বিবিধ প্রসঙ্গ
সেপ্টেম্বর, ২০১৪
চেঁচিয়ে লাভ নেই!
সুমিত রায়
-১-
আমি বধির। আমার মা বেঁচে থাকলে বলতেন "কালার মরণ"। নিজেকে তাই বলতেন, তিনি কানে কম শুনতেন। তাঁর কালে সমাজে বধির লোকদের ওই ভাবেই দেখা হোতো। আমি আর তা করলাম না, আজকের দিনে প্রকাশ্যে এমন কথা বলার দস্তুর নেই। আমি শুনতে না পাওয়াকে বধিরতা (বা বধিরত্ব) আর সেই লোকদের বধিরজন বলবো।
আমি জন্মবধির নয়। মায়ের কাছে পাওয়া জিনের কৃপায় আস্তে আস্তে শ্রবণশক্তি কমে আসছিলো, কিন্তু কাজ চালাতে পারছিলাম। শেষদিকে অবশ্য বাইরের কাজকর্মে একটু অসুবিধা হোতো। তারপর একদিন অসুখে পড়লাম, তখন আমার বয়স পঁয়ষট্টি। সেরে উঠে দেখি শ্রবণশক্তি একেবারে গেছে। অনেক লড়াই করে এখন জীবনযাত্রাটিকে একটু পদস্থ করা গেছে। অন্নসংস্থানের জন্য কাজ করতে হয় না, সেটি রক্ষে। আমি বাক্চতুর লোক, মানুষজনের সঙ্গে তর্ক-আলোচনা করতে ভালোবাসতাম, সেসব গেছে ঘুচে। এখন থাকি লেখাপড়া, ইমেল আর ফেসবুক নিয়ে।
সেই পড়ার মাধ্যমে একদিন একটি বইয়ের সাক্ষাত্ পেলাম, লেখিকা ক্যাথারিন বুটন, অনুবাদে বইয়ের নামটি হবে, "চেঁচিয়ে লাভ নেই" (Katherine Bouton, "Shouting Won't Help: Why I -- and 50 Million Other Americans-- Can't Hear You", Sara Crichton Books, 2013)। ক্যাথারিন একজন বধিরজন, নিউ ইয়র্ক টাইম্স সংবাদপত্রের একজন সম্পাদিকা। তিনি অনেকদিন ধরে বধিরতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, একটি কান দিয়ে শুরু, পরে অন্য কানটিও আক্রান্ত হয়। এই বইটি বধিরতার ওপর লেখা, তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বেশী, বধিরতার পরিসংখ্যান, বধিরতার কারণ, বর্তমান চিকিত্সা পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে অনেক তথ্যও আছে ছড়ানো ছিটোনো। মাঝে মাঝে অন্য বধিরজনের অভিজ্ঞতার কাহিনীও লিখেছেন কোনো বিশেষ তথ্যের ব্যাখ্যা হিসেবে।
ক্যাথারিনের বই পড়ে ভালো লাগলো। যদিও এর আগে ইন্টারনেটের কল্যাণে ছোটোখাটো লেখা অনেক পড়েছি, বধিরতার সব দিক নিয়ে এ ভাবে গুছিয়ে লেখা এই প্রথম পড়লাম। বধিরজনেরা নিজেদের মধ্যে বধিরতা নিয়ে আলোচনা করেন না (সত্যি বলতে কি, কিছু নিয়েই আলোচনা করেন না), কাজেই অন্যরাও যে আমার মতো একই ধরণের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন এবং তা জয় করতে চেষ্টা করছেন, তার লিখিত প্রমাণ পেয়ে মনে বল পেলাম। ভাবলাম বধিরতা নিয়ে কিছু লিখি, আমার নিজের অভিজ্ঞতা নিয়েই লিখি, অন্য বধিরজন কেউ যদি আমার লেখাটি পড়েন তাহলে তিনিও হয়তো এমনই উপকার পাবেন। আরো বুঝলাম যে বধিরতা নিয়ে সাধারণ মানুষ, এমন কী যাঁরা কোনো বধিরজনের কাছের মানুষ, তাঁরাও খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। উদাহরণ, "টেলিফোনে তো বেশ শুনতে পাচ্ছিলে", "তুমি তো এখন দিব্যি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো", "তুমি কানে ওটা পরোনি?", "বীঠোভেনও কালা ছিলেন", "আজকাল তো কতো নতুন নতুন চিকিত্সা বেরোচ্ছে বাপু", টিভি চালিয়ে সংলাপ, দুতিনজনের একসঙ্গে কথা বলা, বধির জানতে পারার পর একটা তাচ্ছিল্যের ভাব-- প্রায়ই তো এসবের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না কেননা কথা শুনতে বা বুঝতে যে তাঁদের অসুবিধে হয়, বধিরজনেরা সে কথাটা চাপা দেবার চেষ্টা করেন, বধিরতা সম্পর্কে তাঁরা বিশেষ স্পর্শকাতর। তবু হয়তো এই কাছের লোকেরাও কেউ কেউ লেখাটা পড়বেন আর বধিরজনদের একটু অন্যভাবে দেখতে শুরু করবেন। এই কারণে মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় কী ভাবে কাজ করে তা নিয়ে একটু বিশদ করে লিখেছি, সমস্ত ঘটনাটি যে বেশ গোলমেলে এবং সেখানে গোলমাল ঘটলে তা ঠিক করা বিশেষ দুঃসাধ্য এর একটা হদিশ দেবার জন্য। সহজে পড়া যাবে বলে ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করেছি অনেক।
এই ভূমিকাটির পরেই বধিরজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কী মনে রাখা উচিত তার একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা দিয়েছি। বধিরজনের কাছের লোকেরা এই লেখাটির আর কিছু না পড়ে শুধু যদি এই অংশটা পড়েন তাহলে আমার শ্রম কিছুটা সার্থক হবে। তারপর যথাক্রমে কিছু পরিসংখ্যান, বধিরতার পথে আমার যাত্রার কথা, শ্রবণেন্দ্রিয়ের শারীরবৃত্ত, ফিজিওলজি, বধিরতার কষ্ট, বিশেষত মানসিক কষ্ট, শুনতে সাহায্য করার জন্য হিয়ারিং এড আদি যন্ত্র, বধিরতার উপশম বা নিরসনের জন্য কী গবেষণা চলছে এবং এক বধিরজন হিসাবে আমার দিনলিপি-- এই নিয়ে লিখেছি। প্রসঙ্গত, ক্যাথারিন বুটন আর আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে, আমি নিজের কথাই বলেছি, ক্যাথারিনের কথা নয়। এই লেখাটি ক্যাথারিনের বই-প্রণোদিত, অনূদিত নয়।
-২-
বধিরতা নিয়ে বিশদ আলোচনার আগে বধিরজনদের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে গেলে যাঁরা কথা বলছেন তাঁদের কী মনে রাখলে ভালো হয় তার একটা তালিকা দেওয়া যাক। বধিরতা বিষয়ে পরে অনেক কথা আমরা বলবো, কিন্তু সবচেয়ে দরকারী কথা আছে এই তালিকাটিতে। দুটি কথা মনে রাখলে ভালো হয়: প্রথম, বেশীর ভাগ বধিরজনই হিয়ারিং এড ব্যবহার করে যদিও বা কথার ধ্বনি শুনতে পান, তাঁদের মগজে যখন সে কথা পৌঁছোয় তা শোনায় জড়িত, যাকে মাম্বলিং বলা হয়। সে কারণে কথাটির অর্থ বুঝতে অসুবিধা হয়। আর দ্বিতীয়, বধিরতার আর এক উপসর্গ হোলো দরকারী কথা আর পিছনের গণ্ডগোলের, ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ, মধ্যে তফাত্ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা।
১) বধিরজনের সামনাসামনি কথা বলবার চেষ্টা করবেন। প্রায় সব বধিরজনেরই বক্তার ঠোঁট নড়াটা দেখা দরকার হয়-- আমরা এটাকে লিপ রিডিং বলবো। সে কারণে বক্তার মুখে আলো পড়াটাও জরুরী। এতেও মুস্কিল এড়ানো যায় না, কেননা অনেক কথা, যথা ইংরেজী ব্যাট, ব্যাড, ব্যান, ম্যাট, ম্যাড, ম্যান, প্যাট, প্যাড, প্যান-- বলতে গেলে ঠোঁট নড়ে একইভাবে, অর্থাত্ লিপ রিডিং করেও লাভ হয় না। তখন বধিরজনকে প্রসঙ্গ দেখে কথাটা বুঝতে হয়।
২) পরিষ্কার উচ্চারণে, স্পষ্টভাবে মন্থরগতিতে কথা বললে বধিরজনদের বুঝতে সুবিধা হয়। আরো তাড়াতাড়ি তো নয়ই,আরো চেঁচিয়েও নয়।
৩) এর পরেও একই কথা শোনার পর যদি বধিরজন দুতিনবার "কী বললে" বা "আবার বলো" বলেন, তাহলে যা বলতে চান সেটা অন্য শব্দ ব্যবহার করে বা একটু অন্যভাবে বাক্যটা সাজিয়ে বলুন। "ছেড়ে দাও" বা "বাদ দাও" বলবেন না, তাতে বধিরজনরা দুঃখ পান।
৪) বেশীর ভাগ বধিরজনই আবহের গণ্ডগোল, ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজ, থেকে দরকারী কথা আলাদা করতে পারেন না। তাই পাখার আওয়াজ, যানবাহনের শব্দ, চলতি গাড়ীর মধ্যে আওয়াজ, জোর হাওয়ার শব্দ, আবহসঙ্গীত, টিভির গোলমাল, অন্য কারো কথাবার্তা-- এসব ছাপিয়ে বধিরজনদের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো মুস্কিল। এমন ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে কানের আরো কাছে মুখ এনে কথা বলেও লাভ হয়না বিশেষ।
৫) কথোপকথন শুরু করার আগে বধিরজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিলে ভালো হয়। নাহলে, প্রথমত প্রথম দিকের সব কথা তাঁরা বুঝতে পারবেন না, তা আবার বলতে হবে। দ্বিতীয়ত তাঁরা চমকে যেতে পারেন এবং যদি কিছু হাতের কাজ করতে থাকেন, তাতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আমাকে নতুন কিছু বলার আগে "বাবা পঅ অ অ অ জ" বলে আমার মেয়ে কথা শুরু করে, তাতে দেখেছি কথোপকথন চালাতে সুবিধে হয়।
৬) যদি বধিরজন ছাড়াও দলে একাধিক লোক থাকেন তাহলে একসময়ে একজন কথা বলার, বা অন্তত কেবল একটি বিষয়ে আলোচনা চালাবার চেষ্টা করবেন। এখানেও ওই লিপ রিডিংটা বধিরজনের পক্ষে খুব জরুরী, তাই কথা বলতে বলতে বা অন্য কারুর প্রশ্নের উত্তর দিতে হঠাত্ মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলে বধিরজনের পক্ষে কথোপকথনের সূত্ররক্ষা করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
৭) বধিরতার সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হোলো না-শোনা বা না-বোঝা নয়, সেটি হোলো ভুল শোনা এবং ভুল বোঝা। কাজেই যদি বধিরজনকে এমন কথা বলতে চান যেটির যথার্থ অর্থ বোঝা অতি আবশ্যক, তাহলে যাচিয়ে নেবেন যে বধিরজন কী শুনেছেন, কী বুঝেছেন। নয়তো তিনি "ধান" কাটার বদলে "কান" কেটে বসে থাকতে পারেন।
শুধু কথোপকথন চালাবার জন্য এতো নিয়ম মেনে চলা, বিশেষত যা স্বাভাবিক চলনের ব্যতিক্রম তাই করতে থাকা, এ সবায়ের পক্ষে কষ্টকর, বধিরজনের শুভানুধ্যায়ীরা ব্যতিক্রম নন। যেমন ধরুন একাধিক লোকে মিলে যেখানে আলোচনা চলছে সেখানে বিভিন্ন শ্রোতার দিকে মুখ না ফিরিয়ে একদিক ফিরে কথা বলা। বা, বহু বছরের অভ্যাসে আমাদের প্রত্যেকের সংলাপে এক বিশেষ উচ্চারণপদ্ধতি এবং এক গতিহার মজ্জাগত হয়ে গেছে। বধিরজনের কথা মনে রেখে সেটা একবার ঠিক করে নিলেও তার থেকে চ্যুতি হওয়া স্বাভাবিক, বারবার সতর্ক করে দিলে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিরক্তি আসতে বাধ্য। এর ওপরে বধিরজনেরা সাধারণত স্পর্শকাতর, কাজেই তাঁরা না শুনতে পেলেও শোনার ভাণ করবেন, মিথ্যে বলবেন, বারবার পুনরাবৃত্তির অনুরোধ করে বিরক্তিভাজন হবার ভয়ে কথোপকথনে যোগ দেওয়া বন্ধ করে দেবেন এবং মেজাজ খারাপ করে বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকতেও পারেন। বধিরজনের সংসর্গে থাকা কঠিন, সঙ্গে বাস করা প্রায় অসাধ্য!
