প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৪

 

আমাদের গৃহে অন্তঃপুরশিক্ষা ও তাহার সংস্কার

স্বর্ণকুমারীদেবী


[লেখক পরিচিতি : স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম ১৮৫৫ খৃষ্টাব্দের ২৮শে আগষ্ট । তবে ১৮৫৫ না ১৮৫৬ এ নিয়ে মতভেদ আছে । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্বল্পায়ুপ্রাপ্ত প্রথম কন্যাসন্তানকে বাদ দিলে স্বর্ণকুমারী ছিলেন চতুর্থ কন্যা ; রবীন্দ্রনাথের চেয়ে পাঁচ বছরের বড় । স্বর্ণকুমারী পড়াশোনা মূলতঃ বাড়ীতে বসেই করেছেন । ছোটবেলায় তার গৃহশিক্ষিকা শ্লেটে একটা কিছু লিখে সেটা নকল করতে বলতেন ; এটা দেবেন্দ্রনাথ জানতে পেরে সেই যান্ত্রিক উপায়ে শিক্ষাদানের পদ্ধতির অবসান ঘটানোর জন্য বাড়ীতে অযোধ্যানাথ পাকড়াশী নামে এক গৃহশিক্ষককে নিযুক্ত করেন । সে সময়ে মেয়েদের অন্দরমহলে অপরিচিত পুরুষদের প্রবেশ প্রথাবিরুদ্ধ ছিল ।
১৮৬৮ সালে ১৩ বছর বয়সে নদীয়া জেলার জমিদার বংশের শিক্ষিত যুবক জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে তার বিয়ে হয় । তার তিন সন্তান - হিরণ্ময়ী দেবী (১৮৭০-১৯২৫), জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল (১৮৭১-১৯৬২) ও সরলা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭২-১৯৪৫) । এদের মধ্যে হিরণ্ময়ী দেবী ও সরলা দেবীর সাহিত্য প্রতিভা উল্লেখযোগ্য । স্বর্ণকুমারীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে । বাঙালীদের মধ্যে তিনিই প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক । এরপর তিনি বিভিন্ন ধরণের বিষয় নিযে লিখতে থাকেন । উপন্যাস, নাটক, কবিতা, এমন কি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধও তিনি রচনা করেন । ঐতিহাসিক উপন্যাসের মধ্যে ‘দীপনির্বাণ’, ‘ফুলের মালা’, ‘মিবাররাজ’ (১৮৭৭), ‘বিদ্রোহ’ (১৮৯০); পারিবারিক বা সামাজিক উপন্যাসের মধ্যে ‘ছিন্নমুকুল’ (১৮৭৯), ‘হুগলীর ইমামবাড়ি’ (১৮৮৭), ‘স্নেহলতা’ (১৮৯২), ‘কাহাকে’ (১৮৯৮), ‘স্বপ্নবাণী’ (১৯২১), ‘মিলনরাতি’; নাটকের মধ্যে ‘রাজকন্যা’, ‘দিব্যকমল’ এবং কবিতার বই ‘গাঁথা’, ‘বসন্ত উৎসব’, ‘গীতিগুচ্ছ’ ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য । বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সঙ্কলন নিয়ে রচিত হয় তার ‘পৃথিবী’ নামক বইটি । সে যুগে স্বর্ণকুমারী, কামিনী রায় প্রমুখ গুটি কয়েক মহিলা লেখক বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন; কারণ সাহিত্যের জগতে মহিলাদের প্রবেশ তখন সাধারণ রীতির বহির্ভূত ছিল । তার একাধিক রচনার ইংরাজী অনুবাদও হয়েছে; ‘ফুলের মালা’ উপন্যাস তিনি নিজেই অনুবাদ করেন । ‘দিব্যকমল’ নাটকটি জার্মান ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে । তবে সাহিত্য চর্চায় তার স্বামী জানকীনাথের প্রেরণা অনস্বীকার্য ।
১৯৭৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উদ্যোগে । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্পাদনার ভার ছেড়ে দিলে স্বর্ণকুমারী সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন এবং সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। পত্রিকাটির স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রাখতে তিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন । অনাথ ব্যক্তি ও বিধবাদের সাহায্যার্থে ১৯৮৬ সালে ঠাকুরবাড়ীর অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে স্বর্ণকুমারে ‘সখী সমিতি’ (রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নাম ) গড়ে তোলেন । বিধবাদের স্বনির্ভর করে তুলতেও এই সংস্থা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল । বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী স্বর্ণকুমারীর রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিচরণ ঘটেছিল । তার স্বামী জানকীনাথ ছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত । এরই প্রভাবে স্বর্ণকুমারী সমাজ সংস্কার ও জাতীয়তাবোধ উদ্দীপ্ত করার কাজেও অংশগ্রহণ করেন । রাণাডে, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী প্রমুখের সঙ্গে ‘ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’-এর বার্ষিক সম্মেলনেও তিনি যোগদান করেছিলেন ।
১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করে । ১৯২৯-এ বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিও হয়েছিলেন তিনি । ১৯৩২ খৃষ্টাব্দের ৩রা জুলাই ৭৭ বছর বয়সে তার কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে । ] দীপক সেনগুপ্ত।

কলিকাতার সাধারণ সম্ভ্রান্ত অন্তঃপুরের কথা জানি না । কিন্তু সেকালেও আমাদের অন্তঃপুরে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন ছিল । সেকালে অর্থে এস্থলে আমি শুধু আমার শৈশবকাল গণ্য করিতেছি না - আমার পিতামাতার আমল হইতে আমার শৈশব পর্যন্ত এ সমস্ত কালখণ্ডটাই গণনায় আনিতেছি । পিতৃদেবের বয়স এখন ৮৩ বৎসর, মাতা ঠাকুরাণী ইহার অপেক্ষা দশ বৎসরের ছোট ছিলেন । ইহাদের পিতামাতার আচার অনুষ্ঠান, সংস্কার শিক্ষা ইহারা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন , এবং ইহা দ্বারাই নিজেরাও মানুষ হইয়াছেন । অতএব উক্ত সেকাল এক শতাব্দীর অন্তর্ভুক্ত কাল বলিয়া ধরা যাইতে পারে ।

