পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪
বারাণসী
হেমেন্দ্রকুমার রায়
[লেখক পরিচিতি : হেমেন্দ্রকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল কলকাতায়। আদি নিবাস কলকাতার পাথুরিয়াঘাটায়। পিতা রাধিকানাথ রায়। হেমেন্দ্রকুমার গভর্নমেণ্ট আর্ট কলেজ থেকে চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করেছেন। কর্মজীবনে সামরিক বাহিনীর হিসাব রক্ষা বিভাগের কর্মী ছিলেন তিনি। চোদ্দো বছর বয়স থেকেই হেমেন্দ্রকুমার সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। ১৯০৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘বসুধা’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘আমার কাহিনী’ প্রকাশিত হয়। হেমেন্দ্রকুমার প্রধানত কিশোর সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিত হলেও বড়দের জন্যও তিনি লিখেছেন। বিভিন্ন শ্রেণীর প্রায় দেড়শ গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। ছোটদের গোয়েন্দা ও রোমাঞ্চকর কাহিনীকার নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। গোয়েন্দা ও সহকারী হিসাবে তার সৃষ্ট চরিত্র জয়ন্ত-মানিক এবং বিমল-কুমার ও সেই সঙ্গে পুলিশ ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবু ছোটদের শুধু নয় বড়দের মনও হরণ করেছিল।
হেমেন্দ্রকুমারের প্রকাশিত গ্রন্থ : উপন্যাস – ‘আলেয়ার আলো’(১৩২৫); ‘জলের আলপনা’ (১৩২৬); ‘কালবৈশাখী’(১৯২১); ‘পদ্মকাঁটা’ (১৯২৪); ‘পায়ের ধূলো’ (১৯২৮); ‘রসকলি’ (১৩২৯); ‘ঝড়ের যাত্রী’ (১৩৩০); ‘ফুলশয্যা’; ‘পরীর প্রেম’; ‘মণিকাঞ্চন’; ‘পথের মেয়ে’; ‘মণিমালিনীর গলি’; ‘পঞ্চশরের কীর্তি’ ইত্যাদি। গল্প – ‘পসরা’ (১৩২২); ‘মধুপর্ক’ (১৩২৪); ‘সিঁদুর চুবরী’ (১৩২৮); ‘মাল্য চন্দন’ (১৩২৯); ‘বেনোজল’ (১৩৩১); ‘শূণ্যতার প্রেম’ (১৩৩৯) ইত্যাদি। নাটক – ‘ইভাদেবীর ভ্যানিটি ব্যাগ’; ‘ধ্রুবতারা’ (যতীন্দ্রমোহন সিংহের উপন্যাসের নাট্যরূপ, ১৯৩১); ‘প্রেমের প্রেমারা’ (প্রহসন ১৯২০) ইত্যাদি। অনুবাদমূলক উপন্যাস – ‘সুচরিতা’ (১৩২৮); ‘ভোরের পূরবী’ (১৯২৮)। কাব্যগ্রন্থ – ‘যৌবনের গান’; ‘সুরলেখা’; ‘ওমর খৈয়ামের রুবায়েৎ’। প্রবন্ধ ও জীবনী – ‘অভিনয় কলা ও রবীন্দ্রনাথ’; ‘সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র’; ‘নবযৌবনের কুঞ্জবনে’; ‘বাঙ্গালা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার’; ‘যাঁদের দেখেছি’; ‘এখন যাদের দেখছি’ ইত্যাদি। কিশোর সাহিত্য – ‘ছুটির ঘণ্টা’; ‘যখের ধন’; ‘আবার যখের ধন’; ‘অদৃশ্য মানুষ’; ‘আজব দেশে অমলা’; ‘কিংকং’; ‘দেড়শ খোকার কাণ্ড’; ‘হিমালয়ের ভয়ঙ্কর’; ‘দেবদূতের মর্ত্যে আগমন’; ‘সন্ধ্যার পরে সাবধান’; ‘পঞ্চ নদীর তীরে’; ‘গোয়েন্দা কাহিনী’; ‘জয়ন্তর কীর্তি’ ইত্যাদি। তার রচিত ‘সিঁদুর চুপড়ি’ গল্পটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়ে একটি সংকলণ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
সম্পাদনা – ‘রংমশাল’ (মাসিক); ‘নাচঘর’ (সাপ্তাহিক); ‘ছন্দা’ (সাহিত্য ও ললিতকলা); ‘শিশির’ (সাপ্তাহিক); ‘দীপালি’। এ ছাড়া ‘ভারতী’, ‘সঙ্কল্প’, ‘মর্ম্মবাণী’ প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
হেমেন্দ্রকুমার শুধু গল্প, উপন্যাস ও কবিতা রচনা করেছিলেন ভাবলে ভুল হবে। গীতিকার হিসাবেও তিনি যথেষ্ট খ্যাতিলাভ করেছিলেন । ১৯৩৩ সালে তার রচিত ‘নয়ন য’দিন রইবে বেঁচে’ ও ‘বঁধূ চরণ ধরে বারণ করি' গান দুটিতে কণ্ঠদান করেছিলেন স্বনামধন্য অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে। শিশিরকুমার ভাদুরীর ‘সীতা’ নাটকের নৃত্য পরিচালনাও করেছিলেন তিনি। এই নাটকের ‘জয় সীতাপতি সুন্দর তনু’ ও ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে’ গান দুটির গীতিকারও ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার এবং গান দুটি যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হেমেন্দ্রকুমার জন্মেছিলেন ১৮৮৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল,৭৫ বছর পরে ১৯৬৩ খ্রীষ্টাব্দের একই তারিখে তিনি লোকান্তরিত হন।] দীপক সেনগুপ্ত।
“ জয় কাশীজি-কী জয়! জয় কাশীজি-কী জয়! জয় কাশীজি-কী জয়!”
গাড়ী হইতে ঘন ঘন জয়ধ্বনি উঠিতে লাগিল। ট্রেণের কামরা হইতে মুখ বাড়াইয়া দেখিলাম, গাড়ী সেতুর উপর দিয়া ছুটিতেছে। স্বর্গের সিঁড়ির মত “বেণীমাধবের ধ্বজা ”, আকাশের নীচে বিপুল শূন্যতাকে যেন চুম্বন করিতে চাহিতেছে ! গঙ্গার ধবল স্রোতে তাহার ছায়া কম্পমান। দুধের ধারার মত সেই চপল জলের উপরে ঝুঁকিয়া পড়িয়া, প্রাচীন সভ্যতার জননী বারাণসী যুগযুগ ধরিয়া আপন মুখ আপনি দেখিতেছে !
