌঁছোতে হবে উপলব্ধির শেষ সীমায়।”
সময় নষ্ট না করে গুরুদেব শ্যামাচরণকে তৈলাক্ত কোন একটি জিনিস তার হাতে দিয়ে পান করতে বলেন। পাহাড়ের নীচেই বয়ে চলেছে গগাস নদী। আদেশ হল, তার তীরে গিয়ে শ্যামাচরণকে শুয়ে থাকতে হবে। আদেশ পালিত হল। কিছুক্ষণ বাদেই শুরু হল ভেদবমি। শ্যামাচরণের অসাড় শরীরটা নদীর স্রোতে ভেসে চলল। অনেক কষ্টে তীর আঁকড়ে ধরে নিস্তেজ অবস্থায় তিনি গুরুর কাছে এসে উপস্থিত হলেন। গুরুদেব প্রফুল্ল বদনে বললেন – “ ভালই হয়েছে। শরীর ও মনের সব গ্লানি ধুয়ে মুছে গেছে। এবার দীক্ষাদানের পালা।” গরম গরম পুরী ও হালুয়া খেয়ে শ্যামাচরণ তার হৃত বল ফিরে পান। এর পরে তার দীক্ষা সমাপ্ত হয়।
গুহা থেকে মাইল পাঁচেক দূরে এক জীর্ণ দেবালয়। সেখানে নাকি মাঝে মাঝে সিদ্ধ যোগী ও মহাপুরুষদের আগমন হয়। এই মন্দিরটি অশ্বত্থামার মন্দির বলেও খ্যাত। চিরজীবী অশ্বত্থামার কখনো কখনো এখানে আগমন ঘটে বলেও জনশ্রুতি। একদিন রাত্রিবেলা গুরুদেব শ্যামাচরণকে এক মহাপুরুষের দেহজ্যোতিও দর্শন করান।
শ্যামাচরণের গুরুদেবের পূর্ব ইতিহাস বিশেষ কিছুই জানা যায় না। ‘বাবাজী মহারাজ’ নামেই তিনি শিষ্য ও সাধক মহলে পরিচিত। দীক্ষা লাভের পর কিছুদিন শ্যামাচরণ বাবাজী মহারাজের সান্নিধ্যে কাটান। এই সময় অলৌকিক কিছু ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন শ্যামাচরণ। এক সকালবেলা কয়েকজন গুরুভ্রাতার সঙ্গে তিনি শৌচাদি কর্মে বাহির হন। গগাস নদীটি ছিল তখন প্রায় জলশূন্য। কিন্তু ফেরার পথে সেই নদীই হড়পা বানে খরস্রোতা হয়ে ওঠে। পার হওয়াটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এক গুরুভ্রাতা সেই সময়ে এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসেন। মাথার পাগড়িটা খুলে নদীতে জলের ঊপর ছুঁড়ে দেন। ভেসে না গিয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে সেটি আড়াআড়ি ভাবে স্রোতের জলে স্থিত হয়। সেটি ধরেই তিনি সবাইকে নদী পেরোতে বলেন। এই ঘটনাটি সম্বন্ধে পরবর্তী কালে গুরুর কাছে বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনি উত্তর দেন – “ এতে আশ্চর্য হবার তো কিছু নেই। অষ্ট সিদ্ধি পেয়েছে বলেই তোমার গুরুভ্রাতা এটা করতে পেরেছে। আমার নির্দেশিত সাধন পথে অগ্রসর হ’লে তুমিও শীঘ্রই এই ক্ষমতার অধিকারী হবে।”
অপর একটি অলৌকিক ঘটনারও উল্লেখ পাওয়া যায়। একবার এক ভক্ত শিষ্য জনৈক শেঠ বাবাজী মহা্রাজকে কোন এক উপলক্ষ্যে নিজ ভাসভবনে নিমন্ত্রণ করেন। শেঠ ভক্ত হলেও তিনি নিজেকে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি বলে মনে করতেন। ধনাভিমান ছিল তার প্রবল। যথা সময়ে ‘তরুণ শিষ্য’কে সঙ্গে করে বাবাজী মহারাজ নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে শেঠের ভবনে হাজির হন। খাতির যত্ন করে তাদের অভ্যর্থনা করে খাবার পরিবেশন করা হয়। কিন্তু মিতাহারী বাবাজী মহারাজের আজ যেন সর্বগ্রাসী ক্ষিদে পেয়ে বসেছে। কিছুতেই তিনি তৃপ্ত হচ্ছেন না। চাঙাড়ি ভর্তি পুরী মালপোয়া মন্ডা মেঠাই সব আসছে, কিন্তু মুহূর্ত মধ্যে সেসব গলাধকরণ করে তিনি বলছেন –“অওর কুছ ?” দেখতে দেখতে অন্যান্য অতিথিরাও নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে হাজির, কিন্তু খাবারের ভান্ডার প্রায় নিঃশেষিত হয়ে এসেছে। এই অবস্থায় শ্যামাচরণই এগিয়ে এসে বললেন – “গুরুজী, আপনি করছেন কি। শেঠজীর ত সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনি শীঘ্র উঠে পড়ুন।” বাবাজী মহারাজ উঠে বললেন – “ সামান্য ক্ষমতা, অথচ অহঙ্কার কত!” বলা বাহুল্য এই ঘটনা শেঠজীর আত্মাভিমানে প্রবল আঘাত হানে। তিনি আর কখনও দাম্ভিকতা দেখান নি। ভক্তের অহমিকা চূর্ণ করে তাকে সঠিক পথে চালনা করাই ছিল বাবাজীর উদ্দেশ্য।
এতদিন শ্যামাচরণের কর্মক্ষেত্র রাণিক্ষেতেই ছিল। মাঝে মাঝে তার সঙ্গে গুরু বাবাজী মহারাজের সাক্ষাতের কোন অসুবিধা ছিল না। একদিন গুরু তাকে বললেন – “ শ্যামাচরণ, এবার তোমাকে তোমার পূর্বের কর্মক্ষেত্র দানাপুরেই ফিরে যেতে হবে। খুব শীঘ্রই ওপরওয়ালার চিঠি তুমি পাবে। তোমার এখানে আসার আদেশ ভুলক্রমে জারি হয়েছিল। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই এটা হয়েছে। তোমার দীক্ষাপর্ব শেষ। এবার ফিরে গিয়ে আমার নির্দেশ মত ক্রিয়াযোগ অভ্যাসে রত হও।” শ্যামাচরণের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। করুণ স্বরে গুরুকে সে জানাল – “গুরুদেব আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে চাই না। এ কঠিন আদেশ আপনি আমাকে করবেন না।” গুরুজী উত্তরে বলেন – “শ্যামাচরণ, তোমাকে আমি যা বলার তা বলেই দিয়েছি। এবার একাগ্র ভাবে তোমার নিজের সাধনায় লেগে পড়। মনে রেখো লোককল্যাণে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করার জন্যই তোমাকে কাজ করতে হবে। অনেকেই ভাবে সংসার পরিত্যাগ না করলে অধ্যাত্মমার্গে অগ্রসর হওয়া যায় না। কিন্তু সংসারাশ্রমে থেকেও যে ঈশ্বরলাভ সম্ভব, এই গুরুত্বপূর্ণ আদর্শটি তোমাকে তুলে ধরতে হবে। তোমাকে দেখে অনেক সংসারী লোক সাধন পথের পথিক হতে ইচ্ছুক হবে। তাদের কাছে ক্রিয়াযোগের আদর্শ প্রচার এবং আগ্রহী ব্যক্তিদের উপদেশ সহকারে ক্রিয়াযোগ সাধন পদ্ধতি ব্যাখ্যা করে যোগমার্গে তাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করাই হবে তোমার লক্ষ্য। চিন্তা কোরো না, প্রয়োজন মত মাঝে মাঝে আমি তোমাকে দর্শন দেব।”
কয়েক দিন পর সত্যিই শ্যামাচরণের দানাপুরে ফিরে যাবার আদেশনামা এসে পৌঁছোয়। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিরুপায় শ্যামাচরণ গুরুকে প্রণাম করে দানাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। গুরুর নির্দেশিত পথে নিয়মিত ক্রিয়াযোগ অভ্যাসের দ্বারা অধ্যাত্মমার্গে ক্রমে তিনি উচ্চ থেকে উচ্চতর সোপানে আরোহণ করেন। শ্যামাচরণের সাধক জীবনে বহু অলৌকিক ঘটনার সমাবেশ দেখা যায়। একটি মাত্র উল্লেখ করা যাক। দানাপুরের অফিসে উদাসীন ও আত্মভোলা শ্যামাচরণকে অনেকেই ‘পাগলা বাবু’ নামে ডাকতেন। একদিন অফিসের এক বড় সাহেবকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে শ্যামাচরণ তার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন যে সাহেবের স্ত্রী বিলাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিৎসায় তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না ; এর জন্য সাহেব খুবই উদ্বিগ্ন, কোনো কাজেই মন বসাতে পারছেন না। শ্যামাচরণ তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন – “চিন্তা করবেন না, আমি এখনই আপনাকে খবর এনে দিচ্ছি।” সাহেব শুনে আশ্চর্য হন ; এখানে বসে শ্যামাচরণ কি করে বিলাতের খবর নিয়ে আসবেন ? পাগলাবাবুর পাগলামিতে তিনি খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না। শ্যামাচরণ অফিসের এক ফাঁকা কামরায় গিয়ে ধ্যানস্থ হলেন এবং কিছু পরে সাহেবকে এসে জানালেন – “ আপনার স্ত্রী ক্রমশ: সুস্থ হয়ে উঠছেন এবং তিনি খুব শীঘ্রই নিজের হাতে আপনাকে চিঠি লিখবেন।” সাহেব শুনে আশ্চর্য হন ; এত তাড়াতাড়ি পাগলবাবু কি করে করে খবর নিয়ে এলেন ? কি করেই বা তিনি জানলেন যে তার স্ত্রী তাকে চিঠি লিখবেন !” অসম্ভব জেনেও পাগলা বাবুর কথায় কোথাও যেন তিনি একটা আশ্বাস খুঁজে পান। মনটা তার কিছুটা শান্ত হয়। কিছুদিন পরে সত্যিই স্ত্রীর চিঠি এসে পৌঁছোয় ; লিখেছেন – তিনি ভাল আছেন এবং ভারতে গিয়ে সাহেবের সঙ্গে দেখা করার পরিকল্পনাও তার আছে। অবশেষে এদেশে এসে সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন তিনি। একদিন সাহেবের অফিসে এসে শ্যামাচরণকে দেখে চমকে ওঠেন মেমসাহেব। সাহেবকে জিজ্ঞাসা করেন – “ইনি কে ? এখানে ইনি কি করে এলেন ? আমি তো ইংল্যান্ডে অসুস্থ অবস্থায় এনাকেই আমার শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। তার পরেই আমি ক্রমশ: সুস্থ হয়ে উঠি।” সাহেব ভারতের সাধু সন্ন্যাসীদের যোগৈশ্বর্যের কথা অনেক শুনেছেন। কিন্তু তারা তো পাহাড় পর্বতের গুহায় থাকেন। তার অফিসের পাগলা বাবু কি করে এই ক্ষমতার অধিকারী হলেন ?” বলা বাহুল্য পাগলা বাবুর এই যোগ বিভূতির কথা মুহূর্ত মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
