নারী
ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫
এক’শ কোটির আন্দোলন - ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
আজকাল ১৪ই ফেব্রুয়ারি মানে - ভ্যালেন্টাইন ডে। যখন কলকাতায় বড় হচ্ছিলাম, সে অনেক যুগ আগের কথা, ভ্যালেন্টাইন ডে বলে জগতে যে কিছু আছে তাই জানতাম না। তখন ১৪ই ফেব্রুয়ারির গুরুত্ব ছিল আমার অনেক ছোট এক ভাইয়ের জন্মদিন হিসেবে। আমেরিকায় আসার পরেও বহু বছর ভ্যালেন্টাইন ডে-র মাহাত্ম্য বুঝি নি। আসে পাশের লোকজন বা বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেও দিনটা নিয়ে খুব একটা চাঞ্চল্য দেখি নি কোনদিন। মনে আছে একবার কলেজে পড়াবার সময়ে হঠাৎ একটা ছেলে হাতে ফুল নিয়ে লাজুক মুখে অনুমতি চাইল ক্লাসের একটা মেয়েকে সেটা দেবে বলে। একটু মজা পেয়েই ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। তারপর অন্য ছাত্রছাত্রীদের চাপা হাসির মধ্যে কোন রকমে মেয়েটিকে খুঁজে তার হাতে ফুলের স্তবকটি গুঁজে দিয়েই দৌড় দৌড়! ব্যাপারটা অদ্ভুত লেগেছিল বলেই মনে আছে। এরকম দু-একটা ছোটোখাটো ঘটনা দেখেছি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম ১৪ই ফেব্রুয়ারি সমাজে বেশ একটা জায়গা করে নিয়েছে। ফেব্রুয়ারির দশ তারিখের মধ্যেই চারিদিকে সাজ সাজ রব - বাজার থেকে লাল গোলাপ উধাও, অখাদ্য চকোলেট লাল বাক্সে ভরে বেশ দামে বিক্রি হচ্ছে, ছোটখাটো রেস্টুরেন্টেও রিজার্ভেশন পাওয়া মুস্কিল। তা এ সব ছেলেপুলের ব্যাপার ভেবে সব সময় উড়িয়েই দিয়েছি।
তবে ভ্যালেন্টাইন ডে-র সমারোহ যে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে সন্দেহ নেই। আমেরিকাতে তো বটেই, কলকাতায় গিয়ে দেখেছি গ্রিটিংস কার্ড কেনার ধুম বেড়ে যায় চারদিকে। সেই সঙ্গে বেশ একটা রোমান্টিক হাওয়া। সত্যি কথা বলতে কি সবই ব্যবসা বাণিজ্য বাড়াবার জন্যে বলেই আমার ধারণা। কিন্তু এরই মধ্যে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ঘিরে অন্য একটা উৎসবের পত্তন আমাকে বেশ নাড়িয়ে দিয়েছে - ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং বা এক’শো কোটির আন্দোলন।
এই এক’শ কোটির আন্দোলন আরম্ভ হয়েছে বেশী দিন নয় - ২০১২ সালে। এর একটা বেশ চমকপ্রদ ইতিহাস আছে। ১৯৯৮ সালে আমেরিকার নারীবাদী লেখিকা ইভ এন্সলারের লেখা নাটক ভ্যাজাইনা মনোলগস-এর (ভারতে নাটকটি ‘যোনি কি বাত’ নামে বিখ্যাত) প্রেরণায় আরম্ভ হয় ভি ডে। ভ্যাজাইনা মনোলগস নাটকটি মঞ্চস্থ করে লাভের টাকা নারী মঙ্গলের কাজে ব্যবহার করার সুবিধার্থে ২০০১ সালে গঠন হয় ভি ডে সংস্থা। এই ভি ডে থেকে জন্ম নিয়েছে ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং আন্দোলন।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা জানিয়েছে পৃথিবীর তিনটি মেয়ের মধ্যে অন্তত একজন ধর্ষণ বা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হবে। পৃথিবীর জনসংখ্যার অনুপাতে হিসেব করলে দেখা যায় এক’শ কোটি নারী পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বাস করে পুরুষের হিংসার বলি হবে। এই এক’শ কোটির অন্দোলনই হল ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং। এ আন্দোলনের বিশেষত্ব মিছিল নয়, মোর্চা নয়, বা ‘বন্ধুগণ’ ডেকে বক্তৃতা দেওয়া নয়। এই আন্দোলন আনন্দের, গানের, মুক্তির। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা গানে, ছন্দে, কবিতায়, নাচে, বাজনায় নারী মুক্তির ভাষা সমাজে ছড়িয়ে দেয়। এক’শ কোটির আন্দোলনের লক্ষ্য সমাজে মেয়েদের নিস্তব্ধতা সাঙ্গ করে মুখরতায় ভরিয়ে দেওয়া।
এ বছর ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং আরম্ভের প্রথম উৎসব হল কলকাতায়। সংবেদের নেতৃত্বে এক’শ সত্তর জন মেয়ে উন্মুক্ত আকাশের তলায় ছজন মহিলা ঢাকীর বাজনার তালে তালে সমাজে নিজেদের স্থান দাবী করল গানের সুরে, নৃত্যভঙ্গিমায়। এই মেয়েরা ধর্ষিতা ও সমাজে অপাংক্তেয়। এই মেয়েরাই নাচের মাধ্যমে জানিয়ে দিল যে নির্যাতন তাদের সহ্য করতে হয়েছে তার লজ্জা সমাজের, তাদের নয়।
এই ভ্যালেন্টাইন ডে-র দিনে পৃথিবীর প্রতিটি মহাদেশে এক’শ কোটি নারীর আন্দোলন জানিয়ে দেবে আমরা ধর্ষিতা হতে পারি, নির্যাতিত হতে পারি, কিন্তু আমরা নীরব থাকতে রাজি নই, আমরা লজ্জায় মুখ ঢাকব না। ঘরের কোনায় বসে কান্না আমাদের জন্যে নয়। আমরা নাচব, গান গাইব, প্রতি নিয়ত দাবী করব পায়ের তলায় শক্ত মাটি। আমরা দাবী করি বৃহত্তর সমাজ আমাদের উপস্থিতি স্বীকার করুক, আমাদের সসম্মানে বাঁচতে দিক। এই আনন্দ মুখরতাই এক’শ কোটি নির্যাতিতার সোচ্চর প্রতিবাদ।
ছবির সূত্রঃ অনুরাধা কাপুর ও সংবেদ
লেখক পরিচিতি - সত্তর দশক থেকেই আমেরিকায় নারী আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশিয় সংস্থা 'মানবী'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।