পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
নভেম্বর ১৫, ২০১৪
পূর্ণিমা
মণীন্দ্রলাল বসু
[ লেখক পরিচিতি : মণীন্দ্রলাল বসু ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে চাংড়িপোতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রবোধচন্দ্র বসু ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট জজ। চাংড়িপোতায় জন্ম হলেও মণীন্দ্রলাল পরে স্থায়ীভাবে কলকাতার ঝামাপুকুরে বাস করেছেন। ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে ম্যাট্রিক পাশ করে বিলেতে যান এবং ১৯৩০ থেকে হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন। আইন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেও তার প্রিয় বিষয় ছিল সাহিত্য। ‘রমলা’; ‘মায়াপুরী’; ‘রক্তকমল’; ‘সোনার কাঠি’; ‘অজয়কুমার’ ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। গল্প, উপন্যাস, ছোটদের রচনা নিয়ে প্রায় ১২টি গ্রন্থ রচনা করেছেন মণীন্দ্রনাথ। ]
দীপক সেনগুপ্ত।
কলিকাতার এক পুরানো পাড়া। সরু গলি যেখানে প্রশস্ততর পথে আসিয়া পড়িয়াছে, সেই মোড়ে একটি ছোট মনোহারী দোকান - খুকীর চুষিকাঠি, পুতুল; খোকনের ইঞ্জিনগাড়ী, লজনচুষ; খোকার মায়ের পযের তরল আলতা, চুলের কাঁটা ফিতে, সুগন্ধি সাবান পাউডার; খোকার বাবার সার্টের বোতাম, লেখবার কালী, সিগারেট; স্কুলের ছেলেমেয়েদের পেন্সিল, একসারসাইজ বুক, মার্ব্বেল, ঘুড়ির সুতো, ইত্যাদি সময় অসময়ের দরকারী অ-দরকারী নানাটুকটাক জিনিস আজ কুড়ি বছর ধরিয়া এই দোকানটি পাড়ার পরিবারদের সরবরাহ করিয়া আসিয়াছে। আজকাল পাড়ার কলেজের ছেলেরা সাহেব পাড়ায় মিউনিসিপ্যাল মার্কেটে গিয়া জিনিস কেনে, খোকাদেরও পুরানো ধরনের ইঞ্জিনগাড়ী পছন্দ হয় না, হালফ্যাসানের এরোপ্লেন চাই; কিন্তু পুরাতন বাড়ীগুলির মহিলা-সম্প্রদায় এই দোকানটির ভক্ত; কারণ দরকার হইলেই খালি বিস্কুটের টিন, খালি সাবানের বাক্স শশিবাবুর দোকান হইতে চাইলেই পাওয়া যায়। শশিবাবু দোকানটি মডার্ন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু নিউ মার্কেটের দোকানগুলির মত নানা লোভনীয় দ্রব্যসম্ভারে সুসজ্জিত করিয়া রাখিবার মত অর্থ তাঁহার ছিল না।
ভাদ্রের সুন্দর প্রভাত; ক্ষান্তবর্ষণ রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে শুভ্র লঘু মেঘগুলি কিশোর মনের দিবাস্বপ্নের মত। শরৎ-প্রভাতের শুভ্র আলো গলির পথটি দীপ্ত মায়াময় করিয়া তুলিয়াছে; হলিদে বাড়ীর বালি-ওঠা দেওয়ালে, পথের কালো পিচে, সংসার-সংগ্রাম-পীড়িত নর-নারীর মুখে কোন যাদুমন্ত্র বুলাইয়া দিয়াছে। দোকানের ছোট দরজার ধারে ছোট এক লোহার চেয়ারে বসিয়া যে তরুণ যুবকটি দোকানের বেচাকেনা করিতেছিল, তাহার ইচ্ছা হইতেছিল দোকান বন্ধ করিয়া এই অনির্ব্বচনীয় আলোকজ্জ্বল পথে বাহির হইয়া পড়ে। কাজে মন লাগিতেছিল না।
