প্রথম পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
নভেম্বর ১৫, ২০১৪
আপনার মাঝে
চিত্তরঞ্জন দাস
[ লেখক পরিচিতি : দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের ৫ই নভেম্বর (২২শে কার্তিক, ১২৭৭ বঙ্গাব্দ) কলকাতার পটলডাঙ্গা স্ট্রীটে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ভূবনমোহন দাশ ও মা নিস্তারিণী দেবী। পৈতৃক নিবাস ছিল বিক্রমপুর (ঢাকা) তেলিরবাগ গ্রামে। গ্রামে দাশ পরিবার পরোপকার ও দানশীলতার জন্য খ্যাত ছিলেন।
চিত্তরঞ্জন ১৬ বছর বয়সে ভবানীপুর লণ্ডন মিশনারী স্কুল থেকে ১৮৮৬ সালে এনট্রান্স পরীক্ষা এবং পরে ১৮৮৮-তে এফ.এ. ও ১৮৯০-এ বি.এ. পাশ করেন। সিভিল সার্ভিস পড়তে বাবা মা তাকে বিলেত পাঠান। ১৮৯২ সালে কিছু পরীক্ষা দিয়ে পরে আর পরীক্ষায় বসেন নি; কিন্তু ১৮৯২-তে আবার পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই সময়ে ভারতবর্ষের নেতা দাদাভাই নৌরজী পার্লামেণ্টের সদস্য হবার চেষ্টা করলে লর্ড সেলিসব্যারী তাকে 'কালা আদমি' নামে অভিহিত করলে চিত্তরঞ্জন নৌরজীর সমর্থনে নানা স্থানে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। নৌরজী সেবার সেলিসব্যারীকে হারিয়ে জয়লাভ করেন। তবে চিত্তরঞ্জনকে এর ফল ভোগ করতে হয়েছিল। তিনি ১৮৯৩ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তের্ণ হলেও চাকরী পান নি। তার স্থান ছিল ৪৩ নম্বরে; ৪২ জন চাকরী পেলেও তিনি পান নি। ব্যারিস্টার হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৮৯৭ সালে চিত্তরঞ্জন বাসন্তী দেবীকে বিয়ে করেন। বাসন্তী দেবী এক অসাধারণ মহিলা ছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাকে মা-এর মত শ্রদ্ধা করতেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ছিলেন দেশবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা অপর্ণা দেবীর পুত্র। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর মাত্র এক বছর পরেই তার একমাত্র পুত্র চিররঞ্জন দাশের মৃত্যু হয়।
প্রেসিডেন্সি কলেজেই চিত্তরঞ্জন সুরেন্দ্রনাথের স্থাপিত স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। ব্যারিস্টার হিসাবে তিনি বহু রাজনৈতিক মামলায় অংশ গ্রহণ করেছেন। 'বন্দেমাতরম' ও 'সন্ধ্যা' মোকদ্দমায় কৃতকার্য হয়ে তিনি আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় বারীন ঘোষ ও অরবিন্দের পক্ষ সমর্থন করেন। একের পর এক মামলায় জয়লাভ করে তিনি প্রভূত যশ ও অর্থের অধিকারী হন। ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে মা নিস্তারিণী দেবী ও ১৯১৪-এর জুন মাসে বাবা পরলোক গমন করলে চিত্তরঞ্জনের মনে ধর্মভাব প্রবল হয়ে ওঠে। ১৯১৪-এর নভেম্বর মাসেই তিনি 'নারায়ণ' মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং নিজের বিভিন্ন লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন। ইচ্ছা ছিল সাহিত্যসেবাতেই আত্মনিয়োগ করবেন কিন্তু সেটা হয়ে ওঠে নি তার গভীর দেশপ্রেমের জন্য। ১৯১৩ সালে শ্রীঅরবিন্দ পণ্ডিচেরীতে স্বেচ্ছায় নির্জনবাসে চলে যান এবং সাময়িক ভাবে আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দান গ্রহণ করবেন না জেনে, চিত্তরঞ্জন তার নিজের রচিত কবিতার বই 'সাগর সংগীত' অরবিন্দকে ইংরাজীতে অনুবাদ করার পরিবর্তে এক হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য করেন।