শ্যামাচরণ লাহিড়ির জীবনকথা লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু মূল ঘটনা যখন তাকে কেন্দ্র করেই তখন তার জীবনের প্রাসঙ্গিকতা কিছুটা তো রয়েইছে। শ্যামাচরণকে উত্তরকালে অনেকেই ‘লাহিড়ীবাবা’ নামে উল্লেখ করেছেন। লাহিড়ীবাবার জীবনের আর একটি মাত্র ঘটনার উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গে ইতি টানবো। জীবনের শেষ দিকে তিনি প্রায়ই ধ্যানস্থ ও নির্লিপ্ত হয়ে কাটাতেন। একদিন তিনি তার বাড়ির কক্ষে সমবেত ভক্ত শিষ্যদের ধীর গম্ভীর কণ্ঠে ভগবদগীতার শ্লোক ব্যাখ্যা করছেন, এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে কান্নার স্বর ভেসে এলো। ক্রমশ: সে কান্না বেড়ে চলাতে শিষ্যরা শ্যামাচরণকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি শান্ত স্বরে উত্তর দেন – “আমার এক মেয়ে খুব অসুস্থ ছিল। হয় তো সে প্রাণত্যাগ করেছে, সৎকারের আয়োজন চলছে।” শিষ্যরা স্তম্ভিত। শ্যামাচরণ আবার অবিচলিত ভাবে গীতার ব্যাখ্যায় ফিরে গেলেন। অতঃপর শিষ্যদের অনুরোধে তিনি থামলেন, বললেন – “বেশ তো, তোমরা যদি না শুনতে চাও, তবে আজ থাক।”
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সাংখ্যযোগ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞের যে লক্ষণ আলোচিত হয়েছে তারই যথাযথ রূপটি সেদিন শ্যামাচরণের আচরণে প্রকট হয়ে ওঠে। তার মৃত্যুর দিনটি তিনি আগেই জানতেন। পৃষ্ঠদেশে কার্বাঙ্কলে আক্রান্ত হয়ে কাশীধামে নিজের বাড়িতে ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৮৯৫ খৃষ্টাব্দে (১০ই আশ্বিন ১৩০২) বৃহস্পতিবার মহাষ্টমীর সন্ধিক্ষণে যোগী শ্যামাচরণ যোগারূঢ় হয়ে দেহত্যাগ করেন।
আমদের মূল কাহিনীটা দুনাগিরি ও তারই কাছাকাছি শ্যামাচরণ লাহিড়ীর গুহাকে কেন্দ্র করে। অতএব এবার সেখানেই ফিরে আসা যাক।
আমি যে কলেজে পড়তাম সেই বি. ই. কলেজ ছিল সম্পূর্ণ আবাসিক। সবাইকে ছাত্রাবাসে থাকতেই হতো। দু’একজনের কথা বাদ দিলে কোন ছাত্র তার নিজের ছাড়া অন্য কোনো বিভাগের ছাত্রদের খুব একটা চিনত না। এমন কি ছাত্রসংখ্যা বেশি হলে নিজের বিভাগেরই সবার সঙ্গে পরিচয় হতো না। রাস্তায় যাতায়াতের সময় প্রতিদিন অনেককেই চোখে পড়ত। এদেরই মধ্যে একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সে সম্পূর্ণ উদাসীন ভাবে চলাফেরা করত। তার মুখমণ্ডলে একটা প্রশান্তির ছাপ ছিল যা সহজেই চোখে পড়ে। খোঁজ নিয়ে জানলাম সে হল প্রবীর নাথ। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি। ক্লাসের চাপে ও অন্যান্য ব্যস্ততায় তার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। পাশ করে বের হবার এক বছর পরেই আমি শিক্ষক হিসাবে নিজের কলেজেই যোগদান করি। সে সময়ে স্নাতকদের শিক্ষকতা করতে কোনো অসুবিধা ছিল না। চাকরিতে থেকেই শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়িয়ে নেবার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। এখানেই হঠাৎ প্রবীরের সঙ্গে দেখা। একদিন সে ভারত সরকারের ‘টিচার ট্রেইনি’ প্রকল্পে আমাদের বিভাগে যোগ দিতে এলো। তখনই আলাপ। কিন্তু তাকে পাওয়া ছিল খুব শক্ত। ক্লাসের সময়টি ছাড়া বাকি সময়তে সে থাকত না। দিনের পর দিন এটা হতে থাকায় বিভাগীয় প্রধান ও অন্যান্য প্রবীণ শিক্ষকেরাও এটা ভাল ভাবে নেয় নি। আমি তখন ক্যাম্পাসেই পোস্ট গ্রাজুয়েট হস্টেলের একটা কামরায় থাকি। স্নাতকোত্তর শ্রেণির ছাত্র ও নবাগত শিক্ষকদের বাসস্থান এখানেই নির্দিষ্ট ছিল। প্রবীরের জন্যও একটা কামরা বরাদ্দ হল। ভাবলাম কলেজের পর সন্ধ্যাবেলা হয় তো তাকে পাওয়া যাবে। কিন্তু সে সময়ে হয় সে থাকত না অথবা ঘর অন্ধকার করে সে কি করত সে ই জানে। কয়েকদিন তার দরজায় কড়া নেড়েছি, ঘুম ঘুম চোখে অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ঘর অন্ধকার কেন জিজ্ঞাসা করাতে বলত – “আর ভাই, অন্ধকারের জীব আমরা; অন্ধকারেই থাকি।” অনেক সময় ক্লাসের পরেই বেরিয়ে গিয়ে অনেক রাতে ফিরত, বলত – “আমি আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে যাই।” সে জায়গাটা কোথায় জিজ্ঞাসা করলে বলত – “এই হাওড়াতেই।”
সত্য কখনো চাপা থাকে না। একদিন একজনের কাছে শুনলাম প্রবীর এক মহাপুরুষের কাছে যাতায়াত করে। আমি একদিন একা পেয়ে প্রবীরকে সরাসরি প্রশ্ন করলাম ব্যাপারটা কি। অনেক কথার পর অবশেষে জানা গেল সে এক যোগীপুরুষের কাছে যোগদীক্ষা নিয়ে ক্রিয়াযোগ অভ্যাস করে। তার গুরু অনিলানন্দ মহারাজের আশ্রমটি ছিল হাওড়ার কদমতালায়। তার অনুসৃত ক্রিয়াযোগের পদ্ধতিটি ছিল শ্যামাচরণ লাহিড়ী প্রদর্শিত যোগধারারই অনুবর্তী। গুরু শিষ্য পরম্পরায় চলে এসেছে। পরে সেই আশ্রমে আমি অনেকবার গিয়েছি। গৌরবর্ণ দীর্ঘদেহী মহারাজের শ্বেতশ্বশ্রুসমন্বিত শান্ত সৌম্য চেহারা যে কোনো লোকেরই সশ্রদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। অনিলানন্দজির উদাসীনতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে তার নির্লিপ্ততার একটা প্রমাণ পেয়েছিলাম এক দিনের একটা ঘটনায়। একবার কৈলাস মানস সরোবর সংক্রান্ত একটা চলচ্চিত্র দেখাবার আয়োজন হয়েছিল সেই আশ্রমে। নির্বাক ছায়াচিত্রটি আশ্রমেরই এক প্রবীন শিষ্য তার অল্পবয়সে কৈলাস যাত্রার সময় ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। তার সেদিনের ভ্রমণসঙ্গী হিসাবে প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক অধুনাপ্রয়াত ভোলানাথ চক্রবর্তীও ছিলেন। বড় জোর জনা কুড়ি লোক দর্শক হিসাবে আশ্রমে সেদিন সমবেত হয়েছিল ছায়াচিত্রটি দেখতে। প্রবীরের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। শিষ্যদের অনুরোধে মহারাজ এসে দর্শকদের একপাশে পদ্মাসনে সোজা হয়ে বসলেন। কৈলাস মানসসরোবর ভ্রমণের ছবি, স্বভাবতই খুব নিবিষ্ট মনে আমি দেখছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার দৃষ্টি পড়ছিল কাছেই উপবিষ্ট মহারাজের উপর। এক ঘণ্টা ব্যাপ্তিকালের ছবিটি প্রদর্শনের সময় তিনি প্রায় কখনই সেটার দিকে তাকান নি, অর্ধ নিমীলিত নয়নে সারাক্ষণ স্থির হয়ে বসেছিলেন; সামান্য নড়াচড়াও তাকে করতে দেখিনি। এই মহাপুরুষের অযাচিত স্নেহও আমি পেয়েছিলাম। যাক সে কথা।
এবার আর এক জনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। প্রশান্ত নন্দী। পোস্ট গ্রাজুয়েট হস্টেলে থাকার সমেয়েই আলাপ। সেও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে টিচার ট্রেইনি প্রকল্পে ওই হোস্টেলেই একটি কামরায় ছিল। সরলতায় ভরা মুখ, অমায়িক ব্যবহার, সাধারণ বেশভূষা; প্রথম আলাপেই একাত্ম হয়ে ওঠার অসামান্য গুণ ছিল তার। কারো কোনো অসুবিধা হলে বা কেউ বিপদে পড়লে সে সব সময়ে হাজির। আই. এস. সি পড়েছিল বেলুড় বিদ্যাপীঠে। গৃহত্যাগীর পরিবারে জন্ম। দুই ভাই ও কাকা সন্ন্যাসী হয়ে সংসারাশ্রম ত্যাগ করেছেন। প্রশান্তর অবচেতন মনে এ বীজ উপ্ত থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপাত ভাবে প্রকট ছিল তার গণিত প্রীতি। অঙ্ক পেলেই সমাধান করতে বসে পড়তো। ব্যাবহারিক জীবনে সে ছিল আধা সন্ন্যাসী। যে কোয়ার্টার্সটি তার নামে বরাদ্দ ছিল, তার চাবি থাকত দরজার বাইরে প্রবেশ মুখে দেয়ালে বসানো ইলেকট্রিক মিটারের ছোট বাক্সটার ভিতর। ডালা খুললেই চাবিটা পাওয়া যেত। দরজা খুলে ঢুকলে সামনেই একটা টেবিল, তার উপর স্তূপীকৃত বই; কোন কোনটা ধূলি ধূসরিত। জামা প্যান্ট দড়িতে ঝুলত। সুরক্ষার প্রয়োজনে কোন আলমারি তার ছিল না। টাকা পয়সা সব টেবিলের ড্রয়ারেই থাকত, প্রয়োজন মত সেখান থেকে নিয়েই সে ব্যবহার করত। ব্রিটিশ আমলের প্রকাণ্ড সব বাড়ি, সেগুলিই একটু অদল বদল করে তৈরি হয়েছিল শিক্ষকদের বাসস্থান। এরকম চার কামরার একটা বাড়িতে সে থাকত। প্রয়োজন ছিল তার মাত্র একটির, বাকি সবগুলি ফাঁকাই থাকতো। উপর থেকে ঝোলানো বেশ কয়েক ফুট লম্বা একটা তারের প্রান্তে একটা বাল্ব লাগিয়ে সেটা দড়ি দিয়ে টেনে এনে খাটের সঙ্গে সংযুক্ত মশারি খাটানোর দণ্ডের সঙ্গে বেঁধে রাত্রিবেলা পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়েছিল। নিজস্ব সখ বলতে তার কিছু ছিল না। এরকম নির্বিকার নির্লিপ্ত আধা-সন্ন্যাসী মানুষ আমি আর দেখিনি।