যখন আমার মাতৃদেবী পুত্রবধূ হইয়া আমাদের গৃহে আসেন , তখন আমাদের প্রপিতামহের পরিবারে অন্তঃপুর পরিপূর্ণ । পিতামহ , দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্ত্রী ও পুত্রবধূগণ তাঁহার ভ্রাতৃবর্গের স্ত্রীকন্যা পুত্রবধূগণ , তাঁহার ভগিনী ভাগিনেয়ীগণ প্রভৃতি সকলেই এই এক বাড়িতে তখন বাস করিতেন । এই বহু পরিবারের কেহই মূর্খ ছিলেন না । বরঞ্চ ইহাদের মধ্যে কেহ কেহ বিশেষ বিদ্যাবতী বলিয়া আদরণীয়া ছিলেন । স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষা তাঁহার গৌরবের বিষয় বলিয়াই জানিতেন । আমাদের দূরসম্বন্ধে এক আত্মীয়া ভগিনী , মাতার বয়স্যা , চমৎকার বিশুদ্ধ বাঙ্গালা লিখিতেন । সংস্কৃতও তিনি কিছু কিছু শিখিয়াছিলেন । সেই জন্যে মেয়েমহলে শুধু নয় , পু্রুষমহলেও তাঁহার যথেষ্ট সম্মান ছিল । পৌত্রী দৌহিত্রীদিগের মধ্যে বরঞ্চ লেখাপড়ায় এরূপ আদর দেখি নাই , কাহাকে কাহাকেও বা মূর্খ দেখিয়াছি । বৃদ্ধগণ প্রৌঢ়গণ আমাদের বাড়িতে যেরূপ বিদ্যানুশীলনের আবহাওয়ার মধ্যে মানুষ হইয়াছিলেন , তাঁহাদের পরবংশীয়া নবীনাগণ অন্যত্র গিয়া শিক্ষালাভের সে সুবিধা পান নাই ।

     আহার বিহার পূজা অর্চ্চনার ন্যায় সেকালেও আমাদের অন্তঃপুরে লেখাপড়া মেয়েদের মধ্যে একটি নিত্যনিয়মিত ক্রিয়ানুষ্ঠান ছিল । প্রতিদিন প্রভাতে গয়লানি যেমন দুধ লইয়া আসিত , মালিনী ফুল যোগাইত , দৈবজ্ঞ ঠাকুর পাঁজি পুঁথি হস্তে দৈনিক শুভাশুভ বলিতে আসিতেন , তেমনি স্নানবিশুদ্ধা , শুভ্রবসনা , গৌরী বৈষ্ণবী ঠাকুরাণী বিদ্যালোক বিতরণার্থে অন্তঃপুরে আবির্ভূতা হইতেন । ইনি নিতান্ত সামান্য বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্না ছিলেন না । সংস্কৃত বিদ্যায় ইঁহার যথেষ্ট বুৎপত্তি ছিল , অতএব বাঙ্গালা ভাল জানিতেন ইহা বলা বাহুল্য । উপরন্তু ইঁহার চমৎকার বর্ণনা শক্তি ছিল , কথকতা ক্ষমতায় ইনি সকলকে মোহিত করতেন । যাঁহাদের বিদ্যালাভের ইচ্ছা নাও বা থাকিত , তাঁহারাও বৈষ্ণবী ঠাকুরাণীর দেব দেবী বর্ণনা , প্রভাত বর্ণনা শুনিতে কুতূহলী হইয়া পাঠগৃহে সমাগত হইতেন । আমার ভাগ্যে বৈষ্ণবী ঠাকুরাণীর দর্শনলাভ ঘটে নাই , সুতরাং তাঁহার বর্ণনা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমার নাই । কিন্তু কাকিমার নিকট ইঁহার প্রভাত বর্ণনার অনুকরণ যাহা শুনিয়াছি , নব্যবংশের প্রীতির জন্য তাহা সযত্নে স্মৃতিকথিত করিয়া নিম্নে বিবৃত করিলাম । 

