পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫
চার্লি চ্যাপলিন
ননীগোপাল মজুমদার
[লেখকের পরিচয় জানা যায় নি] দীপক সেনগুপ্ত ।
চার্লি চ্যাপলিনের নাম নিশ্চয়ই তোমরা সকেলেই শুনেছ । যদি কেউ বল শোননি, তবে কিন্তু আমি ভয়ানক ঠাট্টা করবো - বলব ‘নিতান্ত সেকেলে’ ।
আমাদের দেশে বায়োস্কোপের রেওয়াজ এখনও খুব বেশী হয়নি - শুধু বড় বড় সহরেই তা দেখা যায়। কিন্তু য়ুরোপের পল্লীতে পল্লীতেও বায়োস্কোপ দেখাবার ভারী ঘটা । এই বায়োস্কোপের ভেতর আজকাল সব চেয়ে বেশী বাহবা নিচ্ছেন চার্লি চ্যাপলিন - তাঁর ভাঁড়ামীর অভিনয় করে । ছবিতে তাঁর সে ভাব-ভঙ্গী দেখলে হাসতে হাসতে পেটের নাড়ী ছিঁড়ে যায়। য়ুরোপে এমনও সব লোক পাবে, যারা হয়তো মহাবীর নেপোলিয়নের নামও কোন দিন শোনেনি, অথচ চার্লি চ্যাপলিনের প্রশংশায় চতুর্ম্মুখ ।
বছর বার তের যখন বয়স তখন এই চার্লি ভায়া একবার পেটের দায়ে এক কাচের কারখানায় ঢুকেছিলেন কাজ করতে, কিন্তু ভায়ার চেহারার তো দৌড় ঐ, রোগা পটকা, রক্তশূণ্য - তা অত গরম সইবে কেন ? বেচারা পড়ে যান অজ্ঞান হয়ে । সেই থেকে তাঁর মা তাঁকে প্রতিজ্ঞা করান যে তিনি অভিনয় ছাড়া আর কোন দিকে যেতে পারবেন না - মরে গেলেও না। এই মা’টির কথা জিজ্ঞাসা করলে চার্লি একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন, বলেন “ আমার মা’টি যদি অমন না হতেন, তবে আজ আমি থাকতাম কোথায় ?” বাস্তবিকিই চার্লির বাবা মরে গেলে তাঁর মা তাঁকে আর তাঁর ভাই সীডকে যে ভাবে মানুষ করেছিলেন, সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার !
চার্লির মা ছিলেন বিখ্যাত গায়িকা Lila. কোন একটা জিনিস দেখে সেটী হুবহু নকল করার এক আশ্চর্য্য ক্ষমতা এই নারীর ছিল । ঘরে বসে হয় তো খোস গল্প চলছে, চট করে জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে তিনি এক বারটি দেখে নিলেন রাস্তায় কোথায় কি হচ্ছে । ব্যস, অমনি হাত পা নেড়ে সে দৃশ্যটা চমৎকার সবার সামনে ফুটিয়ে তুল্লেন । মাযের এই গুণটাই নাকি ছিল চার্লির একটা মস্ত বড় শিক্ষার বিষয় ।
বায়োস্কোপের যে সব মজার মজার ছবি চার্লি দিচ্ছেন সেগুলি কি করে তাঁর মনে আসে তা তিনি নিজেই বলেছেন । রাস্তায় চলতে চলতে আমরা কত রকম ব্যাপারই না দেখি । এই রকমই পথে চলতে চলতে দেখতে-পাওয়া একটা ঘটনা তিনি বেছে নেন, আর তারপর ইচ্ছেমত তাতে রং ফলান - এর থেকে এ হতে পারে, তার থেকে সে হতে পারে ইত্যাদি ভেবে ভেবে। যেমন ধর তাঁর ‘ফায়ারম্যান’ নামে বিখ্যাত ছবিখানা । ব্যাপার কিছুই নয়,একদিন রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে চার্লি দেখলেন,একটা বাড়ীতে আগুন লেগেছে,আর দমকলের লোকেরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাই নিভাবার চেষ্টা করছে । ব্যস,অমনি তিনি ভাবতে লাগলেন,ওপরের তালার একটা ঘরে তিনি যেন শুয়ে আছেন,হঠাৎ দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠল,তড়াক করে তিনি জেগে উঠলেন,ছড় ছড় করে নল বেয়ে নীচে নেমে এলেন,একজন লোককে উদ্ধার করে ফেল্লেন ইত্যাদি। আর এক বার এক ঘোরাল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তাঁর মাথায় ‘ফ্লোর ওয়াকার’ নামে ছবিখানার প্লট এসে গেল। গেলেন কোথায় ঘুঁষোঘুঁষির লড়াই (বক্সিং ) দেখতে, অমনি ভেবে ফেল্লেন ‘চ্যাম্পিয়ান চার্লি’ নামে মজার ছবিখানা।