প্রথম দৃষ্টিতেই সমস্ত সহরের আসল রূপাটি যেন চোখের উপরে ভাসিয়া উঠিল। একজায়গায়, একসময়ে চোখের পলক-না-পালটিতে নগরের সবটুকু যদি দেখিয়া লইতে চাও, তবে কাশীকে দেখ। কাশীর মত সহর, এই হিসাবে জগতের আর কোথাও আছে কিনা, জানি না; আর, এইজন্যই কাশীর সহিত পরিচিত হইবার জন্য আমরা এত উদগ্রিব।
এ বারাণসী মহাদেবের রাজত্ব; শুধু রাজত্ব বলি কেন, এখানে বারাণসীরূপে শিবই বুঝি মূর্ত্তিমান! পিনাকীর ললাটে অর্দ্ধচন্দ্র এবং কাশীও ঠিক আধখানা চাঁদের মতই দুধারে বাঁকিয়া আছে। সেই চন্দ্রাকৃতি বারাণসীর শিয়রে বসিয়া গঙ্গা, দিবারাত্র জলক্রীড়া করিতেছেন।
চঞ্চল কালস্রোতের মাঝখানে গিরিদ্বীপের মত বারাণসী স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া, - তাহার চরণ-তলে আসিয়া ধ্বংসের ঢেউ যেন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। জগতে কাশীর মত প্রাচীন জীবন্ত নগর এখন আর কোথাও নাই। কাশী, ব্যাবিলন, চ্যালডিয়ার সভ্যতা দেখিয়াছে, মিশরের সভ্যতা দেখিয়াছে, রোমের সভ্যতা দেখিয়াছে - ভাগ্য-নাট্যের কতবিচিত্র, কত বিখ্যাত, কত অশ্রুসিক্ত বিয়োগান্ত দৃশ্যের অভিনয় তাহার চোখের উপর দিয়া হইয়া গিয়াছে, লিখিত ও অলিখিত ইতিহাস তাহার সাক্ষী। হিন্দুধর্ম্মের মত হিন্দুসভ্যতাও নবীনের ভ্রুভঙ্গীতে কোনকালেই ভ্রুক্ষেপ করে নাই। মৃন্ময়-পাত্র যদি কাংস্য-পাত্রের গায়ে পড়িয়া তাহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে চায়, তবে কাংস্য-পাত্র কিছু না বলিলেও মৃন্ময়-পাত্র আপনা আপনি চুরমার হইয়া যায়। হিন্দুধর্ম্ম ও সভ্যতাকে ভাঙ্গিতে আসিয়াও অনেক ধর্ম্ম ও সভ্যতার ঠিক সেই দশাই ঘটিয়াছে। কাশীর সর্ব্বত্র তাহার স্পষ্ট প্রমাণ আছে। যাহারা হিন্দুধর্ম্মের এই দৃঢ় দুর্গকে আঘাত করিতে আসিয়াছিল ; কাশী তাহাদিগকে বাধা দেয় নাই। কাশী জয় করিতে পারিলেই সমস্ত হিন্দুধর্ম্মকে জয় করা হইবে,এই সত্যটা বুঝিতে পারিয়া বুদ্ধদেব এইখানেই প্রথম ‘ধর্ম্মচক্র’ প্রবর্ত্তন করেন। তেমন আঘাত হিন্দুধর্ম্ম আর কখনও পায় নাই। সে আঘাতে হিন্দুধর্ম্মের ভিত্তি নড়িয়াছিল বটে, কিন্তু আঘাতকারী আজ কোথায় ? বারাণসীতে বৌদ্ধধর্ম্ম আজ বাঁচিয়া নাই। আধুনিক সারনাথে সুধু তাহার কঙ্কাল পড়িয়া আছে। বৌদ্ধ-ধর্ম্মের পর আসিল মহম্মদের সশস্ত্র ধর্ম্ম । বারাণসী হইতে শিবের রাজ্যপাট তুলিয়া দিবার জন্য মোগলপাঠানেরা যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছিল ; এবং শিবকে অন্ততঃ কিছুদিনের জন্যও তাহারা যে সিংহাসনচ্যুত করিতে পারে নাই,এমনও নহে ; কিন্তু এত চেষ্টার পরেও মহম্মদের ধর্ম্ম এখানে টিকিল কৈ ?
দেবতাদের ভিতরে যথার্থ নির্ব্বিকার যদি কাহাকেও বলিতে হয়,তবে তিনি মহাদেব । এক দেবতাকে বেশী আদর করিলে অন্য দেবতাদের মুখভার হয়, এ সম্বন্ধে পুরাণে ঢের গল্প আছে। পুরাণে মহাদেবেরও এমন বদনাম কেহ রটাইয়াছেন কিনা জানি না ;- কেহ রটাইয়া থাকিলেও তাহা যে মিথ্যা, এ কথা নিশ্চয় বলিতে পারি; কারণ, শিব যেখানে একচ্ছত্র অধিপতি, সেই বারাণসীতে অন্য ধর্ম্মেরও প্রবেশ-নিষেধ নাই। শিবের কাশীতে, বিশ্বনাথের পাশেই তাঁহার মন্দির ছাড়াইয়া মসজিদের চূড়া আকাশ ছুঁইতে উপরে উঠিয়াছে। এখানে শিবমন্দিরের পাশে মসজিদ, মসজিদের পাশে বৈষ্ণব দেবতা, তাঁর পাশে রক্তের দেবী কালিকা, তাঁর পাশে খৃষ্টানের গির্জ্জা, তাঁর পাশে জৈন-মন্দির এবং অদূরে থাকিয়া বুদ্ধদেবও শান্ত, নতনেত্রে ধ্যানমগ্ন হইয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার যোগভঙ্গ করে এমন সাহস কাহারও নাই- এ এক বিচিত্র দৃশ্য, অদ্ভুত ব্যাপার ! দেবতাদের মাঝে মানুষ যে ব্যাবধান সৃষ্টি করিয়াছে, মহাদেবের নামমাহাত্ম্যে সে ব্যবধানও যেন অনেকটা সরিয়া গিয়াছে ! ‘গড’, ‘আল্লা’, বিশ্বনাথ, জগন্নাথ, কালী কৃষ্ণ, বুদ্ধ, জৈন এবং খৃষ্টান, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন, ব্রাহ্ম, শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত ও গাণপত্য, এখানে কাহারও ভিতরে ছাড়াছাড়ি নাই। হিন্দু যে কত উদার, তাহার ধর্ম্ম যে কূপমণ্ডুকের ধর্ম্ম নহে, বারাণসী ইহার সাক্ষ্য দিবে। ভেদ সুধু মূর্খ মানুষের মনে, জ্ঞানী ভেদজ্ঞানহীন, জ্ঞানের ক্ষেত্র বারাণসীতে তাই ঐক্যের পতাকা উড়িতেছে।
