প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ

এপ্রিল ১৫, ২০১৫

 

নাকেশ্বরী

শ্রীমতী সুবর্ণলতা


(ছোটদের জন্যে লেখা গল্প - লেখিকার পরিচয় জানা যায় নি )

এক রাজার তিনটি ছেলে ছিল। সেই রাজ্যের মন্ত্রী, সেনাপতি ও নগর-রক্ষকের মেয়ের সঙ্গে রাজপুত্র তিনটির বিয়ের কথা হচ্ছিল, এমন সময় রাজা হঠাৎ মারা গেল। তখন মন্ত্রী, সেনাপতি ও নগর-রক্ষক তিনজনে মিলে পরামর্শ করলে যে, রাজপুত্রদের মেরে ফেলে তারা তিনজনে রাজ্যটা বখরা করে নেবে, আর তাদের মেয়ে তিনজনকে অন্য রাজার ঘরে বিয়ে দেবে। এই মতলব করে, তারা তাদের মেয়েদের ডেকে সব বল্লে - রাজ-পুত্তুরদের মেরে ফেলার উপায় করতে বল্লে। মেয়ে তিনটি রাজকুমারদের আলাদা আলাদা ডেকে বল্লে -"তোমরা তিন ভায়ে আজই দেশ ভ্রমণে যাও, আজ থেকে এক বছরের মধ্যে আমাদের তিন জনার জন্য তিনটি আশ্চর্য্য জিনিষ নিয়ে এস - তাহলে তোমাদের আমরা বিয়ে করব। ততদিন আমাদের বাপেরা মিলে তোমাদের রাজত্ব চালাবে।" এই বলে মেয়ে তিনটে - তিন রাজপুত্তুরকে তিন হাঁড়ি বিষের লাড়ু তৈরী করে দিয়ে রাজ্য থেকে

রাজপুত্তুর তিন ভাই ঘুরতে ঘুরতে তার পরের দিন আর এক রাজ্যে এসে উপস্থিত হল। সেখানে শুনলে - সেই রাজ্যে একটা বুনো হাতী বেরিয়েছে। রাজার হুকুম - যে সেই হাতী মারবে তাকে অর্দ্ধেক রাজ্য ও রাজকন্যা দান করবেন। তখন ঘুরে ঘুরে অনেক ক্ষুধার্ত্ত হয়ে তিনটি ভায়ে একটা বড় দীঘীর ধারে লাড়ুর হাঁড়ি তিনটে রেখে পুকুরে স্নান করতে নাবলো। তারা নাইতে নাইতে দেখতে পেলে একটা প্রকাণ্ড হাতী সেই ঘাটের দিকে আসছে। তারা ভয়ে পুকুরের জলে সর্ব্বাঙ্গ ডুবিয়ে, কেবল নাকটি আর চোখদুটি বার করে স্থির হয়ে রইল। তারা দেখলে হাতীটা ঘাটের কাছে এসে হাঁড়িগুলো ভেঙ্গে লাড়ু গুলো খেতে আরম্ভ করলে। তার পরেই একটা বিকট আওয়াজ করে হাতীটা শুয়ে পড়ে ছটফট করতে করতে মরে গেল। রাজপুত্রেরা বুঝলে যে তাদের মেরে ফেলবার জন্য মেয়ে তিনটে বিষের লাড়ু দিয়েছিল ! তখন তারা জল থেকে উঠে এসে সেই দেশের রাজার কাছে গিয়ে বললে যে তারা হাতী মেরেছে। রাজাও তার কথার মত বড় ভাইটির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়ে অর্দ্ধেক রাজত্ব দান করলেন। বড় ভাইটি সেখানে রাজত্ব করতে লাগল, ছোট ভাই দুটি আবার দেশভ্রমণে বেরিয়ে গেল।

