প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪

 

সেকালের ছাত্রসমাজ

শ্রী যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়


[লেখক পরিচিতি : লেখকের সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় নি। ১৮৬৭ খৃষ্টাব্দে হুগলী জেলার চন্দননগরে জন্ম। পিতার নাম ইন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়। ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং হুগলী কলেজে পড়াশোনা করেন। কেরাণীর চাকরী ছেড়ে ‘হিতবাদী’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে যোগদান করেন। ‘বঙ্গবন্ধু’ পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন। ‘হিতবাদী’, ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি বহু পত্র পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতেন। জীবনে বহু খ্যাতনামা লোকের সংস্পর্শে যে তিনি এসেছেন সেটা বর্তমান লেখাটি পড়লেই বোঝা যাবে। তার প্রকাশিত কযেকটি গ্রন্থ : বৃদ্ধের বচন (১৯১৮) , আগন্তুক ( গল্প-১৯০৬) , শ্রীমন্ত সদাগর , অমিয় উৎস , জামাই-জাঙ্গাল , সওদাগর| ১৯৬০ খৃষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। ] দীপক সেনগুপ্ত।

সেকালের ছাত্রসমাজের সহিত একালের ছাত্রসমাজের যে কত প্রভেদ, তাহা আমার মত বৃদ্ধেরা সহজেই বুঝিতে পারিবেন। এই প্রভেদ বিশেষরূপে বুঝিতে পারা যায় ছাত্রদের বেশভূষায় এবং আচার-ব্যবহারে।

আমরা যখন হুগলী কলিজিয়েট স্কুলে পড়িতাম তখন বাইসিকেল ছিল না। সকল ছাত্রই পদব্রজে স্কুলে যাতায়াত করিত, দুই-চারি জন ধনবানের সন্তান ঘরের গাড়ীতে যাতায়াত করিত। আমাদের বাটী হইতে হুগলী কলেজ প্রায় তিন মাইল। কিন্তু আমাদিগকে প্রত্যহ দুই বেলা এই তিন মাইল তিন মাইল ছয় মাইল পথ পদব্রজে অতিক্রম করিতে হইত না। আমাদের সময়ে কলেজে ও স্কুলে ছাত্র লইয়া যাইবার জন্য অনেকগুলি নৌকা ছিল। প্রত্যেক নৌকায় বার-চৌদ্দ জন করিয়া ছাত্র যাইত। হুগলী কলেজ গঙ্গার উপরেই অবস্থিত, গঙ্গার পশ্চিম কূলে, উত্তরে বাঁশবেড়ে হইতে দক্ষিণে ভদ্রেশ্বর তেলিনীপাড় এবং গঙ্গার পূর্ব্ব তীরে উত্তরে কাঁচড়াপাড়া হইতে দক্ষিণে শ্যামনগর মূলাযোড় পর্য্যন্ত সকল জনপদ হইতেই শত শত ছাত্র নৌকাযোগে যাতায়াত করিত। এইরূপ প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ খানা নৌকা ছিল। বলা বাহুল্য যে, প্রত্যেক নৌকাতেই ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর ছাত্র থাকিত। আমাদের নৌকাতে, আমাদের উপরি শ্রেণীস্থ এবং কলেজেরও কয়েক জন ছাত্র যাতায়াত করিতেন। তাঁহাদের সম্মুখে আমরা কখনও চপলতা বা বাচালতা করিতে সাহস করিতাম না, করিলেও তাঁহারা কখনও তাহা উপেক্ষা করিতেন না, কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে চপলতা করিতে দেখিলে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যেরূপ শাসন করেন, উচ্চশ্রেণীস্থ ছাত্রগণ আমাদের সময়ে সেইরূপ নিম্নশ্রেণীস্থ ছাত্রগণের অশ্লিষ্ট ব্যবহার দেখিলে শাসন করিতেন, এমন কি কর্ণ মর্দ্দন পর্য্যন্ত করিতেন। আমরা আমাদের এক ক্লাস বা দুই ক্লাস উপরের ছাত্রদিগকেও অগ্রজের মতই সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতাম। আমাদের কোন ত্রুটি দেখিয়া তাঁহারা শাসন করিলে বিনা প্রতিবাদে তাহাদের শাসন মানিয়া লইতাম।

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন কলিকাতার ছাত্রসমাজ কিরূপ ছিল জানি না, কারণ সে-সময় আমি কদাচিৎ কলিকাতায় আসিতাম, কলিকাতায় ছাত্রসমাজের সহিত আমার কোন পরিচয় ছিল না। কিন্তু সেকালের চন্দননগর, চুঁচুড়া, হুগলী প্রভৃতি স্থানের ছাত্রসমাজের সহিত, এ কালের স্থানীয় ছাত্রসমাজের তুলনা করিলে স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায় যে, গত পঞ্চাশ-ষাট বৎসরে, ছাত্রসমাজে শিষ্টাচার সম্বন্ধে কি ঘোরতর পরিবর্ত্তন হইয়াছে। এখন দেখিতে পাই যে, নিম্নশ্রেণীর ছাত্রগণের অধিকাংশই তিন-চারি ক্লাস উপরের ছাত্রগণের সহিত সমকক্ষভাবে "ইয়ার্কি" দিতে কিছুমাত্র ইতস্ততঃ করে না, কিন্তু আমাদের সময়ে আমরা এক ক্লাস উপরের ছাত্রদিগের সহিত সমান ভাবে মিশিতে কুণ্ঠা বোধ করিতাম। খেলার সময় উচ্চতর বা নিম্নতর ক্লাসের ছাত্রদিগের সহিত মিলিত হইয়া খেলা করিতাম বটে, কিন্তু ক্রীড়াক্ষেত্রেও দুই এক বৎসরের বয়োজ্যেষ্ঠ বা দুই এক ক্লাস উপরের ছাত্রদিগকে যথোচিত সম্মান করিতাম। যাহারা সেরূপ সম্মান করিত না, তাহাদিগকে আমরা অভদ্র মনে করিতাম।