-৩-
বধিরতা নিয়ে কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। শব্দের শক্তি মাপা হয় একটু গোলমেলে উপায়ে, তাকে বলে ডেসিবেল বা ডিবি। সেটা কী তা বিশদভাবে জানার প্রয়োজন নেই, এটা জানলে হবে যে ০ ডিবির দশগুণ হোলো কুড়ি ডিবি, চল্লিশ ডিবি হবে একশো গুণ, ইত্যাদি। সাধারণ সুস্থ সবল শ্রবণশক্তিবিশিষ্ট মানুষ যে মৃদুতম যে শব্দটি শোনেন (অর্থাত্ আছে কি নেই তার তফাত্ করতে পারেন) সেই শব্দের শক্তিকে ধরা হয় ০, শূন্য ডিবি। কথোপকথন চালাতে শব্দের অন্তত ২৫ ডিবি শক্তি লাগে, সেটি ফিস্ফিসানির বা শান্ত লাইব্রেরি ঘরের শব্দশক্তি। সাধারণত কথাবার্তা চলে ৬০ ডিবিতে। এই যাঁদের এই ২৫ ডিবির শব্দ শুনতে অসুবিধা হয় তাঁদের শ্রবণ-প্রতিবন্ধী (হিয়ারিং ইম্পেয়ার্ড) বলা হয়। এ প্রতিবন্ধের চারটি স্তর আছে-- স্বল্প, মাঝারি, প্রবল, প্রগাঢ় (মাইল্ড, মডারেট, সিভিয়ার, প্রোফাউণ্ড)।
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের অধুনাতম পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বের ৩৬ কোটি মানুষ, শতকরা ৫ ভাগ, শ্রবণ-প্রতিবন্ধী -- তাঁদের শোনাতে গেলে শব্দের শক্তি অন্তত ৪০ ডিবি (শিশুদের ক্ষেত্রে ৩০ ডিবি) হওয়া প্রয়োজন। এর বেশীর ভাগই মধ্য- বা নিম্ন-আয়ের দেশের বাসিন্দা। এদিকে ৬৫ বছরের বেশী বয়সী মানুষদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ শ্রবণ-প্রতিবন্ধী। মধ্য আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া (ভারতবর্ষ এর মধ্যে পড়ে) এবং প্রশান্ত মহাসাগর তটবর্তী দেশেই এঁদের বেশী দেখা পাওয়া যায়। আমেরিকার প্রতিবন্ধীদের পরিসংখ্যান হচ্ছে সাড়ে তিন কোটি এবং ওপরের মাপকাঠি ব্যবহার করলে যাঁদের বয়েস পঁচাত্তরের ওপরে তাঁদের প্রায় অর্ধেকই বধির। এই পরিসংখ্যান নিতে যাঁরা নিজেদের বধির বলে জানেন কেবল তাঁদেরই ধরা হয়েছে। বধিরতার একটা অসুবিধা হচ্ছে অনেকেই যে বধিরতার চৌকাঠ পেরিয়ে গেছেন সেটা বুঝতে পারেন না, বা বুঝেও স্বীকার করতে চান না।
আমেরিকাতেও বধির লোকদের সংখ্যা এতো বেশী দেখে একটু আশ্চর্য লাগে। আমেরিকা শব্দময় ছেনি-হাতুড়ির জগত্ থেকে বেরিয়ে এখন তথ্য প্রযুক্তির জগতে ঢুকছে। এছাড়া শব্দদূষণ, বিশেষত কর্মক্ষেত্রে দূষণের ব্যাপারে আমেরিকার আইনপত্রে বেশ কড়াকড়ি, OSHA নিয়মকানুন শ্লথ নয় মোটেই। বধিরজনের সংখ্যাবৃদ্ধির একটা কারণ অবশ্য মানুষের আয়ুবৃদ্ধি। যেহেতু বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে বধিরতার মাত্রা বৃদ্ধি পায়, সেহেতু বৃদ্ধের সংখ্যা যতো বাড়বে, বধিরের সংখ্যাও ততো বাড়বে, এমনটিই হওয়া উচিত। একটা অদ্ভুত ব্যাপার যে বধিরজনেরা তাঁদের বধিরতা চট করে স্বীকার করতে চান না। বধিরতার প্রথম প্রকাশ সাধারণত মৃদু এবং বধিরতা বাড়েও আস্তে আস্তে। কিন্তু এ সত্ত্বেও দেখা গেছে যে হিয়ারিং এড পরলে উপকার হতে পারে বলে যাঁরা জানেন তাঁদের মধ্যেও পাঁচজনের একজন মাত্র হিয়ারিং এড ব্যবহার করেন। হিয়ারিং এডের প্রচুর দাম এবং বহু ইন্সিওরেন্স কোম্পানী হিয়ারিং এড কেনার পয়সা দিতে চায় না, সেটা অবশ্য এক বড়ো কারণ।
-৪-
আমার নিজের কথা বলি। মা কানে কম শুনতেন। আমার ক্ষেত্রে আমি যে কানে কম শুনছি, মধ্যযৌবন অবধি এ বোধটা হয়নি। গান, বিশেষ করে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, ছিলো আমার নেশার মতো -- আমার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া-- তা গান শুনতে বা গাইতে অসুবিধা হচ্ছে, এও মনে হয়নি। যখন চল্লিশ পার হলাম তখন আমার এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রথম বললেন, ওহে, কানটা একটু দেখাও, তোমার শ্রবণশক্তি কমেছে এবং তা লোকের নজরে পড়তে আরম্ভ করেছে। দেখালাম, ডাক্তার বললেন বংশানুক্রমিক ব্যাপার, নার্ভ ডেথ আরম্ভ হয়েছে, আস্তে আস্তে খারাপ হতেই থাকবে, কিছু করার নেই। কিছু পয়সা খরচা করে দুকানে হিয়ারিং এড লাগালাম, মাঝারি সাইজ, বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া যায় তবে নজর করতে হয়। বন্ধু বললেন, ঠিক হয়েছে। গানবাজনা শুনতে কোনো অসুবিধেই নেই, এক গানের স্কুলে ঢুকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে গাইতে আরম্ভ করলাম, আহামরি কিছু হোলো না তবে লোকে বললে ঘরোয়া পরিবেশে চলতে পারে। এমনি করে দিন যায়, নিজের অজান্তেই হিয়ারিং এডের ভল্যুম বাড়াতে হচ্ছে, গান গাই, তবে ইস্কুলের দিদিমণি আর ততো বাহবা দেন না। মধ্যে হিয়ারিং এডের প্রযুক্তি ডিজিটাল হোলো, কিনে ফেললাম। কলেজে পড়াই, পেছনের বেঞ্চের ছাত্রেরা প্রশ্ন করলে কাছে গিয়ে আবার শুনতে হয়। তা ক্লাস শুরু হবার আগে ওদের সোজাসুজি বলে দিতাম, দেখ বাপু আমি কানে খাটো, কাজেই তোমার কথা অবজ্ঞা করে শুনছি না তা নয়, একটু ক্ষ্যামাঘেণ্ণা করে নিও। আর তারা নিতো। গানবাজনা শোনাটা চলেছে পুরো দমে, সূক্ষ্ম কাজ ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছি বলেই মনে হচ্ছে, তবে তা যাচাই করার চেষ্টা করিনি। মোটামুটি পালে দুয়েকটা ফুটো থাকলেও তরী চলছে সোজাসুজিই।
এর মধ্যে বাঁধা কাজ থেকে অবসর নিলাম। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তিল তিল করে অনেক গান সংগ্রহ করেছিলাম, সেই ৭৮ আরপিএমের ডিস্ক থেকে আরম্ভ করে বড়ো টেপ রেকর্ডারের সাত ইঞ্চি রীল, ক্যাসেট তো অগণ্য, সিডি ইত্যাদি। কিছু দুষ্প্রাপ্য লাইভ রেকর্ডিংও ছিলো। কম্পিউটারের দৌলতে তখন ডিজিটাল রেকর্ডিং প্রযুক্তির বন্যা এসেছে। ঠিক করলাম যে ভালো সফ্টওয়ার কিনে ওই পুরনো রেকর্ড, টেপ ইত্যাদির গান ঘষে মেজে শ্রোতব্য করে রাখবো। হিসেব করে দেখলাম যে আমি যদি আমার জেগে থাকার শতকরা সত্তর ভাগও এই কাজে ব্যয় করি, তাহলে আমার যা সংগ্রহ (এবং তা বর্ধমান) শেষ করতে পাঁচ-সাত বছর লাগবে তো বটেই, বেশীও হতে পারে। অবসরের অবসর কাটানোর কোনো বাধা রইলো না আর, দিনে দশ ঘণ্টা আমি সঙ্গীতেই ডুবে রইলাম। শ্রবণশক্তি যদি বেশ দুর্বলও হয়ে থাকে, তাতে যা করতে আরম্ভ করলাম তাতে কিছু বাধা এলো না।
২০০৫ সালের গোড়ার দিকে কোলকাতা আর ঢাকা ঘুরে ফিরলাম। এক রাত্রি কাটার পরেই মাথার যন্ত্রণা নিয়ে অজ্ঞান, জ্ঞান যখন ফিরলো সাতদিন পরে তখন শরীরে শতেক অস্বাচ্ছন্দ্য, কানে কিছু শুনতে পাইনা। লোকে বললে ব্যাক্টিরিয়াল মেনিঞ্জাইটিস। কর্ণপটহে, ইয়ার ড্রাম, ফুটো করতে হয়েছে, হিয়ারিং এড পরা চলবে না। এর মধ্যে গোদের ওপর বিষফোড়া, হঠাত্ স্ট্রোক হয়ে চিত্পাত। মাস কযেক কেটে গেলো তার থেকে সুস্থ হয়ে কাজ চালানোর মতো উঠতে, বসতে, চলতে, ফিরতে। কানের দিকে নজর দেবার সুযোগই পাওয়া গেলো না। নতুন প্রাণ পাবার উত্সাহে একদিন প্রাণ খুলে গান গাইছি, হিয়ারিং এড তখনো পরা যায়নি, আত্মীয়া বললেন এমা, এ কী বিচ্ছিরি প্যারডি গাইছিস? হিয়ারিং এড যখন পরা গেলো তখন শুনি ভীমসেন যোশী ভুল সুরে গাইছেন। আমার মাথায় বজ্রপাত, আমি সুরকাণা, টোন ডেফ হয়ে গেছি। এ হতে পারে না, এ হতে দেব না-- গানবাজনা নিয়ে আমি বেঁচে আছি, অতি সুখে আছি। তারপর এলিজাবেথ কুবলার-রস দুঃখভোগের যে পাঁচটি পর্যায় বলেছেন-- অস্বীকার, ক্রোধ, রফার চেষ্টা, বিষাদ এবং স্বীকৃতি (ডিনায়াল, অ্যাঙ্গার, বার্গেন, ডিপ্রেশন, অ্যাক্সেপ্ট্যান্স) -- সুবোধ বালকের মতো সব বুড়ীই ছুঁয়ে এলাম। ডাক্তারদের কাছে দৌড়োদৌড়ি করলাম, পায়ে ধরলাম, তাঁরা বিচক্ষণ লোক, যখন মিথ্যা আশ্বাস দিতে রাজী হলেন না তখন রাগারাগি করলাম। রফা করার ব্যাপারটা ঠিক মতো করা গেলো না, আমি নাস্তিক লোক, রফাটা করি কার সঙ্গে। তারপর একনাগাড়ে আড়াই বছর বিষাদে, ডিপ্রেশনে ভুগলাম, নিজের ও কাছের লোকদের জীবন দুর্বিষহ করে। সবটাই কানের জন্য, তা বললে ভুল হবে, মেনিঞ্জাইটিস অতি নচ্ছার রোগ, মস্তিষ্কের (এবং শরীরের অন্য অঙ্গপ্র্ত্যঙ্গে) কোথায় কী ছোবল মেরে গেছে তা আস্তে আস্তে ধরা পড়তে লাগলো এবং তার পুনর্বাসনে সময় ও শক্তিব্যয়ও চলতে লাগলো।
বাড়ী বাঁধা দিয়ে নতুন হিয়ারিং এড কিনে কানের পিছনে লাগা গেলো। সব গান ভুল সুরে শুনি। কণ্ঠসঙ্গীত শুনতে শুনতে হঠাত্ বিনা নোটিশে স্কেল বদলে যায়, বারবার, গানের বাণী স্পষ্ট শোনায় না। যন্ত্রসঙ্গীত তো একেবারে শুরু থেকেই বেসুর। হিয়ারিং এড না পরলে কিছুই শুনতে পাই না, টেলিভিশনে লোকেদের ঠোঁট নড়ছে অথচ কোন শব্দ বের হচ্ছে না। এড পরলে মনে হয় সকলেরই অত্যধিক সুপুরী খেয়ে জিভে জড়তা এনে বসে আছে, বারবার "এ্যাঁ", "কী" বলার পর তাঁরা যদিও আরো জোরে কথা বলেন, কিন্তু আরো পরিষ্কার করে বলেন না। হিয়ারিং এড কোম্পানীর ঠাকরুণের কাছে গেলাম, তিনি নানা ঘণ্টা নেড়ে রায় দিলেন আমার শোনবার অনুভূতিই যে শুধু নষ্ট হয়েছে তা নয়-- হিয়ারিং এড দিয়ে সেটি ম্যানেজ করা যায়-- অর্থ উপলব্ধিও, কম্প্রিহেনশন, বেশ প্রমাণ সাইজে নষ্ট হয়েছে। হিসেব কষে দেখা গেলো যে দুকানে হিয়ারিং এড পরে, একেবারে হৈচৈশূন্য পরিবেশে যা শুনি তার মাত্র অর্ধেক বুঝি। এ জিনিস ঠিক করা আজকের হিয়ারিং এড প্রযুক্তির সাধ্য নয়। ডাক্তাররাও এতোদিন তাই বলার চেষ্টা করছিলেন, আমি শুনতে চাই নি, মানতেও নয়।
তারপর অনেক ওঠানামার মধ্যে দিয়ে এলাম, কান আর ঠিক হোলো না। তার ফল, কিছু মানিয়ে নিতে হোলো, আর যা মানিয়ে নেওয়া গেলো না তা জীবন থেকে বাদ দিতে হোলো। এখন যেখানে এসে পৌঁছেছি সেখানে গানবাজনা নেই, নেই থিয়েটার দেখা বা সভায় যাওয়া। সেল ফোন বাদ, টেলিফোনে স্পীকারফোন থাকলে চলে, দরকারী কল হলে গিন্নিকে ডেকে আনি। দোকানবাজারেও তাই, একান্ত একলা পড়ে গেলে গোড়াতেই কালা বলে স্বীকার যাই, এখানে মোটামুটি সহানুভূতি পাওয়া যায়, কিন্তু আমি যদি কথা না বুঝতে পারি তাহলে তাঁরা আর কী করবেন? মানুষজনের কথা কখনো কিছু বুঝি কখনো বুঝি না, কখন এবং কেন আমার কোনো ধারণা নেই। "উনি কেবল ওঁর সুবিধে মতো শুনতে পান" বললে রাগ করা ছেড়ে দিয়েছি। আড্ডা বা কোনো জমায়েতে যাই না, দুতিনজনের বেশী হলেই আমার সেখানে থাকা বা না থাকা সমান। যেখানে না গেলে নয় সেখানে গিয়ে কখন খেতে পাবো আর কখন বাড়ী যাবো তার চিন্তা নিয়ে বসে থাকি-- ছেলেবেলায় যখন বড়োদের জমায়েতে জোর করে নিয়ে যাওয়া হোতো তখনকার মতো। কেবল এখন আমার বয়স সত্তর ছাড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি মাঝে মাঝে জোর করে গানবাজনা শুনতে আরম্ভ করেছি, কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক অতি ঘুঘু, দুয়েক মিনিট শোনার পর সে ভেতর থেকে কানের সুইচ বন্ধ করে দেয়, দিয়ে অন্য কিছু ভাবতে থাকে। চাকতির মুভি দেখি যাতে ক্যাপশন আছে, কিন্তু তা পড়তে গিয়ে স্ক্রীনে কী ঘটছে তার আর হদিশ রাখা হয় না। দিনের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ কাটে নিঃসঙ্গ ভাষাহীন নিঃশব্দতার মধ্যে। জানি বদ নেশার মতো, কিন্তু ছাড়তে পারি না, ছাড়ার উপায় কই?
