পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫
ভীমে গুণ্ডা
আদিত্য কুমার চট্টোপাধ্যায়
[ লেখক পরিচিতি : লেখকের সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। বেথুন কলেজের বিশিষ্ট অধ্যাপক ছিলেন আদিত্যকুমার। ইণ্ডিয়ান মেসেঞ্জার, তত্ত্বকৌমুদী, মুকুল, সখা, সখা ও সাথী ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি লেখা প্রকাশ করেছেন। ছাত্র বৎসল শিক্ষক হিসাবে তার খ্যাতি ছিল।] দীপক সেনগুপ্ত ।
ঠাকুরদাদা। ঠাকুরদাদা একটা গল্প বল না, শুনি!-এই বলিয়া পাড়ার দশ বার জন ছেলে হরদুলাল চক্রবর্ত্তীকে ঘিরিয়া মহা পীড়াপীড়ি আরম্ভ করিয়াছে। ইনি পল্লীস্থ প্রৌঢ় যুবক বালক সকলেরই সরকারী ঠাকুরদাদা। ইঁহার ব্যবসায় গল্প বলা। ইঁহার মহাভারত প্রভৃতি প্রাচীন শাস্ত্র ও জনশ্রুতি হইতে সংগৃহীত, অথবা নিজের উদ্ভাবিত নানা প্রকার রসিকতা বা উপদেশ পূর্ণ গল্প বলিয়া, ইনি সম্পন্ন লোকদিগের সন্তোষ উৎপাদন পূর্ব্বক যাহা উপার্জ্জন করেন, তাহাতেই ইঁহার ও ঠাকরুণ দিদির সংসারযাত্রা এক রকম করিয়া চলিয়া যায়। পাঠক পাঠিকাগণ এই বর্ণনা হইতেই বুঝিয়াছেন যে ঠাকুরদাদা নিঃসন্তান। সুতরাং সংসারের ভাবনা তাঁহার অতি অল্পই। গল্প বলিয়া যাহা উপার্জ্জন করেন তাহাতেই সন্তুষ্ট চিত্তে দিনপাত করেন।
বালকদিগের ‘সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ’ এড়াইতে না পারিয়া ঠাকুরদাদা গল্প আরম্ভ করিলেন-
‘ মতিলাল বলিয়া এক বুদ্ধিমান বালক ছিল। সে যখন কথামালার লাঙ্গুলহীন শৃগালের গল্প পড়িত, তখন গুরু মহাশয় তাহাকে বলিয়া দিয়াছিলেন ‘লাঙ্গুল’ মানে ‘নখ’। তাহার জ্যাঠা মহাশয়ের বাম হস্তের কনিষ্ঠ অঙ্গুলির নখ খুব বড় ছিল। সে সেই দিনই পাঠশালা হইতে বাড়ী আসিয়া জ্যাঠা মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিল, ‘ হ্যাঁ জ্যাঠা মহাশয়। অত বড় লাঙ্গুল রেখেছ কেন ? কেটে ফেললেই ত হয় ?' জ্যাঠা মহাশয় ত প্রশ্ন শুনিয়া অবাক । তাহার পর দুই এক কথায় বুঝিলেন যে তাহার অভিধানে লাঙ্গুল শব্দের অর্থ-নখ। মতিলাল যখন বোধোদয় পড়ে, তখন তাহার পিতা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ উদ্ভিদ কাকে বলে ?' মতিলাল উত্তর করিল,-‘ যাহা মাটি ফুঁড়িয়া উঠে।’ পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন,-‘যেমন ?' উত্তর হইল,-‘কেঁচো !’ মতিলাল প্রাণিবৃত্তান্ত পড়িয়া শিখিয়াছিল যে, যে সকল জন্তু গিলিয়া খায় তাহারা ডিম পাড়ে। সে সেই দিনই পাঠশালা হইতে বাড়ী আসিয়া তাহার পিতাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাবা ! বাবা ! আজ পড়িলাম, যে সকল জন্তু গিলিয়া খায় তাহারা ডিম পাড়ে। তা কৈ মাসি ত ডিম পাড়ে না ? মাসি ত দাঁত নাই বলিয়া সব জিনিস গিলিয়া খান ?’ তাহার পিতা হাসিতে হাসিতে গিলিয়া খাইলে ডিম পাড়ার মানে বুঝাইয়া দিলেন।