আমরা যখন হুগলী কলিজিয়েট স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে পড়িতাম, তখন আমাদের ক্লাসের যে-সকল ছাত্র বোর্ডিঙে থাকিত, তাহারা মধ্যে মধ্যে চন্দননগরে বেড়াইতে আসিত। সে সময় চন্দননগরের মসিয়ে কুর্জ্জন নামক এক জন ফরাসী ভদ্রলোক নিজের বাড়ীতে ছোটখাট পশুশালা করিয়াছিলেন। তাহাতে সিংহ, বাঘ, হায়না, গণ্ডার, জিরাফ, বনমানুষ এবং নানা জাতীয় পশু এবং কয়েক প্রকার বানর ছিল। ঐ সাহেব নিজের নবনির্ম্মিত অট্টালিকাও নানা প্রকার বহুমূল্য সাজসজ্জায় সজ্জিত করিয়াছিলেন। তাঁহার সুসজ্জিত আবাস ও পশুশালা দেখিবার জন্য প্রত্যহ বহু লোকের সমাগম হইত। আমাদের সতীর্থদিগের মধ্যে প্রায় সকলের উহা দেখিবার জন্য অবকাশ পাইলেই চন্দননগরে আসিত এবং আমাদের বাটী কুর্জ্জন সাহেবের বাটীর অদূরে ছিল বলিয়া প্রায়ই আমাদের বাটীতে আসিত। উহারা আমাদের বাটীতে আসিলে আমার জননী তাহাদিগকে জলযোগ না করাইয়া ছাড়িতেন না। দূরবর্ত্তী স্থানের যে-সকল ছাত্র বোর্ডিঙে থাকিত তাহাদের পথে প্রতি শনিবারে বাটী যাওয়া ঘটিয়া উঠিত না। তাহাদের মধ্যে কেহ কেহ "মুখ বদলাইবার জন্য" মাঝে মাঝে আমাদের বাটীতে আহার করিত। তাহারা শনিবারে স্কুলের ছুটির পথ আমাদের সঙ্গে নৌকা করিয়া চন্দননগরে আসিত এবং সোমবার প্রাতে আহারাধি করিয়া আমাদের সঙ্গেই আবার স্কুলে যাইত। আমার যে-সকল সতীর্থ আমাদের বাড়ীতে আসিত, তাহারা সকলেই আমার মাকে মা বলিয়া ডাকিত, মাও তাহাদিগকে "তুই" বলিয়া সম্বোধন করিতেন। আমার ছোট ভাই ও ভগিনী তাহাদিগকে "দাদা" বলিয়া ডাকিত। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পরের রবিবারে আমার মা তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইতেন।

সেকালে ছাত্রসমাজে ধূমপান ছিল না বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। আমার বয়স যখন চোদ্দ কি পনর বৎসর, সেই সময় আমার কোন সহপাঠীর অগ্রজকে আমি চুরুট খাইতে দেখিয়া অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়াছিলাম। তিনি তখন বোধ হয় কলেজে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়িতেন। তাহার পূর্ব্বে আমি কোন ছাত্রকে ধূমপান করিতে দেখিতে নাই। আমাদের ধারণা ছিল যে বয়োবৃদ্ধ লোকেই ধূমপান করে, ছাত্রজীবনে উহা অস্পৃশ্য। আমাদের ছাত্রাবস্থায় সিগারেটের প্রচলন ছিল না। যাহারা ধূমপান করিত, তাহারা হুঁকা কলিকার সাহায্যে সম্পূর্ণ দেশীয় ভাবেই ধূমপান করিত; বাঙালীদের মধ্যে কদাচিৎ চুরুট ব্যবহৃত হইত, আমরা জানিতাম চুরুটটা সাহেবদিগেই ব্যবহার্য্য। আজকাল দেখিতে পাই সিগারেট ও বিড়ি ছাত্রসমাজে পান ও চায়ের মত বহুল প্রচলিত হইয়াছে। আমি দেখিয়াছি সেকালে স্কুলের ছাত্রগণের মধ্যে তাম্বুলের ব্যবহারও খুব অল্পই ছিল। পান খাইলে জিব মোটা হয়, ইংরেজী শব্দের ঠিক উচ্চারণ হয় না, বোধ হয় এর ধারণা সেকালে ছাত্রসমাজে বদ্ধমূল থাকাতেই স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে তাম্বুলচর্ব্বনের প্রথা খুব অল্প ছিল।