-৫-
এবার এই শ্রবণ যন্ত্রটা কী করে কাজ করে সেটা একটু দেখা যাক। যদি খুব খটোমটো লাগে তাহলে এই অংশটা না পড়লেও চলবে। সাধারণ মানুষ বধিরতার বেশী খবর রাখেন না। সে কারণে এবং বধিরজনের সহৃদয় বন্ধুবান্ধব ব্যাপারটা ভালো করে বুঝলে পর বধিরজনকে হয়তো আরো সাহায্য করতে পারবেন সে কারণে আমি এই ব্যাপারটির আলোচনা করছি।।
প্রথমে শব্দের ব্যাপারটাকে একটা মাত্রা দেওয়া দরকার। শব্দ ছড়ায় হাওয়া বা অন্য কোনো মাধ্যমে ঢেউয়ের রূপে। এই তরঙ্গ সেকেণ্ডে যতো বার ওঠানামা করছে তাকে বলা হয় ফ্রিকোয়েন্সি আর কতোটা ওঠানামা করছে তাকে বলে অ্যাম্প্লিচুড। দেখা গেছে যে শব্দতরঙ্গ যতোই গোলমেলে হোক না কেন তাকে কিছু মৌল ফ্রিকোয়েন্সির তরঙ্গের যোগফল হিসেবে দেখা যায়। এই মৌল শব্দতরঙ্গের মধ্যে যেগুলোর ফ্রিকোয়েন্সি কমের দিকে (এখন আমরা সঙ্গীত বা কথাবার্তার কথা বলছি) সেগুলোকে আমরা বলি বেস bass, খাদ, আর উঁচুর দিকে যেগুলো, সেগুলোকে বলি ট্রিবল treble, চড়া।
Physiology of Human Ear
ওপরের ছবিটির ওপর ক্লিক করলে
একটি চলমান ছবি দেখতে পাওয়া যাবে। পরে এ নিয়ে আলোচনা দেখুন।
এখন কানের কাজ হচ্ছে বাতাসে যে শব্দ ঢেউ তুলে বেড়াচ্ছে সেই ঢেউয়ের থেকে বিদ্যুত্ঘাত, ইলেক্ট্রিক্যাল ইম্পাল্স তৈরী করা, তারপর সেই ইম্পাল্স স্নায়ুর মাধ্যমে মগজের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেওয়া। তারপর কী করে মগজ সেই শব্দের অর্থ-অনর্থ স্থির করে তা বিজ্ঞানীরা এখনো বুঝে উঠতে পারেন নি। কান কী ভাবে তার কাজটি করে? জনসভায় যে মাইক্রোফোন-অ্যাম্প্লিফায়ার-স্পীকার বা পাব্লিক অ্যাড্রেস ওরফে পিএ সিস্টেম নামক ঘটনাটি থাকে, অনেকটা তার মতোই, কেবল পিএ সিস্টেমে গোড়াতেই শব্দতরঙ্গকে বিদ্যুত্তরঙ্গে রূপান্তরিত করা হয় আর কানের ব্যাপারে সেটি হয় সব শেষে। কানের যে অংশটি আমরা দেখতে পাই, আউটার ইয়ার, সেটির নাম পিন্না, তার কাজ হোলো নানা দিক থেকে আসা শব্দতরঙ্গকে এক সঙ্গে করে কানের ফুটো, ইয়ার ক্যানাল (ছবির ১), দিয়ে ভেতরে পৌঁছে দেওয়া। পিন্নাতে শব্দতরঙ্গ কীভাবে বইবে তা নির্ভর করে শব্দ কোনদিক, অর্থাত্ কতোটা ওপর বা নীচ থেকে আসছে তার ওপরে। মগজে সেই প্রতিফলনের বিচার করে তার থেকে ওপর-নীচ, আর বাঁ ও ডানকানের মধ্যে শব্দ পৌঁছবার সময়ের তফাত্ থেকে শব্দ যে ঠিক কোনখান থেকে এলো তা স্থির করতে পারে।
ইয়ার ক্যানাল দিয়ে এসে শব্দতরঙ্গ যেখানে আছড়ে পড়ছে তার নাম হোলো কর্ণপটহ, ইয়ার ড্রাম বা টিম্প্যানিক মেম্ব্রেন (ছবির ২)। এটি আধ ইঞ্চি মাপের একটি cone-আকারের চামড়া, অতি স্পর্শকাতর, নমনীয়তা কম এবং টানটান করে ইয়ার ক্যানালের প্রান্তে আটকানো আছে। এর অন্যদিককে বলে কানের মধ্যপ্রদেশ, মিডল্ ইয়ার। সেখান থেকে গলার সঙ্গে সংযোগ রাখে এক নল (ছবির ৭)। সেটি থাকার জন্য সাধারণ অবস্থায় ইয়ার ড্রামের দুদিকে বাতাসের চাপ থাকে সমান। তার ফলে যখন ইয়ার ড্রামের ওপর শব্দতরঙ্গ আছড়ে পড়ে তখন ইয়ার ড্রামও সেই তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সির সমান মাপে কেঁপে ওঠে। যাঁরা মাইক্রোফোনের খবর রাখেন তাঁরা বুঝবেন যে ইয়ার ড্রাম হোলো মাইক্রোফোনের ডায়াফ্রামের মতো। কিন্তু ইয়ার ড্রাম আরো দুটি উপায়ে শোনার ব্যাপারে সাহায্য করে। প্রথম হোলো যে খাদের আওয়াজ যদি খুব জোরে কানে আসে তাহলে আপনা আপনিই, রিফ্লেক্স অ্যাকশনে, ইয়ার ড্রামের নমনীয়তা কমে যায়, তাতে কানের ভেতরে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা কমে। দ্বিতীয়, এই একই ভাবে ইয়ার ড্রাম ব্যাকগ্রাউণ্ড নয়েজটাও চেপে রাখে আর আমরা নয়েজ ছেড়ে আসল কথাবার্তায় মনোযোগ দিতে পারি। প্রসঙ্গত, সারা শ্রবণ ব্যবস্থার মধ্যে এই ইয়ার ড্রামই হোলো একমাত্র অনুভূতিময় প্রত্যঙ্গ, সেন্সরি অর্গ্যান।
ইয়ার ড্রামের যে দিকটি মিডল্ ইয়ারে, সেই দিক থেকে তিনটে অদ্ভুতদর্শন ছোট্টো হাড় (ছবির ৩, ৪, ৫) আঁকাবাঁকা হয়ে জোড়া লেগেছে যেখানে সেটির নাম কক্লিয়া, cochlea (ছবির ৮), আর যেখানে জোড়া লাগছে তা হোলো ওভাল উইণ্ডো (ছবির ৬)। কক্লিয়া হোলো কানের আভ্যন্তরীণ প্রদেশ, ইনার ইয়ারের বাসিন্দা। এই তিনটি অদ্ভুত হাড়কে বলে অসিকল্স্, এদের কাজ হোলো শব্দের চাপ, প্রেশার, বাড়িয়ে দেওয়া, অ্যাম্প্লিফাই করা। এবং সেই কর্মটি এরা অতি নিপুণভাবে সমাধা করে -- দেখতে অত ছোটো হলে কী হবে, ওইটুকু জায়গাতেই ইয়ার ড্রামের ওপরের চাপ বিশ থেকে বাইশগুণ বাড়িয়ে ওভাল উইণ্ডোতে পৌঁছে দেয়। এই কক্লিয়াটিও আর এক বিস্ময়কর জিনিষ। এটি হোলো একটি নলী, টিউব, শামুকের খোলের মতো গুটিয়ে থাকে একটা মটরশুঁটির মাপে, ভেতরটা তরল পদার্থে ভরা। টিউবটি কার্যত দুটি কুঠরীতে, চেম্বারে, ভাগ করা, তাদের মাঝের দেয়ালটির নাম ব্যাসিলার মেম্ব্রেন। এই ব্যাসিলার মেম্ব্রেনের গঠনটিও লক্ষ্যণীয, এটি আড়াআড়িতে, অর্থাত্ কক্লিয়ার প্রস্থ বরাবর, বিশ থেকে ত্রিশ হাজার বেতের মতো নমনীয় সূক্ষ্ম তন্তু, রীডি ফাইবার, দিয়ে তৈরী। তাদের মধ্যে ওভাল উইণ্ডোর কাছেরগুলি ছোটো, আর ওভাল উইণ্ডো থেকে যতো দূরে যাওয়া যাচ্ছে ততোই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। একটা ফাইবার কতোটা লম্বা সেই মতো বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে অনুরণক, রেজোন্যাণ্ট। ওভাল উইণ্ডোর যতো কাছে আসা যাবে এই ফাইবারের রেজোন্যাণ্ট ফ্রিকোয়েন্সি ততো চড়ার দিকে, আর যতো দূরে ততো খাদের দিকে যাবে। যখন ওভাল উইণ্ডোটি অসিক্ল্ অস্থিগুচ্ছের আঘাতে কাঁপতে থাকে, তখন সেই কাঁপন কক্লিয়ার তরল পদার্থের মধ্য দিয়ে বয়ে যায়। ফলে শব্দতরঙ্গের মধ্যে যে যে ফ্রিকোয়েন্সি আছে, সেই সেই ফ্রিকোয়েন্সির রেজোন্যাণ্ট যে ফাইবারগুলি, সেগুলি কাঁপতে আরম্ভ করে। অনেকটা যেন জলের মধ্যে নানা মাপের বেত ডুবে আছে, জলে ঢেউ উঠলে পর লম্বা বেত খাদের ঢেউ আর খাটো বেত চড়ার ঢেউতে নেচে উঠলো। যাঁরা বিজ্ঞান পড়েছেন তাঁরা জানেন যে এভাবেই টিউনিং ফর্ক কাজ করে। এইভাবে আমাদের শ্রবণেন্দ্রিয় বাইরের শব্দতরঙ্গকে কানের মধ্যে নিয়ে এলো এবং শুধু তাই নয়, সেটিতে যে যে ফ্রিকোয়েন্সি আছে সেই সেই ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা করে ফেললো। খেয়াল রাখতে হবে যে এখনো পর্যন্ত সবই ঘটছে যান্ত্রিক, মেক্যানিকাল, উপায়ে। বৈদ্যুতিক ব্যাপার আসবে একেবারে শেষ পর্যায়ে।
মেম্ব্রেনের এই ফাইবারগুলির ঠিক ওপরে আরেকটি স্তরে হাজার হাজার শুঁয়োর মতো কোষ, হেয়ার সেল্স্ আছে,-- তাদের অর্গ্যান্স্ অফ কর্টি বলা হয়-- তারা এই ফাইবারের কাঁপন টের পায় ও কোথাকার ফাইবার (তার ওপর খাদ আর চড়া নির্ভর করছে) কাঁপলো এবং কতোটা কাঁপলো তার ওপর নির্ভর করে বিদ্যুত্ঘাত, ইলেক্ট্রিকাল ইম্পাল্স্ সৃষ্টি করে। এই ইম্পাল্স্গুলো তারপর সংলগ্ন স্নায়ুর, অডিটরি নার্ভ (ছবির ৯), মারফত্ মগজের শ্রবণ কেন্দ্রে, অডিটরি কর্টেক্সে পৌঁছোয়। তারপর সেই বিদ্যুত্ তরঙ্গ কী করে গান, কথা, ইত্যাদি ইত্যাদিতে পরিণত হয় আর তাদের অর্থ বোধগম্য হয়, সে রহস্য আজও মোটামুটি অজানা। ওপরের ছবিটির ওপর ক্লিক করলে যে পদ্ধতিটির বিবরণ দিলাম তার একটি চলমান ছবি দেখতে পাওয়া যাবে।
-৬-
শ্রবণশক্তি কমে যাবার কারণগুলোকে মোটামুটি দুভাগে ভাগ করা যায়-- প্রথমটিকে বলা হয় পরিবহনজনিত, কন্ডাক্টিভ আর দ্বিতীয়টি স্নায়বিক, সেন্সোনিউরাল সংক্ষেপে SNHL। শতকরা দশ ভাগ বধিরতাকে ফেলা যায় প্রথম ভাগে-- মুখ্যত আউটার বা মিড্ল্ ইয়ারের গোলমাল, যথা ইয়ার ড্রামে ফুটো হয়ে যাওয়া, অসিক্লের হাড় সরে যাওয়া, টিউমার ইত্যাদি, সাধারণত বাচ্চারাই এতে বেশী ভোগে। আর SNHL, যেটি শতকরা ৯০ ভাগ বধিরতার কারণ, সেটির বাসা ইনার ইয়ার অর্থাত্ কক্লিয়া, তার অভ্যন্তরের ফাইবার, অর্গ্যান অফ কর্টি এবং শেষমেষ অডিটরি নার্ভের স্নায়ুগুচ্ছে। এর মধ্যে আবার অর্গ্যান অফ কর্টির যে শুঁয়োর মতো কোষের কথা বলা হয়েছে, সেগুলিই নষ্ট হয় বেশী। স্নায়ুর ক্ষতিকেই যথার্থভাবে স্নায়বিক বলা যায়, কিন্তু পুরো SNHL-টাকেই স্নায়বিক ক্ষতি, নার্ভ ড্যামেজ বলার চল আছে। কান সংক্রান্ত স্নায়বিক ক্ষতি ভালো করা এখনো চিকিত্সা বিজ্ঞানের নাগালের বাইরে, যদিও দেহের অন্য নার্ভ ড্যামেজ চিকিত্সার অধুনা অনেক উন্নতি হয়েছে।
এই নার্ভ ড্যামেজের বহু কারণ থাকতে পারে। প্রথম হোলো বয়স, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আস্তে আস্তে এই হেয়ার সেলগুলি তাদের নমনীয়তা হারিয়ে ফেলতে শুরু করে আর ঠিক ঠিক ফ্রিকোয়েন্সিতে সাড়া দিতে পারে না। দ্বিতীয় হচ্ছে নয়েজ-- নিয়ত কর্মব্যস্ত শহরের, ভীষণ জোরের স্পীকারের বা টিভির এবং কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে শোনার যে নয়েজে আমরা ডুবে থাকি, সেই নয়েজ এবং / অথবা হঠাত্ বিস্ফোরণের মতো প্রচণ্ড নয়েজ। তৃতীয় হচ্ছে কিছু ওষুধপত্র ব্যবহার সংশ্লিষ্ট কুফল, সাইড এফেক্টস্। চতুর্থ হচ্ছে বিশেষ বিশেষ রোগের আক্রমণ। যে হেয়ার সেলগুলি চড়া সুরে, ট্রিব্ল্, সাড়া দেয়, সেগুলিই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে-- কাঁপনের জোর কমে যেতে থকে এবং একদিন হয়তো বন্ধও হয়ে যায়। তার মানে শব্দতরঙ্গের মধ্যে সেই মৌল ফ্রিকোয়েন্সির যে তরঙ্গ ছিলো, সেগুলির খবর সঠিকভাবে অডিটরি কর্টেক্সে পৌঁছোয় না। এতোক্ষণে সুরকাণা হবার ব্যাপারটা বোঝা গেলো কেননা কিছু কিছু স্বর কানে আসছে ঠিকই কিন্তু মগজে পৌঁছোচ্ছে না, অতএব মস্তিষ্ক তাদের ভুলভাল ছাপ লাগিয়ে ফেলছে-- যেমন শুদ্ধ আর কোমল স্বরের, হয়তো নিষাদ, পার্থক্য ধরতে পারছে না। কিছু সময় মনে হচ্ছে শুদ্ধ আবার হঠাত্ মনে হচ্ছে কোমল। যাঁরা গান নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, তাঁরা একে "সুর কম লাগা"র চরম বলে ধরতে পারেন। যন্ত্রসঙ্গীতে স্বর লাগে একেবারে ঠিকঠাক, কাজেই স্বরের অনুপস্থিতিও ঘটছে অকস্মাত্, এবং কানে বেসুর লাগছে আরো বেশী। বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে এসবই ঘটছে মগ্নচৈতন্য, সাব্কন্শাসে, কাজেই চেতন হয়ে এ বিষয়ে সতর্ক থাকলেও লাভ হয় না কোনো।