* * *
বারাণসী, মন্দিরের সহর। শিল্পচাতুর্য্যের জন্য হিন্দুর মন্দির-গুলি বিশ্ববিখ্যাত ; কিন্তু এখানকার দেবালয়ে স্থাপত্যের বিশেষত্ব বা কারুকার্য্যের নমুনা বিশেষ কিছুই নাই। দুচারটি হিন্দু-দেবালয়ে কিছু কিছু কারুকার্য্য আছে বটে , কিন্তু ভারতের অন্য অন্য স্থানের মন্দির শিল্পের সঙ্গে তুলনা করিয়া দেখিলে, এখানকার মন্দির একেবারে কাহারও চোখেই লাগিবে না। বিশ্বনাথের নিজ মন্দিরে বড়মানুষী আছে - কলা-নিপুণতা নাই। তাহার চূড়া ‘সোনায় বাঁধান’, গৃহতল ‘রৌপ্য মুদ্রায় বাঁধান’। কিন্তু আর কোনদিকে - কি উচ্চতাগৌরবে, কি শিল্পগৌরবে -বিশ্বনাথের মন্দির কলারসজ্ঞের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবে না। স্থাপত্য-শিল্পের দিক হইতে বিচার করিয়া দেখিলে বলা যায়, সৌন্দর্য্যে অন্নপূর্ণার মন্দির বিশ্বনাথের মন্দির অপেক্ষা অনেক শ্রেষ্ঠ।
ডাকাতে বিশ্বনাথের সর্ব্বস্ব বারংবার লুটিয়া লইয়াছে। বিশ্বনাথের প্রাচীন মন্দির আর নাই। কিছুদিন আগেও, বিশ্বনাথের আধুনিক মন্দিরের পাশেই প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পড়িয়া ছিল, কিন্তু এখন সে চিহ্ণটুকুও আর দেখা যায় না, পাণ্ডারা সে দুঃস্বপ্নের স্মৃতিকে সরাইয়া ফেলিয়াছে। অনেকে বলেন, বিশ্বনাথের মন্দিরে পুরাণ বিগ্রহও আর নাই, নূতন আসিয়া পুরাতনের স্থান দখল করিয়াছেন।
কাশীধামে এখনও যে মন্দিরগুলি দেখা যায়, সে গুলিরও কথা কোন প্রাচীন ইতিহাসে পাওয়া যায় না। দু-চারিটি মন্দির ছাড়া সেগুলির অধিকাংশই অধুনিক। প্রাচীন দেবধাম বারাণসীর এই অস্বাভাবিক আধুনিকতার কারণও,-দস্যুতা। ১১৯৪ খৃষ্টাব্দে আফগান দস্যুরা যখন সারনাথের বৌদ্ধ সঙ্ঘারাম ভস্মীভূত করিয়া দেয়, তখন বারাণসীর মন্দিরমালাও যে, তাহাদের শাণিত কৃপাণের আলিঙ্গন হইতে মুক্ত ছিল, এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। মোগলদের প্রথম রাজত্বকালে এবং আকবরের সময়ে, কাশীধামের মন্দিরগুলিকে আবার নূতন করিয়া গড়া হইয়াছিল। কিন্তু,ধর্ম্ম-দ্বেষী ঔরঙ্গজেবের শাসনকালে কাশীর সমস্ত মন্দির আবার ভূমিসাৎ করিয়া দেওয়া হয়। ভগ্ন মন্দিরের মালমসলা লইয়া মুসলমানেরা মসজিদ তৈয়ারি করে। পঞ্চগঙ্গা-ঘাটের প্রকাণ্ড মসজিদটি এইরূপেই নির্ম্মিত।
কিন্তু শিল্পের জন্য ত বারাণসীর গৌরব নয়! সমালোচকের চক্ষু লইয়া হিন্দু এ আনন্দধামে আগমন করে না। হিন্দু এখানে আসে, পথের ধূলায় মাথা লুটাইয়া, - চোখে প্রেমের অশ্রু এবং প্রাণে ভক্তির আভাস লইয়া। এখানে পদার্পণ করিলে তাহার জন্ম সার্থক হয়, এখানে মরিতে পারিলে পরলোকের সব ভয় ঘুচিয়া যায়। এখানে মৃত্যুর অর্থ - শবত্বপ্রাপ্তি নহে, শিবত্ব প্রাপ্তি।
শ্মশানেশ্বরের মহাশ্মশান হইতে ঐ যে অবিরত চিতা-ধূম উঠিয়া আকাশকে ধূমল করিয়া দিতেছে, উহা দেখিয়া হিন্দুর প্রাণ কখন কাঁপিয়া উঠে না। তোমরা সবাই বাঁচিতে, হাওয়া খাইতে এখানে আসিয়া, শিকরোলে স্বাস্থ্যনিবাসে বাস কর, - কিন্তু হিন্দু এখানে আসে বাঁচিতে নয়, মরিতে। একদিন দেখিলাম, রাস্তা দিয়া শব লইয়া যাইতেছে। বৃদ্ধের শব। ঘাড়টি একদিকে বাঁকিয়া আছে, হাতদুটি বুকের উপরে যোড়করা ;-বৃদ্ধ প্রার্থনা করিতে করিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছেন। আর, তাঁহার সেই মুখখানি ! সে মুখে যে সৌন্দর্য্য, যে শান্তি-তৃপ্তি, যে পবিত্র হাসি দেখিয়াছিলাম, আমি কি তাহা জীবনে ভুলিব ? মরণের এমন রূপ আমি আর কখন দেখি নাই। শববাহীরা ধীরে ধীরে যাইতেছে; দুপাশ হইতে নর-নারীরা শবের মুখ দেখিবার জন্য ঝুঁকিয়া পড়িতেছে আর বলিতেছে, "জয় বাবা বিশ্বনাথ", “ওগো আমার কবে এমন দিন হবে ”! “ধন্য মৃত্যু -ধন্য ভাগ্যবান ” !
শিবালয়গুলিতে কারুকার্য্য অল্প থাকিলেও, এখানকার অন্যান্য জায়গায় হিন্দুস্থাপত্যের অনেক নয়নমোহন নিদর্শন আছে। যেমন মহারাজ মানসিংহের মানমন্দির। ইহার গবাক্ষ-সংলগ্ন ছোট ছোট বারান্দাগুলি বাস্তবিকই দেখিবার জিনিষ। আমরা বাড়ীঘর তৈয়ারি করিবার সময়ে এমন সুন্দর আদর্শ ফেলিয়া, কেন যে কুৎসিত পাশ্চাত্য আদর্শ গ্রহণ করি, তাহা বুঝিয়া ওঠা দায়। আমাদের সৌন্দর্য্যজ্ঞান কি একেবারে লুপ্ত হইয়াছে ?
