পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
নভেম্বর ১৫, ২০১৪
গোত্রহীনের মা
হেমেন্দ্রলাল রায়
[ লেখক পরিচিতি : কবি ও সাহিত্যিক হেমেন্দ্রলাল রায় ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার ফুলকোচা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম ব্রজদুলাল রায়। স্কুলের পাঠ শেষ করে প্রথমে রাজশাহী গভর্ণমেণ্ট কলেজ ও পরে কলকাতার সিটি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ‘হিন্দুস্থান’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রে দীর্ঘদিন কাজ করার পর তিনি সাপ্তাহিক ‘বাঁশরী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন এবং সম্পাদক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। সচিত্র ‘মহিলা’ সাপ্তাহিকের সম্পাদকও ছিলেন তিনি। সতীশচন্দ্র দাশগুপ্তের খাদি প্রতিষ্ঠানের প্রচার বিভাগের কর্মি পদেও কাজ করেছেন। হেমেন্দ্রলাল ছিলেন একজন প্রকৃত স্বদেশ ভক্ত; খদ্দর প্রচার কার্যে তার পরিশ্রম ও কর্মকুশলতা যথেষ্ট স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তার যুগ্ম-সম্পাদনায় ‘রাষ্ট্রবাণী’ নামক একটি রাজনৈতিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ‘হরিজন’ পত্রিকার সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিক জীবন শেষ করে তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রচার বিভাগে কাজ শুরু করেন।
হেমেন্দ্রলালের রচিত ও প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থ : কাব্য - ‘ফুলের ব্যাথা’ (১৯২৯) ; ‘মণিদীপা’। উপন্যাস - ‘ঝড়ের দোলা’ (১৩৩২);’মায়াকাজল’(১৩৩৭)। গল্প - ‘মায়ামৃগ’ (১৩৩২); ‘পাঁকের ফুল’। শিশুগ্রন্থ - ‘গল্পের ঝরণা’; ‘গল্পের আলপনা’; ‘মায়াপুরী’; ‘পাঁচ সাগরের ঢেউ’; ‘দুর্গম পথের যাত্রী’। রাজনৈতিক গ্রন্থ : ‘রিক্ত ভারত’; ‘বিলাতে গান্ধীজী’। বিবিধ রচনা - ‘শিল্পীর খেয়াল’; ‘সচিত্র আরব্য উপন্যাস’।
হেমেন্দ্রলাল ছিলেন নিঃসন্তান। টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই (২২শে আষাঢ়,১৩৪২) মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কবি ও কথা সাহিত্যিক হেমেন্দ্রলাল লোকান্তরিত হন। ]
দীপক সেনগুপ্ত।
বিদেশেই চিরদিন প’ড়ে ছিলুম! সুতরাং জন্মভূমির সঙ্গে পরিচয় ছিল না বল্লেই হয়। কিন্তু তবু একদিন গাঁয়ের মাটি তাঁর অদৃশ্য দৃঢ় স্নেহের ডোরটা ধ’রে যখন টান দিলেন তখন তাঁর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়্তেও দেরী করতে পারলুম না। কলকাতা থেকেই ঠিক ক’রে এলুম,এবার Privilege-এর পাওনা ছ’টা মাস এই দেশের মাটিতেই কাটিয়ে যাব।
দেশের গাছপালা, নদীনালা, মাঠপ্রান্তরের ভিতর যতই বৈচিত্র্য থাক না কেন, লোকগুলোর ভেতর যে কোনও বৈচিত্র্য ছিল না সে কথা হয় তো না বল্লেও চলে। সব একই রকমের ছাঁচে ঢালা। তাস পাশার আড্ডায় রাজা-উজির মারা,গোপনে পরস্পরের কুৎসা রটিয়ে বেড়ানো,সামান্য স্বার্থ নিয়ে ইতরের মতো গালাগালি ও হাতাহাতি-এই ছিল প্রত্যেকের নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। সুতরাং জীবনটা ক্রমেই একঘেয়ে হ’য়ে উঠ্ছিল। এই একটানা জীবনকে মাঝে মাঝে সরস ক’রে তুলত কেবল একজন। চিরদিন পল্লীর মাঝে থেকেও পল্লীর আর কোন লোকের সাথে কোনখানেই তার কোন রকমের মিল ছিল না।
যার কথা বলছি, সে ছিল আমার পাশের বাড়ীরই চিররুগ্ন বাপের একমাত্র মেয়ে সুষমা। গ্রামের সুবাদে সে আমার বোন হ’তো। সহরের লোকের কাছে পাড়াগাঁয়ের মেয়েও যে বিস্ময়ের বস্তু হ’তে পারে এই মেয়েটিকে না দেখলে তা হয় তো কেউ বুঝতে পারবে না, অন্ততঃ আমি যে বুঝতে পারতুম না তাতে এতটুকু ভুল নেই।
বাড়ী এসেই প্রথম যেদিন তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলুম, নিঃসঙ্কোচেই সে বেরিয়ে এসে আমাকে বসতে আসন দিয়ে প্রণাম করে বল্লে, দেশটাকে তাহ’লে সত্যি সত্যি এবার মনে পড়্ল নীহারদা।
আমি বললুম, তোরা তো মনে করবি নে একখনো, তাই তো আমি নিজেই এলুম ঝালিয়ে নিতে আমার স্নেহের দেনা-পাওনাগুলো! আশা করি এখনো ওগুলো একেবারে বাতিল হয়ে যায়নি! কিন্তু দাবী যদি কখনো ভারি হয় সইতে পারবি তো?