db Levels of Vowels and Consonants + Imposed Audiogram of a hearing-impaired person
এবার বধিরতা আর কথাবার্তা শোনা আর বোঝার ব্যাপার নিয়ে একটু আলোচ্না করা যাক। প্রথমে লক্ষ্য করা দরকার যে প্রায় সব ভাষাতেই ব্যঞ্জনবর্ণ স্বরবর্ণের চেয়ে অনেক বেশী অর্থবহ। এটা স্বাভাবিক, ব্যঞ্জনবর্ণের সংখ্যা স্বরবর্ণের চাইতে বেশ কয়েকগুণ বেশী, অতএব তাদের নানাভাবে বিন্যাস করে অনেক বেশী কথা তৈরী হতে পারে অর্থাত্ বেশী অর্থ প্রকাশ করা যায়। দ্বিতীয়, বেশীর ভাগ ব্যঞ্জনবর্ণের ফ্রিকোয়েন্সি চড়ার দিকে এবং গ্রাম বা অ্যাম্প্লিচুড স্বরবর্ণের চেয়ে মৃদু। অডিওগ্রাম বলে একরকমের ছবি ডাক্তারেরা ব্যবহার করেন, একটা গ্রাফ পেপারের মতো দেখতে, তাতে বাঁদিক থেকে ডানদিকে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি বেড়ে যায় আর ওপর থেকে নীচের দিকে গেলে মৃদুতা কমে শব্দের গ্রাম বেড়ে যেতে থাকে। সেই অডিওগ্রামে যদি স্বর- আর ব্যঞ্জনবর্ণ সাধারণত যেমন উচ্চারণ করা হয় তার মাত্রা দেখানো যায় (ছবি দেখুন) তাহলে এই ব্যাপারটা আরো খোলসা হবে। স্বরবর্ণগুলোর সবকটিরই ফ্রিকোয়েন্সি কমের দিকে। ব্যঞ্জনবর্ণের বেশীর ভাগই চড়ায়, শুধু তাই নয়, উচ্চতার মাত্রাও কম। আরো লক্ষ্যণীয় যে কিছু ব্যঞ্জনবর্ণ খুব ঘেঁষাঘেঁষি, অর্থাত্ একটি বর্ণকে কাছের অন্য বর্ণ হিসেবে শোনার (যথা স ও হ কিংবা থ, প, গ আর চ, জ,দ আর ল ইত্যাদি) সম্ভাবনা বেশী। এবার এই একই ছবির ওপরে যদি এক বধির মানুষের শ্রবণশক্তির ছবি (যাকে বলে হিয়ারিং থ্রেশোল্ড, যেটি দেখানো হয়েছে সেটি একজন মডারেট রকমের বধিরজনের। আমি সিভিয়ার রকমের বধির, অতএব আমার অবস্থা আরো অনেক খারাপ) রাখা যায় [ব্রাউজারে দেখতে হলে ছবিটির ওপর ক্লিক করুন] তাহলে বধিরতার বিশেষ সমস্যাটি প্রকট হবে। ছবিতে যে কোনো ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ যাতে বধিরজন শুনতে পান তার জন্য অন্তত কতোটা জোর থাকা দরকার সেটি একটা লাইন টেনে দেখানো হয়েছে। তার মানে ছবির যে অংশের রং গাঢ়, সেই অংশে (ফ্রিকোয়েন্সি ও মৃদুতা মিলিয়ে) কোনো শব্দ পড়লে বধিরজন তা পরিষ্কার শুনতে পাবেন না। শুধু তাই নয়, কাছাকাছি ফ্রিকোয়েন্সির শব্দের তফাত্ তাঁরা ধরতে পারবেন না। আজকালকার হিয়ারিং এড লাগিয়ে পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি করা যায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এই হিয়ারিং থ্রেশোল্ডের ছবিটি একেবারে নিঃশব্দ পরিবেশে প্রযোজ্য, নয়েজের উপস্থিতিতে এটির বহুগুণ অবনতি ঘটবে। হিয়ারিং এড লাগিয়ে যদিও বা শব্দের জোর বাড়ানো যেতে পারে, কাছাকাছি ব্যঞ্জনবর্ণগুলোকে ফারাক করার ব্যাপারে হিয়ারিং এড থেকে কিছু বিশেষ সাহায্য পাওয়া যায় না। এর এক অবশ্যম্ভাবী ফল হোলো ভুল শোনা নয়, ভুল বোঝা, এবং তার ফল শুনতে না পাওয়ার থেকে আরো খারাপ হতে পারে।
-৭-
আমি যে শুনতে পাচ্ছি না, সেটা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না!
বধিরজনেরা হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা বা দায়সারা ভাবে ঘাড় নাড়াটা তাড়াতাড়ি রপ্ত করে ফেলেন এবং ব্যবহারও করেন। তার একটা কারণ হোলো সাধারণ কথাবার্তা চালাতে গিয়েই বধিরজনেরা এমন ধাক্কা খান যে আস্তে আস্তে সে পথ না মাড়ানোটাই ভালো বলে ভাবতে আরম্ভ করেন। যেমন প্যারিসে গিয়ে খুব চিন্তা করে ঠিকঠাক ফরাসী শব্দ ব্যবহার করে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম এবং আমার চোস্ত ফরাসীর উত্তর পেলাম চোস্ততর ফরাসীতে। এখন সেই উত্তর নিয়ে আমি কী করবো, আমার দৌড় তো আগেই শেষ হয়ে গেছে। তার থেকে ওধার না মাড়ানোই ভালো! তাতে লোকে আমাকে যদি সরাসরি অসভ্য নাও মনে করে তাহলে উন্নাসিক ভাবতে পারে, এবং ভাবেও, কিন্তু কী উপায়?
এর মধ্যে কত জোকে না বুঝে হাসলাম, কতো কথাবার্তার মাঝখানে ফোড়ন কাটলাম যার প্রসঙ্গ অনেকক্ষণ বদলে গেছে বা যে মন্তব্যটি একেবারেই বিষয় বহির্ভূত। কিন্তু বধিরজনদের আরো একটা সমস্যা আছে যা সবায়ের দৃষ্টিগোচর নয়। ধরা যাক বক্তা বললেন "ধান কাটা হবে কাল।" বধিরজন শুনলেন, অর্থাত্ শব্দতরঙ্গ যখন বিদ্যুত্ঘাত হয়ে কর্টেক্সে পৌঁছলো তখন শোনা গেলো "হাঁউ মাঁউটা হোভ পাঁউ।" এবার ব্রেনে কর্টেক্স প্রচুর তোড়জোড় করে ব্রেনের মধ্যে যে অভিধানটি আছে সেটি খুঁজে দেখলো, কিন্তু সে খুঁজে পেলো না কিছুই-- হয়তো "হোভ"-টা বুঝলো "হবে" বলে। এখন ব্রেন হাল ছেড়ে দিতে পারে, কিন্তু তা করলে তার আরব্ধ কর্মে সে ফেল করছে বলে বদনাম হবার সম্ভাবনা আছে তাই মাথা খাটিয়ে ব্রেন বার করলো যে এই শব্দগুলো "কান" "কাটা" "হবে" "খাল" হতে পারে। চারটে কথাকে এখন বাক্য করে সাজিয়ে তো মহা সমস্যা। কান কাটা হবে, কী সাঙ্ঘাতিক। কার কান, কেন সে কী করেছে? এর মধ্যে "খাল" এলো কোত্থেকে, খালের ধারে কাটা হবে, নাকি খালের জলে কানের বিসর্জন? ব্রেন যদি এই সমস্যার সমাধান না করতে পারে, হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে বধিরজনের কাছে ওই কথোপকথনটির সেখানেই অবসান। সাহস করে বধিরজন সমবেত লোকদের প্রশ্ন করে এই কর্ণচ্ছেদনের রহস্যটা খোলসা করে নিতে পারেন এবং তাতে যদি সমবেত লোকেরা বধিরজনকে অজমূর্খ বলে মনে করেন তাহলে তাঁদের দোষ দেবার কিছু নেই।
এই সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আমি একটু বাড়িয়ে বললাম, কিন্তু প্রায় প্রতিটি সংলাপের অর্থোদ্ধার করতে একজন বধিরজনকে বিপুল পরিমাণ মানসিক শক্তি ব্যয় করতে হয়। পরীক্ষা করে এটা দেখা গেছে যে কথার অর্থ বুঝতে এতো শক্তি ব্যয় করার পর বেশীর ভাগ সময়েই বধিরজনেরা কথার উত্তর তৈরী করার বা ব্রেনের অন্য কাজ, যথা সংলাপ থেকে নতুন কিছু তথ্য পেলে সেটিকে স্মৃতিতে ধরে রাখার শক্তি আর খুঁজে পান না। এই ঘাটতিগুলি আস্তে আস্তে জমা হতে থাকে, এবং তার ফলটা শুভ হয় না। জন্স্ হপ্কিন্সের গবেষক ফ্র্যাঙ্ক লিন ২০১১ সালে প্রকাশিত রচনায় এক দীর্ঘস্থায়ী (আঠারো বছর) নিরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে শ্রবণ ছাড়া অন্য কাজের জন্য বরাদ্দ মানসিক শক্তি ব্যয় করে ব্রেন শ্রবণ্শক্তির খর্বতার ক্ষতিপূরণ দেয়। একটা কুফল হোলো বধিরতা আর চিত্তভ্রংশতার, ডিমেন্শিয়া, আপেক্ষিক সম্পর্ক, কোরিলেশন, বৃদ্ধি পাওয়া। এই নিরীক্ষায় যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের বয়স, স্বাস্থ্য, বিশেষ রোগ যথা ডায়াবেটিস বা হাইপারটেন্শন এসবের ঠিকঠাক হিসেব রাখার পরেও লিন দেখেছেন যে নিরীক্ষার শুরুতে যাঁরা বধির ছিলেন তাঁদের মধ্যে পরে ডিমেন্শিয়ার প্রকোপ প্রবলতর। ডিমেন্শিয়ার প্রকোপ বেশী হবে কেন? এক হতে পারে যে বধিরজনেরা সামাজিক নিঃসঙ্গতার শিকার হন এবং নিঃসঙ্গতা ডিমেন্শিয়ার এক সম্ভাব্য কারণ, রিস্ক ফ্যাক্টর। দ্বিতীয় কারণ হতে পারে মানসিক শক্তির ক্রমাগত অপপ্রয়োগ এবং ফলে পরে সেই শক্তিতে দেউলে হয়ে যাওয়া, ওপরে যেমনটি বলা হয়েছে। আর তৃতীয়ত লিন মনে করেন যে বধিরতা আর ডিমেন্শিয়া-- দুটিই অন্তর্নিহিত অন্য কোনো বিকারের, প্যাথোলজির ফল। তিনটে কারণের কোনোটাই আশ্বাসদায়ক নয়, কিন্তু এই শেষটি ভয়াবহ। প্রসঙ্গত, হিয়ারিং এডের ব্যবহারের সঙ্গে এই ডিমেন্শিয়ার প্রকোপবৃদ্ধির কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায় নি।
পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের যে কোনোটির ব্যবহার ব্যাহত হলেই মানুষ কষ্ট পায়। জন্ম থেকেই যাঁরা এক বা একাধিক ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার করতে পারেন না তাঁদের কথা আমি বলছি না, সেই নষ্ট ইন্দ্রিয়ের কথা তাঁরা তো জানতেই পারলেন না, আর দেখা গেছে যে আপনা থেকেই অন্য ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ বাড়িয়ে ব্রেন সেই কমতিটা মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে। যাঁরা অনেকদিন ব্যবহার করার পর আস্তে আস্তে বা হঠাত্ একদিন দেখেন যে একটি ইন্দ্রিয় আর ব্যবহার করতে পারছেন না তাঁদের কথা বলি। পেয়ে হারানোর কষ্টটা আরো মর্মঘাতী। স্পর্শানুভূতি চলে যাওয়াটা সাধারণত কোনো কঠিন অসুখের কারণে হয়ে থাকে এবং ততো বেশী দেখা যায় না। যে সামান্য কয়েকজন স্পর্শশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে তা নিয়ে লিখেছেন তাঁদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে দৈনন্দিন জীবনধারণ দুঃসহ হয়ে ওঠে এই প্রতিবন্ধটি থাকলে। মানুষ তার দেহ ও চলাচলকে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মানিয়ে নেয় এই স্পর্শের মাধ্যমে, কাজেই এটি না থাকলে তাঁদের ওঠা, বসা, চলাফেরা সবই হয় দুঃসাধ্য। অভ্যাস করে দৃষ্টিশক্তির ক্ষমতা বাড়িয়েই সাধারণত এই দুর্ভোগের মোকাবেলা করা হয়। গন্ধানুভূতিকে পঞ্চেন্দ্রিয়ের দুয়োরানী বলা হয়, এটি কমে এলেও সাধারণত লোকে চালিয়ে নিতে পারেন, আর নাকের ওপর ইচ্ছাকৃত অত্যাচার তো সমাজে বেশ চালু, যাঁরা নস্য নেবার নেশা করেন তাঁদের কথা ভেবে দেখুন। গন্ধের মতো স্বাদ চলে যাওয়াটাও লোকে মেনে নেন, বস্তুত অনেক ক্ষেত্রে স্বাদ হ্রাসের কারণ খুঁজলে ওই গন্ধানুভূতির হ্রস্বতাই দেখা যাবে। দৃষ্টি অবশ্যই আমাদের জীবনে অর্থসঞ্চারের এক প্রধান বাহন এবং সে কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে আসা বা হারিয়ে ফেলার আঘাত অতি গুরুতর। তবে যে কারণেই হোক, তা দৃষ্টি ইন্দ্রিয়টির শারীরবৃত্তীয়, ফিজিওলজিক্যাল গঠনের জন্যই হোক বা যুগ যুগ গবেষণার ফলেই হোক, সেই আঘাতের কষ্ট কম করার অনেক উপায় বার হয়েছে। চোখের ছানির কথাটাই ভেবে দেখতে পারেন।
