প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯ - ১৯৪৩)

[জন্ম নদীয়া জেলার মেহেরপুর গ্রামে। বাবা ব্রজনাথ কাজ করতেন কৃষ্ণনগরে; দীনেন্দ্রকুমারের ছাত্রজীবন সেখানেই কেটেছে। ১৮৮৮ সালে মহিষাদল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাশ করে কৃষ্ণনগর কলেজে কিছুদিন পড়েন। কিন্তু কলেজের পথ শেষ করেন নি। অল্প কিছুদিন মহিষাদল স্কুলে শিক্ষকতা করে ১৮৯৩ সালে তিনি রাজশাহী জেলা জজের কর্মচারী হন। সেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ১৮৯৮ সালে দীনেন্দ্রকুমার অরবিন্দ ঘোষের বাংলা শিক্ষক হয়ে দুবছর বরোদাতে কাটান। সেখান থেকে ফিরে এসে উনি প্রথমে সাপ্তাহিক বসুমতীর সহ-সম্পাদক ও পরে সম্পাদক হন। এই সময় তিনি নন্দন কানন পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। নন্দন কানন সিরিজ বা রহস্য লহরী সিরিজ-এ ইংরেজী থেকে অনুবাদ করে বিখ্যাত ডিটেক্টিভ ব্লেককে তিনি বাংলার কিশোরদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। একটি দুটি নয়, এই সিরিজে মোট ২১৭টি উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন! লঘুস্বাদের এই উপন্যাসগুলি দীনেন্দ্রকুমারকে এক সময়ে খুবই জনপ্রিয় করেছিল। 'রূপসী বোম্বেটে' উপন্যাসটির কথা এযুগে কেউ না জানলেও এককালে সেটি পড়েন নি তেমন পাঠক খুব কমই ছিল। রহস্যকাহিনী ছাড়া দীনেন্দ্রনাথ অন্য লেখাও লিখেছেন। তারমধ্যে সেকালের পল্লীজীবন সম্পর্কে লেখা তাঁর বইগুলি (পল্লী চিত্র, পল্লী কথা, পল্লী বৈচিত্র্য) নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ। রবীন্দ্রনাথ সেগুলি পড়ে মন্তব্য করেছিলেন, "বাংলা দেশের হৃদয় হইতে আনন্দ ও শান্তি বহন করিয়া আনিয়া আমাকে উপহার দিয়াছেন।"

দীনেন্দ্রনাথ যখন রাজশাহীতে জেলা জজের অফিসে কাজ করছেন, তখন মামলার নথিপত্রের অনুবাদ অনেক সময় ওঁকে করতে হত। যদিও সেখানে আলাদা ভাবে অনুবাদক হিসেবে একজন চাকরি করতেন, কিন্তু কাজের চাপের জন্য তাঁর পক্ষে সব কিছু অনুবাদ করা সম্ভব হত না। এইভাবে অনুবাদের কাজে দীনেন্দ্রকুমার অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। সাক্ষীদের জবানবন্দী অনুবাদ করে সায়েব জজদের বোঝানো সব সময়ে সহজ নয়। এ নিয়ে কিছু মজার গল্পও তিনি নানান জায়গায় লিখেছেন। দায়রা মামলায় জবানবন্দীর একটা অংশে ছিলো 'জয়লাল আমার হেতো ব্যাটা' - সেটা অনুবাদ করতে দীনেন্দ্রনাথ যখন হিমসিম খাচ্ছেন, তখন জজ সাহেব সাক্ষীকে বললেন 'হেতো ব্যাটা' কথাটা কি বিশদ করে বলতে। দীনেন্দ্রকুমার সাক্ষীকে সেটা বাংলায় বলতেই, সাক্ষী জজ সায়েবের দিকে তাকিয়ে বলল, "হেতো ব্যাটা কারে কয় বুঝলি না সায়েব! ধর তোর একটা ম্যাম (মেম-সায়েব পত্নী) আছে, আর সেই ম্যামের পেটের এক ছাওয়াল (পেটের ছেলে) আছে। তা, তুই হেকিমি কত্তি কত্তি শিঙে ফুকলি। তোর ম্যাম আঁড় (বিধবা) হলেন। মুই (আমি) তোর সেই আঁড় ম্যামকে নিকে (বিয়ে) করনু। তোর ম্যামের সেই ব্যাটা আমার ঘরে আস্যে আমারে বাপজান বুলে ডাক্বিতো? সে হলো গিয়ে ত্যাখন আমার হেতো ব্যাটা।"
'হেতো ব্যাটা'র এই প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা অনুবাদ করে দীনেন্দ্রকুমার জজ সাহেবকে শুনিয়েছিলেন না সংক্ষেপে stepson বলেছিলেন - সেটা অবশ্য কোথাও উল্লেখ করেন নি। যাইহোক, অনুবাদের এই অভিজ্ঞতাকেই পরে তিনি রহস্যলহরী সিরিজে কাজে লাগিয়েছিলেন।

