পরিবেশ
নভেম্বর ৩০, ২০১৪
জীবাশ্ম জ্বালানী (৬ ) - কারবন বন্দী- ও স্বতন্ত্রী- করণ
শঙ্কর সেন
বিশেষ রকমের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ থেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, জীবাশ্ম জ্বালানীগুলি ব্যবহারের ফলে নিঃসরিত বিপুল পরিমাণ কারবন ডাই অক্সাইড বিশ্বে ঘটাচ্ছে ' জলবায়ু পরিবর্তন ', যার নাটকীয় খর্বীকরণ মানুষের এক আশু কর্তব্য ভবিষ্যতের সর্বনাশ থেকে বাঁচার জন্য । অন্যদিকে আগের মতন বর্তমানে ও ভবিষ্যতে সভ্যতার বিকাশের জন্য শক্তির প্রয়োজন রয়েছে যার ৮০-শতাংশ সুলভে পাওয়া যাচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে । তা'ছাড়া, পৃথিবীতে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানীর- বিশেষত: কয়লার এক বিশাল ভাণ্ডার- বর্তমানে যার প্রায় ৭০-শতাংশই রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতে স । শুধুমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ৪১.২- শতাংশ এসেছে কয়লা থেকে, ২০১২-সালে, যখন অন্যান্য জ্বালানীগুলির অংশ হচ্ছে ( শতাংশে ) : প্রাকৃতিক গ্যাস- ২১.৯, জল- ১৫.৭, পারমানবিক- ১১.৭, পুনর্নবীকরণ- ৪.২, এবং তেল- ৩.৯ ।
বর্তমানে প্রতি বছর কয়লা ব্যবহার হয় ৬ বিলিয়ন মেট্রিক টনের মত, যা থেকে উৎপন্ন হয় ১৮ বিলিয়ন টন কারবন ডাই-অক্সাইড । বিভিন্ন উপায়ে এই নিঃসরণ যাতে বায়ুমণ্ডলে না পৌঁছায় তার জন্য মানুষের যা' প্রচেষ্টা হয়েছে তার কয়েকটি আলোচিত হয়েছে ' অবসর'- এর পাতায় [ ' পরিবেশ ' বিভাগে দেখুন- জীবাশ্ম জ্বালানী (৪)- পরিবেশ, জীবাশ্ম জ্বালানী (৫)- ইউ. এস. ভিশন ২১, পরিচ্ছন্ন কয়লা প্রযুক্তি- উন্নত পরিবেশের জন্য, জীবাশ্ম জ্বালানী- কয়লার গ্যাসায়ন ] ।
এই প্রবন্ধে আলোচিত হবে আরও একটি প্রচেষ্টা ' কারবন বন্দী- ও স্বতন্ত্রী- করন (CCষ) ' - যা' উল্লিখিত হয়েছে ইউ. এস. ভিশন ২১-এ । লক্ষ্য হল, বিশাল পরিমাণে উদ্গত কারবন ডাই-অক্সাইড-কে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে না দেওয়া । ভাবা হয়েছে ভূগর্ভে গভীরে ভূতাত্ত্বেয় স্তর-সংহতিতে বা খনিজ কারবনেট রূপে । যদিও ভূতাত্ত্বীয় স্তরবিন্যাসে কারবন ডাই-অক্সাইড নিক্ষেপ বিগত কয়েক দশক ধরেই হয়ে আসছে, দীর্ঘকালধরে বিশাল পরিমাণে গুদামজাত রাখা একটা নূতন ধারণা । সমুদ্রের গভীরে গুদামজাত করারর সম্ভাবনা ত্যাগ করা হয়েছে সামুদ্রিক অম্লায়নের কারণে । ভূতাত্ত্বীয় স্তরকে বর্তমানে সবথেকে আশাব্যঞ্জক মনে করা হচ্ছে । আমেরিকার The National Energy Technology Laboratory (NETL) জানাচ্ছে যে, শুধু উত্তর আমেরিকাতেই এত গুদাম-পরিসর আছে যা' বর্তমান হারে ব্যবহার করা চলবে আগামী ৯০০ বছর ।
