প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ

ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৫

 

আখ্যান মালা

কুমারী হেমলতা দেবী


  [ লেখক পরিচিতি :  ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট নেতা শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রথম সন্তান হেমলতার জন্ম ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে জুন (১১ই আষাঢ়, ১২৬২ বঙ্গাব্দ) দক্ষিণ ২৪ পরগনার মজিলপুর গ্রামে। হেমলতার মা ছিলেন শিবনাথের দ্বিতীয়া পত্নী বর্ধমান জেলার দেপুর গ্রামের অভয়াচরণ চক্রবর্তীর জ্যেষ্ঠা কন্যা বিরাজমোহিনী। ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থে শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন –“ অগ্রেই বলিয়াছি, আমরা দাক্ষিণাত্য বৈদিক কুলজাত কুলীন ব্রাহ্মণ। আমাদের মধ্যে তখন কুলসম্বন্ধের প্রথা ছিল। তদনুসারে হেমলতার শৈশবেই বিবাহ সম্বন্ধ স্থির করিবার কথা। আমি সে পথে বিরোধী হইলাম। তাহার বিবাহ সম্বন্ধ করিতে নিষেধ করিয়া বাবাকে পত্র লিখিলাম। তাহাতে বাবা কুপিত হইলেন। আমার নিষেধ গ্রাহ্য করিলেন না। আমার অজ্ঞাতসারে গোপনে একটি শিশু বালকের সহিত তাহার বিবাহ সম্বন্ধ স্থাপন করিলেন। আমি শুনিয়া অতিশয় দুঃখিত হইলাম।”
হেমলতার স্বামী ছিলেন ডাঃ বিপিনবিহারী সরকার। স্বামীর কর্মস্থল নেপালে গিয়ে কিছুদিন বসবাস করেন তিনি। এ সময়ে তার গ্রন্থ ‘নেপালে বঙ্গনারী’ প্রকাশিত হয়। দু’জন ব্রাহ্ম মহিলার সাহায্য নিয়ে দার্জ্জিলিং-এ ‘মহারাণী গার্লস হাইস্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন হেমলতা। তিনি ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মহিলা সদস্যা। তার রচিত অন্যান্য গ্রন্থ: ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (পাঠ্যপুস্তক, ১৩০৫); ‘সমাজ বা দেশাচার’ (নাটক, ১৩২২); ‘নব পদ্যলতিকা’ (কবিতাগ্রন্থ, ১৩২২); ‘আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর জীবনচরিত’; ‘দুনিয়ার ছেলে’; ‘তিব্বতে তিন বছর’ ইত্যাদি। কিছুদিন শিবনাথ শাস্ত্রীর প্রকাশিত ‘মুকুল’ পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন। বিজ্ঞানী বিজলিবিহারী সরকার তার পুত্র। ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই মে হেমলতার মৃত্যু হয়।] দীপক সেনগুপ্ত।

এ পৃথিবীতে আর আসিবে না

একদিন সরোজা আহারের জন্য অপেক্ষা করিতেছে এমন সময়ে একটু কাগজে লেখা এই কয়টি কথার উপর তাহার দৃষ্টি পড়িল : -“ সৎলোকেরা মনে করেন, আমি এই পৃথিবীতে কেবল একবারই আসিব; সেই সময়ের মধ্যে যত ভাল কাজ করা যায় ও করা উচিত, ইহার প্রতি অমনোযোগী হওয়া আমার কর্তব্য নহে।” সরোজা এই কথাগুলি একবার পড়িল, দুইবার পড়িল, - এই কথাগুলি তাহার প্রাণে বিশেষ রূপে অঙ্কিত হইল। সে অতিশয় ভাবিতে ভাবিতে আহার করিতে বসিল। আহারের সময় মাতার মুখের দিকে চাহিয়া তাহার বোধ হইতে লাগিল যেন তাঁহার কোন সৎইচ্ছা পূর্ণ হয় নাই -যাহা আর হইবে না। সরোজা পূর্ব্বে মনে করিয়াছিল এই ছুটির কয়দিন খুব আমোদে কাটাইবে. কিন্তু এখন তাহার ইচ্ছা হইল “ যতদূর পারি কাজ করিয়া আমার সময়ের সদ্ব্যবহার করিব।” ‘আমি আর এ সময় পাইব না’ - এই ক্ষুদ্র কথা কয়টি তাহার প্রাণকে নাড়িয়া দিল; তাহার প্রাণে আর এক নূতন চিন্তার স্রোত বহাইয়া দিল। যদি মাতা দিন দিন রোগা হইয়া যান, যদি তাঁহার অসুখ বৃদ্ধি পায়, যদি তাঁহার মৃত্যু হয়, এই সকল মহাকষ্টকর ভাবনায় বালিকাকে অস্থির করিতেছিল। সে কেবল এই ভাবিতে লাগিল “ হায় !আমি মায়ের নিকট তাঁহার স্নেহের জন্য ঋণী রহিলাম তাহার পরিশোধ কিরূপে দিব। যাহা হউক যথাসাধ্য চেষ্টা করিব।” আহারের পর সে আহ্লাদে নাচিতে নাচিতে মাকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল “ মা! তুমি না বলেছিলে একদিন ভবানীপুরে গিয়ে মাসীর সঙ্গে দেখা করিবে। আজই যেওনা, - আমি তোমার আজকার সমস্ত কাজ করিব।” মাতা উত্তর করিলেন “ না মা ! আজ অনেক কাজ আছে, আজ আর যাওয়া হবে না।” সরোজা বলিল “ হাঁ মা !আজই যাওনা - আজ আর আমার কোন কাজ নাই, কেবল তোমার কাজই করিব।”
সরোজা তাহার কথা রাখিল।  তাহার মাতা আসিয়া তাঁহার কার্য সমস্তই হইয়াছে দেখিতে পাইলেন। সেই দিন হইতে সরোজাকে আর কোন কার্যের জন্য কিছুই বলিতে হয় নাই।     