কানে শুনতে পাওয়াটা মানুষের জীবনে এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা যোগ করে। সেটি হোলো মানুষে মানুষে যোগাযোগ, যেটি আছে বলে আমরা পশুর চেয়ে বেশী উন্নত দাবী করে থাকি। কাজেই এই শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষতি অন্যান্য ইন্দ্রিয়ে ক্ষতি হবার যেসব অসুবিধা আছে সেসব ছাড়াও অন্য এক মাত্রার অভাব যোগ করে দেয়। সে ক্ষতি সারাজীবনেও সারাই হবার নয়, যতোই চেষ্টা আর চিকিত্সা হোক না কেন, বধিরজন কখনোই তাঁর পূর্বজীবন ফিরে পাবেন না। যদিও বধিরতার চিকিত্সার অনেক উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে তবু একথা নিশ্চিত বলা যায় যে প্রকৃতি আমাদের জীবন যে শ্রবণশক্তি দিয়ে শুরু করে দিয়েছেন সে শ্রবণশক্তির পুনর্গঠন আজকের চিকিত্সাবিজ্ঞান বা প্রযুক্তির চিন্তারও বাইরে। একথা মনে রাখতে হবে যে একটু বেশী বয়সে যাঁরা বধির হয়ে যান তাঁদের রোজকার তো বটেই, তার বাইরের জীবনের বেশীর ভাগই-- সামাজিক, পারিবারিক, ব্যবহারিক, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কিত, সব-- গড়া হয়েছে শ্রবণ ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। ভিত্তি চলে গেলে যেমন সারা বাড়ী ধ্বসে পড়ে, এঁদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই দাঁড়ায়।
-৮-
বধিরজনদের মধ্যে মানসিক অশান্তির ঘটনা সাধারণের থেকে চারগুণ বেশী দেখা যায়। ১৯৯০ সালে এ্যানাল্স্ অফ মেডিসিনে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে যে মানসিক ভারসাম্য নির্ধারণের যে পরীক্ষা তাতে দেখা গেছে যে বধিরজনদের দুই-তৃতীয়াংশের মনে সামাজিক ও আবেগভিত্তিক দ্বন্দ্ব অতি গভীর ও দীর্ঘপ্রসারী। SNHL আর ডিপ্রেশনের কোরিলেশন উপেক্ষা করা যায় না। বধিরতার কারণে সহজ মেলামেশার থেকে বধিরজন সরে এলেন, সেই নিঃসঙ্গতা জন্ম দিলো ডিপ্রেশনের, ডিপ্রেশনের প্রকাশই হচ্ছে নিঃসঙ্গতায় তলিয়ে যাওয়ায়-- এইভাবে বধিরজন এক ঘূর্ণিতে তলিয়ে যেতে থাকেন। বিশ্ববিখ্যাত সঙ্গীতস্রষ্টা লুডভিগ বীঠোভেন তিরিশ বছর বয়সে শ্রবণশক্তি হারাতে আরম্ভ করেন এবং ছাপ্পান্ন বছর বয়সে যখন মারা যান তখন তিনি সম্পূর্ণ বধির হয়ে গেছেন। তিনি তাঁর ভাইদের একটা চিঠিতে লিখছেন: "তোমরা যারা আমাকে পরশ্রীকাতর, জেদী, মনুষ্যদ্বেষী বলে আখ্যা দিচ্ছো, তারা জানোনা যে আমার ওপর তোমরা কী অবিচার করছো। কেননা তোমরা জানো না যে কী গোপন যন্ত্রণার তাগিদে আমার নিজেকে এই ভাবে তোমাদের কাছে প্রকাশ করতে হচ্ছে।... তোমরা জানো যে জন্ম থেকেই আমার কী উত্সাহী চটপটে স্বভাব, আর সেই আমি আজ নিজেকে সব কিছু থেকে সরিয়ে নিয়ে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছি।" বধিরতা সত্ত্বেও বীঠোভেন অমর সঙ্গীত সৃষ্টি করে গেছেন। বীঠোভেন অবশ্য সাধারণ মাপের মানুষ ছিলেন না-- না স্রষ্টা হিসাবে, না সহনশীলতার খতিয়ানে।
যাঁরা বধিরজনদের কাছের মানুষ, প্রিয়জনের বধিরতা তাঁদের জীবনেও অশুভ ছায়া ফেলে। বধিরজনকে সাহায্য করতে, তাঁর জীবন একটু সুসহ করতে তাঁরা উদ্গ্রীব, কিন্তু কাজটি নিষ্করুণভাবে কঠিন। কথা শুরু করার আগে বধিরজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হবে, কথা শুরু করে আস্তে আস্তে কথা বলতে হবে, কথা বলার সময় অন্যদিকে তাকালে চলবেনা, পুনরাবৃত্তি করতে হবে, অনেক সময়েই বহুবার, বধিরজনের কাছ থেকে উত্তর আসতে দেরী হবে, মনে রাখতে হবে যে দরকারী কথাও বধিরজন ভুলে যেতে পারেন কেননা সেকথা তিনি শুনতে বা বুঝতে পারেননি। ভুল শুনে ভুল বুঝে বসে থাকার সম্ভাবনা প্রচুর, কাজেই প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে বধিরজন কী শুনেছেন, কী বুঝেছেন। আত্মীয়স্বজন বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছেই এতো সহিষ্ণুতা দাবী করা উচিত নয়, আর যাঁদের সঙ্গে তাত্ক্ষণিকের সাক্ষাত্-- দোকানদার, ডাক্তার, অন্য কোনো সহায়ক-- তাঁদের কাছে এমন উদারতা আশা করাই অন্যায়। প্রথমেই বধিরতা স্বীকার গেলে কিছু সময় কাজ হয় দেখেছি, একটা তাচ্ছিল্যের ভাব লুকোনো থাকছে বলে মনে হলেও সেটা মেনে নেওয়া যায় কিন্তু যার সম্ভাবনা আরো বেশী, সেটি হোলো বিরক্তি এবং উপেক্ষা-- বধিরজনের ওপর তার মানসিক আঘাত ক্লেশকর, আরব্ধ কাজটাও হয়ে ওঠে না। চিত্কার করে বলতে ইচ্ছা হয়, "দেখুন আমি কালা, কিন্তু আমি হাবা নই।" যেখানে বধিরজন তাঁর বধিরতার কথা গোপন রাখতে চান, যেমন সাবওয়ে বা কোনো দোকানের চেকআউট লাইনে, এমন পরিবেশে জড়বত্ থাকা ছাড়া কী উপায়?
ক্যাথারিন বুটন আর আমার বধিরতার অভিজ্ঞতাতে কিছু পার্থক্য আছে। আমার শ্রবণশক্তি আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছিলো, যখনই বুঝতে পেরেছি তখনই হিয়ারিং এড লাগিয়ে ফল পেয়েছি। কাজ চালানো ভাবে চলছিলো ভালোই, যদিও একদিন শুধু হিয়ারিং এডের ভল্যুম বাড়িয়ে আর চলবে না বলে জানতাম, তবে তা নিয়ে আতঙ্কিত হবার সময় আসেনি। এভাবে আমি নটা-পাঁচটার কাজ থেকে অবসর নিলাম, এদিক ওদিক টুকটাক কিছু করি, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেবার জন্য। সেই সময় একদিন অকস্মাত্ বজ্রপাত, আমি "কানে খাটো" থেকে "বদ্ধ কালা" হয়ে গেলাম। শুনতে না পাওয়ার থেকে বড়ো সমস্যা তখন যে স্ট্রোকের ধাক্কায় মানুষ হয়ে বাঁচতে পারবো না কি বাকী জীবন সব্জী হয়ে কাটাতে হবে। চাকরি বাকরি করার প্রশ্নই ওঠে না, তখন দৈনন্দিন বেঁচে থাকার সংগ্রামেই ভাঁড়ারের সব জমানো শক্তির থেকেও বেশী শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে, ওষুধে পত্রে ডাক্তারে বদ্যিতে ছয়লাপ। সেই শিরে সংক্রান্তি থেকে উদ্ধার পেয়ে যখন কী আছে আর কী নেই তার হিসেব নেবার সময় পাওয়া গেলো তখন শ্রবণ ছাড়াও অন্য এতো খাতে ঘাটতি যে শুধু বধিরতার কথা ভাবলেই চলবে না এটা বোঝা গেলো। ক্যাথারিনের ব্যাপারটা একটু অন্য। তরুণী অবস্থাতেই তাঁর বাঁ কান হঠাত্ কালা হয়ে যায়। অন্য কানের জোরে অনেকদিন তিনি ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে চালিয়েছিলেন-- কাজকর্ম পুরোমাত্রায় চালিয়ে জীবিকার্জনে খুব সাফল্য লাভ করেছেন। তারপর উপায় না দেখে তাঁকে হিয়ারিং এড পরতে হোলো, ডান কানেও শ্রবণশক্তি হারাতে আরম্ভ করলেন, চিকিত্সা করালেন, এখন হিয়ারিং এড এবং কক্লিয়ার ইম্প্ল্যান্ট (ক্রমশ প্রকাশ্য) দুইই ব্যবহার করেন। কাজেই বধিরতার সঙ্গে লড়াই করার ব্যাপারটায় তিনি আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, লড়াইও দীর্ঘতর, অভিজ্ঞতা আরো বিস্তৃত। তাঁর জবানী থেকে আরো দুয়েকটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করার জন্য আমেরিকায় আইন আছে। আর তাছাড়াও প্রতিবন্ধীরা নিজেরা একত্র হয়ে পরস্পরকে সাহায্য করতে চেষ্টা করেন। হিয়ারিং লস অ্যাসোসিয়েশন অফ আমেরিকা তেমনই এক সংস্থা, প্রদেশে প্রদেশে, শহরে শহরে এঁদের শাখা আছে। ক্যাথারিন লিখছেন যে অনেকদিন এড়িয়ে যাবার পর শেষ পর্যন্ত একদিন তিনি এই সংস্থায় যোগদান করলেন, বধিরতা নিয়ে এঁরা অনেক ওয়ার্কশপ করে থাকেন, আকর্ষণ মুখ্যত তাতে যোগ দেওয়া। "বধিরতা এড়াতে আপনি ভুল পথে চলেছেন"-- এই শীর্ষের কথিকাটি তাঁর প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ক্যাথারিন লিখছেন যে কথিকা শুরু হবার পর তাঁর একদমই ভালো লাগছিলো না, মনে হচ্ছিলো বক্তা যা বলছেন তা অতি সরলীকরণ এবং পুনরাবৃত্তি। উঠে চলে আসছিলেন, কিন্তু হঠাত্ তাঁর মনে হোলো, আরে, যা বলা হচ্ছে তা যে আমাকেই লক্ষ্য করেই বলা হচ্ছে। বক্তা শুরু করেছেন, "বধিরতার যে কী কষ্ট, তার মাত্রা বেশীর ভাগ সময়েই পুরো বোঝার চেষ্টা করা হয় না। মানুষজন শোকতাপ তাড়াতাড়ি কাটিয়ে উঠবে, সাধারণত আমরা এই আশা করি। বধিরজনের ক্ষেত্রে সেটা যখন খাটছে না দেখি তখন আমরা বিরক্ত হই। বিশেষ করে যখন বধিরজনের ক্লেশটা সরাসরি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। এমন কী শোক সামলানোর যে পাঁচটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার কথা কুবলা-রস বলেছেন, সেগুলিও বধিরজনেরা পর্যায়ক্রমে অতিক্রম করতে পারেন না-- একই পর্যায়ে বধিরজনেরা বারবার ফিরে আসতে থাকেন।" তারপর বলেন যে সাধারণ বধিরজন যে উপায়ে এই কষ্ট সইবার চেষ্টা করেন-- যথা মদ্যপান, ড্রাগ, অল্পাহার, অতিআহার, অনিদ্রা, সংশ্রব ত্যাগ করা ইত্যাদি, সেগুলি সব এমনিতেই ক্ষতিকর, বধিরতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের ফল হয়ে দাঁড়ায় মারাত্মক। বধিরজনের পক্ষে কীভাবে এ ধরণের সমস্যার মোকাবেলা করা যায় তার কিছু উপায়ও তিনি বর্ণনা করেন।
বধিরতা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের পথ বন্ধ করে অসম্ভব মানসিক চাপের সৃষ্টি করে, সেটা বলার পর আরেকজন বক্তা জানান যে বধিরতার কারণে নিঃসন্দেহে হৃদ্স্পন্দনবৃদ্ধি ও পেশীর যন্ত্রণার, বিশেষত ঘাড় ও কাঁধের পেশীতে, হতে পারে। ক্রোধ, সংশয়, ডিপ্রেশন, বিহ্বলতা, হতাশা, দোষীবোধ, লজ্জা-- এসব মদ্যপান, গাঁজাসেবন আদি বদ্নেশার মতো। এসব "নেশা" দেহের এ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে কর্টিসলের ক্ষরণ বাড়ায়, এবং সেই ক্ষরণ যখন পাকাপাকি হয়ে দাঁড়ায় তখন দেহের ভেতরে ক্ষতি হতে শুরু করে। ডাক্তারেরা সাধারণত বধিরতাকে হার্টের রোগের সঙ্গে যুক্ত করেন না, কিন্তু এই বক্তার মতে বধিরতা সরাসরি হার্টের গোলমালের সূচক না হলেও এদের মধ্যে নিশ্চিত সম্পর্ক দেখা যায় (কোরিলেশনাল নিশ্চিত, কজাল নাও হতে পারে)। এছাড়াও এধরণের বদনেশার তাত্ক্ষণিক কুফল হোলো ভুলে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বিলম্ব বা অপারগতা ইত্যাদি -- প্রতিটিই অবাঞ্ছিত। এই বক্তার মতে বধিরজনের প্রথম কাজ হোলো যে এধরণের উপসর্গের পেছনে যে বধিরতা কাজ করতে পারে, সেটি মেনে নেওয়া এবং তারপর উপশমের উপায় খোঁজা, নয়তো বধিরজন ভুল পথে চালিত হতে থাকবেন। আগের বক্তার মতো ইনিও উপশমের কিছু পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন।
বধিরতার কুফল বহু এবং দূরপ্রসারী। তা মেনে নিতে হবে এবং ভেঙে না পড়ে সংগ্রাম করে যেতে হবে এই হোলো মোদ্দা কথা। কিন্তু দিনের পর দিন এভাবে চলা বড়ো কঠিন, তাই নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্য যতোটুকু করতে হয় তা বাদ দিয়ে বধিরজনেরা আস্তে আস্তে নিঃসঙ্গতার কাছেই আত্মসমর্পণ করেন, ফল যাই হোক না কেন। বধিরতা বড়ো ভয়ঙ্কর অভিশাপ!