একদিন ভোর বেলা চার্লির মা লীলা বলে উঠলেন, “ ঐ দেখ, দেখ, বিল স্মিথ কি ভাবে যাচ্ছে ! দেখেছ সে কেমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, জুতোতে তার কালি নেই, আর মুখখানা কেমন হাঁড়িপানা। আমি নিশ্চয় বলতে পারি, বেচারা আজ তার বউয়ের সাথে ঝগড়া করে বেরিয়েছে - সকালে তার একটু খাবারও জোটে নি।”
ব্যস, সেই থেকে চার্লির মূলমন্ত্র হল তাঁর ছবিতে এমন একজন লোককে দেখান যার নিতান্ত ছোটখাট সাধারন কাজগুলোর মধ্যেও বেশ একটু বোকামোর আভাস পাওয়া যায়। যেমন ধর, হঠাৎ যদি কারো মাথা থেকে একটা টুপি উড়ে যায়, সেটা যত না হাসির বিষয় হবে, তার চাইতে ঢের বেশী হাসির বিষয় হবে যদি সে টুপির মালিকও উস্কোখুস্কো চুলে, কোটের মস্ত বড় কোণ উড়িয়ে সেই টুপির পেছন পেছন হন্তদন্ত হয়ে ছুটতে শুরু করে দেয়। এই জন্যেই দেখবে ডিগবাজী খেতে খেতেও চার্লি ভায়া তাঁর লাঠিটিকে ঠিক ‘বাবু’র মতই ধরে থাকবেন, টুপিটাকে নেড়ে চেড়ে দেখবেন সেটা ঠিক মত আছে কিনা, আর নেকটাইটাও দুরস্ত করার জন্যে খানিক টানাটানি করবেন।
একটি ঘটনাতেই লোককে দু'বার হাসাতে পারলে চার্লি কখনও দুটো ঘটনার জন্য ব্যস্ত হবেন না। এইতো ‘দি এডভেঞ্চার’ নামক ছবিখানায়, তিনি বারাণ্ডায় বসে বরফ খেতে লাগলেন আর তার নীচে হলে বসালেন একজন উচ্চবংশীয়া মহিলাকে । তারপর খানিকটা বরফ গেল তাঁর চামচে থেকে পড়ে পাৎলুনে, এবং শেষে বেয়ে বেয়ে গিয়ে সেটা পড়ল সেই মহিলাটির ঘাড়ে । মহিলা তো লম্ফ-ঝম্ফ দিয়ে সারা । দর্শকেরা একবার হাসলেন চার্লির আনাড়ীপনায়,আর একবার তার চেয়ে বেশী হাসলেন মহিলাটির লম্ফ-ঝম্ফে।
চার্লির ছবির আরও কতগুলি মজা আছে । ছবিতে যদি কোন পাহারাওলা তাঁকে তাড়া করল, তবে সে নিশ্চয়ই হবে মোটা সোটা লম্বা,কেননা চার্লি নিজে হচ্ছেন বেঁটে আর রোগা কিনা । কাজেই তিনি যখন এঁকে বেঁকে নানা রকমে পুলিশের পো'কে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন, তখন দর্শকের টানটা স্বভাবতঃ তাঁর দিকেই যায় - তাঁরা সবাই সেই ভুঁড়ো লাস পাহারাওলার শাস্তিটা দেখে ভারী আনন্দ পান।
এইতো গেল চার্লির ছবির গল্প । এবার তাঁর ঘরের কথা শোন । তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, লোকটি যখন অমন আমুদে তখন বাড়ীতেও নিশ্চয়ই তিনি কতই না মনের স্ফূর্তিতে থাকেন । কিন্তু একেবারে উল্টো। সত্যিকার আনন্দের হাসি জীবনে তিনি ক’বার হেসেছেন তা বোধ হয় গুণে গুণে বলে দেওয়া যায়। বেচারা জীবনে এক মা ছাড়া আর কাউকে ভালবাসতে পারেন নি, আর ছোট বেলাকার সেই দুঃখের ছাপ এতদিন ধরে লক্ষ লক্ষ লোককে হাসিয়েও তিনি মুছে ফেলতে পারেন নি। বাইরে কোথাও নেমতন্ন-টেমন্তন্নে গেলে অবশ্য তিনি লোকজনকে খুব হাসাতে পারেন, কিন্তু ঘরে বসে তাঁকে তাঁর বেহালার করুণ সুর ছাড়া আর কোন সুর সাধতে কেউ দেখে নি।
(‘রামধনু’ পত্রিকা, মাঘ ১৩৩৬)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।