বস্তুত:, বায়ুমণ্ডলে এত বিশাল পরিমাণ নিঃসরিত কারবনের প্রবেশ ঠেকানো সামান্য কাজ নয় । বিশ্বে প্রতি বছরে আনুমানিক ৬ বিলিয়ন কয়লা ব্যবহৃত হয়, যা' উৎপাদন করে ১৮ বিলিয়ন টন কারবন ডাই-অক্সাইড । বর্তমানে আমাদের অভিজ্ঞতা মাত্র কয়েক মিলিয়ন টন-কে নিয়ে । কারবনের ভূতাত্ত্বীয় গুদামজাত-করণের ঘনত্ব হল প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ০.৬ কিলোগ্রাম । যার অর্থ হল, ভূগর্ভে স্বতন্ত্রীকরণের জন্য প্রয়োজন হবে বছরে মোট ৩০,০০০ ঘনকিলোমিটার আয়তনের গুদাম ।
CCS- শৃঙ্খল তিন ভাগে বিভক্ত করা যায় :
(১) কারবন ডাই অক্সাইড সংগ্রহ ;
(২) সংগৃহীত কারবন ডাই অক্সাইড-কে পরিবাহিত করে নিয়ে যাওয়া গুদামস্থলে ;
(৩) ঐ কারবন ডাই অক্সাইড-কে ভূগর্ভে ভূতত্ত্বীয় স্তর-সংহতি যেমন, শূন্য তেল- এবং গ্যাস-ক্ষেত্রে বা গভীর লবণাক্ত জলবাহী স্তরে গুদামজাত করা ( চিত্র ১ ) ।
চিত্র ১ : ভূতাত্ত্বীয় গুদামজাতকরণের পদ্ধতি।
(১) শূন্য তেল- ও গ্যাস-এর আধার ; (২) বাড়তি তেল উদ্ধারে কারবন ডাই-অকা্সাইডের ব্যবহার ;
(৩) অব্যবহৃত গভীর লোনাজল-সম্পৃক্ত পাথুরে আধার ;
(৪) গভীর কয়লা-স্তর, যার খনন সম্ভব নয় ;
(৫) coal-bed-মিথেন উদ্ধারে কারবন ডাই-অকা্সাইডের ব্যবহার ;
(৬) অন্যান্য 'অপশন' ।
উৎস : Anglo-French Scientific Discussion Seminar, Imperial College, London, 27 September, 2007.
এইসঙ্গে আর একটি কাজ হল- স্থাপিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলিতে CCS-এর উপরোক্ত প্রথম কাজটির জন্য যন্ত্রাদি পুনঃস্থাপন(retrofit)করা ।
কারবন ডাই অক্সাইড সংগ্রহ
কারবন বন্দীকরন বোধ করি সর্বাপেক্ষা কার্যকরী হয় যদি জীবাশ্ম জ্বালানী- বা বায়োমাস- শক্তিকেন্দ্রের উৎসমুখে এই প্রক্রিয়া চালানো হয় । কারবন ডাই-অক্সাইড ঘনীকরণ কম হবে যত উৎস থেকে দূরে যাওয়া যাবে।
অক্সিজেন-এ কয়লা দহন করলে সমাহৃত কারবন ডাই-অক্সাইডকে বেশ কিছুটা শুদ্ধ অবস্থায় পাওয়া সম্ভব এবং সোজাসুজি পাইপলাইনে ব্যবহার করা যায় । কারবন ডাই-অক্সাইড প্রবাহে অপবস্তু থাকলে তা' পাইপলাইনে বর্ধিত ক্ষয়(corrosion)সৃষ্টি করতে পারে ; এই ধরণের ক্ষেত্রে ঘসে বিশুদ্ধ অর্থাৎ সম্মার্জনের করার(scrubbing)প্রয়োজন হবে ।
স্থূলভাবে গ্যাস-সম্মার্জনের (gas-scrubbing) জন্য তিনটি কৃতকৌশল ব্যবহার করা হয় : দহন-পশ্চাৎ(post-combustion), দহন-পূর্ব(pre-combustion), এবং অক্সিজেন-সহযোগ(oxyfuel)দহন ।চিত্র ২-এ উপরোক্ত তিন প্রণালির ত্রিমাত্রিক চিত্ররূপ(block diagram)দেওয়া হল ।
চিত্র ২ : ত্রিমাত্রিক চিত্ররূপ- দহন-পশ্চাৎ, দহন-