পুজোর ছুটিতে প্রতি বছরই বেড়াতে যাওয়া একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উদ্যোগটা ছিল আমারই। সঙ্গে দু’চার জন থাকতই। তবে সঙ্গী হিসাবে প্রবীর ও প্রশান্ত ছিল আমার খুব প্রিয় কারণ, দু’জনেই অবিবাহিত, অতএব পিছুটান কম এবং তাদের সঙ্গে আমার মন ও মতের মিল ছিল যথেষ্ট।
প্রবীর বাবাজী মহারাজ ও শ্যামাচরণ লাহিড়ী অনুসৃত পথে ক্রিয়াযোগ অভ্যাস করায় মাঝে মাঝেই তার সঙ্গে বিভিন্ন সাধকদের সম্বন্ধে আলোচনা হত। অবশ্য তার সঙ্গে দেখা হবার সুযোগ ছিল খুবই কম, ক্লাস শেষ হলেই কলেজ ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ত। ক্লাস না থাকলে আসতই না। আমার ইচ্ছা হত দুনাগিরি (বা দ্রোণগিরি) পাহাড়ে গিয়ে শ্যামাচরণ লাহিড়ীর এক সময়ের তপস্যা স্থল সেই গুহাটা দেখে আসা। অল্প বয়সের উন্মাদনা ও অনভিজ্ঞতায় মনে হত সেখানে গেলেই হয় ত বহু সাধু সন্ন্যাসীর দেখা পাওয়া যাবে।
প্রবীর কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখাল না, তবে বলল খবর নেবে। নানা ঘটনাস্রোতে বিষয়টা সাময়িক ভাবে চাপা পড়ে গেলেও একেবারে ভুলে যাই নি। মধ্যে মধ্যে তাগাদা দিয়ে তাকে মনে করিয়ে দিতাম।
একদিন সে খবর আনল – রানীক্ষেত থেকে কিছুটা দূরে দ্বারাহাট (বা দোয়ারাহাট) নামে একটা জায়গা আছে, সেখানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে দ্রোণগিরির অবস্থান জেনে নিতে হবে।
১৯৭৫ সাল। দু’বছর আগেই কেদার-বদরী ঘুরে এসেছি। মূল মন্দির বা বিগ্রহের দর্শন ত আছেই, সেই সঙ্গে যাত্রাপথের অপরূপ সৌন্দর্য, সবুজ গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন পর্বত শ্রেণীর পাদদেশ ছুঁয়ে এগিয়ে চলা অলকানন্দা মন্দাকিনী ও ভাগীরথীর স্বচ্ছ নীল জলধারার অবিরাম কলস্রোত শিল্পীর তুলিতে আঁকা অপরূপ দৃশ্যপটের মতই মনকে আবিষ্ট করে রাখে। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও যাত্রী সংখ্যা এত বেশি ছিল না, এত বেশি সংখ্যক যাত্রীনিবাস ও হট্টগোল পরিবেশকে আবিল করে নি। অনেকের কাছেই দেব দর্শনের সঙ্গে যাত্রাপথও ছিল সমান উপভোগ্য।
এবার বেড়িয়েছি আমরা তিন জন। আমি, প্রবীর এবং অনিচ্ছা সহ প্রশান্ত। আমার এই শেষোক্ত বন্ধু চলাফেরা খুব একটা পছন্দ করত না, নেহাৎ উপরোধে ঢেঁকি গেলার মতই সে যেতে রাজি হয়েছে। কেদারনাথের পর বদরীনাথ দর্শন করে ফেরার পথে কর্ণপ্রয়াগে নেমে গেলাম। পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম এই কর্ণপ্রয়াগ অলকানন্দা ও পিন্ডার নদীর (অপর নাম কর্ণগঙ্গা) সঙ্গমস্থলে অবস্থিত একটি ছোট্ট সুন্দর পরিচ্ছন্ন জায়গা। কুন্তীপুত্র কর্ণ এখানেই তপস্যা করেছিলেন বলে কথিত আছে। এখানে উমা ও কর্ণের মন্দির রয়েছে। এখানেই কর্ণ সূর্যদেবের দর্শন লাভ করে অভেদ্য কবচ ও বর লাভ করেছিলেন। পিন্ডারী হিমবাহ থেকেই পিন্ডার নদীর সৃষ্টি। এই হিমবাহে যাবার অন্যপথ থাকলেও এখান থেকেও যাওয়া যায়।
কর্ণপ্রয়াগ থেকে ফেরার পথে দু’টি রাস্তা রয়েছে। একটি বহু পরিচিত তীর্থ যাত্রীদের ব্যবহৃত পথ , রুদ্রপ্রয়াগ, শ্রীনগর, দেবপ্রয়াগ হয়ে হৃষিকেশ গিয়েছে; অপরটির গতিপথ দেবপ্রয়াগ আদি-বদরী, দোয়ারাহাট হয়ে রানীক্ষেত। আমাদের যেতে হবে দ্বিতীয়টি ধারে। কর্ণপ্রয়াগ পৌঁছেছিলাম বেলা তিনটে নাগাদ। এতদিন পরে ঠিক মনে নেই, সম্ভবত পিপলকোঠিতে দুপুরের খাওয়ার জন্য বাস দাঁড়িয়েছিল।
কর্ণপ্রয়াগ তখন খুব বড় সহর ছিল না। কয়েকটা দোকান এবং কিছু প্রশাসনিক অফিস ঘর চোখে পড়ল। এতদিনে সহর নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়েছে, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে নগর জীবনের উপদ্রব। স্থানীয় এক দোকানের মালিকের সঙ্গে কথা বলে রাতে থাকার ব্যবস্থা করা গেল, একটা বড় ঘরে তিনজন শোয়ার জন্য তিনটে খাটিয়া এবং লেপ। সেই সঙ্গে আর একজন জুটে গেল, একজন স্থানীয় পাহারাদার। সে এসে আমরা কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাব ইত্যাদি জেনে নিয়ে বলল –“এ জায়গাটা এমনিতে নিরুপদ্রব, তবে দু’একটা ছিনতাই যে হয় না এমন নয়।। আপনারা বাইরে থেকে এসেছেন, তবে আমি সঙ্গে থাকলে রাতে ভয়ের কোন কারণ নেই।” খুব বিনীতভাবে সে জানাল, রাতে শোয়ার ব্যবস্থা সে নিজেই করে নেবে, শুধু বিকেলে চা-বিস্কুট ও রাতের খাওয়াটা অতিথি হিসাবে সে আমাদের সঙ্গেই খাবে। সে আমাদের আশ্বস্ত করে বলল যে রানীক্ষেতের বাস সকাল সাতটায় আসবে এবং সে পাঁচটা নাগাদ আমাদের ঘুম থেকে তুলে দেবে যাতে আমরা তৈরি হয়ে নিতে পারি।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটাতেই রাতের খাওয়া শেষ। পাহারাদার কিছুটা গল্প করে আমাদের পাশের ঘরে ঘুমোতে চলে গেল। এত তাড়াতাড়ি শুতে না গিয়ে আমরা বাইরে কিছুটা ঘুরে আসার জন্য বেরোলাম। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। অধিকাংশ দোকান পাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। কোন লোকের সাড়া শব্দ কোথাও নেই। সে রাতে শান্ত মৌন পরিবেশে পাহারের চূড়া ছাড়িয়ে ওঠা চাঁদের মায়াময় আলোয় দুই নদীর মিলিত স্রোতের রূপালী জলধারা এবং নিঃসৃত কলধ্বনি এক নৈসর্গিক পটভূমি সৃষ্টি করেছিল।
আমরা ভোর সারে পাঁচটাতেই উঠে পড়লাম। পাঁচটায় ঘুম থেকে তুলে দেবার ভরসা দিয়ে আমাদের অভিভাবক পাহারাদার তখনও লেপের নীচে অদৃশ্য। পৌনে সাতটায় বাস এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার এক কাপ গরম চা খেয়ে নিয়ে ঠিক সাতটায় বাস ছেড়ে দিল। বাসের আকারটা অন্যান্য সাধারণ বাসের চেয়ে একটু ছোট বলে মনে হ’ল। গাড়িতে আমরা তিনজন ছাড়া আর মাত্র দু’জন যাত্রী বসে আছে। রাস্তায় স্থানীয় আরও দু’চার জন উঠল। রাস্তাটা পাহাড়ের একটু উপরের দিকে উঠে গেছে। দূরে একটু নীচে ছেড়ে আসা কর্ণপ্রয়াগ চোখে পড়ল। ছিলাম মাত্র একটা বিকেল ও একটা রাত, তাতেই মনে হচ্ছে আমাদের অতি পরিচিত স্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এ জন্যই সাধু সন্তরা এক জায়গায় বেশি দিন থাকে না। বহতা পানি ও রমতা সাধুকে জাগতিক কোন আকর্ষণই বেঁধে রাখতে পারে না।
কর্ণপ্রয়াগ থেকে রানিক্ষেতের পথে আদি বদরির দূরত্ব ১৮ কিঃ মিঃ। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেলাম। এখানে পাশাপাশি বেশ কয়েকটি মন্দিরের সারি রয়েছে। মূল মন্দিরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন কালো পাথরে তৈরি তিন ফুট উঁচু বিষ্ণুমূর্তি। আদি গুরু শঙ্করাচার্য (৭৮৮ খৃঃ-৮২০ খৃঃ) মন্দিরের পরিকল্পনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। তবে তার তত্বাবধানেই মন্দির তৈরি হয়েছিল, না কি মন্দির আগেই ছিল তিনি তার সংস্কার সাধন করেছিলেন বলা শক্ত। কথিত আছে ভগবান বিষ্ণু সত্য ত্রেতা ও দ্বাপর যুগে এখানেই অধিষ্ঠিত ছিলেন, কলি যুগের শুরু থেকে তিনি বদরিনাথে চলে যান ; কলি যুগের শেষে তিনি ভবিষ্যৎ বদরিতে ভক্তদের পূজা গ্রহণ করবেন। আদি বদরি থেকে বদরিনাথ পর্যন্ত অঞ্চলটি বদরিক্ষেত্র বলে পরিচিত।