সুষমা বল্লে, একবার যাচাই ক’রেই দেখো না। - সত্যি এবার কিছুদিন বাড়ীতে থাকছ তাহ’লে!
আমি বল্লুম,ইচ্ছা তো আছে, যদি তোরা তাড়িয়ে না দিস্।
সুষমা একটু হেসে বললে, তাই থাকো নীহার-দা! তোমরা যারা গাঁ-টাকে ভালো ক’রে রাখতে পারতে তারা সবাই একে একে বিদায় নিয়েছ ব’লেই তো গাঁ-টার আজ এত দুর্দ্দশা। আমরা না হয় কেউ নই, কিন্তু যে ভুঁইটা সর্বপ্রথম বুকে টেনে নিয়েছিল সেও কি তোমাদের কেউ নয়? আমি তো বুঝ্তেই পারি নে, গাঁয়ের মাটিকে ভালো না বেসে দেশের মা-টিকে মানুষ কি ক’রে ভালো বাসতে পারে।
বিস্মিত হ’য়ে বললুম, তুই তবে দেশের কথাও ভাবিস্?
সে হেসে উত্তর দিলে, না নীহার-দা, ওসব বালাই আমার নেই। নিজেকেই এ পর্য্যন্ত চিন্তে পারলাম না-তা আবার দেশ!
কিন্তু সে তাকে চিন্তে না পারলেও আমি হয় তো তাকে কতকটা চিনতে পেরেছিলুম। তাই তা’র সম্বন্ধে আমার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না।
সুষমা ছিল কুলীনের মেয়ে। সুতরাং বিয়ের বয়স ঢের দিন পেরিয়ে গেলেও সে তখনো অবিবাহিতই র’য়ে গেছ্ল এবং আর যে কখনো তার বিয়ে হবে তারও সম্ভাবনা ছিল না। পাত্রের দুষ্প্রাপ্যতাই যে তার বিবাহ না-হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল তাও মনে হয় না। পাত্র হয় তো তার জুটত কিন্তু বাপের অসুখের দোহাই দিয়ে বিয়ের কথা উঠতেই মেয়েটি এমন ভাবে বেঁকে বসতেন যে, বাপকেই হাল ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হ’য়ে হার মানতে হ’তো।
কিন্তু বিয়ে না করলেও সুষমার ব্রত-নিয়ম পালনের অন্ত ছিল না। সে মাছ পরিত্যাগ করেছিল, একবেলা খেত-তাও হবিষ্যান্ন, পান খেত না, দেহটাকে সমস্ত রকমের অলঙ্কার হ’তে বঞ্চিত করেছিল; ভেজা কাপড় রোদে না শুকিয়ে নিজের গায়েই শুকিয়ে নিত। কখনো কখনো দেখা যেত, সামনে তিন চার দিন সে জলটুকুও স্পর্শ না ক’রে কাটিয়ে দিচ্ছে!