রাজশাহীতে কাজ করার সময়ে দীনেন্দ্রকুমার জানতে পারেন যে অরবিন্দ ঘোষ বরোদায় একজন বাংলা শিক্ষক খুঁজছেন। অরবিন্দ তখন ইংলণ্ড থেকে এসে বরোদায় অধ্যাপনা করছেন। ছেলেবেলা থেকে ইংলণ্ডে বড় হওয়ায় যুরোপের বহু ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও অরবিন্দ বাংলা বিশেষ জানতেন না। দীনেন্দ্রকুমার ইতিমধ্যে ভারতী পত্রিকায় নিয়মিত লিখে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁরই সুপারিশে (মতান্তর আছে) উনি অরবিন্দকে বাংলা শেখানোর ভার পান। নিচের লেখাটি দীনেন্দ্রকুমার লিখেছিলেন টেগার্টের একটি বক্তৃতা পড়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে। এটি মাসিক বসুমতী-তে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত 'সেকালের স্মৃতি'-র (পরে আনন্দ পাবলিশার্স এটিকে বই হিসেবে প্রকাশ করে) একটি ছোট অংশ। ঘরোয়া পরিবেশে অরবিন্দকে প্রায় দুবছর দেখার সুযোগ দীনেন্দ্রকুমার পেয়েছিলেন। তবে টেগার্টের বক্তৃতাটা দৈনিক বসুমতী-তে প্রকাশিত না হলে হয়তো অরবিন্দের কথা 'সেকালের স্মৃতি'-র একেবারে প্রথমেই তিনি লিখতেন না।]

সে কালের স্মৃতির আলোচনা করতে বসিয়াছি, এমন সময় দৈনিক বসুমতী-তে সার চার্লস টেগার্টের বিলাতী বক্তৃতার সারমর্ম কিয়দংশ পাঠ করিলাম। সার চার্লস এখন বিলাতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের একটি স্তম্ভ; তিনি ঘোর সাম্রাজ্যবাদী; কিন্তু তিনি শ্রীঅরবিন্দ সম্বন্ধে যেসব কথা বলিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে মনে হয়, তিনি শ্রীঅরবিন্দের প্রতি অত্যন্ত অবিচার করিয়াছেন; শ্রীঅরবিন্দকে বিপ্লববাদীদের অন্যতম নেতা বলিয়া বিশ্বাস করিয়া অমার্জনীয় ভ্রম করিয়াছেন। আমি জানি, শ্রী অরবিন্দের পক্ষ হইতে ইহার প্রতিবাদ হইবে না এবং অরবিন্দের ভাগ্যে এরূপ বিড়ম্বনা বহুবার ঘটিয়াছে। তিনি কোন দিন তাহা গ্রাহ্য করেন নাই; এখন তিনি সাধন মার্গের যে স্থানে উপনীত হইয়াছেন, সার চার্লসের ন্যায় শক্তিশালী বৈষয়িকের সহস্র আক্রমণেও সেই স্থান হইতে তাঁহার বিচলিত হইবার সম্ভাবনা নাই।

একথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, শ্রীঅরবিন্দ যে সময় সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষায় গ্রীক ও লাটিনে সর্বোচ্চ নম্বর (record marks) পাইয়া সসন্মানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই্যাছিলেন, সেই সময় সার চার্লস সাধারণ মিঃ টেগার্ট রূপে বঙ্গীয় পুলিসের একটি ক্ষুদ্র পদে নিযুক্ত ছিলেন; তখন তাঁহার অরবিন্দের কার্য পদ্ধতির সমালোচনা করিবার শক্তি বা অধিকার ছিলো না; ইংলণ্ডে তখন সার চার্লস টেগার্টের নাম কেহ জানিত না, কিন্তু অরবিন্দের পাণ্ডিত্যে ও কবিত্বশক্তিতে ইংলণ্ডের যুবক সমাজ তখন মুগ্ধ। সত্য বটে, অরবিন্দ অশ্বারোহণের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের অযোগ্য প্রতিপন্ন হইয়াছিলেন, কিন্তু সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করতে না পারিয়া অরবিন্দ ক্ষুণ্ণ হইয়া বিদ্বেষ-বুদ্ধিবশতঃ বৃটিশ গবর্ণমেণ্টের প্রতি বৈরিভাব পোষণ করিতেছিলেন, সার চার্লসের এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। অরবিন্দ চিরদিনই আপনা-ভোলা, সংসারের সুখ-দুঃখে তিনি চিরদিনই উদাসীন। সাংসারিক প্রতিষ্ঠা, উন্নতি, পদ-গৌরব তিনি চিরদিনই তুচ্ছ করিয়া আসিয়াছেন। সত্য বটে, অরবিন্দ বরদা সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করিয়াছিলেন; কিন্তু বরোদার চাকরী লাভের জন্য কোনোদিন ললায়িত হয়েন নাই; বরোদার বর্তমান মহারাজা গুণগ্রাহী সার সয়াজি রাও গায়কবাড় সেনাখান খেল সম্সের বাহাদুর অরবিন্দের গুণে আকৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে বরোদা সার্ভিসে নিযুক্ত করেন; এবং সেই সময়ে বরোদা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল লিট্লভেল সাহেব ছুটি লইয়া যাওয়ায় যদিও অরবিন্দ তাঁহার পদে অস্থায়ীভাবে নিযুক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু মহারাজ গায়কবাড় তাঁহার কলেজে মাস্টারী করিবার জন্যই অরবিন্দকে এদেশে লইয়া আসিয়া চাকরীতে বহাল করেন নাই। চাকরীর প্রতি অরবিন্দের স্পৃহা ছিলো না। ...... অরবিন্দের যেরূপ যোগ্যতা ও তাঁহার প্রতি মহারাজার যেরূপ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস ছিল তাহাতে আমরা আশা করিয়াছিলাম, অরবিন্দ একদিন বরোদা গবর্নমেণ্টের সর্বোচ্চ পদে আরূঢ় হইবেন। কিন্তু মাহারাজা যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও অরবিন্দকে বরোদায় রাখিতে পারিলেন না। অর্থলোভ ও খ্যাতির মোহ অরবিন্দকে মুগ্ধ করতে পারে নাই। সিভিল সার্ভিসে ইহার অধিক কি হইত?

আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে জানি, অরবিন্দ বরোদায় কোন দিন রাজনীতিচর্চা করিতেন না, বিপ্লববাদেরও কোন ধার ধারতেন না। তবে সেই সময়ে তিনি কংগ্রেসের কতগুলি ত্রুটির সমালোচনা করিয়া বোম্বের অন্যতম প্রধান পত্রিকা ইন্দুপ্রকাশে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। সেই প্রবন্ধগুলি এরূপ সারগর্ভ ও যুক্তিপূর্ণ যে, তাহা বোম্বে প্রদেশের শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করিযাছিল। সেই সকল প্রবন্ধে কংগ্রেসের ক্ষতি হইতে পারে, এই আশঙ্কায় মহামতি তিলক তাঁহাকে ঐ শ্রেণীর প্রবন্ধ রচনায় বিরত হইতে অনুরোধ করায় তিনি তাঁর অমোঘ লেখনীকে বিরামদান করিয়াছিলেন। মহামতি তিলকের প্রতি তাঁহার অসাধারণ শ্রদ্ধা ছিল; এই অপরাধে তাঁহাকে বিপ্লববাদী বলিয়া সন্দেহ করা অসঙ্গত। তিনি কোনোদিন রাণ্ড ও আয়ার্স্টের হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেন নাই। কিন্তু গরজের বড় বালাই; গরজের অনুরোধে সার চার্লস তাঁহাকে আজ বিপ্লাববাদীর পর্যায়ভুক্ত করতে কুণ্ঠিত হইলেন না!