আদি বদরিতে আধ ঘণ্টার মত দাঁড়িয়ে বাস আবার চলতে শুরু করল। এখান থেকে দ্বারাহাটের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিঃ মিঃ। পথের অনেকটাই উৎরাই, এঁকেবেঁকে ক্রমশঃ নীচের দিকে নেমে গেছে। ড্রাইভার ইঞ্জিন বন্ধ করে শুধু ব্রেক আর স্টিয়ারিং ব্যবহার করেই বাসটাকে নামিয়ে নিয়ে চলল।
দ্বারাহাটে এসে পৌঁছলাম দুপুর ১২টা-১টা নাগাদ। পথে আর কোথাও বাস থেমেছিল কি না মনে নেই। গুটি কয়েক বাড়ি আর দোকান নিয়ে ছিল তখনকার দ্বারাহাট। পাকা বাড়ি একটাও ছিল না। আজ সেখানে হয়েছে একটা সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও তিনতারা হোটেল। কালের সঙ্গে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। পাহাড়ি অঞ্চলের ছোট ছোট গ্রাম, তা সে যতই প্রত্যন্ত স্থানে হোক না কেন, শিক্ষা স্বাস্থ্য ও অন্যান্য আধুনিক পরিষেবা যা শহরাঞ্চলে লভ্য সে সব থেকে চিরকাল বঞ্চিত থাকবে এটা হতে পারে না। তবু হিমালয়ের শান্ত নির্জন পরিবেশে, সহজ সরল জীবন যাত্রার প্রাত্যহিকতায় নগর জীবনের কোলাহল ও অন্যান্য দূষণের অনুপ্রবেশ কোথায় যেন বিসদৃশ ও বেমানান মনে হয়।
দ্বারাহাট স্টপেজে আমাদের নামিয়ে দিয়ে বাস রানিক্ষেতের দিকে চলে গেল। সামনেই একটা দোকান চোখে পড়ল। দোকানের মালিকের চেহারাটা সুন্দর, কোথায় যেন একটা আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে। ধারে কাছে কোন হোটেল আছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় পরিষ্কার ইংরাজিতে উত্তর দিল – “ There is no hotel here. Where are you coming from ? Why have you come here ?”
হিন্দিতে কথোপকথনে আমরা তিন জনেই সমান দক্ষ। অনেক কসরৎ করে তাকে বোঝাতে পারলাম, আমরা সেখানে গিয়েছি শ্যামাচরণ লাহিড়ীর গুহার খোঁজে। আমাদের গন্তব্যস্থল দুনাগিরি, আমাদের খবর অনুযায়ী তারই আশেপাশে কোথাও রয়েছে সেই গুহা। সে বলল – “ আমার জন্ম এখানেই। রানীক্ষেতে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেছি। শ্যামাচরণ লাহিড়ির কথা কখনও শুনিনি।” সামনের দিকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের উপরে একটা ছোট সাদা মন্দির চোখে পড়ে। সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়ের গায়ে সাদা রঙের মন্দিরটি বহুদূর থেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। সেটা কিসের মন্দির জিজ্ঞাসা করায় সে বলল –“ওটাই দ্বরাহাট। কিন্তু ওখানে আপনারা গিয়ে কি করবেন ? বিশেষ বিশেষ তিথিতে মন্দিরে পূজা হয়, লোক সমাগম হয়। কিন্তু এখন সেখানে কিছুই নেই। তবে দুনাগিরিতে যাবার বাস আছে, যে কোন সময় এসে পড়বে। সকালে একটা বাস ছিল, এখন একটা আসবে; ওখানে যাবার এই দু’টি মাত্র বাস সারাদিনে। যদি যেতেই হয় তবে ইচ্ছে করলে মালপত্র সব আমার দোকানের পাশের ঘরে রেখে যেতে পারেন। চিন্তার কোন কারণ নেই।”
সেই দোকানের মালিককে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হ’ল। তখন আর কিছু করারও ছিল না। দুপুরের খাওয়া হয় নি। লোকটি বলল, খাবার সে তৈরি করে দিতে পারে কিন্তু অন্তত ঘন্টাখানেক সময় লাগবে। বাস যে কোন সময় এসে পড়তে পারে, অতএব খাবার কথা ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। কিছু জিনিস অন্য দুটো সুটকেসে চালান করে দিয়ে একটার মধ্যে শুধু তিনটা কম্বল ভরে নিলাম। পাশের মিষ্টির দোকান থেকে কিছু মিষ্টি খেয়ে নেওয়া গেল, কিছু্টা সঙ্গে নিলাম অজানা ভবিষ্যতের পাথেয় হিসাবে। আশেপাশের অনেক লোককেই গুহার কথা জিজ্ঞাসা করেও কিছু জানতে পারলাম না। এখন বাসের অপেক্ষা।
অবশেষে বাস এলো, বেলা প্রায় তিনটার সময়। আগে জানা থাকলে আমরা অনায়াসেই দুপুরের খাওয়া সেরে নিতে পারতাম। দোকানের সেই মালিক আবার অভয় দিয়ে বলল –“আপনারা কোথায় যাবেন যান। চিন্তা করবেন না, আপনাদের যাবতীয় জিনিসপত্র আমার কাছে সুরক্ষিতই থাকবে।”
আমরা বাসে উঠে পড়লাম। সঙ্গে রইল শীতের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তিনটা কম্বল এবং ক্ষুৎপিপাসা মেটানোর জন্য কিছু মিষ্টি ও এক বোতল জল।
দ্বারাহাট থেকে দুনাগিরির দূরত্ব ১৬/১৭ কিঃ মিঃ। কিছুদূর প্রায় সমতলে যাবার পর রাস্তা চক্রাকারে ক্রমশঃ পাহাড়ের উপর উঠে গেছে। বাসের অন্য যাত্রীরা ছিল সব স্থানীয় লোক, কিছুদূরের মধ্যেই তারা সবাই নেমে গেল। শুধু আমাদের তিনজনকে নিয়ে বাস এগিয়ে চলল। রাস্তায় কোন ঘরবাড়ি বা লোকজন চোখে পড়ল না। জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের গা বেয়ে বাস এগিয়ে চলল। সে সময়ে ঐ সব অঞ্চল ছিল নিতান্তই জনবিরল।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে বাস এসে দাঁড়াল দ্বারাহাটে। আমাদের তিনজনকে নামিয়ে দিয়ে রাস্তা ধরে বাস চলে গেল কুকুচিনা গ্রামের দিকে, সেটাই শেষ স্টপেজ। যে ছোট সাদা মন্দিরটা দ্বারাহাটে পাহাড়ের নীচ থেকে চোখে পড়ছিল আমরা এখন তারই প্রায় প্রবেশ পথের সামনে দাঁড়িয়ে। দ্বারাহাট যদি একটা গ্রাম হয়, তা সেটা যত ছোটই হোক না কেন, তাহলে তার অবস্থান এখানে নয়; হয় ত পাহাড়ের আশেপাশে কোথাও। কারণ, মন্দিরের কাছে শুধু একটা চায়ের দোকান ও জনা তিনেক লোক ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। তারা সবাই ভদ্র চেহারার তিনজন শহুরে লোককে সুটকেস হাতে বাস সেখানে থেকে নামতে দেখে কিছুটা আশ্চর্য হ’ল, তারপর মন্দির দেখতে এবং একটা গুহার খোঁজে এসেছি শুনে বেশ খানিকটা হেসে নিল। তাদের একজন বলল – “আপনারা খোঁজ খবর নিয়ে আসেন নি ? এখন এই মন্দিরে কি আছে ? নবরাত্রিতে (?) এখানে প্রচুর লোক সমাগম হয়। এখন কিছুই নেই।” জিজ্ঞাসা করায় তারা আরও জানাল যে তারা শ্যামাচরণ লাহিড়ীর নাম কোনদিনও শোনে নি, গুহার খোঁজ ত দূরের কথা। লোকগুলোর বয়স ত্রিশের বেশি নয়। প্রচার না থাকলে তাদের মত বয়সে সেই নব প্রযুক্তির যুগে (তখন ট্রানজিস্টারের রমরমা) কোন সাধু সন্ত বা মহাপুরুষ সম্পর্কে অহেতুক কৌতুহলী হয়ে ওঠা নিতান্তই বেমানান। সে ব্যবস্থা অবশ্য এখন হয়েছে, সে সম্বন্ধে পরে আসছি।
তখন বিকেল প্রায় চারটা বাজে। দোকানে একটা বেঞ্চিতে বসে তিনজনে এক গ্লাস করে গরম চা খেয়ে নেওয়া গেল। বেলা পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা ক্রমশঃ নেমে আসছে বুঝতে পারলাম। দোকানদার রাতে কোথায় থাকবে জিজ্ঞাসা করায় জানাল দোকান বন্ধ করে এখনই তারা নীচে গ্রামে চলে যাবে। দোকানে খাবার বলতে একটা কাঁচের বয়ামে খান কয়েক বিস্কুট। দোকান ছেড়ে কিছুটা এগিয়ে আমরা মন্দিরের সীমানায় প্রবেশ করলাম। সিঁড়ি দিয়ে বেশ কয়েক ধাপ উঠে মদিরের চত্বর। যতদূর মনে পড়ে বাইরের বারান্দা দিয়ে চক্রাকারে মন্দিরের চার পাশে ঘুরে আসা যায়। মেঝেটা মোটামুটি পরিষ্কার ; বুঝলাম নিয়মিত ঝাড়ু দেবার ব্যবস্থা আছে। দরজা তালা দেওয়া থাকায় মন্দিরের বিগ্রহ কোন দেবতার বুঝতে পারলাম না। মন্দিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বহু দূরে পাহাড়ের নীচে সমতল ভুমিতে কিছু ঘর বাড়ি দেখা যাছে। কি করনীয় বুঝতে না পেরে মন্দির ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সমতল জমিতে এসে দাঁড়ালাম। রাতটা কোথায় কাটানো যায় সেটাই তখন চিন্তা। ফেরার বাস কাল ভোর সাতটায়। অনেক অ্যাডভেঞ্চার হয়েছে, এখন ফিরতে পারলে বাঁচি।
যা পরিস্থিতি তাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে মন্দির সংলগ্ন প্রশস্ত বারান্দায় রাতটা কাটানো ছাড়া কোন বিকল্প আছে বলে মনে হ’ল না। সেই শীতের রাত্রে প্রায় খোলা জায়গায় কম্বল গায়ে দিয়ে রাত কাটানোর পরিণাম যে শুভ নয় সেটা বোঝা যাচ্ছে। অন্য একটা দুশ্চিন্তা মাথায় ঢুকলো। সেই জনমানবহীন নির্জন পার্বত্য অরণ্যে রাত্রিবেলা কোন জন্তু জানোয়ারের যে আগমন ঘটবে না তারই বা নিশ্চয়তা কোথায় ?