আমার অনেক সময় মনে হ’তো সুষমার এই আত্মনির্য্যাতন খুব স্বাভাবিক জিনিস নয়, এমন কি মানুষ তার রিপুগুলোকে দমন করবার জন্যে যে সব শাস্ত্রীয় অনুশাসন মেনে চলে এগুলোর সঙ্গে তারও বিশেষ কোনো সম্বন্ধ নেই। একটা বিশ্বাস কি ক’রে যে আমার মনের ভেতর বদ্ধমুল হ’য়ে গেছ্ল জানি নে, কিন্তু এ ধারণা কিছুতেই আমি দূর করতে পারছিলুম না যে,তার মনের ভেতর কোথায় যেন একটা অপরাধের অনুতাপ অহর্নিশি কাঁটার মতো বিঁধে আছে এবং এ আত্মনিপীড়ন তারি ফল। মানুষ তার নিজেকে যেমন ভাবে পীড়ন করতে পারে তেমন করে তাকে পীড়ন করতে আর কেউ পারে না।
এই কৃচ্ছ্রসাধন মনের দিক দিয়ে সুষমার ওপর যত বড় দুঃখের বোঝাই চাপিয়ে দিক না কেন, দেহের দিক দিয়ে তার সংযম তাকে একটা অসাধারণ ঔজ্জ্বল্য দান করেছিল। ব্রহ্মচারিণীর নিষ্ঠায় তার তরুণ দেহটাকে দেখাতো একটা আগুনের শিখার মতো। কৃশ অথচ দীপ্ত, ম্লান অথচ তেজস্বী এই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পাড়ার ব্রাহ্মণেতর জাতিরা বলত, হাঁ বামুনের মেয়ে বটে। ব্রাহ্মণেরা বল্ত-একে বলে তপঃসিদ্ধ।
কিন্তু এই বাইরের দীপ্তিটা যে তার কিছুই নয়, তা সেই দিনই টের পেলুম, যে দিন তার জীবনে একটা গোপন অধ্যায় একান্ত আকস্মিক ভাবেই আমার চোখের সম্মুখে খুলে গেল। সেদিন লোকের কাছে সব দীপ্তি সে ম্লান হ’য়ে গেছে, কিন্তু আমার কাছে সেই দিনই নতুন ক’রে ধরা প’ড়ে গেল আগুনের সেই দীপ্তিটা যা ধ্বংস করে অথচ যা ক্লেদাক্ত জিনিসটাকে ও শুচি-শুভ্র ক’রে রেখে যায়।
* * *
সেদিন ভোরে উঠেই দেখি,নদীর ধারের মাঠটা হঠাৎ একেবারে লোকের মাথায় মাথায় ভ’রে উঠ্ছে। এ লোক সমাগম যে কিসের জন্য তা জান্তুম না-জান্বার বিশেষ ইচ্ছাও ছিল না। পাড়া গাঁয়ের হুজুক হয় তো বিনা কারণেই বেড়ে উঠেছে মনে ক’রে,কেবল একখানা বই-এর পাতা খুলে বসেছি,সুষমা ঝড়ের মত ঘরের ভেতর ঢুকে বল্লে,-নীহার-দা, তোমার বই রাখ,আমার সঙ্গে একবার উঠে এস ভাই।
আমি বল্লুম-কোথায় যেতে হবে?
সে বল্লে-ঐ মাঠের মধ্যে।
আমি বল্লুম-এ আবার তোর কি খেয়াল? হয় তো ওখানে একটা সন্ন্যাসী এসেছে,কি বেদের মেয়ে তোর ভোজবাজীর কসরৎ দেখাচ্ছে,কি এমনি ধরনের আর একটা কিছু হচ্ছে এরি জন্য তোকেও ঐ ভিড়ের ভিতর ছুটতে হবে।
সুষমা বল্লে-তুমি ওঠো নীহার-দা, যা জানো না নিয়ে তর্ক ক’রো না।
ধমক খেয়ে মনটা একটু বেঁকে গেল, কিন্তু সে ধমকের ভিতর এমন একটা জোর ছিল যে,তাকে অগ্রাহ্যও করতে পারলুম না। চাদরটা কাঁধে জড়িয়ে সুষমার সঙ্গে পথে বেরিয়ে পড়লুম।
পথে পথে চলতে চলতে সুষমার মুখের দিকে চেয়ে দেখি সে মুখ ইস্পাতের মত শক্ত কঠিন কিন্তু ইস্পাতের মতোই চক্চক্ করছে। তার ভিতর গলিয়ে কোনো কিছুর যে সন্ধান পাবো-তারও কোন উপায় নেই।
প্রায় ভিড়ের কাছে এসে পড়েছি,হঠাৎ একটা সদ্য জাত শিশুর কান্না কানের দোরে এসে ঘা দিলে। সুষমা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকুল ব্যথিত কণ্ঠে বলে উঠ্ল-ঐ শুন্ছ নীহার-দা-আহা বাছারে।
তার মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম,এবার পাষাণ গ’লে ঝরণা নেমেছে। তার অত কঠিন মুখটা এক নিমেষে বেদনায় আর্দ্র হ’য়ে করুণায় গ’লে এমন কোমল হ’য়ে উঠ্ল যে, সে যে সুষমার মুখ তাও যেন চিনতে পারা যায় না।
কল্পনার কাগজটাতে সবে মাত্র তুলির টান পড়েছে এমন সময় সে কান্নার শব্দ ছাপিয়ে জেগে উঠল পাড়ার রসিক ঠাকুরের কণ্ঠস্বর। শুনলুম,সে চীৎকার ক’রে বল্ছে-আ মর ছোঁড়া আবার কাঁদছে। ছিঃ ছিঃ মরণও হয় না তাদের যাদের এই কীর্ত্তি। কি কলঙ্কের কথা! নিজেকে সামলাতে যদি না পারিস, তবে এগুলোকেই বা চোখের সামনে এমন ক’রে ফেলে রাখা কেন?
