প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুল (১)

[বঙ্গসাহিত্যে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরও একটি মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। সেটি তাঁর ব্যাঙ্গাত্মক রচনাগুলি, এবং সম্ভবতঃ এক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃত। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যকীর্তির এই দিকটি বেশ কয়েক দশক ধরে সাধারণ বঙালী পাঠকের অগোচরে থেকে গেছে। সাধারণভাবে আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের ব্যাঙ্গাত্মক রচনা ব'লতে 'কমলাকান্তের জবানবন্দি' লেখাটির খবর রাখি। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি 'লোকরহস্য' নামক গ্রন্থে আটটি ব্যাঙ্গ-কৌতুকপূর্ণ রচনা সংকলিত ক'রেন, যেটি বাংলা ১৮৭৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হ'য়। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন-- " এই গ্রন্থে বঙ্গদর্শনের (তাঁর সময়ের একটি সাময়িক পত্রিকা যেটি তিনি নিজে সম্পাদনা ক'রতেন) প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড হ'ইতে কয়েকটি প্রবন্ধ উদ্ধৃত হ'ইয়া পুনর্মুদ্রিত হ'ইল। এতত্‍‌ সম্বন্ধে একটি মাত্র কথা ব'লা আবশ্যক। বঙ্গদেশের সাধারণ পাঠকের এইরূপ সংস্কার আছে যে, রহস্যমাত্র গালি, গালি ভিন্ন রহস্য নাই। সুতরাং তাঁহারা বিবেচনা ক'রেন যে, এই সকল প্রবন্ধে যে কিছু ব্যাঙ্গ আছে, তাহা ব্যাক্তিবিশেষকে গালি দেওয়া মাত্র। এই শ্রেণীর পাঠকদিগের নিকট নিবেদন যে, তাঁহাদের জন্য এ গ্রন্থ লিখিত হয় নাই।-- তাঁহারা অনুগ্রহ করিয়া পাঠ না করিলেই আমি কৃতার্থ হ'ইব।"
লোকরহস্যের দ্বিতীয় সংস্করণে আরও আটটি কৌতুক নিবন্ধ যোগ ক'রা হ'য়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনকালে এটিই শেষ সংস্করণ। 'ব্যাঘাচার্য বৃহল্লাঙ্গুল' রচনাটি দুটি খণ্ডে আছে; এটি তিনটি ভাগে উপস্থাপনা ক'রছি। রচনাটি তত্‍‌সম তথা সন্ধি-সমাসবদ্ধ শব্দে ভরপুর। কিন্ত্তু সেই শব্দগুলি আজকের বৈজাতিক সহজ বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত ক'রলে রচনাটির স্বভাবিক সম্পদ নষ্ট হ'বে ব'লে মনে ক'রি। পৃথিবীর সর্বাধিক বিক্রীত ব'ই Bible সেই মূল ভাষাতেই রক্ষিত এবং বিক্রীত হ'য়ে আসছে, আধুনিক ইংরাজীতে বিকৃত হ'য় নি, এবং শুধু কয়েকটি চার্চই Bible কেনে না।-- পুষ্পেন্দু সুন্দর মুখোপাধ্যায়]