আট বছরের ছোট মেয়ে, পলাশ ফুলের রংএর খদ্দরের ফ্রক পড়া; দীঘির পাড়ে ব্যাকুল বেণুর মত চঞ্চল সে; তার চোখ ভরা দুষ্টামি, মুখ-ভরা কৌতুক; কচি আমপাতার মত শ্যামশ্রী; স্কিপ করে, সিঁড়ি দিয়ে ছুটে যায়, ছাদে ঘুরি ওড়ান দেখে, তেতুল-লংকা দিয়ে নিষিদ্ধ খাবার খায়, স্কুলের গাড়ী দাঁড় করিয়ে রাখে, নাকে মুখে ভাত গুঁজে বেণী দুলিয়ে ছোটে, বকুনি খায়, কলহাস্যে কথা বলে, গিরি ঝর্ণার মত উদ্দাম উৎসুক উন্মনা।
কিন্তু এক সময় সে শান্ত হয়, গিরি ঝর্ণা যেন সমতল ক্ষেত্রের বিপুলা নদীর মধ্যে কলধ্বনি হারাইয়া স্তব্ধ। তাহার দিদির সম্মুখে সে মৃদু হাসে, হাত পা ছোঁড়ে না, লাফিয়ে লাফিয়ে চলে না; চেঁচিয়ে কথা বলে না, রৌদ্রদীপ্ত নির্বাত মধ্যাহ্ণে নিস্তরঙ্গে নদীজলে বেণুবন যেমন নিষ্কম্পিতভাবে আপনার ছায়া দেখে, তেম্নি চুপ করে সে থাকে দিদির কাছে; তার চোখের চঞ্চল চাউনি স্থির করুণ হইয়া আসে।
এই ছোট মেয়েটিকে পরমেশপ্রসন্নের বড় ভালো লাগে - তাহার চঞ্চল প্রাণময় গতির সরল ভঙ্গী। মেয়েটির নাম যে রাণু, সব সমযে তাহার মনে থাকে না, সে ভুল নামে ডাকে, বেণু বা মীনু। রাণু ঠোট ফুলাইয়া বলে, “যান, আমার নাম আপনার মনে থাকে না, আমি আপনার দোকানে অর কখনো আসব না”। তারপর ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলে, রঙীন সুতো বা ছোট ছুরির সন্ধান করে, দিদির নিকট হইতে যে তিন আনা পয়সা আদায় করিয়াছে, তাহা খরচ করিয়া না ফেলিতে পারিলে তাহার মনে শান্তি নেই। রঙীন পেন্সিল, সাবানের সুন্দর খালি বাকস, সিগারেটের বাক্সের ছবি ইত্যাদি দিয়া পরমেশ তাহার সহিত ভাব করে। তাহাকে একটু ভয়ও করে। তাহার দোকানে অনেক জিনিসই থাকে না বা রাণুর পছন্দ হয না; রাণু ভয় দেখায়, সে বড় রাস্তার বড় দোকানে গিয়া সব জিনিস কিনিবে।
শরতে সেই সুন্দর সকাল বেলাতে রাণুকে দোকানের দিকে আসিতে দেখিয়া পরমেশ কিন্তু একটু উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল; বার্টেন্ড রাসেলের সদ্যপ্রকাশিত একখানি বইএর উপর গভীর মনোযোগ দিল।
“দিদি জিজ্ঞেস করলেন, বার্লিন উল এসেছে?”
কোন উত্তর নাই।
“সারাক্ষণ যদি বই পড়েন, তাহলে দোকান উঠিয়ে দিয়ে চলে যান”।
“ও টেবি, থুড়ি থুড়ি, রাণু, কি চাই সকাল বেলায়?”
“বা, বার্লিন উল যে কাল ওর্ডার দিয়ে গেলুম”।
“ওরে যদু দেখত উলটা”।
যদু নামক ভৃত্যটি দোকানের সত্যিকার বিক্রেতা, কোথায় কোন জিনিস আছে, যত দর সব তার জানা; এই পুরাতন ভৃত্যটি না থাকিলে পরমেশকে দোকান বন্ধ করিয়া দিতে হইত।
যদু একটু রুক্ষস্বরে বলিয়া উঠিল, “উল কোথায় আনলেন দাদাবাবু? কাল ত সারাদিন ঐ বই নিয়েই বসে রইলেন।, বল্লুম এত করে একবার বাজারে যান, কত জিনিস কেনবার বাকী রয়েছে - আলতা সব ফুরিয়ে গেছে - দোকানের আর মান ইজ্জত রইল না –“
“ওই দেখ, ভুলে গেছিত রাণু, - কাল - তোমার দিদিকে বোলো, কাল নিশ্চয়ই পাবেন, কিন্তু রং চাই?”