১৯১৭ সালে চিত্তরঞ্জন প্রাদেশিক রাজনৈতিক সম্মেলনের সভাপতি হন, ১৯১৮-১৯ সালে তিনিই হন কংগ্রেসের প্রধান নেতা। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি একাদিক্রমে ৩/৪ মাস পাঞ্জাবে থেকে স্থানীয় লোকদের সহায়তা করেন। ১৯২০ সালে নাগপুর কংগ্রেসে মাসিক প্রায় ৬০ হাজার টাকার আইন ব্যবসা ত্যাগ করে দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯২১ সালের ১৭ই নভেম্বর ইংল্যাণ্ডের যুবরাজের (প্রিন্স ওফ ওয়েলস) ভারতে আগমন উপলক্ষ্যে সমগ্র বাংলায় হরতাল পালিত হয়; সরকার আইন প্রবর্তন করে এই কার্যকলাপ বন্ধ করার প্রচেষ্টা করলে, চিত্তরঞ্জন সত্যাগ্রহ করেন এবং ১৬০০০ লোক সহ তিনি নিজেও কারাবরণ করেন। ছাত্রদের তিনি বিশ্ববিদ্যালয় নামক গোলামখানা ত্যাগের পরামর্শ দেন। শিক্ষা সম্বন্ধে তার বক্তব্য ছিল - "পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানই শিক্ষার বিশিষ্ট কার্য্য। " ছাত্রদের তিনি বলতেন যে শিক্ষা মানুষের সেবাকে এবং দেশপ্রেমকে গুরুত্ব দেয় না, সে শিক্ষা শিক্ষাই নয়।
আইন অমান্য আন্দোলনের সময় তিনি নিজ পত্নী বাসন্তী দেবী ও ভগ্নি ঊর্মিলা দেবীকে কারাবরণ করতে আদেশ দেন। সম্ভবতঃ সেটাই প্রথম মহিলাদের সত্যাগ্রহে অংশ নেওয়া। ১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন নিজেই আইন অমান্য করে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেও সভায় অনুপস্থিত থাকেন। ১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত লালা লাজপৎ রাই-এর সভাপতিত্বে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের একটি বিশেষ অধিবেশনে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা করলে, চিত্তরঞ্জন কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব দেন, কিন্তু সেগুলি মানা হয় নি। বিপিনচন্দ্র পাল, মদন মোহন মালব্য, জিন্না এবং মিসেস অ্যানি বেসান্ত চিত্তরঞ্জনের পক্ষেই ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে গান্ধীজির সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি কংগ্রেস ছেড়ে 'স্বরাজ্য দল' গঠন করেন এবং জনমত গঠন করতে সচেষ্ট হন। নেতৃত্বে ছিলেন মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন। ভারতে এই দল একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২৪ সালে সরকার বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স জারি ক'রে সুভাষচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ নেতাদের গ্রেপ্তার করলে , গান্ধীজি বুঝতে পারেন যে সরকার স্বরাজ্য দলকে দমন করার মীতি গ্রহণ করেছে। এরপর গান্ধীজি স্বরাজ্য দলকে পূর্ণ সমর্থন যোগান। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন কলকাতার প্রথম মেয়র হন। পরপর দু'বার তিনি এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমে চিত্তরঞ্জনের শরীর ভেঙে পড়ে। কার্যোপলক্ষে ফরিদপুরে গিয়েছিলেন; সেখান থেকে ফিরেই তিনি দার্জিলিং-এ চলে যান। সেখানে মহাত্মা গান্ধী চিত্তরঞ্জনের আবাস 'স্টেপ অ্যাসাইডে' ৫ দিন ছিলেন এবং দেশের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। অসাধারণ ত্যাগ ও স্বদেশ প্রীতির জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে 'দেশবন্ধু' নামে খ্যাত হন। দার্জিলিং থেকে দেশবন্ধু আর কলকাতায় ফেরেন নি। সেখানেই ১৯২৫ সালের ১৬ই জুন ৫৫ বছর বয়সে দেশবন্ধু পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি তার পৈতৃক বসত বাটি জনসাধারণকে দান করে যান। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় তারই নামে 'চিত্তরঞ্জন সেবাসদন'। তার মরদেহ ট্রেনে করে কলকাতায় আনা হলে দুমাইল দীর্ঘ শোকমিছিলে মহিলা সহ প্রায় তিন লক্ষ লোক যোগদান করেন এবং মহাত্মা গান্ধী ছিলেন মিছিলের পুরোভাগে। কলকাতার সেন্ট্রাল এভেনিউর নাম পরিবর্তন করে তারই নামে চিত্তরঞ্জন এভেনিউ রাখা হয়। দিল্লিতে চিত্তরঞ্জন পার্ক এবং তৎসন্নিহিত হাসপাতাল চিত্তরঞ্জন ভবন তারই নাম বহন করছে। ১৯৬৫ সালের ৫ই নভেম্বর দেশবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ভারত সরকারের ডাক ও তার বিভাগ তার স্মরণে একটি স্মারক ডাক টিকিট চালু করে। ১৯৯৮ সালে তার নামাঙ্কিত একটি মুদ্রাও বাজারে ছাড়া হয়।
রাজনীতির মত সাহিত্য ক্ষেত্রেও চিত্তরঞ্জনের উৎসাহ ও অনুরাগ ছিল প্রবল। তিনি বলেছেন "আমি আজীবন সাহিত্য-সেবার চেষ্টা করিয়াছি। " তবে সমাজ সেবা ও দেশের অন্যান্য কাজে যথেষ্ট সময় ও শক্তি ব্যয় করেছেন বলে সাহিত্যের ক্ষেত্রে সে ভাবে মনোনিবেশ করতে পারেন নি। তিনি সব কাজকেই অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত মনে করতেন, বিচ্ছিন্ন ভাবে ভাবতেন না। তিনি বলতেন- "জীবনের প্রত্যেক অংশ তো কবুতরের খোপের মত পৃথক করিয়া ভাগ কর যায় না, সবই যে একই ভাবের ভিন্ন ভিন্ন ধারা। " মৃত্যুর দেড় মাস আগে স্বর্গীয় মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর তৈলচিত্র আবরণ ইন্মোচন সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। সেখানে উপস্থিত সাহিত্যিকগণকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন- "আপনারা রাজনীতি ক্ষেত্রে আসিতে পারেন নাই বলিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ক্ষোভের কোন কারণ নাই। আমিও সাহিত্য সেবায় জীবনাতিবাহিত করিব বলিয়া ঠিক করিয়াছিলাম, ঘটনাচক্রে এক্ষেত্রে আসিয়া পড়িয়াছি। নতুবা সেই পথই অবলম্বিত হইত। কিন্তু অনুশোচনা তজ্জন্য নয়, অনুশোচনা যদি ষোল আনা ভাবে আত্মনিয়োগ না করা যায়। আমি যখনই যাহা করিয়াছি, ষোল আনা ভাবেই করিয়াছি। আপনারাও সাহিত্য-সেবা ষোল আনা ভাবেই করুন, আপনারাও নিশ্চিত ফল লাভ করিবেন। "
চিত্তরঞ্জনের সব চেয়ে প্রিয় লেখক ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র। 'কমলাকান্ত' ছিল তার সম্পূর্ণ মুখস্থ। ইংরাজি সাহিত্যে ব্রাউনিংকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন। এছাড়া সুইনবার্ণ, এমার্সন ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের রচনাও তার খুব ভাল লাগত।
চিত্তরঞ্জন ব্রাহ্ম পরিবারের ছেলে হলেও একান্নবর্তী পরিবারে বাস করার ফলে হিন্দু আচার আচরণের সঙ্গেও গভীর ভাবে পরিচিত ছিলেন। তিনি খোলাখুলিভাবে ব্রাহ্ম সমাজের দোষত্রুটির সমালোচনা করতেন। তিনি মনে করতেন ব্রাহ্ম প্রচারকগণ মনে মুখে এক নহেন। এতে ব্রাহ্মগণ তার প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠেন। চিত্তরঞ্জনের রচিত কবিতাও কুরুচিপূর্ণ বলে ব্রাহ্মরা মনে করতেন। বিশেষত তার 'বারবিলাসিনী' কবিতা অত্যন্ত কুৎসিত বলে সমালোচিত হয়। কবিতাটির কিছু অংশ-
রঞ্জিয়াছি অধর আমার
কোমল বিচিত্র রাগে
আমার অধরে জাগে
রক্ত আভা; কেশে পুষ্পসার -
চঞ্চল কুন্তলে - মধু পুষ্পসার
রমণীর অধর আমার!