“ যামিনী চতুর্যামে লগ্ন হয়ে পড়লেন , কিন্তু বিদায় গ্রহণ করতে পারছেন না ; প্রভাত পূর্ব্বদিগন্তের নীচে এসে দাঁড়িয়ে আছেন , তবে প্রকাশ হ’তে পারছেন না । কেননা শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা দোঁহে দোঁহার প্রেমবন্ধনে নিদ্রাচেতন হ’য়ে রয়েছেন । আহা সারা নিশি মানভঞ্জনে উভয়ের গত হয়েছে , নিশিভোরে তাই ঘুমে বিভোর হয়ে পড়েছেন । মরি , মরি , আহা প্রাণস্বরূপ শ্রীহরি , প্রেমস্বরূপিণী শ্রীরাধার এই প্রেমমিলনে দ্যুলোক ভূলোক বিশ্বচরাচর স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। বিহঙ্গ বিহঙ্গীর কলরব নেই ; নদনদী নিঃস্রোত জীবজন্তু নরনারী গভীর নিদ্রামগ্ন , শুকতারা পূর্ব্বাকাশ হ’তে এখনো অস্ত যেতে পারছেন না , সূর্যদেব অরুণ রথে সমাসীন হয়ে উদয় হ’তে ভয় পাচ্ছেন । সৃষ্টিতে প্রলয় আসে আসে । সূর্য্যদেব চিন্তাকুল হৃদয়ে রথ ফিরিয়ে ভগবান ব্রহ্মার সদনে উপনীত হলেন , হয়ে তাঁকে এই সমুদয় বিপদের কথা অবগত করালেন । ব্রহ্মা মনে মনে প্রমাদ গণনা করে ধ্যানমগ্ন হলেন । ধ্যানভঙ্গে অনন্যোপায় না দেখে কৃষ্ণপক্ষীর ( রামপক্ষী ) স্মরণ করলেন , পক্ষী আগত হলে বলেন , “ হে কৃষ্ণভক্ত বিহঙ্গম , তুমি না রক্ষা করলে এ বিপদে পরিত্রাণ নাই । হে অগতির গতি , ভক্তচূড়ামণি , তুমি ভিন্ন ভগবান বিষ্ণুদেবের নিদ্রাভগ্ন করে এমন সাধ্য আর কা’র ?  অতএব দেবদানব নররাক্ষস সকলের প্রতি কৃপাবাণ হয়ে তুমি গিয়ে তাঁকে জাগরিত কর ; - নচেৎ সৃষ্টি এখনই লোপ পায় ! পক্ষীবর ব্রহ্মার বচনে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে নির্ভয় প্রদান ক’রে বৃন্দাবনের নিকুঞ্জদ্বারে এসে ডাকলেন - কুকুকুহুকু অর্থাৎ উঠ হে উঠ , - কুকুকুহুকু ! কুকুকুহুকু ! ভগবান শ্রীকৃষ্ণদেব কমলালোচন উন্মীলন করে দেখলেন প্রভাত হয়েছে । যতদূর স্মরণ হচ্ছে তাতে লজ্জিত বোধ না করে এই সুখের মিলনভঙ্গ-জনিত অপরাধে তিনি পক্ষীবরকে যে অভিশাপ প্রদান করলেন সেই শাপেই তখনকার পূজ্য পবিত্র কুক্কুটপক্ষী এখন হিন্দুর অস্পৃশ্য ও ম্লেচ্ছের খাদ্য ।”

আমি যে গল্পটি হুবহু আমার খুল্লতাতপত্নীর ভাষায় আবৃত্তি করিলাম এমন নহে , ভাষার রূপান্তর হইয়াছে সন্দেহ নাই । সে এত ছেলেবেলার কথা যখন কাকিমার মুখ হইতে পীড়াপীড়ি করিয়া এই বর্ণনা শুনিতাম । সমস্ত কৌতূহল , সমস্ত প্রাণ তখন কুকুকুহু কথাটির উপর পড়িয়া থাকিত । কখন পাখি ডাকিয়া উঠিবে সেই আগ্রহে প্রথমাংশের প্রতি তেমন মনোযোগই হইত না। তবে এতবার এই গল্পটি শুনিয়াছি , তাই এখনো মনে করিয়া বলিতে পারিলাম ।

     বৈষ্ণবী আসিতেন অন্তঃপুরের চতুঃসীমাবদ্ধা মহিলাগণের জন্য ; বালিকা নববধূ ও বিবাহিতা বালিকা কন্যাগণ ইঁহার কাছেই শিক্ষালাভ করিতেন । কিন্তু বাড়ির বিবাহিতা কন্যাগণ বালিকাদিগের সহিত একত্রে গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় গমন করিতে । ইহাতে আর কিছু না হউক , বালকবালিকার শিক্ষার ভিত্তি সমভাবেই গঠিত হইত ।

     তখন বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় হয় নাই । বৈষ্ণবী ঠাকুরাণী যে পুস্তক হইতে বর্ণ বোধ করাইতেন , তাহার নাম শিশুবোধক । পুস্তকখানি আমি বড় হইয়া দেখিয়াছি । অক্ষরমালা , বানান , দেবদেবী বন্দনা , যামবর্ণনা , লিপিলিখন প্রণালী - এই সমস্তই এই একখানি পুস্তকের মধ্যে স্তূপীকৃত । বন্দনা ও বর্ণনা ভাষা এত কঠিন দুর্বোধ্য যে তাহা ভাল করিয়া বুঝিয়া পড়িলে বাঙ্গালা ভাষা শিক্ষা একরকম শেষ হইয়া যায় । তাঁহারা লেখা অভ্যাস করিতেন প্রথমে তালপাতে , তাহার পর কলাপাতে । বালির কাগজে কঞ্চী কলমের মক্স সর্বশেষে । 