“বা, আমি বলে গেলুম, ভুলে গেছেন, চাপা ফুলের রং, আমি নমুনা দিযে গেছি, মিলিয়ে নেব”।
“ওরে যদু মনে রাখলি, দুপুরে আমাকে মনে করিয়ে দিস”।
“আমাকে টাকা দেবেন দাদাবাবু, আমি গিয়ে নিয়ে আসব, আপনাকে দিয়ে আর হবে না - কর্ত্তাবাবুর সঙ্গে আমি কতদিন গেছি –“
“আচ্ছা, ভেরি স্যরি মিস রাণু, আজ স্কুল নেই বুঝি? কবে পূজোর ছুটি?”
“ও, পূজোর ছুটি, সেত অনেক দেরী। কিন্তু কাল যদি উল না পাই আমি রামবাবুর দোকানে যাব বলছি, - দিদি বলছিলেন, আপনার দোকান চলবে না - শীগগির উঠে যাবে - আজকালকার দিনে খদ্দেরের মন জুগিয়ে না চল্লে –“
“বলছিলেন না কি! উঠে গেলে ত বাঁচা যায় - ওরে সেই নতুন পেন্সিল দেখাত - কেমন সুন্দর”।
“কত দাম?”
“ওর আর দাম কি”।
“না, দিদি বারণ করেছেন বিনা পয়সায় জিনিস নিতে –“
“পয়সায় দুটো”।
যদু একটু ভ্রূকুটি করিয়া উঠিল; চুপ করিয়া থাকিতে ইঙ্গিত করিয়া পরমেশ দু’পয়সা দামের পেন্সিলে এক পয়সায় দুটা দিয়া শরতপ্রভাতের বেচাকেনা অতি সুলভে আরম্ভ করিল। তাহার ইচ্ছা হইল দোকানের সব জিনিস “পূজার সেল” বলিয়া খুব সস্তায় বেচিয়া টাকাগুলি লইয়া কোথাও বাহির হইয়া পড়ে।
রঙীন পেন্সিল লইয়া রাণু লাফাইতে লাফাইতে চলিয়া গেল। পরমেশ আনমনা হইয়া বসিয়া রহিল। কযেকমাস হইল খুকীরা পাড়াতে আসিয়াছে, তাহার দোকানের নিয়মিত খরিদ্দার; বিশেষতঃ খুকীর অপরিচিতা দিদিই তার বড় পেট্রনেস। কোন বাড়ীটি তাহাদের, বাড়ীতে কে কে আছেন, এসব খবর জানিবার ইচ্ছা হইলেও, কুড়েমিতে তাহার জিজ্ঞাসা করা হইয়া উঠে নাই; আর রাণুর দিদির সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে সে সঙ্কোচ অনুভব করিয়াছে। তিনি তরুণী না যুবতী, বিবাহিতা না অবিবাহিতা, সে কিছুই জানিতে চায় না, আপনার মনে সে তাঁর ছবি আঁকিয়াছে, ছবির রেখাগুলি অস্পষ্ট কিন্তু বর্ণ বৈচিত্র্যের অভাব নেই, - সুন্দরী কিশোরী, স্নিগ্ধ মুখ, গভীর উজ্জ্বল চোখ, কল্যাণকর্ম্মরত সুন্দর হাত, মুখের হাসি লাগিয়া আছে, সে হাসি মধুর উদাসতা মাখান, ভাবিতে ভাবিতে শরতের আকাশ বাতাসের দিকে চাহিয়া তাহার অন্তর উন্মনা - হইয়া গেল। দোকানে বসিয়া থাকিতে পারিল না, উল ও অন্যান্য জিনিস কিনিয়া আনিতে হইবে এই অজুহাতে দোকানের ভার যদুর উপর দিয়া সে বাহির হইয়া পড়িল।
পূর্ব্বেতিহাস এইরূপ :
বেশীদিন নয়, ছয়মাস পূর্ব্বে, পরমেশপ্রসন্ন ছিল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের খ্যাতনামা ছাত্র। সকালে সংস্কৃত শ্লোক মুখস্ত করিত, দুপুরে ক্লাসে নোট লিখিত ও লাইব্রেরীতে পাঠ্যপুস্তক পড়িত, সন্ধ্যায় অধ্যাপকদের বাড়ী গিয়া দার্শনিক তর্ক তুলিত, গভীর রাত্রি পর্য্যন্ত স্পেংলার এডিংটন ব্লক ইত্যাদি পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের বই পড়িত। সংসারানভিজ্ঞ পঠনশীল যুবকটিকে তাহার পিতা একদিনের জন্যও দোকানের তত্ত্বাবধান করিতে বলেন নাই।
একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হইতে ফিরিয়া শুনিল, পিতার কলেরা হইয়াছে। কলেরা, রোগের গুরুত্ত্বের জ্ঞান তাহার ছিল না, হোয়াইটহেডের এক নতুন বই সম্বন্ধে আলোচনা করিতে সে তার প্রিয় প্রফেসারের বাড়ী চলিয়া গেল। পরদিন যখন সে দর্শন-ক্লাসে যাইবার জন্য প্রস্তুত, ডাক্তার তাহাকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, তাহার পিতার অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। সে হতভম্ব হইয়া গেল, শুধু এইটুকু বুঝিল, আজ দুপুরে লাইব্রেরীতে নব্য ন্যায় বা নিউ লজিক সম্বন্ধে বই পড়া হইবে না।