পূর্ব, এবং অক্সিজেন-সহযোগে দহন প্রণালিগুলি ।
১- বয়লার, ২- টারবাইন-জেনারেটর, ৩- কারবন
বন্দীকরন ইউনিট, ৪- বায়ু-পৃথকা্করণ ইউনিট,
৫- গ্যাসায়ন ইউনিট ;
অ- অক্সিজেন, ক- কয়লা, কা-ডা- কারবন ডাই-অক্সাইড,
না- নাইট্রোজেন, ফ্লু- ফ্লু-গ্যাস, *- নাইট্রোজেন ৭০ শতাংশ, কারবন ডাই-অক্সাইড ৩ থেকে ১৫ শতাংশ, বা- বায়ু,
বি- বিদ্যুৎ, সি- সিন গ্যাস, হা- হাইড্রোজেন ।
উৎস : Figuerea, J.D., et al: Advances in CO2 capture Technology, Int. Journal of
Greenhouse Gas Control, 2008, pp 11.
দহন-পশ্চাৎ কৃতকৌশলে কারবন ডাই-অক্সাইডকে বন্দী করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফ্লু-গ্যাস থেকে ;
দহন-পূর্ব প্রক্রিয়ায় জ্বালানীতে আংশিকভাবে অক্সিজেন যুক্ত করা হয়, উদাহরণস্বরূপ, গ্যাসিফায়ারের মধ্যে । উৎপাদিত syngas (কার্বন মনোক্সাইড ও হাইড্রোজেনের সংমিশ্রণ) থেকে আলাদা করা হয় কারবন ডাই অক্সাইড ও হাইড্রোজেন । মোটামুটি নির্মল কারবন ডাই অক্সাইডকে দহনের পূর্বে সরিয়ে নেওয়া হয় ;
অক্সিজেন-সহযোগ (oxyfuel) দহনে জ্বালানীকে দহন করা হয় অক্সিজেন-এ, বায়ু-তে নয় ।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে- নানা প্রক্রিয়া নিয়ে- কোনটা সবদিক বিবেচনা করে কার্যকারী হবে ; জানা দরকার বিভিন্ন ছিদ্রপথে কতটা কারবন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে চুঁইয়ে বেরোচ্ছে, অবশ্যই অতিরিক্ত খরচ একটা জানার বিষয় কারণ বিদ্যুতের মূল্য বাড়বে তা' নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন ।
সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন সরকার CCS-গবেষণার ও রূপায়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছেন, ২০১১-সাল পর্যন্ত তার পরিমাণ হবে আনুমানিক ২৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ।
উল্লেখ :
১. Steven Chu- U.S. Secretary of Energy and a Nobel Laureate in physics-Carbon Capture and Sequestration
২. Anglo-French Scientific Discussion Seminar,Organised by the Science and Technology,Department of the French Embassy in the UK and Imperial College London, 27 September, 2007
https://en.wikipedia.org/wiki/Carbon_capture_and_storage
জুলাই ০৬, ২০১৫
লেখক পরিচিতি - শিক্ষাবিদ। বি.ই. কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর। এক সময় পশ্চিম বঙ্গ সরকারের বিদ্যুৎমন্ত্রী ছিলেন। অবসর-এর যুক্ত প্রায় জন্মকাল থেকেই। অবসর-এর উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।