ভাই দুটিতে নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে সন্ধেবেলা একটা দেশে পৌঁছে একটা বড় বাড়ী দেখতে পেয়ে সেখানে গেল। বাড়ী ঢুকে দেখে অত বড় বাড়ী, কিন্তু কেউ কোথাও নেই। তারা এঘর ওঘর দেখতে দেখতে উপরে উঠে গিয়ে একটা বড় ঘরের ভিতর দেখতে পেলে একটি পরমা সুন্দরী কন্যা একলাটি বসে গালে হাত দিয়ে ভাবছে। তাদের দেখেই - মেয়েটি বল্লে -"তোমরা এখানে কি করে এলে ? - এ যে রাক্ষসীর বাড়ী। আমি এ দেশের রাজকন্যা, রাক্ষসী আমাদের রাজ্যশুদ্ধ সবাইকে খেয়েছে, কেবল মায়ায় পড়ে আমাকে রেখেছে ;-তোমরা শীগগির পালাও।" তখন ভাই দুটি নিজেদের পরিচয় দিয়ে বল্লে -"তাহলে চল তিন জনেই পালাই - তোমাকে এখানে একলা ফেলে আমরা যাবনা।" তখন মেয়েটি তাদের দুভাইকে খাইয়ে দাইয়ে শিবের মন্দিরের পাশে অনেক শুকনো বেলপাতা ছিল তার ভিতর তাদের শুইয়ে বেলপাতা চাপা দিয়ে বল্লে "তোমরা আজ সমস্ত রাত এই ভাবে লুকিয়ে থাক - রাক্ষসীর আসবার সময় হয়েছে।" এই কথা শেষ হতে না হতে সবাই একটা হুস হুস শব্দ শুনতে পেলে। রাজকন্যা অমনি তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে উপরে চলে গেল। ভাই দুটি বেলপাতার ফাঁক দিযে দেখতে পেলে - একটা ভয়ঙ্করী রাক্ষসী একটা বড় আসনে চেপে শূন্যে এসে নাবলো। নেমেই বল্লে "হাউ মাঁউ খাউ, মনিষ্যির গন্ধ পাঁউ " রাজকন্যা বল্লে "আমিত মানুষ, এখন দিন দিন বড় হচ্ছি, আমারই গাযে গন্ধ হচ্ছে আমাকেই খা।" রাক্ষসী বল্লে "ষাট ষাট ও কথা কি বলতে আছে ? এখন আয় খাবি। আয়, তোর জন্য কত ভাল ভাল খাবার এনেছি।" রাজকন্যা অমনি কাঁদতে কাঁদতে বল্লে "না আমি খাব না, তুই আমাকে এ বাড়ীতে একলা রেখে চরা করতে যাস, কোন দিন কোথায় কে তোকে মেরে ফেলবে, আমি আর তোকে দেখতে পাবনা ", এই বলে রাজকন্যা ছল করে খুব কাঁদতে লাগল। তখন রাক্ষসী দাত বার কঁরে হাসতে হাসতে বল্লে "দূর পাগলি, তোর ভয় কি ? আমায় কি কেউ মারতে পারে ? ঐ যে শুকনো লাউটা তোলা আছে ওর ভিতর একটা রূপার কৌটা আছে, তার ভিতর একটা ভীমরুল আছে। যদি কোন রাজপুত্তুর এসে এক কোপে লাউটা কেটে কৌটাটা খুলে ভীমরূলটা কামড়াতে না কামড়াতে তাকে হাতে টিপে মারতে পারে তা'হলেই আমি মরব। নৈলে ভীমরূলটা কামড়ালে সে রাজপুত্তুর ত তখনই মরবে, আমিও একশ টা রাক্ষসী হব, তোর কোন ভয় নেই, চল খেয়ে শুবি চল।" রাক্ষসীটা এই বলে আদর করে রাজকন্যাকে খাইয়ে কোলে করে নিয়ে শুয়ে ঘুমাল।

ভোর হতে না হতে আবার সেই রকম হুস হুস শব্দ করে আসনে চড়ে রাক্ষসীটা চরা করতে গেল। তখন রাজকন্যা বেলপাতা থেকে দুভাইকে বার করে সব বল্লে, তাদের সর্ব্বাঙ্গে পুরু করে কাদা মাখালে যাতে ভীমরূল কোন রকমে না কামড়াতে পারে। তারপর এক ভাই তলোয়ারের এক কোপে লাউটা কেটে রূপার কৌটা বার করলে। আর এক ভাই খুব সাবধানে আস্তে আস্তে কৌটা খুলে দুহাতে ভীমরূলটাকে চেপে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে তিন জনে মিলে খিল এঁটে দিলে। তখন হাতের চাপ দিয়ে ভীমরূলটাকে মেরে ছরকুটে ফেল্লে। হাতের তলায় পুরু কাদা থাকাতে ভীমরূলটা কিছুতেই কামড়াতে পারলে না। তখন অমনি তারা শুনতে পেলে শোঁ শোঁ শব্দ করে চেঁচাতে চেঁচাতে রাক্ষসীটা সেই ঘরের দরজায় এসে দড়াম করে পড়ে মরে গেল। এরা তিনজন সারাদিন সারারাত দোর খুল্লেনা। তার পরের দিন দোর খুলে বেরিয়ে এসে, নেয়ে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আমোদ করে খাওয়া দাওয়া করলে। মেজ ভাইয়ের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হল। তখন রাজকন্যার যা ধন-দৌলাত ছিল সব নিয়ে, আর রাজকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি ভাই সেই রক্ষসীর আসনে চড়ে তাদের বড় ভাইয়ের রাজত্বে চল্লো।   