একদা সুন্দরবনমধ্যে ব্যাঘ্রদিগের মহাসভা সমবেত হইয়াছিল। নিবিড় বনমধ্যে প্রশস্ত ভূমিখণ্ডে ভীমাকৃতি বহুতর ব্যাঘ্র লাঙ্গুলে ভর করিয়া, দংষ্ট্রাপ্রভায় অরণ্যপ্রদেশ আলোকময় করিয়া, সারি সারি উপবেশন করিয়াছিল। সকলে একমত হইয়া অমিতোদর নামে এক অতি প্রাচীন ব্যাঘ্রকে সভাপতি করিলেন। অমিতোদর মহাশয় লাঙ্গুলাসন গ্রহণপূর্বক সভার কার্য্য আরম্ভ করিলেন। তিনি সভ্যদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন;--
''অদ্য আমাদিগের কি শুভ দিন! অদ্য আমরা যত অরণ্যবাসী মাংসাভিলাষী ব্যাঘ্রকুলতিলক সকল পরস্পরের মঙ্গল সাধনার্থ এই অরণ্য মধ্যে একত্রিত হইয়াছি। আহা! কুত্‍‌সাকারী, খলস্বভাব অন্যান্য পশুবর্গে রটনা করিয়া থাকে যে, আমরা বড় অসামাজিক, একা এক বনেই বাস করিতে ভালবাসি, আমাদের মধ্যে ঐক্য নাই। কিন্ত্তু অদ্য আমরা সমস্ত সুসভ্য ব্যাঘ্রমণ্ডলী একত্রিত হইয়া সেই অমূলক নিন্দাবাদের নিবাস করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এক্ষণে সভ্যতার যেরূপ দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, তাহাতে আমার সম্পূর্ণ আশা আছে যে, শীঘ্রই ব্যাঘ্রেরা সভ্যজাতির অগ্রগণ্য হইয়া উঠিবে। এক্ষণে বিধাতার নিকট প্রার্থনা করি যে, আপনারা দিন দিন এইরূপ জাতি হিতৈষিতা প্রকাশপূর্বক পরমসুখে নানাবিধ পশুহনন করিতে থাকুন।" (সভামধ্যে লাঙ্গুল চটচটারব।)
"এক্ষণে হে ভ্রাতৃবৃন্দ! আমরা যে প্রয়োজন সম্পাদনার্থ সমবেত হইয়াছি, তাহা সংক্ষেপে বিবৃত করি। আপনারা সকলেই অবগত আছেন যে, এই সুন্দরবনের ব্যাঘ্রসমাজে বিদ্যার চর্চা ক্রমে লোপ পাইতেছে। আমাদিগের বিশেষ অভিলাষ হইয়াছে, আমরা বিদ্বান্‌ হইব। কেন না, আজিকালি সকলেই বিদ্বান্‌ হইতেছে। আমরাও হইব। বিদ্যার আলোচনার জন্য এই ব্যাঘ্রসমাজ সংস্থাপিত হইয়াছে। এক্ষণে আমার বক্তব্য এই যে, আপনারা ইহার অনুমোদন করুন।"
সভাপতির এই বক্তৃতা সমাপ্ত হইলে, সভ্যগণ হাউমাউ শব্দে এই প্রস্তাবের অনুমোদন করিলেন। তখন যথারীতি কয়েকটি প্রস্তাব পঠিত এবং অনুমোদিত হইয়া সভ্যগণ কর্ত্তৃক গৃহীত হইল। সে সকল ব্যাকরণশুদ্ধ এবং অলঙ্কারবিশিষ্ট বটে, তাহাতে শব্দবিন্যাসের ছটা বড় ভয়ঙ্কর। বক্তৃতার চোটে সুন্দরবন কাঁপিয়া গেল।
পরে সভার অন্যান্য কার্য্য হইলে সভাপতি বলিলেন, "আপনারা জানেন যে, এই সুন্দরবনে বৃহল্লাঙ্গুল নামে এক অতি পণ্ডিত ব্যাঘ্র বাস করেন। অদ্য তিনি আমাদিগের অনুরোধে মনুষ্যচরিত্র সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করিতে স্বীকার করিয়াছেন।"
মনুষ্যের নাম শুনিয়া কোন কোন নবীন সভ্য ক্ষুধা বোধ করিলেন। কিন্ত্তু তত্‍‌কালে পব্লিক ডিনরের সূচনা না দেখিয়া নীরব হইয়া রহিলেন। ব্যাঘ্রাচার্য্য বৃহল্লাঙ্গুল মহাশয় সভাপতি v আহূত হইয়া গর্জ্জনপূর্বক গাত্রোত্থান করিলেন এবং পথিকের ভীতিবিধয়াক স্বরে নিম্নলিখিত প্রবন্ধটি পাঠ করিলেন:--