সে না থামতেই সর্ব্বেশ্বর তার কথাটাতে ফোড়ং দিয়ে বল্লে- যা বলেছ রসিক-দা। দিন দিন এ সব কি হচ্ছে। এ রকমের দুর্ব্বলতা তো আগে ছিল না। মানুষ সব সময় আপনাকে সামলাতে পারে না জানি, কিন্তু তাই ব’লে কি কলঙ্কের ছাপ পথে ঘাটে ফেলে রেখে নিজেদের অধঃপতনের বড়াই করতে হবে! আর ওদেরকে পৃথিবীতেই বা আনা কেন? সমাজের কোন স্তরেই তো ওরা মুখ তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
হরিশ ঘোষ কিন্তু এ কথার সমর্থন করলে না। সে বল্লে,ঠাকুর তোমরা তো সকলে সকল কথাই বল্লে। কিন্তু মায়ের মনটাকেও তো দেখ্তে হবে, মনের দুর্ব্বলতা কম বেশী সব মানুষেরই আছে। একটা পাপের হাত হ’তে এড়াতে পারেনি ব’লেই যে আরও একটা পাপ কর্তে হবে কোনো শাস্ত্রেই তো তেমন কথা লেখে না।
রসিক ক্রুদ্ধ হ’য়ে বল্লে- বেটা শূদ্দূর আবার শাস্তর আওড়াচ্ছে। দু’পাতা ইংরেজী পড়েছে কি না! কি হে বাপু, এত যে দরদ দেখছি, কাজটা কি তোমারি নাকি!
এই বিশ্রী ইঙ্গিতে সকলে হো হো করে হেসে উঠ্ল। কিন্তু এ হাসিকে হরিশ নির্ব্বিবাদে সহ্য করলে না, সে বল্লে-রসিক ঠাকুর, তুমি আর বড়াই ক’রো না। তোমার কীর্ত্তি কলাপ এ গ্রামের কেই বা না জানে। বামী জেলেনীর কথা এখনো এ গ্রামের কেউ ভোলেনি।
এবার রসিক একেবারে মারমূর্ত্তি ধারণ ক’রে বল্লে - ভোলেনি তো ব’য়েই গেছে। রসিক চক্রবর্তী ব্যাটা ছেলে। ওর জন্যে তার জাত যাবে না। কিন্তু সে কথা নিয়ে তোর অত মাথাব্যাথা কেন বাপু! বেটা ব্রাহ্মণ দ্বেষী ম্লেচ্ছ কোথাকার!
হরিশও তার সমান তালেই গলা ছাড়লে,বল্লে- গাল দিও না ঠাকুর। তুমি তো জান রসিকের রসিকতা ভেঙে দেবার মতো জোর আমার এই দেহেই ম্লেচ্ছ উপাধিটা দিয়ে তুমিই তো স্বীকার করে নিয়েছ।
এই হট্টগোলে কখন যে পা’র গতিটা থেমে পড়েছিল মনে নেই। হঠাৎ সুষমার কথাতেই চলচ্ছক্তি হীনতার কথাটা ধরা পড়ল। সুষমা বল্ছে- ছিঃ নীহার-দা, ওকি ইতরোমি দাঁড়িয়ে শুনছ তুমি! তার চেয়ে এগিয়ে চল ভাই। অতটুকু শিশু-তার দুঃখের কথা মনে ক’রেও কি করুণা হয় না তোমাদের।
ধীরে ধীরে ভিড়ের ভিতর ঢুকে প’ড়ে সামনের দিকে চাইতেই দেখতে পেলুম, -একটি সদ্য প্রসূত শিশু, রং তার তরুণ সূর্য্যের আলোতে দপ্ দপ্ করছে - ঠিক একটা ভোরের ফোটা স্থলপদ্মের মতো।
হয় তো রোদের আঁচ লেগেই ছেলেটা আবার কেঁদে উঠল। কিন্তু সে কান্না থামবার আগেই সুষমা ছুটে গিয়ে দু’টো হাত বাড়িয়ে তাকে তুলে নিয়ে বুকের ভিতর চেপে ধরলে। চেয়ে দেখলুম-তার চোখে জল, ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি এবং সমস্ত মুখটা ছেয়ে রাফেলের ‘মা’ জেগে উঠেছে।
সাপের উদ্যত ফণার সামনে খানিকটা কার্ব্বলিক এসিড ঢেলে দিলে তার ফণা যেমন আপনা হ’তেই নেমে পড়ে,সব উত্তেজনা যেন মন্ত্রের বলেই শান্ত হ’য়ে গেল। সেই মন্ত্রমুগ্ধ জনতার ভিতর দিয়ে ছেলেটাকে বুকে ক’রে সুষমা ধীরে ধীরে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বল্লে-এইবার আমাকে বাড়ী নিয়ে চল নীহার-দা!