এরকম নানা চিন্তায় যখন আমরা কার্যত প্রায় বিভ্রান্ত, তখন হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে সেখানে একটা লোকের আবির্ভাব ঘটল। নীচে তার গ্রাম থেকে উপরে আমাদের দেখতে পেয়ে পাহাড়ের পাশের ঢালু অংশটি বেয়ে উপরে এসে দাঁড়াবার জন্য মনে হয়েছিল সে যেন হঠাৎই উদয় হয়েছে। লোকটি স্থানীয়, মুখে সারল্যের স্পষ্ট ছাপ। আমাদের জিজ্ঞাসা করল – “আপনারা কোথা থেকে এই সময় এসেছেন?” আমরা শ্যামাচরণ লাহিড়ীর গুহা খুঁজতে এসেছি শুনে সে খুব আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল – “তিনি কে ?” বুঝলাম শ্যামাচরণের নামই সে কখনও শোনেনি, তার গুহার খবর ত দূরের কথা। তার কাছে জানতে চাইলাম ধারে কাছে কোনও সাধু সন্ন্যাসী থাকেন কি না। সরল বিশ্বাসে তার প্রত্যয়ী উত্তর – “হিমালয় ত সাধুদেরই বাসস্থান, তবে তারা ত লোকালয়ে আসেন না।” সাধুদের খবর দেবার থেকে সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল রাতে আমরা কোথায় থাকব এবং কি খাব সেই চিন্তায়। সে বলল, আমরা নির্দ্বিধায় পাহাড়ের নীচে গ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারি, খাবারের ব্যবস্থাও সে করতে পারে।
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সেই পড়ন্ত আলোয় পাহাড়ের গা বেয়ে আঁকাবাঁকা পথ ধরে তার বাড়িতে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে আবার পরদিন সকালে উঠে আসা কোনটাই আমাদের মনঃপুত হল না। খেতে আর আরাম করে ঘুমোতে ত আমরা সেখানে যাই নি। তা ছাড়া তাকে গ্রামে পাঠিয়ে তিনজনের খাবার আনাতে গিয়ে তাকে ও তার বাড়ির লোকদের বিব্রত করাটাও সঙ্গত বলে মনে হল না। সে বুঝতে পেরে বলল – “বাইরে আপনারা রাত কাটাতে পারবেন না, আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।” সে আমাদের মন্দিরের একটু নীচে পাহাড়ের গায়ে তিনটি গুহা দেখিয়ে দিল। গুহা গুলি আগে আমাদের চোখে পড়ে নি কারণ, এদিকিটাতে আমরা আসি নি। তিনটির মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত একটু বড়, তিনজনে কোন রকমে শোয়া যাবে বলে মনে হ’ল। অন্য দুটির মেঝেতে পুরানো খড় বিছানো, হয়ত আগে কেউ এসে থেকেছিল। লোকটি বলল – “আপনারা রাতে এরকম ভাবে থাকতে পারবেন না, এখুনি মশার আক্রমণ শুরু হবে। আমি আপনাদের কিছু কাঠ এনে দিচ্ছি, সেগুলি জ্বালালে গুহাটাও গরম হবে, মশার অত্যাচারও কম হবে।”
লোকটি দ্রুত নীচে নেমে গেল। কিছু পরেই বেশ কিছু শুকনো কাঠ বয়ে নিয়ে এসে কয়েকটা জ্বালিয়ে গুহাতে রেখে বিনীত ভাবে সে বিদায় নিল। তার সঙ্গে আর কখনো দেখা হয় নি। তার অমায়িক ব্যবহার, আন্তরিকতা ও অযাচিত উপচিকীর্ষা চিরদিন মনে গাঁথা থাকবে। হিমালয়ের কোলে আজন্ম পালিত এইসব লোক দারিদ্রকে সঙ্গী করে সারা জীবন কাটালেও সহজাত মানবিকতা ও মূল্যবোধে শহরের তথাকথিত শিক্ষিত লোকদের চেয়ে কয়েক গুণ এগিয়ে। দুঃখ একটাই। সময়ের সঙ্গে সভ্যতার অপ্রতিহত বিস্তারে নগর জীবনের সংস্পর্শে আসতে এরা বাধ্য হচ্ছে এবং তার অনিবার্য উপাদান কৃত্রিমতা ও অবিশ্বাস এদের মনকে ক্রমশ আবিল করে তুলছে।
দ্বারাহাট থেকে নিয়ে আসা মিষ্টি ভাগ ক’রে খেয়ে হাত ধুয়ে এক ঢোক করে জল খেয়ে নিলাম। সবে তখন সন্ধ্যা হয়েছে। যা শুনেছিলাম ঠিক সেটাই হ’ল। ঝাঁকে ঝাঁকে মশা আমাদের ঘিরে ধরতে শুরু করল। আশ্চর্য, এতক্ষণ এরা কোথায় ছিল ? বাইরে দাঁড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠল, বাধ্য হয়ে আমরা গুহার ভিতরে ঢুকলাম। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করতে লাগল, দম বন্ধ হবার অবস্থা। মশা পালিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমরাও পালাতে পারলে বাঁচি। কিছুক্ষণ পরে একটু মুক্ত হাওয়ার খোঁজে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলাম ; বহুদূরে নীচের সমতল ভূমিতে বিন্দু বিন্দু অনেক আলো চোখে পড়ল। ওটাই কি রানীক্ষেত শহর ? এ ভাবেই একবার গুহায় ঢুকে একবার বাইরে বেরিয়ে এসে সেই দুঃস্বপ্নময় রাতটা কাটিয়েছিলাম।
ভোর হতেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। সারারাত না ঘুমানোর ক্লান্তি বাইরের নির্মল ঠান্ডা হাওয়ায় একটু পরেই দূর হয়ে গেল। মন্দিরের বাইরে রাস্তার ধারে চায়ের দোকানটা খুলতে নীচের গ্রাম থেকে দোকানী এসে হাজির। জানতে চাইল আমরা কাল রাতে কোথায় ছিলাম। তাকে চা করতে বলে কাছাকাছি কয়েক পা হেঁটে আসার জন্য উঠলাম, সারারাত এক ভাবে বসে থেকে শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। চারিদিকে অসীম নৈঃশব্দ, শান্ত নির্মল বৈরাগ্যময় পরিবেশ। এখানে অনাবশ্যক কোন প্রয়োজন তৈরি করারও চাপ নেই, সেটা মেটাবার তাগিদাও নেই। জন কোলাহল থেকে অনেক দূরে সংসারত্যাগী সাধুরা পরমার্থ সঙ্গ লাভের আশায় কেন হিমালয়ের নিভৃত কোলে এসে আশ্রয় নেয় সেটা বোঝা শক্ত নয়।
দোকানে এসে দেখি কালকের সেই দু’জন লোকও সেখানে বসে আছে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম দ্বারাহাটে ফেরার বাস পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে। শ্যামাচরণ লাহিড়ীর গুহার সন্ধান করতে এসে এতটা হতাশ হতে হবে ভাবিনি। লোকগুলোকে একটু ক্ষুব্ধ হয়েই জানতে চাইলাম স্থানীয় বাসিন্দা হওয়া সত্বেও তারা সাধক শ্যামাচরণ বা তার গুহার খবর জানে না কেন। তাদের নির্লিপ্ত উত্তর – “ওসব থাকলেও অনেকদিন আগেকার ঘটনা, এখন কারো জানা নেই।” হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা ইঞ্জিনের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ি রাস্তা ধরে দ্বারাহাটে যাবার বাস এগিয়ে আসছে। দোকানের ভিতরের দিকটা অন্ধকার, সেদিকে এতক্ষণ আমাদের নজর পড়ে নি। কাশির শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি এক অতিবৃদ্ধ ব্যক্তি হুঁকো হাতে বসে আছে। জানতে চাইল, আমরা কিসের খোজ করছি। এখানে কোন গুহা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় সে খুব শান্ত স্বরে উত্তর দিল – “ এক গুম্ফা তো হ্যায়। ইধারসে পাঁচ মাইল হোগা। পহলে ওহ তো লাহিড়ীবাবা কা গুম্ফা থা।” শুনে গায়ে শিহরণ বয়ে গেল। যার সন্ধানে এখানে আসা সেটা তাহলে ধারে কাছেই কোথাও আছে। সেই অশিতীপর বৃদ্ধের কাছ থেকে যতটা সম্ভব পথের নির্দেশ জেনে নিলাম। সে বেশি কিছুই বলতে পারল না, শুধু বাস রাস্তা ধরে কুকুচিনা গ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে বলল। দূরত্ব তার মতে পাঁচ মাইলের কাছাকাছি, বাকিটা পথে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হবে।
এদিকে বাস এসে দোকানের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানীর কাছে আমরা ফিরে যাব শুনে চালক অপেক্ষা করছে। বাস একদম ফাঁকা, অন্তত তিনজন যাত্রীর আশায় সে দাঁড়িয়েছিল, যখন জানতে পারল আমরা যাব না, অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সে বাস নিয়ে দ্বরাহাটের দিকে চলে গেল। আমরা উলটো দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম।
উঠে আর চলতে ইচ্ছা করছে না, মনে হয় আর একটু বসে যাই। কিছুদূর চলার পর ডান দিকে খাদের মধ্যে দু’তিনজন পাহাড়ি মেয়েকে চোখে পড়ল, কাস্তে দিয়ে কিছু একটা কাটছে। চেঁচিয়ে গুহার ঠিকানা জানতে চাওয়ায় একজন হাত তুলে সামনের দিকে দেখিয়ে দিয়ে আবার কাজে মন দিল। প্রকৃতির ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই নির্লিপ্ত নৈর্ব্যক্তিক এদের মানসিকতা। বহির্বিষয়ে মনোযোগ না দেওয়াটাই যেন এদের বৈশিষ্ট্য।
