এশিয়ার ফেমিনিজম
বা নারীবাদকে পাশ্চাত্যবাসীরা সাধারণতঃ একটু অবজ্ঞার
চোখেই দেখে। তাদের ধারনা যেখানে পারিবারিক নির্যাতন
অহরহ ঘটছে, পণপ্রথা সমাজের একটা অঙ্গ, অসংখ্য নারীর
জীবন কাটছে চার-দেয়ালের মধ্যে, সেখানে আবার নারীবাদ
কি? কিন্তু এশিয়ার ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে যে, পাশ্চাত্য-নারীবাদকে
অনুকরণ না করলেও নারীদের অ্যাক্টিভিজ্ম বা সক্রিয়
ভূমিকার বহু উদাহরণ সেখানে রয়েছে। এশিয়ার নারীবাদের
সঙ্গে পাশ্চাত্য নারীবাদের ফারাক রয়েছে, কারণ এশিয়ার
নারীরা পাশ্চাত্য 'ফেমিনিজম
'-এর অন্ধ অনুকরণ করে নি। কেন করে নি, তার
একটা কারণ হল, এশীয় নারীবাদের মূলে মেয়েদের উপর পুরুষ-কেন্দ্রিক
সমাজের চাপ ছাড়াও আরও কতগুলি শক্তি কাজ করেছে, যেমন
নারী অবদমনে (জেণ্ডার অপ্রেশন) সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার
প্রভাব, ব্যক্তিসত্বা বনাম গোষ্ঠীসত্বা, ইত্যাদি।
এশীয় নারীবাদ বা থার্ড ওয়াল্র্ড ফেমিনিজ্ম-এর বৈশিষ্ট্য
হল যে, সেখানে নারী অবদমনের সূত্রগুলির মধ্যে বর্ণভেদ
(race), জাত বা শ্রেণীভেদ (caste/class), যৌনতা (sexuality),
সাম্রাজ্যবাদ (imperialism), লিঙ্গভেদ (gender) এবং
সরকারের ভূমিকা - সবকিছুই পড়ে।
বহু এশীয় সমাজে
নারীদের হীনাবস্থার মূলে রয়েছে ঐতিহ্য, সামন্ততন্ত্র,
ঔপনিবেশিকতা এবং পুরুষকেন্দ্রিক সমাজ ও পরিবারে ক্ষমতার
সুস্পষ্ট স্তরভেদ বা 'হায়ারার্কি'। ফলে প্রথম দিকে
নারীবাদীদের চেষ্টা ছিল মেয়েদের এই হীনাবস্থা থেকে
মুক্ত করা। অন্যপক্ষে ৭০ ও ৮০ দশকের নারীবাদী আন্দোলনের
লক্ষ্য ছিল নারীমুক্তি ও ক্ষমতায়ন এবং নারীদের রাষ্ট্রীয়
রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসা। এশিয়ার নারীবাদী ঐতিহ্য
প্রধানতঃ উচ্চশ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল - সমাজের
আলোকপ্রাপ্ত নারীরা এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। কিন্তু
দারিদ্রের পরিপ্রেক্ষিতে নারীবাদীরা মাক্র্সবাদের
প্রতি আকৃষ্ট হয়। প্রসঙ্গতঃ নারীবাদ সংক্রান্ত আলোচনা
ও কাজকর্ম মূলতঃ এনজিওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল - শিক্ষা
প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত - তাদের ভূমিকা ছিল
নগণ্য।
পূর্ব এশিয়া - জাপান, কোরিয়া ও চীন:
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের
পর জাপানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি এবং
কোরিয়ার যুদ্ধের পর দ্রুত শিল্পায়ন এই দুটি দেশের
নারী আন্দোলনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। জাপানের
নারীবাদীরা উনবিংশ শতাব্দীতে তাদের দুর্দশা দূর করার
জন্য যে সঙঘবদ্ধতা অর্জন করেছিল, সেটাকে কাজে লাগিয়ে
এই বৈদেশিক অবস্থানের বিরুদ্ধে আন্দোলন সুরু করে এবং
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলিকে তুলে নিতে বাধ্য
করে। একই সঙ্গে এই নারী সংস্থাগুলি দেশের স্বাস্থ্য
ব্যবস্থার উন্নতি, প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের সংস্থান
এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধাগুলির সুনিশ্চিত করতে সচেষ্ট
হয়। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে কোরিয়া ও জাপানের নারীরা
শ্রমিকের কাজ নিতে সুরু করে এবং ১৯৫৬ সালে জাপানে
প্রথম নারী শ্রমিক সংস্থা (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতিষ্ঠিত
হয়। তা সত্বেও মেয়েদের কাজ বাইরে (pro-work) না সন্তানপালনে
(pro-motherhood) - এই দুই চিন্তাধারা জাপানের নারীবাদী
আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করে। নব্বই দশকের প্রথম দিকে