ভারতের অনেক বড় বড় সহরের নির্ম্মাণ-পদ্ধতিতে পাশ্চাত্য আদর্শের উৎকট অনুকরণ দেখা যায়, বারাণসীতে তাহা দুর্লভ; এ সহরটি একেবারে প্রাচ্য। পুরাতন বাড়ীঘরের কথা ছাড়িয়া দি,এখানে একালে তৈয়ারি বাড়ীগুলিতেও প্রতীচ্যের এতটুকু ভাব নাই। তবে, একটা বিষয়ে আমাদের রসগ্রাহিতা বড়ই ক্ষুণ্ণ হয়। তাহা আধুনিক শিল্পীদের মৌলিকতার অভাব। উপযুক্ত আদর উৎসাহের অভাবেই বোধ হয় আধুনিক শিল্পীদের পরিকল্পনায় প্রশস্ততা ও নূতনত্ব দেখিতে পাওয়া যায় না। তাহারা প্রাচীন আদর্শ হুবহু বজায় রাখিয়াছে বটে, কিন্তু সে আদর্শকে স্বাভাবিক নিয়মে ক্রমোন্নত করিতে পারে নাই। তাহাদের কারুকার্য্যে প্রচলিত রীতি-পদ্ধতির বাঁধা গৎ আছে, কিন্তু কল্পনার স্বাধীন স্ফুর্ত্তি নাই।
বারাণসীর রাজপথ কি বিচিত্র ! দুর্গাপূজার সময়ে নানাদেশের যাত্রিসমাগমে সাধারণ জনতার স্রোত একেবারে বন্যায় পরিণত হয়। বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, নেপালী, মারাঠি, উড়িয়া, মাদ্রাজী, গুজরাটি ও হিন্দুস্থানী - ভারতের প্রায় সকল প্রদেশের লোককেই এই বিপুল জনতার ভিতরে দেখিতে পাওয়া যায়।
তাহাদের পোষাকে রঙ্গের কি বাহার ! পথে পথে যেন চলন্ত রামধনু ছড়াইয়া পড়িয়াছে। খালি পায়ে, পবিত্র কাপড় পরিয়া অনেকে বিশ্বনাথের মন্দিরের দিকে ছুটিয়াছে - সকলকার মুখেই এক রব, - “বোম বোম মহাদেব,বোম বোম মহাদেব ”! রমণীরাও পূজা করিতে চলিয়াছেন । তাঁহাদের এক-একজনের রূপের ছটা কি ! রঙ্গিন কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে আলো-ছায়া নাচাইয়া, ভোমরার মত কাল সদ্যঃস্নাত চুলের রাশ এলাইয়া, তালে তালে চরণতালে পথে পথে যেন পদ্ম ফুটাইয়া, হাতে রঙ্গ-বেরঙ্গা নানান ফুলের সাজি লইয়া নতনেত্রে এই পরমসুন্দরী বিদেশিনী মন্দির-গামিনীরা চলিয়া যান - শরতের এক-একখানি হালকা মেঘের মত !
সময়ে সময়ে ভিড়ের ভিতরে ভক্তির জীবন্ত মূর্ত্তি নজরে পড়িয়া যায় । রাজপথে একদিন এক বুড়ীকে দেখিলাম । তাহার বয়স আশীর কম ত কিছুতেই হইবে না । কোমর ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, পা পড়িয়া গিয়াছে, ঘাড় নুইয়া গিয়াছে; একটি চোখ কাণা, অন্য চোখটিতেও বোধ করি বুড়ী ভাল দেখিতে পায় না। তাহার পরণে কয়লার মত ময়লা কাপড়, -সমস্তটাই ছেঁড়াখোড়া।
দুই হাতে ভর দিয়া, রাস্তার পুরু ধূলার উপরে দাগ আঁকিয়া বসিয়া বসিয়া কোনমতে সে পথ চলিতেছে, আর ক্ষীণ, কাতর স্বরে বলিতেছে, “ জয় বাবা বিশ্বনাথ ”, “ দয়া করে পায়ে রেখ বাবা, -হ্যাঁগা,আমার বাবার মন্দির কোনদিকে গা,ওগো,দেখিয়ে দাও না গা।”
আমি তাহাকে ধরিয়া কোনরকমে ভিড় ঠেলিয়া মন্দির পর্য্যন্ত লইয়া গেলাম। শুনিলাম, সে পথের ভিখারিণী । ভিক্ষা মাগিয়া অনেকদিন হইতে বড় কষ্টে রেলভাড়ার টাকাকয়টি যোগাড় করিয়াছে,- বাবা বিশ্বনাথের পাদপদ্মে জন্মের শোধ জীবনের পাপের বোঝা নামাইয়া দিবার জন্য।
মন্দিরের আঙ্গিনায় ঢুকিয়া বুড়ীকে আমি ছাড়িয়া দিলাম। বুড়ী আর এক-পা আগাইতে পারিল না, বিশ্বনাথের মূলমন্দিরের দিকে ক্ষণিকের জন্য চাহিয়াই ধুপ করিয়া সে চাতালের উপরে সাষ্টাঙ্গে গড়াইয়া পড়িল; একবার ডাক ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিল, তারপর স্তব্ধভাবে স্থির হইয়া রহিল। অন্তরের মধ্যে সে বিশ্বনাথের সাড়া পাইতেছিল কি ?
আমি যতক্ষণ দাঁড়াইয়াছিলাম, বুড়ীকে তত্ক্ষণ উঠিতে দেখি নাই। বোধ হয়, মনের মাঝে ভাবের ঘরে তখন সে বিশ্বনাথের পা জড়াইয়া মনে মনেই বলিতেছে, "ঠাকুর ! পা যখন ধরেছি, তখন আর ছাড়ব না গো, ছাড়ব না !"
মন্দিরে সেদিন অনেক ভক্ত আসিয়াছিল,- তাহাদের অনেকের মুখে চোখে আভাস ছিল যতটা কম, টাকার উত্তাপ ছিল তা’র চেয়ে ঢের বেশী; কিন্তু স্বর্গে যদি বিশ্বনাথের ভক্তের তালিকা লইবার কেহ থাকেন, তবে সেদিনকার তালিকায় সবার বাড়া ভক্ত বলিয়া প্রথম স্থান পাইয়াছিল, ঐ বৃদ্ধা ভিখারিণী !