গল্প শুনিয়া বালকেরা হাসিল বটে, কিন্তু উহা তাহাদের মনঃপুত হইল না। তাহারা বলিয়া উঠিল,“ ও কি গল্প ? একটা ভাল গল্প বল।” ঠাকুরদাদা তখন বলিলেন, “ গল্প কি আর অমনি হয় ? গল্প শুনিতে পয়সা লাগে।”
এই বলিয়া সেদিনকার মত ঠাকুরদাদা প্রস্থান করিলেন।
পরদিন বালকেরা কষ্টে সৃষ্টে আপনাদের খাবারের পয়সা হইতে চারি আনার পয়সা সংগ্রহ করিয়া ঠাকুরদাদাকে আবার গল্পের জন্য ধরিয়া বসিল ও বলিল, “ আমরা অনেক কষ্টে আপনার জল খাবারের মত চারি আনা সংগ্রহ করিয়াছি; ইহা লইয়া আপনি একটী ভাল গল্প বলুন।”
ঠাকুরদাদা পয়সাগুলি কাপড়ে বাঁধিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন,-
“ এক রাজা ছিলেন। তাঁহার দুও সুও রাণী ছিল। একদিন রাত্রি দু প্রহরের সময় রাজা সাত মহল পার হইয়া, সুও রাণীর ঘরের আগড় ঠেলিয়া তাহাকে ডাকিতে লাগিলেন।”-গল্প এই পর্য্যন্ত বলা হইবামাত্র এক জন ছেলে বলিয়া উঠিল, “ ওকি ঠাকুর দাদা ? রাজা সাত মহল পার হয়ে সুও রাণীর ঘরের আগড় ঠেলতে গেলেন- সে কেমন হল?” ঠাকুরদাদা সম্পর্কোচিত সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, “ চারগণ্ডা পয়সায় আগড় নয়ত কি প্যানেলওয়ালা কপাট হবে নাকি ? আগড় যে হয়েছে এই ঢের।"-বলিয়াই ঠাকুর দাদা উঠিয়া প্রস্থান করিলেন।
পরদিন বালকেরা পিতা মাতার কাছে কান্না কাটি করিয়া প্রত্যেকে দুই চারি আনা জোগাড় করিল সকলের সম্পত্তি একত্রিত করিয়া দুই টাকা হইল। তাহারা দুইটী চক চকে টাকা গাঁথাইয়া আবার ঠাকুরদাদাকে ধরিল এবং টাকা দুইটী দেখাইয়া বলিল, “ আজ বল।” এই বলিয়া রাস্তার ধারে এক জনদের রোয়াকে বসিয়া তামাক ও মলয়ানিল সেবন করিতে করিতে নিম্নলিখিত গল্প আরম্ভ করিলেন;-
“ আমি অনেক দেশ বেড়াইয়াছি । ভারতবর্ষের এমন প্রসিদ্ধ স্থান নাই যেখানে আমি যাই নাই। তা ছাড়া সাধারণের অজ্ঞাত অনেক অপ্রসিদ্ধ স্থানও দেখিয়াছি। একবার আমি মফস্বঃলের একটী পল্লীগ্রামে গিয়া কিছুদিন বাস করিয়াছিলাম। ইহা রেলওয়ে ষ্টেষণ হইতে প্রায় ১৫/১৬ ক্রোশ দূরে। সেই জন্য সেখানে পল্লীগ্রামের ভাব অনেকটা আজও বজায় আছে। এখানকার লোকগুলি খুব নিরীহ ও সরল প্রকৃতির। কিন্তু এখানেও সুরা রাক্ষসী দেখা দিয়াছে। বাজারে একটী মদের দোকান আছে। কিন্তু সেখানে বাগদি দুলে প্রভৃতি নীচ জাতীয় লোক ভিন্ন অন্য কেহ যায় না। বাজারের মধ্যস্থলে একটী জলছত্র আছে। এখানে পিপাসার্ত্ত ব্যক্তিগণ আসিয়া বিশ্রাম ও জল পান করে। জল ছত্রটী একটী প্রস্তর নির্ম্মিত ফোয়ারা। নিকটস্থ পাহাড় হইতে অনবরত ইহাতে জল আসিতেছে। ফোয়ারার চতুর্দ্দিক বাঁধান ও ছায়াযুক্ত বৃক্ষ দ্বারা ঘেরা । ফলতঃ স্থানটী অতি রমণীয়। ফোয়ারাটীর নিম্নে অস্পষ্ট অক্ষরে কি লেখা আছে। অনুসন্ধানে জানিলাম একটী বিশেষ ঘটনার স্মৃতিচিহ্ণ স্বরূপ ওই ফোয়ারাটী নির্ম্মিত হইয়াছিল। এক বৃদ্ধার নিকট হইতে উহার যে ইতিহাস শুনিলাম তাহা এই ;-