-৯-
হিয়ারিং এডের ভেতরকার প্রযুক্তিগত ব্যাপারটা সহজ, একটা পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে যেমনটি দেখা যায় তেমনই। শব্দের ঢেউকে বিদ্যুতে পরিবর্তন করার জন্য একটা মাইক্রোফোন, বিদ্যুতের শক্তি বাড়াবার জন্য অ্যাম্প্লিফায়ার, তারপর আবার সেই বিদ্যুত্ তরঙ্গকে বায়ুতরঙ্গে পরিবর্তন করে কানে পোঁছে দেওয়ার জন্য স্পীকার বা রিসিভার। এছাড়া সব কিছু চালানোর জন্য ব্যাটারী এবং ভল্যুম কণ্ট্রোল, সুইচ ইত্যাদি সব আনুষঙ্গিক। এই পরিবর্ধিত শব্দ কানের প্রত্যঙ্গের ভেতর দিয়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত আবার ব্রেনের নার্ভে বিদ্যুত্ সঙ্কেতে পরিণত হবে-- তার বিশদ বিবরণ আমরা অন্যত্র দিয়েছি। হিয়ারিং এড ব্যবহার করেটেলিফোনে কথা শুনতে হয় একটু অন্যভাবে, তার জন্য টেলিকয়েল বলে একটি যন্ত্রও অজকালকার হিয়ারিং এডে লাগালো হয় । এখানে বলা উচিত যে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যান্ট বলে এক ধরণের এড ব্যবহার করা যায় যা ওই কানের কলকব্জা ব্যবহার না করে সরাসরি বিদ্যুত্ সঙ্কেত ব্রেনের নার্ভে পোঁছে দেয়। তার কথা পরে বলা হবে। দেখা গেছে যে সাধারণত দু কানেই হিয়ারিং এড পরলে এক কানে পরবার দ্বিগুণের বেশী ফল পাওয়া যায়, মাথার খুলির মধ্য দিয়ে শব্দতরঙ্গের চলাচল আরো জোরদার হয় বলে। আমি যখন প্রথম হিয়ারিং এড পরতে আরম্ভ করি তখন শুধু অ্যানালগ প্রযুক্তির এডই পাওয়া যেতো। এখন ডিজিট্যাল প্রযুক্তি চালু হয়েছে, সে প্রযুক্তির সুবিধা এতো বেশী-- যথা নয়েজ কমানো, অ্যাম্প্লিফায়ারের সূক্ষ্মতর নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি-- যে এই প্রযুক্তিই এখন বাজারে চলে। সেলফোনের বিবর্তনের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন, যদিও অর্থনৈতিক কারণে হিয়ারিং এডের প্রযুক্তির উন্নয়ন সেলফোনের উন্নতির থেকে বেশ কিছু পেছিয়ে আছে এবং থাকবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে প্রযুক্তির এতো উন্নতি সত্ত্বেও (বা সেই কারণে) হিয়ারিং এড যন্ত্রটিকে বধিরজনের ঠিক মাপসই করা বেশ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। তার একটা কারণ এই যে সাধারণত এই প্রযুক্তির যা ক্ষমতা আমরা হিয়ারিং এডের থেকে তার অনেকগুণ বেশী আশা করে থাকি। সেই আশার মূল হতে পারে হয় দৃষ্টি আর চশমার উদাহরণ থেকে নয় হিয়ারিং এডের আকাশছোঁয়া দামের দিকে চেয়ে।
সমাজে বধিরজনকে ছোট করে দেখা হয়, বধিরতা কলঙ্ক। সেজন্য হিয়ারিং এড পরে উপকৃত হতে পারেন এমন বহু বধিরজন এড পরেন না। ফ্র্যাঙ্ক লিনের সমীক্ষা (২০১১) বলছে আমেরিকায় পাঁচ কোটি লোক বধির এবং তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশের বেশী বয়সীদের ধরলে সাতজনের মধ্যে মাত্র একজন হিয়ারিং এড ব্যবহার করেন। তার অনেক কারণ আছে, বধিরতার সঙ্গে জড়িত অসম্মান তার একটি কারণ। হিয়ারিং এড ব্যবসায়ীরা এই দুর্বলতার সুযোগ নেন, নানা মাপের হিয়ারিং এড-- যা কানের বাইরে দস্তুরমতো দৃষ্টিগোচর মাপের থেকে শুরু করে কানের ফুটোর একেবারে ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয় এমন মাপের-- বিক্রী করে। এর মধ্যে একটি ব্র্যাণ্ড আছে যেটিকে বছরে তিনবার গিয়ে কান দিদিমণিদের দিয়ে খুলিয়ে, পরিষ্কার করে, ব্যাটারী বদলে আনতে হয়। বলাই বাহুল্য এডগুলি যতো ছোটো করা হয় তাদের দামও তেমনি আকাশ ছুঁতে থাকে (২০১৩ সালে দুই থেকে পাঁচ হাজার ডলার) কিন্তু শোনার ব্যাপারে তাদের সাহায্য করার ক্ষমতা বাড়ার চেয়ে কমের দিকেই যায়। প্রসঙ্গত, হিয়ারিং এড যত্র তত্র খুলে রাখা যায়, খুলে রাখা হয় এবং হারায়ও বেশী।
বক্তার কাছাকাছি যদি ট্র্যান্সমিটার নামের একটা যন্ত্র রাখা সম্ভব হয় তাহলে সম্প্রতি প্রচলিত এফএম সিস্টেম ব্যবহার কর বধিরজনের শ্রবণ ক্ষমতা অনেক বাড়ানো যায়। এফএম সিস্টেমে আসলে এফএম রেডিয়োর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় যেখানে বক্তব্যটা ট্র্যান্সমিটার থেকে এফএম রেডিয়ো সঙ্কেত হয়ে প্রচারিত হবে এবং বধিরজন একটি রিসিভার যন্ত্র পরে সেই শব্দ শুনে নেবেন তাঁর টেলিকয়েল ব্যবহার করে। এই সিস্টেমে নয়েজের উত্পাতটা কমানো যায়, তবে একসময়ে মাত্র একজনের বেশী বক্তা থাকলে এটা ঠিক কাজ করে না।
হিয়ারিং এড বাইরের শব্দ ঘষামাজা করে কানের দুয়ারে, ইয়ার ড্রামে পৌঁছে দেয়। তারপর ক্ষতিগ্রস্ত কানেরই সব প্রত্যঙ্গের ভেতর দিয়ে সেই শব্দ গিয়ে বিদ্যুত্তরঙ্গ হয়ে ব্রেনের প্রবেশদ্বারে, অডিটরি নার্ভে গিয়ে পৌঁছোয়। এই পদ্ধতির একটা সুবিধে যে এতে কোনো অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। পঞ্চাশের দশকে ইংল্যাণ্ডের দুজন ভারতীয় ডাক্তার (ডঃ রাণা ও ডঃ দী) বাইরের শব্দকে ঘষামাজা করে সরাসরি বিদ্যুত্ তরঙ্গে পরিবর্ত করে অডিটরি নার্ভে পৌঁছে দেবার এক পদ্ধতি পরীক্ষা করেন ও সফল হন। এই পদ্ধতির সুবিধা হোলো যে এতে ক্ষতিগ্রস্ত কানের কোনো প্রত্যঙ্গই ব্যবহার করা হোলো না, কিন্তু তেমনি অসুধিধা এই যে এতে অস্ত্রোপচার করতে হয়। কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট নাম নিয়ে এই পদ্ধতিটি আস্তে আস্তে চালু হতে আরম্ভ হয় এবং নব্বইয়ের দশকে ডিজিট্যাল হবার পর এর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।
কানের গঠন মনে করলে দেখতে পাবেন যে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ব্যাসিলার মেম্ব্রেনের ভিন্ন ভিন্ন অংশে তরঙ্গ তোলে (চড়া শব্দ কাছে, খাদের শব্দ দূরে, এই বিন্যাসটিকে টোনোটপিক্যাল বলা হয়), সেইমতো অর্গ্যান্স্ অফ কর্টির ভিন্ন ভিন্ন শুঁয়োতে কাঁপন ধরে এবং কম্পনরত শুঁয়োর অবস্থানের ওপর নির্ভর করে অডিটরি নার্ভে ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির বিদ্যুত্ তরঙ্গ সঞ্চালন হয়। কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টের একটি দিকে থাকে এমন একগুচ্ছ ইলেক্ট্রোড যা ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে সাড়া দেয়, সেগুলিকে অডিটরি নার্ভের কাছে প্রোথিত করা হয়। এখন বাইরের শব্দকে তার বিভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে ভাগ করে যদি এই গুচ্ছের বিশেষ বিশেষ ইলেক্ট্রোডে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে অডিটরি নার্ভে সঠিক ভাবে বিদ্যুত্ তরঙ্গের সঞ্চালন হবে, কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টের এই মোদ্দা কথা। অবশ্যই আজকের প্রযুক্তি মারফত্ যতোগুলি ইলেক্ট্রোড লাগানো যায়, তার সংখ্যা অর্গ্যান্স্ অফ কর্টিতে যত শুঁয়ো আছে, তার ধারেকাছেও আসতে পারেনা, তাই এখনো পর্যন্ত এই প্রোযুক্তি শুধু মানুষের কথা শোনার ব্যাপারে সহায়তা করাতেই সীমাবদ্ধ, গান শোনানো তার ক্ষমতার বাইরে। কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টতে প্রথমেই পাওয়া যাবে এক মাইক্রোফোন, এবং তারপর সেখানে তৈরী বিদ্যুত্ তরঙ্গকে নানান ফ্রিকোয়েন্সিতে ভাগ করে ফেলার এবং অন্যান্য কারিকুরি করার জন্য স্পীচ প্রসেসর। এই সঙ্কেত তারপর যায় একটি ট্রান্সমিটারে, সেখান থেকে রেডিয়ো তরঙ্গ মারফত্ তাকে মাথার খুলির মধ্যে প্রোথিত (তা থেকেই ইম্প্ল্যাণ্ট নাম) রিসিভারে পৌঁছে দেওয়া হয়। মাথার চামড়ার নীচেই একটা চুম্বক লাগিয়ে ট্রান্সমিটারটিকে স্থিতু করা হয়, রেডিয়ো মারফত্ রিসিভারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে আর কাটাকুটি করে তার লাগাতে হয় না। রিসিভারটি একটি ছোটোখাটো কম্প্যুটার, সেটি স্পীচ প্রসেসর থেকে পাওয়া সঙ্কেতের ওপর নির্ভর করে যথাযথ ইলেক্ট্রোডে বিদ্যুত্ সঞ্চার করে। কান দিদিমণিরা এই স্পীচ প্রসেসরের প্রোগ্রাম নাড়াচাড়া করেই কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টটিকে গ্রাহকের চাহিদার মাপসই করে দেন। আজকালকার সেমিকণ্ডাক্টর প্রযুক্তির ব্যবহারে মাইক্রোফোন, প্রসেসর আর ট্র্যান্সমিটারের মাপ খুব ছোটো করা যায় এবং তার ফলে এগুলিকে কানের পিছ্নে লুকিয়ে রাখা যায়, খুব খুঁটিয়ে না দেখলে নজরে আসে না যে কেউ কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট পরে আছেন।
অস্ত্রোপচার করে রিসিভার এবং ইলেক্ট্রোডগুচ্ছটিকে মাথার খুলিতে এবং কক্লিয়াতে স্থাপন করতে হয়। কক্লিয়ার অবস্থান করোটিস্থ খুব শক্ত (শরীরের সবচেয়ে কঠিন) একটি অস্থির মধ্যে। কক্লিয়ার নাগাল পেতে শল্যচিকিত্সককে খুলির মধ্যে ড্রিল চালাতে হয়, যেখান দিয়ে সেই ছিদ্রটি করা হয়, তার কাছাকাছি বহু নার্ভের সমাবেশ, বিশেষত মুখের সঙ্গে বিজড়িত এক নার্ভ সমষ্টির, যাতে আঘাত লাগলে মুখের একাংশ চিরতরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। যদিও আজকাল কুশলী ও সতর্ক শল্যচিকিত্সকের হাতে এরকম অঘটন ঘটেনা বললেই হয়, তবু আশঙ্কা থেকেই যায়। তারপর কখনো কখনো কক্লিয়াতে ইলেক্ট্রোড লাগাবার সময় অর্গ্যান অফ কর্টির শুঁয়োগুলি বরাবরের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, সেক্ষেত্রে সেই কানটি একেবারে বরবাদ হয়ে যায়। এই কারণে ডাক্তারেরা একটি কানের কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট যথাযথ কাজ করছে তার প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত অন্য কানে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট লাগান না। অনেকসময় এক কানে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট এবং অন্য কানে হিয়ারিং এড লাগিয়ে সমস্যার সমাধান করা হয়, যেমনটি ক্যাথারিনের বেলায় করা হয়েছে।
কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টের অস্ত্রোপচার আজকাল একদিনেই শেষ করা হয়, অন্য বিশেষ কোনো গোলমাল না হলে হাসপাতালে রাত্রি কাটাতে হয় না। কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট বসাবার পর দুই থেকে সাত সপ্তাহ মতো সময় দিতে হয় ক্ষত শুকোবার জন্য, তারপর বিশেষ প্রোগ্রামের সাহায্যে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট চালু করা হয়। এখানে বলে রাখা দরকার যে বাইরের যে কোনো শব্দসমষ্টি থেকে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট যে বিদ্যুত্ তরঙ্গ সৃষ্টি করে, তা কানের স্বাভাবিক অবস্থায় যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তার চেয়ে অনেক ভিন্ন। অতএব এবার ব্রেনকে সেই নতুন "ভাষা" শেখাতে হয় থেরাপির মাধ্যমে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সেই থেরাপি অনেকদিন চলতে পারে, আর বাচ্চাদের এই কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টে অভ্যস্ত করা সহজসাধ্য নয় মোটেই।