     আমি শৈশব অন্তঃপুরে সকলেরই লেখাপড়ার প্রতি একটা অনুরাগ দেখিয়াছি । মাতাঠাকুরাণী ত কাজকর্মের অবসরে সারাদিনই একখানা বই হাতে লইয়া থাকিতেন । চাণক্যশ্লোক তাঁহার বিশেষ প্রিয়পাঠ ছিল , প্রায়ই বইখানি লইয়া শ্লোকগুলি আওড়াইতেন । তাঁহাকে সংস্কৃত রামায়ণ মহাভারত পড়িয়া শুনাইবার জন্য প্রায়ই কোন না কোন দাদার ডাক পড়িত । দিদিমা - মায়ের খুড়িমা , তিনি ত পুস্তকের কীট ছিলেন । কাব্য উপন্যাসাদির ত কথাই নাই ; তন্ত্রপুরাণ , সাংখ্য আর দর্শনাদির যত কঠিন অনুবাদই হোক না কেন , তাহাতে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা না করিয়া থাকিতে পারিতেন না । আর কোন বই না পাইলে শেষে অভিধানখানাই খুলিয়া পড়িতে বসিতেন । বড়দাদা মহাশয়ের “তত্ত্ববিদ্যা”র সমজদার তাঁহার মত আর কেহ ছিল না । মামীমা , দিদি , বধূঠাকুরাণীগণ প্রভৃতি নবীনার দল অবশ্য কাব্য উপন্যাসেরই অনুরাগিণী ছিলেন । পড়িতে শিখিয়া অবধি আমাদের মাতুলানীকে রামায়ণ , মহাভারত , হাতেমতাই প্রভৃতি পড়িয়া শুনান আমার একটা বিশেষ কার্য্য ছিল । মনে আছে , বাড়িতে মালিনী বই বিক্রি করতে আসিলে মেয়েমহল সেদিন কিরকম সরগরম হইয়া উঠিত । সে বটতলায় যত কিছু নতুন বই , কাব্য উপন্যাস , আষাঢ়ে গল্প - ইহার সংখ্যাই যদিও অধিক - অন্তঃপুরে আনিয়া দিদিদের লাইব্রেরীর কলেবর বৃদ্ধি করিয়া যাইত । ঘরে ঘরে সকলের যেমন আলমারী ভরা পুতুল , খেলনা, বস্ত্রাদি থাকিত , তেমনি সিন্দুকবন্দী পুস্তকরাশিও থাকিত । বড় হইয়া সে-কালের বইগুলি নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়াছি ; - মানভঞ্জন , প্রভাস মিলন , দূতী সংবাদ , কোকিল দূত , রুক্মিণী হরণ , পারিজাত হরণ , গীতগোবিন্দ , প্রহ্লাদ চরিত্র , রতিবিলাপ , বস্ত্রহরণ , অন্নদামঙ্গল , আরব্যোপন্যাস , চাহার দরবেশ , হাতেমতাই , গোলেবকায়লী , লয়লামজনু , বাসবদত্তা , কামিনী-কুমার ইত্যাদি । পাঠক দেখিতেছেন এতগুলির মধ্যে একখানি কেবল নামকরণে সামাজিক; - কামিনী-কুমার কাব্যে লিখিত উপন্যাস । তখন পর্যন্ত গদ্যে উপন্যাস লিখিত হয় নাই । অনেক পরবর্তী সময়ে আমাদের শৈশবে রামনারায়ণ তর্করত্ন গদ্যে সংস্কৃত নাটকাদি অনুবাদের পর , ‘কুলীনকুল সর্ব্বস্ব’ ‘বহুবিবাহ নাটক’ প্রভৃতি সামাজিক নাটক রচনা করেন । কালী সিংহের হুতোম প্যাঁচার নক্সা , প্যারীচাঁদ মিত্রের উপন্যাসবলী ইহারও পরে রচিত । অথচ সাহিত্যনামাবলীতে ইহার নাম কেন দেখিতে পাই না ? ‘কামিনী-কুমার’ গদ্যে লিখিত উপন্যাস , কিন্তু ইহার বিশেষত্ব এই , বিদ্যাসুন্দরের ঠিক অনুকরণ নহে । পূর্বে কাব্য লিখিতে হইলেই ভারতচন্দ্র রায় তাহার আদর্শ হইত । শুনিয়াছি মদনমোহন তর্কালঙ্কার বাসবদত্তা লিখিবার সময় পণ করিয়া লিখিতে বসেন , যে তিনি ভারতচন্দ্রের অনুকরণে কাব্য লিখিয়া ভারতচন্দ্রকেও হারাইবেন । কিন্তু পুস্তক বাহির হইলে , তখনকার সমজদারদের বিচারে তাঁহাকে ভগ্নচেতা হইতে হয় , ক্ষোভে সাধের বাসবদত্তা তিনি অগ্নিসমর্পণ করেন । দুই চারখানি পুস্তক ইতিপূর্ব্বেই যাহা বাহিরে প্রচার হইয়াছিল , তাহাতেই মাত্র মদনমোহনের মহিমা আবদ্ধ থাকে ।       

     কবিত্বে বা ঔপন্যাসিক রহস্যে কামিনীকুমারের মূল্য অধিক , এরূপ বলিতে পারি না - তথাপি সাহিত্যসমাজে ইহার নাম রক্ষা হওয়া উচিত । চলিত বঙ্গসমাজের স্ত্রীপুরুষ লইয়া নায়কনায়িকা রচনার ইহা সর্ব্বাদি পুস্তক । যতদূর মনে পড়িতেছে , কামিনী-কুমারের গল্পটি এইরূপ - প্রথমে নায়কনায়িকার জন্মবিবরণ , রূপবর্ণনা , পরে বয়ঃপ্রাপ্তে উভয়ের দর্শন , পরস্পরের প্রতি অনুরাগ , মিলন আশায় উভয়ের দেশভ্রমণে নির্গমন ; স্থান বর্ণনা কোন কোন স্থানে উভয়ের সন্দর্শনলাভ ; কামিনী ছদ্মবেশী পুরুষ , অতএব কুমারের নিকট অপরিচিত , কিন্তু কুমারকে কামিনী চিনিয়া তাহার সহিত রহস্যালাপে রত হওয়া , অবশেষে উভয়ের গৃহে প্রত্যাগমন , মিলন ও বিবাহ ।

     পিতৃদেবকে ধর্মাত্মা ও ধর্মসংস্কারক বলিয়াই সকলে জানেন । এবং যেহেতু আমাদের দেশের ধর্ম ও সামাজিক আচার পৃথক বস্তু নহে , পরস্পর সংলিপ্ত , সেই হেতু ধর্মসংস্কারের সহিত যে পরিমাণ সমাজসংস্কার অবশ্যম্ভাবী , সেই পরিমাণে গৌণভাবে তিনি সমাজসংস্কারক বলিয়াও পরিচিত । কিন্তু গৌণভাবে নহে , ধর্মসংস্কারের ন্যায় সমাজসংস্কারেও যে ইনি মুখ্যভাবে ব্রতী ছিলেন , ইহার দ্বারাই যে সর্বাগ্রে স্ত্রীলোকের উচ্চশিক্ষার মূলপত্তন হইয়াছে , ইনিই যে বাল্যবিবাহের প্রথম সংস্কার করেন , এমন কি মহিলাদিগের সুসভ্য পরিচ্ছদ প্রবর্ত্তন সংকল্পেও যে কতদূর মনোযোগ দিয়াছেন , তাহা আমরাই বলিতে পারি । রামমোহন রায়ের নাম সর্বাগ্রে , কিন্তু সমাজসংস্কারে যে পিতৃদেব বঙ্গের সর্বপ্রথম পথপ্রদর্শক , তাহাতে সন্দেহমাত্র নাই ।