অরবিন্দ আজন্ম সন্ন্যাসী। বাল্যকাল হইতে পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁহাকে ইংলণ্ডে বাস করিতে হইয়াছিল; কিন্তু বিলাস-লালসা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই। পাঁচ টাকা মূল্যের একটি লোহার খাটিয়ায় একটি পাতলা তোষক ও একখানি কম্বল বিছাইয়া রাত্রিশেষে কয়েক ঘণ্টা মাত্র নিদ্রা যাইতেন। তাঁহার পরিচ্ছদের বিন্দুমাত্র পারিপাট্য ছিল না। আমি দুই বৎসরের অধিককাল তাঁহার বঙ্গভাষার শিক্ষকরূপে তাঁহার সহিত একত্র বাস করিয়াছি; কিন্তু কোনদিন তাঁহাকে মূল্যবান পরিচ্ছদ ব্যবহার করতে দেখি নাই; মূল্যবান জুতা, পরিচ্ছদ প্রভৃতি তিনি কোন দিন ক্রয় করেন নাই। তাঁহার একমাত্র সখ ছিল সিগারেট ধূমপান। তাঁহার গৃহে রাশি রাশি সিগারেটের বাক্স সঞ্চিত থাকিত। বোম্বের বিভিন্ন পুস্তক বিক্রেতার দোকান হইতে প্রতি মাসেই রেল-পার্শেলে কত পুস্তক আসিত তাহাদের সংখ্যা নির্দ্দেশ করা কঠিন। সেই সকল পুস্তকের অধিকাংশই উপন্যাস; কেবল ইংরেজী উপন্যাস নহে, এবং ইংরেজী কাব্য ও উপন্যাসেই যে তিনি অনুরক্ত পাঠক ছিলেন, একথাও বলিতে পারি না; ফরাসী, জার্মান, রুসিয়ান, ইংরাজী, ইটালিয়ান, গ্রীক, কত ভাষার পুস্তক আসিত, তাহা আলমারীতে ধরিত না; ঘরের চতুর্দ্দিকে তাহা পুঞ্জীভূত হইত। তিনি যখন গ্রর্রষ্মাবকাশে কিংবা অন্য কোন ছুটি উপলক্ষে দেশে আসিতেন, তখন তাঁহার সঙ্গে যে সকল ব্যাগ, ট্রাঙ্ক প্রভৃতি আসিত, তাহা নানা ভাষার পুস্তকেই পূর্ণ থাকিত, তাহা বস্ত্রাদি বা পরিচ্ছদের বাহুল্য বর্জ্জিত।

অরবিন্দকে কোনদিন কোন ব্যায়াম করতে দেখি নাই; তিনি সায়ংকালে তাঁহার বাংলোর প্রকাণ্ড বারান্দায় ঘণ্টাখানের দ্রুতপদে ঘুরিয়াই ব্যায়ামের অভাব পূরণ করিতেন; কলেজে যখন চাকরী করিতেন, তখন সকাল সকাল কলেজ হইতে আসিয়া কাগজ কলম লইয়া টেবিলের কাছে বসিতেন, এবং কবিতা লিখিতেন। তাঁহার কবিতার খাতা ছিল; রামায়ণ-মহাভারতের এক একটি উপাখ্যান অবলম্বন করিয়া কবিতা লিখিতেন; এবং ক্ষণকাল চিন্তা না করিয়া দ্রুত লিখিয়া যাইতেন। তাহার পর যখন পাঠ আরম্ভ করতে আরম্ভ করিতেন, তখন তাঁহার বাহ্যজ্ঞান থাকিত না। রাত্রি নয়টা বা দশটার মধ্যে টেবিলে বসিয়া যৎসামান্য আহার শেষ করিয়া পাঠে মনোনিবেশ করিতেন, রাত্রি একটা, কোনদিন দুইটা পর্যন্ত একই ভাবে পাঠ করিতেন; তাহার পর একটি ক্ষুদ্র অনুচ্চ বালিস মাথায় দিয়া সেই সঙ্কীর্ণ লোহার খাটিয়ায় শয়ন করিতেন।...... অরবিন্দ যে এতবড় বিপ্লববাদী ছিলেন, তাহা তাঁহার সহিত দীর্ঘকাল একত্র বাস করিয়া কোনদিন কল্পনা করিবারও সুযোগ পাই নাই; এ জন্য সার চার্লস টেগার্টের অভিমত পাঠ করিয়া আমি বিস্ময় দমন করতে পারি নাই।