মাথার উপরে দ্বিপ্রহরের প্রখর সূর্যের অকরুণ রশ্মিতাপে গেঞ্জি জামা সব ভিজে গেছে। ক্লান্তিতে শরীর আর চলছে না। এ সময়ে হঠাতই যেন রাস্তার মাঝে আবির্ভূত হলেন জটাজুটধারী শ্মশ্রুসমন্বিত গেরুয়াবসন পরিহিত এক সন্ন্যাসী। বয়স মনে হ’ল প্রায় আশি। আশেপাশে গ্রাম ত দূরের কথা কোন বাড়িঘরও চোখে পড়ল না। তবে এখানে ইনি অকস্মাৎ কোথা থেকে এলেন ? কাছে গেলে তিনি শান্ত ভাবে জানতে চাইলেন কোথা থেকে এবং কেন এসেছি। শ্যামাচরণ লাহিড়ীর গুহার খোঁজ করছি শুনে বললেন – “ হিমালয়ে এত দর্শনীয় তীর্থস্থান থাকতে হঠাৎ এত পরিশ্রম করে এখানে কেন ?” আমরা শ্যামাচরণ লাহিড়ি ও বাবাজি মহারাজের কথা বইতে পড়ে কৌতুহল মেটাতে এসেছি শুনে বললেন – “ ওতেই ত শুধু হয় না, অন্য কোন যোগাযোগ আছে।” দ্রুত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন – “ আমি তা হলে তোমাদের কাহিনীটা শোনাই”। বলেই তিনি শ্যামাচরণের কর্মোপলক্ষ্যে রানিক্ষেতে আগমন, সেই নির্জন পার্বত্য প্রদেশে বাবাজি মহারাজের আবির্ভাব, পূর্ব জন্মের সাধনস্থল সেই গুহামধ্যে শ্যামাচরণের দীক্ষা গ্রহণের ঘটনা আনুপূর্বিক ভাবে হুবহু বলে গেলেন যার বর্ণনা আগেই দিয়েছি। বললেন – “ তোমরা ভাগ্যবান, যাও দেখে এসো সেই পুণ্যস্থান। আমার শরীর এখন বয়সের ভারে অপটু, পাহাড়ে ওঠা নামার সামর্থ নেই। ইচ্ছে হচ্ছে আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই, কিন্তু তা আর হয় না”। সন্ন্যাসী সামনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন – “ এখান থেকে সোজা নীচে নেমে যাও, খাদটা পেরিয়ে যে পাহাড়টা দেখছ সেটা ধরে উপরে উঠেই একটা সমতল জায়গা পাবে। তার একটু উপরেই সেই গুহা। বাবাজি মহারাজের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে বললেন – “উনিই ত আমাদের অভিভাবক, অলক্ষ্যে থেকে আমাদের সবার দেখাশোনা করেন। বিপদে আপদে ওনার আশীর্বাদই আমাদের ভরসা যোগায়।” ওনার কি দেখা মেলে, একথা জিজ্ঞাসা করায় একটু বিস্মিতস্বরে বললেন – “উনকো দেখা ক্যায়সে মিলেগা।” তিনি আরো কতগুলি কথা বলেছিলেন যেটা অলিখিত থাকাই শ্রেয়, অযথা বিতর্কের সৃষ্টি করতে চাই না। তাকে প্রনাম্ জানিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম।
রাস্তার ডানদিকে সোজা নেমে গিয়ে খাদটা পেরোলাম। এবার সামনের এই পাহাড়টায় চড়ে উপরে সমতল জায়গাটায় পৌঁছতে হবে। পাহাড়টা যে খুব উঁচু তা নয় তবে বেশ খাড়া মনে হ’ল। শরীর কিছুটা দুর্বল ত ছিলই, সঙ্গে একখানা সুটকেসও রয়েছে। কিছুটা উঠে বিশ্রাম নেবার জন্য একটু দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই সময়ে পাহাড় বেয়ে অনায়াসে উঠে এল একটা লোক। সবল চেহারা, সরল হাস্যময় মুখ। এখানকার লোকেরা কি সবাই নির্মল মনের অধিকারী ? হতে পারে। আধুনিক শিক্ষার অভাবে ‘জ্ঞানার্জন’ ত হয়ে ওঠে নি তাই কুটিলতা কম। সে বলল নীচে গ্রামের বাড়িতে ব’সে তিনজন লোকের পাহাড়ে উঠতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে সে ছুটে এসেছে সাহায্য করতে। আমাদের সুটকেসটা সে নিজের হাতে নিয়ে একটু আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে পাহাড়ের উপরে পৌঁছে দিল। গুহার কথা জিজ্ঞাসা করায় সে আঙুল দিয়ে উপরে দেখিয়ে দিল। সত্যিই সেখানে গাছের আড়ালে এক বিরাট প্রস্তর খন্ড রয়েছে। পাশ দিয়ে ঘুরে গেলেই সেই গুহা। লোকটি জানাল পাশে সামান্য নীচে ছোট একটা গুহায় আর একজন সাধু দীর্ঘদিন ধরে রয়েছেন। আমরা তার সঙ্গেও দেখা করতে পারি।
গগাস নদীটি সম্বন্ধে জানলাম নদীটি বয়ে গেছে আলমোড়া জেলার মধ্য দিয়ে। ১৪টি পার্বত্য খরস্রোতা ধারা মিলে তৈরি হয়েছে গগাস। উৎপত্তিস্থল কিন্তু এই পাহাড়ের আশেপাশে থেকেই। পাহাড়ের এসব ধারা শুধু বর্ষার সময়েই উপর থেকে বিপুল জলরাশি নিয়ে তীব্র গতিতে নেমে আসে, হড়পা বানের সময় এর মধ্যে পড়লে বিপদের যথেষ্ট সম্ভাবনা। অনেক ধারার প্রস্থ কিন্তু বেশি নয়। সারা বছর বয়ে যাওয়া খাদে জল না ও থাকতে পারে। এবার বোঝা গেল কি করে শ্যামাচরণ লাহিড়ীর দীক্ষান্তে একবার তারই এক গুরুভাই যোগ বিভূতি বলে নিজের মাথার পাগড়িটি খুলে আড়াআড়ি ভাবে জলের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে সেটি ধরে সবাইকে ধারটি পেরোতে বলেছিলেন। দুনাগিরি মন্দিরের প্রবেশপথ। সেই পাহাড়ি লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে কিছু টাকা দিতে চাইলাম, সে সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করল। স্থানটিতে নির্মল ঠান্ডা হাওয়া বইছিল ; কিছুক্ষণ বসে থেকে ক্লান্তি অনেকটাই কেটে গেল। এরকম দূষণ মুক্ত সঞ্জিবনী হাওয়া যদি শহরাঞ্চলে থাকত ! কয়েক পা নীচে নেমে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট গুহার মধ্যে চোখে পড়ল সেই সাধুকে। চোখে কাল চশমা, অবিন্যস্ত দাড়ি, ছিপছিপে চেহারার ব্যক্তিটি পরনের কাপড়েরই কিছুটা অংশ গায় দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম তার সঙ্গে কথা বলতে পারি কিনা। শুনে তিনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন – “ আপনারা বাঙালী ? এখানে এসেছেন কেন, হিমালয়ে বেড়াতে ?” শ্যামাচরণ লাহিড়ির গুহা দেখতে এসেছি শুনে মৃদু হেসে বললেন – “ সে তো এখন ইতিহাস। সেখানে আর কি আছে ? এক শতাব্দী আগেকার কথা। এসেছেন যখন দেখে আসুন।” গুহাটি বড়ই। সেখানে এতদিন পরে দেখার আর কি থাকবে। সেরকম কিছু প্রত্যাশা নিয়ে ত আমরা আসি নি। এসেছি সেই স্থানটি দেখতে। এক সময় এখানে মহাগুরু বাবাজী মহারাজের উপস্থিতিতে শ্যামাচরণ লাহিড়ীর দীক্ষাদানের ঘটনাটি ঘটেছিল, মনশ্চক্ষে সেটা প্রত্যক্ষ করলে রোমাঞ্চ জাগে। এটা ব্যক্তিগত অনুভূতি ও বিশ্বাসের ব্যাপার। এই অঞ্চলটি পান্ডুখুলি বা পান্ডুয়াখিল নামে পরিচিত। স্থানীয়রা এই পাহাড়ি অঞ্চল ও বনভূমিকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করে। বহু সাধক ও মহাপুরুষের সাধন ক্ষেত্র বলে এটি পরিচিত। মহামুনি গর্গ এখানে তপস্যা করেছিলেন বলে কথিত ; তার নাম থেকেই গগাস নদীর নাম হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সেই মহাভারতের যুগে পান্ডবেরাও তাদের অজ্ঞাতবাসের কিছুটা সময় এখানে কাটিয়েছিলেন বলে জনশ্রুতি।
যাই হোক সেই সাধুর কথায় ফিরে আসি। কথাপ্রসঙ্গে তিনি অনেক কিছুই বললেন। তার নাম বলেছিলেন উমাকান্ত (যতদূর মনে পড়ে), অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালিতে ছিল তার বাসস্থান। তিনি সাড়ে এগারো বছর ধরে সেই গুহায় রয়েছেন। তিনি কোন মহাত্মার দর্শন পেয়েছেন কি না জিজ্ঞাসা করায় জানালেন, তা তিনি পান নি তবে ‘সংকেত’ পেয়েছেন। তিনি একবেলা শুধু একটু দুধ আর ফল খান, সেটা তাকে নীচের গ্রাম থেকেই দিয়ে যাওয়া হয়। তার কিছু কথা একটু বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়েছিল। শুনেছি তিনি পরে লোকালয়ে ফিরে এসেছিলেন – সেসব প্রসঙ্গ থাক। আমাদের সেখানে যাবার মূল কারণ ছিল লাহিড়ি-গুম্ফা খুঁজে পাওয়া এবং সেটা দর্শন করা। সে ইচ্ছা ত পূরণ হয়েছে। যোগিবর শ্যামাচরণ লাহিড়ীর একমাত্র গৃহীত আলোকচিত্র।