“ প্রায় বিশ বৎসর পূর্ব্বে এক দিন সন্ধ্যাকালে একজন বিদেশীয় লোক এই গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হয়। লোকটা দেখিতে কৃষ্ণবর্ণ, দীর্ঘাকার ও বদমায়েস গোছের । তাহার নাম কি, বাড়ী কোথায়, কেহ কিছু অনুসন্ধান করিয়া স্থির করিতে পারিল না। সেই জন্য সকলে তাহাকে 'ভীমে গুণ্ডা' আখ্য প্রদান করিল। কাজেও সে নাম সার্থক করিয়াছিল। গ্রামের প্রান্ত ভাগে এক খানা অনধিকৃত জীর্ণ পর্ণকুটীর ছিল। তাহার অধিকারী এক বৃদ্ধ ভিখারী কিছুদিন পূর্ব্বে ইহলোক ত্যাগ করে। তদবধি উহা খালি ছিল; ভীমে গুণ্ডা তাহাতেই বাস করিত। সে কাহারও সহিত বড় একটা মিশিত না। কিন্তু পাশ্ববর্ত্তী কাজিরহাট ও অন্যান্য গ্রামের দাঙ্গা হাঙ্গামায় সে প্রায়ই লিপ্ত হইত ও তাহার সহিত কেহ সমকক্ষ হইতে পারিত না। এই সকল কারণে শীঘ্রই সে একজন বদ মায়েস বলিয়া বিখ্যাত হইয়া উঠিল। তাহার সম্বন্ধে নানালোকে নানা কথা কহিত। কেহ বলিত সে নরহত্যা অপরাধে অপরাধী হইয়া লুকাইয়া এখানে বাস করিতেছে। কেহ বলিত সে ডাকাইত, রাত্রিতে দূরবর্ত্তী গ্রামে ডাকাইতি করে। গ্রামের একজন ধার্ম্মিক পরোপকারী ভদ্রলোক তাহার সংশোধনের জন্য তাহাকে ডাকিয়া দুই একবার আলাপ করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু সে এমন কর্কশ ভাবে তাঁহার কথার প্রত্যুত্তর দিয়াছিল যে, তিনি সেই অবধি আর তাহাকে কিছু বলিতেন না। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া গ্রামের কেহই তাহার সহিত মিশিত না, সকলেই তাহার সঙ্গ পরিহার করিবার চেষ্টা করিত। যুবকগণ ভীমে গুণ্ডা আসিতেছে দেখিলেই অন্য দিকে সরিয়া যাইত। রমণীগণ ছোট ছোট বালক বালিকাদিগকে সাবধান করিয়া দিতেন, যেন তাহারা ভীমে গুণ্ডার সংশ্রবে না আসে।
“ এই গ্রামে আসিবার দুই এক বৎসর পরে ভীমে একদিন বৈকালে বেড়াইতে বেড়াইতে পূর্ব্বোক্ত ভদ্রলোকটীর বাগানে উপস্থিত হইল। খানিক দূর অগ্রসর হইয়া সে বালক বালিকা দিগের আনন্দপূর্ণ চিৎকার ধ্বনি শুনিতে পাইল ও বেড়ার অপর দিকে একটি বৃহৎ গাছের তলায় কতকগুলি বালক বালিকা খেলা করিতেছে দেখিয়া, সতৃষ্ণ নয়নে কিয়ৎক্ষণ সেইদিকে চাহিয়া রহিল। এমন সময়ে তাহার নিকটস্থ একটী ঝোপের মধ্য হইতে একটী সাত আট বৎসরের বালিকা বহির্গত হইয়া তাহাকে বলিল, ‘চুপ কর, শব্দ কর না, তাহলে ওরা টের পাবে যে আমি এখানে লুকিয়ে আছি।’ বালিকার মুখে ভীতির চিহ্ণ মাত্র নাই। কেবল মধুরতাপূর্ণ সরল ভাব। পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি বলিয়াই বালিকা বলিল, ‘তোমাকে বড় ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত্ত দেখচি। তুমি এই আধুলীটি লও। আমার মাসি কাল আমার জন্ম দিনে এই নূতন আধুলীটি আমাকে দিয়েছিলেন ’। এই বলিয়া বালিকা বস্ত্রাঞ্চল হইতে একটী চক চকে আধুলী খুলিয়া ভীমেকে দিল। এই সময় অপর বালক বালিকারা তাহার বস্ত্রাংশ দেখিতে পাইয়া ‘ওইরে ! ওইরে !’ করিয়া আনন্দ কোলাহল করিয়া উঠিল। বালিকাও তীর বেগে একদিকে ছুটিয়া লুকাইতে গেল।