     বেথুনস্কুল স্থাপিত হইবামাত্র সমাজনিন্দা অগ্রাহ্য করিয়া যে দুই একটি মহোদয় সর্বাগ্রে তাঁহাদের শিশু কন্যাগণকে স্কুলে প্রেরণ করেন , পিতৃদেব তাঁহাদের মধ্যে একজন ।

     পিতৃদেব পাহাড়ে চলিয়া গেলে আমাদের অন্তঃপুরের শিক্ষাসংস্কার একেবারে বন্ধ হইয়া যায়। তিনি দেশে ফিরিয়া আসিবার পর হইতেই প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের উন্নতি আরম্ভ । তখন হইতে ধর্মসংস্কার ও শিক্ষাসংস্কার একই সঙ্গে প্রবল বেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল ।   

তিনি আসিয়াই প্রথমে শালগ্রামশিলা বিসর্জন দিলেন , বাড়ির সকলকে ব্রাহ্মধর্ম্মে দীক্ষিত করিলেন । প্রতিদিন উপাসনার সময় সত্যধর্ম্ম সম্বন্ধীয় উপদেশে , এবং ভিন্ন সময়ে নানারূপ সরল সহজ বিজ্ঞানবিষয়ক বক্তৃতায় তাঁহার পরিবারের , বিশেষ অন্তঃপুরিকাগণের বুদ্ধি , জ্ঞান ও ধর্ম্মবৃত্তি সমভাবে সম্মার্জ্জিত করিতে লাগিলেন । পৌত্তলিক আচার অনুষ্ঠান উঠাইয়াই ক্ষান্ত না হইয়া , সমস্ত ভারতব্যাপী বহুকাল প্রচলিত হীন স্ত্রী-আচার দুই একটি করিয়া নিজ অন্তঃপুর হইতে একেবারে উঠাইয়া দিলেন ; আজিকালিকার মত বয়স্ক বিবাহ না হউক , বালিকাদিগের বিবাহের একটি বিশেষ বয়ঃক্রম নির্ধারিত করিলেন ও বিবাহের একটি নব পদ্ধতি গঠিত হইল । আমাদের মধ্যমা ভগিনীর বিবাহ হইতে এ পর্যন্ত বাড়িতে সেই পদ্ধতি অনুসারেই সেই বিবাহ কার্য্য সম্পাদিত হইয়া আসিতেছে । তাঁহার শিশুকন্যাগণ শিক্ষার বয়স প্রাপ্ত হইলে পুরাতন প্রথার পরিবর্তে উচ্চ উন্নত প্রণালীতে তাহাদের শিক্ষা আরম্ভ হইল । আমাদের জন্য পণ্ডিত নিযুক্ত হইলেন । দ্বিতীয়ভাগ শেষ করিয়া বাঙ্গালার সহিত সংস্কৃত শিখিতে আরম্ভ করিলাম । অন্তঃপুরে মেম আসিতে লাগিলেন ।

আমাদের বাড়ির এই নবোন্নতিকালে কেশববাবু পিতামহাশয়ের শিষ্য হইলেন । অসূর্য্যস্পশ্য অন্তঃপুরে বাহিরের নিঃসম্পর্কীয় লোক এই প্রথম,অন্তরঙ্গ আত্মীয়ের ন্যায় স্বাগত হইয়া প্রবেশলাভ করিলেন । অনেকে এই ঘটনাটিতে অসমসাহসিকতা প্রত্যক্ষ করিয়া বিস্মিত হন । কিন্তু মহর্ষি পিতৃদেব,যিনি ধর্ম্মের জন্য আত্মীয় বান্ধব,সুবিধা স্বাচ্ছন্দ্য অবাধে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠিত হন নাই,তিনি যে সত্যধর্ম গ্রহণাপরাধে গৃহতাড়িত,শিষ্যরূপে সমাগত,শরণাগত সস্ত্রীক কেশববাবুকে দেশাচার তুচ্ছ করিয়া পুত্রস্নেহে গৃহে গ্রহণ করিবেন,ইহা কি বড়ই আশ্চর্য্যের কথা ?   