* * *
গাঁয়ের পার্লামেন্ট হ’তে এক মুহুর্ত্তে পাশ হ’য়ে গেল যে, সুষমার নিয়ম-কানুন, চার-ব্রত ছিল সবই ভণ্ডামি। দু’ এক জনে এমন কথাও বল্লে যে, তারা বরাবরই জান্ত যে, ও মেয়েটা তেমন সুবিধের নয়। তার কৃচ্ছ্রাসাধন ছিল কেবল লোকের চোখকে ফাঁকি দেবার ফন্দি। নইলে কেউ নাকি আবার এত বয়স পর্য্যন্ত ইচ্ছে ক’রে আইবুড়ো থাকে। যে সুষমা সারা গ্রামের আদর্শ ছিল,এক দণ্ডে তাকে পথের ধূলোয় লুটিয়ে দিয়ে মাড়িয়ে যেতেও কারো বাধল না।
কিন্তু ব্যাপারটা এই অসাক্ষাতের নিন্দেতেই শেষ হ’ল না। এ নিয়ে গ্রামে যে ঘোট পাকিয়ে উঠল সে দিনকার স্নানের ঘাটের উত্তেজনার চাইতেও তার জোর ছিল ঢের বেশী। সমাজপতিরা শিউরে উঠে এর প্রতিকারের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হ’য়ে উঠ্লেন।
তখন কেবল সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হ’য়ে উঠেছে,প্রাতঃকালে সেই জনতা আবার ভিড় পাকিয়ে জমে উঠল, সুষমাদের ঝকঝকে, গোবর দিয়ে নিকানো পরিষ্কার উঠানটার মাঝখানে।
সেই রসিক ঠাকুর এখানেও হেঁকে বল্লেন - সুষমা, তোমার এ অনাচার আমরা সইতে পারছি নে। তোমার জবাব দেবার কি আছে বল।
সুষমা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বল্লে - জবাব দেবার মতো হয়তো অনেকই আমার আছে, কিন্তু আমার জবাব নেবে কে শুনি?
- গ্রামের দশজন,যাঁদের নিয়ে সমাজ তাদের সকলেই আজ এখানে হাজির আছেন।
সুষমা বল্লে - কিন্তু যে সমাজ একটা সদ্যজাত শিশুকে পথের মাঝে ফেলে রেখে নির্লজ্জের মতো হল্লা করতে পারে, তার কাছে আমার জবাবদিহি করবার কিছু নেই।
রসিক বললেন-তোমার না থাকলেও সমাজের হয় তো আছে। তবে তুমি যদি সমাজ না মানো সে আলাদা কথা।
সুষমার স্বরের ভিতর এতক্ষণ কেবল একটা কঠোর তীক্ষ্ণতাই ছিল; এবার তা সেই তীক্ষ্ণতাকেও ছাপিয়ে উঠ্ল একটা বিপুল ঔদাসীন্যের আভাস। সে বল্লে - মানবো না ব’লেই তো তোমাদের মতো শিশুটাকে পথের মাঝে ফেলে কুস্তি লড়তে পারিনি, তাকে বুকে তুলে নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছি।
রসিক। কিন্তু সমাজ তো জড় পদার্থ নয়। তাকে অপমান করলে সে তার শাস্তি কড়ায় গণ্ডায় বুঝে আদায় করতে জানে, সে কথাটাও তা হ’লে তোমার জেনে রাখা উচিত!
সুষমা এবার হেসে বল্লে - নিজেকে যে কোনো শাস্তির হাত থেকেই রেয়াৎ দেয়নি, সমাজ তাকে আর নতুন ক’রে কি শাস্তি দেবে ঠাকুর? কিন্তু তুমি এত শাস্তির কথা বল্ছ,সমাজের হাত থেকে তোমার নিজের প্রাপ্য শাস্তিটা বুঝে নিয়েছ তো?