এবার ফেরার পালা। ভেসে আসা একটা ক্ষীণ শব্দ শুনে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি দূরে পাহাড়ি রাস্তাটা ধরে দ্বারাহাটে ফিরে যাবার শেষ বাসটা চলে যাচ্ছে। তখন বেলা দুটো। আমরা ফিরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। পথে আর কারো সঙ্গে দেখা হ’ল না। ধীরে ধীরে হেঁটে বিকেল চারটা নাগাদ দুনাগিরি মন্দিরের কাছে সেই চায়ের দোকানে এসে পৌঁছলাম। দোকান ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আগের রাতের নিদারুণ অভিজ্ঞতার পর সে রাতটা আর মন্দির সংলগ্ন গুহায় কাটাবার কোন প্রশ্নই নেই। তা হলে ? একমাত্র উপায় রয়েছে বাসের রাস্তা ধরে হেঁটে নীচে নামা। দূরত্ব প্রায় ২০ কিলো মিটার। রাত্রির অন্ধকারে সেই ক্লান্ত শরীরে অন্তত ঘন্টা পাঁচেক ত লাগবেই। সেই জনমানবহীন জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে অতটা পথ চলতে গিয়ে আরো কি অদৃষ্টে আছে কে জানে ? এসব সাত পাঁচ যখন ভাবছি তখন অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা গানের কলি কানে ভেসে এলো, গান গাইতে গাইতে রাস্তা ধরে কে যেন আসছে।
আপন মনে গান গাইতে গাইতে লোকটি এগিয়ে আসছিল। সামনে হঠাৎ আমাদের তিন মূর্তিকে দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। কোথায় যাব জানতে চাওয়ায় জানালাম আমরা দ্বারাহাট যাব, কিন্তু বাস ত এখন মিলবে না, তবে কি আমরা বাসের রাস্তা ধরে হেঁটে নামব ? বিস্মিত হয়ে সে বলল – “ বাসে রাস্তা ধরে ত বাস চলবে, মানুষ কেন হাঁটবে ?” একবারের জন্যও জানতে চাইল না আমরা সে সময়ে কোথা থেকে আসছি বা কেন এসেছি। বলল – “ আমি ত দ্বারাহাটেই যাচ্ছি। সেখানে রামলীলা আছে, দেখে আবার ফিরে আসব। আপনাদের সুটকেসটা আমার কাছে দিন ; আমি নামছি আমার পিছে পিছে আসুন। ৪৫ মিনিটে পৌঁছে যাব।” তখন আর সৌজন্য দেখাবার অবস্থা নেই। বিনা বাক্যব্যয়ে সুটকেসটা তার হাতে দিয়ে ভারমুক্ত হয়ে তার অনুসরণ করলাম। সে পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাহাড়ের ঢাল দিয়ে অনায়াসে নেমে চলল, বুঝলাম বহুবার যাতায়াতে এ পথের প্রতিটি বাঁক ও ওঠানামা তার নখদর্পনে। লক্ষ্য করলাম একটা সঙ্কীর্ণ পায়ে চলা পথ পাহাড়ের গায়ে তৈরি হয়েছে, এটাই তা হলে গ্রামের লোকদের আসা যাওয়ার পাকদন্ডী।
আত্মভোলা লোকটি সুটকেসটা মাথায় নিয়ে চলেছে, গানের তার বিরাম নেই। সম্ভবতঃ লাহিড়ী গুহার কাছেপিঠে কোন গ্রামে তার নিবাস। পাহাড়ের নীচে রামলীলা দেখে আবার পুরো রাস্তা ধরে সে বাড়ি ফিরবে। বাড়ি ফিরতে কটা বাজবে জানতে চাওয়ায় গান থামিয়ে জানাল, ভোরের আগেই সে ফিরে আসবে। আমরা প্রায় শক্তিহীন ভাবে অর্ধচেতন অবস্থায় নেমে যাচ্ছি। প্রায় মাধ্যাকর্ষণের টানে শরীর নেমে যাচ্ছে, আমরা শুধু গতিপথটা ঠিক করে দিচ্ছি। মন্দিরের নীচে গুহা যেখানে আমরা রাতের আশ্রয় নিয়েছিলাম।
সেই ভাঙাচোড়া হোটেলে ঢোকা মাত্র মালিকের সঙ্গে দেখা। তার সেই পুরানো দৃপ্ত ভঙ্গীতেই বলল – “ So you have come back. Go and check your luggage, see if everything is all right.” বুঝলাম মাঝে মাঝে ইংরাজি বলে সে অভ্যাসটা বজায় রেখেছে। সে রাতে আমাদের জন্য তৈরি হয়েছিল রুটি আর মাংস। কর্ণপ্রয়াগে রাতে খেয়েছিলাম, আবার ৪৮ ঘন্টা বাদে পেটে খাবার পড়ল। সারারাত অঘোরে ঘুমিয়ে ভোরে অনেক চাঙ্গা হয়ে উঠলাম। গত রাতের কথা মনে হ’ল। দুনাগিরিতে আমরা যখন বাসের রাস্তা ধরে নামব ঠিক করেছিলাম, ঠিক সেই সময়ে লোকটির দেখা না হলে কি হত তাই ভাবলাম। একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, কাকতালীয় কি না জানি না। গুহা দেখতে যাওয়া ও ফিরে আসার পথে প্রয়োজন মত সঠিক জিনিসটি কিন্তু হাতের কাছে এসে গেছে। দুনাগিরির মন্দির চত্বরে আমাদের রাত্রিবাসের জন্য জনৈক ব্যক্তির আগমন ও আমাদের মন্দির সংলগ্ন গুহা দেখিয়ে দিয়ে কাঠ বয়ে এনে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া ; পরদিন চায়ের দোকান থেকে গুহার সন্ধান না পেয়ে যখন ফিরে আসার বাসে উঠবো ঠিক সেই মুহূর্তে একজন অতিবৃদ্ধ ব্যক্তির লাহিড়ী বাবার গুহার কথা উল্লেখ করা ; গুহার সঠিক অবস্থান দেখিয়ে দিতে রাস্তার মাঝে সেই সন্ন্যাসীর আবির্ভাব ও সবিস্তারে শ্যামাচরণ ও বাবাজী মহারাজের কাহিনী বর্ণনা ; পাহাড় বেয়ে গুহার কাছে যাবার পথে অযাচিত ভাবে এক ব্যক্তির এগিয়ে এসে পাহাড়ের উপরে উঠতে সাহায্য করা এবং পরিশেষে দ্বারাহাটে ফেরার উদ্দেশ্যে বাসের রাস্তা ধরে নামার মুহূর্তে সেই গান পাগল রামলীলা ভক্তের দেখা পাওয়া এবং তাকে অনুসরণ করে অনায়াসে দ্বারাহাটে পৌঁছে যাওয়া – সবই কি নিখুঁত ভাবে ঘটে যাওয়া এক আশ্চর্য সমাপতন ? পাহাড়ের চূড়ায় শ্যামাচরণ লাহিড়ীর সাধন গুহা।
আমাদের হিমালয়ের কোলে লাহিড়ী-গুম্ফার দর্শন কাহিনী মূলত এখানে শেষ হলেও দুর্ভোগের শেষ কিন্তু তখনো হয় নি। এদিকে রচনার কলেবর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সংক্ষেপে বাকিটুকু বলে সেই সঙ্গে আরো দু’একটি প্রাসঙ্গিক কথা বলে শেষ করি।
দ্বারাহাটে আর অযথা সময় নষ্ট না করে আমরা সকালের বাসেই রানিক্ষেতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তখন সকাল ৯ টা, এখান থেকে ঘন্টাখানেকের পথ। বাসে যাত্রী সংখ্যাও বেশি ছিল না। কিন্তু মিনিট পনেরো চলার পরেই প্রশান্ত বলল তার পেটটা খুবই ব্যাথা করছে। ক্রমে সেটা অসহ্য অবস্থা ধারণ করল, যন্ত্রণার তীব্রতায় বাসের মেঝেতে প্রায় শুয়ে পড়ার উপক্রম। ড্রাইভারকে একটু তাড়াতাড়ি চলার অনুরোধ করায় সে বলল এসব রাস্তায় জোরে চালালে বিপদ ঘটার সম্ভাবনা। অবশ্য সে যথাসম্ভব সহযোগিতা করল ; বাসের এক স্থানীয় যাত্রী জানাল রানিক্ষেতে ঢোকার মুখেই একটা ভাল সরকারি হাসপাতাল আছে, সেখানে নিয়ে ভর্তি করে দেওয়াটাই শ্রেয়। সেটাই করলাম। এরপর আমি ও প্রবীর মালপত্র নিয়ে কিছুদূরে রাণীক্ষেতের মুন হোটেলে গিয়ে উঠলাম। রাস্তা থেকে সামান্য কিছুটা নেমে গিয়ে হোটেলটির অবস্থান। সেখানে থেকে দিকচক্রবালে অস্তমিত সূর্যের রক্তিম স্তিমিত আভায় রঞ্জিত তুষারাবৃত পর্বত শৃঙ্গের অপরূপ শোভা দেখে মন জুড়িয়ে যায়।
বিকেলে একবার হাসপাতালে গিয়ে প্রশান্তকে দেখে আসা গেল, অনেকটা সুস্থ হলেও তখনো তার চলার শক্তি নেই। রাত আটটার মধ্যেই খাওয়া দাওয়া শেষ। হঠাৎ মনে হ’ল আমাদের সঙ্গে যথেষ্ট টাকাকড়ি রয়েছে ত ? প্রশান্ত হাসপাতালে ক’দিন থাকবে জানা নেই, সেইমত হোটেলের খরচও বাড়বে ; এরপর পথে যদি আরো কোনো বিপর্যয় ঘটে তবে যা সম্বল রয়েছে তাতে অসুবিধা হতে পারে। একটু বাড়তি টাকা পয়সা সঙ্গে না থাকলে যথেষ্ট ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে বাকি পথটা চলতে হবে। প্রবীরের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলাম কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীদের কাছে টেলিগ্রাম মানি অর্ডারে টাকা পাঠাতে অনুরোধ করব, এ ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় মনে এলো না।
