প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭ - ১৯০৯)

দেশপ্রেমিক কবি হিসেবেই খ্যাত ছিলেন । চট্টগ্রাম থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে তিনি কলকাতায় এসে এফ.এ ও বি.এ পাশ করেন । একুশ বছর বয়সে নবীনচন্দ্র ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন । তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অবকাশরঞ্জনী ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয় । এটি ছিল দেশপ্রেম ও আত্মচিন্তামূলক কবিতার সংকলন । কিন্তু তাঁর কবিখ্যাতি পরিপূর্ণতা পায় পলাশীর যুদ্ধ (১৮৭৫ খ্রী) কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হবার পর । নবীনচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনী 'আমার জীবন' পাঁচখণ্ডে সমাপ্ত করেন । প্রসাদগুণে এটি উপন্যাসের মতোই সুখপাঠ্য । জীবনের নানান ঘটনার মধ্যে তাঁর জীবনের প্রথম অনুরাগের কথাও তিনি পাঠককে শুনিয়েছেন । পুরনো সেই অনুরাগের গল্প আজও পাঠকদের নতুনই লাগবে ।


প্রথম অনুরাগ

প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষ হইল । ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়িল । শেষ দিন যখন পরীক্ষার গৃহ হইতে বাহির হইলাম, বোধ হইল, হৃদয়ে যেন একটু নবীন উৎসাহ, শরীরে যেন একটি নবীন জীবন সঞ্চারিত হইল । বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার কথা যখন মনে করি, তখন আমার একটি দৃশ্য মনে পড়ে । বলিদান । অজ শিশুগুলিকে প্রক্ষালন করিয়া আনিল । পরীক্ষার ফিস দাখিল হইল । ছাগল চিৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল, - বালক অনাহার-অনিদ্রায় রাত্রি জাগিয়া চীৎকার করিয়া পড়িতে লাগিল । ছাগলের ললাটে সিন্দুরের ফোঁটা এবং গলায় বিল্বপত্রের মালা অর্পিত হইল, বালকের 'নমিনেশন রোল' পহুঁছিল । ছাগল তাহার পর কাঁপিতে কাঁপিতে পরীক্ষাগৃহে দাখিল হইল । তাহার পর উভয়ের বলিদান । তারতম্যের মধ্যে এই - ছাগল তখনই মরে, সকল যন্ত্রণার শেষ হয় । বালক যাবজ্জীবনের জন্য আধমরা হইয়া থাকে, তাহার যন্ত্রণা আরম্ভ হয় মাত্র ।

যাহা হউক বলিয়াছি, প্রবেশিকা শেষ হইল; শরীরে নবীন জীবন, নবীন উৎসাহ প্রবেশ করিল; প্রকৃতি নবীন সৌন্দর্যে হাসিল । হৃদয় হইতে কি পাহাড় নামিয়া গিয়া হৃদয় আনন্দে নৃত্য করিতে লাগিল । নানা আনন্দে আমরা দলে-দলে গিরিশৃঙ্গের উপত্যাকায় এবং নির্ঝরের ধারে বেড়াইতে লাগিলাম । কখনও কখনও প্রশ্নের কাগজ খুলিয়া যে-যে প্রকার উত্তর দিয়াছি সেরূপ নম্বর ধরিতাম, কিন্তু কিছুতেই 'পাস মার্ক' কুলাইয়া উঠিত না ।