রসিক আবার কি বল্তে যাচ্ছিল-কিন্তু তাকে বাধা দিয়া বুড়ো তর্কালঙ্কার মশাই বল্লেন- মা লক্ষ্মী, তোমার অন্তরের কথা আমি বুঝেছি,কিন্তু সমাজের দিকেও তো একবার তাকাতে হবে; নইলে সমাজ যদি উচ্ছৃঙ্খল হ’য়ে পড়ে,তবে তো সুখ কারো বাড়ে না মা। যে দুঃখের হাত থেকে তুমি মানুষকে বাঁচাতে চাচ্ছ, সেই দুঃখই যে তখন নিদারুণ হ’য়ে উঠে’ তোমাদের কোমল মনকেই পীড়ন ক’রে জর্জ্জর ক’রে তুলবে-সে কথাটাও তো একবার ভেবে দেখতে হয়।
সুষমা বল্লে-কিন্তু তর্কালঙ্কার কাকা, একটা অসহায় শিশুকে মৃত্যুর পথে পাঠিয়ে দিলেই কি সমাজের সব ভুল শুধরে যাবে। ঐ শিশুর ওপরেও তো সমাজের কর্ত্তব্য আছে।
-আছে বই কি মা। আজ কাল তো অনাথ আশ্রমের অভাব নেই। ওকে সমাজের ভিতর তুলে না নিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দিলেও তো সে দায়িত্ব পালন করা হয়।
সুষমা বল্লে-আপনার সঙ্গে তর্ক করব সে প্রগলভঁতা আমার নেই তর্কালঙ্কার কাকা। কিন্তু আমার মনে হয়, ঐ সব অনাথ আশ্রমে ছেলে পাঠানো আর স্নেহ-শূন্য মায়া-শূন্য কলের হাতে ছেলেমানুষ করার ভার ছেড়ে দেওয়া তো একই কথা। পয়সা নিয়ে যারা পালন কর্বার ভার গ্রহণ করে, তারা সে স্নেহ কোথায় পাবে যা শিশুর রক্তের সঙ্গে মিশে তাকে মানুষ ক’রে গ’ড়ে তোলে। অবশ্য ও যে মন্দের ভালো তা আমি অস্বীকার করছি নে। কিন্তু রোদ,হাওয়া,মাটির রস যেমন ফুলটাকে বর্ণ দেয়, গন্ধ দেয়, ফল ধারণের উপযোগী ক’রে তোলে,শিশুকে মানুষ করতেও যে তেমনি স্নেহ মায়া মমতা মা’র হৃদয়ের দরকার হয়। তর্কালঙ্কার কাকা,আমার তো সংসারে কোন বন্ধনই নেই। -আমিই না হয় ওর মা হ’য়ে ওকে মানুষ ক’রে তুললুম। সমাজের তাতে কোথায় কি ক্ষতি হচ্ছে সে তো আমি কোনো রকমই বুঝে উঠতে পারছি নে।
চোখের জলে সুষমার গলার স্বরটা ভিজে ভারি হয়ে উঠল। সে তাড়াতাড়ি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে উদ্গত জলের ধারটা মুছে ফেলে আবার বল্লে- তার চেয়ে তর্কালঙ্কার কাকা, সমাজের যথার্থ উপকার যদি করতে চান তবে সত্যটাকে চাপা না দিয়ে যারা আদত অপরাধী, ওর সেই কাপুরুষ বাপ-মাকে খুঁজে বার ক’রে দণ্ড দিতে চেষ্টা করুন। নির্দ্দোষীকে শাস্তি দিয়ে কোনো পাপকে যে কখনো বন্ধ করা যায় না, এইসব নাম-গোত্রহীন ছেলেমেয়েগুলোই তো তার প্রমাণ।
তুষারের মত শুভ্র চুলের গোছার ভেতরে শীর্ণ শিরা বহুল হাতের আঙ্গুলগুলো বুলোতে বুলোতে বৃদ্ধ তর্কালঙ্কার বল্লেন - এ দিক দিয়ে যে সমস্যাটাকে এমন ক’রে ভেবে দেখবার কারণ থাকতে পারে, সে কথাটা তো এর আগে দিন মনে পড়েনি মা। রসিক, এ কথাগুলো আর একবার ভালো ক’রে বিচার না ক’রে তো সুষমাকে আমি ঐ ছেলেটিকে আর ফিরিয়ে দিতেও বলতে পারি নে। তারপর তর্কালঙ্কার ঠাকুর একটু স্তব্ধ হ’য়ে থেকে আবার ব’লে উঠলেন,- কিন্তু মা,আমি বুঝতে পারছি নে আমার এই বুড়ো পাকা মাথাটাতে যে কথাটা ঢুকল না, তোর তপঃক্লিষ্ট আচার-নিয়মের বেড়াজালে ঘেরা মনে সে কথাটা একমুহূর্ত্তেই এমন ক’রে স্পষ্ট হ’য়ে উঠল কি করে? যুক্তি মানতে গেলে তো আর ঠিক উল্টো জিনিষটাই হওয়া উচিত ছিল। কি সে যাই হোক, বিপদে যদি কখনো পড়িস্ তবে তোর এই অক্ষম তর্কালঙ্কার কাকা যে তোকে পরিত্যাগ করবে না, এ কথা তোকে নিশ্চয় ক’রেই জানিয়ে গেলুম- আর তাদেরকেও জানিয়ে যাচ্ছি যারা আজ তোর এখানে দল বেঁধে এসেছে তোকে অপদস্থ করতে। বলেই তিনি ধীরে ধীরে যেমন ভাবে এসেছিলেন, ঠিক তেমনি ভাবেই জনতা ত্যাগ ক’রে চলে গেলেন।