এসো পান্থ! ভ্রমিয়া ধরণী
হেথা আজ আঁধিরা রজনী
অবগাহ প্রেমে মোর আজি এ রজনী
এলে পান্থ ভ্রমিয়া ধরণী! ... ইত্যাদি।
ব্রাউনিং-এর One word more কবিতাটিকে তিনি অত্যন্ত প্রশংসা করতেন। তার মতে এ রকম প্রেমের কবিতা জগতে বিরল। টমাস হুডের Bridge of sighs, চার্লস ডিকেন্সের Threatening letter to a young man ইত্যাদি রচনা তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল।
দেশবন্ধুর ধর্মমত ছিল অতি বিচিত্র। ব্রাহ্ম থেকে শাক্ত, বৈদান্তিক, বৈষ্ণব সব ধর্মমতের দ্বারাই তিনি কোন না কোন সময়ে আকৃষ্ট হযেছেন। কিন্তু শেষে তিনি বৈষ্ণব মতেরই অনুবর্তী হন। চিত্তরঞ্জন বলেছেন -"বৈষ্ণব ধর্ম খুব ভাল লাগে, কেন না এই ধর্ম্মে ভাবে ধ্যানে ও কার্য্যে অনেক স্বাধীনতা আছে। অন্যান্য ধর্ম্ম নিজ নিজ মুক্তির জন্য ব্যস্ত, কিন্তু এখানে সকলে একসঙ্গে কাজ করে, কেহই নিজের মুক্তির জন্য ব্যস্ত নয়। " কীর্তন ছিল তার অতি প্রিয়। বৈষ্ণব পদাবলী বিশেষজ্ঞ গণেশ কীর্তনীয়া এবং ভক্ত রামদাস যখন তার বাড়ীতে এসে কীর্তন গাইতেন তখন তিনি প্রায় অর্ধবাহ্য অবস্থায় তা শ্রবণ করতেন। তিনি বলতেন -"কেহ অপরাধ নিবেন না; আমি কীর্ত্তনের পর কথা বলতে কষ্ট বোধ করি। "
দুঃখের এবং আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্রনাথের কবিতা চিত্তরঞ্জনের ভাল লাগে নি। ভাষা ও ভাবের কাব্যিক সংমিশ্রণ এবং বিষয়বস্তুর অন্তর্নিহিত অর্থের অব্যক্ত প্রকাশ হয় ত চিত্তরঞ্জনের কাছে স্পষ্টতার অভাব বলে মনে হয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথকে ইঙ্গিত করে বলেছেন -"আজকালকার কবিতা পড়লে মনে হয় যেন আমাদের ভাব, ভাষা, অন্য প্রকারের। আমরা প্রত্যেক কথাই এমন ঘুরাইয়া বলি যে সাধাসিধে লোক বুঝিতে পারে না। আমাদের ছন্দের এখন সাপের মতন বক্রগতি। তার ঝঙ্কারে এত প্রকার রাগ-রাগিণী আলাপ থাকে যে, যাহার যথেষ্ট সুরবোধ আছে সে ভাব বেচারাকে একেবারেই আমল দেয় না, আর যে হতভাগ্যের একেবারেই সুরবোধ নাই সে অনেক চেষ্টা করিয়াও পড়িতে পারে না। " তবে এই মনোভাব কখনও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে চিত্তরঞ্জনের মনে শ্রদ্ধার অভাব ঘটায় নি। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতির অভিভাষণে তিনি কবিগুরুর প্রতি সশ্রদ্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছেন। আর চিত্তরঞ্জনের প্রয়াণে রবীন্দ্রনাথ সেই বিখ্যাত দুই ছত্রে -
'এনেছিলে সাথে করি মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান। '
দেশবন্ধুর ত্যাগ ও দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেছেন।
চিত্তরঞ্জন যথেষ্ট সাহিত্যানুরাগী হলেও নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সাহিত্যকর্মে মন দিতে পারেন নি। দেশের কাজে তিনি নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। এ কারণে তার প্রকাশিত রচনার সংখ্যা খুব বেশী নয়।
