মতামত ও আলোচনা
নভেম্বর ১৫, ২০১৪
কি যে লিখি?
বিজন বন্দ্যোপাধ্যায়
অবসরে এক সময় বেশ কিছু লেখার একটা চেষ্টা করেছিলাম। পাঠকদের মতামত পেয়ে কিছুটা উল্লসিতও হয়েছিলাম - কারণ আমার লেখা কেউ পড়বে আর সময় করে তাতে মতামতও জানাবে – এতটা আশা করিনি। ফলে গ্যাস খেয়ে বেশ ফুলে উঠেছিলাম আর নিজেকে লেখক ভাবতে শুরু করেছিলাম। সে গ্যাস এখন চুপসে গেছে । শেষ ৪-৫ মাসে অনেক চেষ্টা করেও কলম দিয়ে কিছুই বার করতে পারি নি। অনেক দিন পরে আবার কিছু লেখার একটা চেষ্টা করছি। কি নিয়ে লিখব সেটা এখনও খুঁজে পাই নি। তাই এই টুকু লিখে থমকে যেতে হল। দেখি আবার কবে কি যোগ করতে পারি।
ওপরের টুকু লেখার পড়ে ৩ সপ্তাহ হয়ে গেছে – কি নিয়ে লিখব সেটা ভাবতে ভাবতে। কিন্তু একটা জেদ চেপে গেছে – কিছু না লিখেই ছাড়ব না। তাই অনেক ভেবে একটা লেখার বিষয় মাথাতে এসেছে – পাঠকদের ধৈর্যের এবার পরীক্ষা নিতে সাহস করে এগিয়ে আসছি। দেখি কত পচা টমেটো উপহার পাই।
ভাবলাম নিজের ছোটো বেলার কিছু কথা লেখাটা সব থেকে সহজ। নতুন করে কিছু চিন্তা করতে হবে না। এই লেখাটা স্মৃতিচারণ নয় – “আমার শৈশব” লেখার মত নামকরা কেউ আমি নয় – তাই সে প্রচেষ্টাও করছি না। এই ৭০ বছরের আমিও যে কোনো এক সময় ছোট ছিলাম – সেটা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কোথা থেকে হঠাৎ মনে পড়ে গেলো – সেই ছোট বেলার কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া কথা। তাই এই লেখা।
আমার একবারে শিশু বয়স থেকে ১০-১২ বছর বয়স অবধি আমাদের বাড়ীতে–বিশেষ করে আমাকে দেখার জন্যে - এক কাজের লোক ছিল – তাকে বলাইয়ের মা বলে ডাকা হত। আমি মা বাবার একমাত্র ছেলে – শুধু আমার থেকে দেড় বছরের বড় এক দিদি ছিল। বলাইয়ের মার আমার ওপর ছিল প্রচণ্ড ভালবাসার অধিকার – আমার মা বা বাবাও সেখানে কোন বাধা দিত না – ভালবাসার দাবীকে সঠিক দাম দিত। আমার ডাক নাম বুবু – কিন্তু বলাইয়ের মা আমাকে বুলু বলে ডাকতো।
এই বলাইয়ের মায়ের দাপটের একটা কথা লোকমুখে শুনেছি।কারো বাড়িতে গিয়ে আমাকে কেউ যদি শুধু একটা মিষ্টি হাতে দিত – পেটুক আমি আর একটা পাবার আশাতে অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিতাম। স্বাভাবিক ভাবে মা এতে রেগে গিয়ে আমাকে বকার চেষ্টা করতো – কিন্তু সফল হত না। কারণ বলাইয়ের মা ততক্ষণে মাঠে নেমে পড়েছে - সবার সামনে বলে দিত “একটা মোটে ছেলে – যা চাইবে তাই দেবে – তা নয়।‘ বকুনি সেক্ষণেই বন্ধ আর যার বাড়ী গেছি সে নিরুপায় হয়ে বেজার মুখে আর একটা মিষ্টি দিতে বাধ্য হত।