“ ভীমে গুণ্ডা কোন কথা কহিবার অবসর পাইল না। সে কিয়ৎকাল চিত্রার্পিতের ন্যায় সেই খানে স্তম্ভিত ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল ও হস্তস্থিত চক চকে আধুলীটি দেখিতে লাগিল। ক্রমে তাহার রুক্ষ্ম মুখমণ্ডলে কি একপ্রকার কোমল ভাবের আবির্ভাব হইল। সে তাহার কুটীরের দিকে আস্তে আস্তে ফিরিয়া চলিল। আর তাহার সে উদ্ধত পদবিক্ষেপ নাই। সেদিন সন্ধ্যাকালে তাহাকে মদের দোকানে না দেখিতে পাইয়া তাহার সঙ্গিগণ বলাবলি করতে লাগিল, ‘ আজ ভীমেকে যে দেখছি না ?’
“ সেই দিন গভীর নিশীথে,-‘ ঘরে আগুণ লেগেছে! ঘরে আগুণ লেগেছে !’ এই ভয়ানক চিৎকার ধ্বনি শুনিয়া, গ্রামসুদ্ধ লোক জাগিয়া উঠিয়া দেখে পূর্ব্বোক্ত ভদ্রলোকটীর গৃহে আগুন লাগিয়াছে। তিনি সেদিন কার্য্যোপলক্ষে কলিকাতা গিয়াছিলেন। তাঁহার স্ত্রীর শরীর অসুস্থ। বাড়ীটি দ্বিতল চালাঘর; ভৃত্যগণ তামাকু খাইয়া বেড়ার গায়ে হুঁকা ঠেস দিয়া রাখিয়াছিল, তাহাতেই কেমন করিয়া দড়ির পাট ধরিয়া নীচের ঘরে প্রথমে আগুন লাগে। যে যাহা হউক, গ্রামস্থ সকলের সাহায্যে ঐ ভদ্রলোকটীর স্ত্রী, পুত্র কন্যা ও ভৃত্যগণ সহ দহ্যমান গৃহের বাহিরে নিরাপদ স্থানে আনীত হইলেন। এমন সময় ভৃত্যগণের মধ্যে একজন চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল,’ কৈ ? নলিনী কোথায় ?' সকলেই শিহরিয়া উঠিল। নলিনীর মাতা মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। গ্রামসুদ্ধ লোক নিস্তব্ধ ও নিশ্চল। তখন আগুন এমন জ্বলিয়া উঠিয়াছে যে, বাড়ির ভিতর যাইতে কাহারও সাহস হইতেছে না। এমন সময়ে এক কৃষ্ণবর্ণ দীর্ঘাকার পুরুষ পশ্চাদ্দিক হইতে দ্রুতবেগে আসিয়া, দর্শকগণের চক্ষের পলক পড়িতে না পড়িতে ঐ অগ্নিময় গৃহে প্রবেশ করিল। এত শীঘ্র এই ব্যাপার ঘটিয়াছিল যে দর্শকগণের নিকট স্বপ্নবৎ বোধ হইতে লাগিল। তাহারাও ভীরু লোক নহে, কিন্তু সে সময়ে ঐ গৃহে প্রবেশ করা নিশ্চয় মৃত্যু। এই অসম সাহসের কার্য্য কে করিল? সকলেই রুদ্ধশ্বাসে, উৎকণ্ঠিত হইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল। এক মুহুর্ত্ত এক এক বৎসরের মত বোধ হইতে লাগিল। কিয়ৎক্ষণ পরে সেই কৃষ্ণবর্ণ মূর্ত্তি বালিকা নলিনীকে লইয়া ধূম রাশি ভেদ করিয়া, দ্বিতলস্থ শয়ন কক্ষের দ্বারদেশে দেখা দিল, দর্শকদিগের মুখ নিঃসৃত আনন্দধ্বনিতে গগন বিদীর্ণ হইয়া গেল। বালিকার রক্ষক পূর্ব্বেই তাহার কোমরে একখানি