     যদি আশ্চর্য্য হইতে হয় - তবে ইহার পরবর্তী আর একটি কার্য্যে । এতক্ষণ যাহা বলিলাম,এ সকলই মেজ দাদা মহাশয় বিলাত যাইবার পূর্বেকার কথা - ১৮৫৯ হইতে ১৮৬১ খৃষ্টাব্দের মধ্যে ঘটিত । প্রথমোক্ত সময়ে তাঁহার বিবাহ হয়,এবং শেষোক্ত সময়ে তিনি বিলাত যাত্রা করেন । বৎসরান্তে,কিম্বা তাহারও পরে,ধর্মের জন্য নহে - কেবল স্ত্রীশিক্ষার জন্যই,আর একজন অনাত্মীয় পুরুষ অন্তঃপুরে প্রবেশ লাভ করিলেন । মেমের শিক্ষা আশানুরূপ ফলপ্রদ বলিয়া তাঁহার মনে হইল না । আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রবীন আচার্য্য শ্রীযুক্ত অযোধ্যা নাথ পাকড়াশী অন্তঃপুরে শিক্ষকতাকার্য্যে নিযুক্ত হইলেন । তখন আমার মেজদাদামহাশয়েরও বিবাহ হইয়া গিয়াছে। বৌঠাকুরাণী তিনজন,মাতুলানী,দিদি ও আমার ছোট তিন বোন সকলেই তাঁহার কাছে অন্তঃপুরে পড়িতাম । অঙ্ক,সংস্কৃত,ইতিহাস,ভূগোল প্রভৃতি ইংরাজি স্কুলপাঠ্য পুস্তকই আমাদের পাঠ্য ছিল । বঙ্গ মহিলার সাধারণ প্রচলিত একখানি মাত্র সাড়ি পরিধানে অনাত্মীয় পুরুষের নিকট বাহির হওয়া যায় না,এই উপলক্ষে অন্তঃপুরিকাগণের বেশও সংস্কৃত হইল । বাঙ্গালী মেয়ের বেশের প্রতি অনেকদিন অবধিই পিতামহাশয়ের বিতৃষ্ণা,এবং তাহার সংস্করণে একান্ত অভিলাষ ছিল । মাঝে মাঝে মাত্র দিদিদের,কিন্তু অবিশ্রান্ত তাঁহার শিশুকন্যাদের উপর পরীক্ষা করিয়া,এই ইচ্ছা কার্য্যে পরিণত করিবার চেষ্টারও তিনি ত্রুটি করেন নাই । আমাদের বাড়িতে সেকালে খুব ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সম্ভ্রান্ত ঘরের মুসলমান বালক বালিকার ন্যায় বেশ পরিধান করিত । আমরা একটু বড় হইয়া অবধি তাহার পরিবর্তে নিত্য নূতন পোষাকে সাজিয়াছি । পিতা মহাশয় ছবি দেখিয়াছেন,আর আমাদের কাপড় ফরমাস করিয়াছেন ; দরজি প্রতিদিনই তাঁহার কাছে হাজির,আর আমরাও । কিন্তু এত পরীক্ষাতেও তিনি আমাদের জন্য বেশ একটি পছন্দসই পোষাক ঠিক করিয়া উঠিতে পারেন নাই । মেজ বধূঠাকুরাণী বোম্বাই হইতে গুর্জ্জর মহিলার অনুকরণে সুশোভন সুদর্শন পরিচ্ছদে আবৃত হইয়া যখন দেশে প্রত্যাগমন করিলেন তখনই তাঁহার ক্ষোভ মিটিল । দেশীয়তা,শোভনতা ও শীলতার সর্বাঙ্গীন সম্মিলনে এ পরিচ্ছেদ তিনি যেমনটি চাহিয়াছিলেন,ঠিক সেই রকম মনের মতনটি হইয়া,বঙ্গবালাদিগের ঐকান্তিক একটি অভাবমোচনে তাঁহার অনেক দিনের বাসনা পূর্ণ হইল ।

     এখন হইতে স্ত্রীজাতির উন্নতি সংকল্পে বঙ্গসমাজে মেজদাদামহাশয় শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যুগ আরম্ভ । এতদিন যে তিনি এ সম্বন্ধে নীরব,নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিয়াছিলেন এমন নহে, তবে এতদিন পিতার নেতৃত্বে পুত্র তাঁহার সহায়তা করিতেছিলেন,এখন স্বাধীন ও উপযুক্ত হইয়া পিতার বিশ্রামবসরে নিজে তাঁহার স্থলাভিষিক্ত হইলেন । আশৈশব ইনি মহিলা-বন্ধু ; স্ত্রীশিক্ষা স্ত্রী-স্বাধীনতা পক্ষপাতী । বিলাত যাইবার পূর্বেই উক্ত বিষয়ের ঔচিত্য সম্বন্ধে সারগর্ভ সতেজ যুক্তি প্রদর্শন করিয়া ইনি একখানি পুস্তিকা প্রচার করেন । পিতৃদেব অন্তঃপুরের মঙ্গলের জন্য যে সকল আচারবিরুদ্ধ কার্য্য করিয়াছেন,অধিকাংশই ইহার পরামর্শে,ইহার প্ররোচনায় সম্পাদিত । ইনি এ সকল কার্য্যে পিতার দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ ছিলেন । অন্তঃপুরের অবস্থা সংশোধনের জন্য মাতাকেও ইনি ক্রমাগত ভজাইতেন । আজন্ম যে উদ্দেশ্য ব্রতরূপে হৃদয়ে ধারণ পোষণ করিয়া আসিয়াছেন,নিজে সকর্মা স্বাধীন হইয়া অদম্য অটল উৎসাহে তাহার উদ্যাপনে প্রবৃত্ত হইলেন । পিতা মহিলাদিগের উচ্চশিক্ষার মূলপত্তন করিয়াছিলেন,পুত্র তাহা সযত্নে ফলবন্ত করিয়া সে ফল সমাজে বিতরণ করিলেন ; পিতা ঘরের সংস্কারে বঙ্গের নেতা,পুত্র ঘরের দৃষ্টান্ত পরকে সমর্পণে ধন্য । একজন স্ত্রীজাতির উচ্চশিক্ষার জনয়িতা,একজন স্ত্রী-স্বাধীনতার প্রবর্ত্তক । 