"সভাপতি মহাশয়! বাঘিনীগণ এবং ভদ্র ব্যাঘ্রগণ। মনুষ্য একপ্রকার দ্বিপদ জন্ত্তু। তাহারা পক্ষবিশিষ্ট নহে, সুতরাং তাহাদিগকে পাখী বলা যায় না। বরং চতুস্পদগণের সঙ্গে তাহাদিগের সাদৃশ্য আছে। চতুস্পদগণের যে যে অঙ্গ, যে যে অস্থি আছে, মনুষ্যেরও সেইরূপ আছে। অতএব মনুষ্যদিগকে একপ্রকার চতুস্পদ বলা যায়। প্রভেদ এই যে, চতুস্পদের যেরূপ গঠণের পারিপাট্য, মনুষ্যের তাদৃশ নাই। কেবল ইদৃশ প্রভেদের জন্য আমাদিগের কর্ত্তব্য নহে যে, আমরা মনুষ্যকে দ্বিপদ বলিয়া ঘৃণা করি।
চতুস্পদমধ্যে বানরদিগের সঙ্গে মনুষ্যগণের বিশেষ সাদৃশ্য। পণ্ডিতেরা বলেন যে, কালক্রমে পশুদিগের অবয়বের উত্‍‌কর্ষ জন্মিতে থাকে; এক অবয়বের পশু ক্রমে অন্য উত্‍‌কৃষ্টতর পশুর আকার প্রাপ্ত হয়। আমাদিগের ভরশা আছে যে, মনুষ্য-পশুও কালপ্রভাবে লাঙ্গুলাদিবিশিষ্ট হইয়া ক্রমে বানর হইয়া উঠিবে।
মনুষ্য-পশু যে অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুভক্ষ্য, তাহা আপনারা বোধ হয়, সকলেই অবগত আছেন। (শুনিয়া সভ্যগণ সকলে আপন আপন মুখ চাটিলেন।) তাহারা সকলেই অনায়াসে মারা পড়ে। মৃগাদির ন্যায় তাহারা দ্রুত পলায়নে সক্ষম নহে, অথচ মহিষাদির ন্যায় বলবান বা শৃঙ্গাদি আয়ুধযুক্ত নহে। জগদীশ্বর এই জগত্‍‌-সংসার ব্যাঘ্রজাতির সুখের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, সন্দেহ নাই। সেই জন্য ব্যাঘ্রের উপাদেয় ভোজ্য পশুকে পলায়নের বা আত্মরক্ষার ক্ষমতা পর্যন্ত দেন নাই। বাস্তবিক মনুষ্যজাতি যেরূপ অরক্ষিত-- নখ-দন্ত শৃঙ্গাদি বর্জিত, গমনে মন্থর এবং কোমলপ্রকৃতি, তাহা দেখিয়া বিস্মিত হইতে হয় যে, কি জন্য ঈশ্বর ইহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন। ব্যাঘ্রজাতির সেবা ভিন্ন ইহাদিগের জীবনের কোন উদ্দেশ্য দেখা যায় না।
এই সকল কারণে, বিশেষ তাহাদিগের মাংসের কোমলতা হেতু, আমরা মনুষ্যজাতিকে বড় ব্জালবাসি। দৃষ্টিমাত্রেই ধরিয়া খাই। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাহারাও বড় ব্যাঘ্রভক্ত। এই কথায় যদি আপনারা বিশ্বাস না করেন, তবে তাহার উদাহরণ স্বরূপ আমার যাহা ঘটিয়াছিল, তদ্ব্বৃত্তান্ত বলি। আপনারা অবগত আছেন, আমি বহুকালাবধি দেশভ্রমণ করিয়া বহূদর্শী হইয়াছি। আমি যে দেশে প্রবাসে ছিলাম, সে দেশ এই ব্যাঘ্রভূমি সুন্দরবনের উত্তরে আছে। তথায় গো মনুষ্যাদি ক্ষুদ্রাশয় অহিংস্র পশুগণই বাস করে। তথাকার মনুষ্য দ্বিবিধ; এক জাতি কৃষ্ণবর্ণ; এক জাতি শ্বেতবর্ণ। একদা আমি সেই দেশে বিষয়কর্মোপলক্ষ্যে গমন করিয়াছিলাম।"
শুনিয়া মহাদংস্ট্রানামে একজন উদ্ধতস্বভাব ব্যাঘ্র জিজ্ঞাসা করিলেন-- 'বিষয়কর্মটা কি?"