* * *
বিশ্বনাথের আরতির ঘটা দেখিবার ব্যাপার বটে। অগস্ত্য-কুণ্ডে তাঁহার একদল সেবাইত বাস করেন। তাঁহাদের দেহ-মন-প্রাণ বিশ্বনাথের চরণে একান্তভাবে সমর্পিত। সারাদিন ধরিয়া তাঁহারা মহাদেবের আরতির আয়োজন লইয়া ব্যস্ত থাকেন। রাত্রিকালে তাঁহারা যখন আরতির উপকরণ লইয়া “ বোম বোম মহাদেব ” বলিয়া বিশ্বনাথের নাম-কীর্ত্তন করিতে করিতে মন্দিরের দিকে অগ্রসর হন, তখন তাঁহাদের উদাত্ত কণ্ঠের অনাহত ধ্বনি বারাণসীর পথে পথে বহুদূরে ছুটিয়া যায়। সেই গম্ভীর আহ্বানে শত শত ভক্ত ঘর ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া দাঁড়ান এবং সেবাইতদের পিছনে পিছনে দলে দলে মন্দিরের দিকে গমন করিতে থাকেন।
বিগ্রহের মাথায় ঘড়া ঘড়া দুধ ঢালিয়া, আগে তাঁহাকে স্নান করান হয়। তারপর বিশ্বনাথের মূর্ত্তিকে চন্দনে চর্চ্চিত করিয়া রাশি রাশি বিল্বপত্র, ফুল ও ফুলের মালায় তাঁহাকে সাজাইয়া দেওয়া হয়। এত চন্দন আমি জীবনে কখন এক জায়গায় দেখি নাই। তারপর আরতি।
আরতির সময়ে মন যেন কেমন-কেমন করিতে থাকে ! সে যে কি ভাব, তাহা লিখিয়া ফুটান' যায় না, যা’র যথার্থ প্রাণ আছে, কেবল তিনিই তাহা অনুভব করিতে পারিবেন। চারিদিকে ভক্তেরা দাঁড়াইয়া, অনেক গৃহতলে দণ্ডবৎ হইয়া প্রণত অবস্থায়, কেহ যুক্তকরে বিগ্রহের দিকে নিষ্পলকনেত্রে চাহিয়া, কেহ দুইচোখ বুজিয়া প্রাণের ভিতরে ঠাকুরকে দেখিতেছেন, কেহ কেহ “বিশ্বনাথজী কী জয়” বলিয়া বাহ্যজ্ঞান হারাইয়া নৃত্য করিতেছেন, কেহ জপাসনে বসিয়া আপন মনে জপ করিতেছেন, কেহ দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শিশুর মত কাঁদিয়া ফেলিতেছেন ! হিন্দুধর্ম্মের অপূর্ব্ব দেবতা সেই কৈলাসপতি অথচ শ্মশানেশ্বর, গৃহস্থ অথচ বৈরাগী, শান্ত অথচ রুদ্র দেবাদিদেব মহাদেবের পূজামণ্ডপের ভিতরে দাঁড়াইলে সংসার-চিন্তা দূর হইয়া যায়, ধনের দামামা এবং অভাবের হাহাকার যুগপৎ থামিয়া যায়, ধূপধূনা-চন্দন-পুষ্প-সৌরভে, গম্ভীর-পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণে, আরতিবাদ্যনিনাদে স্বর্গ যেন নামিয়া আসিয়া মর্ত্ত্যকে ‘রাখীর বাঁধনে’ বাঁধিয়া দেয়।
আরতির বাজনা থামিয়া গেল। ভক্তদের ভক্তিনত ললাট মর্ম্মরবিচিত্র মন্দির-তলকে স্পর্শ করিল। চারিদিক স্তব্ধ।
যখন ফিরিলাম, কে তখন ধ্রুপদ ধরিল:-
"মহাদেব শিবমঙ্গল
পিনাকী ত্রিপুরারে-"
* * *
বাঙ্গালার বাহিরে কাশীধামে বাঙ্গালীর সংখ্যা যত বেশী, তত আর কোন সহরে নয়। বাঙ্গালার বাহিরে পা দিলে, বাঙ্গালীর প্রাণপাখী প্রায়ই খাঁচা-ছাড়া হইবার যোগাড় করে। বিদেশ বলিতেই আমাদের চোখে ‘ডালপুরী’ আর ‘পুরীর’র ছবি ভাসিয়া উঠে। কিন্তু কাশীতে সে সব আপদ-ল্যাঠা কিছুই নাই। বাঙ্গালীর যা কিছু দরকার, কাশীতে সে সবই পাওয়া যায়। সুধু ‘পাওয়া যায়' নয়, সব জিনিষই বেজায় সস্তা । তাই, ভুঁড়ি ক্ষীণ হইবার ভয়ে যাঁহারা বিদেশের প্রতি নেহাৎ নারাজ, কাশীর নামে তাঁহাদেরও জিভ রসাল হইয়া উঠে। এখানে আসিয়া বাঙ্গালীরা সুধু যে পুণ্য-সঞ্চয় করেন,তা নয়,ঘি-দুধ-মাছ খাইয়া,আরামভরে ভরা পেটে হাত বুলাইয়া,দুদিন সুদীর্ঘ "আঃ !" উচ্চারণ করিয়া বাঁচেন।
বাঙ্গালায় বসিয়া চিরকাল শুনিয়াছি, কাশীধামে নাকি ভয়ানক গুণ্ডার উপদ্রব! কিন্তু যতবার কাশীতে আসিয়াছি, গুণ্ডার উপদ্রব কখন দেখি নাই - দেখিয়াছি সুধু আমাদেরই স্বদেশী বাঙ্গালীর উপদ্রব।
জিনিষ-পত্র সুলভ ও তীর্থক্ষেত্র বলিয়া বাঙ্গালী কেরাণীরা বুড়াবয়সে ‘পেন্সন’ লইয়া কাশীতে আসিয়া জীবনের শেষ ক’টা দিন বেশ শান্তি ও নির্ঝঞ্ঝাটে কাটাইয়া দেন। প্রতি মাসের পয়লা তারিখে যেদিন ‘পেন্সন’ আসে, স্থানীয় ডাকঘরের দৃশ্য সেদিন ভারি মজার হইয়া উঠে। ডাকঘরের সামনেটিতে সেদিন খালি বুড়া আর বুড়ালোকই দেখা যায়-সকলেরই মাথায় শাদা চুল, সকলেরই গা-মুখের চামড়ায় কুঞ্চন-রেখা পড়িয়াছে। তাঁহারা ‘পেন্সন’ লইতে আসিয়াছেন।
কাশীতে বড় রাজপথ গুটিকত, কিন্তু সরু সরু গলি একেবারে অগুন্তি । গলিগুলি সব পাথরে বাঁধান, মাঝে মাঝে আবার সিঁড়ি আছে । সরু সরু বলিয়া জনতা কিছু কম হয় না। সময় সময় ভিড়ের ঠেলায় পথচলা দায় হইয়া উঠে । পথ যেমন ছোট, দুধারকার বাড়ীগুলি তেমনই বড় আর অত্যন্ত উচ্চ। কাশীতে যিনি নূতন আসিবেন ও একলা বেড়াইতে বাহির হইবেন, তিনি অন্ততঃ একবার না একবার পথ হারাইতে বাধ্য ! এই পথ-হারাণ কাশীর একটি বিশেষত্ব !
কাশীর গলিপথে মহাদেবের প্রিয় বাহন ষণ্ডদলের বিষম আধিপত্য। বিনাশ্রমে দিব্য আহার পাইয়া ষাঁড়গুলি দিনে-দিনে মোটা-সোটা ও বেজায় বড় হইয়া উঠে। মনের খুশিতে তাহারা পথে পথে বেড়াইতে বাহির হয়। নেহাৎ-সরু গলির মাঝে যখন ষণ্ড-দেবতার ‘নাদুস-নুদুস’ চেহারাখানি নজরে পড়ে, পথিককে তখন প্রয়ই তাড়াতাড়ি সসম্মানে পিছু হটিয়া সে গলি ছাড়িয়া বাহিরে গিয়া দাঁড়াইতে হয়। শিবের বাহন যতক্ষণ না দয়া করিয়া গলি ছাড়িয়া বাহিরে আসেন, গলির ভিতরে ততক্ষণ তোমার "no admittance !"