  ৪

আসনে চড়ে শূন্যে যেতে যেতে তিন জনেই ক্ষুধা তৃষ্ণায় বড় কাতর হয়ে পড়ল। তারা দেখলে তাদের আসন একটা বনের উপর দিয়ে যাচ্ছে। তখন তিনজনে সেইখানে নাবলে। মেজ ভাই সেই বন খুঁজে এক কোঁচড় পাকা আতা নিয়ে এসে তিন জনে ভাগ করে খেতে বসল। দুভাই আগেই খেতে আরম্ভ করলে, আর তখনই অমনি এক ভয়ানক আশ্চর্য্য কাণ্ড ঘটে গেল। দেখতে দেখতে দেখতে হু হু করে দুজনার নাক বাড়তে বাড়তে লম্বা হয়ে চল্লো। এই দেখে দুভাই মহাভয়ে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল। রাজকন্যাও কাঁদতে কাঁদতে পাগলীর মত হযে বনের চারিদিকে ছুটাছুটি করতে লাগল। হঠাৎ দেখতে পেলে এক সন্ন্যাসী চোক বুজে ধ্যানে বসে আছেন। দেখেই রাজকন্যা ছুটে গে তাঁর পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে সব বল্লে। তখন সন্ন্যাসী রাজকন্যাকে একটি আম দিয়ে খেতে বলে দিলে। রাজকন্যা সেই ফল এনে খাওয়াইতেই দুভায়ের নাক যেমন ছিল তেমনি হল। তখন সন্ন্যাসীকে প্রণাম করতে গেল। তখন সন্ন্যাসী তিন জনকে কুটীরে নিয়ে তার এক পালিতা কন্যা ছিল, তার সঙ্গে ছোট ভাইটির বিয়ে দিয়ে বল্লে, “এও এক রাজকন্যা আমি ছেলেবেলা থেকে মানুস করছি। এর ভাবনায় আমার তপস্যার বড় ব্যাঘাত হচ্ছিল, আজ আমি নিশ্চিন্ত হলুম।” তখন সকলে মিলে সেই আসনে চড়ে তাদের বড় ভায়ের রাজ্যে চল্লে। ছোট ভাইটি এক থলে নাক বাড়া আতা আর একটা নাক-কমা আম সঙ্গে নিলে।

  ৫

পরদিন তারা তাদের বড় ভায়ের রাজত্বে পৌঁছুলো। তখন সেখানে খুব আনন্দের ঘটা পড়ে গেল। পরে তিন ভাই পরামর্শ করে, তাদের বাপের রাজ্য উদ্ধার করতে ও সেই শত্রু মন্ত্রী, সেনাপতি ও নগর-রক্ষক আর তাদের তিন মেযেকে শাস্তি দিতে চল্লো। রাজপুত্রেরা পিতৃ রাজ্যে পৌঁছেই যুদ্ধ আরম্ভ করল। সন্ধ্যার সময়ে যুদ্ধ শেষে দুদলই নিজের নিজের তাঁবুতে গেল। তখন রাজপুত্র তিনজন ফলওয়ালা সেজে, সেই আতা নিয়ে মন্ত্রী, সেনাপতি আর নগর-রক্ষকের তাবুতে গেল, আর এদিকে রাজকন্যা তিনজন ফলওয়ালী সেজে সেই আতা সঙ্গে নিয়ে তাদের মেয়েদের কাছে বেচে এল। মন্ত্রী, সেনাপতি আর নগর-রক্ষক তেমন সুন্দর পাকা আতা আগে কখন দেখেনি, পেয়েই খেতে আরম্ভ করলে, ওদিকে তাদের মেয়ে তিনটাও খেলে। অমনি দেখতে দেখতে সকলেরি নাক হু হু শব্দে বেড়ে চল্লো,-পরের দিন তারা আর যুদ্ধ করতে পারলে না, রাজপুত্রেরা পিতৃরাজ্য দখল করলে।
তখন, মন্ত্রী, সেনাপতি, নগর-রক্ষক ও তাদের তিনটি মেয়ে রাজপুত্তুরদের পায়ে পড়ে, আপন আপন দোষ স্বীকার করে, কেঁদে ঘাট মেনে মাপ চাইতে লাগল। তখন রাজপুত্র তিনজন তাদের দোষ মাপ করে, তাদের নাক সারবার জন্য সেই পাকা আমটি আনতে গেল, কিন্তু গিয়ে দেখলে যে, সে আম নাই, একটা বড় ইঁদুর সে আম খেয়ে ফেলেছে। তখন তাদের নাক আর ভাল হলনা। তারা আর উঠতে পারতনা, জানলা দিয়ে বাহিরে নাক বার করে দিয়ে রাত দিন শুয়ে পড়ে, তাদের পাপের ফল ভুগতে লাগল।

দেশের লোক সবাই -

‘যেমন পাপী তেমনি সাজা ভাঙ্গল জারিজুরি,
যেমনি কর্ম তেমনি ফল, হয়ে রৈলি নাকেশ্বরী।’

রাস্তা ঘাটে এই ছড়াটি বলে বেড়াত।

 

( ‘শিশু’ পত্রিকা, বৈশাখ ১৩২০ )।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।