বিদ্যুৎ আমার কোনো দূর আত্মীয়-কন্যা । তাহার ভ্রাতা আমাদের সঙ্গে পড়িত । দিবারাত্রি আমরা প্রায় এক সঙ্গে পড়িতাম, খেলিতাম; কখনও-কখনও ঝগড়া করিতাম । বিদ্যুৎ তখন ক্ষুদ্র বালিকা - চঞ্চলা, মুখরা, হাস্যময়ী । বিধাতার হস্তের একটি অপরূপ একমেটে প্রতিমা । যখন সে তাহার নাতিদীর্ঘ কুঞ্চিত অলকরাশি দোলাইয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া যাইত দেখিতাম, তখন সে শত ত্যক্ত করিয়া গেলেও তাহাকে মারিতে ইচ্ছা করিত না । সেও আমাদিগকে বিরক্ত করাটি একরূপ বিজ্ঞান শাস্ত্র করিয়া তুলিয়াছিল । তাহার ভ্রাতা আমাদের অপেক্ষা ভাগ্যবান । যখন বিদ্যুৎ সপ্তম কি অষ্টম বর্ষীয়া বালিকা, সে একাদশ বা দ্বাদশ বয়সে ভাবি সংসারের যন্ত্রণা হইতে অব্যহতি লাভ করে । তদবধি আমি তাহার গৃহে বড় একটা যাইতাম না; গেলে মনে কি যেন দুঃখ, হৃদয়ে কি যেন একটা অভাব বোধ হইত । চার কি পাঁচ বৎসর চলিয়া গিয়াছে । প্রবেশিকা পরীক্ষার পর একদিন বিদ্যুতের মাতা আমাকে ডাকিলেন । আমি অপরাহ্নে তাঁহার গৃহে উপস্থিত হইলাম । তাঁহার জ্যেষ্ঠা ভগিনীর সঙ্গে কথা বলিতেছি, পাশে ও কে ধীরে ধীরে কোমল পদক্ষেপে আসিয়া বসিল? বিদ্যুৎ! কি আশ্চর্য পরিবর্তন । যে-বালিকা ছুটিয়া, বাতাসে কুন্তলের কুঞ্চিত অলকাবলি এবং অঞ্চল উড়াইয়া ভিন্ন চলিতে পারিত না, সে আজি ধীরে-ধীরে কোমল পদক্ষেপে - পায়ের নিচে ফুলটি পড়িলেও নামিতে হইত না - এরূপ অলক্ষিত ভাবে আসিয়া বসিল । যাহার হাসি ও কণ্ঠ বাঁশীর মত অনবরত বাজিত, আজি তাহার তরঙ্গায়িত অধরবিপ্লাবী হাসি কোমলার অধরপ্রান্তে বিলীনপ্রায় হইয়া এক অস্ফুট ভাব ও শোভা বিকাশ করিতেছিল । কণ্ঠ নীরব । যে কখনও গলা জড়াইয়া ধরিয়া অংসে উরসে ভিন্ন বসিত না, কি আশ্চর্য, আজি তাহার সঙ্গে চোখে চোখে দেখা হইলে সে চোখ নামাইয়া লইতেছে । আমি অন্য কাহারও সঙ্গে কথা কহিতে , সে তাহার কমলদলায়ত দুই ভাসা চক্ষু আমার মুখের দিকে স্থিরভাবে স্থাপিত করিয়া অতৃপ্ত ভাবে চাহিতেছে । কি দৃষ্টি ! কি অর্থ ! কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিলে কলকণ্ঠে কাকলি বর্ষণ না করিয়া থামিত না, সে আজি ঈষৎ হাসিয়া নিরুত্তরে অধোমুখে চাহিতেছে ।

আমারও হৃদয়ে কি একটা ভাবের উদয় হইতেছিল, আমি বড় বুঝিতে পারিতেছিলাম না । আমারও সেই মুখখানি বড় দেখিতে ইচ্ছা করিতেছিল, অথচ নয়ন ভরিয়া দেখিতে পারিতেছিলাম বা । কে যেন চোখ ফিরাইয়া দিতেছিল । চোখে চোখে দেখা হইলে কি যেন একটি কোমল কুসুম স্পর্শ-মৃদু-মধুর আঘাত হৃদয়ে পঁহুছিতেছিল । সেখান হইতে যে উঠিতে পারিতেছিল না সেকথা আর বলিতে হইবে না । বসিতে বসিতে সন্ধ্যা, সন্ধ্যার পর কিঞ্চিৎ রাত্রি হইল । অবশেষে উঠিলাম; আত্মহারাবৎ চলিয়া যাইতেছিলাম, অন্ধকারে বারাণ্ডা পার হইয়া বক্ষে কি লাগিল? আমি এক পা পিছাইলাম. কিন্তু আবার সে কুসুমস্তবকনিভ স্পর্শ হৃদয়ে লাগিল - আহা! কি স্পর্শ! বুঝিলাম, আমার বুকে মাথা রাখিয়াছে বিদ্যুৎ । অজ্ঞাতে আমার দুই ভুজ তাহাকে আরও বুকে টানিয়া ধরিল । আমার সমস্ত শরীরের যন্ত্র কি অমৃতে আপ্লুত হইয়া নিশ্চল হইল । বালিকা আমার করে একটি গোলাপ ফুল দিল । আমি তার ললাটে একটি চুম্বন দিয়া উন্মত্তের ন্যায় ছুটিয়া একেবারে গুরুঠাকুর চন্দ্রকুমারের কাছে উর্ধশ্বাসে উপস্থিত হইলাম । গুরুমহাশয় আমাকে যথাশাস্ত্র বুঝাইয়া দিলেন যে, বিদ্যুতের সঙ্গে আমার বিবাহ হইতে পারিবে না । এতএব সেখানে যাইতে আমাকে নিষেধ করিলেন ।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।