* * *
বারাণসীর অদূরে ঋষিপত্তন বা মৃগদাব-কানন বা সারনাথ। তাহা বৌদ্ধ-কীর্ত্তির মহা চিতা । সে চিতা কবে নিবিয়াছে, কিন্তু ভস্মকণা এখনও আছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা সারনাথের অনেক কথা বলিয়াছেন । পত্রান্তরে আমিও কয়েক বৎসর আগে সারনাথের একটি ধারাবাহিক বিস্তৃত ইতিহাস দিয়াছি; সুতরাং, উপস্থিত প্রবন্ধের সম্পূর্ণতাকল্পে পুনরুক্তি না করিয়া সংক্ষেপে দু’চার কথা বলিব মাত্র।
যেখানে নদীর জল-বীণায় চপল বাতাস মধুর তান তুলিয়াছে, যেখানে শ্যামল বনের শীতল ছায়ায় দুর্ব্বাদলেরা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে, যেখানে তপোবনের শান্তিভঙ্গ করিবার ভয়ে পৃথিবীর কোলাহল আপনা-আপনি থামিয়া গিয়াছে, সেখানে ‘ধামেকে’র উচ্চ ও প্রাচীন স্তূপ এখনও চারিদিকে ভাঙ্গা-চোরা বৌদ্ধ-মঠের মাঝখানে নীরব ও অটল হইয়া দাঁড়াইয়া আছে ।
বুদ্ধদেব বুঝিয়াছিলেন, হিন্দুধর্ম্মকে আক্রমণ করিতে হইলে, কোনখানে তাহার হৃদয়, আগে সেটা দেখিতে হইবে। হিন্দুর ধর্ম্ম ও শিক্ষার কেন্দ্র বলিয়া বারাণসী চিরকাল বিখ্যাত। অতএব, বুদ্ধদেব সর্ব্বপ্রথমে এখানে আসিয়া ধর্ম্মপ্রচার সুরু করিলেন ।
হরিণদলের বিচরণ ভূমি বলিয়া তখন এ জায়গাটির নাম ছিল, ‘মৃগদাব’-কানন। বুদ্ধদেবের অহিংসা ধর্ম্মের আশ্রয়ে মৃগ-পরিবারেরা নির্ভয়ে এখানে বেড়াইয়া বেড়াইত; কিন্তু এখন বৌদ্ধধর্ম্মের অতীত প্রভাবের সঙ্গে সঙ্গে, তাহার আশ্রিত মৃগকুলও অদৃশ্য হইয়াছে। শিকারীর নিষ্ঠুর আনন্দে তাহাদের অনেকে অন্তিম নিঃশ্বাস ছাড়িয়াছে; বাদ-বাকী যাহারা ছিল, নিরাপদ আশ্রয় খুঁজিতে তাহারা যেখানে ‘ঈশ্বরের সেরা সৃষ্টি’ মানুষ নাই, সেইখানে পলাইয়াছে। মৃগদাব আজ মৃগহীন।
বুদ্ধদেবের পবিত্র স্মৃতি পূজা করিবার জন্য ‘ধামেক’-স্তূপ নির্ম্মিত হইয়াছিল । সংস্কৃত ‘ধর্ম্ম-দেশক’ হইতে ‘ধামেক’। স্তূপটির এখনকার উচ্চতা ১১০ ফিট। আগে হয়ত আরও উঁচু ছিল। স্তূপের উপরটা আগে ভাঙ্গা দেখিয়াছিলাম; কিন্তু, এবার গিয়া দেখিলাম, স্তূপ-শীর্ষ হইতে বন্য লতা-পাতার মুকুট সরাইয়া আবার তাহা মেরামত করা হইয়াছে।
এই স্তূপের ছায়ায়, সহরের মত বিশাল এক শিল্পবিচিত্র বৌদ্ধ-মঠ ছিল। সেখানে শত শত ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী বাস করিতেন। প্রাচীন ভ্রমণকারী এবং প্রত্নতাত্ত্বিকগণের পুস্তকে এই স্তূপ ও মঠের যে উজ্জ্বল বর্ণনা পাওয়া যায়, তাহাতে বুঝিতে পারি, ইহার শ্রী-ছাঁদের কাছে একদিন ‘ময়দানবের পুরী’ ও বুঝি হার মানিত। যুগ-যুগ ধরিয়া বৌদ্ধ রাজগণ মঠের গায়ে স্বপ্নের মত যে লাবণ্য দিয়াছিলেন, আজ তাহা কোথায় ? অশোক ও কণিষ্কের এত যত্ন, এত চেষ্টা ও এত অর্থব্যয়-সব মিছা হইয়াছে। অতীতের সে ‘কুসুমিত নাট্যশালা’, বর্ত্তমানে ভগ্নচূর্ণ, দুঃখস্তব্ধ, অন্ধকারাচ্ছন্ন !
বৌদ্ধ যতিরা আপনাদের ‘জপ-তপ আর যোগ-আরাধনা’ লইয়াই তুষ্ট ছিলেন। ভিক্ষা-লব্ধ অন্ন খাইয়া, জীবের সেবায় তাঁহারা প্রাণ-মন সমর্পণ করিয়াছিলেন, সংসারের সাতে-পাঁচে কিছুতেই তাঁহারা থাকিতেন না। সহসা একদিন নিয়তির কঠোর পরিহাসে সশস্ত্র পাঠান আসিয়া মঠের দরজা জুড়িয়া দাঁড়াইল। এই অপূর্ব্ব অতিথি, বৌদ্ধ যতিদের করুণ আবেদনে কর্ণপাত করিল না। মঠে তাহারা আগুন ধরাইয়া দিল এবং নির্ব্বিরোধ, অহিংসা-মন্ত্রে দীক্ষিত, বিশ্বপ্রেমিক ভিক্ষুগণের জীবন লইয়া তাহারা অগ্নিকে আহুতি-প্রদান করিল। ভিক্ষুরা নির্ভয়ে বুদ্ধের নামোচ্চারণ করিয়া আগুনের ভিতরে গিয়া পড়িলেন। তাঁহাদিগকে ‘পরিনির্ব্বাণের’ পথ দেখাইয়া হুতাশনও নির্ব্বাণ লাভ করিল।
অগ্নি-স্রোত, মঠগাত্র হইতে সকল শ্রী ধুইয়া,তাহার যা-কিছু গৌরবের,সব নষ্ট করিয়া দিয়াছিল । ধূ-ধূ-প্রান্তর জুড়িয়া দগ্ধাবশিষ্ট বিশাল কঙ্কালের মত যাহা পড়িয়া রহিল, পৃথিবী তাহাকে সমাধিদান করিল। সদাশয় গবর্ণমেন্ট, এতদিন পরে মাটি খুঁড়িয়া সেই কঙ্কাল আবার আকাশের আলোকে বাহির করিয়াছেন। অতীতকে যাঁহারা ভালবাসেন, তাঁহাদের জন্য এখানে এক প্রশস্ত যাদুঘর নির্ম্মিত হইয়াছে। সেই ভীষণ দুর্ঘটনায় ও কালপ্রভাবে যে সকল জিনিষ এখনও নষ্ট হইয়া যায় নাই, এই অট্টালিকায় সেগুলি সারি সারি সাজান আছে। কাপড়ের শুষ্ক রক্তে জলের ছিটা দিলে তাহা যেমন ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠে, এই যাদুঘরের সজ্জা-কৌশল তোমার মনের পটে অতীতকে তেমনই করিয়া ফুটাইয়া তুলিবে। সেকালকার বৌদ্ধ-মঠের শিল্প-চাতুরী, যতিগণের নিত্য-ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদি, প্রতিদিনের জীবন-যাত্রা প্রণালী প্রভৃতি যাহা কিছু জানিবার এখানে আসিলে সে সবই জানিতে পারা যায়।
‘ধামেক’ স্তূপের গায়ে, দু’এক জায়গায় সেই বিশ্বমোহন কারুকার্য্যের চিহ্ণ এখনও কিছু কিছু আছে। আর, সেই অপূর্ব্ব সুন্দর অশোক-স্তম্ভ ! এখন তাহা খণ্ড খণ্ড হইয়া গিয়াছে বটে-কিন্তু এ অবস্থাতেও তাহার সমস্ত সৌন্দর্য্য নিঃশেষ লুপ্ত হইয়া যায় নাই। কঠিন পাথরের উপরে যে শিল্পীরা এমন দর্পণের মত মসৃণতা, এমন ফুলের মত কোমলতা, এমন মোহন-সুন্দর খোদনপটুতা অর্পণ করিয়াছিল, ভারতবর্ষে তাহাদিগকে আর কখনও দেখিতে পাইব কি ?