অরবিন্দের চিঠিপত্র লিখিবার অভ্যাস অত্যন্ত অল্প ছিল। তিনি আত্মীয়-স্বজনের নিকট কদাচিৎ চিঠিপত্র লিখিতেন; তিনি একদিনে একখানি খাতার চারি পাঁচ পৃষ্ঠা কবিতা লিখিতে পারিতেন, কিন্তু কাহাকেও একখানি চিঠি লিখিতে আরম্ভ করিলে তিন চারি দিনেও তাহা শেষ হইত না। তিনি সাধারণত ভগিনী সরোজিনী ও মাতুল যোগীন্দ্রবাবুকেই চিঠিপত্র লিখিতেন। যোগীন্দ্রবাবু প্রাতঃস্মরণীয় স্বর্গীয় রাজনারায়ণ বসু মহাশয়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন।......অরবিন্দ তাঁহার মাসী ও মাসতুতো ভগিনীদের নিকটও চিঠিপত্র লিখিতেন। সার চার্লস টেগার্ট বিপ্লববাদীগণের নেতা বারীন্দ্রকে অরবিন্দের উপদেশে ও পরামর্শে পরিচালিত বলিয়া ইঙ্গিত কয়িাছেন বটে, কিন্তু বারীন্দ্রকে তিনি কদাচিৎ পত্র লিখিতেন, এমন কি দুই চারি মাসেও একখানি পত্র লিখিতেন কিনা সন্দেহ। বারীন্দ্র অরবিন্দের উপদেশে রাজনীতিক মত সংগঠন করিয়াছিলেন বা সরকারের উচ্ছেদ সাধনে কৃতসঙ্কল্প হইয়া দল পাকাইয়াছিলেন, এরূপ অভিযোগ বা সন্দেহ সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ও হাস্যোদ্দীপক বলিয়াই মনে হয়। বারীন্দ্রের দ্বারা কোন দুরূহ কার্য সাধিত হইতে পারে, ভ্রাতার প্রতি তাঁহার ব্যবহারে এরূপ ধারণা কোন দিন আমারে মনে স্থান পায় নাই। আমি যতদিন বরোদায় ছিলাম, সেই দীর্ঘকালের মধ্যে বারীন্দ্র একবারও বরোদায় গমন করেন নাই। আমি দেশে ফিরিয়া বসুমতী-র কর্ণধার কর্মবীর উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুরোধে শ্রীযুক্ত জলধরবাবুর সহযোগিতায় বসুমতীর সম্পাদনা-ভার গ্রহণ করিবার অল্পদিন পরে অরবিন্দ বরোদার চাকরীর মায়া উচ্চপদের আশা ত্যাগ করিয়া কলকাতায় আসিয়া বন্দে মাতরম পরিচালন কার্যে যোগদান করিয়াছিলেন। সেই সময়ের পূর্বে এবং আমার বরোদা-ত্যাগের পর বারীন্দ্র বরোদায় গিয়াছিলেন কিনা, আমার অজ্ঞাত। কিন্তু অরবিন্দ যতদিন বরোদায় ছিলেন, ততদিন কলকাতার সাহিত্য বা রাজনীতিক সমাজের সহিত ঘনিষ্ঠতা করিবার সুযোগ হয় নাই।