আমাদের ছাত্রাবস্থায় মফস্বলের কোথাও ফুটবল খেলা ছিল না। কলিকাতেও তখন বোধ হয় অতি অল্প লোকেই ফুটবলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সেকালে জিমন্যাষ্টিকেরই প্রচলন ছিল। প্রায় প্রত্যেক বড় বড় স্কুলে ছাত্রদের শরীরচর্চ্চার জন্য প্যারালাল বার, হোরাইজোন্টাল বার এবং ট্রাপিজ বার ছিল। স্কুলের বাহিরে প্রায় প্রতি পাড়াতেই একটা করিয়া জিমনাষ্টিক গ্রাউণ্ড বা আখড়া ছিল, সেখানে দশ-পনর জন বালক ও যুবক বৈকালে মিলিত হওয়া জিমন্যাষ্টিক করিত। জিমন্যাষ্টিক ব্যতীত কুস্তি, লাঠিখেলা প্রভৃতির আখড়াও ছিল। ভেলদিগদিগ বা কপাটীখেলা বাঙালী বালক ও যুবকগণের সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় ক্রীড়া ছিল। কিন্তু সেকালে আমাদের এত জাতীয় ক্রীড়াতে প্রতিযোগিতা ছিল না। স্থানীয় বালক ও যুবকগণ আপনাদের মধ্যেই এই খেলা করিত, অন্য স্থানের ছেলেদের সহিত প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হইত না। পঁচিশ কি ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে আমি দৈনিক হিতবাদীতে বাংলায় জাতীয় ক্রীড়া সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলাম। তাহাতে আমি বলিয়াছিলাম যে, কি সভ্য কি অসভ্য সকল সমাজেই কোননা-কোন প্রকার জাতীয় ক্রীড়া আছে। এই কপাটীখেলা বাংলার জাতীয় ক্রীড়া, অতি প্রাচীন কাল হইতে বাংলার বালক এবং যুবক সমাজে কপাটী খেলার প্রচলন আছে। ঐ প্রবন্ধ প্রকাশের কিছু দিন পরে, চন্দননগর প্রবর্ত্তক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা এবং 'প্রবর্ত্তক' নামক কাগজের সম্পাদক, আমার স্নেহভাজন শ্রীযুক্ত মতিলাল রায় তাহার সঙ্ঘস্থিত বিদ্যাপীঠের ছাত্রগণের মধ্যে কপাটী খেলা উন্নত প্রণালীতে প্রবর্ত্তিত করেন এবং ঐ খেলার কতকগুলি নিয়মকানুন প্রণয়ন করিয়া একখানি ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ করেন ও সেই পুস্তিকার মুখবন্ধ স্বরূপ, ‘হিতবাদী'তে প্রকাশিত আমার সেই প্রবন্ধটি উদ্ধৃত করেন। মতিবাবুই প্রথমে ভেলদিগদিগ খেলার প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলকে একটি "শীল্ড" বা ঢাল প্রদান করিবার ব্যবস্থা করেন। ইহার পর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হইবার জন্য চন্দননগরের পালপাড়া, গোন্দলপাড়া প্রভৃতি পল্লীর ছাত্রগণের দ্বারা কয়েকটি ভেলদিগদিগ সমিতি গঠিত হয়। আজকাল কলিকাতা, বালী, কোন্নগর, শ্রীরামপুর, হাওড়া, হুগলী, চুঁচুড়া প্রভৃতি স্থানে বহু কপাটী বা ভেলদিগদিগ সমিতি গঠিত হইয়াছে এবং বেশ সমারোহের সহিত ঐ খেলার প্রতিযোগিতা হয়। মতিবাবু আমাদের এই জাতীয় ক্রীড়াকে "ফুটবল" "ক্রিকেট" "টেনিস" প্রভৃতি বৈদেশিক ক্রীড়ার সমান মর্য্যাদা প্রদান করিয়া দেশবাসীর ধন্যবাদভাজন হইয়াছেন, সন্দেহ নাই। জাতীয় খেলাধূলার প্রতি অনুরাগ আত্মমর্য্যাদাজ্ঞানেরই পরিচায়ক।

আমার মনে হয় যে, সেকাল অপেক্ষা একালের ছাত্র-সমাজে আত্মমর্য্যাদাজ্ঞান প্রবল হইয়াছে। সেকালে ছাত্র-সমাজে দেশাত্মবোধ ছিল না বলিলে বোধ হয় অত্যুক্তি হয় না। আমাদের সমসাময়িক ছাত্রসমাজে স্বদেশপ্রেম বা স্বদেশানুরাগের সূত্রপাত হইয়াছিল কবিবর হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারতসঙ্গীত হইতে। তাঁহার সেই:-
বাজরে বীণা বাজ এই রবে
সবাই স্বাধীন এ বিপুল ভবে,
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে
ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়।

আবৃত্তি করিতে করিতে সেকালের যুবকদের হৃদয় উৎসাহে স্ফীত হইয়া উঠিত। কিন্তু সেই উৎসাহ ঐ কবিতার আবৃত্তিতেই শেষ হইত। সেকালে কোন বাঙালী কোন শ্বেতাঙ্গের সহিত যে মারামারি করিতে পারে, তাহা আমরা ধারণাই করিতে পারিতাম না। কোন শ্বেতাঙ্গ কোন অন্যায় কার্য্য বা অত্যাচার করিলে তাহার প্রতিকার আমরা অসম্ভব বলিয়াই মনে করিতাম। সেকালের বাঙালীর এই ভীরুতা দর্শনে স্বর্গীয় কবি রাজকৃষ্ণ রায় লিখিয়াছিলেন - 