অদূরে আর একটি পাহাড়ের মত স্তূপ। তাহার উপরে হুমায়ূন একটি বাড়ী তৈয়ারি করিয়া দিয়াছিলেন। এই বাড়ীর ছাদে দাঁড়াইলে, চারিদিকের দৃশ্য ছবির মত জাগিয়া উঠে। সুদূরে চক্রবালের বক্র রেখায় বিন্ধ্যাচলের ধূমল ভিত্তি, চারিদিকে বৈচিত্র্যের রাজ্যের মত, বাতাসে রোমাঞ্চিত শস্যক্ষেত্রের পর শস্যক্ষেত্র, মাঝে মাঝে পাখী-ডাকা হাজার গাছের ছায়ামাখা রাঙ্গা রাঙ্গা মেঠো পথ। স্তব্ধ দুপুরে মাঠে মাঠে রোদ আর ছায়ায় যখন লুকাচুরি খেলা চলে, হাওয়া যখন নিজে ঘুমে ঢুলিয়া থামিয়া থামিয়া ঘুম-পাড়ানিয়া গান গায়িতে থাকে, ঘুঘুও তখন দূরের গভীর বন হইতে করুণ, ঘুমন্ত সুরে প্রাণ-মনকে উদাস করিয়া, -বুকের ভিতরে এলাইয়া দেয়।
* * *
কাশীর গঙ্গা !
বিশ্বনাথের চরণে জলাঞ্জলি দিয়া দিবারাত্র পবিত্রসলিলা জাহ্নবী দুলিতে দুলিতে বহিয়া যাইতেছেন । এধারে প্রাসাদের চূড়ার পর প্রাসাদের চূড়া, মন্দিরের পর মন্দির, ঘাটের পর ঘাট ! ওধারে রবিকরোজ্জ্বল শুভ্র সিকতার দীর্ঘ বিস্তার, তা’র পাশে রামনগর যেন চিত্রে লেখা, তা’র পিছনে সবুজ বনের নতোন্নত চঞ্চল রেখা । উপরে আকাশের অগাধ নীলিমা, গঙ্গার ধবলতাকে আপন ছায়াপাতে রঙ্গিন করিয়া তুলিয়াছে ।
চিত্র-১ : শিবালা ঘাট। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই বা ২২ শে নভেম্বর উইলিয়ম ডানিয়েল অঙ্কিত প্রতিকৃতি।
নৌকার পর নৌকা, পাল তুলিয়া পরীর মত নাচিতে নাচিতে চলিয়াছে। নৌকার লোকেরা ঘাটের দিকে তাকাইয়া, ঘাটের লোকেরা নৌকার দিকে তাকাইয়া। কোন নৌকায় একজন সাহেব বসিয়া বিস্মিত নেত্রে বারাণসীর বৈচিত্র্য দর্শন করিতেছে, কোন নৌকায় বা একদল পূণ্যপ্রয়াসী বাঙ্গালী রমণী, - তাঁহারা কাশী প্রদক্ষিণ করিতে বাহির হইয়াছেন। কোন কোন নৌকা তালে তালে দাঁড় ফেলিয়া তীরে লাগে, আর ভিতর হইতে কতকগুলি পশ্চিমা পুরুষ ও রমণী বাহির হইয়া ঘাটে আসিয়া নামিয়া পড়ে, পুরুষগুলি লাঠির ডগায় ময়লা কাপড়ের পোঁটলা-পুঁটুলি বাঁধিয়া লয় এবং রমণীরা নীল ঘাঘরার উপরে, গোছা-গোছা রূপার চুড়ী-পরা, ‘উল্কি’-আঁকা স্বাস্থ্যপুষ্ট হাত-দু-খানি আন্দোলিত করিয়া, জরি-বসান' লাল ওড়নাখানি একবার শূন্যে ছড়াইয়া, টানিয়া দেয়; তারপর দল বাঁধিয়া ঘাটের সিঁড়ি পার হইয়া সাগরে বারি-বিন্দুর মত জনতার মধ্যে কোথায় মিশিয়া যায়। এদিকে মাঝিও নৌকাখানিকে গভীর জলে ঠেলিয়া দিয়া, নিজেও একলাফে তাহার উপরে চড়িয়া বসে।
চিত্র-২ : মণিকর্ণিকা ঘাট, ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দ।
নদীর জলে ডুবিয়া নদীকে যেমন দেখা চলে না, নদীকে দেখিতে হইলে জলের উপরে থাকিতে হয়, কাশীকে
দেখিতে হইলেও তেমনই ভিতরে থাকিলে চলিবে না, দর্শককে বাহিরে আসিতে হইবে। গঙ্গার বক্ষে চলন্ত নৌকায় থাকিয়া কাশীকে যে কি চমৎকার দেখায়, তাহা আর বলিবার নয়। ‘বায়স্কোপে’র ছবির মত কাশীর অভিরাম দৃশ্যবলী তখন চোখের সুমুখ দিয়া ধীরে ধীরে, পরে পরে চলিয়া যাইতে থাকে।
চিত্র-৩ : দশাশ্বমেধ ঘাট , ১৮৮৩।
ঐ দশাশ্বমেধ ঘাট, ঐ মণিকর্ণিকা ঘাট, ঐ শীতলা ঘাট ! ওখানে বিশ্বনাথের মন্দিরে, এখানে কেদারনাথের মন্দির (প্রবাদ বলে, কেদারনাথই আদি বিশ্বনাথ ) সেখানে চেৎসিংহের প্রস্তর নির্ম্মিত প্রাসাদ ও দুর্গ ! কোথাও একটি মন্দির আকণ্ঠ জলে ডুবিয়া আছে, কোথাও-বা একটি পুরাণ' উঁচু ঘাট ভাঙ্গিয়া পড়'পড়' হইয়া জলের উপরে ঝুঁকিয়া রহিয়াছে ! ইহারই মাঝে মাঝে গবাক্ষের মত এক-একটি অবকাশ সহসা সামনে আসিয়া, পর পলকেই সরিয়া যায় এবং সেই অল্প সময়ের ভিতরেই বর্ণবহুল পরিচ্ছদধারী অসংখ্য জনতাপূর্ণ সজীব পথগুলি বিদ্যুতের মত নজরে আসিয়াই অদৃশ্য হয়। পর মুহুর্ত্তেই আবার যাদুকরের যাদুর মত নূতন ঘাট, নূতন মন্দির, নূতন প্রাসাদ, নূতন পথ ! এ যেন ঠিক ‘আরব্য-রজনীর’ গল্পের পর গল্প-দৃশ্য,- একটি গল্প শেষ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার একটি গল্প - মন আর হাঁপ ছাড়িবার অবকাশ পায় না !