আর একটা কথা আমার নিজেরই মনে আছে । বলাইয়ের মা তখন আমাদের বাড়ী আর কাজ করে না – তার ছেলে বলাই অনেক বড় – সে মাকে আর কাজ করতে দিতে রাজি না – তাই তাকে নিজের কাছে দেশে নিয়ে গেছে। কিন্তু বলাইয়ের মা বছরে দু তিন বার আমাকে দেখতে না এসে পারে না। তখন আমি বেশ বড় হয়েছি । বলাইয়ের মা আমাকে দেখার জন্যে এসেছে । আমি নীচের ঘরে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছি । বলাইয়ের মা সেখানে হাতে একটা চিরুনি নিয়ে হাজির । আদর মাখানো গম্ভীর সুরে বলল “ চুলটা ঠিক করে হাচড়াও নি (মানে আঁচড়াওনি ) কেন – এসো ঠিক করে হাচড়ে দি।“ এই বলে বন্ধুদের সামনে আমার গালটা ধরে চুল আছড়ে দিল। এর পর অনেক দিন বন্ধুদের “টাং খিছাই” চলেছিল।
কেন জানি খুব ছোট বেলাতে করা একটা নিজের লজ্জাকর কাণ্ডের কথা মনে আছে। বাড়ীতে লোকে বেড়াতে এলে মা প্লেটে মিষ্টি সাজিয়ে রেখে এসে অনেক সময় তাদের সাথে কথা বলত। আমাকে খাবার প্লেট গুলো দেবার ভার দিত। আমি কাজটা ভাল ভাবেই করতাম – কিন্তু একটাই গোল করে ফেলতাম। কেউ যদি বলতো “ এত খাব না – আমি একটা তুলে নিলাম” – তা হলে বাকি প্লেটটা ফেরত নেবার সময় তাদের দিকে পেছন ফিরে ওখানে দাঁড়িয়েই প্লেটের বাকি মিষ্টি খেয়ে নিতাম – আমার ধারণা ছিল পেছন ফিরে খেলে কেউ দেখতে পাবে না। ততদিনে বলাইয়ের মা চলে গেছে – তাই আমাকে রক্ষা করার কেউ নেই। সুতরাং তারা যাবার পরে মা আমাকে যে বিশেষ আদর করত – সেটা অনুমান করতে কোন অসুবিধা নেই।
আমাদের স্কুলে টিচারের হাতে মার খুব বেশী রকম চালু ছিল। নিজের দোষ ছাড়াও ভাগ্যে মার জুটত – কারণ কেউ কিছু করলে টিচার হাজার বার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও আমরা কারো নাম বলতাম না । ফলে পাইকারি হারে সবার পিটাই হত। আমাদের এক টিচারের একটা খুব খারাপ শাস্তি ছিল। ছাতার বাঁট গলাতে লাগিয়ে টেনে এনে গালে হাতের সুখ করতো । আমাদের ক্লাসে কাশি নামে একটা ছেলে ছিল । তার মাথাটা দুষ্টু বুদ্ধিতে ভরা। একদিন সে আমাদের বলল – ওই টিচারের ক্লাসে ও বদমাইশি করবে। ছাতার বাঁট গলাতে দিয়ে ওকে টানলে আমাদের কি করতে হবে সেটা আগেই শিখিয়ে দিল। যথারীতি তার বদমাইশি দেখে ওই টিচার তার গলাতে ছাতার বাঁট লাগান মাত্র সে অজ্ঞান হবার ভান করল। তার শেখান মত আমরা সবাই এক সাথে বলে উঠলাম “ এ কি করলেন স্যার – ওর মৃগী আছে – ও অজ্ঞান হয়ে গেছে – হেড স্যারকে (তখন হেড স্যার বলা হত – principal না) বলে ওকে হাঁসপাতালে নিয়ে যেতে হবে”। এই বলে আমরা সবাই হেড স্যারের ঘরে গিয়ে তাকে সব বললাম। হেড স্যার অন্য এক স্যারকে ওকে দেখতে আর ওর মাথাতে জল দিতে বলে আমাদের এই স্যারকে ঘরে ডেকে খুব বকুনি দিলেন। আমরা পরম আনন্দে দরজার বাইরে কান পেতে সেই বকুনি শুনলাম। ছাতার ব্যবহার সেই দিন ই শেষ।
স্কুলের আর একটা কথা মনে পরছে। আমাদের একজন টিচার পরীক্ষাতে গার্ড হলে আমরা খুব চিন্তাতে থাকতাম। পরীক্ষাতে পুরো টুকলি করতাম না – যেটা স্কুলে অনেকে করতো । কিন্তু অঙ্ক পরীক্ষাতে উত্তর মেলাতাম না বললে সত্যি বলা হবে না। এই টিচারের টুকলিবাজদের ধরার নিত্য নতুন পদ্ধতি ছিল। তারই দুটো মনে পরছে। আরাম করে চেয়ারে বসে সামনে খবরের কাগজ খুলে তিনি যখন গার্ড দিতে বসতেন , তখন টুকলিবাজরা মহা খুশী হত। কিন্তু