বিছানার চাদর পাকাইয়া বাঁধিয়া দিয়াছিল। তাহারই সাহায্যে বালিকাকে নামাইয়া দিল। নিম্নে তাহার জন্য শত শত হস্ত অপেক্ষা করিতেছিল। বালিকা নিরাপদে নীচে আসিল, সাহায্যকারিগণ আর সেখানে দাঁড়ান অসম্ভব দেখিয়া, বালিকাকে লইয়া পশ্চাতে চলিয়া আসিল ও তাহার রক্ষাকারীকে চিৎকার করিয়া বলিল, "এখন আপনাকে বাঁচাও।" কিন্তু এই কথা শেষ হইতে না হইতে গৃহের জ্বলন্ত সম্মুখ ভাগ লইয়া মহাশব্দে পতিত হইল।
"অগ্নি নলিনীর কেশও স্পর্শ করে নাই। নলিনীর মাতা উন্মত্তার ন্যায় তাহাকে দৃঢ়ভাবে বক্ষে ধারণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, "কে আমার মেয়েকে বাঁচালে?" সকলেই নিস্তব্ধ, কাহারও মুখে কথা নাই। এমন সময় সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করিয়া দর্শকগদিগের মধ্যে এক জন বলিয়া উঠিল-"ভীমে গুণ্ডা।" বাস্তবিকই গৃহের দগ্ধাবশেষ সরাইয়া ফেলিলে পর তন্মধ্য হইতে সর্ব্বজন ঘৃণিত "ভীমে গুণ্ডা"র মৃত দেহ বাহির হইল! কিন্তু তাহার সম্বন্ধে লোকের আর সে ঘৃণা রহিল না। নারীগণ অশ্রুমোচন করিতে করিতে, পুরুষগণ মৃতের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করিতে করিতে তাহার মৃত দেহ দেখিতে আসিল। কিন্তু তাহার দগ্ধ বক্ষঃস্থলে একটী উজ্জ্বল আধুলি কোথা হইতে আসিল সে সম্বন্ধে কেহ কিছু নির্ণয় করিতে না পারিয়া সকলেই একটু আশ্চর্য্য হইল!
"নলিনীর পিতা বাটী আসিয়া সমস্থ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিলেন এবং ভীমেগুণ্ডার এই আত্মবিসর্জ্জনের ব্যাপার চিরস্মরণীয় করিবার জন্য বাজারের মধ্যে পূর্ব্বোক্ত জলসত্র নির্ম্মান করাইয়া, তাহা ভীমেগুণ্ডার নামে প্রতিষ্ঠা করাইলেন। নলিনীর পিতার মৃত্যু হইয়াছে; নলিনীও স্বামী পুত্র কন্যা লইয়া ভিন্নগ্রামে বাস করিতেছেন। কিন্তু এখনও তিনি প্রতিবৎসর একবার করিয়া পুত্র কন্যা দিগকে লইয়া, মাতৃভূমিস্থ সেই জলসত্র দর্শন করিতে আনেন ও ভীমেগুণ্ডার আত্মবিসর্জ্জনের কথা তাহাদের নিকট বর্ণন করেন।
"ভীমেগুণ্ডা নরহত্যাকারী বা ডাকাইত ছিল কি না নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। কিন্তু সে যে ঘোর পাষণ্ড ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই এবং বালিকা নলিনীর মুহুর্ত্ত কালব্যাপী সরল, স্নেহপূর্ণ ব্যবহারে যে তাহার হৃদয় পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল এবং সে জীবনে যতই মহাপাপ করিয়া থাকুক না কেন, এই আত্মবিসর্জ্জনে যে তাহার সমস্ত পাপের প্রায়শ্চিত্ত হইয়াছে, তাহাতে সংশয় করিবার কোনও কারণ দেখা যায় না। প্রেমে বাস্তবিকই পাষণ্ড দলন হয়, মহাপাতকীর পরিত্রাণ হয়।"
(‘সাথী’ পত্রিকা, ১ম ভাগ ১ম সংখ্যা, বৈশাখ ১৩০০ বঙ্গাব্দ)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।