তখন রাত ১০টা বেজে গেছে। হোটেলে সবারই রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। সেখানকার মালিককে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল কিছুটা দূরেই একটা ডাকঘর রয়েছে, তবে এত রাতে টেলিগ্রাম করা যাবে কি না সেটা সে বলতে পারবে না। রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। লোক চলাচল চোখে পড়ল না। এসব অঞ্চলে রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সেরে ফেলাটাই দস্তুর, ঠাণ্ডাও পড়েছে যথেষ্ট। ভারত সরকারের Post & Telegraph ছাপ মারা ছোট বাড়িটা খুঁজে পেতে দেরি হ’ল না। স্বাভাবিক ভাবেই দরজা জানালা সবই বন্ধ। রাস্তায় একটা স্তিমিত ভাবে আলো জ্বলছে। গেটটা খুলে কোন কলিং বেল চোখে পড়ল না। অগত্যা কিছুটা দ্বিধা ও শঙ্কা নিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর দোতলার একটা জানালা খুলে একজন জিজ্ঞাসা করল – “কোওন হ্যাঁয়?” আমরা যতটা সম্ভব আমাদের অসহায়তার কথা জানালাম। একে তার নিদ্রাতুর চোখ তার ওপর আমাদের বিসদৃশ হিন্দি শুনে মনে হ’ল সে খানিকটা সময় নিলো, তার পরে আমাদের দাঁড়াতে বলল। কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে অপেক্ষা করলাম।
কিছুক্ষণ পরে এক তলার অফিস ঘরে কাউন্টারের ছোট জানালাটা খুলে গেল। সেখানে এক বয়স্ক লোক খুব শান্ত ভাবেই জানতে চাইল ব্যাপারটা কি ? এবং সব শুনে আমাদের দিকে একটা টেলিগ্রাম করার ফর্ম এগিয়ে দিল। সে একবার পড়ে নিয়ে আমাদের আশ্বস্ত করে বলল – “ আপনারা যান, আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি।” তার সংযত সহানুভূতি-পূর্ণ ব্যবহার দেখে আমরা একটু আশ্চর্য হলাম। এদের মত লোক এখনো তাহ’লে রয়েছে!
পরদিনটা ছিল খুবই স্বস্তিদায়ক। প্রশান্ত সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে এলো সকাল ১০টা নাগাদ এবং দুপুর ১২টায় কর্মস্থল থেকে পাঠানো টাকা এসে পৌঁছলো। এত তাড়াতাড়ি টাকা পেয়ে গেলাম দেখে একটু অবাক হয়েছিলাম। সেই ঠাণ্ডার রাতে ঘুম থেকে উঠে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া সেই পোস্টমাস্টারের আন্তরিকতার কথা মনে পড়ল। এ রকম কিছু লোকের জন্যই বেঁচে থাকা অর্থবহ হয়ে ওঠে এবং ভবিষ্যতে সুদিনের আশা জাগরূক থাকে।
পরের পর্যায় তো কাঠগোদাম, লক্ষ্ণৌ হয়ে ফেরার পালা। এতে বলার মত কিছু নেই। তবে এখনো অলস মুহূর্তে সেদিনের কথা যখন স্মৃতিপটে উদয় হয়, প্রতিটি খুঁটিনাটি যেন মূর্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অনেক জায়গা দেখতে গিয়ে ফিরে আসার সময় ভেবেছি আবার আসবো। সেটা কখনো হয়ে ওঠে নি, লাহিড়ী-গুম্ফা সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য।
যে ঘটনার বিবরণ লিপিবদ্ধ করলাম সেগুলি সবই আজ থেকে ৪২ বছর আগেকার কথা, তখনকার পরিবেশেরই বর্ণনা। এখন সব কিছুরই নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। দ্বারাহাটে একটা সরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চলছে, গড়ে উঠেছে একটা তিনতারা হোটেল। দুনাগিরির সেই মন্দিরের আমূল সংস্কার হয়েছে। সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য, যে গুহার খোঁজ করতে গিয়ে এত কষ্ট করতে হয়েছে, সেই লাহিড়ী মহাশয়ের গুহা এখন টুরিস্ট স্পট। কম্প্যুটার খুলে ‘babaji cave’ সার্চ করলেই বহু তথ্য মিলবে। আমার কাছে গুহাটির ছবি না থাকায় আমি যে ছবিটি এই রচনার সঙ্গে সংযুক্ত করেছি সেটা ইন্টারনেট থেকেই নেওয়া। দেখে বুঝলাম পরবর্তী সময়ে গুহাটির মেরামত ও সংস্কার করা হয়েছে। ভাল জিনিসের প্রচার হওয়াটা ভাল। তবে ভয় হয়, একদিন গুহার পাশের চায়ের দোকান থেকে মাইকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের গান না বেজে ওঠে। সব জিনিসেরই অন্তর্নিহিত ভাব গ্রহণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের আনুকূল্য চাই, অবশ্যই তদুপযোগী মানসিকতারও প্রয়োজন হয়। কেদার-বদরিতে হেলিকপ্টারে নেমে পুজো দিয়ে সেদিনই ফিরে এলে কি দেব মাহাত্ম্য বৃদ্ধি পায় ? কোন কোন জিনিস বোধ হয় কিছুটা অন্তরালে থাকাই শ্রেয়। অনুসন্ধিৎসা ও শ্রম স্বীকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত বস্তুর যথার্থ মর্যাদা রক্ষিত হয় ও আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদনেরও সহায়ক হয়।
পরিশেষে খুব সংক্ষেপে দু’একটি কথা বলি। শ্যামাচরণ লাহিড়ির শিষ্য যুক্তেশ্বর গিরিজি খুবই উচ্চমার্গের ক্রিয়াযোগ সাধক ছিলেন। পুরীর স্বর্গদ্বারে রয়েছে তার সমাধি মন্দির। তারই সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন পরমহংস যোগানন্দ (মুকুন্দলাল ঘোষ) (১৮৯৩-১৯৫২)। যোগ ব্যায়াম শিক্ষক বিষ্ণুচরণ ঘোষ ছিলেন তারই কনিষ্ঠ ভ্রাতা। তার লেখা ‘Autobiography of a Yogi’ (বাংলায় অনূদিত-‘যোগীকথামৃত’) বইটি পেলে পড়ে দেখতে পারেন। অসাধারণ আকর্ষণীয় গ্রন্থটি। যোগানন্দ পাশ্চাত্যে ক্রিয়াযোগ প্রচারের জন্য ১৯২০ সালে আমেরিকা চলে যান এবং ১৯২৫ সালে ক্যালিফোর্ণিয়ার লস এ্যঞ্জেলসে Self-Realisation Fellowship (SRF)-এর আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরের প্রশাসনিক ভবন স্থাপন করেন। SRF-এর তৃতীয় সভানেত্রী শ্রীশ্রীদয়ামাতা আমাদের দু’এক বছর আগে লাহিড়ি-গুম্ফা দর্শনে গিয়েছিলেন বলে রাস্তার মাঝে দেখা পাওয়া সেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী আমাদের জানিয়েছিলেন। এই SRF-এর উদ্যোগেই গুহাটি প্রচার লাভ করেছে।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে গঙ্গাতীরে এক প্রশান্ত পরিবেশে ১৯৩৯ সালে যোগানন্দ কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটির (YSS) ভারতের রেজিস্টার্ড অফিস। সেখানে রয়েছে যোগদা মঠ। এটি সর্বসাধারণের জন্য মুক্ত। এখানে ধ্যানকক্ষের নিবিড় শান্ত পরিবেশে কিছুক্ষণ কাটালে মন বিক্ষেপ মুক্ত হয়ে আপনিই স্থির হয়ে আসে।
১৯৫২ সালের ৭ই মার্চ পরমহংস যোগানন্দ আমেরিকায় যখন দেহত্যাগ করেন তখন ভারতবর্ষ থেকে প্রতিনিধি পাঠানো এবং আরও কিছু প্রশাসনিক কারণে তার মরদেহ সমাধিস্থ করতে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। ২০ দিন তার দেহ কোন রাসায়নিকের ব্যবহার ছাড়াই শায়িত ছিল এবং ২৭শে মার্চ তার দেহ যখন কফিন-বন্দী করা হয় তখনও সেটি ছিল সম্পূর্ণ সজীব ও অবিকৃত। এটা একটা অভূতপূর্ব এবং আশ্চর্য জনক ঘটনা। এর ফটোগ্রাফও রয়েছে। সেখানে যোগানন্দের মরদেহ যারা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেছেন সে চিকিৎসক বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টের কিয়দংশ এখানে উধৃত করছি –
“...... The physical appearance of Paramhansa Yogananda on March 27th, just before the bronze cover of the casket was put in position, was the same as it had been on March 7th. He looked on March 27th as fresh and as unravaged by decay as he had looked on the night of his death. On March 27th there was no reason to say that his body had suffered any visible physical disintegration at all. For these reasons we state again that the case of Paramhansa Yogananda is unique in our experience.”
লাহিড়ী-গুম্ফার কাহিনী শোনাতে গিয়ে শেষের কিছু অংশ হয় ত না বললেও চলত। কিন্তু প্রাসঙ্গিক ভাবে যারা ক্রিয়াযোগ ও পরম্পরা সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য জানতে ইচ্ছুক তাদেরই জ্ঞাতার্থে এটা লেখা হ’ল।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান। Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.