ঘাট গুলিতে অসংখ্য তালপাতার ছাতা। তাহার ছায়ায় পাণ্ডারা বসিয়া আছে। যাত্রীরা দলে দলে আসিতেছে, প্রণাম করিয়া ভক্তিভরে জলে নামিতেছে, স্নান করিয়া আবার উঠিয়া যাইতেছে। কেহ কেহ নতশিরে, আকটি জলে দাঁড়াইয়া জপ করিতেছে, কেহ-বা ঊর্দ্ধমুখে যুক্তহস্তে ঊর্দ্ধে তুলিয়া সূর্য্যের দিকে চাহিয়া ভক্তিভরে গম্ভীর স্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করিতেছে।
ঘাটের চাতালে সন্ন্যাসীর দল বসিয়া আছেন- শরীর প্রায় উলঙ্গ ভস্মমাখা, মাথার পিঙ্গল জটা স্কন্ধচুম্বন করিতেছে। কোন সন্ন্যাসী ঘাড় বাঁকাইয়া, হাতে কলিকা লইয়া ধূমপান করিতেছেন, কেহ পদ্মাসনে সরল ও নিশ্চল হইয়া বসিয়া, দুই হাঁটুতে দুই হাত রাখিয়া মুদিতনেত্রে স্তব্ধভাবে ধ্যানমগ্ন, - হঠাৎ দেখিলে ভ্রম হয়, বুদ্ধের পাষাণ-মূর্ত্তি ! কেহ এই কাঠ-ফাটা রোদে চারিদিকে অসহনীয় অগ্নিকুণ্ড রাখিয়া ভীষণ কৃচ্ছ্রসাধন করিতেছেন। কেহ কেহ শিষ্যবর্গের মধ্যে বসিয়া ধর্ম্মোপদেশ দিতেছেন।
এই বিচিত্র দৃশ্যাবলীর মাঝে, জাহ্নবীর অবিরত জল-কল্লোলের সঙ্গে, সম্মুখের মানব-মক্ষিকার ঐ বিরাট-বিপুল মধুচক্র হইতে যে অনন্ত গম্ভীর গুঞ্জন উঠিতেছে, তাহা শ্রবণে পশিয়া কেমন এক অপূর্ব্ব বিস্ময়ের ভারে সমগ্র হৃদয়কে যেন আচ্ছন্ন ও অভিভূত করিয়া দেয় !
চিত্র-৪ : বারাণসীর রাস্তা, ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত ফটো।
বিশ্বনাথের বারাণসী ! অন্নপূর্ণার আনন্দধাম ! পৃথিবীতে এমন কোন লেখক আছেন, যিনি তাঁহার সমস্ত সৌন্দর্য্য ও রসকে নীরস ভাষায় ফুটাইয়া তুলিতে পারেন ? যিনি পারেন, তিনি আসুন, আমার কলম এখানে শক্তিহীন।
* * *
সন্ধ্যাকাল । পশ্চিমে দিনের চিতা নিবিয়া গিয়াছে।
আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে; সে আলো জলে পড়িয়া, জলকে যেন জ্যোৎস্না-স্রোত করিয়া তুলিয়াছে। ওপারের দীর্ঘ সৈকত চন্দ্রালোকে শাদা ধব ধব করিতেছে।
মন্দিরে মন্দিরে ঘোর-রোলে কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়া উঠিল, গভীর ফুৎকারে শঙ্খের কণ্ঠে সুদূর জলধির সঙ্গীত বাজিতে লাগিল। আরতির পর চারিদিক স্তব্ধ।
কেদার নাথ ঘাটে কমল করে প্রদীপ ধরিয়া মহিলারা জলের ধারে নামিয়া আসিলেন। দীপগুলি কাঁপিতে কাঁপিতে ভাসিয়া গেল। খানিকক্ষন সেইদিকে চাহিয়া থাকিয়া, তাঁহারা একে একে ভরা কুম্ভ ‘কাঁখে’, করিয়া মধুর, ললিত ভঙ্গীতে সোপান বহিয়া উপরে উঠিয়া, গৃহপথে চলিলেন।
অদূর ঘাটে বসিয়া কথক-ঠাকুর রামায়ণ-কথা সুরু করিলেন। তাঁহার চারিপাশে পুরুষ ও রমণী শ্রোতার দল যোড়হস্তে বসিয়া সীতা-রামের কাহিনী শুনিতে শুনিতে তন্ময় হইয়া গেল।
জলের উপরে এক উচ্চ ও প্রশস্ত স্তম্ভ রহিয়াছে। তাহার শীর্ষে মূর্ত্তিমান রহস্যের মত এক বিশালবপু পুরুষ উপবিষ্ট। তাঁহার পরিধানে গৈরিক বসন ও উত্তরীয়। তাঁহার মুখের একদিকে চাঁদের আলো, অন্যদিকে ছায়া। তাঁহার পাশে কমণ্ডলু । একমনে,বক্ষের কাছে দুই হস্ত তুলিয়া, বাহ্যজ্ঞানহারা হইয়া স্থিরভাবে তিনি যোগমগ্ন। তাঁহার হৃদয়ের ভক্তি যেন আমার প্রাণে আসিয়া জাগিয়া উঠিল! ভক্তি কি সংক্রামক ?
চারিদিকে তপোবনের সেই গভীর শান্তি লইয়া, আকাশের চাঁদের সেই ঘুমন্ত ‘চাদনী’র নীচে, গঙ্গার বুকে তরঙ্গের সেই তালে তালে করতালি শুনিতে শুনিতে এবং সম্মুখে ধ্যানী যোগীর সেই অটল-মূর্ত্তি দেখিতে দেখিতে, ঘাটের সোপানে হেলান দিয়া আমি ধীরে ধীরে ঘুমঘোরে আচ্ছন্ন হইয়া গেলাম।
প্রদত্ত চিত্রগুলি মূল রচনা থেকে নেওয়া হয় নি। এগুলি বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত।
সৌজন্য - দীপক সেনগুপ্ত
( ‘মর্ম্মবাণী’ সাপ্তাহিক পত্রিকা, ২৩শে ভাদ্র ১৩২২ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।