নারীরা আবার সঙঘবদ্ধ হয়ে সরকারকে বাধ্য করে পার্ট-টাইম
কর্মীদের চাকরীর সুরক্ষা করতে এবং কর্মী মায়েদের সুযোগ-সুবিধা
দিতে। এগুলির পরে জাপানী নারীবাদী সংস্থা বেশ্যাবৃত্তি,
নারীপাচার, যৌনকেন্দ্রিক ভ্রমণ (sex tourism), প্রজনন
অধিকার (reproductive right) ও নারী-নির্যাতনের ব্যাপারে
আত্মনিয়োগ করেছে।
কোরিয়াতে নারীশ্রমিকদের
আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।
১৯৮৩ খ্রীষ্টাব্দে কোরিয়ার নারীরা সরকারের উপর চাপ
দিয়ে নারীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য একটি বিশেষ
সংস্থা, কোরিয়ান উইমেন'স ডেভালপমেণ্ট ইনস্টিটু্যট,
তৈরি করায়। নব্বই দশকের প্রথম দিকে নারীদের উদ্যোগে
শ্রম সংক্রান্ত ব্যাপারে নারী-পুরুষের সমানাধিকার
আইন গৃহীত হয়। জাপান ও কোরিয়া দুই দেশেই রাজনৈতিক
ব্যাপারে নারীদের প্রভাব উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে।
চীনদেশের নারীবাদের
সূচনা উনবিংশ শতাব্দীতেই হয়েছিল। সেই সময়ে বহু নারী
স্বাধীন ভাবে কাজকর্ম করা জন্য বিয়ে করতে অস্বীকৃত
হয়। বিপলবের পর পঞ্চাশ দশকে কমিউনিস্ট সরকার বিবাহ
ও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে সমান অধিকার দিয়ে নারীদের
বাইরের কর্মজগতে যোগ দেবার আহবান জানালো। বহু নারী
সংস্থার সৃষ্টি হল, যাদের বেশির ভাগই ছিল সরকারী নিয়ন্ত্রণে।
এ সব সত্বেও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে চীন সরকারের এক-সন্তান
নীতি নারীদের প্রতি অত্যাচার বৃদ্ধির কারণ হয় এবং
লিঙ্গ-ভিত্তিক গর্ভপাত ভয়াবহ আকার নেয়। মাও যুগের
পরে অত্যাধিক কনসিউমারিজ্ম এবং ব্যাপক বেকারত্ব, চাকরীর
বাজারে মেয়েদের কোনঠাসা করে এবং সংসারে তাদের চিরকালীন
ভূমিকা পালনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া - ইন্দোমেশিয়া, মালয়শিয়া, সিঙ্গাপুর
এবং ভিয়েত্নাম:
বিশ্বায়নের ফলে
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষিত
শহুরে চাকুরিজীবি নারীর একটি নূতন দল সৃষ্টি হয়। এদের
আর্থিক সঙ্গতি এবং রাজনৈতিক জগতে এদের প্রভাব থাকার
ফলে এই দেশগুলিতে নারী-পুরুষের যেসব বৈষম্য ছিল -
সেগুলি নূতন ভাবে দেখা শুরু হয়। কিন্তু বিশ্বায়নে
পাশ্চাত্য দেশগুলির সঙ্গে এদের প্রচুর যোগাযোগ থাকলেও
পাশ্চাত্য নারীবাদের পথ অনুসরণ না করে এরা নিজেদের
সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের নারীবাদকে প্রতিষ্ঠা
করে। যেমন, মালয়েশিয়াতে নারী-প্রতিষ্ঠান 'সিস্টার্স
ইন ইসলাম' (১৯৮৮ খ্রী) মুসলমান ধর্মের ভেতরেই নারীদের
অধিকার ও দাবিদাওয়ার উত্তর খোঁজে।
বিংশ শতাব্দীর
৮০ দশক থেকেই দক্ষিণ এশিয় নারীবাদীরা গৃহভৃত্যদের
ও বহুজাগতিক সংস্থায় কর্মরতা শ্রমিকদের কাজের আবহাওয়া
নিয়ে, পারিবারিক নির্যাতন, বহু-বিবাহ, শিক্ষাক্ষেত্রে
বৈষম্য ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে থাকে। ফিলিপিনসে
অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটিগুলিকে
সরানোর জন্য ঐদেশের নারীবাদীরা সক্রিয় ভূমিকা নেয়।
থাইল্যাণ্ডের নারীবাদীরা তাদের শক্তির অনেকাংশই ব্যয়িত
হয় বেশ্যাবৃত্তি নিরোধ এবং নারী পাচারের বিরুদ্ধে
আন্দোলনে।
ভিয়েত্নামের
নারী আন্দোলনের ঐতিহ্যের শুরু ৪০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে
- যখন দুই ট্রুং ভগ্নী আক্রমণকারী চীনা সৈন্যদলকে
শুধু একদল নারী-সৈন্য নিয়ে বাধা দিয়েছিলেন। অষ্টাদশ
শতাব্দীতে বুই থি উয়ান নামে এক নারী চাষী-আন্দোলনের
পুরোধায় ছিলেন। আধুনিক যুগে ভিয়েত্নামে প্রথম নারী
সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে। ১৯৪০ খ্রীষ্টাব্দে