সেদিন সন্ধ্যায় তাহার পিতার মৃত্যু হইল। সম্বলের মধ্যে গলির মোড়ে মনোহারী দোকানটি। জীর্ণ ক্ষুদ্র বাড়ীটিও পৈত্রিক ছিল, দোকানের আয় হইতে সংসার কোনরূপে চলিয়া যাইত।
কলেজের বন্ধুরা পরামর্শ দিলেন, পড়াশোনা না ছাড়িয়া অন্ততঃ এম,এ, পাশ করিতে, তারপর দোকান দেখাশোনা করিলে চলিবে। দু’একজন বড়লোক বন্ধু কিছু অর্থ সহায্য করিতে রাজী হইলেন।
পাড়ায় প্রবীন প্রতিবেশীগণ বলিলেন, বাপু, দোকানটি তোমাদের লক্ষ্মী, ওটি ভাল করে দেখ, ছেলেমানুষ আছ, উন্নতি কর, এখন কত এম,এ পাশ ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সরল শিশু স্বভাবের হইলেও পরমেশের আত্মসম্মনবোধ অতি তীক্ষ্ণ ও কর্ত্তব্যপরায়ণতা উগ্র ছিল। তাহার পিতা দোকানটির সহিত তাহার অর্দ্ধ্ব উন্মাদিনী মাতা ও এক বিধবা শুচিবাইগ্রস্ত ভগ্নির ভার তার উপর চাপাইয়া দিয়া গিয়াছেন। তাহার বোন যখন সতেরো বৎসরে বিধবা হইযা পিতৃগৃহে ফিরিয়া আসিল, মাতার উন্মাদের লক্ষণ প্রথম দেখা দিল; তার তিন বৎসর পরে সেই হতভাগিনী যখন তার একমাত্র পুত্রকে তিন দিনের জ্বরে হারাইল, মাতা শোকে একেবারে পাগল হইয়া গেলেন। এখন তিনি অনেকটা প্রকৃতিস্থা, কিন্তু মাঝে মাঝে মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটে, ঘরের সকল দরজা জানালা বন্ধ করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকেন।
মাতা ও ভগ্নির ভার লইয়া পরমেশ দোকান চালাইতে আরম্ভ করিল কিন্তু বিজ্ঞান দর্শনের গুরুভার বইগুলি জঞ্জালের মত সরাইয়া ফেলিয়া দিতে পারিল না। প্ল্যাঙ্কের কোয়ানটাম থিওরির নব অর্থ, জিন্সের তারালোকের অপূর্ব্ব রহস্যকথা ডিউই হোয়াইটহেডের সদ্য প্রকাশিত পুস্তকে নব সমাজতত্ত্ব পড়িতে পড়িতে,
“এক পয়সার সূচ দেবেন” – “দু’পয়সার খাতা আছে” – “মা একটা খালি কাগজের বাক্স চাইছেন” – “কাপড় কাচা সাবান নেই, ফুরিয়ে গেছে?” – “মশাই, গেঞ্জি মোজা রাখেন না কেন, আজকাল সব দোকানে রাখে” – “মার্ব্বেল পয়সায় কটা, আমার জিনিসটা এনেছেন” -
ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর দিতে বা জিনিস দিয়া হিসাব করিয়া দাম লইতে বিরক্তিতে পরমেশের মন তিক্ত হইয়া উঠিত। যদুর হাতে দোকানের ভার দিয়া সে মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করিয়া চলিয়া যাইত।
সন্ধ্যায় উল পাইয়া রাণু আশ্চর্য্যান্বিত হইল। অর্ডার দিয়া একদিনের তাগাদায় সাধারণতঃ পরমেশের দোকান হইতে কোন জিনিস পাওয়া যায় না, অন্ততঃ দু’দিন লাগে। দরকারী জিনিস দেরিতে আসে বলিয়া দিদির সহিত সে ঝগড়া করিয়াছে, রাগের মাথায় বলিয়াছে, বড় রাস্তায় বড় দোকানে সব জিনিস পাওয়া যায, সেখান হইতে আনিলে এত দেরি হয় না। দিদি কিন্তু এ দোকান ভিন্ন অন্য কোন দোকান হইতে জিনিস কিনিতে নারাজ।
উলের সহিত গোলাপী ফিতে পাইয়া রাণু খুসি হইয়া বলিয়া উঠিল, “দিদি একদিন আপনার দোকান জিনিস কিনতে আসবেন, বলেছেন”।
“সত্যি নাকি!”