একটা সাহেব যদি রেগে ওঠে
শতটা বাঙ্গালী প্রাণভয়ে ছোটে
'দে রে জল' বলি ভূমিতলে লোটে
ঘুষির প্রহারে কাতর হয়।

সত্যই এখনকার পঞ্চাশষাট বৎসর পূর্ব্বে বাঙালীর ভীরুতা ও কাপুরুষতা এইরূপ ছিল। সেই জন্য আমরা বাল্যকালে যখন গল্প শুনিতাম যে, সর সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জিতেন্দ্রনাথ একাকী চার-পাঁচটা গোরাকে মল্লযুদ্ধে হঠাইয়া দিয়াছেন, সেখানে সাহেবের সঙ্গে মারামারি করিয়া নাম কিনিয়াছেন, তখন আমরা জিতেন্দ্রনাথকে অতিমানব বলিয়া মনে করিতাম। আমরা বাল্যকালে দেখিয়াছি, যে এক জন ফিরিঙ্গী, কি একটা কাবুলী রেলের গাড়ীর একটা কক্ষ একাকী অধিকার করিয়া বসিয়া আছে, অন্যান্য কক্ষে যাত্রীর খুব ভিড় হইয়াছে অথচ কোন যাত্রী সাহস করিয়া সেই ফিরিঙ্গী বা কাবুলীর অধিকৃত কক্ষে প্রবেশ করিতেছে না, কি জানি পাছে সে অপমান করে। এই অপমানের ভয়ে ন্যায্য অধিকার পরিত্যাগ যে কত বড়-অপমান, সেকালের অতি অল্প বাঙালী তাহা হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিত। একালের ছাত্রসমাজের তুলনায় যে সেকালের ছাত্রসমাজ অত্যন্ত ভীরু ও কাপুরুষ ছিল তাহাতে কণামাত্র সন্দেহ নাই। 

মনে পড়ে ১৮৮৭ বা ৮৮ খ্রীষ্টাব্দে একবার ফরাসী গবর্ণমেন্ট ভারতে conscription বা বাধ্যতামূলক যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা প্রবর্ত্তনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। তাহাতে চন্দননগরে জনসাধারণের মধ্যে বিষম আতঙ্কের সঞ্চার হইয়াছিল। কণস্ক্রিপশন আইন অনুসারে যাহারা যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা করে, তাহাদিগকে বিদেশে গিয়া যুদ্ধ করিতে হয় না, যদি কখনও শত্রুপক্ষ তাহাদের দেশ আক্রমণ করে, তবেই তাহাদিগকে দেশরক্ষার জন্য যুদ্ধ করিতে হয়। ফরাসী ভারতে ঐ আইন প্রবর্ত্তিত হইলে কোন ভারতীয় ফরাসী প্রজাকে ভারতের বাহিরে গিয়া যুদ্ধ করিতে হইত না, যদি কোন শত্রুপক্ষ ভারতে ফরাসী অধিকার আক্রমণ করিত তাহা হইলেই সেই শত্রুপক্ষের সহিত যুদ্ধ করিতে হইত। ফরাসী ভারতে সেরূপ যুদ্ধের কোন সম্ভাবনা ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকিবে না, সুতরাং চন্দনগরের কোন যুবক কনস্ক্রিপশন তালিকাভুক্ত হইলেও তাহাকে কখনই কোন রণক্ষেত্রে পদার্পণ করিতে হইবে না, ইহা জানিয়াও লোকে ভয়ে অস্থির হইয়াছিল এবং যাহাতে ফরাসী ভারতে বাধ্যতামূলক সময়-শিক্ষা প্রবর্ত্তিত না-হয়, সেজন্য কর্ত্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করা হইয়াছিল। ঐ আবেদনের ফলেই হউক বা অন্য যে কারণেই হউক, ফ্রান্সের কর্ত্তৃপক্ষ ফরাসী ভারতে কনস্ক্রিপশনের আইন প্রবর্ত্তিত করেন নাই। যে চন্দননগর সেকালে কনস্ক্রিপশনের ভয়ে অস্থির হইয়াছিল, সেই চন্দননগরই ১৯১৪ খ্রীষ্টাব্দে, ইউরোপীয় মহাসময়ে সর্ব্বাগ্রে সেচ্ছায় বাঙালী যুবকদলকে সৈনিকরূপে প্রেরণ করিয়াছিল।  চন্দননগরের যুবকগণ স্বেচ্ছায় সৈনিকবৃত্তি অবলম্বন করিতে দেখিয়া পণ্ডিচেরী, কারিকল, মাহে প্রভৃতি ফরাসী উপনিবেশের যুবকগণ যুদ্ধে অগ্রসর হইয়াছিল। ভার্দ্দুনের রণক্ষেত্রে বাঙালী গোলন্দাজ সেনার সাহস ও রণকৌশল দর্শন করিয়া এক জন প্রবীণ ফরাসী সেনাপতি তাহাদের অশেষ প্রশংসা করিয়া বলিয়াছিলেন যে, ভার্দ্দুনের রণক্ষেত্রে যদি এক রেজিমেন্ট বাঙালী গোলন্দাজ সেনা থাকিত তাহা হইলে বহু পূর্ব্বেই জর্ম্মণ সেনাকে ভার্দ্দুন পরিত্যাগ করিতে হইত। এখন যদি ফরাসী গবর্ণমেন্ট থাকায় ফরাসী ভারতে বাধ্যতামূলক সমরশিক্ষার ব্যবস্থার প্রবর্ত্তন করেন, তাহা হইলে চন্দননগরের শত শত বাঙালী যুবা স্বেচ্ছায় সমর-বিদ্যা শিক্ষায় অগ্রসর হইবে, তাহাতে কণামাত্র সন্দেহ নাই। পঁচিশ-ত্রিশ বৎসরের মধ্যে চন্দননগরের যুবক-সমাজের মনোভাবের এই প্রবর্ত্তন বিস্ময়কর নহে কি? 