বৃহল্লাঙ্গুল মহাশয় বলিলেন, "বিষয়কর্ম্ম আহারান্বেষন। এখন সভ্যলোকে আহারান্বেষনকে বিষয়কর্ম্ম বলে। ফলে সকলেই যে আহারান্বেষনকে বিষয়কর্ম্ম বলে, এমত নহে। সম্ভ্রান্ত লোকের আহারান্বেষনের নাম বিষয়কর্ম্ম, অসম্ভ্রান্তের আহারান্বেষনের নাম জুয়াচুরি, উঞ্ছবৃত্তি এবং ভিক্ষা। বলবানের আহারান্বেষন দস্যুতা; লোকবিশেষে দস্যুতা শব্দ ব্যবহার হয় না; তত্‍‌পরিবর্ত্তে বীরত্ব বলিতে হয়। যে দ্স্যুর দণ্ডপ্রণেতা আছে, সেই দস্যুর কার্যের নাম দস্যুতা; যে দস্যুর দণ্ডপ্রণেতা নাই, তাহার দস্যুতার নাম বীরত্ব। আপনারা যখন সভ্যসমাজে অধিষ্ঠিত হইবেন, তখন এইসকল শব্দবৈচিত্র্য স্মরণ রাখিবেন, নচেত্‍‌ লোকে অসভ্য বলিবে। বস্তুতঃ আমার বিবেচনায় এত বৈচিত্র্যের প্রয়োজন নাই; এক উদর-পূজা নাম রাখিলেই সকল বুঝাইতে পারে। সে যাহাই হউক, যাহা বলিতেছিলাম, শ্রবণ করুন। মনুষ্যেরা বড় ব্যাঘ্রভক্ত। আমি একদা মনুষ্যজাতিমধ্যে বিষয়কর্ম্মোপলক্ষে গিয়াছিলাম। শুনিয়াছেন, কয়েক বত্‍‌সর হইল, এই সুন্দরবনে পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি স্থাপিত হইয়াছিল।"
মহাদংষ্ট্রা বক্তৃতা বন্ধ করাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "পোর্ট ক্যানিং কিরূপ জন্তু?"
বৃহল্লাঙ্গুল কহিলেন, "তাহা আমি সবিশেষ অবগত নহি। ঐ জন্তুর আকার, হস্তপদাদি কিরূপ, জিঘাংসাই বা কেমন ছিল, ঐ সকল আমরা অবগত নহি। শুনিয়াছি, ঐ জন্তু মনুষ্যের প্রতিষ্ঠিত; মনুষ্যদিগেরই হৃদয়শোণিত পান করিত; এবং তাহাতে বড় মোটা হইয়া মরিয়া গিয়াছে। মনুষ্যজাতি অত্যন্ত অপরিণামদর্শী। আপন আপন বধোপায় সর্বদা আপনারাই সৃজন করিয়া থাকে। মনুষ্যেরা যে সকল অস্ত্রাদি ব্যবহার করিয়া থাকে সেই সকল অস্ত্রই এ কথার প্রমাণ। মনুষ্যবধই ঐ সকল অস্ত্রের উদ্দেশ্য। শুনিয়াছি, কখন কখন সহস্র মনুষ্য প্রান্তরমধ্যে সমবেত হইয়া ঐ সকল অস্ত্রাদির দ্বারা পরস্পর প্রহার করিয়া বধ করে। আমার বোধ হয়, মনুষ্যগণ পরস্পরের বিনাশার্থ এই পোর্ট ক্যানিং কোম্পানি নামক রাক্ষসের সৃজন করিয়াছিল। সে যাহাই হ'উক, আপনারা স্থির হইয়া এই মনুষ্যবৃত্তান্ত শ্রবণ করুন। মধ্যে মধ্যে রসভঙ্গ করিয়া প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে বক্তৃতা হয় না। সভ্যজাতিদিগের এরূপ নিয়ম নহে। আমরা এক্ষণে সভ্য হইয়াছি, সকল কাজে সভ্যদিগের নিয়মানুসারে চলাই ভাল।"

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

(চলবে)


(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।