“সব জিনিস ভাল ক’রে এনে সাজিয়ে রাখুন, আপনার দোকানেত কিছু থাকে না, এমন বকুনি খাবেন – দেখবেন’খন - দিদি যখন আসবেন -,
হাসিতে হাসিতে রাণু চলিয়া গেল।
দিদি আসবেন - আপনার দোকানে দিদি আসবেন - কথাগুলি গানের সুরের মত শরৎ অপরাহ্ণের আলোক সমস্ত দোকানঘর জুড়িয়া সমস্ত অন্তর ভরিয়া বাজিতে লাগিল - দিদি আসবেন।
অনেক জিনিস ফুরাইয়া গিয়াছে, ঘরটা সাজাইয়া রাখা দরকার। পরমেশ যদুকে ডাকিয়া অকারণে বকুনি দিল, দোকান এত অপরিষ্কার কেন। তারপর, কি কি জিনিস কিনিয়া আনা দরকার তার ফর্দ্দ করিতে বসিল, কালই সব কিনিয়া আনা দরকার, রাণুর দিদি হঠাৎ কবে আসিয়া পড়েন, কে জানে।
ব্যাঙ্ক হইতে মোটা টাকা বাহির করিয়া সারাদিন মুরগীহাটা রাধাবাজার ঘুরিয়া পরমেশ নানাপ্রকার খেলনা, সাবান, লোভনীয় দ্রব্য কিনিয়া ফেলিল; এক চিত্রকর বন্ধুকে ডাকিয়া দোকান সাজাইল, বন্ধুটি এক সচিত্র প্ল্যাকার্ডও দোকানের সামনে আঁকিয়া লিখিয়া দিলেন, “পূজার বাজার এখানে করুন”।
পাড়ার বড় ছেলেরা হাসিল, ছোট ছেলেরা ভিড় করিয়া দাঁড়াইল, বৃদ্ধেরা সন্তুষ্ট হইয়া বাড়ীর ছেলেদের জন্য খেলনা, লজনচুষ কিনিয়া বলিয়া গেলেন, “এই ত চাই বাবা, শশির অনেক পুণ্যের দোকান, মন দিয়ে দেখ”।
কিন্তু চারদিন কাটিয়া গেল, দিদি আসিলেন না। পরমেশের আর দোকান সাজাইবার কোন উৎসাহ রহিল না।
ভাদ্রের শেষে সহসা বর্ষা তাহার মেঘঘন কালো বেণী এলাইয়া দিল সমস্ত আকাশ জুড়িয়া; সারাদিন বর্ষণের পর বিষ্টি একটু থামিয়াছে, আকাশে থমথমে ভাব। খরিদ্দার কেউ নাই, যদু এককোণে বসিয়া ঝিমাইতেছে, স্যাঁতস্যাঁতে দোকানের মৃদু আলোকে পরমেশ একটি বই পড়িতে চেষ্টা করিতেছিল, ইচ্ছা হইতেছিল, দোকান বন্ধ করিয়া তাহার পুরাতন অধ্যাপকের বাড়ী গিয়া কোন নূতন দার্শনিক তত্ত্ব সম্বন্ধে তুমুল তর্ক জুড়িয়া দেয়, চায়ের কাপ আসে, সজল সন্ধ্যা তর্কে আলাপে জমিয়া উঠে। ভাবিতেছিল, জীবনের সত্যিকার সার্থকতা কোথায়?