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিপ্লবে, ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৩ খ্রীষ্টাব্দে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং ১৯৭৮
ও ১৯৭৯ খ্রীষ্টাব্দে কাম্বোডিয়া ও চীনের আক্রমণ রুখতে
ভিয়েত্নামের নারীর অবদান যথেষ্ট। ভিয়েত্নামের কমিউনিস্ট
সরকার নারীদের অধিকার-সংক্রান্ত দাবি-দাওয়াকে অগ্রাধিকার
দিয়েছে এবং নারীদের উপর সমাজের চাপ (পুরুষ ও সামন্ততান্ত্রিক
নিয়ন্ত্রণ) খর্ব করার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। এতগুলি যুদ্ধের
পর দেশের উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা যে অতি-অবশ্য সেটি
সরকার বুঝতে পেরে নারী-শ্রমিকদের (বিশেষ করে শ্রমিক
মায়েদের) সুবিধার্থে নানান আইন প্রণয়ন করেছে।
মধ্য এশিয়া - উজবেকিস্তান, কির্গিজ্স্থান এবং কাজাক্স্থান:
আশি দশকে সোভিয়েত্
রাজ্যগুলি বিভক্ত হবার পর, মধ্য এশিয়ার দেশগুলি স্বাধীন
রাজ্যে পরিণত হয় এবং নতুন ভাবে তাদের সরকারী নীতিগুলি
প্রতিষ্ঠা করে। এই সামাজিক-রাজনৈতিক অভু্যত্থানে নারীদের
যেসব অধিকার সোভিয়েত জমানায় স্বীকৃত ছিল, সেগুলি নিয়ে
অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। অবশ্য কমিউনিস্ট রাজত্বেও এই
অঞ্চলগুলির সংস্কৃতিতে মুসলমান ধর্মের প্রভাব বর্তমান
ছিল। স্বাধীন হবার পর ধর্মের অনুশাসনগুলি নতুন ভাবে
নারীদের উপর চাপানোর চেষ্টা শুরু হল। পর্দা-প্রথা
আবার ফিরে আসতে শুরু করল। সোভিয়েত সরকারও নারীবাদকে
বিভেদ-সূচক বলে মনে করত, সেই মানসিকতা এই নতুন দেশগুলিতেও
পুরোমাত্রায় রয়ে গেল। নারী অন্দোলন যখন নারী-নির্যাতন,
প্রজনন অধিকার, যৌনতা এবং লিঙ্গ-বৈষম্য নিয়ে ব্যস্ত,
তখন এইসব দেশের রাজনৈতিক জগতে তাদের প্রতিনিধিত্ব
কমছে।
দক্ষিণ এশিয়া - বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা
ও নেপাল:
দক্ষিণ এশিয়ার
নারীবাদ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যদিও
এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একাধিক নারীর অবদান
ইতিহাসে স্বীকৃতি পেয়েছে, কিন্তু সঙঘবদ্ধ ভাবে নারীরা
যোগদান করে স্বাধীনতা আন্দোলনে। স্বাধীনতার পরে বেশ
কয়েকটি শক্তিশালী নারী-প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেমন,
'বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ' (১৯৭০ খ্রী), 'ন্যাশেনাল ফেডারেশন
অফ ইণ্ডিয়ান উইমেন' (১৯৫৪ খ্রী), 'উইমেন'স্ অ্যাকশন
ফোরাম ইন পাকিস্তান' (১৯৮১), 'উইমেন'স্ ফাউণ্ডেশন
অফ নেপাল' (১৯৮৮ খ্রী), এবং 'ভয়েস অফ উইমেন ইন শ্রীলঙ্কা'
(১৯৭৮ খ্রী)। এই প্রতিষ্ঠানগুলি অন্যান্য নারীসংস্থার
সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকারের নারীদের প্রতি বৈষম্য-মূলক
নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তাদের স্বার্থ-রক্ষার্থে
প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নে সাহায্য করে যাচ্ছে। যদিও এই
সংস্থাগুলি পাশ্চাত্য নারীবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত,
কিন্তু এদের মতাদর্শ দেশের সংস্কৃতিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে।
এ অঞ্চলের নারীবাদীরা সক্রিয় হয়েছে রাজনৈতিক মঞ্চে
নারীদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে, নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে,
নারী-নির্যাতন রোধে এবং সামগ্রিক ভাবে নারীদের অবস্থার
উন্নতিতে। যদিও অনেক অঞ্চলেই এই সংস্থাগুলিকে কাজ
করতে হচ্ছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, গৃহযুদ্ধ, সামরিক
অভু্যত্থান, মৌলবাদ, দারিদ্র ইত্যাদির মধ্যে, তা সত্বেও
দক্ষিণ এশিয়ার নারী-সংস্থাগুলি খুবই সজীব এবং জোরদার
ভাবে নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।