২০১৩ সালে একটি সাদাসিধে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টের খরচ ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার ডলার মতো পড়তে পারে, তার মধ্যে স্পীচ থেরাপির খরচটাও ধরা হয়েছে। কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট সবার জন্য নয়, যেমন আমার ক্ষেত্রে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট কাজ দেবে না। যাঁদের বধিরতা সিভিয়ার থেকে প্রোফাউণ্ড, তাঁদের ক্ষেত্রেই কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট প্রয়োগ করা হয় এবং মোটামুটি কিছু সর্ত মানা গেলে ইন্সিওরেন্স কোম্পানী খরচ বহন করে। ক্যাথারিনের মতে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট যেন এক দেবদত্ত কবচ, যাঁদের সারাজীবন নৈঃশব্দের যন্ত্রণা ভোগ করতে হোতো, তাঁরা আবার মানুষের জগতে ফিরে আসতে পারেন। তবে এটি ধন্বন্তরীও নয়, বধিরজন সুস্থ অবস্থায় যা শুনতেন কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট পরে তার কাছাকাছিও শুনতে পাবেন না (যেমন গান শোনা), ক্যাথারিন বারবার সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তার কারণ হোলো যে দেখা গিয়েছে বধিরজনেরা কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট লাগিয়ে বড়ো বেশী উন্নতি আশা করেন এবং তার ফলে আশাভঙ্গের মাপটিও হয় বৃহত্। শিশুদের ক্ষেত্রে, বিশেষত যারা জন্মবধির, কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট সত্যিই দৈব আশীর্বাদের রূপ নিতে পারে, তার কারণ, প্রথম, তাদের সদ্যোজাত ব্রেনে শব্দের কোনো প্রতিচ্ছবি তৈরী হয় নি, কাজেই কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টে অভ্যস্ত হওয়া সহজ, আর দ্বিতীয়, শ্রবণশক্তির অন্তত কিছুটা ফেরত্ পেলেই তাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়শক্তিও-- যথা বাক্শক্তি-- ভালো ভাবেই বাড়তে পারে। এদিকে আবার জন্মবধিরদের পক্ষে বেশী বয়সে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট লাগানোর ফল ভালো হয় না। বধিরতা শুরু হবার পর যতো তাড়াতাড়ি কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট লাগানো যায় ততোই ভালো। নয়তো, প্রথম, অডিটরি নার্ভের তরঙ্গবাহী নার্ভগুলো অব্যবহারের ফলে শ্লথ হয়ে যায়, আর দ্বিতীয়, অর্গ্যান অফ কর্টির শুঁয়ো সব শক্ত হয়ে যেতে থাকে, যাকে অসিফিকেশন বলা হয়। আমেরিকায় কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট তৈরী ও বিতরণের জন্য সরকারী সংস্থার অনুমতি নিতে হয় কাজেই কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টগুলিতে খুঁত থাকার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম।
কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে, এবং চলবে। তার ফলে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্টের উপকারিতা বাড়ছে, প্রয়োগের ক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে, খরচ কমে যাচ্ছে, ইন্সিওরেন্স কোম্পানীর দাক্ষিণ্যে কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট অপেক্ষাকৃত স্বল্পবিত্তদের নাগালে আসছে। ২০১০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে আমেরিকায় প্রায় সত্তর হাজার বধিরজন কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট ব্যবহার করছেন, যদিও আন্দাজ করা হয় যে প্রায় তিন লক্ষ লোক কক্লিয়ার ইম্প্ল্যাণ্ট ব্যবহারে উপকার পেতে পারেন।
-১১-
এবার আমার এক বধির দিনের বিবরণ দিই, আমার মনে হয় অনেক বধিরজনই এর মধ্যে নিজেদের অভিজ্ঞতা খুঁজে পাবেন। আমি দুকানেই হিয়ারিং এড পরি, বেশ শক্তিশালী এবং সেই কারণে এদুটিতে এতো যন্ত্রপাতি যে এদের আর কানের মধ্যে লুকিয়ে রাখা যায় না। বেশীর ভাগটাই থাকে কানের বাইরে, সেখানে ভল্যুম বাড়ানো-কমানোর আর অন্যান্য সুইচ আছে, কানের পেছনে গোঁজা থাকে, দুটো প্লাস্টিকের নল দিয়ে কানের ফুটোয় ইয়ার প্লাগের সঙ্গে যুক্ত। নিয়ম করে বছরে একবার করে দোকানে যাই, কান দিদিমণি সব ঠিকঠাক করে দেন। এড পরে থাকলে কানের ফুটো ঘেমে যায়, কুট্কুট্ করে, এদিকে আবার একবার পরে সব গুছিয়ে নিলে আর খুলতে ইচ্ছে হয় না। শোবার সময় তো এড খুলে রাখতেই হয়, সকালে কানে গুঁজতে যতো দেরী করা যায় তাই করি আর একবার পরলে আর পারতপক্ষে খুলি না। আমাদের মার্গসঙ্গীতের গাইয়েরা যেমন গুরুর নাম নিলে কানে হাত দেন তেমন করে প্রয়োজন মতো ভল্যুম বাড়াই কমাই।
এই ভল্যুমের ব্যাপারে মনে রাখতে হবে যে অর্থবহ শব্দের ভল্যুম যখন বাড়াচ্ছি, তখন পেছনের গোলমাল, নয়েজও তেমনি বেড়ে যাচ্ছে। একতলায় আমার বসার ঘরের কাছে একটা পাখা চলে, তার শব্দ মধ্যে মধ্যে অসহ্য লাগে, তাই এডের ভল্যুম রাখি নরমের দিকে। এই পাখা বা এসির শব্দ, ধাতব ঝঙ্কার, যথা রেস্টুরেণ্টে কাঁটাচামচের আওয়াজ, পাতা উল্টানোর খস্খস শব্দ-- এরকম কয়েকটা নয়েজ আছে যা অন্তত আমার কানের পক্ষে মারাত্মক, কিছুতেই ঠেকানো যায় না। এই প্রসঙ্গে বলি যে শ্রবণশক্তি না হারানো পর্যন্ত কেউ বুঝবেন না যে এই নয়েজ ঠেকানো, ফিল্টার করার ব্যাপরটা ব্রেন কী অদ্ভুত চাতুরীর সঙ্গে সমাধা করে। বধিরজন যে অন্য লোকের কথা বুঝতে পারছেন না, তার একটা মুখ্য কারণ হোলো এই 'নয়েজ সাপ্রেশন'-এর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা । ভল্যুম কমের দিকে রাখার আর একটা কারণ আছে। পাখার শব্দ বাদ দিলে আমার বসার ঘরে শব্দ খুব অল্প, প্রায় নেই বললেই চলে। এদিকে ব্রেন যদি অনেকক্ষণ কোনো শব্দ না শোনে, সে নিজেই বিকট সব শব্দ উদ্ভাবন করে-- অকস্মাত্ কিঁইইইইইইইচ্, হুউউউউউশ ইত্যাদি এবং যদিও এটা বুদ্ধিগ্রাহ্য নয় তবু সেই শব্দ মনে হয় হিয়ারিং এডে বেড়ে গিয়ে কানে এসে শলাকার মতো বেঁধে। এই ব্রেনের তৈরী নকল আওয়াজকে অনেকে জানবেন কান ভোঁ ভোঁ করা, বা tinnitus বলে।
আমার বসার ঘরে টেলিফোন আছে, বেশ দামী, স্পীকারফোনের ব্যবস্থা সহ। আজকাল প্রায় সব হিয়ারিং এডেই ফোন কানে লাগিয়ে শোনার বিশেষ ব্যবস্থা থাকে, তাকে বলে টেলিকয়েল। আমারটাতেও আছে কিন্তু বহু চেষ্টা করেও কান দিদিমণি সেটা ঠিক করতে পারেননি। যতোটা ভল্যুম বাড়ালে আমি ফোন কানে লাগিয়ে কথা বুঝতে পারি, ততো ভল্যুম টেলিকয়েল সামলাতে পারে না। তাই স্পীকারফোনই আমার ভরসা। সেল ফোনে আবার তাতেও কাজ হয়না, তার প্রযুক্তিগত কারণ আছে, সে আলোচনায় না গিয়েই বলা যায় যে সেল ফোন, এবং তার থেকে বড়ো কথা, স্মার্টফোনের মজা উপভোগ করা আমার আর হোলো না, হবে বলেও ভরসা নেই। যাঁরা আমার কর্মজীবনের খবর রাখেন তাঁরা জানবেন যে এই ওয়যারলেস প্রযুক্তির প্রচার আর প্রসারে আমিও একদিন কাঠবেড়ালির মতো ল্যাজে করে সেতুবন্ধে কিছু বালি ছিটিয়েছিলাম। যদিও ফোনে কথা বলার একটা বিশাল অসুবিধে যে লিপ রিডিং হয় না, তবু ফোনে কথা বলা সম্ভব হয় কারণ সাধারণত নয়েজ থাকে না একবারে, অন্য পক্ষ ফোনে মুখ লাগিয়ে কথা বলেন, হঠত্ এদিক ওদিক মুখ ফিরিয়ে নেন না, এবং শুধু আমার সঙ্গেই কথা বলাতে মনোযোগ দেন। আমার পরিচিত ফোনসঙ্গীদের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচজনের কথা আমি শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ বুঝতে পারি এবং শেষপর্যন্ত সেই তাঁদের সঙ্গেই কথা বলা হয়। অনেকে বলেন তুমি কেমন ধরণের কালা বাপু, আমার সঙ্গে তো দিব্বি কথা চালাচ্ছো, তাঁদের আর বলে উঠতে পারিনা যে ধাপ্পা দেবার কায়দাটা কেমন শিখেছি দেখো, তোমার কথার অর্ধেকও আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু সেটা তোমাকে জানতে দিচ্ছি না। ফোনে যেহেতু একই সঙ্গে দুজনে কথা বলা যায় না (সিমপ্লেক্স), সেহেতু হুঁ-হাঁ করে চালিয়ে দেওয়া যায়। অপরিচিতদের ফোন আমি ধরিনা, কেননা দেখেছি শেষ পর্যন্ত কথা না বুঝতে পারার অজুহাতে ফোন ছেড়েই দিতে হয়। যেসব সময় ফোনে কথা না বললেই চলে না সেখানে অপর পক্ষকে জানিয়ে গিন্নিকে পাশে রাখি। তবু ফোনে ব্ন্ধুবান্ধবদের কণ্ঠস্বর শুনতেও ভালো লাগে।
আমার সঙ্গে কথাবার্তা চালাবার বেশ কিছু অসুবিধে আছে। প্রথম, আমার গলার আওয়াজ কতোটা উঁচুনীচু হবে তা নির্ভর করে আমি কানে কী শুনছি তার ওপর, যেমনটি সবায়ের হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এর অর্থ হোলো আমার হিয়ারিং এডের ভল্যুম কোথায় রাখা আছে তার ওপরে আমার গলার জোর নির্ভর করে। ধরা যাক যিনি কথা বলছেন তাঁর কথা শোনার সুবিধের জন্য আমাকে ভল্যুমটা বাড়াতে হয়েছে। এখন তাঁর কথা শোনার পর যখন উত্তর দেবো, তখন ওই ভল্যুম বাড়ানোর কারণে আমার গলার আওয়াজ আমার কানে বেশী জোর শোনাবে, তার ফলে আমি আওয়াজ নামিয়ে ফেলবো। এবার তিনি আমার কথা শুনতে পাবেন না। তিনি সে কথা আমাকে বললে আমি মাপ চেয়ে হিয়ারিং এডের ভল্যুম কমিয়ে দেবো, তাতে গলার আওয়াজ জোর হবে। ফলম্ এবার তিনি যখন উত্তর দেবেন, তখন আমি শুনতে পাবো না, এইরকম এক ঘূর্ণি শুরু হয়ে যাবে। দুচারবার এমন হবার পর যাঁরা ঘনিষ্ঠ তাঁরাই বিরক্ত হয়ে যাবেন, অন্যদের কথা তো বলার নয়। দ্বিতীয়, সাধারণত যাঁদের শ্রবণশক্তি অক্ষুণ্ণ তাঁদের সঙ্গে কথোপকথন শুরু করার আগে "শুনুন" বা অমন কিছু বলে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সঙ্গে সঙ্গে কথা শুরু করা যায়, "শুনুন, ক খ গ ঘ..."। বধিরজনের ক্ষেত্রে এই শুধু "শুনুন" বললেই যে তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করা যাবে, এটা ঠিক নাও হতে পারে। এক্ষেত্রে "শুনুন" বলার পর একটু ছেদ দিতে হবে, দেখতে হবে বধিরজন সাড়া দিলেন কিনা, তারপর সংলাপ শুরু করতে হবে। আমার মেয়ের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে, সে সবসময়ে "বাবা, প অ অ অ অজ" বলে কথা শুরু করে। প্রথমে "বাবা" শব্দ শুনে আমি বুঝতে পারি একটা শব্দ হচ্ছে। তারপর "প অ অ অজ"-এর সময় আমি বুঝি যে কথাটা "বাবা", অর্থাত্ আমাকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে। তারপর যখন আসল কথা শুরু হয় তখন আমি তৈরী। এটি না করলে পরে আমি হয় কথোপকথন যে হতে চলেছে সেটি খেয়ালই করবো না, নয় খানিকক্ষণ কথা হবার পর "কী বললে" বা "আবার বলো" বলে আবার গোড়া থেকে কথা শুরু করাবো। বারবার ঘটলে পরে প্রথমটি অসহ্য, দ্বিতীয়টি বিরক্তিকর। এর মধ্যে যদি নয়েজ থাকে, যেমন টিভির শব্দ, তাহলে তো আর রক্ষা নেই। দুঃখের কথা এই যে আমার অভিজ্ঞতায় এই দ্বিতীয় ঘটনাটাই সবসময়ে ঘটে!