একটি মোটরগাড়ী দোকানের সামনে আসিয়া দাঁড়াইল।
“এই যে - এই যে দোকান - রোখো –“
রাণুর কণ্ঠস্বর, হাঁ, রাণুর কন্ঠস্বর। পরমেশ চমকিয়া চাহিয়া উঠিল।
রাণু তাড়াতাড়ি মোটর গাড়ী হইতে নামিল।
স্নিগ্ধ অজানা কণ্ঠস্বর, “জিজ্ঞেস করত, - আমার বোনবার কাঠি এসেছে কিনা –“
“নামবেনা দিদি - তুমি বলছিলে আজ দোকানে নামবে - বিষ্টি ত থেমেছে –“
“আচ্ছা একটু নামি”।
“দিদি এসেছেন!” রাণুর মুখ উৎসাহে আনন্দে জ্বলজ্বল।
পরমেশ অতি ব্যস্ত ভাবে দরজার গোড়ায় চেয়ার সরাইয়া অগ্রসর হইয়া আসিল। বিমুগ্ধভাবে দেখিতে লাগিল, একটি কিশোরী রাণুর হাত ধরিয়া গাড়ী হইতে নামিলেন; চমৎকার বেশ, হাল্ক নীল রংএর জামা, তার ওপর সোনালী সিল্কের শাড়ী দেহের কাঞ্চনবর্ণের সঙ্গে এক হইয়া গিয়াছে; অপূর্ব্ব সুন্দর মুখখানি যেন ভাস্করের খোদাই-করা পাথরের মূর্ত্তি, অচঞ্চল স্থির দৃষ্টি।
চেয়ারটা এগাইয়া দিয়া থতমত ভাবে পরমেশ বলিল, -“আসুন - বসুন –“
রাণুর হাত ধরিয়া দরজার চৌকাঠ পার হইয়া রাণুর দিদি চেয়ারে স্থির হইয়া বসিলেন।
মোটরগাড়ী হইতে কে বলিল, “আমায় এখুনি যেতে হবে, দেরী কোরো না –“
দিদি উত্তর দিলেন, “তুমি গাড়ী নিয়ে যাও দাদা, আমার একটু দেরী হবে, কয়েকটা জিনিস দেখব - রাণুর সঙ্গে এটুকু হেঁটে চলে যেতে পারব”।
“দোকানটা বড় অগোছল রয়েছে - কি দেখাব বলুন –“
দিদি চেয়ারে আত্মসমাহিতভাবে বসে রইলেন, তাঁর সম্মুখে যেন কোন বস্তু নাই, বস্তুর মায়া নাই।
“আপনার বোনবার কাটা এনেছি - অনেক রকম উল এনেছি - কোন রং আপনার পছন্দ –“
দিদি স্থির হইয়া বসিয়া শুধু হাত বাড়াইলেন। পরমেশ আশ্চর্য্য হইয়া নির্নিমেষ নয়নে তাহার দিকে চাহিল, জিজ্ঞাসুভাবে রাণুর দিকে চাহিল। রাণুর আর চপলতা নাই, সে শান্ত ভাবে দাঁড়াইয়া আছে। রাণু করুণভাবে ঘার নাড়িল, ধীরে পরমেশের নিকট আসিয়া মৃদুস্বরে বলিল, “দিদিত দেখতে পান না”।
দিদি দেখতে পান না! দিদি অন্ধ! কাটাগুলি পরমেশের হাত হইতে পড়িয়া গেল, সে কাঁপিয়া উঠিল।
চারিদিক অন্ধকার করিয়া বাহিরে আবার বিষ্টি আসিল। বৃষ্টির ছাট আসাতে দরজাটা বন্ধ করিয়া দিতে হইল। আলো নির্বাণোন্মুখ প্রদীপের মত ম্লান।
একটির পর একটি অনেক জিনিস পরমেশ দিদির হাতে তুলিয়া দিল, কলের পুতুলের মত। মাঝে মাঝে দিদির শীতল কোমল আঙ্গুলের স্পর্শ তাহার উত্তপ্ত হস্তে লাভ করিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।
হাত বুলাইয়া বাছিয়া জিনিসগুলি দিদি রাণুর হাতে তুলিয়া দিলেন।
শ্রান্ত হইয়া পরমেশ একটি টুলে বসিয়া পড়িল। মুখে কোন কথা আসিল না।