সুষমা দোর পর্য্যন্ত তাঁকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে এসে বল্লে - আপনারা যাঁরা দয়া ক’রে আমার ঘরে পায়ের ধুলো দিয়েছেন, এইবার তাঁরাও উঠুন। আপনার আমার ওপর যে সামাজিক দণ্ড বিধান করবেন, আমি নতশিরে তা গ্রহণ করব। কিন্তু ছেলেটাকে আমি ত্যাগ করতে পারব না। বলেই সে ঘরে ঢু’কে সকলের মুখের ওপরে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিলে।
* * *
রাত তখন অনেক হয়েছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই মনে হ’ল, কার করুণ কান্না যেন জানালা গলিয়ে আমার বিছানার ওপরেই লুটিয়ে পড়্ছে। বাইরের দিকে তাকাতেই দেখি, আকাশের এক প্রান্ত হ’তে আর এক প্রান্ত পর্য্যন্ত চাঁদের অগাধ অজস্র আলোকে উচ্ছ্বসিত কানার সুর আর আলোর ধারা আমাকে হাতছানি দিলে। মানুষকে যখন নিশীথে পায়, ঘরের মানুষ নাকি তখন টের না পেয়েও বাইরে পথের ওপরে ছুটে আসে। আমাকে কোন্ নিশীথে পেয়েছিল জানি নে,কিন্তু দোর খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই কান্নার শব্দটা আমার কানের কাছে আরো স্পষ্ট হ’য়ে উঠল। মনে হ’ল, কে যেন তাকে প্রাণপণে চাপতে চাচ্ছে অথচ কিছুতেই চাপতে পারছে না। মনের সমস্ত শাসন না মেনেই সে যেন বেরিয়ে আস্ছে এই নিশীথ রাত্রির স্তব্ধ বুকটাকে একটা করুণ বেদনার রাগিণীতে ভ’রে দিয়ে। আরো একটু মনোযোগ দিতেই বুঝতে পারলুম, প্রাণের হাহাকারের এ রুদ্ধ উচ্ছ্বাস কাল্পনিক তো নয়ই- সামনের প্রান্তর থেকেই সেটা ভেসে আসছে।
আমাদের বাড়ীর কয়েক বিঘে জমির একটু ফাঁকা জায়গার পরেই সুষমাদের বাড়ী। তার পরেই পল্লীগ্রামের বিস্তৃত মাঠ-ধূ ধূ করা বিরাট শূন্যতার রাজ্য। যন্ত্র চালিতের মতো ঘর থেকে নেমে সেই কান্নার উদ্দেশে মাঠের ভিতর বেরিয়ে পড়লুম। কিন্তু খুব বেশী দূর যেতে হ’ল না। সুষমাদের বাড়ীটা কেবল ছাড়িয়ে এসেছি, দেখি বকুল গাছের অন্ধকারে কে একজন বুক-ফাটা ব্যথায় গুমরে গুমরে উঠ্ছে। কোনো পর্ব্বতের গুহার ভিতর আট্কে প’ড়ে নদী যখন তার সমস্ত জলটা বাইরে ছড়িয়ে দিতে পারে না,তখন তার ভেতর যে, আকুল আর্ত্তনাদ উঠতে থাকে, এ কান্নার শব্দ কতকটা তেমনি ধরনের।
আরো একটু এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলুম,কার বুকের ব্যথা এই নিশীথ রাত্রির জ্যোৎস্নার ধারার ভেতরেও রোদনের বন্যার সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে ঠিক তার পাশটাকেই হাঁটু গেড়ে বসে ডাকলুম-সুষমা।
বুকের কাছটাতে বান বিঁধলে হরিণ যেমন ক’রে চমকে লাফিয়ে ওঠে, সুষমা তেমনি ক’রে চমকে উঠে’ আমার দিকে তার বড় বড় করুণ চোখ দুটো তুলে তাকালে, তারপর কান্না-ভেজা সুরে বল্লে - বাবার দুঃখ বাঁচাতে গিয়ে তোমার শান্তি নষ্ট করলুম- সে জন্যে আমায় মাপ ক’রো নীহার-দা। কিন্তু তুমি যে এত রাত্রিতেও ঘুমোওনি সে তো আমি জানতুম না।