আজকাল আমরা দেখিতে পাই, জলপ্লাবন, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প প্রভৃতি দৈব রোষে বিপন্ন জনগণকে রক্ষা ও সাহায্য করিবার জন্য ছাত্রসমাজই অগ্রণী হয়। দেশহিতকর কার্য্যে অর্থের প্রয়োজন হইলে, ছাত্রগণই সর্ব্বাগ্রে অর্থসংগ্রহে প্রবৃত্ত হয়। এরূপ কার্য্য সেকালের ছাত্রসমাজে অজ্ঞাত, এমন কি ধারণারও অতীত ছিল। আমাদের বয়স যখন আট বৎসর কি নয় বৎসর, সেই সময়ে মান্দ্রাজে ভীষণ দুর্ভিক্ষ হইয়াছিল। সে যুগে ব্র্হ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন মহাশয়ের প্রতিষ্ঠিত 'সুলভ সমাচার' ছাত্রসামাজের বিশেষ প্রিয় ছিল। সেই 'সুলভ সমাচারে'  মান্দ্রাজ দুর্ভিক্ষের এক-খানি চিত্র প্রকাশিত হইয়াছিল এবং সকলকে আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করিবার জন্য আবেদন করা হইয়াছিল। বোধ হয় সেই চিত্র দর্শন ও আবেদন পাঠ করিয়া আমাদের স্কুলের শিক্ষকদিগের হৃদয় বিচলিত হইয়াছিল, তাই তাঁহারা এক দিন প্রত্যেক ক্লাসের ছাত্রদিগকে দুই আনা বা এক আনা করিয়া চাঁদা দিতে বলিয়াছিলেন। আমরাও চাঁদা দিয়াছিলাম। কিন্তু সেই দুর্ভিক্ষক্লিষ্টদিগকে সাহায্য করিবার জন্য স্কুলের উচ্চতর শ্রেণীর বা কলেজের ছাত্রদিগকে লোকের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়া পৃথক ভিক্ষা করিতে দেখি নাই। এই সকল ব্যাপারে যে সেকালের ছাত্রসমাজ অপেক্ষা একালের ছাত্রসমাজে কর্ত্তব্যজ্ঞান যথেষ্ট বৃদ্ধি পাইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই।

সেকালের ছাত্রদের তুলনায় একালের ছাত্রগণ বিলাসী হইয়াছে। একালের ছাত্রগণ ফুটবল প্রভৃতি ক্রীড়ার জন্য যৎপরোনাস্তি পরিশ্রম করিতে পারে বটে, কিন্তু সাংসারিক কার্য্যে তাহার অত্যন্ত বাবু হইয়া পড়িয়াছে। এখনও পল্লীগ্রামে অনেক স্কুলের ছাত্রসমাজে শহরের ছাত্রদের মত বিলাসিতা প্রবেশ করে নাই সত্য, কিন্তু বালক ও যুবকগণ যেরূপ অনুকরণপ্রবণ, তাহাতে আর কিছু দিন পরে পল্লীগ্রামের ছাত্রসামাজেরও বিলাসিতা প্রবেশ করিবে সন্দেহ নাই। সকল দেশেই রাজধানীই বিলাসিতার কেন্দ্রস্থল। রাজধানীর ফ্যাশানই বন্যার জলের মত ধীরে ধীরে দেশের সর্ব্বত্র পরিব্যপ্ত হইয়া পড়ে। কলিকাতার ছাত্রসমাজের অনুকরণ করে পল্লীগ্রাম অঞ্চলের ছাত্রগণ। সুতরাং কলিকাতার ছাত্রসমাজের সকল বিষয়েই বিশেষ সাবধান হওয়া উচিত।