বাহিরে সঘনবর্ষণশব্দমুখরিত ভাদ্র সন্ধ্যার সচকিত অন্ধকার। ভিতরে, উলের বাণ্ডিল সাবানের বাক্স আয়না খেলনা খাতার গাদা বিস্কুটের টিন আলতার শিশি নানা দ্রব্য ভরা দোকানের আলোছায় - এক চপলা চঞ্চলা বালিকা, এক অন্ধ সুন্দরী কিশোরী, এক স্বপ্ন-বিহারী প্রেমতৃষিত যুবক বাক্যহারা বসিয়া - যুবকের অন্তরের পরমবেদনাকল্লোলের মত সজল বাতাস গলির মধ্যে হা হা করিয়া ছুটিয়া আসিয়া দোকানের বন্ধ দ্বারের উপর আছাড় খাইযা খাইয়া পড়িতে লাগিল।
অন্ধ। মর্ম্মরপ্রতিমাসম সুন্দরী তরুণী অন্ধ। তাহার চোখের সম্মুখে রং নাই, রূপ নাই, ঘন তমিস্রা। সে যদি জন্মান্ধ হইত, তাহা হইলে অন্ধত্বের বেদনা বোধ করিতে পারিত না। কিন্তু একদিন সে তার ঐ ছোট বোন রাণুর মত দুষ্টামিভরা দুই চক্ষু নাচাইয়া হাসিয়াছে, আকাশের নীল-স্ফটিকের পেয়ালা হইতে শরতের আলোক সুধা পান করিয়াছে; সেই বর্ণের স্মৃতি তাহাকে কি উদাস করিয়া তোলে না!
বর্ষা সন্ধ্যায় অন্ধ কিশোরীর সহিত দেখা হইবার পর হইতে পরমেশ অন্তরের কোন অসহনীয় বেদনায় যেন পাগল হইয়া উঠিল। দুই চক্ষু বুজিয়া সে অনুভব করিতে চেষ্টা করিত অন্ধত্ব কেমন।
সে দোকান ভুলিল। আহার নিদ্রা ভুলিল। যদুরই সবচেয়ে মুস্কিল হইল। সে দেখিল, আগে দাদাবাবু বইতে মুখ গুঁজিয়া পড়িয়া থাকিতেন, এখন চোখ বুজিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকেন। চোখের কোন অসুখ হয় নাই। মা-ঠাকুরাণীর মত তাঁহারও কি মাথা খারাপ হইয়াছে। কর্ত্তার আমলের দোকান সে প্রাণপণে আঁকড়াইয়া ধরিয়া রহিল।
পরমেশ অনুভব করিতে চেষ্টা করিত, অন্ধক্লারের রূপ কি? ঐ অন্ধ কিশোরী পূর্ণিমার চিরান্ধকারময় জগতের রূপ কি? আছে, রূপ আছে। সাত-রংএর দৈর্ঘ্য প্রস্থে বস্তুরূপ এক নয়। সে জগতে বস্তু সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর হইয়া ধ্বনিতে রূপান্তরিত হইয়াছে, যেন প্রলয়ের অন্ধকার হইতে প্রবাহিত হইতেছে ধ্বনির তরঙ্গ, শব্দের কল্লোল; সেই ধ্বনি হইতে গড়িয়া উঠিতেছে নবনব শব্দ-মূর্ত্তি, সঙ্গীতের সুরজালের মত।
অন্ধকারের রূপ ধ্যান শেষ করিয়া যখন সে চোখ মেলিত, বিচিত্র বর্ণময়ী পৃথিবী তাহাকে নব আকর্ষণে টানিত। যে গাছটির দিকে সে কখনও চাহিয়া দেখে নাই, তাহারি পুষ্পিত পুঞ্জিত শ্যামলতায় কি স্নিগ্ধ শ্রী! কি নব মূর্ত্তি-সৌন্দর্য্য চারিদিকে - গলির বাঁক, চালের কলটা, দোকানের বাক্সগুলি, ডাষ্টবিন - সব বস্তু মূর্ত্তিতে নবসৌন্দর্য্য উদ্ঘাটিত হইত।
পরমেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইল।