চিত্তরঞ্জনের রচনা : কাব্য - 'মালঞ্চ' (১৮৯৬) ; 'মালা' (১৯০২ থেকে ১৯০৯ খ্রীষ্টাব্দে রচিত) ; 'সাগর সঙ্গীত' (১৯১০-এ রচিত এবং ১৯১৩-তে প্রকাশিত) ; 'অন্তর্য্যামী (১৯১৪-তে ঐনারায়ণ' পত্রিকায় প্রকাশিত) ; 'কিশোর কিশোরী' (১৯১৫-তে 'নারায়ণে' প্রকাশিত)। শেষ দুটি রচনা পরে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়। গল্প - "ডালিম' (১৯১৪-তে 'নারায়ণে' প্রকাশিত) ; 'প্রাণপ্রতিষ্ঠা' (১৯১৫-তে 'নারায়ণে' প্রকাশিত)। প্রবন্ধ - 'কবিতার কথা' (১৩২১ 'নারায়ণে'র ফাল্গুন সংখ্যা) ; 'বাংলার গীতি কবিতা' (১৩২৩ 'নারায়নে'র পৌষ সংখ্যা) ; 'বিক্রমপুরের কথা' (১৯১৬, বিক্রমপুর সম্মিলনীর সভাপতির ভাষণে পঠিত) ; 'বাঙ্গলার কথা' (১৯১৭ মে, প্রাদেশিক সম্মিলনীর সভাপতির অভিভাষণ) ; 'বাঙ্গলার গীতি কবিতা' (২য় ভাগ) (১৩২৪, অগ্রহায়ণ) ; 'বৈষ্ণব কবিতা' (১৯১৭, উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ১০ম অধিবেশনে পঠিত, ১৩২৪ পৌষে মুদ্রিত) ; 'স্বাগত' (১৯১৮, ঢাকার বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণ; ১৩২৫ বৈশাখে মুদ্রিত) 'বাঙ্গলার গীতি কবিতা' (৩য় ভাগ) (১৯১৮, গিরিজাশঙ্কর রায় কর্তৃক ১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত। প্রবন্ধটির বিশেষ নাম 'শক্তি-সাহিত্য ধারায রামপ্রসাদ') ; 'বঙ্কিম সাহিত্য' (১৯২৪, কাঁঠালপাড়ার সাহিত্য-সভায় সভাপতির অভিভাষণ)।
চিত্তরঞ্জনের সাহিত্য প্রীতি ও তার আর্থিক উদারতার একটি পরিচয় পাওয়া যায় কয়েকটি মাসিক পত্রিকার দুঃসময়ে তার সাহায্য দানে। তার নিজের সম্পাদিত 'নারায়ণ' পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করা ছাড়াও বিভিন্ন পত্রিকায় তার সাহায্য দান সম্বন্ধে জানা যায় অধ্যাপক কৃষ্ণবিহারী গুপ্তর লেখা থেকে। কৃষ্ণবিহারী লিখেছেন -"মানসী পত্রিকা বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য তিনি নিয়মিত অর্থ সাহায্য করিতেন। যে কয়জন উদ্যমশীল সাহিত্য-রসিক যুবক নিজেদের মধ্যে চাঁদা করিয়া 'মানসী' পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করিতেন তাহাদের কাহারই অর্থস্বচ্ছলতা বেশী ছিল না। অধুনালুপ্ত হপশিং কোম্পানীর দ্বিতলের একটি ঘরে ইহার কার্য্যালয় ছিল। চিত্তরঞ্জন মাসে মাসে ৫০ টাকা করিয়া 'মানসী'র জন্য দিতেন, তা ছাড়া এককালীন বেশী টাকাও দান করিয়াছেন। একবার ম্যানেজার যতীন্দ্রনাথ বসু মহাশয় 'মানসী'র জন্য দুই হাজার টাকা আনিয়াছেন, তখন ইহা ঋণ বলিয়াই লওয়া হইয়াছিল, কিন্তু এ ঋণ আর শোধ করা হয় নাই। এই 'মানসী' ও 'মর্ম্মবাণী' সম্মিলিত হইয়া নাটোরের মহারাজা স্বর্গীয় জগদীন্দ্রনাথ রায় কর্ত্তৃক সম্পাদিত হইত। অধুনা ইহা বিলুপ্ত।