আমি বললুম - জীবনে শান্তিই তো সব চেয়ে বড় জিনিষ নয়। কিন্তু কি তোর এত ব্যথা, যা জ্যোৎস্নার চোখেও জলের রেখা টেনে দিয়েছে? ভাইয়ের কাছে কোনো কথা লুকুস নে সুষমা।
দেখলুম সুষমার মুখে সেই দীপ্তিটা ফিরে এসেছে, যে দীপ্তি তার কঠোর নিষ্ঠার ফল। সেই দীপ্তির ওপর ম্লান হাসির একটা রেখা টেনে দিয়ে সে বল্লে - কিন্তু আমার সব কথা তা বলবার মতো নয় নীহার-দা। নারীর এমন অপরাধও আছে যা ভাইয়ের কাছেও বলা যায় না।
-যে ভাই বন্ধুত্বের দাবী করে তার কাছে কিছু না লুকোলেও দোষ হয় না। আমাকে তোর গ্রামের আর দশজনের মতো মনে না করলেও তো পারিস।
প্রতিবাদের ভঙ্গিতে সজোরে মাথাটা নেড়ে সুষমা বল্লে- তা তো কোনো দিনই মনে করিনি। কিন্তু যার কলঙ্কের শেষ নেই, সে তার কলঙ্কের কথা কি করেই বা পুরুষের সামনে প্রকাশ করবে? কিন্তু তুমি যা জেনেছ সেই ঢের নীহার-দা। তার বেশী আর কিছু জানতে চেও না।
আমি বললুম - বেশ তা হয় না-ই জানতে চাইলুম - কিন্তু ঐ পরিত্যক্ত ছেলেটাকে ঘরে তুলে নিয়ে তুই মিথ্যা কেন লোকের লাঞ্ছনা নিজের ওপর টেনে আনছিস, তার কারণটাও কি ভায়ের কাছে ব্যক্ত করা যায় না?
সুষমার অশ্রু-সজল দৃষ্টিটা হঠাৎ যেন শুকিয়ে আগুনের মতো জ্বালাময় হ’য়ে উঠ্ল। তার পর সেই দৃষ্টিটা আমার মুখের ওপরে ফেলে সে বল্লে-যে শিশুটাকে আজ, আমি বুকে তুলে নিয়েছি, তোমরা হয় তো তার মা’র দুর্ব্বলতাটুকুই মাপ করতে পারছ্ না, কিন্তু আমিই জানি, এ দুর্ব্বলতা এ দেশের এক আধ জনের নয়, অনেকের ভেতরেই আছে। আর সে দুর্ব্বলতার জন্য জীবনের বাকী দিনগুলি ধ’রে তারা যে রকমের প্রায়শ্চিত্ত করে, তোমরা তার কল্পনাও করতে পার না। তোমাদের সমাজ বা আইনের হাতে এমন কোন্ দণ্ড আছে যা তার চাইতে কঠোর, যা সেই নিঃসহায় মা সহ্য করে,যে তার পুত্রকে নিতান্ত নিরুপায় হ’য়েই বিসর্জ্জন দিয়েছে। সব কাজের ফাঁকে, দিনের আলোকে, নিশীথ রাতের অন্ধকারে,যখন অসহায় পরিত্যক্ত শিশুটার মুখ তার মনে পড়ে, তখন সে যে পাগল হ’য়ে যায় না, সে তো তার নিজের প্রায়শ্চিত্তটাকে নির্ম্মম ভাবে সহ্য করবার জন্যেই। ব’লেই যেন একটা আকস্মিক ব্যথাকে দমন করবার নিমিত্ত বুকটাকে চেপে ধ’রে মাঠের মাঝখানেই সুষমা আবার ব’সে পড়ল।
তার সেই মূর্চ্ছাহত মুখের দিকে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলুম মনে নেই - কিন্তু তার কথা শুনেই আমার ভেতর চেতনা আসল। সুষমা আমাকে ডেকে বল্লে- ভয় নেই নীহার-দা, ব্যথাটা আমি সামলে নিয়েছি। কিন্তু এত রাতে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না ভাই, বাড়ী ফিরে যাও।
ধীরে ধীরে সুষমার মাথাটা স্পর্শ করে বললুম - তোর যে কি দুঃখ সে আমি বুঝেছি, ভাই, আর সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছি- দুঃখ তোকে খাঁটি সোনা ক’রেই রেখে গেছে - তার ভেতরে আর এতটুকুও খাদ নেই। তোকে ছুঁয়েই আজ শপথ করছি সুষমা-এ দেশে এই ধরনের অত্যাচারিত মাদের সন্ধান হয় তো পাবে না, কিন্তু এ জীবন আমি উৎসর্গ ক’রে দিলুম এই সব অজানা মায়ের নাম- গোত্রহীন ছেলেদেরই জন্য।
(‘কল্লোল’ পত্রিকা, কার্তিক, ১৩৩৩ )।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।