আমি যখন বরোদায় ছিলাম, সেই সময়ে পূজনীয় শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সহিত আমার পত্র ব্যবহার ছিল। সে সময়ে আমি সাধনা ও ভারতী-তে প্রবন্ধাদি লিEখতাম; শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ তাঁহার পত্রে আমার নিকট অরবিন্দের সংবাদ লইতেন, কিন্তু অরবিন্দের সহিত সাক্ষাৎ সম্বন্ধে তাঁহার আলাপ-পরিচয় ছিল না। অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার - এই কবিতা এই ঘটনার বহু পরে - বঙ্গভূমি যখন যখন অরবিন্দের প্রতিভা ও ত্যাগের পরিচয়ে মুগ্ধ হইয়াছিল, সেই সময়ে রচিত হইয়াছিল। তবে মনে হয় বিশ্বকবি অরবিন্দের প্রতিভার পরিচয় পূর্বেই পাইয়াছিলেন, নতুবা প্রায় প্রত্যেক পত্রেই অরবিন্দের সংবাদ জানিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিবেন কেন? অরবিন্দ রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার পক্ষপাতী ছিলেন, তবে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থাবলীতে যে সকল কবিতা সন্নিবিষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের সকলগুলি প্রকাশযোগ্য কিনা, এ বিষয়ে তাঁহার সন্দেহ ছিল। কিন্তু তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করিতেন।...... তাঁহার স্বর্গীয় দাদা মন্মোহন ঘোষ সেই সময়ে ঢাকা কলেজের ইংরাজীর অধ্যাপক ছিলেন। অধ্যাপক ঘোষ মহাশয় ইংলণ্ডে অবস্থান কলে বহু কবিতা রচনা করিয়াছিলেন, কিন্তু সেই সকল কবিতা সাহিত্যে স্থায়িত্ব লাভ করিবে ঔ অরবিন্দ কোনদিন এরূপ ধারণা পোষণ করতে পারেন নাই। শিক্ষা বিভাগে চাকুরি গ্রহণ করিয়া অধ্যাপক ঘোষ বিবাহ করিয়াছিলেন, অরবিন্দ হাসিয়া বলিতেন, উহা দাদার ব্যয়বহুল বিলাসিতা (এক্সপেন্সিভ লাক্সারী)। বরোদার চাকরী ত্যাগ করিয়া কলকাতায় আসিয়া অরবিন্দও বিবাহ করিয়াছিলেন, কিন্তু যাঁহার প্রকৃতি চিরদিনই সন্ন্যাসীর প্রকৃতির অনুরূপ, কোন বন্ধন যাঁহার প্রকৃতিবিরুদ্ধ, তিনি যে কেন বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিলেন তাহা আমাদের বুঝিবার শক্তি নাই। ...... কিন্তু এই বিবাহ সুখের হয় নাই। কারণ, কিছুকাল পরেই অরবিন্দের পত্নী বিয়োগ হইয়াছিল।

(বরোদায়) অনেক সময় আমাদের নানারকম গল্প চলিত, কিন্তু রাজনীতি বা ইংরাজের শাসননীতি প্রসঙ্গে কোন আলোচনা আমাদের গল্পে স্থান পাইত না। অরবিন্দ এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্বাক ছিলেন। বস্তুতঃ কথায় বা ব্যবহারে কোন দিন এরূপ প্রমাণ পাই নাই, যাহাতে অরবিন্দকে বৃটিশ সরকারের উচ্ছেদকামী ভয়ঙ্কর বিপ্লবাদী বলিয়া সন্দেহ করা যাইতে পারিত। বন্দে মাতরম দেশাত্মবোধের বিকাশ-চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু কোনদিন গুপ্তহত্যার সমর্থম করে নাই; অরবিন্দের হৃদয় প্রত্যেক চিন্তাশীল শিক্ষিত ব্যক্তির হৃদয়ের ন্যায় স্বদেশ-প্রেমে পূর্ণ ছিল, কিন্তু তাঁহার প্রতি গুপ্তহত্যার সমর্থনের আরোপ করা কেবল অন্যায় নহে, গর্হিত বলিয়া মনে হয়। অরবিন্দ নরহত্যার সমর্থন করিতে পারেন - ইহা ধারণারও অতীত। অরবিন্দের ন্যায় নির্বিকার, নির্বিরোধ, নিরীহ সাহিত্যসেবীর এরূপ কলঙ্ক প্রচার অল্প নির্লজ্জতার পরিচয় নহে।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।