সেই খুশি খুবই ক্ষণস্থায়ী – সামনে কাগজ রেখেই তিনি হঠাৎ বলতেন “ সব দেখতে পাচ্ছি – কাশি, দীপেন, দীপক আর সমর – তোমরা উঠে এস”। আমরা প্রথমে খুব অবাক হতাম । পরে তার ভুল করে ফেলে যাওয়া একটা কাগজ দেখে ব্যাপারটা বুজলাম। কাগজে ভরতি ছোট ছোট ফুটো আর তাই দিয়ে সব দেখা যায়। তার আর একটা পদ্ধতি ছিল। এটা আরও innovative. চোখে কালো চশমা পরে এসে বলতেন – চোখে প্রবলেম আছে। তার পর কারো নাম না বলে বলতেন – “তোমরা টকাটুকি করছ – সব দেখেছি – এখনই উঠে এস”। যারা টুকছে তারা ভয় পেয়ে উঠে আসতো । পরে জেনেছি – তিনি তখন কারুকেই দেখেন নি – ওটা একটা বুদ্ধির চাল।
আরও দুজন টিচারের কথা মনে আসছে। একজন ভীষণ নস্যি নিতেন । তার ক্লাস এ প্রথম বেঞ্চে কেউ বসতে চাইতো না – কারণ নস্যি নেবার পরে তিনি যখন হাত ঝাড়তেন, সেই নস্যির গুড়ো চোখে পড়তো। দেশে সুকুমার রায়ের একুশে আইন চালু থাকলে তাকে কোটাল নিশ্চয় একুশ দফা হাঁচিয়ে মারতো । নস্যি নেবার তার একটা বিশেষ স্টাইল ছিল। নস্যি ধরা ডান হাত তিনি নাকের বাঁ গর্তে প্রবেশ করাতেন। নাকের ডান গর্তে নস্যি নিতে বাঁ হাত ব্যাবহার করতেন। সব থেকে বড় বিশেষত্ব হল, এক হাত নাকে গেলে অন্য হাত বিপরীত দিকের কানে যেত । তাই এনার নাম দেওয়া হয়েছিল বজ্র গুণন (cross multiplication). বজ্রগুণনের সঠিক রূপ বলে বোঝানো শক্ত – তাই নিজেই বিনা নস্যিতে বজ্রগুণনের অনুকরণ করে মেয়েকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে নীচে দিলাম।
আর একজন বেশ মজা করতেন। একদিন জিজ্ঞাসা করলেন “আমদানি পিপীলিকা নহে বরফ” এর ইংরাজি বল্ তো । অনেকে অনেক চেষ্টা করল। শেষে তিনিই উত্তর দিলেন “ important notice”. আমরা কিছুই বুজলাম না। তিনি বললেন “এটাকে ভেঙ্গে ভেঙ্গে মানে দেখ্। import (আমদানি) ant (পিপীলিকা ) not (নহে) ice (বরফ)।“ স্বাভাবিক ভাবে ইনি ছাত্রদের খুব প্রিয় ছিলেন।
জেগে জেগে স্বপ্নের মত কিছুর ঘোরে ছিলাম বোধহয় অনেকক্ষণ – হঠাৎ মেয়ের ডাক শুনলাম “বাবা চা হয়ে গেছে”। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। আর লেখাটা সেখানেই শেষ করলাম।
পেছনের দিকে তাকালে অতীত আর্তির উত্তাপে সব কিছুই ভাল মনে হয় – সত্যি ভাল ছিল কিনা বলা খুব শক্ত। এ সব কথা সব সময় মনে থাকে বললে মিথ্যা বলা হবে । কোথাও পড়া একটা লাইন মনে ভেসে উঠছে “মনে থাকে না – মনে পড়ে “
লেখক পরিচিতঃ শুনেছি বছর ৫০ আগে আমি নাকি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছিলাম – যাদবপুর থেকে। কয়েক বছর আগে হঠাৎ লেখক হবার ক্ষ্যাপামি চাপলো মাথাতে । অবসর সে সুযোগ ও দিল । সেই সুযোগের সুবিধাটা নিয়ে মতামত আর আলোচনা বিভাগে গোটা দশ আর ভ্রমণ বিভাগে গোটা তিন লেখা অবসরের পাতাতে জায়গা পেল আর অনেক পাঠকদের মতামত পাওয়া গেল এই সব লেখাতে । এতে উৎসাহ পেয়ে আবার কলম ধরেছি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।