আমরা বাল্যকালে, চন্দননগর গড়ের স্কুলে পড়িতাম। গড়বাটী নামক পল্লীতে ঐ স্কুলটি অবস্থিত বলিয়া লোকে সংক্ষেপতঃ উহাকে গড়ের স্কুল বলিত। ঐ স্কুল আমাদের বাটী হইতে অন্যূন দেড় মাইল বা তিন পোয়া দূরে। আমার বয়স যখন সাত বৎসর কি আট বৎসর তখন আমি ঐ স্কুলে প্রবেশ করি। আমাদের বাটীর নিকটে, ফরাসী মিশনরীদের "সেন্ট মেরিজ ইনষ্টিটিউশন" নামে আর একটি স্কুল ছিল কিন্তু তাহাতে ইংরাজী ও বাংলা শিক্ষার সুব্যবস্থা ছিল না, ফরাসী শিক্ষাটাই ভালরূপে হইত। ঐ স্কুলে ফরাসী-বিভাগে দরিদ্র ছাত্রগণই অধ্যয়ন করিত। যাঁহারা বাংলা এবং ইংরাজী শিক্ষা প্রয়োজনীয় বলিয়া মনে করিতেন, তাঁহারা পুত্রদিগকে গড়ের স্কুলেই ভর্ত্তি করিয়া দিতেন। সেই জন্য আমরা বাটীর কাছে সেন্ট মেরিজ ইনষ্টিটিউশন থাকিতেও দেড় মাইল দূরবর্ত্তী গড়ের স্কুলেই ভর্ত্তি হইয়াছিলাম। অন্যূন পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বে, ফরাসী গবর্ণমেন্ট মিশনরীদিগের হাত হইতে লোকশিক্ষার ভার স্বহস্তে গ্রহণ করাতে সেন্ট মেরিজ ইনষ্টিটিউশনের মিশনারী শিকক্ষ-গণ চন্দননগর হইতে প্রস্থান করেন। গবর্ণমেন্ট ঐ স্কুলের নাম পরিবর্ত্তন করিয়া উহাকে "ডুপ্লে কলেজ" নামে অভিহিত করিলেন, কিন্তু তখন ইহাতে কলেজ বিভাগ ছিল না, এন্ট্রান্স ক্লাস পর্য্যন্ত ছিল। কয়েক বৎসর পরে উহাতে কলেজ ক্লাস খোলা হয়। গবর্ণমেন্টের হাতে আসিবার পর হইতেই ডুপ্লে কলেজে ইংরাজী শিক্ষার সুব্যবস্থা হয়। 

সেকালের ছাত্রসমাজের প্রসঙ্গে ডুপ্লে কলেজের ইতিহাস অবান্তর হইলেও, বাটীর কাছে স্কুল থাকিতেও কেন আমরা গড়ের স্কুলে ভর্ত্তি হইয়াছিলাম, পাঠকগণ তাহা বুঝিতে পারিবেন। চন্দননগরের পশ্চিমে, বেজড়া, নবগ্রাম, আলতাড়া প্রভৃতি গ্রামের বহু ছাত্রও গড়ের স্কুলে পড়িত। গড়ের স্কুল হইতে ঐ সকল গ্রামের দূরত্ব দুই ক্রোশ, আড়াই ক্রোশ হইবে। সুতরাং ঐ সকল গ্রামের ছাত্রগণকে গড়ের স্কুলে পড়িবার জন্য প্রত্যহ চার-পাঁচ ক্রোশ পদব্রজে যাতায়াত করিতে হইত। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র, বর্ষার বৃষ্টিধারা মাথায় করিয়া দশ-বার বৎসর বয়ষ্ক বালকগণ দুই ক্রোশ আড়াই ক্রোশ দূরবর্ত্তী স্কুলে পড়িতে হাইত, ইহা একালের কলিকাতা বা মফস্বলের শহরবাসী ছাত্রগণ বোধ হয় ধারণাই করিতে পারে না। তাহারা ফুটবল গ্রাউণ্ডে খেলার সময় বোধ হয় সাত-আট মাইল দৌড়াদৌড়ি করিতে পারে, কিন্তু এক মাইল দূরবর্ত্তী স্কুল বা কলেজে যাইতে হইলে ট্রাম কিংবা বাস না হইলে যাইতে পারে না। একদিন একজন ভদ্রলোক দুঃখ করিয়া বলিতেছেন, "আজকালকার ছেলেরা ফুটবল খেলিবার সময় এক ঘন্টা ধরিয়া দৌড়াদৌড়ি করিতে কষ্টবোধ করে না, কিন্তু বাজারে বা দোকানে যাইতে বলিলেই তাহাদের মাথায় বজ্রাঘাত হয়।  সেদিন আমার ছেলেকে বাজারে যাইতে বলাতে সে উত্তর করিল সাইকেলে লিক হয়েছে, কি করে যাব?" বলা বাহুল্য যে একালের অধিকাংশ ছেলেরই সাংসারিক কার্য্যে কোথাও যাইতে হইলেই বাইসিকেলে লিক হয়।