১৮৬৪ খৃষ্টাব্দের প্রথমে মেজদাদা মহাশয় ইংলণ্ড হইতে প্রত্যাগমন করেন । তখন আমার বয়স ৭ বৎসর । তখন অন্তঃপুরে অবরোধ প্রথা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান । তখনো মেয়েদের একই প্রাঙ্গণের এ বাড়ি হইতে ও বড়ি যাইতে হইলে ঘেরাটোপ মোড়া পালকির সঙ্গে প্রহরী ছোটে,তখনো নিতান্ত অনুনয়ে বিনয়ে মা গঙ্গাস্নানে যাইবার অনুমতি পাইলে বেহারারা পাল্কি শুদ্ধ তাঁহাকে জলে চুবাইয়া আনে । স্ত্রীকে মেজদাদা লইয়া যাইতেছেন বোম্বাই সমুদ্রপার,কিন্তু তখনো অন্তঃপুর হইতে তাঁহাকে বহির্বাটির প্রাঙ্গণ পর্য্যন্ত হাঁটাইয়া গাড়ি চড়াইতে পারিলেন না । কুলবধূর পক্ষে ইহা এতই নূতন এতই লজ্জাজনক যে বাড়িশুদ্ধ সকলেই ইহাতে বিশেষ আপত্তি প্রকাশ করিলেন । অগত্যা পালকি করিয়া তাঁহাকে জাহাজে উঠাইতে হইল । একজন ফ্রেঞ্চ মহিলা তাঁহার বহির্গমনের উপযোগী নূতন বেশ প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলেন । কিন্তু অদম্য ইচ্ছার স্রোতে দৈব পর্য্যন্ত গা ঢালিয়া দেয় - মানুষের কি কথা - দুই বৎসর পরে মেজ দাদা যখন সস্ত্রীক বাড়ি ফিরলেন তখন আর কেহ বধূকে পালকি করিয়া গৃহে আসিতে বলিতে পারিলেন না । কিন্তু ঘরের বৌকে মেমের মত গাড়ি হইতে সদরে নামিতে দেখিয়া সে দিন বাড়িতে যে শোকাভিনয় ঘটিয়াছিল,তাহা বর্ণনার অতীত,বাড়ীতেও এ সময় ইহারা একরূপ এক ঘরে হইয়া রাখিলেন । বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বধূঠাকুরাণীর সহিত অসঙ্কোচে খাওয়া দাওয়া করিতে বা মিশিতে ভয় পেতেন । কিন্তু দুই বৎসর পরে মেজদাদা আবার বোম্বাই হইতে বাড়ি আসিলেন তখন বাঁধাবাঁধি অনেকটা শিথিল হইল । তখন সবে আমার বিবাহ হইয়াছে । স্বামী স্ত্রীশিক্ষানুরাগী,উন্নতি প্রবর্তক । বিশ্বাসানুসারে কার্য্য করিয়া তাঁহাকেও জীবনে অনেক সহ্য করিতে হইয়াছে,পিতার ত্যাজ্য পর্যন্ত হইয়াছেন । তিনি মেজদাদার সঙ্গে পূর্ণপ্রাণে মিশিয়া তাঁহার দলপুষ্ট করিলেন,এবং বাড়ির আর সকলেরও মতামত অনেক পরিবর্তিত হইয়া আসিল ।         

     ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে আমার চতুর্দশবর্ষ বয়ঃক্রমের সময় শিক্ষার সৌকর্য্যার্থে স্বামী আমাকে বোম্বাই রাখিয়া আসিলেন । তখনও আমি ইংরাজি জানিনা বলিলেই হয়,অতি সামান্যই শিখিয়াছি । শিশুকন্যা হিরন্ময়ীকে লইয়া আমি এক বৎসর সেখানে ছিলাম । বৎসরান্তে সকলে একত্রে ফিরিলাম ।     

     ভাঙ্গনধরা তীর অনেকদূর পর্য্যন্ত খসিল । কলিকাতায় ফিরিয়া মেজদাদা আর নিজের ঘরে একঘরে নহেন,দলে পুষ্ট । দেখিতে দেখিতে অল্প দিনের মধ্যে বাড়ির আবহাওয়া সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইল । এস্থলে এ কথা বলা আবশ্যক,বাড়ির ছেলেমেয়েদের বিদ্যা শিক্ষা সম্বন্ধে সেজদাদা পরলোকগত হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরকাল উৎসাহ এবং অধ্যবসায়ের সীমা ছিল না । বাড়ির মেযেদের ইংরাজি বাঙ্গালায় নিজে শিক্ষাদান করিতেন । এক্ষণে সেজদাদা মহাশয় তাঁহার পত্নীকে ওস্তাদের নিকট গান শিক্ষা দিতে লাগিলেন । বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা গান বাজনা,লেখাপড়া সর্ব্ব রকমে বেশ ভাল করিয়া শিক্ষা পাইতে লাগিল । দিদিরা পর্য্যন্ত ঘরে কাঁচিয়া ইংরাজি শিখিতে আরম্ভ করিলেন । গাড়ি করিয়া যাতায়াত ত আর লজ্জার বিষয় নহে,পালকির চলন একরকম উঠিয়াই গেল । আজ ৩৫ বৎসর মেজদাদা মহাশয় ইংলণ্ড হইতে আসিয়াছেন,ইহার মধ্যে তাঁহার দৃষ্টান্তে,তাঁহার যত্নে আমাদের অন্তঃপুরে আকাশ-পাতাল প্রভেদ । কেবল আমাদের গৃহে কেন ? তাহার দৃষ্টান্ত সমস্তে বঙ্গে আজ পরিব্যাপ্ত । এ দেশের কোন সম্ভ্রান্ত মহিলার পক্ষেই এখন বাহিরে যাওয়া সেরূপ নূতন নহে,সেরূপ লজ্জাজনক নহে । বাহিরে যাইতে হইলে সুসভ্য পরিচ্ছদেরও আর ভাবনা নাই । এখন স্ত্রী-শিক্ষা স্ত্রী-স্বাধীনতা বহু বিস্তৃত । যে কণ্টকাকীর্ণ পথ বহুযত্নে বহু পরিশ্রমে তিনি মুক্ত প্রসারিত করিয়াছেন,বঙ্গবালা মাত্রেরই নিকট তাহা এখন সহজ,সুগম । উন্নতিশীলদিগের কথা ছাড়িয়া,- অন্তঃপুরিকাগণের মধ্যেও উন্নতির এই স্রোতাবেগ প্রবাহিত । এখন কন্যাকে দেখিতে আসিয়া বরপক্ষীয়গণ প্রথমেই জিজ্ঞাসা করেন - কন্যার লেখাপড়া কিরূপ । রীতিমত বিদ্যাচর্চা,শ্বশুর শাশুড়ির নিকটও কন্যাভাব,গাড়ি চড়িয়া যাতায়াত,যাতায়াতে বোম্বাই ফ্যাসানে পরিচ্ছদ পরিধান এ সকল এখন হিন্দু সমাজনীতির অঙ্গীভূত । আর এ সকলের যিনি প্রবর্তক ৩৫ বৎসর পূর্ব্বে তাঁহাকে শত বাধা একাকী এক হস্তে উৎপাটন করিতে করিতে অগ্রগামী হইতে হইয়াছে । নিজের বাড়ির লোকে পর্যন্ত তাঁহার সহিত যোগ দিতে ভয় পাইয়াছে । স্ত্রীজাতির উন্নতিতে ইনি এমনই অটল সম্পর্ক ছিলেন,মহিলাদের মঙ্গল কল্পনায় ইনি এমনই আনন্দলাভ করিতেন যে,তাহাদের কার্য্য-সাধন জন্য কোন বাধাই বাধা জ্ঞান করেন নাই ; কোন অপমানেই তাঁহাকে নত করিতে পারে নাই । আজকাল যাঁহারা সমাজে স্ত্রীকে লইয়া বহির্গত হন,তাঁহাদের মধ্যেও অনেকেই বহু পুরুষের মাঝে দু একটি মহিলাকে লইয়া গিয়া অন্যের অঙ্গুলিনির্দ্দিষ্ট হইতে লজ্জা-বোধ করিবেন,কেবল তাহাই নহে, যাঁহারা ইহাদের দলভুক্ত নহেন , অর্থাৎ যাঁহারা স্ত্রীকে লইয়া বাহিরে যান না,তাঁহাদের সঙ্গে স্ত্রীকে পরিচিত করিতেও আপত্তি করিবেন । কিন্তু মেজদাদার সেণ্টিমেণ্ট,মেজদাদার যুক্তি এ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বীপরিত,তাঁহার নিকট এ কথা পাড়িলে তিনি রাগিয়া বলিবেন একরাশ পুরুষের সভায় কেন দু একটি মেয়ে লইয়া যাইব না ? যাঁহার স্ত্রীকে লইয়া বাহিরে যান না,তাঁহাদের নিকট স্ত্রীকে বাহির না করিলে তাঁহাদের শিক্ষা হইবে কিসে ? অভ্যাস পরিবর্তন হইবে কেমন করিয়া ? কেবল কথায় নহে,কার্য্যতঃ চিরদিন তিনি এইরূপ করিয়া আসিয়াছেন । বিদেশে সভা-সমিতিতে বা ‘পান সুপারী’তে তাঁহাকে একা নিমন্ত্রণ করিবার যো ছিল না । বাড়ির মেয়েরা পর্য্যন্ত নিমন্ত্রিত না হইলে তিনি কোথাও যাইবেন না, সকলেই জানিয়াছিল । মেজদাদার স্বভাবে স্ত্রী সম্মান এতই ওতঃপ্রোতভাবে বর্তমান,কোন ভদ্র পুরুষে যে স্ত্রীজাতির প্রতি অসম্মান দৃষ্টিতে চাহিতে পারে,ইহা তিনি অন্তরে ধারণা করিতে অক্ষম ।