থিয়েটারে গিয়ে নাটক বা মুভি দেখাটা আমার একেবারেই ঘুচে গেছে, ডায়ালগ শুনতেও পাই না, বুঝতেও পারি না। অনেক নাট্যমঞ্চে আজকাল লুপ বলে এক ব্যবস্থা রাখা হয়, তাতে ওই হিয়ারিং এডের টেলিকয়েল মারফত্ শুনতে পাবার কথা, কিন্তু আমার বরাতে সেটা কাজ করেনা। টিভিটা কোনকালেই বেশী দেখতাম না, তবে ডিভিডিতে মুভি দেখার শখ ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে এখানকার বেশীর ভাগ টিভি শো বা ডিভিডি মুভিতে ক্যাপশনের ব্যবস্থা থাকে, আমেরিকার প্রতিবন্ধতা আইনের কল্যাণে, তাতে কাজ চালানো যায়। তবে ক্যাপশন পড়ায় মন দিতে গিয়ে স্ক্রীনে কী ঘটছে তাতে পুরোপুরি মন দেওয়া যায় না, তবে বলে না ভিক্ষার চাল, কাঁড়া না আকাঁড়া। প্রসঙ্গত, আজকালকার হিন্দি আর বাংলা মুভির বেশীর ডিভিডিতেই ক্যাপশন থাকে, পুরো বাণিজ্যিক কারণে। বিলেতের ছবি বা টিভিতে তেমন বাধ্যবাধকতা নেই, এটা দুঃখের কথা।
সঙ্গীতের ব্যাপারে বিশেষ এগোনো যায়নি, তবে চেষ্টার ত্রুটি নেই। আমি সঙ্গীত বেসুর শুনি, হয় গোড়া থেকেই উদ্ভট সুর, নয়তো শুনতে শুনতে মধ্যে হঠাত্ বিনা নোটিসে যেন স্কেল চেঞ্জ হয়ে যায়। যাঁরা মন দিয়ে গান শোনেন, তাঁরা জানবেন যে বেসুরো গান, এবং সে একবার দুবার নয়, বারবার সুর কেটে যাওয়া গান শুনতে থাকা কঠিন। এছাড়া সেতার, সরোদ আদি ঝঙ্কারের বাজনা হিয়ারিং এডের প্রসাদে কানে ব্যথা দেয়। একসময় গেছে যে গানবাজনার ধারে কাছে যেতে পারতাম না। কিছুদিন আগে স্থির করলাম যে এখন বধিরতার সঙ্গে বাস করাটা অভ্যেস হয়ে গেছে, এবার জোর করে গান শুনে দেখিই না কী হয়। এবং চমত্কৃত হলাম। যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যাপারটা আগের মতোই আছে, তবে বেহালাটা সইয়ে নিতে পারি। তবলা কখনোই বেগ দেয় নি। তারপর কণ্ঠসঙ্গীত। জোর করে পণ্ডিত যশরাজ এবং কৌশিকী চক্রবর্তীর আসরে বসলাম। দেখি কিছুক্ষণ গানে মনঃসংযোগ করার পর মন অন্য কথা ভাবতে শুরু করেছে, গান যে কী হচ্ছে তার দিকে নজরই নেই। ধরা পড়ে আবার গানের দিকে মন ফেরানো গেলো, আবার কিছুক্ষণ পরে... ইত্যাদি। আসরের শেষে দেখি কিছুটা শোনা হয়েছে এবং আগের মতো স্বর্গবাসের অভিজ্ঞতা না হলেও রসের ঘরে কিছু জমা পড়েছে। তাই লাভ। বসার ঘরে এসে ফেসবুক বা কম্প্যুটারের অন্যান্য উত্স থেকে গান চালিয়ে দিয়ে দেখছি অচেনা গান হলে মনেই ধরে না। চেনা গান হলে মিনিটখানেক শোনা যায়, তারপর ব্রেন সুইচ অফ করে দেয়, সেটা বুঝে আবার চালু করার আগেই গান শেষ হয়ে গেছে। আগে যেমন গানের ভালোমন্দ, সুরের প্রয়োগ, রাগ এবং গায়কীর চলন বুঝতে পারতাম তার ধারে কাছেও যাওয়া যাচ্ছে না, যাবেও না। নিয়তি কেন বাধ্যতে!
সত্যি কথা বলতে কী, যেদিন কোথাও যাবার কথা না থাকে সেদিন ভালো লাগে। ব্যায়াম করতে যেতে হয়, তা না গেলে চলবে না বলে, আর সেখানে হাসিমুখে ঘাড় নাড়া ছাড়া কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই সেই রক্ষে। তারপর যদি একলা কিছু কেনাকাটার কাজ চুকোতে হয় তাহলে আমি সন্ত্রস্ত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে বেরোতে হয়; মানুষগুলো আমাকে পছন্দ করে, আমারও তাদের হাসি মুখ দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই কখন বাড়ী ফিরবো তার কাল গুনি। গৃহিণীর তো কোনো উপায় নেই, আমার কারণে তাঁকেও নিঃসঙ্গতা মেনে নিতে হয়েছে, আমি বাড়ী থাকলেও সে না থাকারই মতো। সামান্য কথাবার্তা হয়, না হলে চলে না, কিন্তু এই বধিরকে কথা বোঝাতে কালঘাম ছুটে যায় তাঁর, বুঝতে পারি তাই বিশ্রম্ভালাপের কোনো দাবী রাখি না। নাতনীগুলো এতো সব বোঝে না, দৌড়ে এসে কী বলে আবার ফুড়ুত্ করে পালায়, কিছুই বুঝতে পারি না। বাপমা ধমক দেয়, জানোনা দাদাভাইয়ের সঙ্গে ওরকম করে কথা বলতে নেই, ওরা মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়ায়, আমার বুক যায় ভেঙে। বাড়ীতে দুজনের বেশী লোক আসছে জানলে আমার হৃত্কম্প, অতিথি সত্কারে যে অনেক ত্রুটি হবে তা জেনে। বাইরে কোথাও নেমন্তন্ন থাকলে জানি যে শুরু করবো পূর্ণ উদ্যমে, তারপর কথাবার্তার প্রবাহ অনুসরণ করতে এতো শক্তি খরচ হবে যে খানিকক্ষণ পরে আর মনোযোগ দিতে পারবো না, বিশেষত একসঙ্গে একাধিক সংলাপ, নয়েজ, লিপ রিডিং না করতে পারার কারণে। নিজেকে গুটিয়ে নেবো, সকলের আনন্দের মধ্যে আমিই এক মূর্তিমান নিরানন্দ হয়ে বসে থাকবো। জানি অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে সম্পূর্ণ অদরকারী অপদার্থ বোধটা কখন না কখন এসে ছোবল মেরে যাবে। বড়ী ফিরবো বিধ্বস্ত হয়ে।
২০০৫ সালে বধিরতার প্রথম আঘাত এসেছিলো গান শুনতে না পারার রূপ ধরে। আর সেই সঙ্গে আমার পরিচয় হয় মানসিক বিষাদ, ডিপ্রেশনের সঙ্গে। আমার পঁয়ষট্টি বছরের জীবনে কখনো এই রোগটির সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে মনে আসে না, যখন পরিচয় হোলো তখন আমি একেবারে গুঁড়িয়ে গেলাম। স্ট্রোক হবার কারণে জমি উর্বরই ছিলো, গান না শুনতে পাওয়া তাতে ছড়ালো বিষবৃক্ষের বীজ, তার বিষে আচ্ছন্ন রইলাম প্রায় আড়াই বছর। এর অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরা জানবেন লক্ষণ কী, যাঁদের নেই তাঁদের জেনে কাজ নেই। তাই থেকে এটিকে যমের মতো ভয় করি, একটু আধটু লক্ষণ টের পেলেই আপ্রাণ চেষ্টা করি যাতে পাকাপাকি না চেপে বসতে পারে। ওষুধ পাওয়া যায়, অনেকে খেয়েও থাকেন, স্ট্রোকের পরে আমাকেও খেতে হয়েছিলো, না খাওয়াটাই ভালো। তবে এ কালো মেঘটির রূপালী পাড় আছে, ডিপ্রেশন তাড়াবার চেষ্টায় অনেক নতুন কিছু জানা হছে, শিখছি, কুশলতা বাড়ছে। উদাহরণ: একেবারে জেদ করে, একটু খাটাখাটনি করে কাজ চালাবার মতো করে কোয়াণ্টাম মেকানিক্স্ আর থিওরি অফ রিলেটিভিটি পড়ে ফেললাম। পরীক্ষা পাস দেবার মতো নয়, ওপর-ওপর, যাকে বলে পপুলার সায়েন্স। তাতে বিশ্বজগতের কোনো উপকার হবে না জানি, এর মধ্যেই আমিও যা পড়লাম তার পনেরো আনা ভুলে মেরে দিলাম কিন্তু যতোদিন তাতে ডুবে রইলাম ততোদিন ডিপ্রেশন ধারে কাছে ঘেঁষতে পারলো না, শেষ যখন হোলো তখন ব্রতশেষের এক সুন্দর শান্তি ছেয়ে রইলো মনকে কিছুদিন। এক সময়ে ক্রসওয়ার্ড করতে ভালো লাগতো, মধ্যে ঘুচে গিয়েছিলো, এখন রবিবার সকালে কাগজওয়ালা নিউ ইয়র্ক টাইম্স দিয়ে যাবার ত্বর সয়না। কৌশলটা হচ্ছে আগে থেকে কিছু প্রজেক্টের কথা চিন্তা করে রাখতে হয়, তারপর একটু "গা ম্যাজ ম্যাজ" করতে আরম্ভ হলেই নতুন প্রজেক্ট আরম্ভ করে দিতে হয়। যাঁরা ডিপ্রেশনে ভুগেছেন তাঁরা জানেন যে একবার ডিপ্রেশনের কবলে পড়লে কিছু কাজ করা, বিশেষত নতুন কিছু কাজ শুরু করা একেবারে অসাধ্য। এটা একটু বিশদ করে লিখলাম যে আমি এভাবে উপকার পাচ্ছি, কাজেই যাঁরা এ লেখাটি পড়বেন তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এই পন্থাটি কাজে লাগাতে পারেন। কেউ কেউ বলতে পারেন এভাবে ডিপ্রেশনের উপশম হতে পারে, বধিরজনের পক্ষে যা ডেমোক্লিসের খড়গ সেই ডিমেন্শিয়া এড়াতে পারবে তার কোনো স্থিরতা নেই কিন্তু। জানি, তবু চেষ্টা তো করেছিলাম,মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি তখন চেষ্টা তো করতেই হবে।
"অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ", কবি বলেছিলেন। বধিরজনের কথা তিনি বলেন নি!
------------------------------------------------------
"Oh you men
who think or say that I am malevolent, stubborn, or misanthropic,
how greatly you wrong me. You do not know the secret cause which
makes me seem that way to you. ...For six years I have been
hopelessly afflicted. ...Though born with a fiery, active temperament,
even susceptible to the diversions of the society, I was soon
compelled to isolate myself, to live life alone. -- Beethoven,
in a letter of 1802 to his brothers Carl and Johann."
লেখক পরিচিতি: পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।