আমরা বাল্যকালে বোধ হয় মাসের মধ্যে পনের কি কুড়ি দিন জুতা না পরিয়াই স্কুলে যাইতাম। আমাদের জুতা ছিল না তাহা নহে, ‘দেড় মাইল পথ যাইব, নাইবা জুতা পায়ে দিলাম' এই কথাটাই মনে হইত। আমাদের সময়ে স্কুলের বোধ হয় অর্দ্ধেক ছাত্র নগ্নপদেই স্কুলে যাইত আর আজকাল সেই গড়ের স্কুলে শতকরা পাঁচ জন ছেলে নগ্নপদে যায় কিনা সন্দেহ। সেকালের ছাত্রসমাজে বেশ-ভূষার পারিপাট্য ছিল না বলিলেই হয়। একখানা পরিধেয় কাপড় এবং গায়ে একটা জামা - তা সেই জামায় বোতাম থাকুক আর নাই থাকুক, ইহাই ছিল সাধারণ ছাত্রের বেশ। শীতকালে সেই জামার উপর একখানা মোটা চাদর অথবা দোলাই। যাহারা একটু সাজসজ্জা করিয়া যাইত তাহাদিগকে সকলে বাবু বলিয়া লজ্জা দিত। স্কুলে কোন ছাত্রের মাথায় ‘সিঁতা' বা 'টেরি' ছিল না। আমরা যখন হুগলী কলিজিয়েট স্কুলে এন্ট্রান্স ক্লাসে পড়িতাম,তখন শিবচন্দ্র সোম মহাশয় হেড মাষ্টার ছিলেন। কোন ছাত্র সিঁতা কাটিয়া স্কুলে গেলে তিনি সেই ছাত্রের মাথায় হাত বুলাইতে বুলাইতে চুল এলোমেলো করিয়া দিতেন এবং বলিতেন, cultivate the inner part of your head, not the outer part. একালের ছাত্রদের বেশভূষার পারিপাট্য সম্বন্ধে অধিক বলা নিষ্প্রয়োজন, সকলেই তাহা দেখিতে পাইতেছেন। একদিন এক জন বৃদ্ধ ভদ্রলোক ট্রামে কয়েক জন স্কুলগামী ছাত্রকে দেখিয়া বলিয়াছিলেন, “এখনকার ছেলেরা সেজেগুজে শ্বশুরবাড়ী যাইতেছে কি স্কুলে যাইতেছে তাহা বলা কঠিন"। কথাটা মিথ্যা নহে।

পুত্রকন্যাদের স্কুলের বেশভূষা জোগান একালের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত গৃহস্থদিগের পক্ষে একটা দায় হইয়াছে। এই দায় আরও বাড়াইয়াছে বর্ত্তমান শিক্ষাপ্রণালী। সেকালের একখানা কথামালা, বোধহয়, আখ্যানমঞ্জরী, চরিতাবলী, পদ্যপাঠ প্রথমভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ, লোহারামের ব্যাকরণ, শশিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূগোলসূত্র, প্রসন্নকুমার সর্ব্বাধিকারীর পাটীগণিত বহু বৎসর ধরিয়া স্কুলে চলিত। গৃহস্থ একবার কয়েকখানা পুস্তক কিনিয়া কিছু দিনের জন্য নিশ্চিন্ত হইতেন, সেই পুস্তক তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র, মধ্যম পুত্র, তৃতীয় পুত্র প্রভৃতি পরে পরে অধ্যয়ন করিত। ইংরেজী স্কুলেও ঐরূপ ছিল, বার্ণার্ড স্মিথের বা পি. ঘোষের এলজেব্রা, এরিথ্‌মেটিক, ইউক্লিডের জিয়মেট্রি, লেনিজ গ্রামার, লেথ্‌ব্রিজের সিলেকশন্‌স্‌ প্রভৃতি পুস্তক বহু বৎসর ধরিয়া বিদ্যালয়ে পঠিত হইত। দরিদ্র ছাত্রেরা উপর ক্লাসের ছাত্রদের নিকট হইতে পুরাতন পুস্তক চাহিয়া লইয়া পড়িত। ছাত্রগণ প্রথমে স্লেটে অঙ্ক কষিয়া পরে সেই অঙ্ক খাতাতে তুলিত। গড়ের স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রগণ পর্য্যন্ত স্কুলে স্লেট লইয়া যাইত। আজকাল প্রতিবৎসর নূতন নূতন পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা হওয়াতে দরিদ্র ছাত্রদের অভিভাবকবর্গ অস্থির উঠিয়াছেন। কেবল পাঠ্যপুস্তকে নিস্তার নাই, সঙ্গে সঙ্গে তাহার অর্থ-পুস্তকও চাই। আমাদের সময়ে এত অর্থ-পুস্তকের ছড়াছড়ি ছিল না। আমরা দুর্ব্বোধ্য শব্দের অর্থ ডিক্‌শনারি বা অভিধান দেখিয়া বাহির করিতাম ও খাতাতে লিখিয়া লইতাম। আমরা এণ্ট্রান্স ক্লাসে উঠিয়া প্রথমে ইংরেজী সাহিত্যের অর্থ-পুস্তক ক্রয় করিয়াছিলাম। সংস্কৃতের অর্থ-পুস্তক দ্বিতীয় শ্রেণীতে কিনিয়াছিলাম। আজকাল নিম্নশ্রেণীর ছাত্রদের হাতে বড়-একটা স্লেট দেখিতে পাই না; অঙ্ক, শ্রুতিলিখন প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ই কাগজে কলমে করিতে হয়। আমরা যখন নিম্ন শ্রেণীতে পড়িতাম, তখন "এক্‌সারসাইজ বুক" নামক খাতা কিনিতে পাওয়া যাইত না, অন্ততঃ মফস্বলে ছিল না, কলিকাতায় ছিল কি না বলিতে পারি না। আমরা ডিকশনারি বা অভিধান দেখিয়া যে-খাতায় শব্দের অর্থ লিখিতাম, সে-খাতা আমরা নিজেরাই তৈয়ারী করিতাম। সুতরাং সকল ছাত্রের খাতা ঠিক একই আকারের হইত না।