'সাহিত্য' পত্রিকাকে ঋণ হইতে বাঁচাইবার জন্য তিনি যথেষ্ট সহায়তা করিয়াছিলেন। আর একখানি মাসিক পত্রিকা 'নির্ম্মাল্য' মনোহরপুকুর রোডস্থ একটি বাড়ী হইতে রাজেন্দ্রলাল বিদ্যাবিনোদ কর্ত্তৃক সম্পাদিত হইত। 'নির্ম্মাল্য'-এ চিত্তরঞ্জনের অনেক কবিতা বাহির হইয়াছিল। এই মাসিক পত্রিকা পরিচালনের আবশ্যিক খরচ চিত্তরঞ্জনই বহন করিতেন এবং সাহিত্যসেবী রাজেনবাবুকেও নানা ভাবে সাহায্য করিয়াছেন। .... " মৃত্যুর কিছু পূর্বে তিনি বলেছিলেন কযদি পাঁচ বৎসর বাঁচি তা হলে দুবৎসর যা করচি তাই করব, বাকী তিন বৎসর গঙ্গাতীরে সাহিত্য সাধনায কাটাব। ও
সানগ্রিকভাবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জীবন ছিল অসাধারণ কর্মব্যস্ততা ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তার যে বিষয় সম্বন্ধে যা মনে হয়েছে তিনি তা স্পষ্টভাবে বলতে কখনও কুণ্ঠিত হন নি। এ নিয়ে তাকে অনেক নিন্দাবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। পরিশেষে সুভাষ চন্দ্র বসুর একটি মন্তব্য দিয়ে উপসংহার টানা যাক। সুভাষ চন্দ্র বলেছেন -"দেশবন্ধুর জীবনই একখানি মহাকাব্য। " ]
দীপক সেনগুপ্ত।
১
ওরে পাখী! সন্ধ্যা হ'লো আয়রে কুলায়,
সমস্ত গগন ভরে'
আঁধার পড়িছে ঝরে'
ওরে পাখী! অন্ধকার! নীড়ে ফিরে আয়!
বন্ধ কর পাখা তোর - আয়রে কুলায়!
যতক্ষন আলো ছিল মেটে নি কি আশ?
ওরে সারাদিনমান
তুই করেছিস পান
যত মধু ছিল ভরি' ধরণী আকাশ!
এবে আলো সাঙ্গ হ'লো - মেটেনি পিয়াস?
ওরে আয়! ফিরে আয়! আপনার মাঝে!
ওরে বন্ধ কর পাখা,
অপূর্ব্ব-আলোক মাখা
অনন্ত গগনতল, হেথায় বিরাজে!
২
ভয় নাই ভয় নাই, রে আমার মন!
এ যে শুধু ক্ষণিকের মোহ অন্ধকার!
আবৃত অন্তরে তোর জ্যোতিঃ চিরন্তন
ডুব দে ডুব দে তবে আপন মাঝার।
সিক্ত কর ওরে পাখী পক্ষদুটি তোর,
আপন আনন্দভরা আত্মার আলোকে।
আপনারি জ্ঞানে হয়ে আপনি বিভোর
অন্তর-গগনতলে উড়িস পুলকে।
ব্রহ্মাণ্ডে পড়িবে তোর চরণের ছায়া,
বাসনা বিলুপ্ত হবে আত্মার মাঝারে!
দুই হাতে ছিন্ন করি শত মিথ্যা মায়া
আপনার মহিমার দুন্দুভি বাজারে!
ভয় নাই ভয় নাই রে আমার হিয়া!
মুহূর্ত্তে ভ্রান্তি শুধু আনিছে আঁধার;
জীবনের জ্যোতির্ম্ময় প্রদীপ ধরিয়া,
দেখারে আপন পথ আপন মাঝার।
৩
তবু যে তরাসে কাঁপে শ্রান্ত হিয়াখানি
আপনার অন্তরের পথ নাহি জানি।
সম্মুখে পশ্চাতে তার,
অন্তহীন অন্ধকার
ঘিরিছে সতত তারে শত আবরণে
এই ঘোর অন্তরের অন্ধকার বনে।
ভয় নাই, ওরে মন! কররে নির্ভর
অন্ধকারাক্রান্ত এই আপনারি 'পর।
এই যে আঁধার রাজি
নয়ন ভরিছে আজি,
এরি মাঝে পাবি তুই আত্ম-পরিচয়,
মুহূর্ত্তের ভ্রান্তি শুধু আর কিছু নয।
( ‘মানসী’ পত্রিকা, ভাদ্র ১৩১৭ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|