নবনববর্ণপ্রকাশিনী বস্তু-রূপময়ী আলোকোজ্জ্বলা পৃথিবী একবার তাহাকে ভোলায়, দুই চোখ ভরিয়া সে রং ও রেখার সৌন্দর্য্য পান করে; আবার অন্ধকারের অরূপ মহারহস্য তাহাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে, সে সব ভুলিয়া অন্ধকার ধ্যান করিতে বসে।
কোন বন্ধু যদি তাহাকে বলিত এই মানসিক দ্বন্দ্ব এই অন্তরের বেদনা হচ্ছে অন্ধ পূর্ণিমার প্রতি তার সমবেদনাময় প্রেম, পূর্ণিমাকে পাইবার জন্য গভীর ব্যাকুলতা, তাহা হইলে সে বন্ধুর সহিত তাহার সারা জীবনের জন্য বিচ্ছেদ হইত, সন্দেহ নাই।
যে দেবতা জন্মমৃত্যু আলোকান্ধকারের ভিতর দিয়া অরূপ হইতে রূপে, রূপ হইতে অরূপে বিশ্ব জগৎ ভাঙিয়া গড়িয়া চলিয়াছেন, তিনিই সমস্যার সমাধান করিয়া দিলেন।
বর্ষার ধারা শেষ হইযাছে; আকাশ-ভরা জ্যোৎস্না, নীল সিল্কের ঘেরাটোপ হইতে স্বপ্নময় আলোর বন্যা।
বিহ্বলের মত পরমেশ বহুক্ষণ ছাদে ঘুরিল; আলোর মায়া চোখ বোজা যায় না, ইচ্ছে করে নয়ন যেন কখনও না নীমিলিত হয়।
রাত গভীর হইয়া আসিল। পাড়া ঘুমন্ত; গলি নিঝুম; মায়ালোকময় পথ।
ছাদ হইতে নামিয়া সে জনহীন নিঃশব্দ পথে ঘুরিতে লাগিল। এতদিন যে কামনাকে সে নিরুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল আজ সে জাগিয়া উঠিয়াছে, জ্যোৎস্নার সোনার কাঠির স্পর্শে অন্তরের রুদ্ধগৃহে সে রাজবালা জাগিয়া উঠিয়াছে।
সে পূর্ণিমাকে ভালবাসে। এই কথাটি আকাশভরা জ্যোৎস্নায় সে গভীর আনন্দে উপভোগ করিল। শুধু অনুভব করিয়া সে তৃপ্ত নয়, সে কথাটি তাহাকে বলিতে চায়।
সাদা বাড়ীটি জ্যোৎস্নায় ঝকমক করিতেছে। বাড়ীটার চারদিকে কতক্ষণ সে ঘুরিল। তারপর ধীরে ধীরে সিড়ি দিয়া দোতলা পার হইয়া ছাদে গিয়া পৌছিল।
বেতের একটি লম্বা চেয়ারে নীলকুশানে মাথা ঠেকাইয়া পূর্ণিমা ছাদে একা বসিয়া। তাহার পাশে টবগুলিতে সাদা ফুলের মেলা।
জ্যোৎস্না-উদাস শরতের সুনির্ম্মল শুভ্র রাত্রির মত পূর্ণিমা উন্মনা বসিয়া।
“আমি এসেছি”।
“জানতুম, তুমি আসবে”।
“আমি তোমাকে ভালবাসি”।
“তুমি আমাকে গ্রহণ কর”।
তপ্ত কম্পিত হস্তে স্নিগ্ধ শীতল আঙুলগুলির স্পর্শ।
কিছুদিন পরে পাড়ার সবাই অবাক হইযা দেখিল গলির ছোট মনোহারী দোকানটা বড় রাস্তার মোড়ে এক বড় ঘরে উঠিয়া গিয়াছে, নিউ মার্কেটের দোকানের মত সুন্দর সাজান, নানা জিনিসভরা। পুরাণো স্যাঁতস্যেঁতে ঘরটা ছাড়িয়া যাইতে যদুর বিশেষ দুঃখ হইয়াছিল, নূতন দোকানের জাকজমক ও বিক্রির ধুম দেখিয়া সে দুঃখ সে শীঘ্রই ভুলিল। এখন দোকানের কাজের ভিড়ে তার একটুও সময় নাই।
( ‘উত্তরা’ মাসিক পত্রিকা, আশ্বিন ১৩৪০ )।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।