রাজার ভদ্রতা ও সুবুদ্ধি

একদিন কোন একজন রাজা একটী দরিদ্র বালককে উপদেশ দিতেছিলেন,দেখিয়া,একজন খোসামুদে আশ্চর্য হইয়া তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিল;তিনি উত্তর দিলেন, “ দেখ,যদিও বালকটী গরিব তথাপি উহার আত্মা আমারই ন্যায় মূল্যবান, উহার ও আমার উভয়েরই এক ঈশ্বর ও এক পথ। তবে কেন উহাকে নীচ বলিয়া ঘৃণা করিব ?”

এযে নূতন মেয়ে !

একবার একটি নৈতিক বিদ্যালয় সংস্থাপন করিবার নিমিত্ত একজন ধার্মিক লোককে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল। তিনি প্রাতঃকালের কাজে অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন-বৈকালে আপনার কাজ করিতে পারিবেন না, এইরূপ মনে করিলেন। কিন্তু তাঁহার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেইস্থানে যাইতে হইল। তিনি সেই স্থানে গিয়া সেই সকল লোককে বিশেষ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। তিনি দেখিলেন একটি বালিকা অতি কদর্যরূপে কাপড় পরিয়া সেই স্থানের এক পার্শ্বে বসিয়া আছে; তাহার রৌদ্রতপ্ত ছোট মুখখানি হাত দিয়া ঢাকা, এবং চক্ষের জল হস্তের মধ্য দিয়া দর দর করিয়া পড়িতেছে। তাহার ক্রন্দন দেখিয়া বোধ হইল যেন, দুঃখে কষ্টে তাহার ক্ষুদ্র প্রাণটী ফাটিয়া যাইতেছে। শীঘ্রই আর একটি একাদশবর্ষীয়া বালিকা সেইখানে আসিল। সে এই বালিকাটিতে কাঁদিতে দেখিয়া তাহার নিকটে গেল এবং অতি স্নেহের সহিত তাহাকে নিকটের নদীর ধারে একখানি কাঠের উপর বসাইয়া হস্তে করিয়া জল লইয়া তাহার চক্ষু ও অশ্রুমাখা মুখ খানি শীতল করিয়া, তাহার সহিত অতি প্রফুল্ল ভাবে কত আলাপ করিতে লাগিল। ক্ষুদ্র বালিকাটী পুনরায় প্রফুল্ল হইল, চোখের জল তাহার নিকট বিদায় লইল, মুখখানি ফের হাসিমাখা হইল। সেই ভদ্র লোকটী নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “ বাছা !এটি কি তোমার ছোট বোন ? ” বালিকাটি নম্রভাবে উত্তর দিল, “ না মহাশয় ! আমার একটিও বোন নাই।”
“ তবে বোধ হয় তোমরা এক পাঠশালায় পড়, না ?"
বালিকাটি বলিল “ না,আমি ইহাকে কখনও দেখি নাই, জানি না কোথা থেকে এসেছে।”
“ জান না! তা হলে কেমন করে ওকে নিয়ে এসে এমন যত্ন কর্‌ছ ?”
“ ও মেয়েটি এখানে নূতন এসেছে, একলা একলা, ফাঁক ফাঁক লাগছে,-কাহারও উহার উপর ভাল ব্যবহার করা উচিত, সেই জন্য আমি ওকে এখানে এনেছি।”
ভদ্রলোকটি মনে করিলেন “ আমি আজ এই বিষয় লইয়া কিছু বলিব।” তাঁহার সেদিনকার উপদেশের বিষয় এই:-“ তুমি তোমার ভাই বোনদিগের প্রতি যেটুকু ভাল ব্যবহার কর, সে টুকু ঈশ্বরের প্রিয় কার্যই কর।” তিনি বালিকা দুটিকে সেখানে লইয়া গিয়া ঘটনাটি সংক্ষেপে সকলকে জানাইলেন। অনেক বালকবালিকা একমনে সে কথা শুনিল।