আমাদের সময়ে ষ্টীল পেনের প্রচলন খুব অল্প ছিল। বাংলা হস্তাক্ষরের জন্য কঞ্চি, শর, খাগড়া বা পাহাড়ে কলমীলতার কলম ব্যবহার করিতাম, ইংরেজী হস্তাক্ষরের জন্য কুইল পেন বা হংসপুচ্ছ লেখনী ব্যবহার করিতাম। বালকবালিকারা প্রথমেই স্টীল পেনে লিখিতে আরম্ভ করিলে হাতের লেখা পাকিতে বিলম্ব হয় এবং নিবের খোঁচাতে অনেক সময় কাগজ ছিঁড়িয়া যায়। আমরা বোধ হয় স্কুলে তিন-চারি বৎসর পরে ষ্টীল পেনে হাত দিয়াছিলাম। কুইল পেনের ব্যবহার আজকাল নাই বলিলেই হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক বৎসর আমি কলিকাতায় কোন সওদাগরী আপিসে কর্ম্ম করিয়াছিলাম। সেই আপিসের বড়সাহেব কখনও ষ্টীল পেন ব্যবহার করিতেন না, তিনি সর্ব্বদাই কুইল পেন ব্যবহার করিতেন, অনেক সময় খাগড়ার কলমেও লিখিতেন। তিনি অবসর লইয়া স্বদেশে যাইবার সময় আফিসের বড়বাবুকে বলিয়া গিয়াছিলেন যে তাঁহার জন্য যেন মধ্যে মধ্যে কিছু খাগড়ার কলম কাটিয়া তাঁহার কাছে পাঠান হয়। বড়সাহেব যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন বড় বাবু প্রতি বৎসর বড়দিনের উপহারস্বরূপ পাঁচ-ছয় ডজন খাগড়ার কলম কাটিয়া তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দিতেন।

আমরা যে-বৎসর হুগলী কলিজিয়েট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ি, সেই বৎসর স্বর্গীয় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বিরুদ্ধে আদালত-অবমাননার অভিযোগ ও বিচারে তাঁহার কারাদণ্ড হয়। এই ঘটনাই বোধ হয়, বাঙালী ছাত্রজীবনে রাজনীতিক আলোচনার সূত্রপাত করে। সুরেন্দ্র বাবুর কারদণ্ড হইবার পর, কলিকাতার অধিকাংশ স্কুল-কলেজের ছাত্রেরা কয়েক দিনের জন্য পাদুকা ত্যাগ করিয়া শুধু পায়ে বিদ্যালয়ে গিয়াছিল। হুগলী কলেজেও কলিকাতার সেই তরঙ্গ লাগিয়াছিল; কলেজ ক্লাসের অনেক ছাত্র পাদুকা ত্যাগ করিয়াছিল, কিন্তু আমাদের হেডমাষ্টার মহাশয় স্কুল-বিভাগের ছাত্রদিগকে পাদুকা ত্যাগ করিতে নিষেধ করাতে আমরা পাদুকা ত্যাগ করি নাই। বঙ্গব্যবচ্ছেদ উপলক্ষেই আমাদের দেশের ছাত্রগণের মধ্যে রাজনীতিক আন্দোলন প্রকট হইয়াছিল। বিলাতী বর্জ্জন ও স্বদেশী গ্রহন সম্বন্ধে সুরেন্দ্র বাবু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ দেশে দেশে বক্তৃতা করিয়া ছাত্রসমাজে দেশাত্ববোধের সঞ্চার করিয়াছিলেন, ছাত্রগণ পিকেটিং প্রভৃতি দ্বারা সেই দেশাত্মবোধ কার্য্যে পরিণত করিয়াছিল। তাহার পূর্ব্বে ছাত্রসমাজকে দলবদ্ধভাবে অন্যরূপ কোন কার্য্য করিতে বড় দেখা যাইত না। ভূতপূর্ব্ব বড়লাট লর্ড কার্জ্জন বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ করিয়া বাঙালীর তথা বাংলার ছাত্রসমাজে, জাগরণ আনয়ন করিয়াছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই।

একালের ছাত্রসমাজে যেমন অনেক গুণ আছে, সেইরূপ অনেক দোষও প্রবেশ করিয়াছে। সেকালের ছাত্রসমাজ দোষেগুণে মিশ্রিত ছিল। যাঁহারা সেকালের ছাত্রসমাজ দেখিয়াছেন, এবং একালেরও ছাত্রসমাজ দেখিতেছেন, তাঁহারা সহজেই উভয় কালের ছাত্রসমাজের পার্থক্য বুঝিতে পারিবেন। সেকালের ছাত্রসমাজের স্বদেশ ও স্বজাতির প্রতি আকর্ষণ এবং আত্মমর্য্যাদাজ্ঞান কম ছিল, একালের ছাত্রসমাজে অবিনয়, অশিষ্টতা, বিলাসিতা এবং সাংসারিক ব্যাপারে ঔদাস্য বৃদ্ধি পাইয়াছে, ইহা আমরা অর্থাৎ বৃদ্ধের দল বেশ সুস্পষ্টরূপে দেখিতে পাই।

সৌজন্য - দীপক সেনগুপ্ত

( ‘প্রবাসী’ মাসিক পত্রিকা , বৈশাখ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।