     মেজদাদার কাছে যদি বলি,বুদ্ধিতে পুরুষ স্ত্রীলোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ,যদি বল পুরুষের ন্যায় তাহাদের উচ্চশিক্ষা অনাবশ্যক,কার্য্যক্ষেত্রে তাহারা পুরুষের অসমকক্ষ,অমনি তিনি গরম হইয়া উঠিবেন,মেয়েদের পক্ষ হইয়া তর্কপরায়ণ হইবেন । বাড়ির মেয়েরা থিয়েটার বা মিউজিয়াম বা পশুশালা বা কোন বক্তৃতা শুনিতে যাইতে চাহে - সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবার পুরুষ মিলিতেছে না,মেজদাদা জানিতে পারিলেই অমনি শত অনিচ্ছা শত অসুবিধা সত্ত্বেও তাহাদের সঙ্গে করিয়া যথাস্থানে লইয়া যাইবেন । মেয়েদের কর্তার নিকট যদি কোন আবেদন থাকে ত মেজদাদাই তাহাদের মুরুব্বি ; বাড়ির মেয়েরা সকলেই জানে মেজদাদার মত সহায়,বন্ধু তাহাদের আর কেহই নাই,তাঁহার উপর সকলেরই অসীম বিশ্বাস । বাস্তবিক পক্ষে মহিলাদিগের সর্বতোভাবে এমন মঙ্গলাকাঙ্খী বন্ধু ও নেতার উপযুক্ত,এমন উদার মহৎ অন্তঃকরণব্যক্তি সংসারে কম দেখিতে পাওয়া যায় । আমার ভ্রাতা মনে করিলে এ কথা আমি সর্বজনসমক্ষে এরূপ মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারিতাম না,কিন্তু এখন আমি তাঁহার কার্য্য সমালোচনায় বিচারাসীন বলিয়া তাঁহাকে সর্বসাধারণের সম্পত্তিরূপে সম্মুখে রাখিয়া অপক্ষপাতীরূপে তাঁহার প্রাপ্য তাঁহাকে দান করিতেছি মাত্র ।

     সুখের বিষয় তাঁহার প্রাণমন উদ্যম এখন সার্থক,আশৈশব জীবনের উদ্দেশ্য সফল,সমস্ত ভারতবর্ষের মধ্যে মহিলোন্নতিতে বঙ্গদেশ আজ সর্বপ্রধান ।

     এইখানে একটি কথা না বলিলে সত্যের অবমাননা ঘটে । যদি স্ত্রী মেজদাদার সহায়তা না করিতেন,তাহা হইলে এত শীঘ্র স্ত্রীজাতির এত দূর উন্নতি হইত কি না সন্দেহ । অন্ততঃ তিনি যে অনেক পরিমাণে এ উন্নতি অগ্রসর করিয়া দিয়াছেন তাহাতে সন্দেহ নাই ।   

সৌজন্য - দীপক সেনগুপ্ত

(‘প্রদীপ’ মাসিক পত্রিকা, ভাদ্র ১৩০৬)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।