ঠিক উত্তর

একদিন একটি বালককে তাহার সঙ্গীগণ তাহার পিতার গাছ হইতে কতকগুলি আম পড়িতে বলিল। কিন্তু তাহার পিতা সেই আমগুলিতে হাত দিতে নিষেধ করিয়াছিলেন। তাহার সঙ্গীরা বলিল;“তুমি ভয় পাও কেন ? তোমার বাবাত আর তোমায় মারিবেন না ?” বালকটি উত্তর করিল, “ সেই জন্যই আমার হাত দেওয়া উচিত নয়। বাবা আমায় আঘাত করিবেন না বটে, কিন্তু আমিত অবাধ্য হইয়া তাঁহার মনে আঘাত দিব ?”

শাস্তি

পাঁচ বৎসরের একটি ছোট ছেলে কোন দোষ করাতে, তাহার পিতা তাহাকে ডাকিয়া তাহার দোষের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। অবশেষে সে যে দোষ করিয়াছে তাহা তাহাকে বুঝাইয়া দিয়া, ঈশ্বরের কাছে তাহার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করিলেন। তার পর একখানি বই হইতে, এই কথাগুলি পড়িয়া তাহাকে বুঝাইয়া দিলেন:-"যিনি সন্তান দোষ করিলে শাস্তি দেন না, তিনি সন্তানের মঙ্গল চান না। যে পিতা সন্তানের মঙ্গল চান, তিনি যথাসময়ে তাহার দোষের জন্যে তাহাকে শাস্তি না দিলে ছেলেদের জ্ঞান হয় না। ছেলেদের আপনাদের ইচ্ছামত কাজ করিতে দিলে শেষে এমন কাজ করে, যাহাতে পিতা মাতার নিন্দা হয় "। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “এখন বাপু! আমার কি করা উচিত বল দেখি ?" ছেলেটি উত্তর দিল, "কেন বাবা ! আমি যে দোষ করিয়াছি ও শাস্তি পাবার উপযুক্ত; আমায় শাস্তি দিবেই।" শাস্তি পাবার পরে, বালকটি পিতাকে জড়াইয়া ধরিল এবং বলিল, "বাবা ! আমি আর কখন তোমার অবাধ্য হইব না।"

শিশুর সততা

গ্রামের কোন ছোট বিদ্যালয়ের একটি শ্রেণীর বালকদিগকে, তাহাদের পড়া লইতে লইতে, একটি কঠিন শব্দ বানান করিতে বলিলাম। প্রথম, দ্বিতীয়, করিয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে সকলের চেয়ে ছোট একটি বালককে জিজ্ঞাসা করিলাম; সে ঠিক বলিল। আমি তাহাকে প্রথম বসিতে বলিয়া আরও ভাল করিয়া শিখিতে পারে সেই উদ্দেশ্যে যাই বোর্ডে লিখিয়া দেখাইব, অমনি ছেলেটি বলিয়া উঠিল "পণ্ডিত মহাশয়! আমি ‘উ’র স্থানে ‘ঊ’ বলিয়াছি।" এই বলিয়াই সে আপন স্থানে আসিয়া বসিল। বল দেখি ক্ষুদ্র বালকের পক্ষে ইহা কি সামান্য সুবুদ্ধি দেখান ! যদি সে আপনার ভুল না বলিত তাহা হইলে আমি চিরকালই মনে করিতাম সে ঠিকই বলিয়াছিল; কিন্তু বালকটি এমন সৎ যে যাহা তাহার পাওয়া উচিত নহে, তাহা লাভ করিবার ইচ্ছা হইল না।

    ( মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে )

          

( ‘সখা’ পত্রিকা, ১ম খণ্ড ৭ম সংখ্যা, জুলাই ১৮৮৩ )

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।